রাজা
ছবির মতো গ্রামখানি। ছোট্ট একটা নদী, সারাদিন কুলকুল করে কত কথাই বলে! সবুজ ধানখেত। গমের খেত। বড় বড় আমবাগান। ভোর হয় পাখির ডাকে। সন্ধ্যা নামে মন্দিরে আরতির ঘণ্টাধ্বনিতে। প্রত্যেক বাড়িতেই গরু আছে। নদীর ধারের সবুজ মাঠে সার বেঁধে তারা। চরতে যায় রোজ সকালে পথের লাল ধুলো উড়িয়ে। নধর গাভী। সঙ্গে তাদের বাচ্চা। আদর করে পরস্পর পরস্পরের গায়ে পড়ে। কখনও ছুটে ছুটে পথ চলে, কখনও থেমে থেমে। গরুর বাঁধা ঘণ্টার নানা রকমের টুংটাং শব্দ। সূর্য যখন নদীর ওপারে অস্তে নামে, আকাশ যখন গোলাপি লাল, তখন তারা আবার সার বেঁধে ফিরে আসে ঘুম-ঘুম চোখে।
বড় শান্তির গ্রাম। সকাল নটার সময় পাঠশালা বসে জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপে। গ্রামের যত শিশু একসঙ্গে নামতা পড়ে। শিক্ষকমশাই বসে থাকেন আসনে। রোদের ঝাঁঝে তাঁর ফরসা মুখ লাল দেখায়। বাইরে বড় বড় প্রজাপতি ওড়ে। হলুদ রঙের বোলতা। ডুমো ডুমো ভ্রমর।
বারোটার সময় ওই ছোট নদীতে বালকের দল ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের কলকোলাহলে নদীর কী আনন্দ! গামছা দিয়ে ছোট ছোট মাছ ধরে আবার ছেড়ে দেয় জলে। এইটাই খেলা, এটাই তাদের আনন্দ।
ঠিক একটার সময় এই নদীর ধার দিয়ে ঘোড় চেপে একজন যায়। খুব সুন্দর দেখতে। গায়ে রংবেরঙ-এর তাপ্পি মারা ঝলমলে, ঝলঝলে একটা পোশাক, মাথায় নীল রঙের পাগড়ি, হাসি হাসি মুখ। সবাই বলে লোকটি একজন জাদুকর। রাজবাড়িতে জাদু দেখাতে যায়। অনেকে বলে, ইনিই আমাদের রাজা। ছদ্মবেশে এভাবেই ঘুরে বেড়ান। নদীর ওপারে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট। একটা বাগানবাড়ি আছে। দুপুরবেলা রাজা সেইখানে যান। ওখানে একটা ঝরনা আছে। পাহাড়ের গা বেয়ে সাদা দুধের মতো ফেনা-ফেনা জল একটা সরোবরে এসে পড়ছে। সেই জলে কত হাঁস দোল খেতে খেতে ভাসছে। লাল, সাদা, নীল, গোলাপি, খয়েরি। বাগানের ছায়া ছায়া পথে গলা উঁচু বড় বড় রাজহাঁস রাজার মতো ঘুরে বেড়ায়।
ওই সরোবরে নাকি ভারী সুন্দর একটা সাদা নৌকো আছে। রাজা সেই নৌকোয় চড়ে সারাদুপুর ওই সরোবরে, হাওয়ায় ভেসে ভেসে, নৌকো যখন যেদিকে যায় সেই দিকে যাবেন। এই সময় তিনি বই পড়েন। নানারকম বই। এই রাজা কোনওদিন যুদ্ধ করেননি। এই রাজার কোনও প্রাসাদ নেই। সম্পত্তি নেই। মণিমাণিক্য নেই। ওই একটি ঘোড়া। রাজার রাজা ছাড়া আর কেউ নেই।
কখনও কখনও গাছের তলায় তাঁবু খাঁটিয়ে থাকেন। গাছের ডালপালা জোগাড় করে এনে ইটের উনুনে আগুন জ্বেলে নিজের রান্না নিজেই করে নেন। আর যখনই মানুষ বিপদে পড়ে রাজা সবার আগে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। গ্রামের একেবারে উত্তরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছোট্ট একটি। চালাবাড়ি আছে। সেইব্রাহ্মণ ভীষণ ভগবান-ভক্ত। ভগবানের কথা ছাড়া কিছু বলেন না। জীবনে কখনও কোনও অন্যায় কাজ করেননি। রাজা এই পরিবারটিকে ভীষণ ভালোবাসেন। অনেক সময় এখানেও থাকেন। রাজার একটা বাঁশি আছে আর আছে একটা লণ্ঠন। যখন যেখানে থাকেন সেইখানে রাতের বেলা একটা গাছের ডালে লণ্ঠনটা ঝুলিয়ে দেন। মিহি নীল রঙের আলো চারপাশে ছড়িয়ে যায়, তখন বোঝা যায় রাজামশাই কাছাকাছি কোথাও আছেন।
রাজা কেন এইব্রাহ্মণের ঘরে থাকেন?
সে-ও বেশ একটা কাহিনি আছে।
এই দেশে একবার খুব দুর্ভিক্ষ হল। পর পর তিন বছর এক ফোঁটা বৃষ্টি হল না। চাষের জমি। ফেটে চৌচির। নদী শুকিয়ে গেল। গাছের পাতা ঝরে গেল। সরোবরে জল নেই। ভীষণ, ভীষণ দুর্ভিক্ষ। মানুষ মারা যেতে লাগল অনাহারে। একমাত্র শকুনদেরই খুব আনন্দ।
এই গরিব ব্রাহ্মণ পরিবারের তখন খুব দুর্দিন। শাস্ত্র প্রচার করে আর মানুষকে ধর্মের উপদেশ দিয়ে সামান্য যা পান, তাতেই দিন চলে। সে রোজগারও বন্ধ মানুষের এই দুঃসময়ে। একবার এমন হল, পর পর পাঁচদিন কোনও খাদ্য জুটল না। টানা উপবাস। ছ-দিনের দিন ব্রাহ্মণ অল্প যবের ছাতু সংগ্রহ করতে পারলেন। ব্রাহ্মণ সেই ছাতু সমান চারভাগে ভাগ করলেন। তারপর সেটিকে তৈরি করে সবে খেতে বসেছেন সপরিবারে আর ঠিক তখনই দরজায় ঘা পড়ল। ব্রাহ্মণ উঠে গিয়ে দরজা খুললেন। দাঁড়িয়ে আছেন এক অতিথি। সাদরে নিয়ে এলেন ভেতরে। আসন দিলেন। এইবার আপ্যায়ন। নিজের ভাগের খাবারটি অতিথির সামনে ধরে দিলেন। তিনি নিমেষে সেটি নিঃশেষ করে বললেন, ব্রাহ্মণ! আপনি আমার বিপদ আরও বাড়িয়ে দিলেন। আমি দশদিন না-খেয়ে আছি। এই সামান্য ছাতুতে আমার খিদের আগুন যে আরও বেড়ে গেল!
তখন ব্রাহ্মণের স্ত্রী স্বামীকে বললেন, আমার ভাগটিও আপনি নিবেদন করে দিন।
ব্রাহ্মণ বললেন, তা হয় না।
ব্রাহ্মণী বললেন, সে কী কথা! অতিথি নারায়ণ। অতিথি তো শুধু আপনার একার নয়, আমাদের সকলের। আপনি দিন। চিন্তা করবেন না। কর্তব্য পালন করুন।
ব্রাহ্মণ তখন স্ত্রী-র ভাগটি অতিথিকে দিলেন। নিমেষে সেটি খেয়ে অতিথি হাসতে হাসতে বললেন, কিছুই হল না।
ব্রাহ্মণের পুত্র তখন তাঁর ভাগটি অতিথিকে নিবেদন করে বললেন, পুত্রের কর্তব্য পিতাকে তাঁর কর্তব্য পালনে সহায়তা করা।
পুত্রের ভাগ খাওয়ার পরেও অতিথির খিদে গেল না। তখন পুত্রবধূও তাঁর অংশটি দিয়ে দিলেন। সেই ভাগটি শেষ করে অতিথি বললেন, এতক্ষণে হল।
তিনি আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। আর কেউ জানল না, সেই রাতেই ব্রাহ্মণের পরিবারের চারজন অনাহারে মারা গেল। ভোরের দিকে একটি বেজি হঠাৎ সেইখানে এল। এসে দেখছে, চারটি মৃতদেহ, আর কিছু ছাতুর গুঁড়ো মেঝেতে পড়ে আছে। বেজি সেই ছাতুর গুঁড়োর ওপর। গড়াগড়ি দিতেই তার শরীরের অর্ধেকটা সোনার হয়ে গেল। এইবার সে যখন বাইরে এসেছে, দেখছে কী, ঘোড়ার পিঠে চেপে এক রাজা এসেছে। রাজাদের সে খুব চেনে। কারণ সে রাজবাড়িতেই বড় হয়েছে।
বেজি জিগ্যেস করলে, এখানে কী হয়েছিল যে আমার আধখানা শরীর সোনার হয়ে গেল?
রাজা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে নামতে বললেন, এখানে একটি যজ্ঞ হয়েছিল, আত্মত্যাগের শ্রেষ্ঠ যজ্ঞ। সেই যজ্ঞের ভূমিতে গড়াগড়ি দিয়েছিলে, তাই তোমার শরীরের আধখানা সোনার হয়ে গেছে। এইবার তুমি আর একটা এইরকম যজ্ঞের সন্ধান করো, তাহলে তোমার পুরো শরীরটাই সোনার হয়ে যাবে।
বেজি চলে গেল। আজও তার সন্ধান শেষ হয়নি। যেখানেই যজ্ঞ হয় সেইখানেই গড়াগড়ি দিয়ে দেখে তার বাকি শরীরটা সোনার হল কিনা! হয় না। তখন সে বলে, তোমাদের কিছু হয়নি। ভড়ংটাই সার।
রাজা সেই চারটি মৃতদেহের পাশে বসে মৃদুস্বরে ডাকলেন, ব্রাহ্মণ ওঠো! আমাকে আসতে হল তোমাদের জন্যে।
ব্রাহ্মণ চোখ মেলে বললেন, আপনি কে?
আমি সেই অতিথিরই আর এক রূপ। আমি জীবনের জাদুকর।
কেউ জানে না, একমাত্র ব্রাহ্মণ জানেন রাজা কে!
লণ্ঠনের নীল আলোর দিকে তাকিয়ে রাজা বললেন, ব্রাহ্মণ! এই আলোটা এইবার একদিন লাল হয়ে যাবে; খুব শিগগির হবে। তখন শুরু হবে দানবের যুগ। আমরা তখন চলে যাব। সবাই তৈরি থাকো।