সকলের কল্পনার বাইরে
কিন্তু সকলের অগোচরে সকলের কল্পনার বাইরে প্রায় প্রত্যহ রাতে ভীষণ কিছুই ঘটে যাচ্ছে। রাগে আর মত্ত নেশায় তার কিছু আভাস কেবল নিতাই সেকরা পেয়েছে।
যেটুকু পেয়েছে ঘটছে তার থেকে ঢের বেশি।
দেড় মাস আগের সেই দুপুরে শ্রীনাথ পোন্দার ওই গান শুনে খেয়েদেয়ে চলে যাবার দিন সাতেক বাদে রাতের দিকে মনোহর পাইক খোশমেজাজে ঘরে ফিরেছে। মদও গিলে আসেনি। বলেছে, ছিনাথদা দারুণ খুশি তোর ওপর, আবার আমার ওপর তেমনি রাগ এমন সুন্দর বউটার অঙ্গে একটা গয়নার টুকরোও নেই কেন? আমি যত বলি রাধা গয়না পরতেই চায় না, শুনতেই চায় না। বলল, দেখি পরতে চায় কিনা, আমি পরাব। আজ বেস্পতিবার, এই রোববার তার বারুইপুরের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন, দিন কয়েক থেকে আনন্দ করে আসব।
রাধা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠেছে, তার লক্ষ্মীকান্তপুরের বাড়িতে নয় কেন-সেখানে তার বউ ছেলেমেয়ে আছে তাই আনন্দ করতে অসুবিধে হবে বলে?
মনোহর থমকেছে একটু। তারপরেই বিরক্ত।”তুই কি থেকে কি বুঝিস ঠিক নেই–আরে নিজের এলাকায় থাকলে দু’দও ফুরসত মেলে তার। দিন-রাত লোক আনা-গোনা ভ্যাজর ভ্যাজর লেগেই আছে, দুদিন ভালো করে বিশ্রাম নিতে হলেও ছিনাথদা ঘর ছেড়ে পালায়। বাজে রাগ করিসনি–এর মধ্যে আমি তোকে খান দুই ভালো শাড়ি আর জামাটামাও কিনে দেব।
এমনি একটা সময় আসছে রাধা জানতই, তবু রাগে ঘৃণায় বিবর্ণ। শুরুতেই প্রচণ্ড ঘা না বসালেই নয় বলে উঠল, আমি কোথাও যাবনি তুমি চুলোয় যাও, এত নিচ এত হীন তুমি?
মনোহরের মাথায় রক্ত ওঠার মতো এ-ই যথেষ্ট। এগিয়ে এলো। গলা টিপে ধরল। সজোরে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল। দম বন্ধ হয়ে রাধার দু’চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার উপক্রম–যাবি না? ছিনাথদা ডেকেছে আর তুই যাবি না? আমি তার খাই পরি, সে আমাকে রাজার হালে রেখেছে–দুদিনের জন্য আদর করে ডেকেছে আর তুই যাবি না? মাটিতে আছড়ে ফেলল। কিল চড় লাথি। রাধা নিস্তেজ। এতেই ঢিট হয়েছে ধরে নিয়ে মনোহর নিশ্চিন্ত। মদ নিয়ে দাওয়ায় বসার আগে ট্রাঙ্ক খুলে তাকে এক পাঁজা একশ টাকার নোট রাখতে দেখল রাধা। এত টাকা কোথা থেকে এসেছে কেন এসেছে বুঝতে এক মুহূর্ত সময় লাগল না।
পরদিন। রাধা রোজই সন্ধ্যার আগে রাতের রান্না সেরে রাখে। সন্ধ্যার পর কপালী বাবার ওখানে যায়। রাধা হেঁসেলে। খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। একটা বড় একটা ছোট মোড়ক হাতে হাসি হাসি মুখে মনোহর সেখানে এসে দাঁড়ালো। গত রাত থেকে এ পর্যন্ত এই প্রথম কথা।–কাল খামোখা এমন রাগিয়ে দিলি–ধর, দুখানা খুব সুন্দর শাড়ি এনেছি, জামা দুটোও দামী–তোর পছন্দ হবে।
রাধা ঘুরে তাকালো। উঠল। মোড়ক দুটো হাত থেকে নিল। হেঁসেলের জানালা দিয়ে ও দুটো জল-কাদার আঁস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়ে আবার উনুনের কাছে বসল।
একটু পরেই অস্ফুট আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হাতে নয়, চেলা-কাঠ তুলে এনে এক ঘায়ে পিঠের চামড়া দু ফাঁক করে দিয়েছে মনোহর। সেখানেই থামল না। চুলের মুঠি ধরে হিড়হিড় করে ওকে জল-কাদার উঠোনে ফেলে ঘুষি লাথি চড়। মুখে আঘাত করল না, জানে আঘাতে বিকৃত হলে শ্ৰনাথ পোদ্দারের চোখের রঙ ছুটে যাবে। মারতে মারতে নিজেই হাঁপিয়ে উঠল, কিন্তু ওর মুখ দিয়ে যাবে বলাতে পারল না। মারের সঙ্গে অশ্রাব্য সব কথা।–যাবি না? তিন ডাকাত তোকে খুবলে খেয়েছে, পেট হবার ভয়ে সাত তাড়াতাড়ি হাবড়া বোনাইয়ের সঙ্গে বে-তে বসেছিস, গান শেষ করেও বিন্দুবাসিনী আর রুমা সেনের বাড়ি থেকে বেরুতে তোর তিনপো ঘণ্টা এক ঘণ্টা দেরি হত কেন আমি বুঝি না–অতবড় বাড়ি থেকে এক তলায় নামলেই নিচিন্তি–ওই নিখিল রায় আর অজয় গুপ্তও তোক ছেড়েছে বলতে চাস? আমাকে নিয়ে সাত-সাতটা মরদকে ঠাঁই দিয়েছিল, তার ছিনাথদার বেলাতেই তুই মস্ত সতী হয়ে গেলি? আমার হিল্লে হয়ে যাবে সেটা কিছু নয়?
রাত্রিতে দাওয়ায় মদ নিয়ে বসেছে। রাধা ঘরে। বিলাসী খবর নিতে এসেছে রাধা পুজো করতে গেল না কেন। রাধা দেহটা দরকার সামনে হিঁচড়ে টেনে বলল, বাবাকেই পুজো করে নিতে বলা, শরীলটা ভালো না, বোলো কাল যাব
মদের নেশায় মনোহর তখন বসে থাকতে পারছিল না, তব চিৎকার আর গর্জন করে উঠেছে, খব-দার! ব-ই-লে দিস রা-আধা আল-কো-না-দিন যাবে নি–গেলে ওর আমি জা-আ-ন্ নেব।
বিলাসী ভয়ে পালিয়েছে।
পরদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করেও রাধাকে। যাবে বলতে চেষ্টা করেছে। না পেরে বিকেলের দিকে তাকেই লক্ষ্মীকান্তপুর ছুটতে হয়েছে। আগামী কাল অন্তত বউকে নিয়ে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে যেতে পারবে না বুঝতে পেরেছে। শ্ৰনাথ পোদ্দারকে যাহোক বলে বুঝ দিতে হবে।
অত মার খেয়েও সেই রাতে রাধা কপালী বার ডেরায় গেছে। জংলি কালীর পুজো করেছে। কি হয়েছে দশবার করে জিগ্যেস করেও কপালী বাবা জবাব পাননি। কেবল এক কথা, আমার মা কালীর সঙ্গে মামলা, জানতে চেও না।
রাতে ফিরে আবার মার। শ্রীনাথের কাছে ব্যঙ্গের চাবুক খেয়ে নিতাই সেকরার ডেরায় বসে প্রচুর মদ গিলে মনোহর ঘরে ফিরেছে। ওই চাবুক যে-কোনো সময় হিংস্র ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে মনোহর জানে। মত্ত অবস্থায় মারতে মারতে রাধাকে মাটিতে শুইয়ে ফেলেছে। সেই সঙ্গে গর্জন, কি দেখেছে ছিনাথদা তোর মধ্যে, তাই মেরে ফেলতি পারছি না, না হলে তোকে আমি খুন করে ভুয়ে পুঁতে ফেলতাম।
-দোতারবাবুর সঙ্গে ওসি অংশুমান ঘোষ এসে কপালী বাবার ডেরায় রাধার সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে এই এক মাসের মধ্যে মনোহর আরো তিনবার রাধাকে শ্ৰীনাথ পোদারের বারুইপুরের বাগানবাড়িতে নিয়ে যাবার দিন ঠিক করে তিনবারই ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিবারের নৃশংস মার রাধা মুখ বুজে সহ্য করেছে, তার সর্বাঙ্গ ক্ষত বিক্ষত, তবু তার মুখ দিয়ে মনোহর ‘যাবে’ কথাটা বার করতে পারেনি। ওই মার খেয়ে প্রত্যেক রাতেই রাধার বেদম জ্বর আসছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর মাথায় কাপড় দিয়ে শাড়িতে সর্বাঙ্গ ভালো করে ঢাকাটুকি দিয়ে জংলি কালীর পুজো করতে গেছে। সেখানে শাড়ি বদলাবার সময় বিলাসকেও কাছে থাকতে দেয়নি। মায়ের দাগ দেখলে আর্তনাদ কাব উঠবে মাঝে মাঝে পুজো শেষ করে আর ফিবতে পারে না ওই ঘরেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। কপালী বাবা বরাবরই দাওয়ায় শোন। বিলাসী দাওয়ার আর এক কোণে পড়ে থাকে। রাধা কবে ফিরল কবে ফিরল না মনোহর টেরও পায় না। বউকে বশে আনাব তাড়নায় তার নেশা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেছে, এমন নেশার জের কাটতে বেলা আটটা নটা বেজে যায়।
এবারে শেষ বারের মতো দিন ঠিক করে রাত আটটা নাগাদ মনোহর ঘরে ফিরেছে বিকেল থেকে আকাশ কালীবর্ণ, মেঘ গজরাচ্ছে, বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে। সন্ধ্যায় আরো বেড়েছে। বৃষ্টি একবার নেমে গেলে আর বেরুতে পারবে না, তাই রাধা সন্ধ্যায় গিয়ে খানিক আগে পুজো সেরে চলে এসেছে। ঘরের ঠাকুর দেবতার ছবিগুলোর সামনে বসেছিল। পিছন থেকে এসে মনোহর দু-হাতে চুলের মুঠি ধরে বসা থেকে রাধাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল, হিড হিড় করে চার-পাঁচ হাত তফাতে টেনে নিয়ে এলো।–খুব বেশি মদ খায়নি, টলছে না, নৃশংস মূর্তি।
হিসহিস করে বলল, এবারে তোর একদিন কি আমার একদিন, কাল তোকে নিয়ে যাব আমি ছিনাথদাকে শেষ কথা দিয়ে এসেছি, কাল ভোর-ভোর তোকে নিয়ে বারুইপুর যাব। আমি সঙ্গে থাকব, তবু তোকে নিয়ে যাবার জন্য ভোর রাতে ছিনাথ পোন্দারের তিনজন বাছাই করা লোক আসবে
কথার ফাঁকে বাধা দেখল তার বুক পকেটে এক থোক একশ টাকার নোট উঁচিয়ে আছে।
দেখছিস কি, ছিনাথদার সঙ্গে শেষ ফয়সল করে এসেছি, টাকাও নিয়ে এসেছি। সকালে তুই মুখ বুজে সুড়সুড় করে না গেলে যারা আসছে তারা রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। তারপর তারা তোর গায়ে হাত দেবে, আমিই সেই ব্যবস্থা করে এসেছি। সকালে ন। পারলে ওদের সাহায্যে রাতের আন্ধারে তোকে আমি নিয়ে যাই হলপ করে এসেছি, এবার তোর বাপের সাধ্যি নেই আমাকে ঠেকায়। -যাবি কি যাবি না?
রাধা চেয়ে আছে।
প্রচণ্ড চড়ে মাথা ঘুরে খাটের কাছে মাটিতে পড়ল। মনোহর আবার দু’হাতে চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলল।–যাবি কি যাবি না?
যাব যাব! যাব!
শেষের দুবার এত জোরে বলল যে হিংস্র মূর্তি মনোহরও থমকালো।
কিন্তু পরের মুহূর্তে রাখা নিজেই দিশেহারা। হ্যাঁ, নিজের কানে নিজের গলা স্পষ্ট শুনেছে! কিন্তু ও তো বলতে চায়নি! মেরে ফেললেও যাবে না এ সঙ্কল্প তো স্থিরই ছিল। তবু বলল কেন? কে বলো? কে? কে? কে? উদভ্রান্তের মতো রাধা ঘরের চারদিকে তাকাতে লাগল।
মনোহরের চোখে মুখে চাপা উল্লাস। মারে মারে সব ধৈর্য আর গো নিঃশেষ ভেবেছে। দাতে দাঁত চেপে বলল, কথার আর নড়চড় যেন না হয়, রাতে আমার সুটকেসে কিছু শাড়ি জামা গোছগাছ করে রাখবি, লোক তিনটে রাত থাকতে আসবে, আমার ঘুম না ভাঙলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলে দিবি। উঠোনের দরজা খোলাই থাক
ঘোরালো ধারালো দু’চোখ একবার মুখের ওপর বুলিয়ে নিয়ে আলনার কাছে চলে গেল। ওটার পিছনে মাটির দেয়াল-তাতে রমজত থাকে, আস্ত বড় একটা মদের বোতল বার করে ওটা খুলে কাঁচাই গলায় ঢালল খানিকটা। বোতল নিয়ে হেঁসেলের দিকে গেল। পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে কি খেল সে-ই জানে। বোতল গেলাস আর জলের ঘটি নিয়ে দাওয়ায় বসল। দেড় মাস ধরে তার স্নায়ুব ওপর দিয়েও কম ধকল যায়নি। আজ সব ধুয়ে মুছে যাবে।
রাধার তখনো দিশেহারা মূর্তি। না, সে যাবে কক্ষনো বলতে চায়নি, কক্ষনো না! কিন্তু নিজের কানে নিজের গলা শুনছে। কে-কে বলালো তাকে দিয়ে!
ঘণ্টা দেড়েক হবে হয়তো। মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তেমনি ঝড়ো বাতাস। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, থেকে থেকে বজ্রপাত হচ্ছে।
ঘরে রাধা স্থাণুর মতো বসে। বিড়বিড় করে বলেই চলছে, কে বলালে–কে বলে
দাওয়ায় মনোহর পাইক বেহুশ ঘুমে। এত খেয়েছে যে মুখ দিয়ে গাঁজা বেরুচ্ছে। জল ঝড়ের তাণ্ডবে তার নাসিকা গর্জন শোনা যাচ্ছে না। খালি বোতলটা বাতাসে হোক বা পায়ের ধাক্কায় হোক, দাওয়ায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘটিটাও এক কোণে উপুড় হয়ে আছে।
-কে? কে বলালে? কে বলালে?
আরো আধঘণ্টা বাদে রাধা উঠল। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। লোকটা মরার মত পড়ে আছে। যত ঝড়-জলই হোক, সমস্ত রাত এভাবেই কাটবে। ঘর থেকে লণ্ঠনটা এনে দরজায় দাঁড়িয়েই মুখের কাছে ধরল। রাধা শিউরে উঠল। বীভৎস। এমন বীভৎস আর কখনো মনে হয়নি। রাধা লণ্ঠনটা আবার জায়গায় রাখল। শাড়িটা গাছকোমর করে শক্ত করে এটে নিল। ঘর থেকে বেরিয়ে দাওয়ার এ মাথায় এসে উঠোনে নামল। মুষল বৃষ্টি গায়ে ছুচের মতো বিধতে থাকল। পেছনের চালাঘরের পাশ দিয়ে পুকুর ধারে এলো। জংলা পথ ধরে অন্ধকার দুর্যোগে কপালী বাবার ডেরার দিকে চলল। খালি পা পিছলে পিছলে যাচ্ছে, এটা ওটা পায়ে ফুটছে, ঝড়ের ঝাপটায় টাল খেয়ে পড়ছে, রাধার ভ্রূক্ষেপ নেই।
পৌঁছুল। দাওয়ার এক কোণে বিলাসী কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছ। মাঝে মাঝে অনেক রাত পর্যন্ত কপালী বাবা মায়ের ধ্যানে বসেন। মন অস্থির হলে বেশি বসেন। কদিন ধরেই মন খুব অস্থির। আজও বসেছেন।
বাবা!
কপালী বাবা বিষম চমকে ফিরলেন। আসন ছেড়ে দ্রুত কাছে এলেন। –এত ঝড়ে জলে তুই! এ, ভিজে যে শেষ হয়ে গেছিস। এত রাতে–
কথা থেমে গেল। মুখের দিকে চেয়ে বিমূঢ়। রাধার দুচোখ ধক ধ করে অলছে। এই মূর্তি এমন এলন্ত চোখ কপালী বাবা আর দেখেননি।
দাওয়া থেকেই কালীর দিকে খানিক ওই চোখের আগুন ঠিকরলো। বিড়বিড় করে রাধা বলল, আজ মামলার শেষ রাত, আমার জামা-কাপড় এনে দাও, ভিজে কাপড়ে ঢুকব না।
কপালী বাবা হন্তদন্ত হয়ে ভিতরে গিয়ে ওর কাপড় জামা গামছা এনে দিলেন। তারপর ঘরের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালেন।
মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে ভেজা শাড়ি জামা বদলে রাধা ভিতরে এলো। ভিজে চুলের বোঝা পিঠ ছড়ানো। মায়ের মূর্তির খুব কাছে এসে চেয়ে রইল খানিক। তেমনি আগুনের গোলার মতো চোখ।
মেঝেতেই বসল। দু’চোখ মায়ের মুখের পর অপলক।
কপালী বাবা দাওয়ায় চলে এলেন। চারদিকে গাছ-গাছালির দরুন জলের ছ’টি আসে না। বাতাসের তাণ্ডবে ওগুলোর শ-শ। আর্তনাদ। রাধার ভেজা জামাকাপড় গামছা মেঝেতে পড়ে আছে। একে একে তুলে নিঙড়ে, টাঙানো দড়িতে ঝুলিয়ে দিলেন।
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন।-মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রাধা অস্ফুট স্বরে বলছে, কেন বললি? কেন বললি?
খানিক পায়চারি করে আবার এসে দাঁড়ালেন।
-কেন বললি? কেন বললি?
অনেকক্ষণ বাদে পা টিপে ঘরে এসে দাঁড়ালেন। শব্দ না করে চাটাইটা কোণ থেকে তুলে নিয়ে আবার বাইরে এলেন।
-কেন ব্লালি? কেন বলালি?
কপালী বাবা দাওয়ায় চাটাইটা পেতে বসলেন। চোখ বুজে তিনিও ধ্যানে বসতে চেষ্টা করলেন। অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন, কিন্তু ধ্যানে মন বসলই না। চোখ তাকিয়ে ঝুঁকে ঘরের ভিতরে তাকালেন। রাধা মেঝেতে ওপাশ ফিরে মায়ের পায়ের সামনে ঘুমোচ্ছ। কপালী বাবা আস্তে আস্তে উঠলেন। হাতঘড়ি দেখলেন। রাত বারোটার কাছাকাছি। ঝড়ো বাতাস কমেছে কিন্তু প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। পায়ে পায়ে রাখার কাছে এসে দাঁড়ালেন। যে বাহ কোমরের ওপর তাতে বীভৎস দাগরা দাগর দাগ। চামড়া ফেটে গেছে। ঘাড়ের পাশেও আঘাতের চিহ্ন। নিল আক্রোশে কপাল। বাবা ফুঁসছেন। পিঠের অবস্থা দেখতে পেলে কি করতেন কে জানে!
এই রাতে এমনিতে আর ঘুম আসবে না। দেয়ালের খোপ থেকে ছোট বোতলটা আর নিঃশব্দে এক গেলাস জল গড়য়ে নিয়ে আবার বাইরে এসে বসলেন।
.
ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভাঙলো। বিলাসী ঠেলছে। দাওয়ার সামনে দুজন লোক দাঁড়িয়ে, তাদের চোখ খুব স্বাভাবিক নয়। উঠে চোখ মুছতে মুছতে কপালী বাবা ঘড়ি দেখলেন। সকাল সাতটা বাজে। বৃষ্টি পড়ছে না, কিন্তু আকাশ মেঘলা বলেই মনে হচ্ছে খুব সকাল।
লোক দুটো উত্তেজিত মুখে যে-খবর শোনালো, কপালী বাবার সর্ব শরীর নিস্পন্দ, স্থির একেবারে।-সকালে জংলা পথে পাড়ার দুজন লাক হাটমুখে যাচ্ছিল রাধার ঘরের পিছনের পুকুরে একটা লাশ চাখে পড়তে চিৎকার করে লোকজন ডেকেছে। লাশের চারভাগের তিন ভাগ পুকুরে কাদাজলে, বুক থেকে মাথা পর্যন্ত কেবল দেখা যাচ্ছে। ঘাড় কাত করা, তাই দেখেই চিনতে পারেনি, তাছাড়া মুখ জল-কাদায় ভরা। সাহস করে দেহকেউ ছোঁয়নি, কিন্তু লোকজন এসে ভালো করে দেখেই চিনেছে লোকটা কে। মনোহর পাইক। তার ঘাড় দুটো আর কানের নিচে একটা আঘাতের চিহ্ন-ভারি ধারালো কিছু দিয়ে খুন করা হয়েছে। অত বৃষ্টি সত্ত্বেও গায়ের জামার ওপরের দিক রক্তে লাল। …দুজন লোক সাইকেল নিয়ে থানায় খবর দিতে গেছে, আর রাধার ঘরে রাধাকে না পেয়ে এই দুজন এখানে এসেছে। রাখার উঠোনে ছোট একটা কুড়ুল পড়ে ছিল।
খানিক স্তব্ধ হয়ে থেকে কপালী বাবা বুকে ঘরের ভিতরে তাকালেন। রাধা অসাড়ে ঘুমোচ্ছে। কপালী বাবা উঠে ঘরে এলেন। তপতপে মুখের দিকে তাকিয়ে কি-রকম খটকা লাগল। কপালে হাত দিয়েই চমকে উঠলেন, তাঁর হাতে যেন তপ্ত ঘেঁকা লাগল। ঘুমে নয়, জ্বরে বেহুঁশ।
বিলাসীকে কপালে জলপটি দিতে বলে কপালী বাবা লোক দুটোর সঙ্গে রাধার ঘরের দিকে চললেন। অনেকেই সেদিকে ছুটছে। খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে।
রাধার স্বামী মনোহর পাইক খুন হয়েছে আর রাধাও ঘরে নেই শোনামাত্র দুজন সাব-ইন্সপেক্টর আর জনাকয়েক কনস্টেবল নিয়ে অংশুমান ভ্যানে করে বেরিয়ে পড়লেন। বাড়ি থেকে ডাক্তার বিজন চৌধুরীকেও তুলে নিলেন, তিনি মৃত ঘোষণা করলে বডি সন্নানো হবে।
জিপ থেকে নেমে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে সদলে সোজা পিছনের পুকুর ধারে এলেন। সেখানে তখন বহু লোক। তাদের ধমকে সরিয়ে পথ করতে হল। কি অবস্থায় লাশ পড়েছিল আগেই শুনেছেন। অংশুমান দেখলেন একটু। ডাক্তারকে ইশারা করতে তিনি দু মিনিটের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কর্তব্য সারলেন। বডি জলকাদা থেকে টেনে তোলা হল। জলে ধুয়ে ক্ষত তিনটে আর একবার ভালো করে পরীক্ষা করা হল। মনোহরের পরনে ফুলপ্যান্ট, গায়ে টেকিটের জামা। বুক পকেট উঁচু মনে হতে অংশুমান হাত ঢুকিয়ে জলে চুপসানো একতাড়া একশ টাকার নোট বার করলেন। এত ভেজা নোট গোনা সম্ভব নয়, তবু হাজার আড়াই তিন হতে পারে। তাহলে যে বা যারা ওকে খুন করেছে, টাকার লোভে করেনি।
ভিড়ের একদিক থেকে কপালী বাবা এগিয়ে এলেন।–পুলিশ সাহেব ওই নিতাই বলছে কাল সন্ধ্যায় মনোহরের পকেটে সে ওই নোটের পাঁজা দেখেছিল।
অংশুমান তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকে তাকালেন।–রাধা কোথায়?
আমার ঘরে।
-আপনার ঘরে কখন থেকে?
রাত তখন সাড়ে দশটা হবে, প্রচণ্ড জলঝড় হচ্ছিল।
–সমস্ত রাত সে আপনার ওখানেই ছিল।
-হ্যাঁ, সকালে এই খবরটা শুনে ওকে তুলতে গিয়ে দেখি জ্বরে বেহুশ।
অংশুমান ডাক্তারের দিকে তাকালেন একবার। তারপর এদিক ফিরে আবার জিগ্যেস করলেন, রাধা এর আগে আর কখনো রাতে আপনার ওখানে থেকেছে?
ইদানিং মাঝে মাঝে থাকত.. ওর ওপর অত্যাচারের মাত্রা খুব বেশি মাত্রায় বেড়ে গেছল মনে হয়।
–ঠিক আছে, নিতাইকে অপেক্ষা করতে বলুন, আপনিও থাকুন।
মনোহরের দেহ কন্স্টেবলরা ধরাধরি করে তুলে এনে ঘরের সামনের দাওয়ায় শুইয়ে দিল। অংশুমান সাব-ইন্সপেক্টর দুজনকে নিয়ে রাধার ঘর রান্নাঘর, পিছনের চালাঘর দেখলেন। রান্না জিনিসের সবই প্রায় পড়ে আছে, চালাঘরে দুচাকা লাগানো একটা ঠেলা শুধু পড়ে আছে। চেলা-কাঠের স্তূপ দাওয়ার ও-পাশে, সেখানে আর কোনো কুড়ুল নেই। কুড়ুল দাওয়ার সামনে উঠোনে পড়ে আছে। দাওয়ার ওপর শূন্য মদের বোতল আর ঘটি।
উঠোনে বা দাওয়ায় কোথাও রক্তের চিহ্ন নেই। উঠোনে টেনে এনে খুন করা হয়ে থাকলে রাতের অত বৃষ্টিতে চিহ্ন থাকার কথাও নয়।
নিতাই সেকরার ডাক পড়ল। উত্তেজনার মাথায় বাবাকে ওই টাকার কথা বলে ফেলে সে এখন জেরার ভয়ে চুপসে আছে। অংশুমানের সামনে এসে জোড় হাতে নমস্কার ঠুকল।
-মনোহরের পকেটে কাল তুমি টাকা দেখেছ না সে তোমাকে দেখিয়েছে?
–টাকা সে বরাবর বুকের পকেটে রাখত হুজুর, ওই পালা জামার ওপর দিয়েই টাকা দেখা যেত–
-ও কিসের টাকা মনে হয় তোমার?
-জানি না হুজুর, ও ছিনাথ পোন্দারের অনেক কম কাজ করত, মোটা মোটা টাকাও পেত।
–সে কাল কখন তোমার ওখানে গেছল?
–সাঁঝের মুখে।
–কতক্ষণ ছিল?
–এক ঘণ্টাটাক হবে।
-কেন গেছল?
ইতস্তত করতে লাগল।
-কেন গেছল? কঠিন গলা।
–আজ্ঞে হুজুর আমাকে দোস্ত ভাবত, গলা ভেজাতে মাঝে মাঝে আসত।
একটি বাজে কথা বলবে না, তোমার সঙ্গে কি কথা হয়েছে সব ঠিক ঠিক বলো।
-আজ্ঞে হুজুর, বলেছেল ছিনাথ পোদ্দারের কাছ থেকে আসছে, রাধা তিন-চার বার তার নেমন্তন্ন বরবাদ করেছে বলে মনোহরের মেজ খুব বিগড়েছেল, বলেছেল, এবার ওর লাশ গেলেও যাবে– ছিনাথদার বাছাই করা তিনজন লোক ভোর রাতে ওদের নেতে আসবে, তখনো যদি রাধা বাদ সাধে তাহলে অন্য ব্যবস্থা হবে।
এসব কথা সে তোমাকে বলতে গেল কেন?
নিতাই সেকরা থতমত খেল একটু।– আজ্ঞে হুজুর ও জিনিস পেটে পড়লেই ও গলগল করে কথা বলত–আর একটু চেষ্টা করলেই ওর ভেতর থেকে সব কথা টানি বার করা যেত।
–তাহলে তুমি বলতে চাও, ভোর রাতে যাদের আসার কথা ছিল রাধাকে ঘরে না পেয়ে তারাই মনোহরকে খুন করে পুকুর ধারে ফেলে রেখে গেছে।
নিতাই আবার দু’হাত জোড় করে ফেলল, আমি কিছু বলতে চাই না হুজুর–কিছুটি না।
সেখান থেকে ভ্যানে কপালী বাবার ডেরায় চললেন। কপালী বাবাকেও তুলে নেওয়া হয়েছে। অংশুমান তাঁকে কেবল জিগ্যেস করলেন, রাধা তাহলে এখন পর্যন্ত কিছু জানে না?
বিলাসীকে ওর কাছে রেখে এসেছি, সে শুনেছে–এতক্ষণে বলেছে কিনা জানি না।
অংশুমান ভাবছেন, কোনো একজনের পক্ষে এতবড় মানুষটাকে খুন করে পুকুর ধারে টেনে এনে ফেলা সম্ভব নয়। একাধিক লোকই ছিল। অত ঝড় জলের দরুন জুগে বা পায়ের ছাপ ধুয়ে গেছে।
একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে কুড়ুলটা আনতে বলে সঙ্গে ডাক্তার চৌধুরীকে নিয়ে অংশুমান কপালী বাবার ডেরায় এলেন। বাবাও সঙ্গে। রাধা তখনো জ্বর-ঘুমে আচ্ছন্ন। বিলাসী তখনো জলপটি লাগিয়ে হাত-পাখা দিয়ে মাথায় বাস করছে। লোকজনের সঙ্গে বাবাকে দেখে ও পাখা হাতে নিয়েই ছুটে এলো।মেয়েটাকে মেরে মেরে আধমরা করেছে গো বাবা, দুই হাতে আর ঘাড়ে কোমরে মারের দাগ দেখে সন্দ হতে আমি বেলাউস টানি তুলি পিঠ দেখলাম, দেখে যাও কি অবস্তা।
পায়ের জুতো খুলে সকলে ঘরে ঢুকলেন। রাধা ওপাশ ফিরে অচেতনের মতো শোয়। বিলাসী প্রথম একদিকের বাহুর আর ঘাড়ের দাগ দেখালো। তারপর সন্তর্পণে ঢিলে ব্লাউসটা অনেকটাই টেনে তুলে পিঠ দেখালো। বিজন ডাক্তার আঁতকে উঠলেন, সর্বনাশ এতে টিটেনাস হয়ে যেতে পারে।
কপালী বাবা রাগের চোটে হুংকার দিয়ে উঠলেন, মনোহরের এ দশা যে করেছে আমি তাকে আশীর্বাদ করছি–আশীর্বাদ করছি।
অংশুমান চাপা ধমক লাগালেন, থামুন।
অস্ফুট একটু যন্ত্রণার শব্দ করে না আস্তে আস্তে চিত হয়ে শুলো। কিছু অনুভব করল কিনা সে-ই জানে। চোখ মেলে তাকালো। রক্তবর্ণ চোখ, কিন্তু ঘরের মোক দেখে ফ্যালফেলে চাউনি। নিজের গোয় বুকের কাপড় টেনে নিল। আস্তে আস্তে উঠে বসে শাড়ির আঁচলটা পিঠ বেড়িয়ে জড়িয়ে নিল।
বিজন ডাক্তার এগিয়ে এসে কপালে হাত দিয়েই ভুরু কোচ কালেন। ব্যাগ খুলে থার্মোমিটার লাগিয়ে মুখে দিলেন। রাখা সকলকে দেখছে, তখনো আত্মস্থ নয়। থার্মোমিটার মুখেই মুখ উঁচিয়ে একবার জংলি কালীকে দেখে নিল। ও কোথায় এতক্ষণে স্পষ্ট হল যেন।
জ্বর মুখে একশ পাঁচের কাছে। ডাক্তার পরীক্ষা শেষ করে ব্যাগ খুলে তখনকার মতো দুটো বড়ি শুধু খাওয়াতে পারলেন। একটা প্রেসকৃপশন লিখে বাবার হাতে দিয়ে বললেন, এ ওষুধগুলো আনিয়ে এই-এইভাবে খাওয়াতে থাকুন, আমি বিকেলে এসে আবার দেখে যাব এখন নাড়াচড়া চলবে না।
রাধা স্থির চোখে সকলকে দেখছে। বলল, অমন জ্বর প্রায় রোজই হতেছে, ভেনিতোমরা এখেনে কেন? লাল দুচোখ বড়বাবুর মুখের ওপর ঘুরল।
রাধার শরীরের অবস্থা দেখতেই পাচ্ছেন অংশুমান, তবু সুযোগ পেলে পুলিশের কর্তব্য আগে। জিগ্যেস করলেন, তুই অত রাতে ঝড় জল মাথায় করে এখেনে এসেছিলি কেন?
চোখে চোখ রেখে রাধা জবাব দিল, মা-কে শেষ দেখা দেখি যেতে এয়েছিলাম।
শেষ দেখা কেন?
তেমনি চেয়ে থেকে রাখা থেমে থেমে জবাব দিল, খুব ভোর ভোর ছিনাথ পোদ্দারের তিনজন লোক আসি আমাকে তার বারুইপুর বাগানবাড়িতে নে যাবার কথা ছেল, সেখেন থেকে ফিরে আর মায়ের মুখ দেখা হত না
বক্তব্য বুঝলেন অংশুমান।–তিনজন লোক আসার কথা ছিল কেন, মনোহরই তো নিয়ে যেতে পারত।
এবারে না গেলে তারা আমাকে রাতের অন্ধকারে মুখ বাঁধি নে যেত।
–তার মানে মনোহর আগেও তোকে অনেকবার নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে?
দেড় মাস ধরে
এবারে তুই যেতে রাজি হয়েছিলি?
–হাঁ, যাব বলেছিলাম।
–অমন ঝড় জলে তোকে বেরুতে দেখে মনোহর কিছু বলেনি?
-সে তখন এক বোতল মদ খেয়ে দাওয়ায় বেহুশ হয়ে পড়েছিল, ধাক্কা মেরে বিষ্টির মধ্যে উঠোনে ফেলে দিলেও ঘুম ভাঙত না।
অংশুমান ঘুরে সাব-ইন্সপেক্টরকে ইশারা করতে সে কুড়ুল হাতে সামনে এগিয়ে এলো। ওটা নিয়ে অংশুমান সামনে ধরলেন।এটা তোদের কুড়ুল?
রাধা দেখল। আস্তে আস্তে তার মেরুদণ্ড সোজা হল। তারপর কেবল মাথা নাড়ল। তাদেরই।
-এটা কোথায় থাকে?
–চেলা-কাঠের ঢিপির ওপর।
দোতারাবাবুর মুখে যে-কারণে যে অত্যাচারের কথা শুনেছিলেন অংশুমান, তা মিলছে। আর নিতাই সেকরার আজকের কথাও মিলছে, শ্ৰনাথ পোদ্দারের তিনজন লোক এসে রাধাকে নিতে আসার কথা ছিল, মনোহর একা নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি।
এবারে যা ঘটেছে অংশুমান আস্তে আস্তে রাধাকে বললেন। রাধা শোনার আগেও যেমন পরেও তেমনি। অত জ্বরের জন্য নয়, ওর সবেতে এই অবিচলিত ভাব দেখে অভ্যস্ত। তাঁর মুখের ওপর সোজা চোখ রেখেই শুনল।
অংশুমানের এবার ফেরার তাড়া। সামনে এখন গুরুতর কাজ। আর আসবেন বলে উঠলেন, দুপা এগিয়েও ফিরলেন। কপালী বাবাকে জিগ্যেস করলেন, দাওয়ার দড়িতে ভেজা শাড়ি জাম-টামা দেখছি–রাধার?
কপালী বাবা মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জবাব দিলেন, মায়ের পুজো আজকাল বাধাই করে বলে ওর একপ্রস্থ ধোয়া জামা-কাপড় মায়ের ঘরেই থাকে। কাল রাতে ভিজে চুপসে আসতে এগুলো ছেড়ে ওগুলো। পরেছিল।
রাধার ওখানে দুজন কনস্টেবলকে প্রহরায় রেখে অংশুমান থানায় ফিরলেন। বারুইপুর থানার ও. সির সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিলেন। তারপর প্রথমে মনোহরের বডি আনার ব্যবস্থা করে নিজে কিছু লোক নিয়ে ভ্যানে বারুইপুর ছুটলেন। আর ক’জনকে নির্দেশ দিয়ে সমীকান্তপুরে পাঠালেন।
ভ্যানে বারুইপুর খুব দুরের পথ নয়। লোকজনকে জিগ্যেস করে শ্রীনাথ পোন্দারের বাগানবাড়ির হদিস পেতে সময় লাগল না। বারুইপুর থানার ওসি সদলে আগেই পৌঁছে গেছে। উঁচু পাঁচিল ঘেরা অনেক জমি আর গাছপালার মাঝে বাগানবাড়ি। খুব কাছা কাছির মধ্যে আর কোনো ঘরবাড়ি নেই।
সামনের মস্ত গেট দুটো হাঁ-করা খোলা। অংশুমান দল-বল সমেত ভ্যান নিয়ে ঢুকলেন। নেমে ডাকাডাকি করতেও বাড়ি থেকে কেউ সাড়া দিল না। মস্ত একতলা দালান, সারি সারি অনেক ঘর। একটা ঘরের কেবল সামনের দরজা খোলা। সদলে ঢুকলেন। আবার হাঁকডাক করলেন। কিন্তু বাড়িতে জনপ্রাণী আছে বলে মনে হল না। এর ওঘর করে যে-ঘরে এলেন, দেখেই বোঝা গেল মালিকের বিলাস কক্ষ। মস্ত জোড়া খাট পাতা, কাঁচের আলমারিতে সারি সারি বিলিতি মদের বোতল। টেবিলের ওপরেও আধ-খাওয়া মদের বোতল, মদের গেলাস, খাবারের প্যাকেট। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘরের চারদিক আগে দেখে নিহিলেন অRমান, জোড়া পালনের দিকে চোখ পড়তে রঙিন বেডকভারটা কেমন এলোমেলো মনে হল, বাচ্চা ছেলেরা ধস্তাধস্তি করলে যেমন হয়।
এগিয়ে এলেন। তারপরেই চক্ষু স্থির। রঙিন বেড কভারে চাপচাপ রক্ত। ভালো করে নজর করে দেখেন গোলাপী কার্পেটেরও জায়গায় জায়গায় রক্তে ভেজা। ,
অংশুমান পকেট থেকে রিভলভার বার করলেন, সঙ্গের দুজনও। কনস্টেবলদেরও অস্ত্র তাদের হাতে। একসঙ্গে এঘর ওঘর খোঁজ হতে লাগল। কোনো ঘরে কেউ নেই। পিছনের দিকের একটা ছোট মতো ঘরের শেকল তোলা। শিকল নামিয়ে দরজা খুলতেই মনে হল চাকর বাকরের ঘর হবে। পরের মুহূর্তে আবার চক্ষু কপালে সকলের।
খাটিয়ার ওধারে মেঝের ওপর একটা নয়, দু-দুটো গুলিবিদ্ধ দেহ।
তাদের একজন নিঃসন্দেহে শ্রীনাথ পোদ্দার। তার কপালে আর গলায় গুলি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় জোয়ান গোছের লোকটা অচেনা। সে যুঝেছিল কিনা বলা যায় না, তার দেহে অনেকগুলো গুলির চিহ্ন।
–শ্রীনাথ পোদ্দারের রক্তে ভেজা জামার পকেটে একটা কাগজ উঁচিয়ে আছে। অংশুমান সন্তর্পণে সেটা টেনে নিয়ে ভাঁজ খুললেন।
অস্ত্রের বিশেষ রকমের ছাপ দেওয়া এক বিশেষ রকমের নক্সা কাটা কাগজ। এই ছাপ এই নক্সা খুব ভালোই চেনেন অংশুমান। নকশালদের এক বিশেষ গোষ্ঠীর খতমের চিহ্ন এটা। এই কাগজ পাঠিয়ে তারা হুমকি দেয়, আবার খতমের পর এই চিহ্ন রেখে গিয়ে তারা তাদের জয় ঘোষণা করে।
বাগান বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর কিছুই চোখে পড়ল না। কোনো গাড়ি বা চাকার দাগের চিহ্নমাত্র নেই।
চারজন সশস্ত্র লোককে প্রহরায় রেখে অংশুমান অন্যদের নিয়ে সেখান থেকেই লক্ষ্মীকান্তপুরের দিকে ছুটলেন।
ভেবে চলেছেন। চেষ্টা করেও ঘটনা মেলাতে পারছেন না।…গাড়ি বা চাকার দাগ নেই যখন প্রবল ঝড়-জলের মধ্যেই ব্যাপারটা ঘটেছে। অবশ্য চাকার দাগ আছে কিনা জল শুকোলে বোবা যেতে পারে, গেট থেকে বাড়ির সিঁড়ি পর্যন্ত এখনো জলে জলাকার।… মত ঝড় জলে অনেক কাছ থেকেও কারো গুলির শব্দ শুনতে পাবার কথা নয়। কিন্তু বাকি তিনটে লোক যাদের ভোর-ভোর রাধাকে নিতে আসার কথা ছিল, তারা গেল কোথায়? হতে পারে তাদের লক্ষ্মীকান্তপুর থেকেই আসার কথা ছিল। তাহলে ধরে নিতে হয় শ্রীনাথ পোন্দার কেবল একজনকে নিয়েই রাতে ওই বাগানবাড়িতে ছিল। কিন্তু অত চতুর আর সাবধানী লোকটার এত সাহস হবার কথা নয়।…অথচ বড়সড় মাত্র দুটোই খাবার প্যাকেট ছিল, আরো তিনজনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। টেবিলে মদের গেলাসও দুটোই ছিল।
শ্রীনাথ পোদ্দারের খুব বিশ্বস্ত চেলার সংখ্যা ষাট জনের ওপর। অংশুমান আগে যাদের পাঠিয়েছিলেন তারা জেরা করেও হদিস পায়নি কোন্ তিনজনের ভোর রাতে মনোহর পাইকের কাছে আসার কথা ছিল। এখান থেকে বেরুবার সময় সঙ্গে কারা ছিল সেই জেরা করতে গিয়ে তারা শুনেছে, শ্রীনাথ পোন্দার এখন কলকাতায়, যাবার সময় তার অন্তরঙ্গ বন্ধু তার সর্বদার সঙ্গী সূর্যকান্ত হালদার ছিল, তিনজন বডিগার্ড ছিল আর মনোহর পাইক ছিল। সকাল দশটা নাগাত তিনি নিজের বড় গাড়িতে সকলকে নিয়ে কলকাতা রওনা হয়েছেন। হ্যাঁ, তাঁর ড্রাইভার মুকুন্দই গাড়ি চালাচ্ছিল। শ্ৰনাথ পোদ্দারের ওমুক বন্ধুর বাড়িতে ছেড়ে দিয়ে কেবল সূর্যকান্ত ছাড়া আর সকলে বিকেলের মধ্যে লক্ষ্মীকান্তপুরে ফিরে এসেছে। কলকাতাতেই তাঁর তিন চার দিন থাকার কথা। হ্যাঁ, ওই গাড়িতে তাদের সঙ্গেই মনোহর পাইকও ছিল, সে জয়নগরে নেমে গেছল, তার সঙ্গে শ্রীনাথ পোদারের কি কথা হয়েছে তারা জানে না।
অংশুমানের আরো জোরালো জেরার ফলও একই। আধ-বুড়ো মুকুন্দ ড্রাইভার বার বার দিব্য কেটে বলল, এই-এই কজন আর মনোহর পাইককে নিয়ে সে বিকেলের মধ্যে ফিরে এসেছে। তার জেরায় জানা গেল, সূর্যকান্ত হালদার সুপটু ড্রাইভার, অনেক সময়েই শ্রীনাথ পোদ্দার ড্রাইভারকে না নিয়ে তাকে নিতেন।
বলা বাহুল্য বাগানবাড়িতে নিহত দ্বিতীয় মানুষটার সঙ্গে সূর্যকান্ত হালদারের চেহারার বর্ণনা নিঃসংশয়ে মিলছে।
এরপর সেই দিনই অংশুমান কলকাতায় ছুটেছেন। কলকাতার শ্ৰনাথ পোদ্দারের সেই বন্ধুর বাড়িতে হানা দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, শ্রীনাথ তার গাড়িটা সেই দিনের মতো ধার নিয়ে গতকাল বিকেলের মধ্যেই চলে গেছে। না ড্রাইভার নেয়নি, তার সঙ্গী সূর্যকান্ত এক্স পার্ট ড্রাইভার। কথা ছিল সূর্যকান্ত আজ বিকেলের মধ্যেই গাড়িটা ফেরত দিয়ে যাবে। এতক্ষণে গাড়িটা ফিরে আসা উচিত ছিল।…ঘটনা শুনে ভদ্রলোক হতবাক।
এবারে অংশুমানের হিসেবের অনেকটাই মিলছে। …এটাই ঐনাথের বড় চাল ছিল। অহের গাড়িতে সূর্যকান্তকে নিয়ে সে সন্ধ্যার অন্ধকারে বারুইপুরের বাগানবাড়িতে আসবে। কেউ জানবে না কেউ সন্দেহ করবে না। পরদিন সকালে বা রাতে মনোহর আর তার তিনজন লোক রাধাকে নিয়ে আসবে। সাফ প্ল্যান।…লক্ষ্মী কান্তপুরের ওই চেলাদের মধ্যেই তারা তিনজন ছিল, রাধাকে না পেয়ে তারা মনোহরকে ওভাবে খুন করে গেছে। তারা কারা, অংশুমানের তা নিয়ে আর খুব মাথা ব্যথা নেই। কারণ ওই একটা, একটা কেন শ্ৰীনাথ পোদ্দারের মৃত্যুর জন্যও তার মনে কোনো আক্ষেপ নেই। তিনি কেবল আনুষ্ঠানিক কর্তব্য করে গেছেন। শ্রীনাথ পোদ্দারের বন্ধুর গাড়ির হদিস আজও মেলেনি।
কেস মোটামুটি ধামাচাপা। অংশুমান তার বদলি আর প্রমো শনের জন্য আবার জোর তদবি শুরু করেছেন। আট-আটটা বছর হতে চলল, একই জায়গায় একই পোস্টে পড়ে আছেন।
বড় কর্তাদের কাছে আশ্বাস পেয়েছেন, শিগগীরই তাঁর সম্পর্কে সুবিবেচনা করা হবে।
*
মাস দুই পরে এক সন্ধ্যায় রাধার মূর্তি দেখে অংশুমান তাঁর স্ত্রী সুচারু দেবী হতভম্ব। মাতন থেকে থানা পর্যন্ত আড়াই মাইল পথ হেঁটে এসেছে। সাদা-মাটা বেশবাস পরিচ্ছন্ন নয়, আধ ময়লা শাড়ি, আঁচল মাটিতে লুটোচ্ছে, মাথায় তেল চিরুনি না পড়ে এক পিঠ চুলে জট বেঁধে গেছে। এযেন সেই ঢলঢলে মিষ্টি মুখ কালো মেয়েটাই নয়। অনেক অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করার পরেও রাধার এমন মূর্তি দেখেননি অংশুমান। চোখে মুখে অব্যক্ত যন্ত্রণার ছাপ, ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখ দুটো অস্বাভাবিক ঝকঝক করছে।
সুচারু দেবী তাড়াতাড়ি তাকে ঘরে এনে বসালেন।–কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে?
রাধার উদ্ভ্রান্ত চাউনি অংশুমানের মুখের ওপর। ঠোঁট দুটো আরো বেশি কাঁপছে। জবাব দিল, বড়বাবু দয়া না করলে আরো খারাপ দেখবে, রাধার শেষ দেখবে।
অংশুমান কাছে এগিয়ে এলেন, এসব কি বলছিস তুই, কি হয়েছে?
বসা থেকে উঠে রাধা মাটিতে আছাড় খেয়ে তার দু-পা আঁকড়ে ধরল, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বড়বাবু, এক তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
পা ছাড়িয়ে দু’হাতে ওকে টেনে তুললেন। সুচারু দেৰী আবার ওকে ধরে জোর করে বসালেন। অংশুমানও অধীর, কি হয়েছে বলবি তো?
-মা আমার গান কেড়ে নেছে, তাকে ডাকতে পারি না, পুজো করতি পারি না, তার নাম শোনাতে পারি না। এমন হলে বাঁচব কি করে বড়বাবু।
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বিমূঢ়। অংশুমান জিগ্যেস করলেন, গান করতে পুজো করতে নাম করতে পারিস না কেন?
-গলায় কে কুলুপ আঁটে, আর ভেতর থেকে কে ধমকায়, কবুল করলি না কেন, কবুল করলি না কেন–এত ভয় বুকে নিয়ে, সত্যের মুখ চাপা দিয়ে গান হয় পুজো হয় না হয়। যা দুর হ–দূর হ!
অংশুমানই দিশেহারা।-কি কবুল করিসনি। কোন সত্যের মুখ চাপা দিলি?
চাউনি বদলাতে লাগল, টান টান হয়ে বসল। ঝকঝকে চোখ দুটো বড়বাবুর মুখের ওপর এটে বসতে লাগল। গলার স্বরও বদলে গেল।ওই ঝড়জলের রাতে মনোহর পাইককে আমি খুন করেছি, আমিই তাকে কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে মেরেছি।
সুচারু দেবীর গলা দিয়ে একটা শব্দ বেরিয়ে আসছিল, হাতে করে নিজের মুখ চাপা দিলেন। অংশুমান একটা ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সামনের দরজা দুটো বন্ধ করে দিলেন। কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইলেন খানিক।–তোর সঙ্গে আর কে ছিল–কপালী বাবা?
-না না না! আমি একা করেছি, কেউ আমার সঙ্গে ছেল না!
-এতবড় শরীরটাকে একলা তুই টেনে এনে পুকুরে ফেললি কি করে।
কিছু কঠিন হয়নি, সব ব্যবস্থা সাজানো ছেল, আগে শোনো, আর তো তোমার কাছে মিছা বলব না, সব কবুল করে আমি সাজা নেতে এয়েছি, ফাঁসী যেতে হলেও কটা দিন বুক ভরে মায়ের পুজো মায়ের গান করতি পাব–যাবজ্জেবন জেল হলে তা পাবই।
এরপর অভিভূত হয়ে ঘটনা শুনলেন দুজনে।
…না রাখা অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শ্রীকান্ত পোদ্দারের কাছে যাবে বলেনি। মেরে ফেললেও বলার কথা নয়। কিন্তু কেউ তাকে দিয়ে আচমকা বলিয়েছে যাবে। রাধা নিজেকে ভস্ম করতে চেয়েছে আর যে বলিয়েছে তাকেও।…মনোহর তখন বেহুঁশ ঘুমে। ঝড় জল মাথায় করে রাখা পিছনের জংলা পথে কপালী বাবার ডেরায় জংলি কালীর কাছে এসেছে। ভেজা জামা-কাপড় বদলে মায়ের কাছে বসেছে। আর অসহ্য যন্ত্রণায় পাগলের মতো জানতে চেয়েছে মা কেন ওর মুখ দিয়ে যাবে বলালো।
হঠাং ঝিমুনি এসে গেছল। শুয়ে পড়েছিল। কতক্ষণ জানে না, রাত কত জানে না। ঝাঁকুনি খেয়ে উঠে বসেছে।…তাকে যেতে হবে। নিয়ে যেতে ভোর-ভোর লোক আসবে। ও বলেছে যাব। তখনো প্রবল বৃষ্টি। কপালী বাবা দাওয়ায় ঘুমোচ্ছন। তাঁর মাথার কাছে ছোট মদের বোতল আর গেলাস। তিনি গাঢ় ঘুমে। দড়ি থেকে ভেজা জামা-কাপড় নিয়ে রাধা ঘরে এসে পরে নিল। শুকনো জামা-কাপড় যেখানে থাকে রেখে দিল। মা-কে শেষবারের মতো দেখে নিয়ে নেমে এলো।
…নিজেরই তখন মনে হচ্ছিল, যে-রাধা যন্তন্নায় পাগল হয়ে ছুটে এসেছিল সেই রাধা ঘরে ফিরছে না। এত বৃষ্টিতে পথ ভাঙতে কষ্ট হচ্ছে না, যন্তনার লেশমাত্র নেই, কোথায় যেতে হবে জেনেও উদবেগ নেই। এমন হল কি করে, ওই রাক্ষুশী কি তবে ওকে ত্যাগ করল?
ঘরে ফিরল। হারিকেনটা তেমনি জ্বলছে। ওটা তুলে নিয়ে দাওয়ায় এলো। মনোহর পাইক তখন উঠোনমুখে হয়ে ঘাড় ঝুলিয়ে ঘুমোচ্ছে। তারপরেই কি হল জানে না। ভিতর থেকে কেউ যেন ওকে বলে দিল কি করতে হবে। ও মায়ের মেয়ে, লম্পট ছিনাথ পোদ্দারের কাছে যাবে এ কখনো হতে পারে? হারিকেন হাতে দাওয়ার এদিক ওদিক দেখল। কি খুজছে জানে না। চেলা কাঠের ওপর কুড়ুলটা চোখে পড়ল। ওটা নিয়ে ঘরের চৌকাঠের এ-ধারে দুই হাঁটুর ওপর বসল।
ক’বার কুড়ুল চালিয়েছে, রাধা জানে না। হারিকেন তুলে এগিয়ে এসে দেখল, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। হাতের কুড়ুল ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল। তোড়ের বৃষ্টিতে রক্তের দাগ থাকবে না। লণ্ঠন নিয়ে ঘরে এসে পরনের ভেজা জামা-কাপড় দেখে নিল। না, কুড়ুল বলেই ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটেনি বা ওর জামা কাপড়ে লাগেনি।
এখন কি করতে হবে সেটা খুব সহজে মনে এসে গেল। পিছনের চালাঘরে এসে দু-চাকার ঠেলাটা টেনে এনে দাওয়ায় লাগিয়ে দিল। ঘরে এসে পরনের জবজবে ভেজা জামা-কাপড় খুলে ফেলে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হল। খুব সহজে ঠেলে ঠেলে নিথর রক্তাক্ত দেহটা ঠেলার ওপর ফেলল। অনায়াসে দেহসুদ্ধ ঠেলাটা টেনে এনে পুকুর ধারে এলো। তারপর ঠেলার পিছন দিকটা উঁচিয়ে তুলতে দেহটা আপনি পুকুরে পড়ল। রাধা ঠেলা নিয়ে আবার উঠোনে ফিরল। ঠেলা রক্তে মাখা মাখি, কিন্তু এই মুষল বৃষ্টিতে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ধুয়ে যাবে, আর চাকার দাগের চিহ্নও থাকবে না। হারিকেন হাতে দাওয়াটা খুব ভালো করে দেখল। জায়গায় জায়গায় রক্ত থুবড়ে আছে। এক বালতি জল আর শলা কাটা নিয়ে এলো। মাটির দাওয়া দু’ মিনিটের মধ্যে পরিষ্কার, আর উঠোনে তো বৃষ্টির জলের স্রোত। তবু ঘর থেকে মনোহরের টর্চ এনে আর এক দফা ভালো করে দেখে নিল। রক্তের চিহ্নমাত্র নেই, ঠেলাটাও পরিষ্কার। টর্চ রেখে ঠেলাটা আবার চালার নিচে রাখল। জলে ভেজা, চাকায়ও কাদা মাটি লেগে আছে। একটা ছালা এনে আগে ওপরটা পরে চাকা দুটো ভালো করে ঘসে ঘসে মুছল। হারিকেনের আলোয় দেখল। এতেই হবে।
ঘরে এসে ওই ভেজা জামা-কাপড় পরে নিয়ে হারিকেনের আলো কমিয়ে ঘরের কোণে রেখে রাধা আবার জংলা পথে মায়ের কাছে ফিরে চলল। সব মিলিয়ে এক ঘণ্টারও সময় লাগেনি বোধহয়।
কপালী বাবা তেমনি ঘুমোচ্ছেন। অন্য কোণে বিলাসী। এবার জবজবে ভেজা কাপড়েই ঘরে ঢুকতে হল। মায়ের মুখের দিকে চেয়ে মনে হল মা হাসছেন। শুকনো জামা-কাপড় পরে ভেজাগুলো নিঙরে আবার দাওয়ার দড়িতে যেমন ছিল তেমন মেলে দিল। যাতা দিয়ে ঘরটা মুছে শুয়ে পড়ামাত্র আর জ্ঞান নেই।
অংশুমান পাথরের মতো মুখ করে ঘরে পায়চারি করছেন। সুচারু দেবী নিস্পন্দের মতো বসে। রাধা আকুল হয়ে বলল, আর কিছু ভেবনি বড়বাবু, তুমি আমার শাস্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে দয়া করে আমাকে এ যন্তন্ন থেকে বাঁচাও–আমাকে মুক্ত করো।
অংশুমান সামনে এসে দাঁড়ালেন।এ ব্যাপারটা তুই আর কাউকে বলেছিস–কপালী বাবাকে বলেছিস?
-বাবাকেই শুধু বলেছি, কিন্তু সে-তো আর কবুল করা হল না, হলে আমার এই দুর্দশা হবে কেন! বাবা তো মেয়ের সব দোষ চাপা দিয়ে মেয়েকে আগলাবেই।
–তুই আমার কাছে এসেছিস তিনি জানেন?
জানলে মুখ হাত-পা বেন্ধে আমাকে ফেলি রাখত, এমনিতেই তরাসে আছে।
তোর ভিতর যে এত যন্তন্না দিচ্ছে সে তোকে শাস্তি নিতে বলছে না, কবুল করতে বলছে?
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো একটু।–একই কথা হল…কবুল করতেই বলছে।
-বেশ। কবুল করা হয়ে গেছে। এরপর সব ভাবনা আমার। কিন্তু এ কথা যদি আর তুই কোনো লোককে বলেছিস তাহলে আমিই তোর সব থেকে বড় শত্রু হব মনে রাখিস। তোর কি হবে জানি না। কিন্তু তোর সঙ্গে কপালী বাবাকেও আমি আসামী সাজিয়ে ফাঁসীতে ঝোলাবই!
রাখা চাপা আর্তনাদ করে উঠল। এ কি বলছ বড়বাবু, বাবা তো ফুলের মতো নিষ্পাপ।
-ওসব আমি জানি না, তুইও ফুলের মতো নিষ্পাপ। যা হয়েছে তা আর ভবিষ্যতে কেউ কোনদিন জানবে না। তোর কবুল করার কথা, কবুল করা হয়েছে, এখন দ্যাখ তোর পুজো আর গান হয় কিনা।
একজন সাব-ইন্সপেক্টরকে দিয়ে জিপে করে ওকে কপালী বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু অংশুমান বা তাঁর স্ত্রী কেউই নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন নি। পরের সন্ধ্যায় জিপে দুজনেই কপালী বাবার ডেরার দিকে রওনা হয়েছেন। পৌঁছুতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। একটু দূর থেকে রাধার খুব পরিচিত গলার গান কানে এলো। নিঃশব্দে তারা দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন। কপালী বাবা হাত তালি দিয়ে দিয়ে তাল রাখছেন, রাধা ঠিক আগের মতোই দু’চোখ বুজে ভাবে বিভোর হয়ে দুলে দুলে গাইছে।
‘কালী-নামের গণ্ডী দিয়ে আছি দাঁড়াইয়ে।
শোন্ রে শমন তোরে কই
আমি তো আটাশে নই,
তোর কথা কেন রব সয়ে।
এতো ছেলের হাতের মোয়া নয় যে,
খাবি হুমকি দিয়ে।
বলৰি সাজা পাবি
মা-কে দিব কয়ে,
সে-যে কৃতান্তদলী শ্যামা বড় ক্ষ্যাপা মেয়ে।
সুচারু দেবীর দুই গাল বেয়ে ধারা নেমেছে। অংশুমানের চোখও শুকনো নয়।
আরো মাস দুই বাদে অংশুমানের প্রমোশনসহ বদলির হুকুম এসেছে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই এখন এজন্যেই আবার খুব মন খারাপ। বাকি দিনগুলো এখানে এভাবে কেটে গেলেই যেন বড় সুখের হত। সুচারু দেবী স্বামীর আসকারা পেয়ে রাধাকে জোন করেই কোয়াটারস এ ধরে নিয়ে আসেন, তিন-চার দিনও আটকে রাখেন। কপালী বাবা একটুও আপত্তি করেন না। তিনি আবার একটা মজার গান বেঁধেছেন, মোটা ভাঙা-ভাঙা গলায় বাউল সুরে সকলকে সে গান শোনান। এরা স্বামী-স্ত্রীও তাঁর ওখানে গিয়ে চেলাদের সঙ্গে বসে এ গান এনেছেন।
ওরে ও মাতনের মানুষ
রাধার বুকে কতই তোরা
ভক্তি দেখলি পুজা দেখলি
মায়ের সঙ্গে লড়াই দেখলি না।
ওরে ও মাতনের মানুষ
রাখার চোখে কতই তোরা
প্রেম দেখলি জল দেখলি
রাধার চোখে আগুন দেখলি না।
শুনে সকলে না বুঝেও হাসে। অংশুমান হাসেন সুচারু দেবী হাসেন। গম্ভীর হতে গিয়ে রাধাও এক-একসময় হেসেই ফেলে। কখনো দুহাত জোড় করে বাবাকে নিষেধ করে মিনতি জানায়।
না, সে-লড়াই আমি দেখিনি। সেই আগুনও না। কিন্তু সেদিন অংশুমানের ঘরে বসে রাধার কালো টানা চোখে কয়েক পলকের জন্য আগুন আমি দেখেছি।…দেওয়ালে টাঙানো মায়ের বড় ছবির সামনে দাঁড়িয়ে ধীর টনটনে গলায় বলেছিল, আমিও দেখব তোর মুরোদ কত, হেরে হাসিস না জিতে কঁদিস!
এই লড়াই বা তার হার-জিত হাসি-কান্না আমার কাছে দূরের জিনিস। এপথের কথা শোনা আছে, জানা নেই। এখনো লড়াইয়ের হাতিয়ার তো দেখছি বিজ্ঞানের ওষুধ। রাধার নিজস্ব লড়াই বা তার চোখের আগুনের দাম কি, অংশুমান ঘোষের রোগের ভবিষ্যৎ কি, আমি জানি না। কিন্তু মন আশার দরিয়ায় সাঁতার কাটছে। আশা করতে বড় ভালো লাগছে।