শকসো
ঢাকা থেকে জরুরি কাজে সিলেট যাব, তাড়াহুড়ো করে এয়ারপোর্টে এসে শুনি ফ্লাইটটা দুই ঘণ্টা পিছিয়ে দিয়েছে। আমার মতো আরও অনেক যাত্রী বিরস মুখে বসে আছে-প্লেনের যাত্রীরা একটু ভদ্রগোছের বলে মনে হয়, না হলে এতগুলো মানুষকে এক কথায় দুই ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়ার পরও কোনো চ্যাঁচামেচি নেই, ঝগড়াঝাটি বাগবিতণ্ডা নেই।
এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে হাতের খবরের কাগজটা প্রায় মুখস্থ করে ফেললাম। কাগজের চতুর্থ এবং পঞ্চম পৃষ্ঠায় মফস্বলের অনেক খবর থাকে। মফস্বলে ভালো কিছু ঘটে বলে মনে হলো না, বেশির ভাগই খুন-জখম এবং অ্যাসিড মারার গল্প, প্রথম এক-দুই লাইন পড়ে আর বিস্তারিত পড়ার ইচ্ছা করে না। কাগজটা ভাজ করে রেখে দেখলাম আমার পাশে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বসে আছেন। আমার চোখে চোখ পড়তেই একটু হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “সিলেট যাচ্ছেন?”
“জি।”
“প্লেন কেন লেট হয়েছে জানেন?”
“না।”
“বিমানমন্ত্রী কলকাতা গিয়েছেন শাড়ি কিনতে।”
“শাড়ি কিনতে?”
“হ্যাঁ। শালির বিয়ে।”
শাড়ি কেনার সাথে সিলেটে প্লেন লেট হবার সম্পর্ক কী আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “মন্ত্রী শাড়ি কিনলে আমাদের প্লেন লেট হবে কেন?”
একটাই তো প্লেন। সেই প্লেন কলকাতা থেকে ফিরে আসবে, তারপর আমাদের নিয়ে সিলেট যাবে।”
আমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বললাম, “সত্যি বলছেন?”
“সত্যি। একেবারে পাকা খবর। ফ্লাইট ম্যানেজার আমার বিশেষ বন্ধুমানুষ। সে খবর দিয়েছে। মন্ত্রী সাহেব তার মিসেসকে নিয়ে বাজারে চলে গেছেন। ইন্সট্রাকশন দেওয়া আছে যতক্ষণ না ফিরে আসছেন ততক্ষণ প্লেনটাকে আটকে রাখতে হবে।”
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম, ভদ্রলোক হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “এত অবাক হচ্ছেন কেন? এরকমই তো চলছে। মোগল বাদশারা যে রকম সারা দেশের সবকিছুর মালিক ছিল
আমাদের মন্ত্রীরাও তা-ই। তারা সবকিছুর মালিক!”
আমি মাথা নেড়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলাম। ভদ্রলোক চেয়ারে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সিলেট নতুন যাচ্ছেন।’
“না। সেখানেই থাকি।”
“সুন্দর জায়গা! বিউটিফুল!”
কথা বলার জন্যে কথা বলা। তাই আমাকেও ভদ্রতা করে কিছু-একটা জিজ্ঞেস করতে হয়। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কোথায় থাকেন?”
“বেশির ভাগ সময় ঢাকাতেই থাকি। বাকি সময় চিটাগাং আর খুলনা। মাঝে মাঝে রাজশাহী-সিলেট।”
“ও।” আরও কিছু জিজ্ঞেস করা যায় কি না ভাবছিলাম, তার মাঝে ভদ্রলোক আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেন আপনি?”
“আমি পড়াই। ইউনিভার্সিটিতে।”
“ও! ভেরি গুড।” ভদ্রলোক এমনভাবে মাথা নাড়লেন যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করা একটা সাংঘাতিক কাণ্ড! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি?”
“আমি?” আমি এখন বিজনেস করি।”
“আগে অন্যকিছু করতেন?”
“হ্যাঁ। আগে ডাক্তার ছিলাম। সার্জন।”
“সার্জন?” আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “সার্জারি ছেড়ে দিলেন কেন?”
ভদ্রলোক উত্তর না দিয়ে তার ডান হাতটা আমার সামনে এনে মেলে ধরলেন, আমি দেখলাম, তার বুড়ো আঙুলটা নেই, কেউ যেন নিখুঁতভাবে কেটে নিয়েছে। আমি একটু হকচকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোনো অ্যাকসিডেন্ট?”
“নাহ।”
“তাহলে?”
“কেটে ফেলেছি।”
“কেটে ফেলেছেন? কোনোরকম ইনফেকশন?”
“উঁহু। ইনফেকশন নয়। এমনিতেই কেটে ফেলেছি।”
“তা ঠিকই বলেছেন, খামোখা কে আঙুল কেটে ফেলবে? তাও বুড়ো আঙুল। সার্জনের বুড়ো আঙুল “কারণ অবিশ্যি একটা ছিল।”
আমি একটু কৌতূহল নিয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। নিজে থেকে না বললে কারণটা জানতে চাওয়া ভদ্রতা হবে কি না বুঝতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “আপনি যদি শুনতে চান তাহলে বলতে পারি। গল্পটা এখনও কেউ বিশ্বাস করে না-আপনি যদি না চান আপনাকেও বিশ্বাস করতে হবে না।”
“কেন বিশ্বাস করব না?”
“শুনলেই বুঝতে পারবেন। যা-ই হোক–” বলে ভদ্রলোক তার বুড়ো আঙুলবিহীন হাতটা সামনে তুলে সেটার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আমার নাম মাহবুব খন্দকার।
আমি নিজের নাম বলতেই তিনি করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন, আঙুলবিহীন হাত করমর্দন করতে আমার গা একটু কাটা দিয়ে উঠল, কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না।
ভদ্রলোক এতক্ষণ বেশ হাসি হাসি মুখেই বসেছিলেন, এবারে গল্প শুরু করার আগে হঠাৎ কেমন জানি একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
গল্পটা ছিল এরকম। তার ভাষাতেই বলা যাক।
আমার জন্ম অক্টোবরের নয় তারিখ, সেটা হচ্ছে তুলারাশি। তুলারাশির মানুষেরা নাকি ভূত-প্রেত পরলোক এসব অলৌকিক জিনিসে উৎসাহী হয়। সেটা সত্যি কি না আমি জানি না, কিন্তু আমার আসলেই ভূত-প্রেত এসবে খুব উৎসাহ ছিল। কাউকে জিনে ধরেছে বা পরীতে বশ করেছে শুনলে আমি দেখতে যেতাম, বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে পোড়োবাড়িতে রাত কাটিয়েছি, লাশকাটা-ঘরে ঘুরে বেড়িয়েছি। প্ল্যানচেট করেছি, চক্রে বসেছি, অমাবস্যার রাতে শ্মশানে গিয়েছি, জিন বশ করার দোয়া-দরুদ পড়েছি, কিন্তু আমার কপালই হোক আর যা-ই হোক সত্যিকারের অলৌকিক কিছু কখনো দেখিনি। প্রায়-ভৌতিক অনেক কিছু আছে, কিন্তু সত্যিকারের ভৌতিক ব্যাপার যার ব্যাখ্যা নেই সেরকম কিছু একবারও দেখতে পেলাম না।
মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ভূত-প্রেত কিংবা অলৌকিক জিনিস আকর্ষণ খানিকটা কমে এলো। অ্যানাটমি ক্লাসে বেওয়ারিশ লাশ কাটাকুটি করে আর ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে খুন-জখম অ্যাকসিডেন্টে মানুষকে মারা যেতে দেখে দেখে মন খানিকটা কঠোর হয়ে গেছে। তখন ভূত-প্রেত আর জিন-পরীতে আকর্ষণ বেশি থাকতে পারে না। তবুও আকর্ষণ যে একেবারে চলে গেল তা নয়, অলৌকিক জিনিসের গন্ধ পেলে একবার ঢু মেরে আসতাম।
মেডিক্যাল কলেজ শেষ করে বিলেত গেলাম, সেখান থেকে এফআরসিএস ডিগ্রি নিয়ে ফিরে এসেছি। দেশে আমার তখন খুব রমরমা ব্র্যাকটিস। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রায় কশাইয়ের মতো মানুষকে কেটে ফেলি, ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই। কয়েকটা ক্লিনিকের সাথে যোগাযোগ রয়েছে-দিনে দু-চারটে অপারেশন করতে হয়। একদিন গলব্লাডার স্টোনের জন্যে একজন মহিলাকে কাটব, ভদ্রমহিলা হঠাৎ কাতর স্বরে বললেন, “ডাক্তার সাহেব, আমাকে কেন কাটাকুটি করছেন? আমি তো বাঁচব না।”
আমি হাহা করে হেসে বললাম, “আমি কি এতই খারাপ সার্জন যে গলব্লাডার স্টোন সরাতে গিয়ে আপনাকে মেরে ফেলব?”
“সেটা নয়।” ভদ্রমহিলা ফিসফিস করে বললেন, “আমার আসলে ক্যান্সার হয়েছে।”
“ক্যান্সার?” আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “আপনি কেমন করে জানেন?”
“আমাকে একজন বলেছেন?”
“যিনি বলেছেন তিনি কি ডাক্তার? বায়োপসি করেছে?”
“না।” ভদ্রমহিলা মাথা নাড়লেন, তার কিছু করতে হয় না। এমনিতেই বলতে পারে।”
আমি খুব কষ্ট করে বিরক্তি গোপন করে বললাম, “যিনি আপনাকে এরকম একটা কথা বলেছেন তিনি খুব অন্যায় করেছেন। আমি আপনার পেট খুলছি-আপনাকে জানাব যে আপনার ক্যান্সার নেই।”
যাই হোক, অপারেশন টেবিলে পেট খুলে আমি একেবারে থ হয়ে গেলাম। সত্যি সত্যি ক্যান্সার-ভেতরে পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েছে, আমাদের কিছু করার নেই। আমি আবার বন্ধ করে ফিরে এলাম, তিন দিন পর ভদ্রমহিলা মারা গেলেন, মারা যাবার আগে তার কাছ থেকে আমি সেই মানুষটার ঠিকানা নিয়ে রাখলাম।
কয়দিন পর ঠিকানা খুঁজে খুঁজে আমি সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করেছি। পুরান ঢাকার এক ঘিঞ্জি অন্ধগলিতে একটা ছোট অন্ধকার মসলার দোকানে উবু হয়ে বসে মসলা বিক্রি করছে। আধ্যাত্মিক মানুষের যে রকম চেহারা হওয়ার কথা তার চেহারা মোটেও সেরকম নয়। শুকনো তোবড়ানো গাল, কোটরাগত চোখ, থুতনিতে ছাগলের মতো দাড়ি, মাথায় তেল চিটচিটে টুপি, গুনে গুনে ময়লা নোট ক্যাশবাক্সে রাখছে।
আমি পরিচয় দিয়ে বললাম, “আমি আপনার কাছে একটি কথা জানতে এসেছি।”
“রোগীর কথা জানতে এসেছেন? আমি কিন্তু শনি-রবিবার ছাড়া বলি না।”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না, আমি রোগীর কথা জানতে আসি নাই। আপনি কেমন করে রোগীর কথা বলেন সেটা জানতে এসেছি।”
আমার কথা শুনে মানুষটা হঠাৎ মুখ শক্ত করে আমার দিকে রুক্ষ চোখে তাকাল। কঠোর গলায় বলল, “সেটা শুনে আপনি কী করবেন?”
“আমি জানতে চাই।”
“সব জিনিস সবাই জানতে পারে না। আপনি বাড়িতে যান।” বলে লোকটা আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে তার খরিদ্দারদের জন্যে জিরা ওজন করতে শুরু করল।
আমি অবিশ্যি হাল ছেড়ে দিলাম না, লোকটার পেছনে একেবারে চিনেজোকের মতো লেগে রইলাম। কখনো কাকুতি-মিনতি, কখনো ভয়ভীতি, কখনো মিষ্টি কথা, কখনো শক্ত কথা কিছুই বাকি রাখলাম না। শেষ পর্যন্ত যে-জিনিসটা কাজে দিল সেটা হচ্ছে নগদ টাকা। আমি একবারও চিন্তা করিনি টাকা দিয়ে মানুষটাকে নরম করা যাবে, তাহলে প্রথম সেটা দিয়েই শুরু করতাম।
লোকটাকে নগদ দুই হাজার টাকা দেওয়ার পর টাকাগুলো গুনে ক্যাশবাক্সে রেখে বলল, “আমার পোষা শকসো আছে।”
“পোষা কী?”
“শকসো।”
“সেটা কী?”
“জিনের মতো কিন্তু জিন না। জিন তো আগুনের তৈরি, এটা আগুনের না। এইটা রক্তমাংসের। রক্ত খায়।”
“রক্ত খায়?”
“হ্যাঁ।”
“সেটা পায় কোনখানে?”
“শরীরের মাঝে থেকে চুষে নেয়।”
“কার শরীর থেকে?”
“আমার পোষা শকসো-আমার শরীর থেকে খায়।”
আমি গাঁজাখুরি গল্প শুনে হাসব না কাদব বুঝতে পারলাম না। মানুষটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। দুই দুই হাজার টাকা একেবারে অকারণে পানিতে ফেলে দিয়েছি বলে আফসোস হতে লাগল। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, “এই শকসো কী করে?”
“বেশি কিছু করতে পারে না। রোগ শোক হলে বলে দিতে পারে। ওষুধপত্র দেয় মাঝে মাঝে।”
“কেমন করে দেয়?”
“বলে দেয়।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “বলে দেয়? কেমন করে বলে?”
“এই তো আপনাকে আমি যেভাবে বলি।”
“তার মানে আপনি তাকে দেখতে পারেন।”
বুড়ো তার দাড়ি নেড়ে বলল, না দেখলে কথা বলব কেমন করে?”
আমি মুখ শক্ত করে বললাম, আমাকে দেখাতে পারেন?”
“নাহ্।” বুড়ো মাথা নেড়ে বলল, “অন্য কেউ থাকলে বের হয় না।”
“কেন বের হয় না?”
“সবকিছুর একটা নিয়ম আছে না? মানুষের নিয়ম মানুষের শকসোর নিয়ম শকসোর।”
আমি হতাশ হয়ে বললাম, “তার মানে আমি কোনোদিন দেখতে পারব না?”
“পারবেন না কেন? আপনি দেখতে চাইলে আপনি শকসো পোষেন।”
আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, “আমি পুষতে পারব?”
বুড়ো মানুষটা তার কোটরাগত চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “ইচ্ছা করলে মানুষ কী না পারে! তবে—”
“তবে কী?”
“শকসো পোষা কিন্তু কুত্তা-বিলাই পোষার মতো না।”
“বুঝতে পারছি।”
“বিপদ আছে।”
“বিপদ-আপদ আমার ভালোই লাগে।”
মানুষটা খুব শ্লেষের ভান করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ তাহলে তো ভালোই।”
তারপর তার ক্যাশবাক্সের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা জীর্ণ কাগজ বের করে আনল। এই প্রথমবার আমি লক্ষ করলাম তার ডান হাতটা পঙ্গু-শুকনো এবং শক্তিহীন, শুধু হাতে বুড়ো আঙুলটি বড় এবং অতিকায়। শুধু তা-ই নয়, দেখে মনে হলো আঙুলটি যেন তার নিয়ন্ত্রণে নেই, হঠাৎ হঠাৎ সেটি নড়ছে।
দুই হাজার টাকার বিনিময়ে আমি একটা জীর্ণ কাগজে লেখা একটি মন্ত্র এবং সেই মন্ত্রপাঠের কিছু নিয়মাবলি নিয়ে ফিরে এলাম। ডান হাতের বুড়ো আঙুলের নখে খানিকটা সরিষার তেল মাখিয়ে সেটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মন্ত্র পড়তে হবে। মন্ত্র পড়ার আরও
কিছু নিয়মকানুন আছে, গুরুপাক খাবার খাওয়া যাবে না, কাঁচা রসুন খাওয়া যাবে না, পরিষ্কার কাপড় পরে থাকতে হবে, অন্যকিছুতে মনোযোগ দেওয়া যাবে না, শুরু করতে হবে মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে ইত্যাদি ইত্যাদি। দীর্ঘ মন্ত্র, সেটা শুরু হয়েছে এভাবে :
আচাতন, কুচাতন গিলাবালী
মা মাকালী রাখাতালি শুশুতালি ফা
এর পরে আরও আঠারো লাইন। এটা কী ভাষায় লেখা, এর অর্থ কী কিছুই জানি না তবুও আমি শুরু করে দিলাম। আমার স্ত্রী খুব বিরক্ত হলো, কিন্তু আমি যখন শুরু করে দিয়েছি এখন তো এর শেষ না দেখে ছাড়তে পারি না। গভীর রাতে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরে বারান্দায় বসে ডান হাতের বুড়ো আঙুলে সরিষার তেল মাখিয়ে বিড়বিড় করে আচাতন কুচাতন’ পড়তে থাকি। এভাবে একদিন-দুদিন করে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেল, কিন্তু শকসোর দেখা নেই। আমি যখন মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছি যে ধড়িবাজ মানুষটা আমাকে ঠকিয়ে দুই হাজার টাকা মেরে দিয়েছে, তখন এক রাতে খুব বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। নখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়ছি, হঠাৎ মনে হলো আমার বুড়ো আঙুলটা যেন একটু নড়ে উঠল, মনে হলো আঙুলটা যেন আমার নিজের না, যেন অন্য কারও। আমি অবাক হয়ে দেখলাম নখের নিচে হঠাৎ করে কেমন যেন কালচে রং দেখা যাচ্ছে, হঠাৎ করে ব্যথা পেয়ে কালশিটে পড়ে গেলে যে রকম হয় অনেকটা সেরকম। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, মনে হলো বুড়ো আঙুলের ভেতরে কিছু-একটা নড়ছে, বিচিত্র একধরনের অনুভূতি। নখের মাঝে কালো রংটা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল এবং মনে হলো তার পেছন থেকে জীবন্ত কিছু-একটা নড়ছে। হালকা গোলাপি রঙের জিনিসটা নড়তে নড়তে স্পষ্ট হতে শুরু করে এবং ধীরে ধীরে সেটা একটা প্রাণীর রূপ নিতে থাকে। চেহারা দেখে মনে হয় অনেকটা মানুষের মতো, কিন্তু যেন পুরোপুরি মানুষ নয়। শুধু তা-ই নয়, আমার মনে হতে লাগল প্রাণীটা যেন আমার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি হঠাৎ ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম, মন্ত্র পড়া বন্ধ করে লাফিয়ে উঠে হাত ঝাঁকাতে শুরু করলাম যেন অশুভ এই প্রাণীটাকে ঝাঁকিয়ে হাত থেকে ফেলে দেওয়া যাবে। প্রায় সাথে সাথেই বুড়ো আঙুলের অসাড় হয়ে থাকা বিচিত্র অনুভূতিটা কমে গিয়ে সেটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। আমি তাকিয়ে দেখি নখটাও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, দেখে কে বলবে একটু আগে সেখানে বিচিত্র জীবন্ত কিছু-একটা দেখা গেছে!
ব্যাপারটা কি আসলেই ঘটেছে নাকি এটা আমার মনের ভুল আমি সে-ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম না, কিন্তু এই মাঝরাত্তিরে কেন জানি সেটা আর পরীক্ষা করে দেখার সাহস হলো না। সে-রাতে আমার ঘুম হলো ছাড়া-ছাড়া ভাবে, মাঝরাতে হঠাৎ ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে জেগে উঠলাম। পাশে আমার স্ত্রী শুয়েছিল, সে ভয় পেয়ে জেগে উঠে আমাকে ধরে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে তোমার?
আমি কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে কঁপা গলায় বললাম, ‘খুব ভয়ের একটা স্বপ্ন দেখছিলাম
কী স্বপ্ন দেখেছ?
ভয়ের স্বপ্ন দেখতে যে রকম ভয় হয় বলতে গেলে কিন্তু সেরকম হয় না-বরং সেটাকে কেমন জানি ছেলেমানুষি এবং হাস্যকর শোনায়। আমি তাই কিছু না বলে আবার শুয়ে পড়লাম।
পরদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে অবিশ্যি আমার কাছে গতরাতের পুরো ব্যাপারটাকেই ছেলেমানুষি আর হাস্যকর মনে হতে লাগল। নখের মাঝে একটা-কিছু দেখা নিশ্চয়ই চোখের ভুল ছিল। সেখানে সরিষার তেল মাখানোর জন্যে চকচক করছিল বলে হয়তো কোনো কিছুর প্রতিফলন পড়ছিল, মাঝরাত্তিরে উর্বর মস্তিষ্কের কল্পনায় সেটাকেই মনে হয়েছে বিদঘুঁটে কোনো প্রাণী-মসলার দোকানের বুড়োর ভাষায়-শকসো! ব্যাপারটা খানিকক্ষণ চিন্তা করে আমি মন থেকে দূর করে দিলাম।
পরবর্তী কয়েকদিন আমি কাজকর্ম নিয়ে খুব ব্যস্ত ছিলাম। শরীরটাও কেমন যেন ঠিক ভালো ছিল না, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক খেলে যেমন অস্থির লাগে সারাক্ষণই সেরকম লাগছিল। সমস্যাটা কোথায় ঠিক ধরতে পারছিলাম না, কিন্তু শুধু মনে হতে থাকে ডান হাতের বুড়ো আঙুলে কিছু-একটা হয়েছে। একদিন বেশ রাত করে বাসায় ফিরে এসেছি-আমার স্ত্রী তার এক দূরসম্পর্কের বোনের বিয়েতে গেছে, বাসায় আমি একা। রাত্রিবেলা ঘুমানোর আগে আমার হঠাৎ নখের মাঝে ছবি দেখার কথা মনে পড়ল। আমি নখের দিকে তাকিয়ে অনেকটা অভ্যাসের বশেই আচাতন-কুচাতন’ মন্ত্র পড়তে শুরু করে দিলাম এবং কী আশ্চর্য, সাথে সাথে হঠাৎ আমার বুড়ো আঙুলটা অসাড় হয়ে গেল, মনে হলো ওটার ভেতরে কিছু নড়ছে এবং দেখতে দেখতে বুড়ো আঙুলের নখটা কালচে নীল রঙের হয়ে গেল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, দেখতে পেলাম সেই কালচে নীল রঙের ভেতর থেকে একটা প্রাণীর চেহারা ভেসে আসছে, সেদিনের মতো এত অস্পষ্ট নয়, আজ এটি স্পষ্ট এবং এক কথায় ভয়াবহ।
নখের মাঝে ছোট একটি প্রাণী। কিন্তু সেটি স্পষ্ট, তার খুঁটিনাটি সব দেখা যাচ্ছে। প্রাণীটি মানুষের মতো, কিন্তু মানুষ নয়। এর উঁচু এবং আসমান কপাল, ভুরুহীন কুতকুতে চোখ, স্থির দৃষ্টি, ছোট নাক, নাকের ঠিক নিচেই বিস্তৃত একটা মুখ। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মুখটা হাঁ করল এবং দেখতে পেলাম দাঁতহীন জিবহীন সরীসৃপের মতো লালচে পিচ্ছিল একটা মুখ। আমার সমস্ত শরীর আতঙ্কে শিউরে উঠল।
আমার ইচ্ছে করল আতঙ্কে চিৎকার করে ছুটে পালাই, কিন্তু একজন মানুষ নিজের বুড়ো আঙুল থেকে কেমন করে ছুটে পালাবে? আমি অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করলাম, বিড়বিড় করে নিজেকে বললাম, “ভুল দেখছি। আমি নিশ্চয়ই ভুল দেখছি। আমি যদি চোখ বন্ধ করি তাহলে চোখ খুলে দেখব কিছুই নেই।”
আমি খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে আবার চোখ খুললাম, ভয়ে ভয়ে আবার বুড়ো আঙুলের দিকে তাকালাম, দেখতে পেলাম কুৎসিত প্রাণীটা এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হতবুদ্ধি হয়ে প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, ঠিক তখন প্রাণীটা মাথা নাড়ল ডান থেকে বামে তারপর বাম থেকে ডানে। প্রথমে ধীরে ধীরে তারপর দ্রুত। কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করা হলে সে যদি মাথা নেড়ে না বোঝাতে চায় অনেকটা সেরকম। প্রাণীটা হঠাৎ মাথা নাড়া বন্ধ করে মুখ হাঁ করল, আমি আবার তার দাঁতহীন জিবহীন লালচে মুখগহ্বর দেখতে পেলাম। প্রাণীটা স্থিরচোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমার ভুলও হতে পারে কিন্তু মনে হলো সেটি যেন কূর ভঙ্গিতে হাসল। তারপর হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি দীর্ঘ সময় একাকী বসে রইলাম, লক্ষ করলাম আমার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
পরদিন পুরান ঢাকায় সেই ঘিঞ্জি গলিতে গিয়ে বুড়ো মানুষটাকে খুঁজে বের করলাম। মানুষটা আমাকে দেখে তার পান-খাওয়া দাঁত বের করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “খবর ভালো?”
আমি ইতস্তত করে বললাম, “বুঝতে পারছি না।”
“শকসো কি এসেছে?”
“ইয়ে মানে নখের মাঝে দেখলাম—”
লোকটা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তার মানে এসেছে সাবধানে থাকবেন এখন। উলটাপালটা কিছু হলে বিপদ হতে পারে।”
“বিপদ?”
“হ্যাঁ।” বুড়ো মানুষটা দাঁত বের করে আবার হাসার ভঙ্গি করে বলল, “শকসো আপনার শরীরে বাসা তৈরি করছে। সেখানে থাকবে এখন থেকে। আপনার রক্ত খেয়ে বড় হবে। কাজেই ভালো করে খাবেন। মাছ, গোশত আর পালংশাক।”
আমি হতবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটা গলা নিচু করে বলল, “বেশি জানাজানি যেন না হয়। জানাজানি হলে অনেক সমস্যা।”
“কী সমস্যা?”
“লোকজন ভয় পায়। কাছে আসে না। আর লোকজনকে দোষ দেবেন কেমন করে,-ভয় পাওয়ারই তো কথা! প্রথম প্রথম আমারও ভয় লাগত।”
“এখন লাগে না?”
“না। অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনারও অভ্যাস হয়ে যাবে। তবে শকসোরে একটু কন্ট্রোলে রাখবেন। শরীরের ভেতরে সব জায়গায় যেতে দিবেন না। আপনি টের পাবেন শরীরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, নড়ছে, আপনি কন্ট্রোল করবেন।”
লোকটার কথা শুনে আমার সমস্ত শরীর গুলিয়ে এলো। আমি হতচকিতের মতো তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মানুষটা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “ভয় পাবার কিছু নেই। শকসো অনেক কাজে আসে। রোগশোক বালা মুসিবত বলতে পারে। তার কিছু সিগন্যাল আছে। যেমন ধরেন মাথা নাড়া–”
আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, “যদি ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ে তার অর্থ কী?”
লোকটা চমকে আমার দিকে তাকাল, বলল, “মাথা নেড়ে না করছে?”
“অনেকটা সেরকম।”
“সর্বনাশ!”
“কেন? কী হয়েছে? কথা বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে গেল।
“এইটার অর্থ খুব খারাপ। এইটার অর্থ কেউ-একজন মারা যাবে।”
“কে মারা যাবে?”
“শকসোকে ডাকার আগে আপনি যাকে ছুঁয়েছেন।”
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম সেদিন বাসায় ফেরার আগে আমি শেষবার কাকে ছুঁয়েছি। ক্লিনিকে আমার কোনো-একজন রোগী? কাগজ বুঝে নেবার সময় কোনো-একজন নার্স? ড্রাইভার? সিগারেটের দোকানের কমবয়সী ছেলেটা? আমি ভেবে পেলাম না।
বুড়ো মানুষটা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, “শরীরের মাঝে শকসো রাখা খুব বড় কাজ। জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে কিন্তু শকসো থাকলে সে ইঙ্গিত দেয়। বড় কঠিন ইঙ্গিত। আপনার হাতে সেই ইঙ্গিত-এটা খুব বড় দায়িত্ব। সাবধানে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে-নইলে কিন্তু গোনাগার হবেন।”
পুরান ঢাকার গিঞ্জি গলিতে মসলার দোকানের সেই বৃদ্ধের কথা আমি পুরোপুরি বিশ্বাস করিনি-বিজ্ঞান অনেক এগিয়ে গেছে, শরীরের ভেতরে রক্ত খেয়ে ভিন্ন কোনো প্রাণী বেঁচে থাকলে তাকে কোনো-না-কোনোভাবে ধরা সম্ভব, টেস্টটিউবে ভরে সেটাকে টিপেটুপে দেখা সম্ভব। নখের নিচে এসে কেউ ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিতে পারবে না। আমি নিজের চোখে দেখলেও সেটা বিশ্বাস করব না।
বাসায় এসেই অবিশ্যি আমার সেটা বিশ্বাস করতে হলো। আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছে-এইমাত্র তার খবর এসেছে। একটা এনজিওতে চাকরি করত, ময়মনসিংহ যাচ্ছিল, উলটো দিক থেকে একটা ট্রাক এসে ধাকা দিয়েছে। গাড়িতে চারজন ছিল-তিনজন সাথে সাথে মারা গেছে, চতুর্থজন হাসপাতালে এখনও সংজ্ঞাহীন। আমার বন্ধু তিনজনের একজন। আমার এখন মনে পড়েছে রাত্রিবেলা তার সাথে কথা বলে যাবার আগে পিঠে একটা থাবা দিয়ে এসেছিলাম-আমার হাতে তাকেই আমি শেষবার স্পর্শ করে এসেছিলাম। শকসো ঠিক ইঙ্গিতই দিয়েছে।
ঘটনাটি আমাকে সাংঘাতিকভাবে নাড়া দিল, শরীরের মাঝে বিদঘুঁটে একটা প্রাণী বাস করছে, মানুষের জীবন নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করছে, সেটা নিয়ে আমার খুব-একটা মাথাব্যথা হলো না-কিন্তু হাট্টাকাট্টা প্রাণবন্ত, একজন মানুষ যে একেবারে হঠাৎ করে মারা যেতে পারে সেটা আমার জন্যে গ্রহণ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ল।
যাই হোক, তারপর অনেকদিন কেটে গেছে, বুড়ো আঙুলে সেই অশরীরী প্রাণীর কথা আমি একরকম ভুলে গেছি, তখন একদিন ক্লিনিকে একটা রোগী এসেছে। কমবয়সী বাচ্চা, হৃৎপিণ্ডের ভাল্ব নিয়ে একটা সমস্যা হয়েছে, অত্যন্ত জটিল অপারেশন, আমাদের দেশে তখনও কেউ সেটা সাহস করে করছে অপারেশন করার আগের রাতে আমি তাকে দেখতে গিয়েছি, বিছানায় ম্লান মুখে শুয়ে আছে। আমি তার হাত স্পর্শ করলাম, হঠাৎ কী মনে হলো বিড়বিড় করে সেই মন্ত্র পড়তে শুরু করলাম, ‘ আচাতন কুচাতন গিলাবালী মা…
প্রায় সাথে সাথেই বুড়ো আঙুলে কুৎসিত সেই মাথাটা ফুটে উঠল। মাথাটি আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে কয়েকবার ওপরে-নিচে করল, কোনো কিছুতে সম্মতি জানাতে হলে আমরা যেভাবে মাথা নাড়ি। তারপর হঠাৎ করে সেটি অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমি ডাক্তার-মানুষ, আমার কুসংস্কার থাকা ঠিক নয়, কিন্তু তখন আমি কীভাবে জানি নিশ্চিত হয়ে গেলাম, যত কঠিনই হোক এই অপারেশন দিয়ে ছেলেটার প্রাণ বেঁচে যাবে।
পরদিন ছেলেটার সার্জারি হলো–দীর্ঘ সার্জারি–প্রায় ছয় ঘণ্টার মতো লাগল। অপারেশন থিয়েটার থেকে যখন বের হলাম আমরা এত ক্লান্ত যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, কিন্তু সবাই খুব খুশি। চমৎকারভাবে সার্জারি শেষ হয়েছে, ছেলেটা বেঁচে যাবে তাতে সন্দেহ নেই।
সত্যি ছেলেটা বেঁচে গেল। সপ্তাহ দুয়েক পর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেল। ঘটনাটায় আমার হয়তো খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি কেন জানি খুশি হতে পারলাম না। নিজেকে কেমন জানি একটা প্রতারক প্রতারক মনে হতে লাগল। যদি দেখতে পেতাম শকসোটা মাথা নেড়ে বলছে ছেলেটা বাঁচবে না, তাহলে কি আমি তার জন্যে এত শক্তি ব্যয় করতাম, নাকি দায়সারাভাবে কিছু-একটা করতাম?
ব্যাপারটা পরীক্ষা করার সুযোগ এসে গেল দুদিন পরেই। একজন রোগী অপারেশনের জন্যে অপেক্ষা করছে। জটিল অপারেশন, কিন্তু আমি আগে অনেক করেছি। সত্যি কথা বলতে কী, ঢাকা শহরে এই বিশেষ অপারেশনটির জন্যে আমার খানিকটা খ্যাতি আছে। ক্যাবিনে যখন কেউ নেই আমি রোগীটার হাত ধরে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তেই শরীরের ভেতরে একটা কম্পন অনুভব করলাম, মনে হলো সত্যি সত্যি কিছু-একটা শরীরের ভেতরে নড়ছে, হাত বেয়ে সেটা আমার নখের তলায় হাজির হলো। কুৎসিত প্রাণীটা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডান থেকে বামে মাথা নাড়ল। শকসোটা মনে করে রোগীটা বাঁচবে না।
আমার কেন জানি রোখ চেপে গেল, মনেমনে ঠিক করলাম যেভাবেই হোক একে বাঁচাতেই হবে। আমি রোগীর যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যতটুকু সম্ভব প্রস্তুত হয়ে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলাম। দীর্ঘদিন থেকে সার্জারি করছি, হাতে চাকু ধরামাত্রই নিজের ভেতরে কেমন জানি একটা আত্মবিশ্বাস অনুভব করি, আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না। জুনিয়র ডাক্তাররা মোটামুটি প্রস্তুত করে সরে গেছে, আমি কাজ শুরু করেছি, হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, আমার মনে হলো আমার বুড়ো আঙুলটা যেন জীবন্ত হয়ে গেছে তার ওপর যেন আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফোরসেপ দিয়ে ধরে যেই চাকু নামাতে যাই চাকুটা নড়ে যায়–কিছুতেই ঠিক জায়গায় বসাতে পারি না। জোর করে চেষ্টা করতেই হঠাৎ করে একটা বড় আর্টারি কেটে ফেললাম–গলগল করে রক্ত বের হয়ে এলো। বলা যেতে পারে আমার জীবনে এর থেকে বড় দুঃসময় আর কখনো আসে নি।
আমি নিজে অপারেশন চালিয়ে যেতে পারলাম না, জুনিয়র ডাক্তাররা জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে শেষ করল। আমি পুরোপুরি পরাজিত একজন মানুষের মতো ফিরে এলাম। রোগীটি যে ভোর হবার আগেই মারা যাবে সে-ব্যাপারে আমার নিজের কোনো সন্দেহ ছিল না।
বাসায় এসে আমি অন্ধকার বারান্দায় মুখ ঢেকে বসে আছি, তখন আমার স্ত্রী এসে আমার কাছে বসল। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”
আমি তখন খুব দুর্বল হয়ে আছি, পুরো ব্যাপারটা আমার ওপর এত ভয়ংকর চাপ সৃষ্টি করেছে যে সেটা আর নিজে নিজে সহ্য করতে পারছি না। আমি ঠিক করলাম আমার স্ত্রীকে সব খুলে বলতে হবে, কারো সাথে এই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের যন্ত্রণাটা ভাগাভাগি করে নিতে হবে।
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, “আমি তোমাকে আজ একটা কথা বলব। আমি ব্যাপারটা তোমার কাছে থেকে অনেকদিন গোপন রেখেছি।”
আমার কথা শুনে আমার স্ত্রী খুব অবাক হল না, নিচু গলায় বলল, “আমিও তোমাকে একটা কথা বলব যেটা আমি তোমার কাছ থেকে গোপন রেখেছি।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “কী কথা?”
“আগে তোমারটা বলো।”
আমি কিছু-একটা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু আমার স্ত্রী শান্ত চোখে বলল, “তুমি, আগে বলো। প্লিজ!”
আমি তখন একটা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে তাকে আমার গত কয়েকদিনের কথা বলতে শুরু করলাম। কেমন করে ব্যাপারটা শুরু হলো, কেমন করে সত্যি সত্যি বুড়ো আঙুলের নিচে কদর্য একটা মুখ ভেসে আসতে শুরু করল, কেমন করে সেটা মুত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করতে শুরু করল, কেমন করে আমাকে অপারেশন টেবিলে পুরোপুরি অকর্মণ্য করে তুলল, আমি কিছুই গোপন করলাম না।
সবকিছু শুনে আমার স্ত্রী হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি এটা বিশ্বাস কর?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “আমি বিশ্বাস করতে চাই না, কিন্তু তুমিই বলো আমি কেমন করে অবিশ্বাস করি?”
আমার স্ত্রী খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ভালোই হলো।”
“কী ভাল হলো?”
“তুমি বলে দিতে পারবে আমি বাঁচব কি বাঁচব না।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “কী বলছ তুমি?”
“আমি খুব অসুস্থ।”
“কী হয়েছে তোমার?”
“লিউকিমিয়া।”
আমি চমকে ওঠে বললাম “কী বলছ তুমি!”
“হ্যাঁ। আমি অনেকদিন থেকে পরীক্ষা করাচ্ছি। ব্লাড স্যাম্পল সিঙ্গাপুর থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনা হয়েছে। পজিটিভ।”
“আমাকে—আমাকে–তুমি এতদিন বলনি কেন?”
আমার স্ত্রী হাসার চেষ্টা করে বলল, “এই তো বললাম। আগে থেকে বললে তুমি আগে থেকে দুশ্চিন্তা করতে।”
“কিন্তু, কিন্তু–“
“কিন্তু কী?”
আমি কিছু না বলে হতবাক হয়ে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার স্ত্রী আমার গায়ে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, “তুমি জান এই লিউঁকিমিয়ার চিকিৎসা কী। কিমোথেরাপি। বড় কষ্ট এই চিকিৎসায় আমি জানি। যদি আমি বাঁচব না তাহলে এই কষ্টের। ভেতর দিয়ে আমি যেতে চাই না। জীবনের শেষ কয়টা দিন আমি একটু শান্তিতে কাটাতে চাই।”
আমি বিস্ফারিত চোখে আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সোজা হয়ে বসে বললাম, “কী বলছ তুমি এসব?”
“ঠিকই বলছি। আমার স্ত্রী তার হাতটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও। আমাকে ধরো। ধরে তুমি তোমার আচাতন কুচাতন মন্ত্রটা বলো।”
“না।”
“তোমাকে বলতে হবে।”
“না, কিছুতেই না।” আমি চিৎকার করে বললাম, কিছুতেই না। আমি এসব বিশ্বাস করি না।”
“আমি করি। আমার স্ত্রী আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “ অবুঝ হয়ো না। প্লিজ। বলো, আমি বাঁচব কি বাঁচব না।”
গল্পের ঠিক এ পর্যায়ে এয়ারপোর্টের পেজিং সিস্টেমে ঘোষণা দেওয়া হলো সিলেটগামী প্যাসেঞ্জাররা যেন ডিপারচার লাউঞ্জে এসে হাজির হয়। প্লেনটা এক্ষুনি ছাড়বে। ডাক্তার মাহবুব খন্দকার গল্প থামিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমিও ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর?”
তারপর দেখতেই পাচ্ছেন। ওয়াইফকে একটু বুঝিয়ে বাথরুমে গেলাম। হ্যাঁক স ছিল, ঘঁাচ করে বুড়ো আঙুলটা কেটে ফেললাম।”
আমি শিউরে উঠে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। ভদ্রলোক ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি পাশে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, “আপনার স্ত্রী?”
“সে ভালো আছে। পারফেক্ট। ফিট অ্যাজ এ ফিডল। লিউঁকিমিয়ার চমৎকার চিকিৎসা বের হয়েছে।” ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয় ভঙ্গিতে হাসলেন।
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে।”
“বলুন।”
“যখন আপনি বুড়ো আঙুলটা কাটলেন তখন শকসোটা কোথায় ছিল? কী হলো সেটার।”
ডাক্তার মাহবুব আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “ সেটা আরেক কাহিনী। বিমানমন্ত্রীর আরেক শালির বিয়ে না হলে সেটা বলে শেষ করা যাবে না।”