Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » প্রতিবেশিনী || Rabindranath Tagore

প্রতিবেশিনী || Rabindranath Tagore

অডিও হিসাবে শুনুন

আমার প্রতিবেশিনী বালবিধবা। যেন শরতের শিশিরাশুপ্লুত শেফালির মতো বৃন্তচ্যুত; কোনো বাসরগৃহের ফুলশয্যার জন্য সে নহে, সে কেবল দেবপূজার জন্যই উৎসর্গ-করা।

তাহাকে আমি মনে মনে পূজা করিতাম। তাহার প্রতি আমার মনের ভাবটা যে কী ছিল পূজা ছাড়া তাহা অন্য কোনো সহজ ভাষায় প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করি না— পরের কাছে তো নয়ই, নিজের কাছেও না।

আমার অন্তরঙ্গ প্রিয়বন্ধু নবীনমাধব, সেও কিছু জানিত না। এইরূপে এই-যে আমার গভীরতম আবেগটিকে গোপন করিয়া নির্মল করিয়া রাখিয়াছিলাম, ইহাতে আমি কিছু গর্ব অনুভব করিতাম।

কিন্তু মনের বেগ পার্বতী নদীর মতো নিজের জন্মশিখরে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে চাহে না। কোনো-একটা উপায়ে বাহির হইবার চেষ্টা করে। অকৃতকার্য হইলে বক্ষের মধ্যে বেদনার সৃষ্টি করিতে থাকে। তাই ভাবিতেছিলাম, কবিতায় ভাব প্রকাশ করিব। কিন্তু কুণ্ঠিতা লেখনী কিছুতেই অগ্রসর হইতে চাহিল না।

পরমাশ্চর্যের বিষয় এই যে, ঠিক এই সময়েই আমার বন্ধু নবীনমাধবের অকস্মাৎ বিপুল বেগে কবিতা লিখিবার ঝোঁক আসিল, যেন হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো।

সে বেচারার এরূপ দৈববিপত্তি পূর্বে কখনো হয় নাই, সুতরাং সে এই অভিনব আন্দোলনের জন্য লেশমাত্র প্রস্তুত ছিল না। তাহার হাতের কাছে ছন্দ মিল কিছুরই জোগাড় ছিল না, তবু সে দমিল না দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলাম। কবিতা যেন বৃদ্ধ বয়সের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর মতো তাহাকে পাইয়া বসিল। নবীনমাধব ছন্দ মিল সম্বন্ধে সহায়তা ও সংশোধনের জন্য আমার শরণাপন্ন হইল।

কবিতার বিষয়গুলি নূতন নহে; অথচ পুরাতনও নহে। অর্থাৎ তাহাকে চিরনূতনও বলা যায়, চিরপুরাতন বলিলেও চলে। প্রেমের কবিতা, প্রিয়তমার প্রতি। আমি তাহাকে একটা ঠেলা দিয়া হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “কে হে, ইনি কে।”

নবীন হাসিয়া কহিল, “এখনো সন্ধান পাই নাই।”

নবীন রচয়িতার সহায়তাকার্যে আমি অত্যন্ত আরাম পাইলাম। নবীনের কাল্পনিক প্রিয়তমার প্রতি আমার রুদ্ধ আবেগ প্রয়োগ করিলাম। শাবকহীন মুরগি যেমন হাঁসের ডিম পাইলেও বুক পাতিয়া তা দিতে বসে, হতভাগ্য আমি তেমনি নবীনমাধবের ভাবের উপরে হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ দিয়া চাপিয়া বসিলাম। আনাড়ির লেখা এমনি প্রবল বেগে সংশোধন করিতে লাগিলাম যে, প্রায় পনেরো-আনা আমারই লেখা দাঁড়াইল।

নবীন বিস্মিত হইয়া বলে, “ঠিক এই কথাই আমি বলিতে চাই, কিন্তু বলিতে পারি না। অথচ তোমার এ-সব ভাব জোগায় কোথা হইতে।”

আমি কবির মতো উত্তর করি, “কল্পনা হইতে। কারণ, সত্য নীরব, কল্পনাই মুখরা। সত্য ঘটনা ভাবস্রোতকে পাথরের মতো চাপিয়া থাকে, কল্পনাই তাহার পথ মুক্ত করিয়া দেয়।”

নবীন গম্ভীরমুখে একটুখানি ভাবিয়া কহিল, “তাই তো দেখিতেছি। ঠিক বটে।” আবার খানিকক্ষণ ভাবিয়া বলিল, “ঠিক ঠিক।”

পূর্বেই বলিয়াছি আমার ভালোবাসার মধ্যে একটি কাতর সংকোচ ছিল, তাই নিজের জবানিতে কোনোমতে লিখিতে পারিলাম না। নবীনকে পর্দার মতো মাঝখানে রাখিয়া তবেই আমার লেখনী মুখ খুলিতে পারিল। লেখাগুলো যেন রসে ভরিয়া উত্তাপে ফাটিয়া উঠিতে লাগিল।

নবীন বলিল, “এ তো তোমারই লেখা। তোমার নামে বাহির করি।”

আমি কহিলাম, “বিলক্ষণ। এ তোমারই লেখা, আমি সামান্য একটু বদল করিয়াছি মাত্র।”

ক্রমে নবীনেরও সেইরূপ ধারণা জন্মিল।

জ্যোতির্বিদ যেমন নক্ষত্রোদয়ের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে আমিও যে তেমনি মাঝে মাঝে আমাদের পাশের বাড়ির বাতায়নের দিকে চাহিয়া দেখিতাম, সে কথা অস্বীকার করিতে পারি না। মাঝে মাঝে ভক্তের সেই ব্যাকুল দৃষ্টিক্ষেপ সার্থকও হইত। সেই কর্মযোগনিরতা ব্রক্ষ্মচারিণীর সৌম্য মুখশ্রী হইতে শান্তস্নিগ্ধ জ্যোতি প্রতিবিম্বিত হইয়া মুহূর্তের মধ্যে আমার সমস্ত চিত্তবিক্ষোভ দমন করিয়া দিত।

কিন্তু সেদিন সহসা এ কী দেখিলাম। আমার চন্দ্রলোকেও কি এখনো অগ্ন্যুৎপাত আছে। সেখানকার জনশূন্য সমাধিমগ্ন গিরিগুহার সমস্ত বহ্নিদাহ এখনো সম্পূর্ণ নির্বাণ হইয়া যায় নাই কি।

সেদিন বৈশাখ মাসের অপরাহ্নে ঈশান কোণে মেঘ ঘনাইয়া আসিতেছিল। সেই আসন্ন ঝঞ্ঝার মেঘবিচ্ছুরিত রুদ্রদীপ্তিতে আমার প্রতিবেশিনী জানালায় একাকিনী দাঁড়াইয়া ছিল। সেদিন তাহার শূন্যনিবিষ্ট ঘনকৃষ্ণ দৃষ্টির মধ্যে কী সুদূরপ্রসারিত নিবিড় বেদনা দেখিতে পাইলাম।

আছে, আমার ঐ চন্দ্রলোকে এখনো উত্তাপ আছে! এখনো সেখানে উষ্ণ নিশ্বাস সমীরিত। দেবতার জন্য মানুষ নহে, মানুষের জন্যই সে। তাহার সেই দুটি চক্ষুর বিশাল ব্যাকুলতা সেদিনকার সেই ঝড়ের আলোকে ব্যগ্র পাখির মতো উড়িয়া চলিয়াছিল। স্বর্গের দিকে নহে, মানবহৃদয়নীড়ের দিকে।

সেই উৎসুক আকাঙ্ক্ষা-উদ্দীপ্ত দৃষ্টিপাতটি দেখার পর হইতে অশান্ত চিত্তকে সুস্থির করিয়া রাখা আমার পক্ষে দুঃসাধ্য হইল। তখন কেবল পরের কাঁচা কবিতা সংশোধন করিয়া তৃপ্তি হয় না— একটা যে-কোনোপ্রকার কাজ করিবার জন্য চঞ্চলতা জন্মিল।

তখন সংকল্প করিলাম, বাংলাদেশে বিধবাবিবাহ প্রচলিত করিবার জন্য আমার সমস্ত চেষ্টা প্রয়োগ করিব। কেবল বক্তৃতা ও লেখা নহে, অর্থসাহায্য করিতেও অগ্রসর হইলাম।

নবীন আমার সঙ্গে তর্ক করিতে লাগিল; সে বলিল, “চিরবৈধব্যের মধ্যে একটি পবিত্র শান্তি আছে, একাদশীর ক্ষীণ জ্যোৎস্নালোকিত সমাধিভূমির মতো একটি বিরাট রমণীয়তা আছে; বিবাহের সম্ভাবনামাত্রেই কি সেটা ভাঙিয়া যায় না।”

এ-সব কবিত্বের কথা শুনিলেই আমার রাগ হইত। দুর্ভিক্ষে যে লোক জীর্ণ হইয়া মরিতেছে তাহার কাছে আহারপুষ্ট লোক যদি খাদ্যের স্থূলত্বের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করিয়া ফুলের গন্ধ এবং পাখির গান দিয়া মুমূর্ষুর পেট ভরাইতে চাহে তাহা হইলে সে কেমন হয়।

আমি রাগিয়া কহিলাম, “দেখো নবীন, আর্টিস্ট্‌ লোকে বলে, দৃশ্য হিসাবে পোড়ো বাড়ির একটা সৌন্দর্য আছে। কিন্তু বাড়িটাকে কেবল ছবির হিসাবে দেখিলে চলে না, তাহাতে বাস করিতে হয়, অতএব আর্টিস্ট্‌ যাহাই বলুন, মেরামত আবশ্যক। বৈধব্য লইয়া তুমি তো দূর হইতে দিব্য কবিত্ব করিতে চাও, কিন্তু তাহার মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষাপূর্ণ মানবহৃদয় আপনার বিচিত্র বেদনা লইয়া বাস করিতেছে, সেটা স্মরণ রাখা কর্তব্য।”

মনে করিয়াছিলাম, নবীনমাধবকে কোনোমতেই দলে টানিতে পারিব না, সেদিন সেইজন্যই কিছু অতিরিক্ত উষ্মার সহিত কথা কহিয়াছিলাম। কিন্তু হঠাৎ দেখিলাম, আমার বক্তৃতা-অবসানে নবীনমাধব একটিমাত্র গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আমার সমস্ত কথা মানিয়া লইল; বাকি আরো অনেক ভালো ভালো কথা বলিবার অবকাশই দিল না।

সপ্তাহখানেক পরে নবীন আসিয়া কহিল, “তুমি যদি সাহায্য কর আমি একটি বিধবাবিবাহ করিতে প্রস্তুত আছি।”

এমনি খুশি হইলাম— নবীনকে বুকে টানিয়া কোলাকুলি করিলাম; কহিলাম, “যত টাকা লাগে আমি দিব।”

তখন নবীন তাহার ইতিহাস বলিল।

বুঝিলাম, তাহার প্রিয়তমা কাল্পনিক নহে। কিছুকাল ধরিয়া একটি বিধবা নারীকে সে দূর হইতে ভালোবাসিত, কাহারও কাছে তাহা প্রকাশ করে নাই। যে মাসিক পত্রে নবীনের ওরফে আমার, কবিতা বাহির হইত সেই পত্রগুলি যথাস্থানে গিয়া পৌঁছিত। কবিতাগুলি ব্যর্থ হয় নাই। বিনা সাক্ষাৎকারে চিত্ত-আকর্ষণের এই এক উপায় আমার বন্ধু বাহির করিয়াছিলেন।

কিন্তু নবীন বলেন, তিনি চক্রান্ত করিয়া এই-সকল কৌশল অবলম্বন করেন নাই। এমন-কি, তাঁহার বিশ্বাস ছিল, বিধবা পড়িতে জানেন না। বিধবার ভাইয়ের নামে কাগজগুলি বিনা স্বাক্ষরে বিনা মূল্যে পাঠাইয়া দিতেন। এ কেবল মনকে সান্ত্বনা দিবার একটা পাগলামি মাত্র। মনে হইত, দেবতার উদ্দেশে পুষ্পাঞ্জলি দান করা গেল, তিনি জানুন বা না জানুন, গ্রহণ করুন বা নাই করুন।

নানা ছুতায় বিধবার ভাইয়ের সহিত নবীন যে বন্ধুত্ব করিয়া লইয়াছিলেন, নবীন বলেন, তাহারও মধ্যে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। যাহাকে ভালোবাসা যায় তাহার নিকটবর্তী আত্মীয়ের সঙ্গ মধুর বোধ হয়।

অবশেষে ভাইয়ের কঠিন পীড়া উপলক্ষে ভগিনীর সহিত কেমন করিয়া সাক্ষাৎ হয় সে সুদীর্ঘ কথা। কবির সহিত কবিতার অবলম্বিত বিষয়টির প্রত্যক্ষ পরিচয় হইয়া কবিতা সম্বন্ধে অনেক আলোচনা হইয়া গেছে। আলোচনা যে কেবল ছাপানো কবিতা-কয়টির মধ্যেই বদ্ধ ছিল তাহাও নহে।

সম্প্রতি আমার সহিত তর্কে পরাস্ত হইয়া নবীন সেই বিধবার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বিবাহের প্রস্তাব করিয়া বসিয়াছে। প্রথমে কিছুতেই সম্মতি পায় নাই। নবীন তখন আমার মুখের সমস্ত যুক্তিগুলি প্রয়োগ করিয়া এবং তাহার সহিত নিজের চোখের দুই-চার ফোঁটা জল মিশাইয়া তাহাকে সম্পূর্ণ হার মানাইয়াছে। এখন বিধবার অভিভাবক পিসে কিছু টাকা চায়।

আমি বলিলাম, “এখনই লও।”

নবীন বলিল, “তাহা ছাড়া বিবাহের পর প্রথম মাস পাঁচ-ছয় বাবা নিশ্চয় আমার মাসহারা বন্ধ করিয়া দিবেন, তখনকার মতো উভয়ের খরচ চালাইবার জোগাড় করিয়া দিতে হইবে।”

আমি কথাটি না কহিয়া চেক লিখিয়া দিলাম। বলিলাম, “এখন তাঁহার নামটি বলো। আমার সঙ্গে যখন কোনো প্রতিযোগিতা নাই তখন পরিচয় দিতে ভয় করিয়ো না। তোমার গা ছুঁইয়া শপথ করিতেছি, আমি তাঁহার নামে কবিতা লিখিব না, এবং যদি লিখি তাঁহার ভাইকে না পাঠাইয়া তোমার কাছে পাঠাইয়া দিব।”

নবীন কহিল, “আরে, সেজন্য আমি ভয় করি না। বিধবাবিবাহের লজ্জায় তিনি অত্যন্ত কাতর, তাই তোমাদের কাছে তাঁহার সম্বন্ধে আলোচনা করিতে তিনি অনেক করিয়া নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। কিন্তু এখন আর ঢাকিয়া রাখা মিথ্যা। তিনি তোমারই প্রতিবেশিনী, ১৯ নম্বরে থাকেন।”

হৃৎপিণ্ডটা যদি লোহার বয়লার হইত তো এক চমকে ধক্‌ করিয়া ফাটিয়া যাইত। জিজ্ঞাসা করিলাম, “বিধবাবিবাহে তাঁহার অমত নাই? ”

নবীন হাসিয়া কহিল, “সম্প্রতি তো নাই।”

আমি কহিলাম, “কেবল কবিতা পড়িয়াই তিনি মুগ্ধ? ”

নবীন কহিল, “কেন, আমার সেই কবিতাগুলি তো মন্দ হয় নাই।”

আমি মনে মনে কহিলাম, ‘ধিক্‌।’

ধিক্ কাহাকে। তাঁহাকে, না আমাকে, না বিধাতাকে। কিন্তু ধিক্‌।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

We are happy to announce that our app is now available in
Google Playstore!