Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর || Muhammad Zafar Iqbal » Page 3

বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকর || Muhammad Zafar Iqbal

খেতে বসে প্লেটের দিকে তাকিয়ে শিউলি বলল, “এটা কী?”

মতলুব মিয়া ভান করল যেন সে প্রশ্নটা শুনতে পায়নি। শিউলি পেটের সাদামতন আঠা-আঠা জিনিসটায় হাত দিয়ে আরেকবার নেড়ে হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল, “এটা কী না বললে আমি খাব না।”

২৭৫

মতলুব মিয়া মুখ শক্ত করে বলল, “ঢং কোরো না। এইটা ভাত।”

“ভাত?”

শিউলি পেটটা ধরের উলটো করে ফেলল, দেখা গেল সাদামতন আঠালো জিনিসটা পড়ল না, প্লেটে আটকে রইল। আঙুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে বলল, “এইটা ভাত না। ভাত এভাবে আটকে থাকে না, নিচে পড়ে যায়।”

“ঠিক আছে ঠিক আছে বাবা–বুঝলাম। ভাতটা একটু গলে গেছে।”

“ভাত এভাবে গলে না। যদি এভাবে গলে সেটা ভাত থাকে না।”

টেবিলের অন্যপাশে বসে রইসউদ্দিন খুব মনোযোগ দিয়ে শিউলি এবং মতলুব মিয়ার কথাবার্তা শুনছিলেন। তাঁর প্লেটেও ভাত নামের এই সাদা আঠা আঠা জিনিসটা রয়েছে। তিনি জিনিসটা একটু নেড়েও দেখেছেন। মুখে দিতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু তাঁর কোনো উপায় আছে বলে মনে হচ্ছিল না। গত পঁচিশ বছর থেকে মতলুব মিয়া তাকে এরকম কুৎসিত জিনিস খাইয়ে আসছে। খাবার যে ভালোমন্দ হতে পারে, তার মাঝে যে উপভোগের একটা ব্যাপার আছে সেটা তিনি জানেনই না।

শিউলি সামনে বাটিতে রাখা খানিকটা মাছের ঝোলের দিকে দেখিয়ে বলল, “এটা কী?”

মতলুব মিয়া কঠিনমুখে বলল, “মাছের তরকারি।”

“মাছ রান্না করার আগে মাছকে কুটতে হয়, পেট থেকে নাড়িভুড়ি বের করতে হয়–এই দেখি এমনি বেঁধে ফেলেছ। ওয়াক, থুঃ!”

মতলুব মিয়া মুখ শক্ত কর বলল, ‘সেগুলি বড় মাছ। ছোট মাছ কুটতে হয় ণা।”

“তোমাকে বলেছে। এই দেখো মাছের পেটে নিশ্চয়ই কেঁচো আছে পিঁপড়ার ডিম আছে, ব্যাঙের পচা ঠ্যাং আছে–”এই বলে শিউলি সাবধানে একটা মাছের লেজ ধরে তুলে এনে পেটে চাপ দিতেই সত্যি সত্যি ময়লা হলদে এবং কালচে কিছু নোংরা জিনিস বের হয়ে এল। শিউলি নাক কুঁচকে খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মতলুব চাচা, তুমি একটা আস্ত খবিশ!”

মতলুব মিয়া মুখ রাগে থমথম করতে থাকে। সে চোখমুখ লাল করে বলল, “এই মেয়ে, তুমি খাওয়া নিয়ে মশকরা কর? তুমি জান যারা না খেয়ে থাকে তারা এটা খেতে পেলে কী করবে?”

“কচু করবে!” শিউলি ঠোঁট উলটে বলল, “আমি অনেকদিন না খেয়ে থেকেছি। কফিল চাচার বাসায় কিছু হলেই আমাকে না খাইয়ে রাখত, কিন্তু আমি মরে গেলেও তোমার এই মাছ খাব না। হ্যাঁক, থুঃ!”

“তা হলে কী খাবে?”

“তুমি আবার সবকিছু ঠিক করে রান্না করবে।”

“ইশ! মামাবাড়ির আবদার!” মতলুব মিয়া মুখ ভেংচে বলল, “এখন আমি লাটসাহেবের জন্যে সবকিছু আবার নতুন করে রান্না করব! আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই!”

শিউলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে, তা হলে আমিই রান্না করব।”

রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “তুমি রান্না করতে পার?”

শিউলি মাথা নেড়ে বলল, “না।”

“তা হলে?”

“মতলুব চাচাও তো পারে না। সে রান্না করছে না?”

অকাট্য যুক্তি। রইসউদ্দিন কিছু বলতে পারলেন না, তবে মতলুব মিয়া মেঘের মতো গর্জন করে বলল, “কী বললে?”

“তুমি শুধু যে রাঁধতে পার না তা-ই না। তুমি জান পর্যন্ত না কী দিয়ে রাঁধতে হয়।”

“আমি কী দিয়ে রাধি?”

“কেরোসিন তেল দিয়ে। তোমার সব খাবারে খালি কেরোসিনের গন্ধ। হ্যাঁক, থুঃ!”

মতলব মিয়া দাঁত-কিড়মিড় করতে লাগল। তাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে শিউলি বলল, “আর এই প্লেটগুলো দেখো।”

“কী হয়েছে প্লেটে?”

“উপর দিয়ে চিকা হেঁটে গেছে, তুমি সেই প্লেট ধোও নাই। এই দেখো, চিৎকার পায়র ছাপ দেখা যাচ্ছে।”

রইসউদ্দিন ভালো করে শিউলির প্লেটটা দেখলেন, সত্যি সত্যি প্লেটের পাশে ময়লা, ছোট ছোট পায়ের ছাপ। শিউলি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “রইস চাচা, তুমি অপেক্ষা করো, আমি বেঁধে আনছি। শুধু চুলোটা কেমন করে ধরাতে হয় একটু দেখিয়ে দেবে?”

মতলুব মিয়া সারাক্ষণ মুখ গোঁজ করে রইল। তার মাঝে সত্যি সত্যি শিউলি খানিকটা ভাত বেঁধে ফেলল, সাথে ডিমভাজা। রইসউদ্দিন অনেক দিন পর বেশ তৃপ্তি করে ভাত খেলেন।

পরদিন রইসউদ্দিন অফিসে গেছেন। টেবিলে টোস্ট বিস্কুট রাখা থাকে, তাই দিয়ে তিনি নিজে সকালের নাশতা সেরে ফেলেন। মতলুব মিয়া কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে তার ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরি হয়। আজ অবিশ্যি দেরি করতে পারল না, শিউলি তাকে ডেকে তুলে ফেলল।

মতলুব মিয়া চোখ লাল করে বলল, “কী হয়েছে?”

“ওঠো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।”

“উঠে কী হবে?”

“ঘরদোর পরিষ্কার করতে হবে। দেখেছ ঘরবাড়ির অবস্থা?”

মতলুব মিয়া কম্বল সরিয়ে উঠে বসল। তাকে দেখে মনে হতে লাগল সে বুঝি কারও উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। চোখ-মুখ পাকিয়ে বলল, “ছেমড়ি–”

শিউলি বাধা দিয়ে বলল, “খবরদার, আমাকে ছেমড়ি বলবে না!”

মতলুব মিয়া গর্জন করে বলল, “ছেমড়িকে ছেমড়ি বলব না তো কী বলব? শুনো ছেমড়ি, আমি এই বাসাতে আছি আজ পঁচিশ বছর–তুমি আসছ পঁচিশ ঘণ্টাও হয় নাই। এই বাসায় কী করতে হবে কী না-করতে হবে সেই হুকুম তুমি দেবে না।”

“আমি মোটেও হুকুম দিচ্ছি না। কিন্তু ঘরদোর ময়লা হয়ে আছে সেটা পরিষ্কার করতে হবে না?”

“আমার যখন ইচ্ছা হবে আমি পরিষ্কার করব। তোমাকে বলতে হবে না।”

“একশো বার বলতে হবে।”

শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, “তুমি খালি শুয়ে শুয়ে ঘুমাবে আর রইস চাচা কষ্ট করে করে তোমাকে খাওয়াবে সেটা হবে না।”

“দেখো ছেমড়ি–”

“খবরদার আমাকে ছেমড়ি বলবে না।”

“বললে কী হবে?”

“বলে দেখো কী হয়!”

“ছেমড়ি ছেমড়ি ছেমড়ি। বলেছি। কী হয়েছে?”

শিউলি কিছু না বলে উঠে গেল। মতলুব মিয়া দেখল তার কিছুই হল না, কিন্তু তবু কেমন যেন একটু ভয় পেয়ে গেল। এইটুকুন মেয়ে, কিন্তু চোখের দৃষ্টিটা কেমন যেন বাঘিনীর মতো।

মতলুব মিয়া আর কথাবার্তা না বলে বিছানা থেকে উঠে গেল। অবিশ্বাস্য মনে হলেও দেখা গেল সে সারাদিন ঘরদোর একটু পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছে। দুপুরবেলা থালা-বাসন পর্যন্ত ধুয়ে ফেলল। সন্ধ্যে না হতেই রান্না শুরু করে দিল। তবে সে শিউলিকে চেনে না বলে বুঝতে পারল না, এত করেও তার বিপদ একটুও কাটা গেল না।

কাউকে শাস্তি দিতে হলে শিউলি প্রথমে তাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে, এবারেও সে তাই করল, গভীর মনোযোগ দিয়ে কয়েকদিন মতলুব মিয়ার কাজকর্ম লক্ষ করল। মতলুব মিয়ার কাজকর্ম লক্ষ করার একটামাত্র সমস্যা লক্ষ করার মতো কোনো কাজকর্মই সে করে না। বেশির ভাগ সময়েই সে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে নাহয় বসে থাকে। নেহাত দরকার না পড়লে সে নড়াচড়া করে না। পৃথিবীর সব মানুষের জীবনেই কোনো-না-কোনো উদ্দেশ্য বা শখ থাকে। তার জীবনে কোনো উদ্দেশ্য বা শখ কিছুই নেই। একমাত্র যে-জিনিসটাকে শখ বলে চালানো যায় সেটা হচ্ছে সিগারেট। সারাদিনে সে বেশ কয়েকটা সিগারেট খায়। রইসউদ্দিন সিগারেটের গন্ধ একেবারে সহ্য করতে পারেন না বলে সে সিগারেট খায় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে। শিউলি চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করল এই সিগারেট দিয়ে মতলুব মিয়াকে কঠিন একটা শাস্তি দিতে হবে।

মতলুব মিয়া কী সিগারেট খায় জেনে নিয়ে একদিন শিউলি পাশের দোকান থেকে দুই শলা সিগারেট এবং একটা ম্যাচের বাক্স কিনে আনল। সিগারেটের ভেতর থেকে আধাআধি তামাক বের করে সে দেশলাইয়ের বারুদগুলো চেঁছে চেঁছে ভেতরে ঢোকাল। তারপর আবার সিগারেটের তামাকটা ঢুকিয়ে দিল। এমনিতে সিগারেটেটা দেখে কিছু বোঝার কোনো উপায় নেই কিন্তু আগুনটা যখন মাঝামাঝি পৌঁছে যাবে হঠাৎ করে দেশলাইয়ের বারুদ জ্বলে উঠবে। যে সিগারেট টানছে তার পিলে চমকানোর জন্যে এর থেকে ভালো বুদ্ধি আর কী হতে পারে?

দেশলাইয়ের বারুদভরা দুই শলা সিগারেট মতলুব মিয়ার বালিশের তলায়। রাখা সিগারেটের প্যাকেট ঢুকিয়ে দেওয়ার পরই শিউলির কাজ শেষ। এরপর শুধু অপেক্ষা করা।

শিউলি যেটুকু আশা করেছিল মতলুব মিয়ার সিগারেট নিয়ে তার থেকে অনেক বেশি মজা হল। রাত্রে ভাত খেয়ে তার বিছানায় বসে সে সিগারেট ধরিয়ে খুব আরামে কয়েকটা টান দিয়েছে হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই সিগারেটের মাঝে যেন একটা বোমা ফাটল! স্যাৎ করে বিশাল আগুন জ্বলে উঠল সিগারেটের মাথায়। কিছু বোঝার আগেই সেই আগুনে মতলুব মিয়ার গোঁফে আগুন ধরে গেল।

গোঁফে আগুন লাগলে সেটা নেভাবার কোনো উপায় নেই সেটা এই প্রথমবার মতলুব মিয়া আবিষ্কার করল। দেখতে দেখতে তার নাকের ডগায় সিকিভাগ গোঁফ পুড়ে ছাই হয়ে গেল। মতলুব মিয়া জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিকট গলায় চিৎকার করে উঠে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করল। কম্বলে জড়িয়ে গিয়ে পা বেঁধে হুমমুড় করে নিচে পড়ে যা একটা তুলকালাম কাণ্ড হল সে আর বলার মতো নয়। জ্বলন্ত সিগারেট গিয়ে পড়ল বিছানার চাঁদরে–সেখানে আবার একটা ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ড ঘটে গেল।

মতলুব মিয়ার চিৎকার আর হৈচৈ শুনে রইসউদ্দিন এবং তাঁর পিছুপিছু শিউলি ছুটে এল। বিছানার চাঁদরে আগুন জ্বলছে, পানি ঢেলে সেই আগুন নিভিয়ে রইসউদ্দিন টেনেটুনে মতলুব মিয়াকে তুলে দাঁড় করালেন। নাকের ডগায় পুড়ে গোঁফের খানিকটা উধাও হয়ে গেছে বলে তাকে দেখতে এত বিচিত্র লাগছিল যে শিউলি মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হেসে ফেলল। রইসউদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে মতলুব মিয়া?”

মতলুব মিয়া কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, “সিগারেটটা হঠাৎ কেমন জানি দুম করে ফেটে গেল!”

রইসউদ্দিন ধমক দিয়ে বললেন, “সিগারেট কি গ্যাস বেলুন যে দুম করে ফেটে যাবে?”

“বিশ্বাস করেন–”মতলুব মিয়া ভাঙা গলায় বলল, “কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ করে দুম করে ফেটে আগুন ধরে গেল।”

রইসউদ্দিন আবার ধমক দিয়ে বললেন, “আজেবাজে কথা বলবে না মতলুব মিয়া। কতবার বলেছি ঘরের মাঝে বিড়ি-সিগারেট খাবে না–সেই কথা কি শুনে দেখেছ? সিগারেটের আগুনে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছ, নিজের গোঁফ জ্বালিয়ে দিচ্ছ–ফাজলেমির তো একটা সীমা থাকা দরকার!”

মতলব মিয়ার দুই নম্বর সিগারেট নিয়ে আরও বেশি মজা হল। কারণ সেটাতে শব্দ করে হঠাৎ দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল মাছ-বাজারে। চমকে উঠে ভয় পেয়ে বিকট চিৎকার করে মতলুব মিয়া সেই জ্বলন্ত সিগারেট ছুঁড়ে দিল সামনে, সেটি গিয়ে পড়ল এক মাছওয়ালার ঘাড়ে। সেই মাছওয়ালা জ্বলন্ত আগুন নিয়ে লাফিয়ে পড়ল পাশের মাছওয়ালার কোলে। মাছ-বাজারের কাদায় তারা গড়াগড়ি করতে লাগল আর তাদের ঝাপিতে রাখা আফ্রিকান রাক্ষুসে মাগুর মাছগুলো গড়িয়ে পড়ল নিচে। সেগুলো কিলবিল করে সাপের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, মাছ-বাজারের মানুষের পায়ে, আঙুলে কামড়ে ধরল একটি দুটি বদরাগী মাছ।

মানুষজনের হৈচৈ চিৎকার শুনে বাজারের লোকজন মনে করল বুঝি চাঁদাবাজরা এসেছে চাঁদা তুলতে। লাঠিসোটা নিয়ে কিছু মানুষ ছুটে এল তাড়া করে, কিছু বোঝার আগে দমাদম দুই-এক ঘা পড়ল মতলুব মিয়ার মাথায় আর ঘাড়ে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা মতলুব মিয়া যখন বাসায় ফিরে এল তাকে দেখে রইসউদ্দিন আঁতকে উঠলেন। তার জামাকাপড় ঘেঁড়া, কপালের কাছে ফুলে আছে, গালের কাছে খানিকটা ছাল উঠে গেছে এবং সে হাঁটছে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে। রইসউদ্দিন ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে তোমার মতলুব মিয়া?”

“পাবলিক ধরে মার দিয়েছে।”

“কেন?”

“ভেবেছে আমি মাছ-বাজারে ককটেল ফাটিয়েছি।”

রইসউদ্দিন চোখ কপালে তুলে বললেন, “ককটেল? তুমি ককটেল ফাটিয়েছ?”

“না। আসলে ককটেল ফাটাই নাই। সিগারেটেটা যখন দুম করে বোমার মতো ফেটে গেল–”

“সিগারেট?”

“জে। মতলুব মিয়া মাথা চুলকে বলল, “কেন যে সিগারেটগুলো এইভাবে আগুন ধরে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না!”

রইসউদ্দিনের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল শিউলি, হঠাৎ সে মুখে হাত দিয়ে খিকখিক করে হেসে উঠল। হাসির শব্দ শুনে রইসউদ্দিন চমকে উঠে তার দিকে তাকালেন। হঠাৎ তার মাথায় একটা সন্দেহের কথা মনে হল। এগুলো কি শিউলির কাজ? যে-মেয়েটি কফিলউদ্দিন আর তাঁর স্ত্রীর মতো মহা ধুরন্ধর মানুষকে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দেয়, মতলুব মিয়ার মতো অকাট মূর্খ তো তার কাছে ছয় মাসের শিশু!

রইসউদ্দিন ঘুরে, শিউলির দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “শিউলি!”

শিউলি মুখ তুলে তাকাল। বলল, “জি?”

“তুমি কি জান মতলুব মিয়ার সিগারেটে আগুন ধরে যাচ্ছে কেন?”

শিউলির মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে ওঠে, সে মাথা নাড়িয়ে বলল, “জানি।”

মতলুব মিয়া হতভম্বের মতো শিউলির দিকে তাকিয়ে রইল। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “জা-জা জান?”

“হ্যাঁ জানি। আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেই এরকম বিপদ হয়।”

“খা-খারাপ ব্যবহার করলে? কে-কে-কেন?”

শিউলি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, “আমার একটা পোষ জিন আছে তো তাই! হি হি হি!”

শিউলির হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে রইসউদ্দিন হঠাৎ কেমন জানি দুর্বল অনুভব করতে থাকেন।

দুদিন পর মতলুব মিয়া এসে রইসউদ্দিনকে একটা ভালো বুদ্ধি দিল। বলা যেতে পারে মতলুব মিয়ার সুদীর্ঘ জীবনে এই প্রথমবার একটা কথা বলল যার ভেতরে খানিকটা চিন্তা-ভাবনার ব্যাপার আছে। সে রইসউদ্দিনকে বুদ্ধি দিল শিউলিকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়ার জন্যে। বুদ্ধিটি অবিশ্যি কোনো গভীর ভাবনা থেকে আসেনি, এটা এসেছে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে শিউলি মতলুব মিয়ার পেছনে লেগে যায়, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড় ধোওয়া বাথরুম ধোওয়া, বাসন ধোওয়া, বাজার করা, রান্না করা–এমন কোনো কাজ নেই যেটা তার করতে হচ্ছে না। গত পঁচিশ বছরের একটানা আরাম মনে হচ্ছে রাতারাতি শেষ হতে চলেছ। শিউলিকে স্কুলে ভর্তি করে দিলে দিনের একটা বড় অংশ কাটবে স্কুলে। যতক্ষণ বাসায় থাকবে ততক্ষণ পড়োশোনাও করতে হবে–মতলুব মিয়ার পেছনে এত লাগার সুযোগ পাবে না।

শিউলিকে স্কুলে দেবার বুদ্ধিটি রইসউদ্দিনের পছন্দ হল। সত্যি কথা বলতে কি, কথাটি যে তার নিজের মনে হয়নি সেজন্য তার একটু লজ্জাও হল। শিউলির ছোট চাচাকে তিনি খোঁজা শুরু করেছেন। প্রথম ব্যাপারটিকে যত অসম্ভব মনে হয়েছিল এখন সেটাকে তত অসম্ভব মনে হচ্ছে না। তার নাম-ধাম জোগাড় হয়েছে। কয়েকদিনের মাঝেই আমেরিকার নানা জায়গায় চিঠিপত্র লেখা শুরু করবেন। কবে শিউলির ছোট চাচা খোঁজ পাবেন, কবে তাকে নিয়ে যাবেন তার নিশ্চয়তা নেই। পাঁচ-ছয় মাস এমনকি কে জানে বছরখানেক লেগে যেতে পারে। ততদিন তো শিউলিকে শুধুশুধু ঘরে বসিয়ে রাখা যায় না!

স্কুলে যাবার ব্যাপারটা শিউলির খুব পছন্দ হল না, কিন্তু রইসউদ্দিন সেটাকে মোটেই গুরুত্ব দিলেন না। তাকে নিয়ে রীতিমতো জোর করে পাড়ার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। ভালো স্কুলে ছাত্র ভর্তি করা যেরকম খুব কঠিন, এই স্কুলটাতে মনে হল ভর্তি করানো ঠিক সেরকম সহজ। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক বা ক্লাসঘর কোনোকিছুই ঠিকভাবে নেই। বেতন দিতে রাজি থাকলে মনে হয় তারা গরু ছাগল এমনকি চেয়ার-টেবিলও ভর্তি করে নিতে রাজি আছে!

স্কুলে গিয়ে প্রথম দিনে শিউলির কালোমতন একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হল। স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে সে খুব শখ করে তেঁতুলের আচার খাচ্ছিল। শিউলিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এই স্কুলে ভর্তি হয়েছ?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার বাবা-মা নিশ্চয়ই ডিভোর্সি। বাবা-মা ডিভোর্সি হলে বাচ্চারা এই স্কুলে ভর্তি হয়। তখন তো বাচ্চার আর যত্ন থাকে না তাই সব বাবা-মা এনে এই স্কুলে ভর্তি করে দেয়। কঠিন স্কুল এটা। মাস্টার মাত্র দুইজন। মোটো মাস্টারনি আর চিকন মাস্টারনি। সাদা মাস্টারনি আর কালা মাস্টারনিও বলতে পার। রাগী মাস্টারনি আর হাসি মাস্টারনিও বলতে পার। যার যেটা ইচ্ছা সে সেইটা বলে আমি বলি রাজি আপা আর পাজি আপা। রাজি আপা সবকিছুতেই রাজি। তুমি যদি বল, আপা আজকে পড়তে ইচ্ছা করছে না তা হলে রাজি আপা সাথে সাথে রাজি হয়ে যাবে। বলবে ঠিক আছে। যদি পাজি আপাকে বল আপা পড়তে ইচ্ছা করছে না, পাজি আপা মনে হয় বন্দুক বের করে গুলি করবে ডিচুম ডিচুম। কেউ কখনো বলে নাই। পাজি আপার ক্লাসে কোনো হাসি-তামাশা নাই। নো নো নো…”

কালোমতন মেয়েটা একটানা কথা বলে যেতে লাগল। শিউলি প্রায় মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কথা বলতে বলতে একসময় যখন নিঃশ্বাস নেবার জন্যে একটু থেমেছে তখন শিউলি জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”

“আমার আসল নাম ছিল মৃত্যু। আম্মু অবিশ্যি স্বীকার করে না। কিন্তু আমি শিওর। মৃত্যু থেকে মিততু। মিততু থেকে মিতু। এখন সবাই ডাকে মিতু। আমার অবিশ্যি মৃত্যু নামটাই ভালো লাগে। যখন বড় হব তখন আবার মৃত্যু করে ফেলব। কী সুইট না মৃত্যু নামটা? তোমার নাম কী? দাঁড়াও, আগেই বোলো না, দেখি আমি আন্দাজ করে বলতে পারি কি না। মানুষের চেহারার সাথে নামের মিল থাকে তো তাই চেষ্টা করলে পারা যায়। ভালো করে তাকাও আমার দিকে। তোমার নামটা একটু বেশি চোখা, পাখির ঠোঁটের মতো লাগে। তার মানে পাখি নামে নাম। ময়না না হলে তো তোতো না হলে টিয়া। ঠিক হয়েছে?

“উহ। আমার নাম শিউলি।”

“ইশ ভাই! একটুর জন্যে পারলাম না। তোমার কপালটা দেখে মনে হয়েছিল বলি ফুল, একেবারে ফুলের পাপড়ির মতো ছিল। ফুল হলেই বলতাম বকুল না হলে উঁই না হলে শিউলি। বলতাম না?”

শিউলি মাথা নাড়ল, হয়তো বলত। মিতু মেয়েটা আবার চলন্ত ট্রেনের মতো কথা বলতে শুরু করল, “তুমি প্রথম এসেছ তো তাই তোমাকে সবকিছু বলে দিতে হবে। না হলে তোমার বিপদ হতে পারে। আমাদের ক্লাসে কোনো নরমাল ছেলেমেয়ে নেই। সবগুলো অ্যাবনরমাল। অর্ধেকের বেশি হচ্ছে মেদামার্কা। সেগুলো নড়েচড়ে না, কথা বলে না। যেটা সবচেয়ে বেশি মেদামার্কা সেটার আবার চশমা আছে। সেটা পরীক্ষায় ফাস্ট হয়। সেটার নাম শরিফা, আমরা ডাকি ল্যাদাল্যাদা শরিফা। বাকি অর্ধেক হচ্ছে দুর্দান্ত। এর মাঝে কয়েকটা মনে হয় এর মাঝেই জেল খেটেছে। হরতালের সময় টোকাইরা গাড়ি ভাঙচুর করে জান তো–এরাও তখন তাদের সাথে গাড়ি ভাঙচুর করতে নেমে যায়। এদের লিডার হচ্ছে কাসেম। সবাই ডাকে কাউয়া কাসেম। কাউয়া কাসেম থেকে সাবধান। সবসময় তার পকেটে দুই-চারটা ককটেল থাকে। সেইদিন অঙ্ক পরীক্ষায় সরল অঙ্কের উত্তর হল সাড়ে তিন। সরল অঙ্কের উত্তর হবে এক নাহয় শূন্য–সাড়ে তিন কেমন করে হয়? কাউয়া কাসেম তখন রেগে গিয়ে বলল, চল গাড়ি ভাঙচুর করি। ঠিক তখন পাজি আপা এল ক্লাসে। কাঁক করে ঘাড়ে চেপে ধরে দুম করে মাথার মাঝে দিল একটা রদ্দা–কাউয়া কাসেম ঠাণ্ডা হয়ে গেল।”

শিউলি অবাক হয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে রইল তার মিতু একেবারে মেশিনের মতো মুখে খই ফোঁটাতে লাগল। একজন মানুষ যে এত কথা বলতে পারে সে নিজের চোখে না দেখলে ব্যাপারটা বিশ্বাস করত না। স্কুলের ঘণ্টা পড়ার আগেই এই স্কুল, স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, মাস্টার-মাস্টারনি, দপ্তরি, বেয়ারা, বুয়া সবার সম্পর্কে শিউলির একেবারে সবকিছু জানা হয়ে গেল।

প্রথম ক্লাসটি বাংলা। পড়াতে এলেন ফরসামতন হালকা-পাতলা একজন কমবয়সী মহিলা। মিতু গলা নামিয়ে শিউলিকে বলল, “এইটা হচ্ছে রাজি আপা। রাজি আপাকে যেটা বলবে সেটাতেই রাজি।”

শিউলি দেখল কথাটি মিথ্যে নয়, রোল কল করার পরই মিতু হাত তুলে বলল, “আপা আজকে আমরা পড়ব না।”

“কেন পড়বে না মিতু?”

মিতু শিউলিকে দেখিয়ে বলল, “এই যে এই মেয়েটা আজকে আমাদের ক্লাসে নতুন এসেছে, সেইজন্যে আনন্দ করব।”

রাজি আপা হাসিহাসি মুখে বললেন, “কিন্তু তা হলে এই নতুন মেয়েটা যদি মনে করে এই স্কুলে মোটে পড়াশোনা হয় না?”

পেছনের বেঞ্চে বসা কুচকুচে কালো একটা ছেলে মোটা গলায় বলল, “তা হলে তো ভালোই হয়।”

মিতু ফিসফিস করে শিউলিকে বলল, “এইটা হচ্ছে কাউয়া কাসেম।”

একেবারে সামনে বসে থাকা চশমা পরা একটা মেয়ে একেবারে কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, “না আপা না। পড়াশোনা না হলে কেমন করে হবে?”

মিতু ফিসফিস করে বলল, “ল্যাদল্যাদা শরিফা।”

রাজি আপা বললেন, “আচ্ছা তা হলে এক কাজ করা যাক। পড়াশোনাও হোক আবার আনন্দও হোক। সবাই একটা করে চার লাইনের কবিতা লেখো।”

ল্যাদল্যাদা শরিফা বলল, “কিসের উপর লিখব আপা? ছয় ঋতুর ওপরে? নাকি প্রকৃতির ওপরে?”

“সবাই নিজের ওপরে লেখো। তা হলে এই যে নতুন মেয়েটা সবার সম্পর্কে জানতে পারবে। ভালো হবে না?”,

ল্যাদল্যাদা শরিফা বলল, “খুব ভালো হবে আপা খুব ভালো হবে। কিন্তু আপা আমি নিজের সম্পর্কে মাত্র চার লাইনে কী লিখব? আমি কি বেশি লিখতে পারি? আট লাইন না হলে যোলো লাইন?

রাজি আপা বললেন, “ঠিক আছে লেখো।”

পেছন থেকে কাউয়া কাসেম বলল, “নিয়ম যখন ভাঙাই হল আমিও ভাঙি?”

রাজি আপা বললেন, “তুমিও বেশি লিখবে?”

“না আপা। আমি কম লিখব, এক লাইন লিখি?”

“এক লাইনে কবিতা হয় না কাসেম। কমপক্ষে চার লাইন লিখতে হবে। নাও সবাই শুরু করো।”

সবাই মাথা গুঁজে লিখতে শুরু করল। কোনো শব্দ নেই, শুধু কাগজের ওপর পেন্সিলের ঘসঘস শব্দ। মাঝে মাঝে শুধু কেউ-একজন আটকে-থাকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে আবার নতুন করে শুরু করছে।

কুড়ি মিনিট পর প্রথম কবিতাটি লেখা হল। লিখেছে মোটাসোটা গোলগাল একটি ছেলে, তার নাম সুখময়। রাজি আপা তাকে কবিতাটি পড়ে শোনাতে বললেন, সে লাজুক-মুখে পড়ে শোনাল :

“আমার নাম সুখময়
কিন্তু আমার জীবন বেশি সুখময় নয়,
কারণ–মাঝে মাঝে আমার
টনসিলে ব্যথা হয়।”

রাজি আপা হাততালি দিয়ে বললেন, “ভেরি গুড সুখময়, খুব সুন্দর কবিতা হয়েছে। এখন কে পড়ে শোনাবে?”

ক্লাসের মাঝামাঝি বসে-থাকা একটি মেয়ে কবিতার খাতা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার চুল পরিপাটি করে বাঁধা, ঠোঁটে লিপস্টিক, মুখে পাউডার। সে কাঁপা গলায় বলল,

“আমার নাম ফারজানা হক বন্যা
আমি একদিন হব মডেল কন্যা
আমি হব বিখ্যাত গান গায়িকা
আমি হবই হব প্যাকেজ নাটকের নায়িকা।”

রাজি আপা মুখ টিপে হেসে বললেন, “খুব সুন্দর কবিতা বন্যা। তুমি নিশ্চয়ই একদিন নায়িকা হবে। এরপর কে পড়তে চাও?”

পেছনের বেঞ্চ থেক কাসেম বলল, “আমারটা পড়ব আপা?”

“পড়ো দেখি।” কাসেম উঠে দাঁড়িয়ে মোটা গলায় বলল,

“কাসেম কাসেম
ঢেম ঢেম
ভুম ভাম ভেম
ঢেম ঢেম।”

রাজি আপা মাথা নেমে বললেন, “ভুম ভাম ঢেম এগুলা কিসের শব্দ কাসেম?”

“ককটেলের।”

“উঁইঁ। এরকম লিখলে হবে না। নিজের সম্পর্কে লিখতে হবে। আবার চেষ্টা করো।”

কাসেম মাথা নেড়ে আবার তার কাগজ নিয়ে বসে গেল। রাজি আপা শরিফার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার কী খবর শরিফা?”

“প্রথম চার লাইন হয়ে গেছে আপা।”

“পড়ে শোনাও দেখি আমাদের!” ল্যাদল্যাদা শরিফা উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে পড়তে শুরু করল :

“আমি শরিফা বেগম অতি বড় এক জ্ঞানপিপাসু মেয়ে।
প্রতিদিন আমি বই নিয়ে বসি রাতের খাওয়া খেয়ে।
অঙ্ক করি, বাংলা পড়ি, পড়ি বিজ্ঞান বই
হোমওয়ার্ক সব শেষ করে বলি আর হোমওয়ার্ক কই?”

রাজি আপা মুখ টিপে হেসে বললেন, “তোমার নিজেকে তুমি খুব সুন্দর ফুটিয়েছ শরিফা।”

শরিফা একগাল হেসে বলল, “এখনও তো শেষ হয়নি। শেষ হলে দেখবেন।”

রাজি আপা শিউলির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে আমাদের নতুন মেয়ে! তোমার কত দূর?”

শিউলি মাথা নাড়ল, “হয়ে গেছে।”

আপা বললেন, “পড়ো দেখি।”

শিউলি শুরু করল :

“শিউলি আমার নাম–
আমার সাথে তেড়িবেড়ি করলে ঘুসি মারি ধাম ধাম।
আমার সাথে ফাঁইট?
এমন শিক্ষা দেব আমি যে জন্মের মতো টাইট!”

শিউলির কবিতা শুনে রাজি আপার চোয়াল ঝুলে পড়ল, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো গলায় বললেন, “ইয়ে নিজেকে খুব সুন্দর করে প্রকাশ করেছ শিউলি। তবে কিনা–”

পেছনে থেকে কাউয়া কাসেম বলল, “ফাস্ট ক্লাস কবিতা হইছে আপা। একেবারে ফাস্ট ক্লাস! রবীন্দ্রনাথ ফেইল।”

সেকেন্ড পিরিওডে অঙ্ক ক্লাস। ঘণ্টা পড়ার পর শিউলি দেখল মোটামতন একজন কালো মহিলা মিলিটারির মতন দুমদাম করে পা পেলে ক্লাসে ঢুকলেন। মিতু তার ব্যাগের ভেতর থেকে একটা মাঝারি সাইজের শিশি বের করে শিউলিকে দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “নাও।”

“এটা কী?”

“তেল। কানে লাগিয়ে নাও।”

“কানে?”

“হ্যাঁ।”

“কেন?”

“টের পাবে একটু পরেই।”

শিউলি ঠিক বুঝতে পারল না কেন কানে তেল লাগাতে হবে। কিন্তু আর প্রশ্ন করল না। মিতুর দেখাদেখি দুই কানের লতিতে একটু তেল মেখে নিল। তেলের শিশিটা মিতুকে ফেরত দেওয়ার আগেই আপা ক্লাসে ঢুকে গেলেন, শিউলি তাড়াতাড়ি শিশিটা ডেস্কের নিচে লুকিয়ে ফেলল।

কালো মোটা এবং রাগী-রাগী চেহারার আপা ক্লাসে ঢুকেই টেবিলের উপর দুম করে তাঁর খাতাপত্র রেখে হুংকার দিলেন, “কে কে হোমওয়ার্ক আনে নাই?”

সারা ক্লাস চুপ করে রইল, হয় সবাই হোমওয়ার্ক করে এনেছে নাহয় যারা আনেনি তাদের সেটা স্বীকার করার সাহস নেই। শিউলি মাত্র আজকেই প্রথম ক্লাসে এসেছে, তার হোমওয়ার্ক আনার কথা কি না সেটাও সে ভালো করে জানে না। আপা চোখ পাকিয়ে সারা ক্লাসের দিকে তাকালেন। শিউলি দেখল তার চোখের সাদা অংশে লাল রঙের রগগুলো ফুলে রয়েছে। আপা দুই পা এগিয়ে এসে সামনে যাকে পেলেন খপ করে তার কান ধরে টেনে প্রায় শূন্যে তুলে ফেললেন। সেইভাবে ঝুলিয়ে রেখে বললেন, “দেখা হোমওয়ার্ক।”

একটা ছেলেকে কানে ধরে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখলে তার পক্ষে হোমওয়ার্ক দেখানো খুব সহজ ব্যাপার নয়, কিন্তু সে তার মাঝেই হাতড়ে হাতড়ে তার বইখাতা ঘেঁটে তার অঙ্কখাতা বের করে এগিয়ে দিল। আপা সেইভাবে কান ধরে তাকে ঝুলিয়ে রেখে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে হুংকার দিলেন, “কোথায় হোমওয়ার্ক খুলে দেখা।”

ছেলেটা আধা-ঝুলন্ত অবস্থায় খাতা খুলে হোমওয়ার্কটি বের করে দিল, শিউলি ভাবল এবার নিশ্চয়ই তার কানটা ছেড়ে দেওয়া হবে কিন্তু আপা ছাড়লেন না। কানে ধরে ঝুলিয়ে রেখে খাতার পৃষ্ঠা উলটিয়ে কিছু-একটা দেখে বাজখাই গলায় ধমক দিলে বললেন, “পেন্সিল দিয়ে লিখেছিস কেন?”

ছেলেটা চিচি করে বলল, “তা হলে কী দিয়ে লিখব?”

“কলম দিয়ে, গাধা কোথাকার!”

শিউলি ভাবল এখন নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে, কিন্তু আপা তাকে ছাড়লেন না। সেভাবে ঝুলিয়ে রাখলেন। আরও খানিকক্ষণ খাতার দিকে তাকিয়ে থেকে হুংকার দিয়ে বললেন, “বলেছি না খাতার পাশে এক ইঞ্চি মার্জিন রাখতে? এত বেশি রেখেছিস কেন?”

এতক্ষণে শিউলি বুঝে গিয়েছে এই আপার নাম কেন পাজি আপা রাখা হয়েছে–মহাপাজি আপা রাখলেও খুব একটা ভুল হত না। শিউলির এবারে সন্দেহ হতে থাকে কান ধরে রাখা ছেলেটিকে আদৌ ছাড়া হবে কি না। যখন সে প্রায় নিঃসন্দেহে হয়ে গেল সে কানে ধরে ঝুলয়ে রেখে এই এক ঘণ্টাতেই ছেলেটার কানটি খানিকটা লম্বা করে দেওয়া হবে তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে পাজি আপা দুপা এগিয়ে গিয়ে একটি মেয়ের কান ধরে তাকে শূন্যে তুলে ফেললেন। ছেলেটার দুর্গতি দেখে সে আগেই তার হোমওয়ার্কের খাতা খুলে রেডি হয়েছিল। মহাপাজি আপা তাই তাকে হোমওয়ার্কের কথা কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, হুংকার দিয়ে জানতে চাইলেন, “লেফটেন্যান্ট বানান কর দেখি!”

অঙ্ক ক্লাসে কেন লেফটেন্যান্ট বানান করতে হবে সেটা শিউলি বুঝতে পারল কিন্তু ক্লাসে সবার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল এই ক্লাসে কেউ এই সমস্ত ছোটখাটো জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায় না। অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে কিন্তু মেয়েটা সত্যি সত্যি লেফটেন্যান্ট বানান করে ফেলল।

পাজি আপা এতে আরও রেগে গেলেন। দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “ডায়রিয়া?” মেয়েটা শুকনো মুখে বলল, “কার?”

“কারও না গাধা কোথাকার! বানান কর।”

“মেয়েটা ঢোক গিলে চেষ্টা করল, “ডি-আই-আই-আর—”

মহাপাজি আপা কানে ধরে ঘ্যাঁচ করে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে মেয়েটাকে আরও দুইঞ্চি ওপরে তুলে ফেললেন। মেয়েটা যন্ত্রণার একটা শব্দ করে থেমে গেল, মনে হল বুঝতে পারল এই আপার সামনে কাতর শব্দ করে কোনো লাভ নেই। আপা বললেন, “পড়াশোনার নামে বাতাস নেই, দিনরাত শুধু নখড়ামো? ধ্যাষ্টামো? বাদরামো? একেবারে সিধে করে ছেড়ে দেব।”

শিউলি একটা নিঃশ্বাস ফেলল, কেউ যদি এখানে নখড়াননা ধ্যাষ্টামো বা বাঁদরামো করে থাকে সেটা হচ্ছে এই পাজি আপা। কাউকে যদি সিঁধে করার দরকার থাকে তা হলে এই মহাপাজি আপাকে।

পঞ্চম ছেলেটিকে কানে ধরে ঝুলিয়ে রেখে মনে হল পাজি আপা প্রথমবার শিউলিকে দেখতে পেলেন। খুব গরমের দিনে রোদের মাঝে হেঁটে এসে হঠাৎ করে ঠাণ্ডা পেপসির বোতল দেখলে মানুষের চোখে যেরকম একটা ভাব ফুটে ওঠে পাজি আপার চোখে ঠিক সেরকম ভাব ফুটে উঠল। আপা থপ থপ করে হেঁটে শিউলির সামনে হাজির হলেন, জিব দিয়ে সুড় করে লোল টেনে বললেন, “নতুন মেয়ে? আরেকটা বাঁদর? নাকি আরেকটা শিম্পাঞ্জি?”

পাজি আপা মাথা নিচু করে শিউলির চোখে চোখ রেখে তাকালেন। দূর থেকে ভাল করে দেখতে পায়নি কাছে আসার পর শিউলি দেখতে পেল আপার নাকের নিচে পাতলা গোঁফের রেখা। আপা নাক দিয়ে ফোৎ করে একটা শব্দ করলেন, “এই ক্লাসে সবাইকে আমি সিধে করে রাখি। মনে থাকবে?”

শিউলি মাথা নাড়ল, তার মনে থাকবে।

”আমাকে দেখেছ তো? দুষ্টু ছেলেপিলের আমি কল্লা ছিঁড়ে ফেলি। বুঝেছ?”

পাজি আপা শিউলির আরও কাছে এসে বললেন, “এইবার বলো দেখি চান, আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?”

“সত্যি বলব?”

“বলো।”

“আজকে আপনি মোচ কামাতে ভুলে গেছেন।”

সারা ঘরে হঠাৎ একেবারে পিনপতন স্তব্ধতা নেমে এল। মনে হল একটা মাছি হাঁচি দিলেও বুঝি শোনা যাবে। পাজি আপা নিজের কানকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলেন না, শিউলির দিকে মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ক্লাসের দিকে তাকালেন। ক্লাসের সবাই তখনও তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠিক তখন হঠাৎ কেউ-একজন একটা বিদঘুঁটে শব্দ করল, হাসি আটকে রাখার চেষ্টা করার পরও যখন হাসি বের হয়ে আসে তখন যেরকম শব্দ হয় শব্দটা অনেকটা সেরকম। হাসি সাংঘাতিক ছোঁয়াচে জিনিস, হাম বা জলবসন্ত থেকেও বেশি ছোঁয়াচে। তাই হঠাৎ একসাথে সারা ক্লাসের নানা কোণা থেকে বিদুঘটে শব্দ শোনা যেতে লাগল। এক সেকেন্ড পর দেখা গেল ক্লাসেই সবাই মুখে হাতচাপা দিয়ে হিহি করে হাসতে শুরু করেছে।

পাজি আপা চোখ পাকিয়ে ক্লাসের সবার দিকে তাকালেন, কয়েক পা এগিয়ে ক্লাসের মাঝামাঝি দাঁড়ালেন, এমনকি একটা ছোট হুংকার দিলেন। কিন্তু কোনো লাভ হল বলে মনে হল না, সবাই হাসতেই থাকল। তখন মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন শিউলির দিকে। হুলো বিড়াল পাখির ছানার উপর লাফিয়ে পড়ার আগে চোখের দৃষ্টি যেরকম হয়, তার চোখের দৃষ্টি হল হুবহু সেরকম। নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ করে তখন চলন্ত ট্রেনের মতো ছুটে আসতে লাগলেন, শিউলি তখন বুঝতে পারল তার এখন বেঁচে থাকার একটিমাত্র উপায়।

মিতুর দেওয়া তেলের শিশিটা তখনও তার হাতে, ছিপিটা খুলে সাবধানে সে উপুড় করে তেলটুকু ঢেলে দিল সামনে। পাজি আপা এতকিছু খেয়াল করলেন না, হেঁটে একেবারে সেই তেলঢালা পিচ্ছিল জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। গলা দিয়ে বাঘের মতো শব্দ করে শিউলির কান ধরার চেষ্টা করলেন। ধরেও ফেলেছিলেন প্রায়, কিন্তু কানে তেল মাখিয়ে রেখেছিল বলে শিউলি পিছলে মাথা বের করে নিল। পাজি আপা তাল সামলাতে পারলেন না, তার বিশাল দেহ নিয়ে মেঝেতে ঢেলে-রাখা তেলে আছাড় খেলেন।

ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সবিস্ময়ে দেখল তিনি পিছলে যাচ্ছেন, তাল সামলানোর চেষ্টা করছেন, একটা বেঞ্চ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করলেন, ধরে রাখতে পারলেন না, মুখ দিয়ে বিকট গাগা শব্দ করতে করতে পাজি আপা উলটে পড়লেন। সমস্ত ক্লাসঘর তখন কেঁপে উঠল, মনে হল কাছাকাছি কোথাও যেন অ্যাটম বোমা পড়েছে!

ক্লাসে তখন একটা অত্যন্ত বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, ছেলেমেয়েরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করল, এই যে ভয়ংকর পাজি আপা তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সেই আপাও একেবারে সাধারণ মানুষের মতো আছাড় খেয়ে পড়তে পারেন। শুধু তাই নয়, আছাড় খেয়ে পড়ে যাবার পর তাঁর বিশাল দেহ নিয়ে যখন উঠতে না পেরে হাঁসফাঁস করতে থাকেন তখন তাঁকে এতই হাস্যকর দেখাচ্ছিল যে কারওই বুঝতে বাকি থাকে না যে পাজি আপার ভয় দেখানোর পুরো ব্যাপারটাই আসলে একটা ভান।

ছেলেমেয়েদের ভয়ডর এত কমে গেল যে হেডমাস্টার যখন কী হয়েছে খোঁজ নিতে এলেন তখন তিনি আবিষ্কার করলেন, ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে খেতে তাঁকে টেনেটুনে ঠেলেঠুলে তোলার চেষ্টা করছে–যেন পাজি আপা তাদেরই মতো একজন ক্লাসের ছেলে বা মেয়ে।

পাজি আপা এরপর আর কোনোদিন শিউলির ক্লাসে পড়তে আসেননি।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *