Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যার যা হারিয়ে গেছে || Sunil Gangopadhyay

যার যা হারিয়ে গেছে || Sunil Gangopadhyay

সেই যে একদিন এক ছোকরা বাজিকর অমলতাশ গাছতলায়
জোর গলায় হেঁকে বলেছিল:
কার কী হারিয়ে গেছে, এসো, এসো, আমাকে বলো
আমি সব খুঁজে দেব, আমি সব খুঁজে দেব!
এমন কে আছে, যার কখনও কিছু হারায়নি
এমন কে আছে যার কিছু হারাবার দুঃখ নেই
এমন কে আছে যে কিছু ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখে না
অনেক মানুষ এসে জড়ো হল সারা গায়ে রোদ্দুর মেখে
অনেক মানুষ এল এক চোখে বিশ্বাস, অন্য চোখে
অবিশ্বাস নিয়ে
অনেক মানুষ এল সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে দু’হাতে
পিছুটান সরিয়ে সরিয়ে
সবাই তাকে পলকহীন ভাবে দেখে নেয়
সবাই তার অচেনা মুখে একটুও চেনা চিহ্ন আছে কি না খোঁজে

টুকরো টুকরো রঙিন কাপড় জোড়া দেওয়া আলখাল্লা পরা
পুরুষ্টু গোঁফটা নিশ্চয়ই নকল, তার জোড়াভুরু নরম
নবীন তৃণের মতন
তার থুতনিতে মুছে যায়নি কৈশোরের লাবণ্য
চোখ দুটি দুরন্ত ঘোড়সওয়ার।
তার উত্তোলিত ডান হাতে কিছু নেই, তবু যেন অদৃশ্য
জাদুদণ্ড ধরে আছে

কে আগে নিজের কথা জানাবে?
সকলের ঠেলাঠেলির মধ্যে কেমন যেন লজ্জা ভাব
কতই বা বয়েস ছেলেটার, তার কাছে কি মন খোলা যায়
তবে হতেও পারে কোনও গুনিনের বংশধর
যার হারানো বস্তু সব চেয়ে অকিঞ্চিৎকর, সে-ই প্রথম
মুখ খুলতে পারে
মাঝ বয়েসী, মুখে-মেছেতা স্ত্রীলোকটি বলল, ওগো
আমার একটা কাঁসার রেকাবি, ঠাকুরের…
তার কথা শেষ হল না, জাদুকর তার হাতে পাঞ্জার বরাভয়
দেখিয়ে বলল,
জানি, জানি, পাবে, ঠিক পেয়ে যাবে, তিন সত্যি
এরপর ফুটফাট বাজি ফোটার মতন শুরু হয়ে গেল
আমার আংটি, আমার ফাঁদি নথ, আমার জলে-ডোবা
পেতলের ঘড়া, তিনখানা একশো টাকার নোট,
মায়ের ছবি…
সে যদি নারী হত, তা হলে বলা যেত, তার হাসি
পূর্ণিমার আলোর মতন
সে পুরুষ, তাই তার হাসি যেন সদ্য ভাঙা নারকোলের
ভেতরের শুভ্রতা
সেই হাসি দিয়ে সে সবাইকে বলতে লাগল, পাবে
ঠিক পেয়ে যাবে, তিন সত্যি, তিন সত্যি
অনেকেই আশা করেছিল, সে সাঁইবাবার মতন শূন্যে হাত ঘুরিয়ে
তক্ষুনি তক্ষুনি এনে দেবে বাতাস থেকে
হারিয়ে যাওয়া সব কিছু
তবু তার তিন সত্যিতে এমন সরল সত্যের দৃঢ়তা
যা মুখের ওপর অস্বীকার করা যায় না
শূন্যতার মধ্যেও যেন ফুল ফুটছে, মেঘলা আকাশেও
যেমন ঝিকমিক করে তারা

শুধু দু’তিনজন দাঁড়িয়ে রইল এক পাশে
তারা কিছুই জানাল না, তাদের যা হারিয়েছে
তা জানাবার মতন ভাষা নেই
এ এমনই এক নিঃস্বতা যে বস্তুবিশ্বের অন্য কিছুই
তাদের মনে পড়ে না
তাদের নতচক্ষু, মনে মনে কাঁদছে বোধহয়
কেউ অন্যদের দিকে তাকাচ্ছে না
পাশাপাশি দাঁড়িয়েও তারা একলা
তাদের প্রত্যেকের হারাবার বেদনার নিজস্ব তীব্রতা এক নয়
তাদের কান্নাও আলাদা
বাজিকরটি আর সবাইকেই ফিরিয়ে দিয়েছে দৃষ্টি
প্রত্যেককে দিয়েছে তিন সত্যি
এই ছোট দলটির দিকে সে চেয়ে রইল একটুক্ষণ
এদের কোনও দাবি নেই, এদের কান্নাও সে শুনতে পায়নি
তবু বুঝতে তার দেরি হল না
তার মুখের হাসি অন্ধকার হয়ে গেল
নেমে এল ডান হাত
আর সে তিন সত্যি বলতে পারল না

বিকেল ফুরিয়ে গেছে, রাত্রি আসছে অন্য দেশ থেকে
মানুষেরা ঘরে ফিরবে, গোধূলিতে শোনা যাবে
যাই যাই মৃদু ফিসফিসানি
অনেকেই চায় তবু এ ছোকরাটি কারুর বাড়িতে
আশ্রয় নেবে না
কোনও গৃহস্থের বাড়ি শয্যা পাতা তার নাকি গুরুর নিষেধ
সে অন্ন নেবে না, ফল-মূল নেবে না, কোনও দক্ষিণাও চাই না
তবু কেন সে মানুষের হারিয়ে যাওয়া সব কিছু উদ্ধার
করতে এসেছে?
মন্ত্র-টন্ত্রও কিছু শোনায়নি, কোন সাহসে তিন সত্যি
উচ্চারণ করল এতবার?
যে কিছুই চায় না, সে কেন মানুষকে কিছু দেবে?
এ কোন্ আজব প্রাণী, সে কি এই পৃথিবীর নয়
তার খিদে তেষ্টাও নেই, সে শুয়ে থাকবে আকাশের নীচে
সে কোথা থেকে, কেনই বা এল, কেউ কিছুই বুঝল না
এবং পরদিন সকালে সে অদৃশ্য হয়ে গেল
তবে কি সত্যিই অলীক, দৈবী মায়া, সে রকমই ভাবতে ইচ্ছে করে
সে কি শত শত শতাব্দীর এক পথিক, হঠাৎ হঠাৎ
গাছতলায় এসে দাঁড়ায়?

দু’একদিনের মধ্যেই কেউ পুকুরঘাটে ফিরে পেল রেকাবি
কারও মায়ের ছবি উদ্ধার হল ইঁদুরের গর্ত থেকে
এ রকম দু’একটিতেই দিকে দিকে রটে গেল তিন সত্যির মহিমা
এসব কাকতালীয় বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না
তার চেয়ে অলৌকিকত্ব অনেক জোর এনে দেয়
আসবে, আসবে, এরপর সব কিছুই ফিরে আসবে
অমলতাশ গাছটির নীচে স্থাপিত হবে এক অজ্ঞাত
দেবতার নামে বেদী
তেত্রিশ কোটির পরেও আরও একজন
শুধু যে-কয়েকজন নিস্তব্ধ ছিল, যারা কিছু চায়নি
যারা পায়নি তিন সত্যির প্রতিশ্রুতি
তারা আর ওই গাছতলায় যায় না, তাদের কান্না থামেনি।

এ বছর বন্যায় নদী এসে গ্রাস করেছে ইস্কুলবাড়ি
এ বছর তিল চাষ নষ্ট হয়ে গেছে শোঁয়া পোকার উপদ্রবে
এ বছর জমিতে জমিতে অনেক রক্ত ঝরেছে
এ বছর সদ্য স্তনবতী দুটি মেয়ে হারিয়ে গেছে মালবাজারে
এ বছর উদরাময় এসেছে রাক্ষসীর বেশে
তবু মজা পুকুরের পাঁক থেকে একটি শূন্য পেতলের কলসি
ভেসে উঠলে
চতুর্দিকে শোনা যায় জয়ধ্বনি
সবাই তো আগেই বলেছিল, তিন সত্যি কখনও
মিথ্যে হয় না
সেই বাজিকর অবশ্যই ফিরে আসবে
এর মধ্যে যার যার হারিয়েছে, সে সবও সে চোখের সামনে
এনে দেবে।

শুধু যা হারিয়ে যাওয়ার কথা মুখে বলা যায় না
তার সন্ধানেই তো ছুটে বেড়াচ্ছে সেই আলখাল্লা পরা, পাতলা ছেলেটা
যে মেয়েটি মুখ বুজে করে যাচ্ছে ঘর সংসারের কাজ
তার ভালোবাসা হারিয়ে গেছে তাই সে নিভৃতে গোপনে কাঁদে
শিলাবৃষ্টিতে ঝরে যাচ্ছে আমের বোল, তার সব ফুল
ঝরে গেছে আগেই
আগুন লাগল গ্রামের হাটে, তার বুক যে পুড়ে খাক হয়ে গেছে
কেউ জানে না
ভালোবাসা হারিয়ে গেছে, তাই শুকিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী
ভালোবাসা হারিয়ে গেছে তাই চতুর্দিকে এত দুর্গন্ধ
বাতাসে এত তাপ, পাতাল থেকে উঠে আসছে বিষাক্ত কীট
অনেক মানুষ সারা জীবন জানলই না সত্যি সত্যি সে
কী হারিয়েছে
তাপ্পি মারা আলখাল্লা পরা ছোকরাটি রাত কাটাচ্ছে
এক গাছতলা থেকে অন্য গাছতলায়
এক এক সময় সে নিজেই উছাড়ি পিছাড়ি হয়ে কাঁদে
কোনওদিন কি সে পারবে তিন সত্যি দিয়ে
বন্দি করতে ভালোবাসাকে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress