Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লিভিংস্টোন || Sankar Brahma

লিভিংস্টোন || Sankar Brahma

১).

টুকাইদের বাড়ির পাশেই ছোট একটা মাঠ আছে। মাঠের চারপাশটা ঝোপ-ঝাড় আর জঙ্গলে ভরা। মাঠ না বলে এটাকে ছোট এক চিলতে জমি বলাই ভাল। বিকেলবেলা টুকাইরা সেখানেই ক্রিকেট খেলে। ছোট্টু নিয়ে আসে তার ব্যাট, নিমু নিয়ে আসে উইকেট। আর টুকাই নিয়ে যায় তার বল। পিকলুরও একটা বল আছে, সেটা রাবারের। পিকলু মাঠে খেলতে এলে সেটা দিয়েই বরাবর খেলা হয়ে থাকে। টুকাই বলটা তার হাফ-প্যান্টের পকেটে করে মাঠে নিয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু সহজে পকেট থেকে বের করতে চায় না। কিছুদিন আগেই অনেক বায়না করে, মার কাছ থেকে সাতটা টাকা আদায় করে ক্যাম্বিস বলটা কিনেছে টুকাই স্কুলের পাশের দোকান ‘সনাতন স্টোর’ থেকে।
ব্যাট উইকেট হারাবার ভয় নেই। কিন্তু কেউ জোরে ব্যাট হাকালে বলটা ঝোপে-জঙ্গলে হারাবার ভয় থাকে। তাই টুকাই বলটা বের করতে চায় না। পিকলু মাঠে না এলে, বাধ্য হয়েই টুকাইকে পকেট থেকে ক্যাম্বিস বলটা বের করতে হয়। সেটা দিয়েই কয়েকদিন ধরে খেলা চলছে। পিকলু নৈহাটিতে তার মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে। ক’দিন ধরে তাই মাঠে আসছে না সে। আজ নিমুর করা একটা ঝুলন্ত বল টুকাই নিজেই ব্যাট দিয়ে এমন জোরে হাকাল যে বলটি গিয়ে পড়ল মাঠের ডান দিকের ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে। টুকাই ব্যাটটা মাঠে ফেলে রেখেই একছুটে বলটা খুঁজতে জঙ্গলে গেল। তারপর নিমু আর ছোট্টুও বলটা খুঁজতে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। তারা অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও বলটা পেল না কোথাও খুঁজে। এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে। অন্ধকারে আজ আর বলটা খুঁজে পাওয়া যাবে না বুঝেই ওরা ব্যাট আর উইকেট নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। টুকাই আরও কিছুক্ষণ খুঁজে দেখল জঙ্গলের মধ্যে। না সেও পেল না। জঙ্গল থেকে ফেরার সময় তার চোখে পড়ল একটা ঝোপের মধ্যে নীলাভ রঙের একটা পাখির ডিম। বেশ সুন্দর দেখতে। টুকাই স্কুলের বন্ধু শ্যামলের কাছে শুনেছো, তিতির পাখি এমন নীলাভ রঙের ডিম পারে। সে ঝুকে পড়ে ডিমটা হাতে তুলে নেয়। তুলে নিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখে, যেটাকে সে পাখির ডিম ভেবে ছিল, সেটা আসলে কোন ডিম নয়। একটা শক্ত পাথরের টুকরো ঠিক ডিমের আকারের। সেটা তুলে নিয়ে সে পকেটে রাখল। তারপর নগদ সাতটাকা দিয়ে কেনা বলটা হারাবার দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরল।
তারপর মাঠের প্যান্ট শার্ট ছেড়ে, হাত মুখ ধুয়ে ভাল জামা কাপড় পরে, বই নিয়ে পড়তে বসল। পড়তে পড়তে সে কখন যেন বলের দুঃখ ভুলে গেল। ভুলে গেল নীলাভ রঙের পাথরের ডিমটার কথাও। পড়া শেষ করে রাতের রুটি তরকারি খেয়ে, নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার বল হারানোর কথাটা মনে পড়ল। মনে পড়ে গেল সেই পাথুরে ডিমটার কথাও। বাথরুমে ঢুকে কালকের মাঠ থেকে ফিরে ছাড়া প্যান্টটার পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে কোথাও সেই পাথুরে ডিমটা খুঁজে পেল না। কি হলো তবে সেটা? মা কি তাহলে সেটা ফেলে দিয়েছে? ভাবল টুকাই।
মা তখন রান্না ঘরে চা করছিল। টুকাই বাথরুম থেকে বেরিয়ে, সেখানে গিয়ে মাকে বলল, মা তুমি কি বাথরুমে রাখা আমার প্যান্টের পকেটে কোন কিছু পেয়েছো?
– না তো, আমি তোমার ছাড়া প্যান্টে এখনও হাত দিইনি। কি জিনিষ পকেটে?
টুকাই তা শুনে তার কথার আর কোন উত্তর না দিয়ে ভাবল, তাহলে সেটা গেল কোথায়? মাঠ থেকে ফেরার সময় কি কোথাও পড়ে গেছে সেটা? তা কি করে হবে? গেট খুলে বাড়িতে ঢোকার সময়ও তো টুকাই পকেটে হাত দিয়ে সেটার অস্তিত্ব টের পেয়েছিল। টুকাই আশ্চর্য হয়ে ভাবতে থাকে।
মা তার পড়ার টেবিলে এসে তাকে দুধ রুটি খেতে দিয়ে, দাদুর ঘরে গেল তাকে চা আর বিস্কুট দিতে। বাবা এক্সিডেন্টে মারা যাবার পর, টুকাইরা এখানে থাকে দাদুর কাছে।

পড়া শেষ করে টুকাই স্নান খাওয়া সেরে স্কুলে চলে গেল। টুকাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। প্রথম পিরিয়ডে বাংলা, দ্বিতীয় পিরিয়ডে অংক ক্লাস হয় তার। দ্বিতীয় পিরিয়ডে শচীন স্যার ক্লাশে ঢুকে
বোর্ড পাঁচটা বিভিন্ন ধরণের অংক কষতে দিলেন। অংকেই টুকাইয়ের যত ভয়। আর সব মোটামুটি পারে। টুকাই অংক করার জন্য ব্যাগের চেন খুলে খাতা পেন বের করতে গিয়ে দেখলো, পাথুরে নীলাভ ডিমটা তার ব্যাগের ভিতরে এক কোনায় অবহেলায় পড়ে আছে। দেখে টুকাই আশ্চর্য হয়ে গেল। এখানে এটা এলো কি করে? সকালে কত খুঁজেছে এটাকে। খুঁজে কোথাও পায়নি। তবে কি টুকাই অবচেতন মনে মাঠ থেকে ঘরে ফিরে এটাকে স্কুলের ব্যাগের মধ্যে রেখে হাত পা ধুতে বাথরুমে ঢুকে ছিল? কই তার তো তেমন কিছু মনে পড়ছে না। টুকাই ব্যাগ থেকে পাথরটা বের করে হাতে নিয়ে স্পর্শ করে দেখছিল। শচীন স্যার সেটা দেখতে পেয়ে টুকাইকে তার কাছে পাথরটা নিয়ে যেতে বললেন। তার কাছে পাথরটা নিয়ে যেতেই, তিনি পাথরের ডিমটাকে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললেন, এটা দেখে তো মনে হচ্ছে ‘লিভিংস্টোন’ মানে জীবন্ত উপল। শুনেছি এই ধরনের পাথর নকি , আফ্রিকার কিলিমানজারো পাহাড়ে পাওয়া যায়। এই পাথর নাকি স্ব-ইচ্ছায় চলা-ফেরা করতে পারে, আবার কারও ভাগ্য ফেরাতে পারে। আমি অবশ্য এসব কথা বিশ্বাস করি না। যাক, এটা তুমি কোথায় পেলে?
– মাঠের পাশে জংলা মতো একটা ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা জায়গায়।
– বেশ, এটাকে রাখো এবার তোমার পকেটে। বলে, তিনি পাথরটা আবার টুকাইকে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, যাও এবার গিয়ে অংকগুলি করে নিয়ে এসো।
টুকাই পাথরটা ফেরৎ নিয়ে প্যান্টের ডান পকেটে রেখে বললো, আচ্ছা।
তারপর বোর্ড থেকে খাতায় অংকগুলি টুকে নিয়ে, তার সমাধান করে শচীন স্যারের টেবিলে খাতাটা জমা দিয়ে এলো, অন্যদের জমা করা খাতার উপরে।
সবার খাতা জমা হওয়ার পর, শচীন স্যার খাতাগুলি উল্টে নিয়ে, এক এক করে সব খাতাগুলি দেখে, টেবিলের উপরেই খাতাগুলি ডাই করে জমা রাখলেন। তারপর নতুন অংশ শেখাতে শুরু করলেন। নিয়ম হচ্ছে শচীন স্যার ক্লাস শেষ করে পিরিয়ডের ঘন্টা বাজার পরে চলে গেলে পরে, এক এক করে য়ে যার খাতা, নাম দেখে নিয়ে আসে। টুকাই খাতা নিয়ে ফিরে এসে দেখলো, স্যার তার সমাধান করা সব অংকে রাইট চিহ্ন দিয়ে, খাতার নীচে ‘ভেরি গুড’ লিখে তার সই ও তারিখ দিয়েছেন। এমনটা সাধারণত ঘটে না। বোর্ডে কষতে দেওয়া অ্যকের দু’তিনটার বেশি অংকের সমাধান সে ঠিক করতে পারে না। আজ সব অংকগুলিই তার ঠিক হয়েছে, এসব লিভিং স্টোনের কারসাজি নয় তো ! হতেই পারে, ভাবে টুকাই।

২).

নিবারণ বাবুর বয়স হয়েছে। বারো বছর আগে অবসর নিয়েছেন। এখন সারাদিন ঘরে বসেই কাটান। ইচ্ছে হলে কোন কোন দিন বিকেলবেলা একটু হাঁটতে বের হন। বেশী দূর হাঁটতে পারেন না। বেশীক্ষণ হাঁটলে দু’পায়ের পেশিতে টান ধরে, দু’পাশের পাঁজরা দু’টো ব্যথা করে ওঠে। তাই কিছুক্ষণ হেঁটেই বাড়ি ফিরে আসেন।

এই মাসেই একবার লাইফ সার্টিফিকেট জমা দিতে ব্যাঙ্কে যেতে হবে। অবসরের পর প্রথম প্রথম কয়েক বছর বেশ উৎসাহ ছিল লাইফ সার্টিফিকেট ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার। আজকাল তা হ্যাপা মনেহয়।
ব্যাঙ্কের ছেলে ছোকরারা আজকাল বয়স্ক মানুষদের তেমন পাত্তা দেয় না। মনে মনে বুড়ো-হাবড়া ভাবে। কোন কাজে তাদের কাছে গেলে কোন সহযোগিতা পাওয় যায় না, বরং তাদের আচরণে অপমানের ছিটে থাকে।
নিবারণ বাবু ‘অডিট জেনারেল অব বেঙ্গল’-য়ে কাজ করতেন। তার কাছেও বয়স্ক কত লোক আসত কাজ নিয়ে। তিনি তাদের হাসি মুখে সমানের চেয়ারে বসাতেন। তারপর তাদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনে সাধ্য মতো সমাধান করার চেষ্টা করতেন। তার মতো অনেকেই এসব করতেন সেসময়। তিনি বিশেষ কিছু করতেন না।
আর আজকাল কী হয়েছে, তরুণ হালচাল। দেখলে অবাক লাগে। প্রথম প্রথম দেখে খুব রাগ হতো। আজকাল আর হয় না। বরং করুণা হয় তাদের কথা ভেবে, মনে পড়ে সেই প্রবাদ-কথা ‘ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে ‘।
তাদেরও একদিন নিবারণ বাবুর মতো বয়স হবে, তাদেও লাইফ সার্টিফিকেট ব্যাঙ্কে জমা যেতে হবে পেনশনের জন্য। তাদের সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের কর্মীরা কী ধরণের আচরণ করবে তাদের সঙ্গে তারা তা ভাবে না? নিবারণ বাবু ভেবে শিউরে ওঠেন।
নিবারণ বাবু টুকাইয়ের দাদু হন। দিদিমা মারা যাওয়ার পর একটু সিনিক (নিন্দুক) হয়ে পড়েছেন। কোন কিছুর মধ্যের ভাল কিছু দেখতে পান না। সব কাছের মধ্যেই সকলের দোষ খুঁজে বেড়ান।
দাদুর লাইফ সার্টিফিকেট ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে বলে মা টুকাইকে নিয়ে সেদিন দাদুর সঙ্গে গাঙ্গুলিবাগান ব্যাঙ্কে গেলেন। দাদুকে নিয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকে দেখলেন, কাউন্টারে বাবার বন্ধু নিতাই কাকু বসে আছেন। টুকাইয়ের বাবাও ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন। মা নিতাই কাকুর কাছে গিয়ে দাদুর লাইফ সার্টিফিকেট জমা দেওয়ার ব্যাপারে কথা বললেন। নিতাই কাকু মাকে হাত জোড় করে নমস্কার করল। তারপর দাদুর পেনশন বই দেখে অনলাইনে দাদুর লাইফ সার্টিফিকেট জমা করে নিলেন। দাদুর কোন সই সাবুদ লাগল না। আমি আর দাদু বসে রইলাম চেয়ারে। মা লাইফ সার্টিফিকেট জমার প্রিন্ট আউট হাতে নিয়ে দাদুর কাছে এসে বললো, চলো বাবা তোমার লাইফ সার্টিফিকেট জমা হয়ে গেছে। মার কথা শুনে দাদু আশ্চর্য হয়ে বললো কী ! আমি কোন সই-সাবুদ করলাম না আর আমার লাইফ সার্টিফিকেট জমা হয়ে গেল? মার কথা বিশ্বাস হচ্ছিলো না দাদুর। মা তখন দাদুর হাতে প্রিন্ট আউটের রিসিট কপিটা দেখিয়ে বললো, এই দেখো। দাদু সেটা হাতে নিয়ে, পাঞ্জাবির পকেট থেকে চশমাটা বের করে, চোখে পরে, সেটা পড়ে দেখলেন। পড়ে খুশি হয়েছেন বলে, মনে হলো না দাদুর চোখ মুখ দেখে। এতো সহজে কাজটা হয়ে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি।
টুকাই বুঝতে পারে এর রহস্যটা। তার পকেটে যে
জীবন্ত উপল-টা (লিভিংস্টোন) আছে। দাদু সেটা জানে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress