Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj » Page 10

নিশুতি রাতের ডাক || Syed Mustafa Siraj

মায়াপুরী স্টুডিওতে প্রতিভা পিকচার্সের ঘরে রথীন্দ্র কুশারী কথা বলছিলেন বালক দাশগুপ্তের সঙ্গে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বেজে গেছে। স্টুডিওতে আজকাল সন্ধ্যার পর শুটিং হলে এক নম্বর ফ্লোরে কারণ এই ফ্লোরটা গেটের খুব কাছে। লোকজন ভুলেও আলোর বাইরে পা বাড়ায় না। এমনিতেই শুটিং কমে গেছে। স্টুডিও কর্তৃপক্ষ খুব চিন্তিত। একে বাংলা ছবির অবস্থা করুণ। তাতে এই স্টুডিও যেটুকু ঢিমেতাল চলছিল, পর-পর দুটি হত্যাকাণ্ডের ফলে তাও যেন চলছে না। রথীন্দ্র কুশারীর মায়াপুরীতে শেয়ার আছে। জেদী ও সাহসী লোক। বালকবাবুকে বলছিলেন–অমিয় চলে গেল। খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলুম কয়েকটা দিন। পরে দেখলুম, আমি যদি পিছিয়ে নাকি, মায়াপুরীর নাভিশ্বাস শুরু হবে। কাজেই ছবি আমি করব। তবে ওই সব পাতাল-টাতাল আর নয়।……হাসলেন রথীন্দ্র।

বালকবাবু বললেন, বেশ তো। আমার হাতের ছবিটা প্রায় শেষ। আর দুদিনের টুকিটাকি একটু কাজ আছে। আউটডোরে সেরে নেব। তারপর আমার ব্যাপার জান তো? তিন মাসে পারলে চার মাস করি না।

–হ্যাঁ তুমি স্পিডি খুব। রথীন্দ্র আড়মোড়া দিয়ে বললেন।–গল্প তুমিই দেখে নাও। কাস্টিং-টাস্টিং এভরিথিং তোমার। আমাকেও তো জান। কক্ষণো ইন্টারফিয়ার করি না। তা ছাড়া ডিসট্রিবিউটার আমার বাঁধা। রিলিজে দেরি হবে না। খুব ভালো চেইন আছে রিলিজের।

ক্যান্টিন বয় সুরেশ এসে বলল–বাবুর ফোন।

রথীন্দ্র বললেন–কোন বাবুর?

সুরেশ দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল–বাচ্চুবাবু কে, তার।

–মারব একে থাপ্পড়! বলে হাত তুলে হাসতে হাসতে রথীন্দ্র উঠলেন।

বস সাঁটুল! আসছি।

রথীন্দ্র গেলে একা নিঝুম পরিবেশে অস্বস্তি লাগছিল বালকবাবুর। বাইরে খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। সিগারেট ধরালেন। বাগানের দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন। এখন হঠাৎ লোডশেডিং হলেই বিপদ। মায়াপুরী এখন মৃত্যুপুরী হয়ে গেছে।

রথীন্দ্র তাড়াতাড়ি এসে গেলেন। সীমন্ত কর্নেল সায়েবকে নিয়ে আসছে। থাকতে বলল।

কর্নেল সায়েব? সে আবার কে?

রথীন্দ্র একটু হাসলেন।– তুমি চেনো না ওঁকে? ভেরি ইন্টারেস্টিং ম্যান। আসুন না, দেখবে। এস, ভেতরে গিয়ে বসি। আমরা ছাড়া তো দেখছি আজ ধুনি জ্বালানোর একটা লোকও নেই মায়াপুরীতে।

বালকবাবু বললেন–লোডশেডিং হলে মুশকিল। আমার ভাই আজকাল কী হয়েছে মানে অমিয় বা উজ্জ্বলদার মৃত্যুর পরে অতটা হয়নি। অমর্ত্যটার মৃত্যুর পরে কেমন একটা যেন আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে খালি! খেলার ক্লাবের কথা ভাবলেই কেমন যেন লাগছে। স্টুডিওতে এসেও তাই।

ভেতরে গিয়ে টেবিলে মোম বের করে রেখে রথীন্দ্র বললেন-দেখ ভাই সাঁটুল। আমার কথাবার্তা স্ট্রেটকাট। পাপ করলে তার ফল ভুগতে হবে–এই হল আসল কথা। অমিয়কে আমি লাইক করতুম ওর গুণের জন্য। কিন্তু তুমি যেমন জান, আমিও তেমনি জানি, অমিয় কী ছিল। আর উজ্জ্বলের কথা তো বলতে নেই। তুমি অমর্ত্যর কথা বলছ? জান না অমর্ত্য কী মাল ছিল? সাঁটুল, তুমি যদি কারুর সর্বনাশ না করে থাক, তোমার সর্বনাশ কেউ করবে না। মানুষ মানুষকে কি এমনি এমনি খুন করে রে ভাই? ঘা খেয়ে খেয়ে, ঘা খেয়ে খেয়ে যখন আর সহ্য করতে পারে না, তখন–ওই যা। তুমি মাইরি বড় ইয়ে। লোডশেডিং-লোডশেডিং করে তাকে ডেকে এনে তবে ছাড়লে!

