Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রাখালী || Rakhali by Jasimuddin

রাখালী || Rakhali by Jasimuddin

অডিও হিসাবে শুনুন

এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো,
মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো।
রানতে বসে জল আনতে সকল কাজেই হাসি যে তার,
এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে মার।
সান করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে
মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই থামতে নারে।

এই মেয়েটি এমনি ছিল, যাহার সাথেই হত দেখা,
তাহার মুখেই এক নিমেষে ছড়িয়ে যেত হাসির রেখা
মা বলিত, বড়ুরে তুই, মিছেমিছি হাসিস্ বড়,
এ শুনেও সারা গা তার হাসির চোটে নড় নড়!
মুখখানি তার কাঁচা কাঁচা, না সে সোনার, না সে আবীর,
না সে ঈষৎ ঊষার ঠোঁটে আধ-আলো রঙিন রবির!
কেমন যেন গাল দুখানি মাঝে রাঙা ঠোঁটটি তাহার,
মাঠে ফোটা কলমি ফুলে কতকটা তার খেলে বাহার।

গালটি তাহার এমন পাতল ফুঁয়েই যেন যাবে উড়ে
দু একটি চুল এলিয়ে পড়ে মাথার সাথে রাখছে ধরে।
সাঁঝ-সকালে এ ঘর ও ঘর ফিরত যখন হেসে-খেলে;
মনে হত ঢেউয়ের জ্বলে ফুলটিরে কে গেছে ফেলে!

এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে ও পথ দিয়ে চলতে ধীরে
ওই মেয়েটির রূপের গাঙে হারিয়ে গেল কলসটিরে।
দোষ কি তাহার? ওই মেয়েটি মিছেমিছি এমনি হাসে,
গাঁয়ের রাখাল! অমন রূপে কেমনে রাকে পরাণটা সে!
এ পথ দিয়ে চলতে তাহার কোঁচার হুড়ুম যায় যে পড়ে,
ওই মেয়েটি কাছে এলে আচঁলে তার দে সে ভরে।
মাঠের হেলের নাস্তা নিতে হুকোর আগুন নিবে যে যায়,
পথ ভুলে কি যায় সে নিতে, ওই মেয়েটি রানছে যেথায়?
নিড়ের ক্ষেতে বারে বারে তেষ্টাতে প্রাণ যায় যে ছাড়ি,
ভর-দুপুরে আসে কেবল জল খেতে তাই ওদের বাড়ি!
ফেরার পথে ভুলেই সে যে আমের আঁটির বাশীটিরে,
ওদের গরের দাওয়ায় ফেলে মাঠের পানে যায় সে ফিরে।
ওই মেয়েটি বাজিয়ে তারে ফুটিয়ে তোলে গানের ব্যাথা,
রাঙা মুখের চুমোয় চুমোয় বাজে সুখের মুখর কথা!

এমনি করে দিনে দিনে লোক- লোচনের আড়াল দিয়া,
গেঁয়ো স্নেহের নানান ছলে পড়ল বাঁধা দুইটি হিয়া!
সাঁঝের বেলা ওই মেয়েটি চলত যখন গাঙের ঘাটে
ওই ছেলেটির ঘাসের বোঝা লাগত ভারি ওদের বাটে।
মাথার বোঝা নামিয়ে ফেলে গামছা দিয়ে লইত বাতাস,
ওই মেয়েটির জল-ভরনে ভাসতে ঢেউয়ে রূপের উছাস।
চেয়ে চেয়ে তাহার পানে বলত যেন মনে মনে,
জল ভর লো সোনার মেয়ে! হবে আমার বিয়ের কনে?
কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা,
মেঠো বাঁশী বাজিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা!

বাঁশের কচি পাতা দিয়ে গড়িয়ে দেব নথটি নাকের,
সোনা লতায় গড়ব বালা তোমার দুখান সোনা হাতের।
ওই না গাঁয়ের একটি পাশে ছোট্র বেঁধে কুটিরখানি,
মেঝের তাহার ছড়িয়ে দেব সরষে ফুলের পাঁপড়ি আনি।
কাজলতলার হাটে গিয়ে আনব কিনে পাটের শাড়ী,
ওগো বালা! গাঁয়ের বালা! যাবে তুমি আমার বাড়ি?”

এই রুপেতে কত কথাই আসত তাহার ছোট্র মনে,
ওই মেয়েটি কলসী ভরে ফিরত ঘরে ততক্ষণে।
রুপের ভার আর বইতে নারে কাঁখখানি তার এলিয়ে পড়ে,
কোনোরুপে চলছে ধীরে মাটির ঘড়া জড়িয়ে ধরে।
রাখাল ভাবে, কলসখানি না থাকলে তার সরু কাঁখে,
রুপের ভারেই হয়ত বালা পড়ত ভেঙে পথের বাঁকে।
গাঙোন জল ছল-ছল বাহুর বাঁধন সে কি মানে,
কলস ঘিরি উঠছে দুলি’ গেঁয়ো-বালার রুপের টানে।

মনে মনে রাখাল ভাবে, “গাঁয়ের মেয়ে! সোনার মেয়ে।
তোমার কালো কেশের মত রাতের আঁধার এল ছেয়ে।
তুমি যদি বল আমায়, এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি
কলাপাতার আঁধার-ঘেরা ওই যে ছোট তোমার বাড়ি।
রাঙা দু’খান পা ফেলে যাও এই যে তুমি কঠিন পথে,
পথের কাঁটা কত কিছু ফুটতে পারে কোনমতে।
এই যে বাতাস-উতল বাতাস, উড়িয়ে নিলে বুকের বসন,
কতখন আর রুপের লহর তোমার মাঝে রইবে গোপন।
যদি তোমার পায়ের খাডু যায় বা খুলে পথের মাঝে,
অমর রুপের মোহন গানে সাঁঝের আকাশ সাজবে না যে।

আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! একা একা পথে চল,
ব্যথায় ব্যথায় আমার চোখে জল যে ঝরে ছল ছল।”
এমনিতর কত কথায় সাঁঝের আকাশ হত রাঙা,
কখন হলুদ, আধ-হলুদ, আধ-আবীর মেঘ ভাঙা।
তার পরেতে আসত আঁধার ধানের ক্ষেতে, বনের বুকে,
ঘাসের বোঝা মাথায় লয়ে ফিরত রাখাল ঘরের মুখে।

সেদিন রাখাল শুনল, পথে সেই মেয়েটির হবে বিয়ে,
আসবে কালি ‘নওশা’তাহার ফুল-পাগড়ী মাথায় দিয়ে।
আজকে তাহার ‘হলদি-ফোটা’ বিয়ের গানে ভরা বাড়ি,
মেয়ে-গলার করুণ গানে কে দেয় তাহার পরাণ ফাড়ি’।
সারা গায়ে হলুদ মেখে সেই মেয়েটি করছিল সান,
কাঁচা সোনা ঢেলে যেন রাঙিয়ে দেছে তাহার গা’খানা।
চেয়ে তাহার মুখের পানে রাখাল ছেলের বুক ভেঙে যায়।
আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! কেমন করে ভুললে আমায় ?

সারা বাড়ি খুশীর তুফান-কেউ ভাবে না তাহার লাগি,
মুখটি তাহার সাদা যেন খুনী মকর্দ্দমার দাগী।
অপরাধীর মতন সে যে পালিয়ে এল আপন ঘরে,
সারাটা রাত মরল ঝুরে কি ব্যথা সে বক্ষে ধরে।

বিয়ের ক’নে ছলছে আজি শ্বশুর-বাড়ি পালকী চড়ে
চলছে সাথে গাঁয়ের মোড়ল বন্ধু ভাই-এর কাঁধটি ধ’রে ।
সারাটা দিন বিয়ে বাড়ির ছিল যত কল-কোলাহল
গাঁয়ের পথে মূর্ত্তি ধরে তারাই যেন চলছে সকল।

কেউ বলিছে, মেয়ের বাপে খাওয়াল আজ কেমন কেমন,
ছেলের বাপের বিত্তি বেসাৎ আছে কি ভাই তেমন তেমন?
মেয়ে-জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদে মেলা,
সুর্য যেমন বইছে পাটে ফাগ-ছড়ান সাঁঝের বেলা!
এমনি করে কত কথাই কত জনের মনে আসে,
আশ্বিনেতে যেমনি তর পানার বহর গাঙে ভাসে।
হায়রে আজি এই আনন্দ, যাবে লয়ে এই যে হাসি,
দেখল না কেউ সেই মেয়েটির চোখদুটি যায় ব্যথায় ভাসি।
খুঁজল না কেউ গাঁয়ের রাখাল একলা কাঁদে কাহার লাগি
বিজন রাতের প্রহর থাকে তাহার সাথে ব্যথায় জাগি।

সেই মেয়েটির চলা-পথে সেই মেয়েটির গাঙের ঘাটে
একলা রাখাল বাজায় বাঁশী ব্যথার ভরা গাঁয়ের বাটে।
গভীর রাতে ভাটীর সুরে বাঁশী তাহার ফেরে উদাস
তারি সাথে কেঁপে কেঁপে কাঁদে রাতের কালো বাতাস।
করুণ করুণ-অতি করুণ বুকখানি তার উতল করে,
ফেরে বাঁশীর সুরটি ধীরে ধীরে ঘুমো গাঁয়ের ঘরে ঘরে।

“কোথায় জাগো বিরহিণী ! ত্যজি বিরল কুটিরখানি,
বাঁশীর ভরে এস এস ব্যথায় ব্যথায় পরাণ হানি।
শোন শোন দশা আমার, গহন রাতের গলা ধরি’
তোমার তরে ও নিদয়া, একা একা কেঁদে মরি।
এই যে জমাট রাতের আঁধার, আমার বাঁশী কাটি তারে,
কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কেঁদে মরে বারে বারে।”
ডাকছাড়া তার কান্না শুনি একলা নিশা সইতে নারে,
আঁধার দিয়ে জড়ায় তারে, হাওয়ায় দোলায় ব্যথার ভারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

We are happy to announce that our app is now available in
Google Playstore!