Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রানা মকুলের দুই খুড়ো ছিলেন— চাচা আর মৈর। যদিও দুজনে রাজার ছেলে, কিন্তু তাঁদের মা ছিলেন কাঠুরের মেয়ে; সেইজন্য রানাদের চেয়ে তাঁরা মানে খাটো! মেবারের সিংহাসনেও বসবার তাঁদের কোনো উপায় ছিল না। আর সে চেষ্টাও তাঁরা করেননি— মুকুল তাঁদের যথেষ্ট জমিজমা দিয়েছিলেন। মকুলজী যদি তাঁর দুই চাচাকে কেবল রাজসভার শোভামাত্র করে রেখে চুপচাপ থাকতেন, তবে আর কোনো গোলই হত না; তা না, একদিন দুই কুড়োকে সাতশো করে সেপাইয়ের সর্দার বানিয়ে দিয়ে যুদ্ধে পাঠিয়ে মকুল রানা একটু মজা দেখতে চাইলেন।
খুড়ো দুজনের কাজের মধ্যে ছিল দিবারাত্রি আফিং খেয়ে ঝিমানো। হঠাৎ সর্দার ব’নে গিয়ে লড়াইয়ে যেতে হলে, তাঁরা না-জানি কী বিপদেই পড়বেন— কোথায় থাকবে আফিং, কোথায় বা তামাক? দুধের পুরু সর, রাবড়ি, মালাই সেখানে তো পাওয়াই যাবে না; উল্‌টে বরং মাঠের হিম খেয়ে মরতে হবে!— মাদেরিয়ার ভীলদের হাঙ্গামা মেটাতে গিয়ে মকুল এই তামাশা দুই খুড়োকে নিয়ে শুরু করলেন। অনেক দিন বেশ আমোদে কাটল। তামাশার সঙ্গে সাতশো সেপাইয়ের সর্দারে মাসোহারা যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ ভাইপোটিকে আমোদ দিতে দুই খুড়োর আপত্তি হল না; কিন্তু ঠাট্টা-তামাশা ক্রমেই একটু কড়া-রকম হতে লাগল। এমন কি, আফিংচি হলেও তামাশার খোঁচার দিকে চোখ বন্ধ করে ঝিমানো দুই খুড়োর পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠল। কিন্তু ভাইপোর অনুগ্রহ ছাড়া বেচারাদের পেট চালাবার জন্য উপায় ছিল না; কাজেই মনের রাগ তাদের মনেই জমা হতে লাগল! আর কোনো কোনো দিন মুখ ফুসকে বেরিয়েও আসতে শুরু করলে! এতে মকুলজীর আমোদ আরো বেড়ে চলল বই কমল না। লোককে নিয়ে তামাশা করার নেশা লখারানার মতো মকুলেরও কম ছিল না! একদিন দুই চাচা তাঁকে স্পষ্ট মুখের উপর শুনিয়ে দিলেন যে বাপের তামাশার ফলে তিনি যে সিংহাসন পেয়েছেন, নিজের তামাশার দোষে সেটা কোনদিন বা তাঁকে হারাতে হয়। চাচার মনের কথা এমন স্পষ্ট শুনেও মকুলের চোখ ফুটবল না। খুড়োদের ক্ষেপিয়ে তিনি তামাশা করেই চললেন।
সেদিন বনের মধ্যে একটা গাছে হঠাৎ রাত্রের মধ্যে রাঙা ফুল এতো ফুটে উঠেছে যে মনে হচ্ছে বনে কে আগুন ধরিয়ে গেছে। মকুল সেই গাছটা দেখিয়ে পাশের একজনকে গাছের নামটা শুধোলেন। সে ঘাড় নেড়ে বললে, ‘গাছের খবর আমরা রাখিনে রানাসাহেব!’
মকুল তাঁর দুই খুড়োর দিকে চেয়ে বললেন, ‘গাছটার নাম কী আপনারা জানেন চাচা?’
শাদা কথা কিন্তু দুই খুড়ো বুঝলেন, তাঁদের মা ছিলেন কাঠুরের মেয়ে কাজেই গাছের খবর তাঁদেরই কাছে পাওয়া সম্ভব— এইটেই রানা ইশারায় জানালেন। মা যেমনই হোক, সে তো মা, তাকে নিয়ে তামাশা কোন ছেলে সইবে! সেইদিনই দুই খুড়ো মকুলের কাজে ইস্তফা দিয়ে সভা ছেড়ে শুকনো মুখে বিদায় হয়ে গেলেন। রানার দেওয়া সাজসজ্জা, অস্ত্র-শস্ত্র, টাকা-কড়ি লোক-লস্কর, হাতি-ঘোড়া সব পড়ে রইল; কেবল একটি মা-হারা মেয়ে যাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে দুই ভায়ে আপনাদের সব ভালোবাসা দিয়ে পুষেছিলেন, তাকেই কোলে করে সেপাই সর্দার সবার মাঝখান দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেলেন— একেবারে বন ছেড়ে।
দুই খুড়োর উপর কতটা অন্যায় হয়েছে, মকুল তখন বুঝলেন। মাপ চেয়ে দুই কুড়োকে ফিরিয়ে আনতে লোকের পর লোক গেল, কিন্তু দুই খুড়ো আর ফিরলেন না! অনুতাপে মকুল সারাদিন দুঃখ পেতে থাকলেন। নিতান্ত ভালোমানুষ নিরুপায় দুই খুড়োর শুকনো মুখ তাঁকে আজ কেবলি ব্যথা দিতে লাগল। তিনি সন্ধ্যাবেলা শিবির ছেড়ে একা বনের মধ্যে বেড়াতে গেলেন! সর্দারেরা রানার মনের অবস্থা বুঝে কেউ আজ সঙ্গে যেতে সাহস পেলেন না। সবাই তফাতে-তফাতে রইল। বনের তলায় আঁধার ক্রমে ঘনিয়ে এল, আকাশে আর আলো নেই, এ-সময়ে যখন চারিদিকে বিদ্রোহী ভীল, তখন রানাকে আর বনের মধ্যে একা থাকতে দেওয়া উচিত না ভেবে যখন সব সর্দার বনের দিকে এগিয়ে চলেছেন, সে সময়ে মনে হল যেন অনেকগুলো শুকনো পাতা মাড়িয়ে অন্ধকারে কারা ছুটে পালাল। তারপরেই সর্দারেরা দেখলেন, সেই রক্তের মতো রাঙা ফুলগাছের তলায় রানা মকুল পড়ে রয়েছেন; বুকের দুই দিকে দুটো বল্লমের চোট দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রানা সন্ধ্যার মালা জপ করছিলেন, এখনো তাঁর ডান হাতের আগায় মালা জড়ানো। রানার মতো রানা ছিলেন মকুল— মেবারে হাহাকার পড়ে গেল। সবাই বলতে লাগল, এ কাজ সেই দুটি খুড়োর না হয়ে যায় না। মাদেরিয়ার বনে বিদ্রোহীদের কেউ এসে যে রানাকে মেরে যেতে পারে এটা সবার অসম্ভব বোধ হল!
পায়ীগ্রাম থেকে একটু দূরে পাহাড়ের উপরে রাতকোটের কেল্লা। সেইখানে এ-গ্রাম সে-গ্রাম ঘুরে চাচা আর মৈর অতি কষ্টে এসে পৌঁছলেন।
ওদিকে মকুলের উপযুক্ত ছেলে রানা কুম্ভ, তাঁর সঙ্গে মাড়োয়ারের যোধরাও এসে মিলেছেন; গ্রামে-গ্রামে পরগণায়-পরগণায় তাঁদের লোক চাচা মৈর— দুই ভাইকে ধরবার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পায়ীগ্রাম চিতোর থেকে বহুদূর। ক’ঘর ছুতোর-কামার, জনকতক, জোতদার কিষান, বেশির ভাগই গরীব গুর্বো। চাচা আর মৈর দুজন সর্দার তাদের মধ্যে এসে ভাঙা কেল্লাটা দখল করে ধুমধাম লাগিয়ে দেওয়াতে প্রথমটা তারা খুব খুশি হল! প্রথম-প্রথম দু-একবার তাদের সবারই পাল-পার্বণে কেল্লাতে নিমন্ত্রণ, আনাগোনাও হল; কিন্তু যতই টাকার টানাটানি হতে লাগল, ততই দুই সর্দার হাত গোটাতে লাগলেন। শেষে এমন দিন এল যে দুই সর্দারের কথা কেউ আর বড়ো একটা মুখেই আনত না। আবার পাহাড়ের উপর ভাঙা কেল্লার দুই বুড়োর নামে নানা-রকম গুজব রটতে লাগল! কেউ বললে, তাদের অনেক টাকা; কেল্লার মধ্যে তারা সেই সব ধন দৌলত এনে পুঁতে রেখেছে; রোজ তিনটে রাতে পাহাড়ের একটা দিকে কে যেন লণ্ঠন নিয়ে উঠছে সে স্বচক্ষে দেখেছে। কেউ বললে, দুই সর্দার কেল্লার মধ্যেকার একটা সুরঙ্গ দিয়ে দিল্লী যাওয়া-আসা করেন, নবাবও মাঝে মাঝে কেল্লায় এসে নাচ-তামাশা খাওয়া-দাওয়া করেন, তার ভাই একদিন হাট সেরে ফেরবার সময় সারঙ্গীর আওয়াজ আর মেয়েমানুষের গান স্পষ্ট শুনেছিল। একজন কামার কবে কেল্লায় দু-একটা মর্চে-ধরা দরজার খিল মেরামত করে এসেছিল, সে বললে, স্বচক্ষে দেখে এসেছে দুই বুড়োতে একটা আগুনের উপরে লোহার কড়া চাপিয়ে মুঠো-মুঠো লোহা চুর ফেলছে, আর সেগুলো সোনা হয়ে উথলে পড়ছে। কড়াখানা কিন্তু মানুষের টাটকা রক্তে ভরা; দুটো কালো বাঘ সেই কড়াখানার চারিদিকে কেবল মাটি শুঁকে-শুঁকে ঘুরছে।
রাতকোটের কেল্লা ক্রমে নানা আজগুবি ভয়ংকর কাণ্ডের, ভয়ের আর তরাসের জায়গা বলে রটে গেল। ভয়ে সেদিক দিয়ে লোক আনাগোনাই আর করত না, দিনে-দুপুরে যেন তারা বাঘের গর্জন শুনতে থাকল, আর সন্ধ্যার সময় দেখতে লাগল— যেন কারা ঘোড়ার পিঠে থলে বোঝাই টাকা নিয়ে চলেছে— ঝম-ঝম।
দুই সর্দার মাসে-দুমাসে একবার হাটে নেমে আসতেন, কাপড়-চোপড় আটা গম একটা খোঁড়া ঘোড়ার পিঠে বোঝাই দিয়ে আবার পাহাড়ের উপর কেল্লায় উঠে যেতেন। কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে সারাগ্রাম হপ্তাখানেক ধরে সরগরম থাকত। সে নানা কথা— আটাওয়ালা দুই বুড়োকে আটা বেচে টাকার বদলে মোহর পেয়েছে। ঘি দশ সের তার দাম কতই বা? বুড়োদের ঘি বেচার পরদিনই গোয়ালার স্ত্রী গলায় হঠাৎ রুপোর হাঁসুলিটা দেখা যায় কেন? আর সেই কাপড়ের মহাজন, তার দোকান থেকে দুটো বুড়ো কেন যে এত শাড়ি কেনে, সেটা প্রকাশ হয়েও হচ্ছে না, সে কেবল মহাজনটা রীতিমতো কিছু মেরেছে বলে!
এদিকে গ্রামের ঘরে-ঘরে এই চর্চা, ওদিকে পাহাড়ের উপরে দুই বুড়োতে সেই কুড়োনো মেয়েকে তাদের সব ভালোবাসা দিয়ে আদর-যত্নে মানুষ করেছে। মেয়েটি তাদের প্রাণ, সেই ভাঙা কেল্লা, সেই মেয়ের হাসিতে, তার কচি গলার মিষ্টি কথায়, পাপিয়ার মতো তার গানের সুরে, দিন রাত ভরে রয়েছে। তার হাতে লাগানো ফুলের লতা ভাঙা দেওয়াল বেয়ে উঠে সকাল-সন্ধ্যায় ফুল ফেটাচ্ছে, গন্ধ ছড়াচ্ছে রাজার ভয়ে দেশছাড়া এই দুটো বুড়োর জন্যে। একলা কেল্লায় এই তিনটি প্রাণী, আর আছে— এক পাহাড়ী কুকুর, দেখতে যেন বাঘ। সেই কুকুরই চাকর, দারোয়ান, সান্ত্রী, পাহারা— অজানা লোক যে হঠাৎ কেল্লায় ঢুকবে, তার যো নেই। শঙ্খচিল যেমন পাহাড়ের চূড়ায় বাসা বেঁধে বাচ্চা নিয়ে থাকে তেমনি শাদা-চুল দুই বুড়োতে সেই অগম্য পুরীতে আদরের মেয়েকে নিয়ে রয়েছেন— অনেকদিন ধরে। এমন সময় একদিন পায়ীগ্রামের দফাদারের সুন্দরী মেয়েটি হারাল। নদীতে ডুবে সে মরল, কি বাঘেই তাকে ধরলে কিছুই ঠিক হল না। কিন্তু সবাই ঠিক করলে যে ঐ বুড়ো সর্দার দুটো সুন্দরী দেখে মেয়েটিকে চুরি করেছে। মেয়ের বাপ পাগলের মতো হয়ে কাজকর্ম ছেড়ে দিনরাত রাতকোটের কেল্লার পাশে পাশে ঘুরতে লাগল। তার নিশ্চয় বিশ্বাস সুন্দরিয়া তার ঐ কেল্লাতেই আছে। কেননা একদিন সকালে সত্যিই সে একটা মেয়েকে এলোচুলে পাহাড়ের পাকদণ্ডি বেয়ে বেড়াতে দেখেছে— খুব দূর থেকে যদিও কিন্তু সে যে তারই মেয়ে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দফাদারকে সবাই পরামর্শ দিলে, ‘যাও রানা কুম্ভের কাছে নালিশ করো গিয়ে। তোমার মেয়েটি যে ভয়ানক লোকদের হাতে পড়েছে, কুম্ভ ছাড়া কারো সাধ্যি নেই তাকে ছাড়িয়ে আনে।’ বুড়ো দফাদার চলল। মরচে-ধরা তলোয়ার কোমরে বেঁধে, আর নিজের চেয়ে একটু বুড়ো এক ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে একলা চিতোরের দিকে চলল সে।
রাতকোট থেকে চিতোর কত দিন-রাতের পথ তা কে জানে, দফাদার কিন্তু চলেছে। মেয়ের শোকে পাগলের মতো চলেছে; আর ফিরে-ফিরে রাতকোটের কেল্লাটার দিকে তলোয়ার উচিয়ে গালাগালি পাড়ছে; এমন সময় পথের মধ্যে তিন ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে দেখা। কথায় কথায় দফাদারের মুখে মেয়ে চুরির খবর শুনে তিনজনেই বললে, ‘চলো, দফাদার-সাহেব, এর জন্যে আর রানার কাছে যেতে হবে না। আমরাই তোমার মেয়েকে উদ্ধার করে সেই বুড়োর দফা-রফা করে আসছি, চলো!’ শুনে দফাদার ঘাড় নেড়ে বললে ‘জানো না সেই দুই বুড়োকে, তাই এমন কথা বলছ। মানুষের অগম্য স্থানে থাকে তারা। যদি কেউ সে-কেল্লা মারতে পারে তো রানা কুম্ভ! পাহাড় বেয়ে সেখানে উঠতে হবে রাস্তা নেই। বনে জঙ্গলে দিনে বাঘ হাঁকার দিয়ে ফেরে। কেউ সেখানে যেতে পারে না; আর গেলেও ফিরতে পারে না এমনি ভয়ানক পাহাড়ের চূড়োয় রাতকোটের কেল্লা! আর তারি মধ্যে রাক্ষসের চেয়ে ভয়ানক দুই বুড়ো বসে!’ বলেই দফাদার হাউমাউ করে মেয়ের জন্যে কাঁদতে লাগল। তিন সেপাইয়ের মধ্যে সব ছোটো যে সেপাই, সে বললে, ‘ভয় নেই, আমরা ঠিক সেখানে যাব, চলে এস।’ ছোটো সেপাইয়ের কথা শুনে দফাদার একটু চটে বললে, ‘আমার কথায় বিশ্বাস হল না? আমি বলছি, সেখানে যাবার রাস্তা নেই!’
ছোটো সেপাই আর কেউ নয়, রানা কুম্ভ নিজে। চাচা আর মৈরকে সন্ধান করে শাস্তি দিতে চলেছেন। দফাদারের কথায় রানা হেসে বললেন, ‘কেউ যদি কেল্লায় উঠতেই পারে না, তবে বুড়ো-দুটো তোমার মেয়েকে নিয়ে সেখানে গেল কোথা দিয়ে? রাস্তা নিশ্চয়ই আছে।’ দফাদার আরও রেগে বলছে, ‘ওহে ছোকরা, রাস্তা থাকলে আমি কি সেখানে না উঠে এদিকে আসি? নিজেই গিয়ে বদমাস দুটোর মাথা কেটে আমার মেয়েকে’ বলেই বুড়ো আবার কাঁদতে লাগল। তিন সেপাই তাকে ঠাণ্ডা করে পায়ীগ্রামে ফিরিয়ে আনলেন।
গাঁয়ের মধ্যে সামান্য সেপাই-বেশে দফাদারের সঙ্গে রানা কুম্ভ যখন উপস্থিত হলেন, তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে— আকাশে কালো মেঘ জমে ঝড়বৃষ্টির উপক্রম হচ্ছে। গাঁয়ে এসে রানা খবর পেলেন, কেল্লার উপরে যে বুড়ো দুটি আছেন তাঁরা হচ্ছেন তাঁর বাপের খুড়ো— চাচা আর মৈর। রাগে কুম্ভ লাল হয়ে উঠলেন, ‘চলো, আর দেরি নয় এখনি সেই দুটো পাপাত্মার উচিত শাস্তি দেব!’ রানা কেল্লার মুখে ঘোড়া ছোটালেন দেখে সঙ্গে দুটো সেপাইও চলল— পিছনে। দফাদর অন্ধকারে খানিক ওদের দিকে হাঁ-করে চেয়ে থেকে, ‘পাগল! পাগল!’ বলে ঘাড় নাড়তে-নাড়তে নিজের বাসায় খিল দিলে। সোঁ-সোঁ ঝড় বইতে লাগল আর তার সঙ্গে বৃষ্টি নামল। এক-একবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তারই আলোয় দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের উপর রাতকোটের কেল্লা— কালো অন্ধকারের একটা ঢেউ যেন আকাশজুড়ে স্থির হয়ে রয়েছে। ভিজে মাটিতে তিনটি ঘোড়ার পায়ের ছপ-ছপ শব্দ হতে থাকল। রানা বললেন, ‘ঘোড়া এইখানে ছেড়ে পায়ে হেঁটে চলো।’ বনের মাঝে ঘোড়া বেঁধে তিন সেপাই পাহাড়ে চড়তে শুরু করলেন।
এদিকে পাড়াড়ের উপরে ভাঙা কেল্লায় দুটি বুড়ো আর তাঁদের সেই কুড়োনো মেয়েটি একটি পিদিমের একটুখানি আলোয় মস্ত-একখানা অন্ধকারের মধ্যে বসে গল্প করছেন আর কেল্লার ফটকে সিংহের মতো কটা চুল প্রকাণ্ড শিকারী কুকুর হিঙ্গুলিয়া ভাঙা দরজার চৌকাঠে মস্ত থাবা দুটো পেতে মুখটি বাড়িয়ে দুই কান খাড়া করে বাইরের দিকে চেয়ে রয়েছে কেউ আসে কি না ভিজে বাতাসে শিকারী কুকুরের কাছে রাতে-ফোটা একটা বনফুলের গন্ধ ভেসে এল; তার পরেই কাদের পায়ের তলায় বনে কুটো-কাটা ভাঙার একটুখানি শব্দ হল। কুকুর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে আস্তে-আস্তে বার হল— জঙ্গলের পথে। বনের মধ্যে ভিজে পাহাড়ের তাত উঠছে। অন্ধকারে দু-চারটে জোনাকিপোকা লণ্ঠন জ্বালিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে! কুকুর পাহাড়ের পাকদণ্ডির ধারে চুপটি করে গিয়ে দাঁড়াল। রাতের বেলায় অচেনা কাদের পায়ের শব্দ শুনে শিকারী কুকুরের চোখ দুটো জ্বলছে। কুকুর সজাগ হয়ে বসে আছে। কিন্তু যারা পাহাড়ে উঠছে, তারাও কম সজাগ নেই— পাকা শিকারী পাকা যোদ্ধা রানা কুম্ভ, তাঁর চারণ, আর মাড়োয়ারের যোধরাও! জানোয়ারের চোখ জ্বলছে কোন ঝোপের আড়ালে, সেটা এরা জোনাকির আলো বলে ভুল করলে না। রানার হাতের ছুরি সাঁ-করে গিয়ে বিঁধল হিঙ্গুলিয়ার বিশ্বাসী প্রাণটি ধুক-ধুক করছে ঠিক যেখানে। শিকারীর ছুরিতে কেল্লার একটি মাত্র রক্ষক, দুটি বুড়ো একটি কচি মেয়ের একমাত্র বন্ধু আর বিপদের সহায়— সেই সিংহের মতো হিঙ্গুলিয়া মরল— একটিবার কাতর স্বরে ডাক দিয়ে। সে যেন বলে গেল— ‘সাবধান।’ ঝড়ের বাতাসে সেই শেষ-ডাক ছেড়ে দিয়ে কুকুর স্তব্ধ হল! রানার বড়ো স্ফূর্তি হয়েছিল যে তিনি কেল্লা নেবার মুখেই একটা মস্ত সিংহ শিকার করলেন। সঙ্গীরাও বললেন, ‘রানা, এ বড়ো সুলক্ষণ।’ কিন্তু সেই ডাক যখন অন্ধকার চিরে পাহাড়ের চূড়োয় কেল্লার দিকে একটা কান্নার মতো ছুটে গেল, তখন সবার মুখ চুন হয়ে গেল। দেখলেন একটা কুকুর পড়ে আছে। তিনজন আস্তে আস্তে আবার চললেন। মনে কারু আর তেমন উৎসাহ রইল না।
ওদিকে সেই আঁধার ঘরের একটি পিদিম বাতাসে নিবু-নিবু করছে; তাকেই ঘিরে তিনটি প্রাণী। বুড়ো চাচা গল্প বলছেন, তাঁর ছোটো ভাই আর এক বুড়ো ছেঁড়া কাঁথায় বসে ঝিমচ্ছেন, আর একটি মেয়ে অবাক হয়ে শুনছে ঃ ‘আমরা দুই ভাই তখন খুব ছোটো। আমি চলতে শিখেছি আর ও তখন মায়ের কোলে-কোলেই ফেরে। মা আমার হাত ধরে চললেন— এতটুকু ওকে বুকে করে। গাঁয়ের সবাই বলতে লাগল, তুই কাঠুরের মেয়ে, কবে রানা ক্ষেতসিং তোকে বিয়ে করেছেন, তা কি তাঁর মনে আছে? মিছে চিতোর যাওয়া! মা ঘাড় নাড়ালেন, তারপর আমরা ঘর ছেড়ে বার হলেম। আমাদের সেই ছোটো ঘরখানি সেই সবুজ মাঠের ধারে সেই মস্ত তেঁতুলতলার দিকে চেয়ে আমার মনটা কেমন-কেমন করতে থাকল। আমি কেবলি ঘরের দিকে ফিরে চলতে চাইলেম। মা কিন্তু আর সেদিকেও চাইলেন না— সোজা চললেন আকাশ যেখানে মাটিতে এসে মিলেছে বরাবর সেই দিকেই চেয়ে। সন্ধ্যা হলে পথের ধারে, কোনো দিন গাছ তলায় কোনো দিন খোলা মাঠে মা আমাদের নিয়ে রাত কাটান। সকালে আবার চলতে আরম্ভ করেন। দুপুরে কোনো দিন কোনো গাঁয়ে আসি, সেখানে যা ভিক্ষে পাই, তাই খাই! কোনো দিন কিছু পাইও না, খাইও না। এইভাবে মা আমাদের চলেছেন— চিতোরের রানার দুঃখিনী কাঠকুড়োনি রানী! কতকাল পথে-পথে কাটল তার ঠিক নেই! সারা বর্ষা চলে গেল— ভিজতে-ভিজতে পথ চলতে চলতে! শীত এল। মাঠের দুরন্ত বাতাস রাতের বেলায় গায়ে যেন বরফ ঢেলে দিতে লাগল। ছেঁড়া কাঁথায় আমাদের জড়িয়ে নিয়ে মা সারারাত কাঁদতেন আর জাগতেন। আমাদের দুঃখিনী মা— রানী মা! আমি এক একদিন বলতেম মা, ঘরে চলো। মা বলতেন, আর একটু গেলেই ঘর পাব। আমি সামনের দিকে চেয়ে দেখতেম, দূরে কেবল একটা ঝাপসা পাহাড়ের ঠাণ্ডা নীল ঢেউ! মা, সেই নীলের দিকে চেয়ে চলতেন, আর এক-একবার তাঁর চোখ দিয়ে ঝর-ঝর করে জল পড়ত। এমনি সে কত দিন, কত দূর চলে একদিন আকাশে আজকেরই পথের ধারে চুপটি করে ঘুমিয়ে ছিলেন, আমি তাঁকে জাগিয়ে দিয়ে বললেম, মা চেয়ে দেখো পাহাড়ের উপর কত বড়ো বাড়ি! মা একবার চোখ মেলে দেখে বললেন, ওই আমার ঘর! খানিক পরে আস্তে-আস্তে আমায় বুকের কাছে টেনে নিয়ে একটি সোনার হার আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘রানাকে এইটে দেখাস, তিনি তোদের ঘরে ডেকে নেবেন।’
বুড়ো চাচার চোখে জল ভরে উঠল। মেয়েটি বললে, ‘তারপর? কী হল?’ কারো মুখে কথা নেই। অনেকক্ষণ পরে চাচা উত্তর দিলেন, ‘তারপর আর কী? রাজার রাজা যিনি, তিনি আমার দুঃখিনী মাকে ডেকে নিলেন— নিজের ঘরে!’
‘আর তোমাদের?’ মেয়েটি শুধাল।
চাচা আস্তে বললেন, ‘আমরা গেলাম রানার সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে কতকাল কাটালেম সুখে-দুঃখে দুই ভাই একলা! অত বড়ো রাজবাড়ি, সেখানে মাকে কোথায় খুঁজে পাব? দুজনে একলা থাকি আর মায়ের জন্যে কাঁদি— ’
মেয়েটি ভারি ব্যস্ত হয়ে শুধোলে, ‘রানার ঘরে মাকে পেলে না?’
চাচা ঘাড় নাড়লেন, ‘না। কোথায় যে গেলেন মা, তা কেমন করে জানব? সে অনেক দিন পরে, দুই ভাই যখন বুড়ো হয়েছি, তখন এক দিন সকালে উঠে রাজসভায় যাব, এমন সময় দেখলেন, পথের ধারে মা আমাদের এতটুকু একটি কচি মেয়ে হয়ে একলাটি দাঁড়িয়ে ঘরে যাব বলে কাঁদছেন। আমরা সেই অনেক দিনের হারানো মাকে ফিরে পেয়ে কোলে করে একেবারে ঘোড়া হাঁকিয়ে এই পাহাড়ে এসে উপস্থিত হলেম।’ মেয়েটি শুধোলে, ‘রানা আবার কাঠকুড়েনি রানীকে কেড়ে নিতে এলেন না?’ চাচা, মৈর দুজনেই বলে উঠলেন, ‘খুঁজে পেলে তো রানা? আমরা এমন জায়গায় মাকে লুকিয়ে রেখেছি রানার সাধ্যি কী, সেখান থেকে মাকে খুঁজে বার করেন!’ গল্প শুনতে-শুনতে মেয়েটির চোখ ঘুমিয়ে পড়ছিল। সে চাচার কোলে মাথা রেখে বললে, ‘আমাকে একদিন তোমাদের মাকে দেখাবে?’ চাচা আস্তে মেয়েটির চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, আর একটু বড়ো হও, তারপরে সেই নিরালা ঘরে একটি পিদিম জ্বালিয়ে মা যেখানটিতে একলা বসে আছেন সেখানে আমরা সবাই মিলে চুপি-চুপি চলে যাব।’ মেয়েটি ঘুমের ঘোরে দরজার দিকে চেয়ে বললে, ‘হিঙ্গুলিয়া?’ চাচার ভাই আফিমের ঝোঁক মাথা দলিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাকেও সঙ্গে নিতে হবে।’ যারা গল্প বলছিল আর শুনছিল, সবাই আস্তে-আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। জেগে রইল কেবল একটি পিদিমের আলো— অন্ধকারের মাঝে যেন কষ্টিপাথর-ঘষা একটুখানি সোনালী রঙ।
কোন সময়ে ঝড় বাতাস বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ জানে না; কখন রানা কুম্ভ তলোয়ার খুলে ঘরে ঢুকেছেন, হঠাৎ একটা মেঘ গর্জনের সঙ্গে কড়্‌ কড়্‌ করে বাজ পড়ল। তিনজনেই চমকে উঠে দেখলেন তিনখানা খোলা তলোয়ার মাথার উপরে ঝকঝক করছে। রানা কুম্ভ ডাকলেন, ‘ওঠো!’ দুই বুড়োতে উঠে দাঁড়ালেন— মেয়েটির হাত ধরে। কুম্ভ গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘রানাকে খুন করেছ, রাজপুত্রের মেয়েকে চুরি করে পালিয়ে এসেছ, এর শাস্তি আজ তোমাদের নিতে হবে!’
চাচা অবাক হয়ে বললেন, ‘রানাকে?’
মৈর আস্তে আস্তে বললেন, ‘মকুলজীকে?’
কুম্ভ বললেন, ‘হ্যাঁ, তাঁরই খুনের শাস্তি এই নাও!’ দুখানা তলোয়ার একই সঙ্গে দুই বুড়োর মাথায় পড়ল। মেয়েটি ‘মা!’ বলে একবার ডেকে অজ্ঞান হল। ঝড়ের বাতাস কোথা থেকে হঠাৎ এসে ঘরের পিদিম নিবিয়ে দিলে! কুম্ভ জানলেন, তাঁর বাপের খুনের শাস্তি দিলেন, রাজস্থানের সবাই জানলে তাই, কেবল ক্ষেতসিংহের কাটকুড়োনি রানীর দুই ছেলে, যাঁদের মাথা কাটা গেল, তাঁরাই জানালেন না, কেন রানা তাঁদের শাস্তি দিলেন! আর সেই মেয়েটি জানলে না দফাদারের ঘরে রাতারাতি কারাই বা তাকে রেখে গেল, আর কেনই বা সকলে গাঁয়ের লোক তাকে ঘিরে বলাবলি করলে— এ-তো নয়, সে-তো নয়! এমনি নানা কথা কয়ে সবাই মিলে সন্ধ্যেবেলায় গাঁয়ের বাইরে, মাঠের ধারে কেন যে তাকে একা বসিয়ে দিয়ে সবাই যে যার ঘরে চলে গেল, আর কেনই বা সারা রাত চাচা, হিঙ্গুলিয়া, হিঙ্গুলিয়া বলে কেঁদে ডাকলেও কেউ সাড়াশব্দ দিলে না, আর সেই রাতকোটের কেল্লা অন্ধকারে কোথায় যে হারিয়ে গেল খুঁজে খুঁজে চলে-চলে পা ধরে গেল, তবু তো আর সেখানে সে ফিরতে পারলে না!— কেন? কেন?
তারপরে রানা কুম্ভ চিতোরের সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর রানী মীরা দেখতে যেমন, গান গাইতেও তেমন। রতিয়া-রানার মেয়ে মীরা! তাঁর গান শুনে রূপ দেখে রানা কুম্ভ তাঁকে বিয়ে করেন। রানী স্বামীর সেবা করেন কিন্তু মন তাঁর পড়ে থাকে— রণ্‌ছোড়জীর মন্দিরে বাঁশি হাতে কালো পাথরের দেবমূর্তির পায়ের কাছে।
রানার কিন্তু এ ভালো লাগে না। তিনি নিজে কবি, গান রচনা করেন, আর সেই গান মীরা গায় রাজমন্দিরে বসে— এই চান রানা। কিন্তু সে তো হল না! মীরা দেবতার দাসী, তিনি রণ্‌ছোড়জীর মন্দিরেই সারা দিনমান ভক্তদের মধ্যে গাইতে লাগলেন, ‘মীরা কহে বিনা প্রেমসে না মিলে নন্দলালা!’
চিতোরেশ্বরী মীরা সবার মাঝে গান গাইবে একতারা বাজিয়ে, এটা ভারী লজ্জার কথা হয়ে উঠল। রানা হুকুম দিলেন, ‘মন্দিরে বাইরের লোক আসা বন্ধ করো।’
এক রাতের মধ্যে মন্দিরটা কানাতে ঘেরা হয়ে গেল। মীরাকে আর কেউ দেখতে পায় না কিন্তু গানের সুর শুনতে কানাতের বাইরে দেশ-বিদেশের লোক জড়ো হয়। বাঁশি শুনে হরিণ যেমন, তেমনি সবাই এক-মনে কান-পেতে প্রাণ ভরে মীরার গান শুনতে থাকে— তাড়ালে যায় না, হুকুম শোনে না, কাউকে মানেও না।
জোছনা-রাতে মন্দিরের সামনে শ্বেত-পাথরের বেদীতে বসে সোনা আর হীরে-জড়ানো সাজে সেজে মীরা স্বর্গের অপ্সরীর মতো দেবতার সামনে একলা নাচছেন, গাইছেন, রানা বীণা বাজাচ্ছেন, বাইরে লোকের ভিড়, এমন সময় আকাশ থেকে তারার মালার মতো একগাছি হীরের হার মীরার গলায় এসে পড়ল। রানা চমকে উঠে বীণা বন্ধ করলেন। মীরা সেই অমূল্য হার নিজের গলা থেকে খুলে মন্দিরের মধ্যে বংশীধারী রণ্‌ছোড়জীর গলায় পরিয়ে দিয়ে সে-রাতের মতো গান বন্ধ করলেন। হার যে কে দিয়ে গেল, তার আর খোঁজ হল না, কিন্তু দেশে নানা কথা রটল। কেউ বললে, দিল্লীর বাদশা দিয়ে গেছেন; কেউ বললে কে-এক উদাসীন, কেউ বা আরো কত কী! কিন্তু মীরা অমূল্য হার রানাকে না দিয়ে যে রণ্‌ছোড়জীকে নিবেদন করে দিয়েছেন তাতে সবাই খুশি হল। ভক্তেরা মীরার জয়জয়কার দিলে! কিন্তু কুম্ভ রানা একটু চটলেন। তিনি হুকুম দিলেন, ‘এবারে ভক্তেরা আসুন আর মীরা থাকুন বন্ধ অন্দরে।’ এই হুকুম দিয়ে রানা মহম্মদ খিলজীর সঙ্গে লড়ায়ে চলে গেলেন। মীরার গান বন্ধ হল। সেই সঙ্গে চিতোর নিরানন্দ হয়ে গেল। মন্দিরে কাঁদে ভক্তেরা; অন্দরে কাঁদেন মীরা। নন্দলালার দেখা না পেয়ে বন থেকে ছিঁড়ে আনা ফুলের মতো মীরা দিন-দিন মলিন হচ্ছেন, এমন সময় একদিন যুদ্ধ জয় করে ধুম-ধামে মহারানা চিতোরে এলেন। মামুন-শাকে তার মুকুটের সঙ্গে রানা চিতোরে বন্ধ রাখলেন। রাজ্যের কারিগর মিলে পাথর কেটে চিতোরের মাঝখানে প্রকাণ্ড জয়স্তম্ভ তুলতে আরম্ভ করলে। কিন্তু মীরার মন রানা জয় করতে পারলেন না; মীরা বললেন, ‘রানা, আমি নন্দলালার দাসী, আমাকে ঘরে বন্ধ কোরো না। আমি শুনতে পাচ্ছি আমার নন্দলালা বাইরে থেকে আমাকে ডাকছেন— ‘মীরা আয়!’ আমাকে ছেড়ে দাও রানা, আমি পথের কাঙালিনী হয়ে নন্দলালার সঙ্গে বৃন্দাবনে চলে যাই!’ রানা রেগে বললেন, রতিয়া সামান্য সর্দার, তার মেয়ে তুমি! তোমার কপালে সিংহাসন জুটবে কেন? যাও বেরিয়ে— যেখানে খুশি— আমি নতুন রানী নিয়ে আসছি।’ সেইদিন চিতোরেশ্বরীর মীরা নন্দলালার মীরা, ভিখারিনীর মতো একতারা বাজিয়ে পথে বার হলেন। আর রানা বার হলেন নতুন রানীর খোঁজে।
মন্দুর-রাজকুমারের সঙ্গে ঝালোয়ারের রাঠোর সর্দারের মেয়ের বিয়ে, বর আসছে ধুমধাম করে, এমন সময় রানা কুম্ভ এসে ঝলকুমারীকে সভার মধ্যিখান থেকে কেড়ে নিয়ে চিতোরে আনলেন। একে মহারানা, তাতে কুম্ভ, তাঁর উপর কথা কয় রাজস্থানে এমন তো কেউ নেই! কেবল বৃন্দাবনে মীরা যখন শুনলেন, মন্দুর-রাজকুমারের মুখে, রানা দুই প্রাণীর ভালোবাসার উপরে কী বিষম ঘা দিতে প্রস্তুত হয়েছেন, তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। ঝলকুমারীর বরকে নিয়ে চিতোরে চললেন। রানার কাছে খবর পৌঁছল মীরা আসছেন। আর কেন আসছেন সেটাও শুনলেন কুম্ভ। রানা কড়া হুকুম দিলেন, ‘ঝলোয়ান-বাগানের মধ্যে ঝলকুমারীকে কড়া পাহাড়ায় যেন বন্ধ রাখা হয়!’ তারপর কুম্ভ মীরাকে এক চিঠি পাঠালেন— চিতোরেশ্বরী মীরা, চিতোরেশ্বর তাঁকে পেলে সুখী হবেন। তিনি যা ভিক্ষা চাইতে এসেছেন, সেই স্ত্রী-রত্ন যেখানে বন্ধ আছে, সেই ঝলোয়ানের চাবিও রানা পাঠালেন। ইচ্ছে করলে বাগানের দরজা খুলে রানী মীরা ঝলকুমারীকে দেখে আসতে পারেন। কিন্তু মন্দুরের রাজকুমার যদিও বা কোনো উপায়ে ঝলোয়ানের বাগানে প্রবেশ করেন, কুমারীর দেখা পাবেন না নিশ্চয়। কেননা, রানার অন্দরে রানী ছাড়া কোনো পুরুষের যাবার হুকুম নেই। যদি যায়, তবে মাথা বাইরে রেখে যায় এটা জানা কথা!
তখন সন্ধ্যা আসছে। আকাশে একটিমাত্র তারা; আর দূরে ঝলোয়ানের বাগানের মধ্যে, পাথরের রাজপ্রাসাদের উপরে একটি ঘরে একটি আলো জ্বলজ্বল করে জানাচ্ছে মন্দুরের রাজকুমারের উপরে ঝলকুমারীর জ্বলন্ত ভালোবাসা! ঠিক সেই সময়ে রানার চিঠি মীরা পেলেন! চিঠি পড়ে মীরা বুঝলেন উপায় নেই। তিনি দুটি কথা রানাকে লিখলেন— ‘প্রেম না করলরে, বিনা প্রেমসে প্রেম না মিললরে!’ মীরা মন্দুরের রাজকুমারের হাতে ঝলোয়ানের চাবি দিয়ে চিতোর ছেড়ে চলে গেলেন; আর মন্দুর-রাজকুমার ঝলকুমারীকে শেষ-দেখা দেখে নিতে বাগানে ঢুকলেন— আলোর নিশানার দিকে চেয়ে।
সেই রাতকোটের কেল্লায় অন্ধকার-রাতে দুটি বুড়ো আর একটি কচি মেয়ের ভালোবাসার প্রদীপ যেমন করে হঠাৎ নিবেছিল, আজও আবার তেমনি করে রানা কুম্ভ নিজের অন্দরে ঝলকুমারীর ভালোবাসার প্রদীপটি তলোয়ারের চোটে নিবিয়ে দিয়ে সকালে রাজসভায় এসে বসলেন। কারিগর এসে জোড়-হাতে বলল, ‘মহারানার কীর্তিস্তম্ভ শেষ হয়েছে। স্তম্ভের নাম কী, জানতে চাই। পাথরের খোদাই করতে হবে।’
কুম্ভরানা খানিক ভেবে বললেন ‘লেখগে যাও— কুম্ভশ্যাম।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *