শ্বেত পাথরের থালা (Shwet Pathorer Thala) : 01
পঁয়তাল্লিশ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটের বাড়ির বয়স এ বাড়ির মুড়োয় লেখা আছে, যার থেকে হদিশ পাওয়া যায় বাড়িখানার পত্তন এ শতকে নয়। একশ পুরো না হলেও পঁচাশির কাছাকাছি বয়স গেছে। মা গঙ্গা খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাওয়ায় তাঁর জলো হাওয়ায় এবং বঙ্গোপসাগর দক্ষিণে একশ পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় সাগরের নোনা হাওয়ায়ও বটে কলকাতার বাড়ি ইংল্যান্ডের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ ম্যানর হাউজের মতো দীর্ঘদিন টেঁকে না। তবু বিলিতি কোম্পানির পয়লা নম্বরের জিনিস—মাৰ্বল, থাম, খিলেন, টালি, আসল বর্মা-টিকের জানলা, দরজা, বরগা এবং চুন-বালির বিশ ইঞ্চির গাঁথনি এই সব বাড়ির প্রাচীনত্বকে এখনও সাড়ম্বরে রক্ষা করে চলেছে। সযত্নে পালিশ করা এর প্রাচীনত্ব যার আরেক নাম আভিজাত্য, আরেক নাম প্রশ্নহীন অতীতমুখিতা, আরেক নাম? সংস্কার এবং তা কু-উপসর্গযুক্ত।
মার্বলের সাদা-কালো ছক-কাটা চল্লিশ ফুট লম্বা দালান। এ মুড়ো থেকে ও মুড়ো হাঁটলে তবে কালো পাথরের সিঁড়ি। আবার দালান, একতলার। অমনি চল্লিশ ফুট লম্বা। অমনি সাদা-কালো ছক। তার মাঝামাঝি অবধি হেঁটে গেলে তবে খাবার ঘরের দরজা। এই সমস্তটা হাঁটতে দুপুর দুটো অর্থাৎ ঠিক দ্বিপ্রহরে, ক্লান্ত দুর্বল শরীরটা তার থরথর করে কাঁপতে থাকে। সৈন্য-ব্যারাকের মতো বাড়ির গড়ন। দক্ষিণ চেপে সারি সারি ঘর, দোতলারগুলো তো বটেই, একতলার ঘরগুলোও কলকাতার বিখ্যাত দখিনা পবন সময়মতো পেয়ে থাকে। উত্তরে দালান। লাল নীল সুবজ হলুদ কাঁচ দিয়ে তার মাথায় কারুকার্য। তিন পাট করা জানলার শার্সিতেও তাই। সূর্য উত্তরায়ণে গেলে মার্বলের মেঝের ওপর চার রঙের হোরিখেলা হয়ে থাকে। পূবমুখী বাড়ি। ছাদে উঠলে সূর্যোদয় দেখা যায়। সামনের অনেক দূর পর্যন্ত প্রায় সমান মাপের দোতলা বাড়ি নিয়েই পল্লী। দূরে, ঠিক দুটি তালগাছের মধ্য দিয়ে সূর্যদেব যখন উঠে আসেন তখন শ্যাওলা-ছ্যাতলা-পড়া, টবের ফুল গাছঅলা, এ মুড়ো ও মুড়ো টানা তার বা নারকেল-দড়িতে কাপড়-শুকনো বৃদ্ধ ছাদগুলোও আলোয় আলো হয়ে যায়। কিন্তু জবাকুসুমসঙ্কাশ তরুণ তপনের কাছে তাদের আলোয় আলোকময় হয়ে ওঠবার প্রার্থনা যে জাগেই এমন কথা বলা যায় না। কারণ সেই সব অলৌকিক প্রত্যূষে পাড়ার প্রান্তে টিউব-ওয়েলের ঘটাং ঘটাং একবার চড়ায় ওঠে আবার খাদে নামে, বাসন মাজার ঝনঝন শব্দ, ঝাঁটার শপাং শপাং এবং নিদ্রোত্থিত গৃহিণীদের কর্কশ নির্দেশাদি ভোরবেলার বাতাবরণে এমন একটা দুটো বিবাদী স্বর চড়িয়ে রাখে যে বৈদিক উদাত্ত-অনুদাত্ত-স্বরিতই হোক আর রাবীন্দ্রিক সুরই হোক, বিষণ্ণ মুখে পশ্চাদপসরণ করতে পথ পায় না।
বাড়ির পশ্চিমে খোলা আধকাঁচা উঠোনে চাকরবাকরদের টালি-ছাওয়া পাকা ঘর। মস্ত মস্ত চৌবাচ্চা-অলা কলঘর এবং অযত্নের বাগান। কোথায়, কবে, কোন পাখি ঠোঁটে করে আধ-খাওয়া ফল ফেলে গিয়েছিল। কাঁচা উঠোনের মাটি ফাটিয়ে সেখানে বঙ্কিম ঠামের এক চিরসবুজ, চিরফলন্ত পেয়ারা গাছ। পাশে জোড়া নিম। সে-ও পাখ-পাখালিরই মালিগিরিতে। নিমের ছায়া ভালো, বলে সবাই। এই তিনে মিলে পশ্চিম দিক এমন ছায়া করে রাখে যে দুপুর বারোটার পর সূর্য হেললে শেষ বেলার রোদ আর এ বাড়ি পায় না। পেতে হলে ছাদে উঠতে হবে। দালানে এখন লম্বা ছায়া পড়ে গেছে। উত্তরের শনশনে হাওয়া ঢুকছে লাল-নীল কাচ শার্শির এক আধটা ভোলা পাল্লার ফাঁক দিয়ে। পায়ের তলায় হিমের ছুঁচ। গায়ের কালো পশমি চাদরটা ভেদ করে হাড় হিম করে দিচ্ছে উত্তুরে হাওয়া।
বাড়ির আর সব ঘরে শান্তিনিকেতনী পর্দা ঝুললেও খাবার ঘরের দরজা ফাঁকা। ঢুকতে, বেরোতে এঁটো-কাঁটা লাগবে। বাড়ির ছেলেরা, কর্তারা বাসি-টাসি মানার ধার ধারে না। ওসব পবিত্রতা খালি মেয়ে-মহলের জন্যে। শাশুড়ি বলেন মেয়েছেলের চরিত্তিরেই বাড়ির চরিত্তির। ব্যাটাছেলের দস্তখত আর মেয়েছেলের সহবত। ব্যাটাছেলের এক এক আঁচড় সইয়ে এক এক থলি টাকা উঠে আসবে। আর মেয়েছেলের শীল-শাল, হায়া-লজ্জা, আচার-বিচারেই বাড়ির মান-ইজ্জত। লোকজনের অভ্যেস বড় খারাপ তার ওপর, নোংরা কি ভিজে হাতটা ঝপ করে হয়ত পর্দায় মুছে ফেলল। চোদ্দবার অমন নোংরা হবে দিনে। তার চেয়ে দরজা ন্যাড়া থাক। সেই ন্যাড়া দরজা-পথে দেখা যায় ডান দিক ঘেঁসে খাবার টেবিল পড়েছে, যা এ বাড়ির বড় ছেলে বিদেশ থেকে ফিরে চালু করেছিল অনেক আপত্তি, অনেক মন কষাকষির পর। পাশে ফ্রিজ। তারও বয়স বেশি নয় এবং তাকে চালু করতেও সেই একই মানুষ ও একই রকম মন কষাকষি। সব এঁটো-কাঁটা সকড়ি হয়ে যাবে। প্রথম প্রথম ফল দুধ দই মিষ্টি ছাড়া কিছু থাকত না। এখন সবই থাকে। খালি সকড়ি আর আ-সকড়ির তাক আলাদা। এখন না হলে চলে না। গ্রীষ্মের দিনে শরবত, ঠাণ্ডা জল—পাঁচটা মানুষকে ঠাণ্ডা খাইয়ে কেরামতি দেখাবার জিনিসও বটে। এ জিনিস কিছু সবার ঘরে নেই। বাঁ দিকের কোণে কালো কম্বলের আসন। সামনে পরিষ্কার করে মোছা মেঝের ওপর সাদা পাথরের থালা। কাশীধামের জিনিস। পাশে গেলাস, বাটি, সবই একদম সাদা, শ্বেতশুভ্র পাথরের। পবিত্র নিষ্কলঙ্ক।
থালার ওপর ছোট ডেকচি থেকে আতপান্ন বেড়ে হঠাৎ ডুকরে উঠলেন মাঝবয়সী গিন্নি-বান্নি মানুষটি। চুলগুলি চার ভাগের এক ভাগ সাদা। চওড়া সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। চওড়া লাল নকশি পাড় শাড়ি। তিন থাক দাঁত দেওয়া। এই রকমের রাঙা পাড় শাড়ি ছাড়া উনি পরতে চান না। দু হাত ভর্তি ঝমঝমে চুড়ি লোহা রুলি শাঁখা। কান্নাটি তার চেয়েও ঝমঝমে। কণ্ঠের জোরেও বটে, শোকের জোরেও বটে: ‘কোথায় গেলি রে খোকা! একবার দেখে যা বাছার আমার কষ্টটা দেখে যা একবার। দুধের বাছাকে কেমন করে এ জিনিস ধরে দিই রে!’
বসেছিলেন আরও দুজন। একজন খুড়শাশুড়ি। তিনি চট করে চোখে আঁচল চাপা দিলেন। দ্বিতীয় জন বড় ননদ। তিনি চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ালেন। এসরাজের আর্তনাদ-মলিন আবহসঙ্গীতসহ এ এমনই এক গা-ছমছমে দৃশ্য যে কোনও এয়োতিই একে বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না। খাবার জন্য সবে যে ঘরে পা বাড়িয়েছিল, এতক্ষণ দালান হাঁটার ক্লান্তি তার পায়ে, এতক্ষণ পাথরের ঠাণ্ডায় পা পেতে রাখার কালশিটে তার দু পায়ের আঙুলে। শরীরের ভেতরটা দুর্বলতায় এবং আকস্মিক উত্তেজনায় কাঁপছে। হঠাৎ সে বলে উঠল—‘যা দিলে আপনারও কষ্ট হয় না, আমিও খেতে পারি এমন জিনিস দিলেই তো পারেন মা। রোজ রোজ এ নিয়ে এত কান্নাকাটির দরকার কি? আর এ আমি সত্যিই খেয়ে উঠতে পারছি না, পারছি না…।’ শেষের শব্দগুলো বিকৃত রুদ্ধ কান্নায়।
ঘরের মধ্যে যেন অকস্মাৎ বজ্রপাত হল।
বড় ননদ চলে যাবেন বলে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই অবস্থাতেই একটু ন যযৌ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যুগপৎ শাশুড়ি ও বউ-এর মুখ দুটো দেখে নিলেন। তারপর হঠাৎ একটু বেগেই বেরিয়ে গেলেন।
শাশুড়ি সেই যে উদ্যত কান্না গিলে মুখখানাকে নিচু করে ফেলেছেন আর তোলেননি। খুড়শাশুড়ির চোখের জল শুকিয়ে মুখটা কিরকম বিহ্বল হয়ে রয়েছে। যেন তাঁকে কেউ থাবড়া মেরেছে হঠাৎ। আলু-কাঁচকলার হবিষ্যান্ন আজ আর কিছুতেই বন্দনার গলা দিয়ে নামল না। ক্রোধে-ক্ষোভে-লজ্জায় গলার মধ্যে পিণ্ড, পাকিয়ে গেল।
ঊনিশশ’ পঞ্চান্ন সাল সবে আরম্ভ হয়েছে। জানুয়ারির শেষ। শীত খুব জানান দিচ্ছে। এখনও, স্বাধীনতার সাত আট বছর পরেও বুঝি কমলালেবু, আপেল, প্লাম কেকের সাহেবি ডালির প্রত্যাশায় আছে। এ বাড়িতে এই শীতের অর্থ এবার অন্যরকম। এ শীত মৃত্যুর, ক্ষতির, বিষাদের, যে বিষাদের কূল এখনও দূরে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আজ তিন চার মাস হতে চলল অভিমন্যু ভট্টাচার্য এ বাড়ির বড় ছেলে, বন্দনার স্বামী, চার বছরের অভিরূপের বাবা। যোগীন্দর অ্যান্ড যোগীন্দরের চীফ ডিজাইনার হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা গেছেন। মারা যাবার বয়স তো হয়ইনি, চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই মানুষটিকে কোনক্রমেই ত্রিশের বেশি বলে বোঝা যেত না। এক সময়ে নামী স্পোর্টসম্যানও ছিলেন। ফার্স্ট-ডিভিশন ফুটবলার। বাঁ হাঁটুর মালাইচাকি ঘুরে যাওয়ায় খেলা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু যোগব্যায়াম, মূলারের ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ চার্ট এবং ঘড়ি ধরে অনুসরণ করে শরীর-স্বাস্থ্য রেখেছিলেন সোজা, মজবুত, ঘাতসহ, তরুণ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারেননি। কোনও অসুখ-বিসুখের বালাই-ই ছিল না শরীরে। ট্যুরে গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশ। রাশিয়ার কোল্যাবরেশনে নতুন স্টীল প্লান্ট বসেছে। ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি পৌঁছলেন ভর সন্ধেবেলা। মা বাবাকে আসতে যেতে প্রণাম করার রেওয়াজ। বাবার পায়ের ওপর নত হয়েই চট করে উঠে দাঁড়ালেন। বাবা বললেন—‘কি হল রে?’
—‘না কিছু না। আমি চান সেরে আসছি বাবা।’
রূপ চৌকাঠ থেকেই বাবার কোলে ওঠার বায়না নিয়েছিল। সে প্রচণ্ড বাবা-ভক্ত। তার হাতটা ধরে অভিমন্যু বললেন—‘কোলে উঠলে কিন্তু সেই মজার জিনিসটা দোবো না রূপু।’ বাবার হাত ধরে মজার জিনিস পাবার আশায় লাফাতে লাফাতে দোতলায় উঠল ছোট্ট অভিরূপ। ঘরে ঢুকেই বন্দনাকে বললেন—‘বুকে ক’দিন ধরেই একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে বুঝলে! কাজের ভিড়ে মন দেবার সময় পাইনি। একটা কার্বো-ভেজ থার্টি বার করো তো বাক্স থেকে!’ বন্দনা ওষুধের বাক্সটা নামিয়েছে তাক থেকে, শুনছে হাসতে হাসতে বলছেন—‘বুকের বাঁ দিক ব্যথা, তার মানে হার্ট, তার মানে ফেল, তার মানে চললুম এ যাত্রায়, বুঝলে কিছু?’
বন্দনা বলল—‘কি হচ্ছেটা কি? সব তাতেই হাসি-ঠাট্টা। যা-তা খেয়েছো বুঝি?’
—‘বাঃ, অফিস পাঠিয়েছে নিজের স্বার্থ দেখতে। খাতিরের খাওয়া চারবেলা, খাবো না?’
—‘খেয়েছে তো ওই সব রিচ রান্না আর …’
—‘ওঃ বন্দনা, তুমি এমন করছো যেন খেয়ে সাঙ্ঘাতিক একটা পাপ করে ফেলেছি। আরে বাবা, খাওয়ার জন্যেই তো জীবন! তবে তুমি রাগ করো না, আমি শুধু বুড়ি ছুঁয়েছি।‘
—‘অর্থাৎ?’
—‘তুমি যেমন কনে-বউ হয়ে ষোড়শ ব্যঞ্জনের বুড়ি ছুঁয়েছিলে ঠিক তেমনি।’
—‘সত্যি?’
—‘সত্যি। আসলে তো চালিয়েছি মাছ-পোড়া, মাংস-পোড়া আর কাঁচা সবজি দিয়ে। তবু যে কেন এই বায়ুপুরাণ!’
বন্দনা বলল—‘এখনও ব্যথা কমছে না? দাঁড়াও আমি এখুনি ডাঃ সেনগুপ্তকে ফোন করে দিচ্ছি।’
—‘আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও’ খপ্ করে বন্দনার হাতটা ধরে ফেললেন অভিমন্যু।
—‘কথায় কথায় অত ডাক্তার-বদ্যি কিসের, অ্যাঁ? কার্বো-ভেজে কমছে না দেখলে তবে ঠিক করব এটা বায়ুপুরাণ নয়, হৃৎ-পুরাণ। তখন খাবো একটা স্পাইজেলিয়া সিক্স, নাম শুনেছো জীবনে? তারপর ক্রেটিগাস মাদার গরম জলে কয়েক ফোঁটা ফেলে …।’
বলতে বলতেই অভিমন্যু বাথরুমের দিকে এগিয়েছিলেন। ধবধবে টার্কিশ তোয়ালে এক হাতে, সবুজ বর্ডার দেওয়া, অন্য হাতে পাটভাঙা পায়জামা-পাঞ্জাবি। এ বাড়ির সবাই গামছা ব্যবহার করে, অভিমন্যু ছাড়া। পায়জামার অভ্যাসও অভিমন্যুর একার। বাকি সবাই ধুতি, কিম্বা লুঙ্গি। এসব খানিকটা বিদেশে গড়ে ওঠা অভ্যাসও বটে, খানিকটা বন্দনার ইচ্ছের জোরেও বটে। অভিমন্যুর চোখের তলায় সামান্য কালি, ঘুমোতে না পারার, সর্বক্ষণ ঘিনঘিনে ব্যথা লেগে থাকার। পরিষ্কার কামানো মুখে একটু এই এতটুকু সবুজ শ্যাওলার ছোপ। মুখে নির্ভেজাল সরল, বিজয়ীর হাসি। দৃশ্যটা চোখ বুজলেই চোখের সামনে ভাসে।
বাথরুম বন্ধ করবার পরই হঠাৎ সেই অব্যক্ত যন্ত্রণাময় চিৎকার—‘বন্দনা-আ-আ।’
সুটকেস থেকে জামাকাপড় বার করছিল বন্দনা। খাটের গায়ে একে একে সাজিয়ে রাখছে। ব্যবহৃত রুমাল, গেঞ্জি, আন্ডারওয়্যার সব বালতিতে। শার্ট তোয়ালে, পায়জামা, পাঞ্জাবি ধোবার বাক্সে ফেলবে বলে জড়ো করছে। সেই চিৎকার যেন বুকের মধ্যে দমাস করে একটা শেল ফাটালো।
—‘বন্দনা-আ-আ-আ।’
বাথরুমের দরজাটা কোনমতে খুলে দিয়ে মেঝের ওপর শুয়ে পড়েছিলেন। চোখ দুটো ক্রমেই বড় হয়ে উঠছে। সে কি যন্ত্রণায়? ভয়ে না বিস্ময়ে?
—‘কলি কলি, শিগগিরই সেনগুপ্তকাকাকে ফোন কর’ —বলতে বলতে বন্দনা মাথাটা কোলে তুলে নিয়েছে, তার ঘোমটা খসে পড়েছে, চুল এলানো, কাঁধের ওপর এখনও অভিমন্যুর একটা শার্ট, ধোবাকে দেবে না নিজে কাচবে, বিচার করছিল বলে কাঁধের ওপর তুলে রাখা, পড়ি-মরি করে চতুর্দিক থেকে ছুটে আসছে ননদ কলি, মিলি, কাকিমা, শাশুড়ি। ছেলেরা বাড়িতে কেউ নেই। শ্বশুরমশাই ভাগ্যিস আজকাল রোজ কোর্টে যান না। তাঁর খড়মের দ্রুত আওয়াজ—‘ওকে আগে একটু কোরামিন দাও, কোরামিন দাও, দশ পনের ফোঁটা। নেই? তোমাদের বাড়িতে কি কিছু থাকে না? কলি, ফোনটা করেছো? সে কি? হাত কাঁপছে, দাও, আমায় দাও, সামান্য একটা কাজও কি মেয়েদের দিয়ে হবে না?—হ্যালো, সেনগুপ্ত, সেনগুপ্ত আমি কাশীনাথ। ‘কাশী, ছেলের বোধহয় স্ট্রোক হচ্ছে, করোনারি, শিগগিরই এসো, দেরি নয়।’
ডাক্তার এসে মৃত্যু-যন্ত্রণার অন্তিম পর্ব দেখলেন। অক্সিজেন-সিলিন্ডারটা পৌঁছলো প্রয়োজনের ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে। ততক্ষণে সব শেষ।
তিন মাস কাবার হয়ে চার মাসে পড়ল সময়। আকস্মিক এই মৃত্যুর সীমাহীন আতঙ্ক ও বীভৎসতা এখনও পর্যন্ত বন্দনাকে বোবা করে রেখেছে। প্রস্তরীভূত। জড়বৎ। শুধু মাঝে মাঝে অগ্ন্যুৎপাত হয়। ঘুমের ঘোরে সে বিছানার চাদর মুঠো করে আঁকড়ে আপ্রাণ চিৎকার করে ওঠে। স্বামীর সেই অমানুষিক যন্ত্রণায় বিকৃত মুখের ছবি, সেই ভয়বিস্ফারিত কেমন যেন অবাক হয়ে যাওয়া শেষ অভিব্যক্তি ঘুমের মধ্যে থেকে থেকে হানা দেয়। শুধু একবার রুদ্ধ কণ্ঠে বলতে পেরেছিল—‘আমি কি মরে যাচ্ছি বন্দনা? আমি কি সত্যি-সত্যি মরে যাচ্ছি?’
মৃত্যুর জন্য কোনও প্রস্তুতি ছিল না ভদ্রলোকের। কর্মব্যস্ত, পরিপূর্ণ জীবনযাপনে মগ্ন আনন্দমুখর জীবনটার মাঝখানে থেকে মানুষটাকে যেন কেউ নির্মম হাতে ছিঁড়ে নিল।
শুধু স্বামী বলে নয়, অসামান্য প্রিয়জন বলেই নয়, বন্দনা যেন কোনও সম্পূর্ণ তৃতীয়-ব্যক্তির চোখ দিয়ে ঘটনাটাকে দেখতে পায়, এবং দেখে তৃতীয় ব্যক্তি হয়েও যন্ত্রণায় আছাড়ি-পিছাড়ি করতে থাকে। লম্বা-চওড়া, সুঠাম স্বাস্থ্যবান মানুষটা। সব সময়ে হুল্লোড়ে, হাসিতে, আড্ডায় সবাইকে মাতিয়ে রাখত। আত্মীয়মহলে তো বটেই, অফিসে-ফ্যাকটরিতে পর্যন্ত কি জনপ্রিয় ছিল সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেবার এই ক্ষমতায়। ওয়ার্কার-মহলের মুখভার, ম্যানেজমেন্ট আগে খুঁজবে ভটচায্যি সাহেবকে। পার্সোনেল-এর দায় তাঁর নয়, জনসংযোগের দায়ও তাঁর নয়, তবু এসব ব্যাপারে কোনও গুরুতর সমস্যা হলে ভট্চায্যির ক্যারিশমার ওপর সবাইকার প্রথম আস্থা। পরিপূর্ণ জীবনের প্রতিমূর্তি যেন। আহা! যখন সব শেষে শুয়েছিল। মুখটা কালো, কার প্রতি যেন দুরন্ত অভিমানে চোখ দুটো ঈষৎ বিস্ফারিত হয়ে আছে। বন্দনা, আমি কি সত্যি সত্যি মরে যাচ্ছি? সে দৃশ্য দেখে বুকফাটা আর্তনাদ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল বন্দনা। শুধু বেঁচে থাকার আহ্লাদেই যে অষ্টপ্রহর আটখানা হয়ে থাকত, সেই মানুষটির অকালমৃত্যুর কাছে তার ব্যক্তিগত শোকও যেন নগণ্য।
ভয়ঙ্কর কিছু একটা করতে ইচ্ছে যায়। দৌড়ে গিয়ে চিতায় উঠে পড়া, কিম্বা ছাদের ওপর থেকে লাফ খাওয়া, কিম্বা গঙ্গায় ঝাঁপ, কেরোসিন গায়ে ঢেলে লকলকে আগুনের বেড়ে…। বীভৎস কিছু একটা। তুলসীচন্দন দিয়ে চোখের পাতা দুটি আস্তে বুজিয়ে দিচ্ছেন শাশুড়ি। ছেলের মাথাটি কোলের ওপর আড় হয়ে পড়েছে। সেই শিশুকালের মতো, সন্ধের ঝোঁকে যখন শেলেট-পেনসিল হাতে জাদুর চোখে ঘুম আসত। সারা মুখটা মায়ের চোখের জলে ভেজা। মেজ ছেলে শান্তিপুরের নতুন ধুতি আনছে। ছোট ছেলে কুঁচনো চাদর। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে ছেলেদের বন্ধু-বান্ধবরা ফুল, অগুরু, খই, ফুটো পয়সা। মৃদু গলায় মাসতুত ভাইটি ডাকল ‘বল হরি।’ ‘হরিবোল’ গলা বসে গেছে ভাইদের, তাবৎ শ্মশানযাত্রীর। হরিনাম নয়, পুরুষ কণ্ঠের দুর্লভ কান্না। এক দিক দিয়ে ছেলেকে বার করা হচ্ছে, যে মাত্র ঘণ্টাকয় আগে সুটকেস হাতে এই গেট দিয়েই ঢুকেছিল। আরেক দিক দিয়ে অজ্ঞান অচৈতন্য বউটির দেহ কেউ মাথার দিকে, কেউ পায়ের দিকে, কেউ কোমরের কাছে ধরে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে সাদা, ঠাণ্ডা, খালি ঘরে। ছেলের জন্য ডাকা ডাক্তারের বিদ্যা বউয়ের চিকিৎসায় কাজে লাগছে এবার।
শ্রাদ্ধ? শেষ কাজ। সে তো করতেই হয়। গুরুজনের চোখের ওপর দিয়ে কনীয়ানের প্রেতকার্য। শ্রাদ্ধের দিন বাড়ির যেখানে যত ঠাকুর দেবতার ছবি ছিল সব আছড়ে ভাঙছিল বন্দনা। কোথা থেকে তার শরীরে এত জোর, এত ক্রোধ এল সে জানে না। ময়না ডালের কীর্তন দিয়েছেন কর্তা। সবাই সেইখানে। মাথুর পালায় ভাবাবেশে ঘন ঘন মূর্ছা হচ্ছে মূল গায়েনের, হুঙ্কার দিয়ে চলছে দোহারকি। সেরেস্তা-ঘরে শ্রাদ্ধ-কর্ম। বৈঠকখানায় একদিকে শান্তিপর্ব, আরেকদিকে গীতা পাঠ। পাল্লা দিয়ে চড়ছে, নামছে পণ্ডিতদের গলার স্বর। কাকার কোলে-বসে সদ্য চার বছর অতিক্রান্ত অভিরূপ শ্রাদ্ধ ঘরে। রোগিণীর কাছে তখন কেউ ছিল না। হঠাৎ আছড়ে পিছড়ে কাচ-ভাঙার শব্দে সব এক এক করে ছুটে এসেছিল। কৃষ্ণ, কালী, অন্নপূর্ণা, গুরুদেব যা যা পেয়েছে আছড়ে-আছড়ে ভাঙছে বউ। মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠছে। হাত-ভর্তি রক্ত। বাড়িতে ওর হাতের কাছে সত্যি এতো ঠাকুরের ছবিও তো ছিল। ঠাকুরের ছবি ঘরে রাখলে, ঘর নিরাময় হয়, সুখে-শ্রীতে উছলে পড়ে সংসার এই বিশ্বাস। ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল দিনের পর দিন। সেই অসহায় নিদ্রার মধ্যে দিয়েই পাড়া ভেঙে ব্রাহ্মণ ভোজন হল। বাড়ির বড় ছেলে, রাজার মতো ছেলে গেছে, কেউ যেন বাদ না যায়। সে যা-যা খেতে ভালোবাসত তা সবাই খাক। বিশ্বাত্মা পরিতৃপ্ত হোক। তারপর এঁরা সব মাছ-হাত, মাছ-মুখ করলেন সাতাশ বছরের অচৈতন্য উন্মাদিনী শাঁখা ভেঙে, লোহা খুলে, হা-হা সিঁথি, শুকনো-মুখ, সাদা-কাপড়ে পরিত্যক্ত ভিখারিণীর শবের মতো পড়ে রইল একধারে। এই বিয়োগান্ত সামাজিক নাটকের আসল নায়ক যে এই নায়িকা এই রুক্ষকেশী, ধূম্রলোচনা, ধূমাবতী এ কথা কুশীলবদের কারও খেয়াল রইল না।
দিনের পর দিন। সকাল থেকে রাত, রাত থেকে সকাল নিত্যকর্ম হল ঘুম। ঘুম, ঘুম আর ঘুম। যাতে কোনও ছিদ্রপথে শোক ঢুকে না পড়ে তার চূড়ান্ত ডাক্তারি ব্যবস্থা। শরীর রক্ষার জন্য এক ঘুম থেকে জেগে উঠে আরেক ঘুমে চলে যাবার হাইফেন-সময়ে সামান্য কিছু খেয়ে নেওয়া, স্নায়ুতন্ত্র ভয়ঙ্কর বিচলিত থাকায় সেই খাবারও প্রায়শই বমি করে ফেলা। অতঃপর দুর্বল ঘুরন্ত মাথা, টলমলে দেহটাকে টেনে এনে আবার শয্যায় ফেলে দেওয়া। সবাই ভেবেছিল এ জীবনটাও বরবাদই হয়ে গেল বুঝি। বাড়ির প্রথম শিশুটির বুঝি সম্পূর্ণ অনাথ হতে আর দেরি নেই। শুধু বুড়ো ডাক্তার সেনগুপ্ত মাথা নেড়ে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন: ‘ভরা যৌবনের জীবন, তার ওপর স্ত্রী-শরীর, এতো আদরের শরীর, যত্নের স্বাস্থ্য, ও কি সহজে যায় মা!’
একদা একদিন এইরকম ওষুধ-ঘুম থেকে সহসা জেগে উঠে বন্দনা বুঝতে পারছিল না সে কোথায়। তার চোখের সামনে তখন একটা ফিকে নীল পট। তাতে লম্বা কালোকালো ডোরা আর মাঝে একটা ছোট্ট কালো বল। কিছুই মাথায় নিচ্ছিল না। মাঠ তো সবুজ হয়! নীল মাঠ? ডোরাগুলো কি? ওই বল কোন খেলার? কোন খেলুড়ির? কখন সে খেলা শুরু হবে? দুর্বল মস্তিষ্কে এই সব অস্ফুট প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছিল। তারপর একটা খয়েরি চিল, যাকে বন্দনার চোখে কালোই দেখাল, হঠাৎ বাচ্চা ঘোড়ার মতো তীব্র হ্রেষাধ্বনি করে ঝপ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা কালো ফুটকির ওপরে, বন্দনা সহসা বুঝতে পারল এটা চিল, ওটা পায়রা, দলছুট বেচারা পায়রা, নীল বিস্তারটা মাঠের নয়, আকাশের। ডোরার মতো দেখতে ওগুলো গরাদ। সংসার কারাগৃহের লৌহগরাদও বটে আবার পঁয়তাল্লিশ নম্বর শ্যামবাজার স্ট্রিটের দোতলার ঘরের দক্ষিণের জানলার গরাদও বটে।
এই সময়ে ছোট কালো বলটা নড়েচড়ে উঠল। খোঁচা খোঁচা চুলে ভরা একটা ছোট্ট শিশু মাথা। ওর বাবা নেই। মা থেকেও নেই। বিশাল সংসারে ছোট্ট পাঁচ বছরের রূপ একা। এখনও সেই ঘর সেই-ই আছে। কিন্তু হায়, আশ্রয় নেই আর। রূপ সেই প্রচণ্ড প্রতারণার দিকে মহানির্বেদে পেছন ফিরে কিসের প্রত্যাশায় আকাশমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে জানে না। ভীষণ রোগা। কাঁধের হাড় দুটো উঁচু হয়ে আছে। কচি মাথাটা কুচকুচে কালো কদমছাঁট চুলে ছাওয়া। বন্দনার ঠিক পায়ের কাছে খোলা জানলাটা। তার ফ্রেমে আটকে আছে আকাশ। স্তূপের পর স্তূপ মেঘপাহাড়। একটা স্তূপের ওপারে সূর্য। আলোর ছটা বিকীর্ণ হয়ে পড়েছে সারা আকাশ জুড়ে। পাহাড়-পর্বতের মাথা জাগানো সেই আকাশ-সমুদ্রে সাঁতার কাটছে একলা স্বভাবের চিল, ঘুরপাক খাচ্ছে তীব্র শিসের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে দলবদ্ধ পায়রা।
এই ছবিটা বোধহয় বন্দনার চিরকাল মনে থাকবে। উদার আকাশের পটে পিং পং বলের মতো একটি শিশুমস্তক। একদিকে বিরাট আর একদিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। কী অনন্ত, অবাধ! কী সীমাবদ্ধ, ভঙ্গুর, কী শক্তিহীন!
বুকের মধ্যে যেন বাঘে আঁচড়াচ্ছে। বন্দনা খাট থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে হোঁচট খেলো, বুঝতে পারল তাড়াতাড়ি চলাফেরা করার শক্তি তার নেই। আস্তে আস্তে পা টিপে-টিপে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিল। রূপ প্রথমে বুঝতে পারেনি কে। মা প্রাণপণে তার চোখ টিপে ধরে আছে।—‘কে?’ আঃ ছাড়ো না! কে? ছোট্ট অভিরূপ চিলের গলায় চেঁচায়। কেমন বিরক্ত, খ্যাপাটে সুর।
—‘ভাল্লাগছে না বলছি, ছাড়ো! ছাড়ো না!’
বন্দনা ওর চিবুকটা ধরে আস্তে আস্তে সামনে ঘোরায়। মাতৃস্পর্শ ভুলে গেছে ছেলেটা। আসলে মাতৃস্পর্শ-মাতৃগন্ধ তো কোনও অলৌকিক ব্যাপার নয়, চুড়ির রিনিঝিনি, বিশেষ পাউডার বা মাথার তেলের গন্ধ সমস্ত মিলিয়ে মাতৃ-আবহ। বন্দনাকে দেখে অবাক হয়ে তাকাল, তারপর তার ছোট্ট দুটো তুলতুলে ঠোঁটে হঠাৎ জোয়ার এল। বন্দনা দেখছে ঠোঁট ফুলে ফুলে উঠছে, চোখের কূল ভরে ভরে উঠছে। ছেলের মুখ বুকের মধ্যে গুঁজে নিয়ে বন্দনা মনে মনে বলল—‘ঈশ্বর যদি না-ই থাকেন, রূপু তোর আমি আছি। বিশ্বজননী যদি তাঁর কর্তব্য ভুলে যান, তোর এই শক্তিহীন মা একাই সংগ্রাম করবে।’ রূপ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মায়ের মনে হল ও যেন শুধু অভিরূপই নয়, অভিমন্যুও। নির্মম বিশ্বপ্রকৃতির হিংস্র হাতের মুঠোয় অসহায় মানুষ। বলছে—‘আমাকে কেড়ে নিও না। পৃথিবী বড় সুন্দর। আমাকে আর একটু বাঁচতে দাও।’ দাঁতে দাঁত চেপে বন্দনা বলে—‘আমাকে শেষ না করে তোকে কেউ আর নিতে পারবে না। একবার হেরেছি তাই বলে কি বারবার হারব?’