বালকবাবু নার্ভাস ভঙ্গিতে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। অন্ধকারে আস্তে বললেন–মোম জ্বাল!

রথীন্দ্র মোম জ্বেলে হাসলেন। কেটে পড়তুম এবার। কিন্তু সীমন্তটা জট পাকিয়ে দিল। এসো। মুখে যতই বলি, আমারও একা থাকার সাহস নেই।

–মাইরি!

সুরেশ টর্চ জ্বেলে দুটো চা দিয়ে গেল। রথীন্দ্র বলে এসেছিলেন আরেকদফা চায়ের কথা।

একটু পরে বাইরে সীমন্তের সাড়া পাওয়া গেল বাচ্চুদা!

রথীন্দ্র সাড়া দিলেন। চলে আয়। আলো দেখাতে হবে নাকি?

না। টর্চ আছে।

কর্নেল বারান্দায়। সীমন্ত উঁকি মেরে বলল–উরে ব্বাস! বালকদা যে!

রথীন্দ্র বললেন– কর্নেল! ভেতরে আসুন।

কর্নেল খোলা বারান্দার রেলিঙে ঝুঁকে নিচের আধতলাটা দেখার চেষ্টা করছিলেন। টর্চের আলো ফেলে। উনি আসছেন না দেখে রথীন্দ্র বেরিয়ে গেলেন। অবাক হয়ে বললেন–কী দেখছেন?

কর্নেল বললেন–আমার সঙ্গে একটু আসুন। নিচে গিয়ে বলছি। শুধু আপনি একা।

রথীন্দ্রর মুখে বিস্ময়। দরজায় উঁকি মেরে বললেন–সাঁটুল, সীমন্ত! তোমরা গল্প কর। আমরা আসছি।

নিচে গিয়ে কর্নেল বললেন–ইলেকট্রিশিয়ান বনবিহারী দাসকে আপনি নিশ্চয় চেনেন?

–হ্যাঁ। সে তো কন্ট্রাক্টার সরলবাবুর লোক। কেন বলুন তো?

সীমন্তর কাছে শুনলুম, বনবিহারী এই নিচেতলার একটা ঘুপটি ঘরে থাকেন!

–হ্যাঁ। থাকতে দেখেছি। কিন্তু কি—

–প্লিজ, আগে ওর ঘর কোনটা বলুন।

রথীন্দ্র পা বাড়িয়ে বললেন–নিচের ঘরগুলো স্টুডিওর গোডাউন। ওই শেষদিকের একটা ঘর খালি পড়েছিল। গত মাসে সরলবাবু রিকোয়েস্ট করলে, ঘরটা যদি ওঁর একজন ইলেকট্রিসিয়ানকে দিই, ভাড়ার অসুবিধে হবে না। বেচারা থাকে সেই দমদম না কোথায়। কাজের অসুবিধে হয়। যাই হোক, সরলবাবুর অনুরোধে ব্যবস্থা করে দিয়েছি।…এই যে এই ঘরটা। তালাবন্ধ দেখছি। রথীন্দ্র ঘুরে দাঁড়ালেন। –নেই। কোথাও গেছে-টেছে। এসে যাবেখন। খুব দরকার নাকি?

কর্নেল বললেন–তালাটা ভাঙা দরকার। ভেতরটা দেখতে চাই।

রথীন্দ্র আরও চমকে গেলেন।–কাজটা বেআইনি হবে না?

না। পুলিসেরই এতক্ষণ এ ঘরে ঢোকা উচিত ছিল। ওরা গুরুত্ব দিচ্ছে না।… বলে কর্নেল তালায় হ্যাঁচকা টান দিলেন। উপড়ে এল মরচে ধরা কড়াদুটো। দরজা খুলে ঢুকে টর্চের আলোয় ভেতরটা দেখতে থাকলেন। রথীন্দ্র হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে।

স্যাঁতসেঁতে মেঝেয় একটা মাদুরসুদ্ধ বিছানা গোটানো। একটা জলের কুঁজো এবং কাঁচের গ্লাস। নোংরা পলেস্তারাখসা দেয়ালে একটা মাকালীর ক্যালেন্ডার টাঙানো। জানলাহীন বদ্ধ ঘর। ভ্যাপসা গন্ধ। এই ঘরে হতভাগিনী অপালা ওরফে চন্দ্রার বাবা এসে আশ্রয় নিয়েছিল। অমিয় বকসী আর উজ্জ্বলকুমারকে নরকে ঢোকানোর জন্যই তাদের কর্মস্থানে ঢুকে ওত পেতেছিল। তার পক্ষে এইটাই ছিল উপযুক্ত বধ্যভূমি। স্টুডিও এলাকার বাগান, পুকুর, জঙ্গল তার মতো হত্যাকারীর পক্ষে–যার কিনা হাতুড়ি ছাড়া অন্য অস্ত্রে হাত খোলে না, অত্যন্ত নিরাপদ ক্ষেত্র।

বিছানাটা টেনে বিছিয়ে দিলেন কর্নেল। একটা জীর্ণ তোষকের ওপর সস্তা ছিটের চাদর। নোংরা বালিশ। কোনোরকমে নিছক বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু চাই, তার বেশি কিছু ঘরে নেই।

বালিশটা পরীক্ষা করছিলেন কর্নেল। খোলের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা পুরোনো ঘেঁড়া মলাটের এক্সাইজ বুক। খুলেই অবাক হলেন। অপটু হস্তাক্ষরে ইংরেজি বাক্য, বাংলা বাক্য। বানান সংশোধন করা হয়েছে লাল কালিতে। তলায় লেখা ও মিস অপালা গুপ্ত। কুমারী অপালা গুপ্ত। ইংরেজি ও বাংলায়। ক্লাস থ্রি। স্কুলের নাম লেখা অংশটা ছেঁড়া।

একটা পাতা উল্টে দেখলেন, লেখা আছেঃ

Q. 1 What is your fathers name?

My fathers name is Mr. Shibshankar Gupta.

Q. 2. What is your mothers name?

My mothers name is Mrs. Mridula Rani Gupta.

দ্রুত পাতা ওল্টালেন। রথীন্দ্র এসে উঁকি মেরে দেখছেন। তার দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এ পাতায় লেখা আছে?

আমি বড় হইয়া দেশের সেবা করিব। গরিবদের উপকার করিব। রুগ্ণ লোকের প্রতি যত্ন লইব। আমি একজন আদর্শ নারী হইব।

হুঁ, শ্রুতলিখন লিখেছে অপালা। ভুল বানান শুদ্ধ করা হয়েছে। তার বাবাই করেছেন। কারণ পাশে গুড লিখে এস জি ইনিসিয়াল করা আছে।

পরের পাতায়ঃ আমার বাবা খুব ভাল, আমার মা খুব ভাল। বাবা আমাকে ভালবাসে। বাবা আমাকে বকে। মা বকে না। পাশে বাবার মন্তব্যঃ দুষ্টু মেয়ে! আমি বকি বুঝি?

কর্নেল! রথীন্দ্র ডাকলেন।

কর্নেল খাতা ভাঁজ করে পকেটে ঢুকিয়ে ধরা গলায় বললেন–হ্যাঁ, চলুন। বাইরে গিয়ে রুমাল বের করে চোখ মুছলেন অন্ধকারে। একটা শান্ত সুন্দর সংসার–আশা-আকাঙ্ক্ষা সাধ স্বপ্নে গড়া জীবনের ছন্দ কেমন করে আস্তে আস্তে তাল কেটে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। কে এর জন্য দায়ী? মৃদুলা? বলা কঠিন। কিন্তু যদি মৃদুলার উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অভিনেত্রী হবার সাধ এই ভাঙনের কারণ হয়, সে নিজে তার প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে আত্মঘাতিনী হয়ে। আর উজ্জ্বলকুমার? তিনিই মৃদুলাকে প্ররোচনা দিয়ে বাইরে এনে ভোগ করতে চেয়েছিলেন, তার প্রমাণ তার একটা লুকিয়ে রাখা ছবিতে স্পষ্ট। আর অমিয় বকসী? অত গুণী প্রতিভাশীল মানুষ। তিনিও কামার্ত পশুর মতো কন্যাতুল্য কিশোরী অপালাকে নিষ্কৃতি দেননি। ভাবতেও গা ঘিনঘিন করে। এর চেয়ে পাপ আর কিসে? পলাতকা অপালা যখন চন্দ্রা নাম নিয়ে ব্রথেলে আশ্রয় নিয়েছিল তখনও কত পশু তাকে ছিঁড়ে খেয়ে গেছে। ওই অমর্ত্য রায় তার ভাল হবার সুযোগটুকু নষ্ট করে দিয়েছিলেন স্বপনের কাছ থেকে প্ররোচনায় তাকে ছিনিয়ে নিয়ে। স্বপনকে ভুল বুঝেছেন শিবশংকর। স্বপনের চেষ্টাকে তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। স্বপনের মধ্যে উদ্ধার করার একটা আকুতি আছে। রাখীর প্রতি তার আচরণ, নন্দিতা নামে আরও একটি মেয়েকে তার উদ্ধারের ব্যর্থ চেষ্টা–এ সবই তার প্রমাণ।

রথীন্দ্র আবার ডাকলেন– কর্নেল!

কর্নেল তার কাঁধে হাত রেখে আস্তে বললেন বলব, বলব বাচ্চুবাবু। সব কথা বলব। আমাকে–প্লিজ একটু–জাস্ট একটু সময় দিন। ওঃ! কি ট্রাজিক, কি মর্মান্তিক এই রহস্যময় কেসের পরিণতি! কেন যে আমার এখনও শিক্ষা হল না। আবার জড়াতে গেলুম নিজেকে। ওকে ডার্লিং! নাও আই অ্যাম অলরাইট।

কর্নেল জোরে নিঃশ্বাস ফেললেন!…

স্টুডিও বিল্ডিংয়ের দিকটা ঘন অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকার বাগান, পুকুর, পার্ক, জঙ্গল জুড়ে। পুকুরের পূর্ব পাড়ে ঘন ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন ইলেকট্রিশিয়ান শিবশংকর গুপ্ত। দক্ষিণে বাঁধানো ঘাট আছে। কত ছবির শুটিং হয় সেখানে। এখন নিঝুম অন্ধকারে। শনশন করে বাতাস বইছে গ্রীষ্মের রাতে। ঘাটের মাথায় গিয়ে বসলেন। পুকুরের জলে শাপলার পাতা কাঁপছে। নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব ঝিকমিক করছে জলের ভাজে। ভেঙে যাচ্ছে, নিভছে, ভেসে উঠছে। শিবশংকরের বুকের ভেতর থেকে কী একটা ঠেলে উঠছে বারবার। আস্তে নাক ঝেড়ে ময়লামাখা শার্টের হাতায় নাক ঘষলেন। তাকিয়ে রইলেন নক্ষত্রভরা জলের দিকে। অপালার কচি মুখটা ভেসে উঠছে কেন যে এখন! শিবশংকর দুঃখিত দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে মনে মনে বললেন–মা অপু, তোর আত্মার শান্তি হবে বলে। আর কিছুর জন্য না। তুই শান্তি পাবি বলে যত কিছু! আমার আর কী? বুড়ো হয়ে গেছি। শরীরটা কোনরকমে টিকিয়ে রেখেছিলুম শুধু তোর ফ্যাকাসে রোগা মুখখানার দিকে তাকিয়ে। নইলে কবে তোর মায়ের মতো তোর মায়েরও দোষ নেই রে। চিরকাল বোকা–নির্বোধ মেয়েছেলে। যে যা বলে, বিশ্বাস করে। সামনে পিছনে ঠাওর করে না। বোকা বলেই না বজ্জাত। উজ্জ্বলের পাল্লায় পড়ে সে আমার কাছ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। ডিভোর্স পর্যন্ত করে বসল। কী না–আমি অত্যাচার করি ওর ওপর। তখন উজ্জ্বল নামকরা হিরো। তার কথায় মিথ্যা সাক্ষী দিল শুয়োরের বাচ্চা অমিয় বকসী। উজ্জ্বল তো দেবেই সাক্ষী। ডিভোর্স হয়ে গেল। ধন্য বিচার। তারপর কী হল, তুই তো দেখেছিস মা। তখন তুই এগারো বছরের মেয়ে। দেখলি তো তোর মা কী বিপদে পড়ে গেল? উজ্জ্বলের ধাপ্পা কি বুঝতে পারলে? সিনেমায় কে অমন বোকা মেয়েকে চান্স দেবে দিলেই বা কী হবে? আমি তো জানি ওর অ্যাকটিংয়ের দৌড়। অমিয়র কাঁধে চাপা ছাড়া আর উপায় ছিল না, বুঝলি তো? হু, অমিয়র নাম শুনলে তোর ঘেন্না হয় আমি জানি! থাকবলব না। অমিয় নরক দেখতে চাইছিল, দেখিয়ে দিয়েছি। উজ্জ্বলকেও নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি। তুই শান্ত হ মা! অনেক দুঃখ, অনেক যন্ত্রণা, কষ্টের আগুনে দগ্ধ মরেছিস! বাঁচতে চেয়ে অমিয়র কাছ থেকে পালিয়েছিলি–কিন্তু এ পৃথিবী যে তোর মতো অসহায় মেয়ের প্রতি নিষ্ঠুর। চারদিকে রাক্ষস পিল পিল করে বেড়াচ্ছে। তারা তোকে বাঁচতে দিলে না। তোকে তারা ছিঁড়ে খেতে লাগল। উজ্জ্বলের জায়গায় এসে দাঁড়াল তার হারামজাদা ছেলে স্বপনটা। আর ওই অমর্ত্য নামে এক কুকুর! তাকেও নরকে পাঠিয়ে দিয়েছি। বাকি রইল স্বপন ছোকরা। তাকেও নরকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলুম। বেকায়দায় পড়ে পারা গেল না। আর দু-একটা দিন অপেক্ষা কর! মা অপালা! তোর কোনো দোষ নেই। তোর মায়েরও কোনো দোষ নেই। পৃথিবীটাই যে পাপে ভরে গেছে। তুই কী করবি –তোর মাই বা কী করবে?

ফোঁস ফোঁস নাক ঝেড়ে শার্টের হাতায় নাক ঘষলেন আবার। বুকের ভেতর সেই জিনিসটা ঠেলে আসল। ঢোক গিলে তাকালেন জলে প্রতিবিম্বিত নক্ষত্ৰকণায় ফুটে ওঠা কচি নিষ্পাপ মুখখানির দিকে। চোখ জলে ভরে গেল। গা বেয়ে শব্দহীন কান্নার স্রোত গড়িয়ে যেতে থাকল।….মা, তোর জন্য রোজ এক বোতল রক্ত নিয়ে রোজিদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে থেকেছি। আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। আমি তোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারতুম রক্ত দিয়ে। যা রোজগার করেছি, সব খরচ করতুম তোর জন্য। তোর চিকিৎসা করতুম ভাল ডাক্তারের কাছে। তোকে ওই রাক্ষসের পুরী থেকে উদ্ধার করতে পারলুম না। ভাবিস না, আমি কাউকে ছাড়ব না। স্বপন, তারপর রোজি হারামজাদী, তারপর ওদের বাড়ির সেই সায়েবটা, তারপর….। এর বেশি আর পারব না। তুই শান্ত হ মা। তুই আমার কত আদরের মেয়ে। তোর কচি মুখের সেই গন্ধটা এখনও ভুলিনি। এখনও পাচ্ছি। ছোটবেলার মতো আরেকটা হামি দে তো মা!

ডুকরে কেঁদে উঠেই সংযত হলেন শিবশংকর। চারদিকে তাকালেন। অন্ধকারে গাছপালার শব্দ হচ্ছে। কাঁধের ব্যাগে হাত ভরে হাতুড়ির বাঁটটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। ব্যাগে টর্চ আছে, কিন্তু এই এক মাসে মায়াপুরী স্টুডিওর প্রতিটি ইঞ্চি চেনা হয়ে গেছে। অন্ধকারে নির্ভুল পা ফেলে হাঁটতে অসুবিধে হয় না।

রাতে আজকাল স্টুডিওতে শুটিং কেউ করতে চায় না! নিঝুম হয়ে থাকে পরিবেশ। আতঙ্কে কেউ সন্ধ্যার পর ফ্লোর এলাকা ছেড়ে বাইরে পা বাড়ায় না। শিবশংকর সাবধানে হেঁটে লম্বা বাড়িটার শেষ প্রান্তে নিচু তলায় তার ঘরের সামনে পৌঁছুলেন। দরজার সামনে এসে তালা খুলতে গিয়ে সতর্কভাবে টর্চ। জ্বাললেন। এখন তার মেদিনীপুরের গ্রামে থাকার কথা। রাতটা কাটিয়ে ভোরে বেরিয়ে পড়বেন। চুপিচুপি পুবদিকের পাঁচিল ডিঙিয়ে। অবস্থা বুঝে আত্মপ্রকাশ করবেন।

কিন্তু দরজা হাট করে খোলা। তালাটা কড়াসুদ্ধ ওপড়ানো। ভেতরে বিছানাটা ওল্টানো। সঙ্গে সঙ্গে টর্চ নিভিয়ে দিলেন। তাহলে পুলিস সব টের পেয়ে গেছে? কী ভাবে টের পেল? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।

এদিক-ওদিক দরজার বাইরে তাকিয়ে দেখে ঘরে ঢুকে বালিশের ভেতর খাতাটা খুঁজলেন। নেই। সারা শরীর হিম হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মাথা ঘুরতে লাগল।

আর থাকলেন না ভেতরে। বেরিয়ে এলেন। মাথা টলমল করছে। নক্ষত্রের আকাশেও যেন বড় হাওয়া দিচ্ছে আজ রাতে। দুলছে। কাঁপছে। আবার ব্যাগে হাত ভরে হাতুড়ির বাঁটটা শক্ত করে ধরলেন। সাহস পাওয়ার জন্য। এই জিনিসটাই তার চরম অবলম্বন। এ দিয়ে নারীদের শাস্তি দিয়েছেন। এটা তার কাছে শক্তিমান ন্যায়দণ্ড! এটা যতক্ষণ কাছে আছে ততক্ষণ তার সঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বর আছেন। ঈশ্বর, তুমিই জানো, আমি কোনো অন্যায় করছি না। পুবের পাঁচিলের দিকে হাঁটতে থাকলেন হতচকিত শিবশংকর গুপ্ত……

কর্নেল তখন লালবাজার পুলিস হেডকোয়ার্টারে ডি সি ডি ডি অরিজিৎ লাহিড়ীর ঘরের দরজায় পৌঁছেছেন। সীমন্তকে বেশি রাত হতে পারে বলে নিচের রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছেন। সোজা ঘরে ঢুকতেই অরিজিৎ লাফিয়ে উঠলেন। কী সর্বনাশ!

কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ, সর্বনাশই বটে। বলে বসলেন।

অরিজিৎ ঘন্টা বাজিয়ে কফির হুকুম দিলেন। তারপর জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে– তাকালেন কর্নেলের দিকে। কর্নেল একটু হেসেছেন। কিন্তু চেষ্টাকৃত হাসি। মুখে গাম্ভীর্য থমথম করছে। কিছু বলছেন না দেখে অরিজিৎ বললেন-সরলবাবুকে ডেকে এনে একটা স্টেটমেন্ট নিয়ে আপাতত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরলবাবুর বক্তব্য হল। তার ভাল ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন ক্যারি পিগট নামে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। থাকতেন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। ও মাসে ক্যারি বনবিহারী দাসকে তার কাছে সুপারিশ করেন। কারণ ক্যারি অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছেন। সরলবাবু সরল বিশ্বাসে বনবিহারীকে চাকরি দেন। তারপর তার কাজের পরিচয় পেয়ে খুশি হন। খুব অভিজ্ঞ এবং দক্ষ লোক বনবিহারী। তাকে হাতের কাছে রাখার জন্য মায়াপুরীস্টুডিওতেই থাকার ব্যবস্থা করে দেন। বাই দা বাই, ক্যারি ছিল রোজি স্মিথের স্বামী! আপনি তার নাম এবং রোজির ঠিকানা নিয়েছিলেন।

কর্নেল আস্তে বললেন–তত কিছু ভেবে নিইনি। স্টুডিও এবং ইলেকট্রিশিয়ান শব্দ দুটো তখন আমাকে পেয়ে বসেছিল। তাই তোমাকে টুকে দিতে বলেছিলুম।

অরিজিৎ উচ্চহাস্য করে বললেন–যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলে পাইতে পার অমূল্য রতন। যাই হোক, আমি কিন্তু এখনও ভেবে পাচ্ছি না। বনবিহারীর সঙ্গে ক্যারির কীভাবে পরিচয় হল?

বনবিহারীবাবু প্রায়ই তার মেয়ের জন্য রোজির অর্থাৎ মিসেস মিশেলের বাড়ির সামনে গিয়ে ধরনা দিতেন। এভাবেই ক্যারির সঙ্গে আলাপ হয়ে থাকবে।

অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে তাকালেন। কিন্তু চোখে বিস্ময়। বললেন–মেয়ের জন্য? কে মেয়ে?

–অপালা ওরফে চন্দ্রা।

–আচ্ছা! বুঝতে পেরেছি। সবটাই এবার পরিষ্কার হয়ে গেছে। বনবিহারীই তাহলে মৃদুলার আগের স্বামী–যার ফটো আমরা উদ্ধার করেছি। নিশ্চয় আসল নাম নয়?

কর্নেল মাথা নাড়লেন। না। শিবশংকর গুপ্ত।

অরিজিৎ নোট করতে যাচ্ছিলেন। কর্নেল প্যান্টের পকেট থেকে ভাজ করা এক্সারসাইজ খাতাটা বের করে বললেন–এটা একটা ডকুমেন্ট। মূল্যবান সাক্ষ্য। তোমরা মায়াপুরীতে বনবিহারীবাবুর ঘর সার্চ করলেই এটা পেয়ে যেতে।

অরিজিৎ ভুল স্বীকার করে বললেন–আসলে মেদিনীপুরের রিপোর্টটা পেয়ে তখন আমরা সরলবাবুর দিকেই দৃষ্টি দিয়েছিলুম।

তারপর দ্রুত পাতা উল্টে কিছুক্ষণ খাতাটা দেখার পর দুঃখিতভাবে মাথা দুলিয়ে বললেন স্যাড, ভেরি স্যাড! একেবারে ট্রাজিক ব্যাপার। তবে শিবশংকরবাবুর মোটিভ স্পষ্ট হয়ে গেল।

কফি এল। কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল বললেন–এবার বেশি গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটার জন্য এসেছি বলি।……অরিজিৎ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে বললেন– সেটা আমার ফাঁদ সম্পর্কে, যে-ফঁদের কথা তোমাকে বলেছি। তোমরা অবিলম্বে স্বপনের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ তুলে নাও।

অরিজিতের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। একটু ভেবে নিয়ে বললেন-একটু সময় লাগবে, কর্নেল! গভর্মেন্টের পদ্ধতির কথা আপনি তো জানেন! হ্যাঁ– খুনের চার্জে তাকে আর জড়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তার নামে অন্তত গোটা পাঁচেক নানা ধরনের কেস ঝুলছে। হাঙ্গামা, শাসানো, মারধর করা ইত্যাদি অভিযোগ স্বীকার করছি, এগুলো পেটি অফেন্স। তাহলেও আইন ইজ আইন। আপনি নিশ্চয় আমাকে বে-আইনি কাজ করতে বলবেন না?

কর্নেল শক্ত মুখে বললেন–বলব। কারণ আইনের জন্য মানুষ নয়। মানুষের জন্যই আইন।

অরিজিৎ অবাক হলেন। –ঠিক বুঝতে পারছি না, কর্নেল!

–স্বপন ছিল আসলে একজন প্রতিশ্রুতিবান ফুটবলার। অমর্ত্য তার কেরিয়ার নষ্ট করে দিয়েছিলেন। কিন্তু সে অকপট প্রকৃতির ছেলে, কিছুটা আদর্শবাদী, সাহসী এবং জেদী। প্রতিক্রিয়ার দরুন প্রচণ্ড ক্ষোভে সে হয়তো কিছু মাত্রা ছাড়া কাজ করে বেড়িয়েছে। কিন্তু সেগুলো কী? অন্যায়ের প্রতিবাদ। অরিজিৎ, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়েই সে ফেঁসে গেছে। তাকে কেসে জড়ানো হয়েছে। আমাদের সমাজটা আজ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে অন্যায়টাই এখন স্বাভাবিক। কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাকে সমর্থন করা দূরে থাক, অন্যায়কারীর পক্ষ নিয়ে আমরা তাকেই লাঞ্ছিত করি। স্বপন এই মনোবৃত্তির শিকার, অরিজিৎ!

অরিজিৎ হাসবার চেষ্টা করে বললেন–কেমন করে জানলেন? আপনার তদন্তের সূত্রে বুঝি?

ধর, তাই। আমি চাই, তাকে তোমরা কালই সরকারিভাবে অব্যাহতি দাও। প্রেস কনফারেন্স ডেকে–

বাধা দিয়ে অরিজিৎ বললেন–অসম্ভব কর্নেল। মানে, আপাততঃ অসম্ভব। কেন বলি শুনুন। প্রথম কথা, তার নামে এফ. আই. আর. দাখিল হয়েছে। খুনের কেসের এফ. আই. আর. অবশ্য দুদিনের মধ্যে প্রত্যাহার করে। শিবশংকরবাবুর নামে নতুন এফ. আই. আর. দাখিল করা হবে। যদিও এতে মামলার জোর কমে যাবে। কারণ বিচারকের মনে ধারণা জন্মাবে পুলিস। দ্বিধাগ্রস্ত–আসামী বদলাচ্ছে বার বার। এটা গেল প্র্যাকটিক্যাল সমস্যা। এবার আছে টেকনিক্যালিটিজ। তার জন্য সময় লাগবে। কর্নেল, এই হাতটা সামান্য একটা ব্লেড দিয়েই এক সেকেন্ডে অনেকটা চেরা যায়। কিন্তু ঘা শুঁকতে সময় লাগে। এবার আসছি, স্বপনের বিরুদ্ধে অন্যান্য পেটি কেস প্রসঙ্গে। আপনি বলবেন, বহু কেস তো পুলিস ধামাচাপা দেয়। হ্যাঁ, দেয়। কিন্তু সেও একটা দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি। কালই আমরা প্রেস কনফারেন্স ডেকে বলতে পারি না যে স্বপন সমস্ত কেসে নির্দোষ! এতে পুলিসের ভেতরকার মরাল কারেজ নষ্ট হয়ে যাবে। যে সব অফিসার ওই কেস দিয়েছেন, তারা মনে মনে আহত হবেন। শুধু তাই নয়, এর সুযোগ বহু ক্ষেত্রে তারা নেবেন এবং পরিণামে দুর্নতি বেড়ে যাবে। ভেবে দেখুন আপনি!

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। –অরিজিৎ! তোমরা আমার সহযোগিতা চেয়েছিলে। প্রকৃত খুনীকে খুঁজে বের করতে অনুরোধ করেছিলে। আমি তা করেছি। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার তোমরা আমাকে সহযোগিতা করলে না। ওকে, এই আমার শেষ কেস। তোমাদের সঙ্গে সম্পর্কেরও শেষ। গুড বাই।

অরিজিৎ ব্যস্তভাবে বললেন-কর্নেল! প্লিজ প্লিজ আপনি বসুন। আপনি উত্তেজিত।

-হ্যাঁ, আমি উত্তেজিত। আমি চেয়েছিলুম শিবশংকরবাবুকে ফাঁদে ফেলতে। এখন দেখ, তোমরা তাকে কত দিনে খুঁজে বের করতে পার!

অরিজিৎ উঠে এসে কর্নেলের হাত ধরে বসিয়ে দিলেন চেয়ারে। তারপর বললেন–বেশ তো, সেজন্য অসুবিধে হবে না। স্বপনকে আপাতত যতদিন চাইবেন ততদিন অ্যারেস্ট করব না, দেখেও দেখব না।

কর্নেল শুদ্ধভাবে বললেন–তুমি আমাকে স্বপনকে ধোঁকা দিতে বলছ? মিথ্যা বলে তাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিই, তাই চাইছ? না অরিজিৎ! তাকে প্রবঞ্চনা করে তোমাদের কাজ উদ্ধার করা অসম্ভব আমার পক্ষে। তার চোখে আমি কত ছোট হবে যাব, বুঝতে পারছ না?

অরিজিৎ চিন্তিতমুখে নিজের আসনে গিয়ে বসলেন। কপালে হাত রেখে টেবিলে কনুই ভর করে দুমিনিট ঝুঁকে থাকার পর মুখ তুললেন। একটু হাসলেন মনে হচ্ছে শিবশংকরবাবুকে ফাঁদে ফেলে ধরার চাইতে স্বপনকে ফ্রি করে দেওয়ার প্রতি আপনার আগ্রহ বেশি!

–ভুল করছ। দুটো ব্যাপারই অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে রয়েছে। অথবা একই জিনিসের দুটো দিক। দুটোকে আলাদা করা যায় না।

–আচ্ছা, ধরুন স্বপনকে আমরা সব কেস থেকে অব্যাহতি দিলুম। তারপর– মানে, আপনার সেই ফাঁদটার কথা বলছি।

–তারপর তুমি অবিলম্বে ইলেভেন টাইগার্স ক্লাবের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলবে। ওঁদের অনুরোধ করবে স্বপনকে আবার ক্লাবে খেলোয়াড় হিসেবে নিতে। আশাকরি, ওঁদের অমত হবে না। অমর্ত্য বেঁচে নেই। আমি পুরনো কাগজ ঘেঁটে দেখেছি, স্বপন ছিল ওঁদের দলের সেরা খেলোয়াড়। ওঁরা যদি জানতে চান কেন তোমার এতে আগ্রহ, তুমি বলবে–আমি স্বপনের ফ্যান ছিলুম। তা ছাড়া ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেই স্বপনকে তুমি রি-এস্টাব্লিশ করতে চাইছ।

–ওকে, ওকে! বুঝেছি। তারপর স্বপন নিয়মিত মাঠে যাবে। খেলবে। কিন্তু ফাঁদটা কোথায়!

–অরিজিৎ, শিবশংকরের আরেক টার্গেট স্বপন। তিনি তাকে খুনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বপন জখম হয়েছে।

–অদ্ভুত! কিন্তু কোথায় সে?

–আছে। তবে আশাকরি বুঝতে পেরেছ কেন সে টার্গেট?

–হ্যাঁ। অপালা বা চন্দ্রার প্রেমিক ছিল সে।

–তা নয়। শিবশংকরের ধারণা হয়ে থাকবে যে যারা তার মেয়ের সর্বনাশ করেছে, স্বপনও তাদের একজন। তা না হলে স্বপনকে তিনি খুনের চেষ্টা করতেন না। সব কথা যথাসময়ে বলব তোমাকে।

অরিজিৎ গম্ভীর হলেন ফের।

ঠিক আছে। আমি কমিশনার সায়েবের সঙ্গে আলোচনা করে আপনাকে জানাচ্ছি। এখন তো ওঁকে পাওয়া যাবে না। কাল সকালেই কথা বলে আপনার কাছে যাব। আশাকরি আপনার অনুরোধ রক্ষা করতে পারব। হি ইজ এ ভেরি সেন্সি ম্যান। আপনার গুণমুগ্ধ ভক্তও!

কর্নেল উঠলেন। বললেন সাড়ে দশটা বাজে। ট্যাক্সি পাব কি না কে জানে! না হলে ট্রাম।

অরিজিৎ উঠে দাঁড়ালেন। গাড়ি আনেননি? এতক্ষণ বলবেন তো! চলুন, আমিও বেরোই। আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব।

শিবশংকর উত্তর কলকাতার একটা গলিতে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলেছেন। লম্বা মানুষ। রোগা গড়ন। খাড়া নাক। কাঁচা পাকা ছোট-ছোট চুল। একটুখানি গোঁফ রাখেন। কিন্তু দুদিন ধরে কামানো হয়নি। খোঁচা খোঁচা সাদা গোঁফদাড়িতে মুখ ভরে গেছে। গলি প্রায় নির্জন। হলদে আলোয় দুধারের জীর্ণ বাড়িগুলো দাঁত বের করে আছে। রাত সাড়ে দশটায় পাড়াটা নিশুতি হয়ে গেছে। দুপাশে তাকাতে তাকাতে হাঁটছেন। মাঝে মাঝে পেছনে তাকিয়ে নিচ্ছেন। কত বছর পরে এই গলিতে ঢুকেছেন আবার। একটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন। দরজায় একটি কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে। কলে জল ভরতে দিয়ে অপেক্ষা করছে। জিজ্ঞেস করলেন–হ্যাঁ মা, এখানে কিরণময়ী নামে একজন থাকত। এখন কি থাকে বলতে পার? দাঁড়াও–কিরণের নাম বললে চিনতে নাও পার। নবগোপাল!

কিশোরীটি গম্ভীর মুখে বলল–আমার বাবা!

শিবশংকর হাত বাড়িয়ে তার মাথা ছুঁলেন। ও আমার মা গো! তুমি কিরণের মেয়ে? আহা হা!

কিশোরী মাথা সরিয়ে নিল বিব্রত ভাবে। শিবশংকর ঢুকে গেলেন ভেতরে। ডাকলেন–কিরণ! কিরণ কৈ গো? আমি শিবুদা!

বিধবা এক প্রৌঢ়া ছোট্ট উঠোনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে। অবাক চাউনি। একটু পরে হেসে ফেললেন। –শিবুদা! এত রাত্রে কোত্থেকে তুমি? এস এস। ইশ! তোমাকে চেনাই যাচ্ছে না যে গো! অসুখ হয়েছিল নাকি?

শিবশংকর হাসলেন।–কত বছর পরে এলুম বল তো কিরণ? আসাই হয় না। বলে এতক্ষণে চোখ গেল কিরণময়ীর সাদা থানের দিকে। –আঃ হা! কবে কপাল ভাঙলি বোন? কী হয়েছিল নবগোপালের? আহা রে!

কিরণময়ী শ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বললেন–দাঁড়িয়ে কেন শিবুদা? ভেতরে এসে বস।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *