Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাত ফুরোল, কথা ফুরোল || Anish Deb

রাত ফুরোল, কথা ফুরোল || Anish Deb

কোনও মেয়েকে একান্তে চুমু খেতে যাওয়ার মুহূর্তে যদি দরজায় কলিংবেল বেজে ওঠে তা হলে কে না বিরক্ত হয়!

সুতরাং আমিও বিরক্ত হলাম।

সুচরিতার প্রস্ফুটিত ঠোঁট আমার চোখের সামনে ক্লোজ আপে ভাসছিল। ঝিম ধরিয়ে দেওয়া কেমন একটা গন্ধ ওর শরীর থেকে বিকিরিত হয়ে আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। কিন্তু কলিংবেলের শব্দে আমার চোয়াল শক্ত হতেই সুচরিতা সেটা টের পেল। আলতো গলায় ও বলে উঠল, এই ফ্ল্যাটে নয়–ওদিকের ফ্ল্যাটে কেউ বেল বাজাচ্ছে।

ওর অবস্থা আমি বুঝতে পারছিলাম..ঠিক আমার মতোই।

কলিংবেল অধৈর্য সুরে আবার বেজে উঠল। কোনও ভুল নেই আমার ফ্ল্যাটেই।

এরপর আর বিছানায় শুয়ে থাকা যায় না। সুতরাং বিরক্তির একটা শব্দ করে উঠে পড়লাম। ছোট্ট করে তীক্ষ্ণ শিস দিতেই অটোমেটিক অডিয়ো কন্ট্রোল ঘরের আবছা আলো ধীরে-ধীরে জোরালো করে দিল। ধবধবে সাদা বিছানায় সাপের মতো এঁকেবেঁকে শুয়ে থাকা ধবধবে ফরসা সুচরিতাকে একপলক দেখলাম। তারপর মনে-মনে নিজের পছন্দের তারিফ করলাম।

আমি বাইরের ঘরের দিকে রওনা হতেই সুচরিতা অস্পষ্ট গলায় পিছন থেকে বলল, ম্যানেজ করে জলদি চলে এসো।

আমি হাতঘড়ির বোতাম টিপতেই টকিং ওয়াচ মিষ্টি মেয়েলি গলায় বলে উঠল, এখন রাত দশটা বেজে আটাশ মিনিট বারো সেকেন্ড।

এত রাতে কে এল আমাকে ডাকতে!

একথা ভাবতে-ভাবতে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। পাশের স্ট্যান্ড থেকে রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটটা তুলে নিয়ে দরজা লক্ষ করে একটা বিশেষ বোতাম টিপলাম। সঙ্গে-সঙ্গে দরজার একটা অংশ চৌকো জানলার মতো স্বচ্ছ হয়ে গেল। এর মধ্যে দিয়ে ভেতর থেকে বাইরেটা দেখা যায়, কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যায় না।

বাইরে দাঁড়ানো দুজন লোককে আমি দেখতে পেলাম। আর সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারলাম, এদের ম্যানেজ করে জলদি সুচরিতার কাছে ফিরে যাওয়া যাবে না। জানলাটাকে আবার অস্বচ্ছ করে দিলাম।

লোক দুজন বোধহয় হোমিসাইড স্কোয়াডের সাদা পোশাকের অপারেটর। ওদের পোড় খাওয়া চেহারা, ঠান্ডা চোখ অন্তত সে কথাই বলছে। ওরা কি তা হলে শ্রাবন্তীকে খুঁজে পেয়েছে? কিন্তু তার সঙ্গে আমাকে জড়াল কেমন করে। সেরকম কোনও চিহ্ন তো আমি ফেলে আসিনি!

রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটের অন্য একটা বোতাম টিপতেই বন্ধ দরজা নিঃশব্দে পাশে সরে গেল। আমি এবার ওদের মুখোমুখি।

ওদের সাজপোশাক প্রায় একই ধাঁচের–চেহারাও অনেকটা তাই।

চাপা জিনসের প্যান্ট, ঢোলা সুতির জামা, চোখে কালো সানগ্লাস। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, কপালে ভাঁজ, চোয়ালের হাড় উঁচু। একজনের বাঁকানের লতিতে একটা সোনার রিং চকচক করছে।

আপনিই অমিত মজুমদার? দুজনের একজন জানতে চাইল।

আমি শান্তভাবে ঘাড় নেড়ে জানালাম, হ্যাঁ।

আমরা হোমিসাইড স্কোয়াড থেকে আসছি লেজারে হলোগ্রাম করা একটা ছোট্ট কার্ড আমার চোখের সামনে তুলে ধরল প্রথমজন : এত রাতে আপনাকে ডিসটার্ব করার জন্যে দুঃখিত। আপনাকে একবার আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।

কেন? কী ব্যাপার?

মার্ডার কেস। শ্রাবন্তী সেন নামে একটা ইয়াং মেয়ের লাশ আমরা কাল সকালে পেয়েছি। গঙ্গায় পাওয়া গেছে। গলা টিপে মার্ডার করে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়েছে। বডিটা জেটির নীচে আটকে গিয়েছিল, তাই ভেসে যায়নি।

আমি ভেতরে-ভেতরে নিজেকে সামলে নিলাম। বিব্রতভাবে বললাম, আসুন, ভেতরে এসে বসুন।

প্রথমজন ঠান্ডা গলায় জবাব দিল, বসার টাইম নেই। চলুন, হেডকোয়ার্টারে গিয়ে কথা হবে।

এক মিনিট। আমি চট করে রেডি হয়ে আসছি।

মেক ইট কুইক।

ওদের দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে আমি সুচরিতার কাছে চলে গেলাম। ওর খোলা পিঠে একটা চুমু খেয়ে পোশাক ঠিকঠাক করে নিলাম। মাথা আঁচড়ে গায়ে বিদেশি কোলোন স্প্রে করে নিলাম। তারপর আয়নায় নিজের চোখে তাকিয়ে চাপা গলায় বললাম, সাবধান, যেন কোনও ভুল না হয়। সিরিয়াল কিলারদের ভুল করলে চলে না।

একবার সুচরিতার দিকে তাকালাম। ও একইভাবে বিছানায় শুয়ে আছে। বোধহয় আমার কথাটা শুনতে পায়নি। অবশ্য পেলেও তার মানে বুঝতে পারবে না। যখন বুঝবে তখন আর কিছু করার থাকবে না–অনেক দেরি হয়ে যাবে।

সুচরিতাকে বললাম, লাভ, আমি ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই আসছি। পুলিশ একটা মার্ডার কেসে ভুল করে আমাকে হ্যারাস করতে এসেছে। তুমি চিন্তা কোরো না নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।

সুচরিতা শরীরটাকে আধপাক ঘুরিয়ে অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে আমার দিকে তাকাল।

–আমি এসে তোমার ঘুম ভাঙাব। ওর দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করলাম আমি।

ফ্ল্যাটের বাইরে এসে দরজার পাশে দেওয়ালে বসানো অটোমেটিক ভয়েস লক সিস্টেমের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম, ফ্ল্যাট লক করে দাও।

যন্ত্র তার সূক্ষ্ম বিচারে মালিকের কণ্ঠস্বর নিখুঁতভাবে চিনতে পারল। সঙ্গে-সঙ্গে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমার গলায় খোলার নির্দেশ না পেলে এই দরজার লক আর খুলবে না।

ওরা দুজন পাথরের মূর্তির মতো অপেক্ষা করছিল। আমি চলুন বলতেই রোবট দুটো যেন সাড় ফিরে পেল। নিঃশব্দে দুজন আমার দুপাশে চলে এল। আমরা এলিভেটরের দিকে রওনা হলাম।

বাইরের রাস্তায় এসে গাড়িতে ওঠার সময় ওদের একজন আমাকে জিগ্যেস করল, মিস্টার মজুমদার, শ্রাবন্তী সেনকে আপনি চিনতেন?

আমি শ্রাবন্তীকে চিনতাম–বেশ অন্তরঙ্গভাবেই চিনতাম। তাই নির্লিপ্ত গলায় বললাম, না–।

সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা তার পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে সঙ্গীর হাতে তুলে দিল, বলল, বর্ধন, তুমিই জিতলে–আমি হেরে গেলাম।

আমাকে অবাক হতে দেখে বর্ধন হেসে বলল, মিস্টার মজুমদার, আপনার এখানে আসার সময় বিশ্বাসকে আমি বলেছিলাম, শ্রাবন্তী সেনকে চেনার ব্যাপারটা আপনি ডিনাই করবেন। ও আমার কথা মানতে চায়নি, তাই আমার সঙ্গে একশো টাকা বাজি ধরেছিল– জিভে দুঃখের চুকচুক শব্দ করে আবার হাসল বর্ধন ও বিশ্বাস, বেকার তোমার একশোটা টাকা গেল।

গাড়ির পেছনের সিটে আমাকে মাঝখানে রেখে বর্ধন আর বিশ্বাস দুপাশে বসল। ওদের লুকোনো ব্লাস্টার গান আমার কোমরে খোঁচা দিচ্ছিল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে এগোতেই বর্ধন চাপা গলায় বলল, মিস্টার মজুমদার, শ্রাবন্তীকে আপনি চিনতেন…আমাদের হাতে মারাত্মক প্রমাণ রয়েছে।

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বর্ধনের দিকে তাকাতেই বাঁ-পাশ থেকে বিশ্বাস বলে উঠল, অমন ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটাকে খুন করলেন কেন বলুন তো!

আমি অসহায়ভাবে বলে উঠলাম, আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে শ্রাবন্তীকে আমি চিনি না।

হেডকোয়ার্টারে গিয়ে দাওয়াই দিলেই সব বেরিয়ে পড়বে। দাঁতে দাঁত চেপে বর্ধন মন্তব্য করল।

আমি নিরুপায় হয়ে গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা আমার মুখে দক্ষ হাতে তুলির আঁচড় কাটছিল। আর আমার মনে পড়ছিল ফুটফুটে মেয়েগুলোর কথা।

গত চারমাসে কলকাতার নানা জায়গায় এগারোজন তরুণীর মৃতদেহ পাওয়া গেছে। ওদের প্রত্যেককেই গলা টিপে খুন করা হয়েছে। খুন করেছি আমি। না, আসলে ঠিক আমি না–আমার ভেতর থেকে একটা অচেনা খুন-পাগল লোক এই জঘন্য কাজগুলো করে। চারমাস আগে আমার মাথার ভেতরে ওই পাগলটা প্রথম জেগে ওঠে। খুন করে রত্নাকে। তারপর একে একে মাধুরী, সুজাতা, নয়না, সুন্দরী, প্রথমা, সাগরিকা…সব নাম আমার মনে নেই। সংখ্যাটা যে মনে আছে তার কারণ ইন্টারনেট নিউজে প্রায় প্রতিদিনই এ-নিয়ে খবর বেরোয়–তাতে বারবার করে ওরা সংখ্যাটা আমাকে জানিয়ে দেয়–পাছে আমি ভুলে যাই। ওরা আমার নাম দিয়েছে–মানে, আমার ভেতরের ওই পাগলটার নাম দিয়েছে সিরিয়াল কিলার ধারাবাহিক খুনি। একজন রসিক সাংবাদিক এমন মন্তব্যও করেছে, এই সিরিয়ালের সবে এগারোটা এপিসোড হয়েছে, কত এপিসোডে শেষ হবে কে জানে!

আমার হাসি পেল। কটা এপিসোডে এই সিরিয়াল যে শেষ হবে তা আমিও জানি না। জানে আমার মাথার ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ওই পাগলটা। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, আজ কিংবা কাল রাতে সুচরিতাকে নিয়ে পাগলটার বারো নম্বর এপিসোড শেষ করার কথা।

শ্রাবন্তীর কথা মনে পড়ল আমার। শ্রাবন্তীকে আমি যে ভালো করেই চিনতাম তার কী মারাত্মক প্রমাণ পেয়েছে ওরা? এর আগের খুনগুলোর বেলায় পুলিশ আমাকে কোনও সন্দেহ করেনি, কোনওদিন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেও আসেনি। কিন্তু এইবার যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই ওদের হাতে কোনও-না-কোনও সূত্র আছে। অর্থাৎ, কোথাও একটা ভুল করে ফেলেছি আমি। কিন্তু কী সেই ভুল?

লালবাজারে হোমিসাইড স্কোয়াডের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছোতেই আমার ভাবনায় বাধা পড়ল। মনে-মনে নিজেকে তৈরি করে নিলাম। সতর্কতা বাড়িয়ে দিলাম দশ গুণ।

গাড়িতে অটোমেটিক প্রোগ্রাম করাই ছিল। তাই ড্রাইভার হাত গুটিয়ে বসে থাকলেও গাড়িটা হিসেবমতো নিখুঁত বাঁক নিয়ে একটা নির্দিষ্ট পার্কিং স্পেসে গিয়ে দাঁড়াল। গাড়ির ভয়েস রেসপন্স সিস্টেম বলে উঠলঃ আমরা গন্তব্যে এসে গেছি।

ড্রাইভার কী-একটা বোতাম টিপতেই হাইড্রলিক কন্ট্রোল নিঃশব্দে দুটো দরজা খুলে দিল। আমরা তিনজন নেমে পড়লাম।

এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে আমি চারপাশটা দেখতে লাগলাম।

লালবাজারের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে আগে কখনও আমি আসিনি। এর সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে বহুবার গেলেও ভেতরে এই প্রথম। কেন জানি না, আমার বুকের ভেতরে একটা অচেনা পেন্ডুলাম ঢং-ঢং করে বাজছিল।

পাথর বাঁধানো বিশাল পার্কিং স্পেসে প্রায় দেড়-দু-ডজন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। জায়গায়। জায়গায় লাগানো হ্যালোজেন বাতি সুন্দর আলোর বৃত্ত তৈরি করেছে। বৃত্তের বাইরেটা আবছা অন্ধকার।

উঠোনের মাঝে একটা লাস্যময়ী নাচিয়ে ফোয়ারা। তার নাচের তালে-তালে লুকোনো বাজনা নীচু গ্রামে বাজছে। বাজনার সঙ্গে তাল রেখে চলছে লাল-নীল-হলদে-সবুজ আলোর খেলা।

উঠোনকে ঘিরে প্রায় বিশতলা উঁচু চারটে বিশাল বাড়ি। বাড়ির দেওয়ালগুলো যেন সানগ্লাসের কাচ দিয়ে তৈরি। বাড়ি লক্ষ করে অনেকগুলো হ্যালোজেন ফোকাস লাগানো রয়েছে। বাড়ির কাচের দেওয়াল সেই আলো আয়নার মতো ঠিকরে দিচ্ছে।

এই সুন্দর-সুন্দর বাড়ির ভেতরেই চলে অপরাধীকে শায়েস্তা করার নোংরা কাজ।

রাত বেড়েছে, তাই লোকজন কম চোখে পড়ল। আমি বর্ধনের দিকে তাকাতেই সে বলল, আমাদের সঙ্গে আসুন।

বিশ্বাস ওর বাঁ কানের সোনার রিংটা নাড়াচড়া করছিল, আমার চোখে চোখ পড়তেই বাঁকা হাসল।

আমরা তিনজনে দ্বিতীয় বাড়িটার দিকে এগোলাম। শানবাঁধানো চাতালে আমাদের জুতোর শব্দ ফোয়ারার বাজনার সঙ্গে মিশে গেল।

বাড়ির ভেতরে ঢুকে দুটো ভয়েস লক দরজা পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম অটোমেটিক এলিভেটরের কাছে। এলিভেটর আমাদের নিয়ে গেল এগারোতলায়। সেখানে আধুনিক ছাঁদে তৈরি গোলকধাঁধার মতো গোটাপাঁচেক অলিন্দ পেরিয়ে পৌঁছোলাম একটা ঘরে। ঘরের দরজায় লাগানো লাল রঙের ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে জানিয়ে দিচ্ছে ঘরটার নাম : ইন্টারোগেশান রুম।

ঘরের চারদিকে অসংখ্য অচেনা যন্ত্রপাতি। তার মাঝে ন্যাড়া মাথা, পরনে কালো চামড়ার জ্যাকেট, কুতকুতে চোখ, আর ফরসা চেহারার যে-মানুষটি বসে আছে, তাকেও প্রথমটায় যন্ত্র বলে ভুল হল আমার।

আসুন, মিস্টার মজুমদার…বেশিক্ষণ আপনাকে আটকে রাখব না। শঙ্খচূড় সাপ যদি কথা বলতে পারত তা হলে সে বোধহয় এইভাবেই কথা বলত। কথাটা বলে যন্ত্রের চেহারার মানুষটি হাসল। হাসি মানে তার ঠোঁটের রেখা সামান্য চওড়া হল, দু-একটা ভাঁজ পড়ল ঠোঁটের কোণে।

বিশ্বাস আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, এখন আপনি জোয়ারদারসাহেবের প্রপার্টি। এ-ঘরে ঢোকার আগে আর পরে মানুষ একরকম থাকে না। আমরা দুজন স্রেফ সাক্ষীগোপাল হয়ে ওঁর গান অনুযায়ী তাল দেব।

ঘরের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উষ্ণতাকে বোধহয় দশ-বারো ডিগ্রির কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে থাকবে, কারণ আমার বেশ শীত করছিল।

জোয়ারদার তীক্ষ্ণ চোখে আমাকে জরিপ করতে করতে বলল, বসুন।

একটা আধুনিক টেবিলকে মাঝখানে রেখে আমি জোয়ারদারের মুখোমুখি বসলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে টের পেলাম, বিশ্বাস আর বর্ধন আমার ঠিক পেছনে অ্যাটেনশান হয়ে দাঁড়িয়ে।

জোয়ারদার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিলের ডানদিক ঘেঁষে রাখা একটা কম্পিউটারের কয়েকটা বোতাম টিপল। চোখ সরু করে মনিটরে কী দেখল কে জানে! তারপর সাপের মতো কেবল লাগানো একটা মাউথপিসের মতো যন্ত্র কম্পিউটারের পাশ থেকে তুলে নিয়ে বলল, বর্ধন, ওঁকে স্ক্যান করো।

বর্ধন চট করে চলে গেল জোয়ারদারের পাশে। ওর হাত থেকে মাউথপিসটা নিয়ে আমার কাছে এল। তারপর আমার বাঁ-হাতের কবজির ওপর যন্ত্রটা না ছুঁইয়ে বুলিয়ে নিল। জোয়ারদার তখনও ঠান্ডা চোখে কম্পিউটারের পরদার দিকে তাকিয়ে।

এখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষের বাঁ-হাতের কবজিতে একটা করে পারসোনাল ইনফরমেশান মাইক্রোচিপ বসানো থাকে। সেটা বাইরে থেকে দেখা যায় না। তবে স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করলে তার যাবতীয় তথ্য কম্পিউটারের পরদায় ফুটে ওঠে। আমারও উঠল।

জোয়ারদার যেন একটু অবাক হয়েই জিগ্যেস করল, মিস্টার মজুমদার, কিড স্ট্রিট ব্রাঞ্চের স্পার্ম ব্যাঙ্কে সেভেন্টি এইটে আপনার জন্ম?

আমার জন্মতারিখ ২২ জানুয়ারি ২০৭৮ সাল। আর স্পার্ম ব্যাঙ্কে, মানে, ল্যাবরেটরিতে জন্ম হওয়াটা প্রায় ষাট বছর হল স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সুতরাং জোয়ারদারের প্রশ্নের মানে বুঝতে পারলাম না। তবুও শান্তভাবে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।

ইন্টারেস্টিং। থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বলল জোয়ারদার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখল আমি কোনও কথা বললাম না তখন টিভিতে খবর পড়ার মতো নিপ্রাণ ভঙ্গিতে বলল, সেভেন্টি এইটে কিড স্ট্রিটের ব্রাঞ্চে একটা ইনফেকশানের ব্যাপার হয়েছিল। ফলে সে-বছর ওই ব্যাঙ্ক থেকে প্রচুর অ্যাবনরমাল বেবির জন্ম হয়েছিল।

আপনি কি বলতে চান আমি অ্যাবনরম্যাল?

জোয়ারদার ঘাড় কাত করে ভুরু উঁচিয়ে আমাকে দেখল, তারপর চেয়ারে বসে পড়ল ও না, না–আপনি অ্যাবনরমাল হবেন কেন! কিন্তু গত চারমাস ধরে যে-সিরিয়াল কিলার কলকাতার আনাচেকানাচ ঘুরে বেড়াচ্ছে সে যে অ্যাবনরমাল সেটা তো মানবেন।

একটা খুন-পাগল মানুষ অস্বাভাবিক হবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মধ্যে তো সেরকম কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নেই। শুধু মাঝে-মাঝে যা একটু ওই মেয়েগুলোকে খতম করতে ইচ্ছে করে।

সিরিয়াল কিলারের অ্যাবনরমাল হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। জোয়ারদারের কথার উত্তর দিলাম।

হাসল জোয়ারদার, বলল, তা হলে তার জন্ম আটাত্তর সালে হতেও পারে। যখন কিড স্ট্রিটের স্পার্ম ব্যাঙ্কে ওই ইনফেকশানের ব্যাপারটা হয়েছিল…।

আপনি কী বলতে চান স্পষ্ট করে বলুন জোয়ারদারের হাসির ধরনটা আমার মাথার ভেতরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছিল।

সেটা বোধহয় জোয়ারদার বুঝতে পারল। তাই আরও নোংরাভাবে হেসে শক্ত গলায় বলল, আমি যা বলতে চাই বেশ স্পষ্ট করেই বলেছি। অন্তত আপনার না বোঝার কথা নয়। এখন আপনার স্পষ্ট উত্তর দেওয়ার পালা। আপনি শুধু স্বীকার করুন যে, শ্রাবন্তী সেনকে আপনি চিনতেন।

আমি বিদ্রোহী ভঙ্গিতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বর্ধন আর বিশ্বাসের দিকে একপলক তাকিয়ে জোয়ারদারকে বললাম, আমি শ্রাবন্তী সেনকে চিনি না। একটু আগেই ওঁদের সে কথা বলেছি। আপনাদের কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

বসুন, মিস্টার মজুমদার, অযথা উত্তেজিত হবেন না। হম্বিতম্বি করে একটু-আধটু রাগ দেখালেই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আপনি যে মিস সেনকে চিনতেন তার মারাত্মক প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। কলকাতার সিরিয়াল কিলারকে ধরার চেষ্টাটা আমি সেখান থেকেই শুরু করতে চাই। আপনি নিজে থেকে সবকিছু বলে আমাকে সাহায্য করলে আপনারও সুবিধে হবে।

কীসের সুবিধে?

হাত নেড়ে ঘরের আধুনিক সব যন্ত্রগুলোর দিকে ইশারা করে জোয়ারদার বলল, সুবিধে হবে এটাই যে, এইসব খারাপ-খারাপ যন্ত্রগুলো আপনার ওপরে আমাকে ব্যবহার করতে হবে না।

আমি চেয়ারে বসে পড়লাম আবার। হাত-পায়ের জোর যেন হঠাৎই কমে গেছে বলে মনে হল।

জোয়ারদার বিশ্বাসকে লক্ষ্য করে বলল, বিশ্বাস, আমাদের তৈরি কমপ্যাক্ট ডিস্কটা মজুমদারবাবুকে দেখাও।

ওর কথার নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের ছুরি যেন আমার শরীরে সত্যি-সত্যিই কেটে বসল।

বিশ্বাস ঘরের একটা যন্ত্রের কাছে গেল। সেখানে কয়েকটা বোতাম টিপতেই ঘরের সামনের দেওয়ালের একটা চৌকো মাপের অংশ আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর আমাকে অস্বস্তিতে ফেলে দিয়ে শুরু হল এগারো এপিসোডের টিভি সিরিয়াল। রত্না, মাধুরী, সুজাতাকে দিয়ে শুরু হয়ে শেষ হল শ্রাবন্তীকে দিয়ে। জীবন্ত ছবির সঙ্গে সেখানে তাল মিলিয়ে চলল পেশাদারি হাতে তোলা সাউন্ডট্র্যাক।

সিডি-তে জীবন্ত ছায়াছবি দেখতে-দেখতে আমার ভেতরে একটা কষ্ট টের পাচ্ছিলাম। এগারোজন তরুণীকে খুন করেছি আমি! এ আমি কী সাংঘাতিক পাপ করেছি। ছিঃ ছিঃ!

আমি রুমাল বের করে চোখের কোণ মুছে নিলাম। দেওয়ালের পরদায় তখন শ্রাবন্তীকে দেখা যাচ্ছে। ওর গলায় আঙুলের দাগ : ফরসা ত্বকে কালচে ছোপ।

সিনেমা চলার সময় জোয়ারদার নিজের মতো করে বাড়তি ধারাবিবরণী দিচ্ছিল। আর একইসঙ্গে অদ্ভুত-অদ্ভুত নজরে আমাকে লক্ষ করছিল।

প্রায় ঘণ্টাদেড়েক পর সিরিয়াল শেষ হলে জোয়ারদার বিশ্বাসকে সিডি প্লেয়ারের সুইচ অফ করে দিতে বলল। তারপর আমার চোখে সরাসরি তাকিয়ে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, বলুন, মিস্টার মজুমদার…কী ঠিক করলেন?

আপনি আসল খুনিকে ধরতে না পেরে শুধু-শুধু আমার মতো একজন ইনোসেন্ট সিটিজেনকে হ্যারাস করছেন। আমি হোমিসাইড স্কোয়াডের চিফের কাছে ব্যাপারটা রিপোর্ট করব।

কথা বলতে বলতে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। হাত তুলে জোয়ারদারকে কী একটা বলতে যাচ্ছিলাম, বর্ধন আমার বুকে সপাটে এক ধাক্কা দিয়ে আমাকে ছিটকে চেয়ারে ফেলে দিল।

অসহ্য ব্যথা, তার সঙ্গে দম আটকানো অবস্থা টের পেলাম। যন্ত্রণায় আমার মুখ কুঁচকে গেল। কাত হয়ে চেয়ারে পড়ে রইলাম আমি।

জোয়ারদার মিহি শব্দ করে হেসে বলল, আপনি আমাকে রূঢ় ব্যবহার করতে বাধ্য করছেন, মিস্টার মজুমদার। আমি নরমালি পেশেন্ট অনুযায়ী মেডিসিন দিই। ডোন্ট ফোর্স মি টু অ্যাডমিনিস্টার রাফ মেডিসিন। এখনও বলছি, আমার কথামতো কাজ করুন। তাতে আপনারই ভালো হবে…।

আমি দ্রুত ভাবতে শুরু করলাম। কী অকাট্য প্রমাণ পেয়েছে ওরা? কী করে ওরা বুঝতে পারল আমিই সেই সিরিয়াল কিলার?

মিস্টার মজুমদার, লুকোচুরি করে আর লাভ নেই। এতদিন ধরে তদন্ত করেও আমরা এই খুনগুলোর কোনও কিনারা করতে পারিনি। কারণ সেরকম সলিড কোনও প্রমাণ আমাদের হাতে আসেনি। এই সিরিয়াল কিলিং নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্ট একেবারে জেরবার হয়ে যাচ্ছিল। তারপর…ফরচুনেটলি…শ্রাবন্তী সেনের মার্ডারের ইনভেস্টিগেশানের সময় আমরা এই প্রথম আলো দেখতে পেলাম। আর সে-আলো গিয়ে পড়েছে আপনার দিকে…। কথা বলতে-বলতে মুচকি মুচকি হাসছিল জোয়ারদার।

আমি জোয়ারদারের কথা খুব একটা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম না। বাঁ-হাতে মাথার ঝাঁকড়া চুলের ভেতরে আঙুল চালাচ্ছিলাম। একটু পরেই আঙুলের ডগায় লুকোনো ধাতব প্লেটটা খুঁজে পেলাম। সামান্য চাপ দিয়ে প্লেটটা একপাশে সরাতেই ইলেকট্রনিক্স প্রকোষ্ঠের দরজা খুলে গেল। এর ভেতরে আছে বেশ কয়েকটা মাইক্রোচিপ। এই চিপগুলো আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ। সতেরো বছর বয়েসে আমার মাথার গোলমাল দেখা দেয়–হয়তো ওই স্পার্ম ব্যাঙ্কের ইনফেকশানের জন্যে। তখন ডাক্তার বলেছিল, আমার মাথার গোলমালের ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত। ওটা সরীসৃপের মতো শীতঘুম দেয়। তারপর হঠাৎ করে জেগে উঠে বিনা নোটিশে মাথাচাড়া দেয়। সেটা ঠিকঠাক করতেই আমার ব্রেনে অপারেশন হয়েছিল। বসাতে হয়েছিল একমুঠো মাইক্রোচিপ।

তখন আমি ইলেকট্রনিক্স জানতাম না।

কিন্তু পরে ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পর, হার্ডওয়্যারে ডক্টরেট করার পর, নিজের মাথা নিয়ে আমি নিজেই মাথা ঘামিয়েছি। মাইক্রোচিপগুলোয় কিছু রদবদল করেছি। কিন্তু তাতেও যে আমি পুরোপুরি সুস্থ হইনি তার প্রমাণ শ্রাবন্তীরা।

কিন্তু শ্রাবন্তীর ব্যাপারে কী প্রমাণ পেয়েছে জোয়ারদার?

অনেক ভেবেও কোনও কূল পাচ্ছিলাম না আমি। মাঝে-মাঝে অনেক ব্যাপার আমি ভুলে যাই। তারপর হঠাৎ করেই সেগুলো আবার মনে পড়ে যায়। শ্রাবন্তীর বেলায়ও হয়তো তাই হয়েছে।

কিন্তু আমাকে কষ্ট করে সেটা আর মনে করতে হল না। জোয়ারদার আমাকে সাহায্য করল। ও ইশারা করতেই বিশ্বাস কোথা থেকে একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে ছুঁড়ে দিল আমার সামনে।

আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। মাথার ধাতব দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলাম।

এই হল সেই প্রমাণ। মন্তব্য করল জোয়ারদার, অ্যাবসোলিউট প্রুফ। নিন, প্যাকেটটা খুলুন–খুলে দেখুন।

আমি কাঁপা হাতে প্যাকেটটা টেবিল থেকে তুলে নিলাম। ওটা ধীরে-ধীরে খুলতে শুরু করলাম। কী আছে এর ভেতরে? আমার হাত এত কঁপছে কেন?

প্যাকেট থেকে বেরিয়ে এল একগোছা চিঠি।

সেগুলো হাতে নিয়ে হতভম্বভাবে আমি জোয়ারদারের দিকে তাকালাম। হোঁচট খাওয়া গলায় কোনওরকমে বললাম, এ…এগুলো..কী?

জোয়ারদার হেসে বলল, প্রেমপত্র। শ্রাবন্তীকে লেখা আপনার প্রেমপত্র। অথচ আপনি বারবার বলছেন শ্রাবন্তী সেনকে আপনি চেনেন না।

মনে পড়েছে।

শ্রাবন্তীকে আমি বহু চিঠি লিখেছি। এর আগে কাউকে আমি কোনও প্রেমপত্র লিখিনি। কারণ আমি চাইনি পুলিশের হাতে কোনও সূত্র পৌঁছে যাক। তবে শ্রাবন্তীর বেলা আমার ভেতরে কী একটা যেন হয়ে গিয়েছিল। ওকে চিঠি না লিখে আমি পারিনি। ওকে একদিন না দেখলেই আমি চোখে অন্ধকার দেখতাম। ওকে আমি পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু…।

কিন্তু একদিন আমার ভেতরের অসুখটা শীতঘুম ভেঙে বেরিয়ে এল। শ্রাবন্তীর দিন ফুরোল। বেশ মনে আছে, অন্ধকার মাঠে ওর মৃতদেহ সামনে নিয়ে আমি পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। আমার অসুখটাকে অভিশাপ দিয়েছিলাম বারবার। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।

চিঠিগুলো আমি একে-একে দেখতে শুরু করলাম। আমার সুন্দর হাতের লেখায় আঁকা এক একটি চিঠি–ভালোবাসার চিঠি। চিঠির শেষে আমার নাম লেখা। চিঠিগুলোর কথা আমি একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।

ওরা তা হলে শুরু থেকেই এগুলোর কথা বলতে চাইছিল। মারাত্মক প্রমাণ! অকাট্য প্রমাণ। অ্যাবসোলিউট প্রুফ!

হাসি পেয়ে গেল আমার। হোমিসাইড স্কোয়াড এখনও আমাকে ততটা চিনতে পারেনি। চিনতে পারলে জোয়ারদারবাবু একেবারে তাজ্জব হয়ে যাবে।

আমার ঠোঁটের এক চিলতে হাসি বোধহয় জোয়ারদারের নজরে পড়েছিল। ও খানিকটা বাঁকা সুরে জিগ্যেস করল, কী, এবার শ্রাবন্তী সেনকে মনে পড়েছে তো! নাকি এখনও বলবেন এই চিঠিগুলো আপনার লেখা নয়?

অতিচালাক গোয়েন্দার চোখে সরাসরি তাকিয়ে আমি হেসে বললাম, ঠিকই ধরেছেন। শ্রাবন্তী সেনকে আমি চিনি না। আর এই চিঠিগুলোও আমার লেখা নয়।

চিঠির শেষে আপনার নাম আছে।

কলকাতা শহরে আমি একাই অমিত নই। ভালো করে খোঁজ নিন, শ্রাবন্তী কোন্ অমিতের সঙ্গে প্রেম করত।

আমার আত্মবিশ্বাস জোয়ারদারকে একটা ধাক্কা দিল। কিন্তু পেশাদার হওয়ার জন্যেই কয়েক লহমায় সেটা সামলে নিয়ে ও বলল, ঠিক আছে, সোজা আঙুলে যখন ঘি উঠবে না তখন আঙুল একটু-আধটু বাঁকাতেই হবে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল জোয়ারদার ও এর মধ্যে যে-কোনও একটা চিঠি আপনি বেছে নিন, মিস্টার মজুমদার।

আমি কথা না বাড়িয়ে দু-পৃষ্ঠার একটা চিঠি বেছে নিলাম। বাকি চিঠিগুলো রেখে দিলাম টেবিলের ওপরে।

সামনে আঙুল তুলে আমার পিছনে দাঁড়ানো বর্ধনকে নির্দেশ দিল জোয়ারদার, বর্ধন, ওঁকে কাগজ-কলম দাও।

বর্ধন যন্ত্রের মতো নিঃশব্দে এবং ক্ষিপ্রতায় কাগজ-কলম আমার সামনে এনে দিল।

টেবিলের ওপাশে পায়চারি করতে করতে জোয়ারদার বলল, মিস্টার মজুমদার, ওই চিঠিটা আপনি চারমিনিটের মধ্যে কপি করে দিন। তারপর প্যাটার্ন কমপেয়ারেটরে চিঠি দুটো দিয়ে আমরা দেখে নেব দুটো হাতের লেখায় শতকরা কতটা মিল, আর কতটাই বা গরমিল।

আমি ভয় পেলাম। এখনই এখানে বসে চিঠিটা কপি করতে হবে এটা আঁচ করতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, ওরা পরে কোনওসময় আমার ফ্ল্যাট সার্চ করে আমার হাতের লেখার স্যাল নিয়ে এসে এই চিঠির সঙ্গে তুলনা করে দেখবে।

জোয়ারদারকে বললাম, আমার আঙুলে ব্যথা আছে। এখন লিখতে আমার অসুবিধে আছে।

পায়চারি করতে করতে থমকে দাঁড়াল জোয়ারদার, হিসহিস করে হেসে উঠে বলল, আই গট য়ু, ম্যান। আমাকে চালাকিতে ফঁকি দেওয়া অত সহজ নয়। এখনও বলছি, মিস্টার মজুমদার, আপনি কনফেস করুন, তা হলে শুধু-শুধু আপনাকে আর টরচার করব না। নাউ, কাম অন–।

আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি, মিস্টার জোয়ারদার– আমি একরোখা গলায় জবাব দিলাম, আমি বলেছি, আজ এখন আমার লিখতে অসুবিধে আছে। আশা করি কাল-পরশুর মধ্যে আমার আঙুলের ব্যথা সেরে যাবে–তখন আপনি যা বলবেন তা-ই লিখে দেব–নো প্রবলেম।

জোয়ারদার গুম হয়ে গেল। একটু আগেই ওর চোখে-মুখে যে-হিংস্র উল্লাস ফুটে উঠেছিল তা স্তিমিত হয়ে গেল পলকে।

আমি জানি, আমার জিজ্ঞাসাবাদের প্রতিটি মুহূর্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিয়ো রেকর্ডিং করে নেওয়া হচ্ছে। হাতের লেখা মিলিয়ে দেখার বর্তমান আইন অনুসারে জোয়ারদার আমাকে এখনই লেখার জন্যে বাধ্য করতে পারে না। আমি লিখতে গররাজি হলে অন্য কথা। কিন্তু আমি শুধু দু একদিন সময় চেয়েছি।

আসলে দু-একদিন নয়, আড়ালে দশমিনিট সময় পেলেই আমার কাজ হয়ে যাবে। আমারই ভুল। চিঠিগুলোর কথা আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য বিকল্প পথ জানা আছে বলেই বোধহয় ব্যাপারটা আমি তেমন গুরুত্ব দিইনি।

আপনি তা হলে এখন লিখবেন না?

না–আমার আঙুলে ব্যথা।

কাল সন্ধেবেলা কি আপনার অসুবিধে হবে?

মোটেই না। কখন আসতে হবে বলুন।

রাত আটটার সময় বিশ্বাস আর বর্ধন আপনাকে নিয়ে আসবে। বাট ডোন্ট ট্রাই এনি মাঙ্কি ট্রিক। চালাকি ধরে ফেলা আমার হবি, মিস্টার মজুমদার।

আমি হাসলাম, বললাম, আপনি মিছিমিছি আমাকে সন্দেহ করছেন, জোয়ারদারবাবু। তা ছাড়া আমি জানি, চালাকি করে আপনার সঙ্গে পারব না।

জোয়ারদারের চোখ ছোট হল, চোয়ালের রেখা স্পষ্ট হল। বুঝতে পারলাম, আমার জোয়ারদারবাবু বলার ঢঙটা ওর পছন্দ হয়নি।

এরপর ঘরে ফেরার পালা।

বিশ্বাস আর বর্ধন যত্ন করে আমাকে বাড়ির সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিল।

আমি আবার ফিরে গেলাম সুচরিতার কাছে।

আমার ফেরার শব্দ পেয়ে ও জেগে উঠল। আমাকে হাত ধরে টেনে নিতে চাইল বিছানায়। উ-উ-ম-ম করে আদুরে শব্দ করল আলতো গলায়।

আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, একমিনিট, সুইটি–একটু টয়লেট থেকে আসছি।

টয়লেটে গিয়ে অটোমেটিক কোলোন স্পেয়ারের সামনে দাঁড়ালাম। সুগন্ধী ঠান্ডা বাতাস আমাকে ভাসিয়ে দিল। আমি চোখ বুজে শ্রাবন্তীর কথা ভাবতে লাগলাম।

একমাত্র ওকেই আমি ভালোবাসার চিঠি লিখেছি–আর কাউকে না। আমার ভেতরের পাগলটা শুধু ওকেই ভালোবেসে ফেলেছিল। আর সবাই ছিল ওর কাছে একরাত বা কয়েক রাতের সঙ্গিনী। রাত ফুরোলেই সব ভালোবাসা শেষ। সুচরিতাও তাই। আর কাউকে আমি ভালোবাসার চিঠি লিখব না।

যদিও বা লিখি, শ্রাবন্তীকে লেখা চিঠির মতো হাতের লেখায় লিখব না। লিখব অন্য কোনও নতুন হাতের লেখায়।

কোলোন স্পেয়ার বন্ধ করে দেওয়ালে লুকোনো একটা ক্যাবিনেটের দরজা খুললাম। আমার সামনের তাকে এখন অনেকগুলো মেগা স্কেল ইন্টিগ্রেটেড মাইক্রোচিপ। মাথার চুলের ভেতরে হাত চালিয়ে ছোট্ট ধাতব প্লেটটা সরিয়ে দিলাম। মাথার ভেতরে আঙুল ঢুকিয়ে খুব সতর্কভাবে একটা চিপ বেস থেকে খুলে নিলাম। সেটা তাকে রেখে দিয়ে নতুন একটা চিপ তুলে নিলাম। তার নম্বরটা ঠিক আছে কিনা একবার দেখে নিয়ে সাবধানে সেটা বসিয়ে দিলাম মাথার ভেতরে। তারপর ধাতব ঢাকনা টেনে বন্ধ করে দিলাম।

ব্যস, আর কোনও চিন্তা নেই। আমার হাতের লেখা এবার বদলে যাবে।

আমাদের হাতের লেখার ধরন মস্তিষ্কের যে-অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এই চিপটা অনেকটা যেন তারই বিকল্প। সতেরো বছর বয়েসে অপারেশানের সময় আমার মাথার ভেতরে একগাদা চিপ বসানো হয়েছিল। তার কয়েকবছর পর হার্ডওয়্যারে গবেষণা করার সময় এ ধরনের মাইক্রোচিপ আমি হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলাম। আর তারই একটা দিয়ে বিশেষ ধরনের সার্কিট তৈরি করে বসিয়ে দিয়েছিলাম আমার মাথার ভেতরে।

বিভিন্ন হাতের লেখার ধরনের জন্যে সারকিট ডিজাইন করার বিভিন্ন চিপ পাওয়া যায়। সেই চিপটা পালটে নিলেই আমার হাতের লেখার ধরন পালটে যায়।

সুতরাং আর আমি জোয়ারদার অ্যান্ড কোম্পানিকে ভয় পাই না।

আমার সিরিয়ালের বারো নম্বর এপিসোডের জন্যে মনে-মনে তৈরি হয়ে আমি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *