নসুমামার কেরামতি
কথায় বলে বৃহস্পতিবারের বারবেলা–ও নাকি সাংঘাতিক অলক্ষুণে ব্যাপার। কিন্তু ট্রেনের টিকিট অন্যদিনের নেই। সব হাউসফুল। কাউন্টারের বুকিং ক্লার্ক-এর চেহারাটা একফালি যা দেখেছি, তাতে মনে হয়েছে যেন ছোবড়া ছাড়ানো নারকোল। তেমনি রুক্ষ গলায় বলে, ওই বেস্পতিবারের টিকিটই আছে। নিতে হয় নাও, না হয় সরো।
পটলার নসুমামাও এসেছে। সে নাকি এসব মানে না। বলে,—তাই দিন।
আমি বলি,—মামা, বেস্পতিবার-এর বারবেলায় যাবে?
-চোপ। ডরপোক কাঁহিকা। বি ব্রেভ! ওসব কুসংস্কার কি এখনও এই যুগে মানে কেউ? চাঁদে মানুষ যাচ্ছে—দুদিন পর বেস্পতির ঘাড়েও গিয়ে চাপবে। ছাড় তো টাকা!
পটলা টাকা বের করে দেয়। ওদিকের কাউন্টারবাবু যে বেশ রসস্থ ব্যক্তি তা বোঝা যায়। অশ্বত্থগাছ পাথরের বুকেও রস গ্রহণ করতে পারে, উনিও সেই রকম। শুকনো টিকিট থেকেও রস টেনে বের করেন। ছ’জনের টিকিটের পুরো দামই দিয়েছি। তাও উনি বলেন,—আরও একশো টাকা লাগবে। পার টিকিট পঁচিশ করে নিই, দেড়শ টাকা পাওয়ার কথা, তা তোমাদের পঞ্চাশ টাকা ছেড়ে দিলাম।
মানে?—হোঁৎকা শুধোয়।
টিকিটবাবু বলে ওঠেন,—তাহলে টিকিটও নাই ।
নসুমামার দরাজ দিল। পরের পয়সাকে মাটির মতই হীন বস্তু ভাবে। বনেদি পরিবারের ছেলে। তাই বলে,-দিয়ে দে পটলা। এত করে বলছেন। না হলে তো টিকিট নাই — !
যেতেই হবে। তাই পটলা দিল একশো টাকা। রসিক ভদ্রলোক এবার টিকিটও দেন। হোঁৎকা বলে,—ঘুষ! সরকারি কর্মচারী ঘুষ খাচ্ছে ?
নসুমামা বলে—বকশিশ। বুঝলি, প্রণামী না দিলে ভগবানও চোখ তুলে দেখে না। তাই তো মন্দিরে এত প্রণামী পড়ে।
–সে তো দেবতা ।
নসুমামা বলে,—এরা নরদেবতা। সবচেয়ে বড় দেবতা। এদের তো প্রণামী দিতেই হবে। গেল টাকাটা ক্লাব ফাণ্ড থেকে। ভেবেছিলাম দূর বন অঞ্চলে যাচ্ছি, সেখানে খরচা আছে। কিন্তু রেলবাবু সেই বাজেট থেকে একশো টাকা সাফ করে দিল।
পটলার নসুমামা বলে, – ভয় নাই ম্যানেজ করে দেব পরে।
যেতে হবে সারান্দার জঙ্গলে। সারান্দার অরণ্য বিশাল, বিস্তৃত। ওকে বলা হয়, সাতশো পাহাড়ের দেশ। গহীন দুর্গম বনরাজ্য। বাঘ, হাতি, বাইসন, সম্বর, হরিণ সবই আছে। ঠাকুমা পটলাও যাবে শুনে প্রথমে রাজি হয়নি। শেষে নসুমামার কথায় রাজি হয়, আর আমাদের অর্থাৎ পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের বাকি চার মূর্তিকে বলে, – সাবধানে যাবি ভাই। পটলার ওপর নজর রাখিস।
যথারীতি হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে উঠলাম।
নসুমামার আদিবাড়ি হুগলিতে। নসুমামার ঠাকুরদা ওই দুর্গম বনপাহাড়ে কাঠ-এর ব্যবসা করতে গিয়ে প্রচুর টাকা কামিয়ে ওই সারান্দার বাইরে বড়জামদায় বিশাল বাড়ি, কারখানা, ব্যবসা এসব করেন। সেই বিষয়সম্পত্তি কারখানার মালিক এখন নসুমামারা।
তবে নসুমামা যে কোনো কাজ করে, তা বিশ্বাস হয় না। নসুমামা উড়ো পাখির দলে। তেমনি নড়বড়ে লোক ।
প্ল্যাটফর্মে ট্রেন দাঁড়িয়ে, তখন সিগন্যাল হয়ে গেছে। নসুমামা বলে,—তোরা এক নম্বর লেট লতিফ ! কাজ করবি ঘড়ি ধরে। তা নয় যাচ্ছি যাব। ওঠ-ওঠ, ট্রেন ছেড়ে দেবে। এই তো এস-থ্রি কামরা।
আমাদের বার্থও রিজার্ভ করা আছে। নসুমামা বলে,—উঠে বেশ জমিয়ে বাৰ্থে বিছানা পেতে নিবি। খাবার দাবার খাবো তারপরে। ওঠ।
কামরায় দুমদাম উঠে পড়ি। বরাতজোরেই ট্রেনটা পেয়ে গেছি। উঠতে না উঠতেই ট্রেন ছেড়ে দিল।
আমরা এবার ধীরে সুস্থে বার্থ নাম্বার খুঁজছি। রাত-ভোর জার্নি। ভোরে টাটানগরে নেমে বড়জামদার ট্রেন ধরতে হবে। সেটা টাটানগরের স্টেশনের ওদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকে। ট্রেন থামবে একেবারে খড়গপুরে।
হুড়মুড় করে ট্রেন চলেছে। ওদিকে বার্থের সন্ধানে গিয়েছি। বিছানা পেতে এবার আরাম করে বসবো। ওমা! দেখি আমাদের ছ’খানা বার্থের তিনখানাতে এর আগেই গোলগাল এক শেঠজি, তার লটবহর লোকজন নিয়ে জমিয়ে বসেছে। আর দুটো বার্থ খালি আছে, তাও টং-এর উপর। অন্যখানা ওদিকে জানলার ধারে।
নসুমামাই বলে,–এ বার্থ তো হমলোগকা। ছোড় দিজিয়ে-
সেও বলে,—ক্যা! হাম্ টিকিট কাটা—
এমন সময় টিকিট চেকার চার্ট নিয়ে আসতেই আমরা বলি, – আমাদের বার্থ!
টিকিট চেকার আমাদের টিকিট নিয়ে দেখে শুনে বলে,—এ কোন্ ট্রেনে উঠেছেন? এ তো আহমেদাবাদ এক্সপ্রেস। আপনাদের টিকিট তো টিটলাগড় এক্সপ্রেসের—সেটা ছাড়ে এর পর । এখানে আপনাদের বার্থ তো নেই।
বৃহস্পতিবারের বারবেলার খেলই শুরু হয়েছে।
চেকার বলে,—খড়গপুর নেমে যেতে হবে।
এবার অবাক হই। নসুমামার ঘড়িটা দেখি, একঘণ্টা দশ মিনিট ফাস্ট। নসুমামার ঘড়ি না—ঘোড়া। তাই নসুমামা আমাদের তার ঘড়ির টাইমে এসে অন্য ট্রেনেই তুলেছে। টিটলাগড় এক্সপ্রেস খড়গপুরে আসবে মাঝরাতে, তখন দরজাই খুলবে না কেউ। তাই চেকারকে বলি,—টাটানগরে নেমে যাব। একটু যেতে দেন যদি—
চেকার অম্লান বদনে বলে,–ছ’জনের একশো টাকা লাগবে।
এরা একশোর নীচে কথা বলে না। বলি,—টিকিট তো রয়েছে। চেকার সাহেব বলেন,–এ ট্রেনে উঠেছ পেনাল্টি দিতে হবে।
নসুমামার দরাজ দিল। বলে,—দিয়ে দে টাকাটা। রাতদুপুরে আর ঝামেলা করিস না।
বাড়তি টাকা দিয়ে টিকিট কেটে কামরার এক দিকে মালপত্রের উপর বসে ঝিমুচ্ছি। রাত কত জানি না। খড়গপুর পার হয়ে রাতের অন্ধকারে ট্রেন ছুটে চলেছে। ওই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়েছি।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না, গাড়ি থেমেছে। তখন ফর্সা হয়ে গেছে। নসুমামা জেগে উঠে বলে,–নাম, নাম, লেট-লতিফের দল! আবার লেট। এত ঘুমোয়? টাটানগর ছাড়িয়ে চক্রধরপুর এসে গেছি। কি ঘুম রে তোদের? কুম্ভকর্ণের ঘুম।
আবার বিপদ। চক্রধরপুর থেকে বড়জামদা যেতে গেলে পিছিয়ে রাজঘরসোয়ান স্টেশনে আসতে হবে। সেখান দিয়েই বড়জামদার ট্রেন যায়। আর এখন কোনো ট্রেনও নেই ওদিকে যাবার। ওদিকে প্যাসেঞ্জার ট্রেন কমই চলে।
বড়জামদার ওদিকে আছে অনেক আয়রন ওর, ম্যাঙ্গানিজ ওর মাইন। এছাড়া বনের কাঠের ব্যবসা। লোহা কারখানাগুলোয়, অর্থাৎ দুর্গাপুর, ভিলাই, বার্নপুর, রাউরকেল্লা, বোকারো, টাটানগর—যেখানে যত লোহা কারখানা আছে, সেখানেই ওই বড়জামদা থেকে খনিজ লোহা, পাথর, ম্যাঙ্গানিজ এসব যায়। তাই ওদিকে প্যাসেঞ্জার ট্রেনে পৌঁছতে গেলে বৈকাল হয়ে যাবে, অথচ যে ট্রেনে যেতাম — সেটা ধরতে পারলে বেলা দশটা নাগাদ পৌঁছে স্নান খাওয়া করে রেস্ট নিতাম।
সেসব এখন স্বপ্নের কথাই ।
রাগ হয় নসুমামার উপর। পথ ছেড়ে বেপথে এসে গুনোগার দিয়ে এখন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে হাতমুখ ধুয়ে বসে আছি।
হঠাৎ নসুমামা কোথা থেকে ঝড়ের মত এসে বলে,—চল। যাবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এর আগে নসুমামা লম্বা লম্বা গল্প অনেক শুনিয়েছে কলকাতায়। ‘ওদিকের কাকপক্ষীতে আমাদের চেনে’ ।
তাই যাবার ব্যবস্থা হয়েছে শুনে বলি,—কারো গাড়ি-টাড়ি পেলে নাকি ?
—চল তো!
ভাবলাম, ওই অঞ্চলের কোনো প্রাইভেট গাড়িই পেয়েছে বোধ হয় ৷ যাক, গাড়িতে আরামেই যাওয়া যাবে।
হোঁৎকাও খুশি,—নাঃ, নসুমামার এলেম আছে ।
প্ল্যাটফর্মের ওদিকে গিয়ে দেখি, একটা মালগাড়ি খালি ভক্সওয়াগনের মালগাড়ি। নসুমামা গার্ডকে কি বলছে। গার্ড বলে,—উঠে পড়ুন। গাড়ি ছেড়ে দেবে, সিগন্যাল পেয়েছি। —ওঠ-ওঠ!
আমি বলি,–মালগাড়ি যে মামা !
—গার্ডের কামরায় ওঠ তো। হোক মালগাড়ি। বড়জামদা যাচ্ছে, ম্যানেজ করেছি। দেখবি খাবার সময়েই পৌঁছে যাব।
গাড়ির কামরার মেঝেতে আমরা সমাসীন। মালগাড়ি টিক টিক করতে করতে চলেছে। রাজঘরসোয়ান হয়ে বড়জামদার ব্রাঞ্চ লাইনে যখন ঢুকল, তখনই দশটা বেজে গেছে।
বড়জামদার এই লাইন গেছে সারান্দার অরণ্যের শেষ স্টেশন গুয়ামাইনস অবধি। এই লাইনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলে একেবারে গোনা গুনতি, বাকি সব যাতায়াত করে মালগাড়িই। লোহাপাথর আনতে যায় ।
আমাদের মালগাড়ির ড্রাইভার ফিরিঙ্গি সাহেব। শীর্ণ কালচে চিমসে চেহারা, বাঁশের লগার মত লম্বা। প্যান্টটাও ধুলো কালিতে ময়লা, শার্টটার আসল রং কি ছিল তা বোঝা যায় না এখন । সঙ্গে একজন সহকারী আছে।
রাজঘরসোয়ান স্টেশনে চা আর শুকনো বিস্কুট মেলে। খিদেও লেগেছে। এর আগে রাতের খাবারও শেষ। হোঁৎকার আবার ঘন ঘন খিদে পায়। সে বলে,—ওই বিস্কুটই প্যাকেট
চারেক নে।
নসুমামা বলে,–দেরি হবে না। দুপুরের আগেই পৌছব।
ওর কথায় আর বিশ্বাস নেই। কাল রাতে যা খেল দেখিয়েছে তা এখনও ভুলিনি। পটলা গোটা ছয়েক প্যাকেট বিস্কুটই তুলল। আমি তার থেকে একটা প্যাকেট ওই গার্ডসাহেবকেও দিলাম।
সঙ্গের লোকটা বলে, —চা কই?
রাজঘরসোয়ান স্টেশনে দেখি ট্রেনের ড্রাইভার আর গার্ড কি কথাবার্তা বলছে। ওদের সেই অনুচরও রয়েছে।
বেশ আলাপ টালাপের পর ট্রেন এবার জামদা লাইনে ঢুকেছে।
তারপরই শুরু হল আসল ব্যাপার।
গার্ডের সেই অনুচর-ওর নাম নাকি পিটার, সে বলে আমাদের,—ইউ ম্যান, তোমাদের ছজনের লাগবে দেড়শো টাকা।
মানে?—অবাক হই টাকার কথা বলতে। ভেবেছিলাম নসুমামার চেনা জানা গার্ড, এমনিই নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।
বলি,—আমাদের তো টিকিট আছে।
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়। গার্ডের সেই অনুচর পিটার সাহেব বলে,–তাহলে সামনের স্টেশনে নেমে যাও, সেই ট্রেনেই যাবে। দিস ইজ গুডস্ স্পেশাল ম্যান। এর জন্য আলাদা চার্জ দিতে হবে। পার হেড টোয়েনটি ফাইভ। না দাও—নেমে যাও ।
তেপান্তরের মাঠে একটা স্টেশন ঘর, দূরে নীল পাহাড়ে বনের সূচনা। জনমানবহীন এই মাঠে নামতে হবে? খাবার জল অবধি মেলে না, আর পরের গাড়ি সেই বেলা চারটেয়।
রেলের লোকরা যে এমনি অর্থপিশাচ তা জানা ছিল না। উঠে অবধি রকমারি গচ্চা দিয়ে চলেছি। নসুমামার সেই এক ডায়লগ,—দিয়ে দে। এরা পেয়ে থাকে। না হলে কখন পৌঁছব
কে জানে !
এত টাকা! একটু কমাও গার্ডসাহেব। —গোবরা বলে।
পিটার বলে, – কম হবে না। এই রেট।
অগত্যা গুনে গুনে আবার দেড়শো টাকা গেল। নেহাত পটলা আছে তাই রক্ষে, না হলে কি যে হত কে জানে।
এরপর শুরু হল গার্ডসাহেবের আসল ব্যবসা।
এইসব লাইনে ট্রেন কম। প্রত্যেক স্টেশনে কুলি, আদিবাসী লোকজন, হাটের যাত্রীরা, মালপত্র আনাজ মহুয়ার ইয়া বড় বড় হাঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর প্রতি স্টেশনেই মালগাড়িও থামছে
পিটার নেমে গিয়ে ওইসব খালি ওয়াগনে লোকজনদের তুলছে, আর নগদ পয়সা আদায় করছে। ওদিকে ড্রাইভারও নজর রাখছে কত লোক উঠছে। পিটার রয়েছে এই কাজের জন্যই।
ফি স্টেশনে লোক তুলছে—কিছু নামছেও, আর পিটার নোটের তাড়া এনে গার্ডের ওদিকের ড্রয়ারে পুরছে। গার্ডসাহেবের এমন আমদানির বহর দেখে আমরা তো অবাক।
বেলা তখন দুটো বেজে গেছে। পথে খাবার-দাবার কিছুই নেই। পেটের মধ্যে খোলকরতাল বাজছে। হোঁৎকা গুম হয়ে গেছে। শুধোই,—আর কতদূর মামা ?
নসুমামা বলে,—এই তো এসে গেছি, গোটা ছয় সাত স্টেশন ।
মানে আরো তিনঘণ্টা! – গোবরা গর্জে ওঠে।
ওদিকে দেখি গার্ডসাহেব এবার টিফিন কেরিয়ার খুলে লাঞ্চ-এর আয়োজন করছে। অবশ্য সুখাদ্য কিছু নয়, পান্তা ভাত আর কুচো চিংড়ির চচ্চড়ি। সঙ্গে পিঁয়াজ আর কাঁচা লঙ্কা।
ওরা লাঞ্চ করছে, আমরা বাইরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রেন থেকে পাহাড় বনের শোভা দেখছি। এখন বন বেশ গভীর হয়েছে। শালবন—মাঝে মাঝে দু-একটা পাহাড়ি ঝর্না, ব্রিজ ও আছে, আর দিগন্তে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়গুলো যেন প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে।
নসুমামা সান্ত্বনা দেবার জন্যেই বলে, –আর বেশি দেরি হবে না। কাল কেসটা গড়বড় হয়ে গেল—
পটলা বলে,—কত লোকসান হল জ-জানো ?
হোঁৎকা বলে,—আমি যামু না। এইখানেই নাইমা যামু।
নসুমামা বলে,—এখানে কোথায় নামবে? আর দুঃখ করো না, সব পুষিয়ে যাবে। এ-ও একটা অ্যাডভেঞ্চার হে!
ওদিকে ওদের পাত্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। সামনে স্টেশন আসছে। নসুমামা বলে, –এর একটা স্টেশন পরেই জামদা। আর একটু কষ্ট কর। কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না হে! জীবনে কত কষ্ট করেছি!
কেষ্ট পেয়েছ?—আমার কথায় নসুমানা বিজ্ঞের মত হাসল।
বনের মধ্যে স্টেশন। স্টেশনটা বড়ই। চারিদিকে ছড়ানো বনপাহাড়ের মধ্যে বড় বড় আয়রন মাইন। এখান থেকেও কয়েকটা লাইন বের হয়েছে। গার্ডসাহেব নেমে গেছে, প্ল্যাটফর্মে দেখি সেই ড্রাইভারও নেমে এসেছে। তিনজনে বেশ হাসিখুশির মধ্যে আলোচনা
করছে।
গোবরা বলে,—আজকের যে টাকা উঠেছে তারই ভাগা-ভাগির হিসাব হচ্ছে। মাইনে ছাড়া দিনে ব্যাটারা কতটাকা চুরি করে রেল কোম্পানিকে ঠকাচ্ছে দ্যাখ!
আমাদের যে বেশ কয়েকশো টাকা রেলের অসাধু কর্মচারীদের জন্য গেছে এটা বুঝেছি হাড়ে হাড়ে।
আবার বেশ কিছু যাত্রী উঠল। ছাগল-ভেড়াও তুলেছে। নসুমামা বলে,-আজ বড়জামদার হাট, তাই এত ভিড়।
অবশ্য আমাদের কজনকে গার্ডসাহেব মালগাড়িতে তোলেনি, বরাবর তার কামরাতেই রয়েছি। বারান্দায় বসে বনের শোভা দেখছি ।
এই জামদার পরের স্টেশনই গুয়া। তবে এই মালগাড়ি নাকি বড়জামদা স্টেশন থেকে ভিতরে কোনো আয়রন মাইনের দিকে চলে যাবে। যাত্রীরা সবাই নেমে যাবে ওখানে।
পিটার, গার্ডসাহেব এবার বাইরের বারান্দায় এসে খুশি মনে গান ধরেছে। পিটারও খুশি, আর আদায়ের ঝামেলা নেই—যা হয়েছে তা মন্দ নয়। নসুমামাকে দেখছি না, বোধহয় ভিতরে ঘুমোচ্ছে।
বড়জামদার স্টেশনে গাড়ি ঢুকতে নসুমামা বলে,– আমি স্টেশনে নেমেই বাইরে গে একটা অটো ধরব। আগে ধরতে না পারলে অটো মিলবে না, আজ হাটবার। তোরা নেমেই বাইরে চলে যাবি ।
স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে মামা নেমেই হাওয়া । আমরাও নেমেছি। মালগাড়িতে এত লোক ছিল ভাবিনি। পিল পিল করে লোক নামছে—মালপত্র, ছাগল, মুরগি, ভেড়া নিয়ে ।
কোনো মতে বের হবার জন্য ওভারব্রিজ পার হয়ে এদিকে এসে পৌঁছেছি। তখন ওদিককার প্ল্যাটফর্ম অনেক ফাঁকা হয়ে গেছে। প্ল্যাটফর্মে দেখি সেই পিটার আর গার্ডসাহেবের মধ্যে চিৎকার চেঁচামেচি হচ্ছে। সিঁটকে গার্ড পিটারকে বলছে,—ইউ থিপ্! চোর কাঁহিকা !
পিটার কি বলার চেষ্টা করে, এবার গার্ডের কামরায় ঢুকে বের হয়ে এসে বলে,—গড নোজ! আমি কিছু জানে না ।
এমন সময় মোটকা ড্রাইভারও এসে পড়ে। কি শুনে সে এবার ওই সিঁটকে গার্ডের দিকে একহাত তুলে গজরায়,—ইউ লায়ার, থিপ্। হামকে ফাঁকি দেবার মতলব। আই শ্যাল কিল ইউ ।
গার্ডসাহেব তখন আশমানে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করে,—বিলিভ মি দেশপাণ্ডে।
ড্রাইভারের পদবি বোধহয় দেশপাণ্ডে। সে তখন গর্জাচ্ছে—হমুকে শেয়ার নেহি দেনা? ইউ ডেভিল, নিকালো রুপেয়া।
গার্ড বলে,–নাই, অল গন! আপন গড !
–শাট আপ!
হঠাৎ নসুমামার ডাক শুনে এমন সার্কাস দেখা ফেলে পেছন দিকে চাইলাম। নসুমামা ভিড়ের মধ্যে থেকে ডাকছে,—চলে আয় শিগগির। নালে গাড়ি পাবি না।
আমরাও স্টেশন থেকে বের হয়ে পথে ওই ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলাম। নসুমামা বলে, —চল ওদিকে। অটোওয়ালাকে ফিট করে রেখেছি।
এখান থেকে মাইল পাঁচেক গেলে তবে মামাদের বাড়ি বড়বিলে। সেইটাই এখানকার মধ্যে নাকি বড় শহর। পাহাড় বন নদী সবই আছে।
বড়জামদা ছাড়িয়ে অটোটা চলেছে। চারিদিকে পাহাড়, আর সেই পাহাড়ের বুক ঘন বনে ঢাকা। মামা বলে,—এসবই সারান্দার মধ্যে।
হাটতলার পাশে একটা দোকানে গরম কচুরি ভাজা হচ্ছে। গন্ধেই খিদেটা চাগিয়ে ওঠে। হোঁৎকা বলে,— পটলা আমি মইরা যামুরে, প্যাট হাঁচড় পাঁচড় করতাছে।
মামাই বলে,–নাম, এদের কচুরি খুবই উৎকৃষ্ট।
নামলাম ।
কিন্তু গোবরা কোষাধ্যক্ষ। এর আগে রেলে দিতে হয়েছে একশো টাকা বুকিং ক্লার্ককে, গাড়ির চেকারকে একশো, আর গার্ডকে দিতে হয়েছে দেড়শো। এছাড়া চা বিস্কুট আর চিনেবাদামেই গেছে প্রায় শত খানেক।
গোবরা বলে,—হিসাব করে খাবি। ক্যাশের স্বাস্থ্য খুবই খারাপ। অনেক গচ্চা গেছে। হোঁৎকাকে সামলাবি ।
চারখানা করে কচুরির অর্ডার দেওয়া হয়।
হোঁৎকা বলে,—তরাই খা। আমি খামু না।
হোঁৎকা যে অনশন সত্যাগ্রহ করবে জানা ছিল না। এমন সময় সকলকে অবাক করে নসুমামা বলে, আটখান করেই দাও, তারপর দেখা যাবে।
গোবরা বলে,—কিন্তু মামা – !
মামা অভয় দেয়,এ আমার জায়গা, তোরা খা—যা খুশি ।
এই কথা শুনে হোঁৎকা ডজন দেড়েক কচুরি, সেই সঙ্গে বার তিনেক আলুর তরকারি, শেষ পাতে গোটা আষ্টেক রাজভোগ আর চারটে কালাকাঁদ খেয়ে, গেলাস দুয়েক জল খেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,—এবার মনে হয় বাঁইচা গেলাম।
আমরাও মন্দ খাইনি। বেলা তখন চারটে বাজে। দেখলাম সেই যাত্রীবাহী ট্রেনটাও এসে স্টেশনে ঢুকছে। পটলা বলে,—ওই ট্রেনে এলে আর দেড়শো টাকা গচ্চা যেত না। একসঙ্গেই তো এল।
নসুমামা সান্ত্বনা দেয়,—যা হয়ে গেছে তার জন্য ভাবতে নেই ।
দোকানদার সব হিসাবপত্র করে বলে,—দুশো বারো টাকা হয়েছে।
চমকে উঠি টাকার অঙ্ক শুনে। মামা কিন্তু নির্বিকার। হাতের ব্যাগটা নিয়ে উঠে গিয়ে অনায়াসেই টাকা মিটিয়ে কিঞ্চিৎ মৌরি কাউন্টার থেকে নিয়ে মুখে ছিটিয়ে বলে,—আয় এবার বাড়ি যেতে হবে ।
মামার এই ব্যাপারে আমরাও অবাক। কৃপণ নসুমামা হঠাৎ যেন দাতাকর্ণ হয়ে গেছে। অটো চলেছে। হঠাৎ মনে পড়ে প্ল্যাটফর্মের সেই লড়াই-এর দৃশ্যটা। আগে গার্ড আর ড্রাইভারে দেখেছি গলাগলি ভাব। শুধোই,—মামা, হঠাৎ ওই লরেল হার্ডির মারপিট শুরু হল কেন বলো তো? মোটকা ড্রাইভার গার্ডকে তুলে লাইনেই আছড়াতে গেল।
নসুমামা পাহাড়-বনের দিকে চেয়ে বলে,–কোনো রিজন নিশ্চয়ই আছে।
—সেই কারণটাই তো জানতে চাইছি।
মামা বলে,– পরে জানবি। ওদের বখরা নিয়ে এমন প্রায়ই হয়। ওই যাত্রীদের কালেকশন গার্ড আর ড্রাইভারের মধ্যে ভাগ হয়। বেধেছে তাই নিয়েই হয়তো। ছাড় তো! এসে গেছি।
নসুমামাদের বাড়িটা শহরের উপকণ্ঠে। চারিদিকে পাহাড়, মধ্যে একটা সবুজ উপত্যকার বুকে এই শহর। ভালো বাড়ি—রাস্তা—বড় বড় দোকান পশার নানা জিনিস সবই মেলে। ব্যাঙ্ক, কাছারি—তাও আছে। একটা মহকুমা শহর এটা।
মামাদের বাড়িটা নদীর ধারে বেশ অনেকখানি জায়গা নিয়ে। আম, লিচু, কলাগাছ, কাঁঠালগাছ রয়েছে বাগানে। এখানে বেশ জমিয়েই রয়েছে নসুমামারা ক’পুরুষ ধরে।
আমাদের জন্য ওদিকে একটা খালি বাংলোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিশাল এলাকাটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সামনেই পাহাড়-বন।
ফটিক বলে,—দারুণ জায়গা।
হোঁৎকা অবশ্য কবি, শিল্পী-টিল্পী নয়। সে বলে,–হাঁরে, খাওয়ার ব্যবস্থাটা কনে হইব? নসুমামা বলে,ওসব হয়ে যাবে, ভেবো না।
মালগাড়ির আয়রন ওরের লাল ধুলো সর্বাঙ্গে। তাই প্রথমে স্নান করে, ফ্রেশ হয়ে নিই। তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে।
এর মধ্যে নসুমামার ভাই রাসুমামাও এসে পড়েছে। ওদের বড়দা শিবুবাবুই ব্যবসাপ দেখেন, আর ওই দুই ভাইকে সামলান ।
কারখানা জমি জিরেত সবই আছে। নিজেদেরই পোলট্রি ফার্ম। ওদিকে বেশ কয়েকটা নধর জার্সি গাইও রয়েছে।
স্নানাদির পর এসে গেছে গরম পরোটা আর মুরগির মাংস। এখানকার জলও দারুণ। সেই কচুরি কখন হজম হয়ে গেছে।
এবার একটা গড়াগড়ি দিচ্ছি। নসুমামা আসে। বলে,—কেমন জায়গা রে!
বলি,—দারুণ!
নসুমামা এবার গোবরাকে বলে,–নে। রেল কোম্পানির লোকগুলোকে গুনোগার দিলি সাড়ে তিনশো টাকা, রাখ সেটা তোদের ক্যাশে।
এবার অবাক হই,—সে কি মামা, তুমি কেন টাকা দেবে? ওটা তো আক্কেল-সেলামি, তুমি কেন গচ্চা দেবে ?
পটলা বলে,—তা তো বটেই। টাকা কেন দেবে?
নসুমামা বলে,–এ টাকা ওই শালাদের চুরির টাকা রে– আমি চোরের উপর বাটপাড়ি করেছি ওদের শিক্ষা দেবার জন্যে।
মানে?—গোবরা অবাক হয়।
নসুমামা এবার ওই গার্ড ড্রাইভারের মারপিটের ‘রিজন’ প্রকাশ করে। বলে,—ওই পিটার আর গার্ড যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ড্রয়ারে রাখছিল। স্টেশনে নামার আগেই ওদের ড্রয়ার থেকে সব চুরির মাল ব্যাগে পুরে কেটে পড়েছিলাম। সব সাফ ।
ওই টাকা নিতে বাধে। পটলাই বলে, –ও লাগবে না মামা। কত এনেছ?
মামা ব্যাগটা বের করে দেখায়। বলে, হাজার তিনেক হবে।
-একদিনে এত টাকা ?
মামা বলে,-বোঝ তাহলে, রেল কোম্পানির কত ঝাড়ে ওরা।
পটলা বলে,—সব টাকাটাই রেখে দাও, কোনো ভালো কাজে লাগানো যাবো।
নসুমামা বলে,–নিতে চাইনি, ওদের শিক্ষা দেবার জন্য নিয়েছি। তা যখন বলছিস, থাক এটা। পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তেই যাবে।
নসুমামা এমনিই অসাধারণ। তবে এরপর রাসুমামার যে পরিচয় পেলাম তাও কম নয়। সন্ধ্যায় রাসুমামা এসে জোটে। পরনে এখন রাসুমামার হাফ প্যান্ট। হাতে বন্দুক, গলায় টোটার মালা, মাথায় টুপি।
বাংলোর বাগানে বসে আছি, ওই ধড়াচূড়া পরে রাসুমামা ঢুকল।
—তোরা এসে গেছিস? বহুৎ আচ্ছা হয়েসে। বৈঠ, বৈঠ। চা আনো—চঞ্চল। গুটে বিস্কুটও দিবা ।
রাসুমামার ভাষাটাও খিচুড়ি মার্কা। বড়জামদার অবস্থান বড় বিচিত্র জায়গায়। শহরের অর্ধেকটা বিহার, রাস্তার ওদিকটা উড়িষ্যা। তাই বিহারি-ওড়িয়া ভাষার খিচুড়ি চলে এখানে। বাঙালিরা তো তিনরকম ভাষাতেই কথা বলে। রাসুমামা এদেশেই মানুষ, তাই ওর ভাষাটাও বিচিত্র।
রাসুমামা নাকি বিরাট শিকারি। ওকে ওই পোশাকে ঢুকতে দেখে পটলা বলে,–কোথায় গেছলে?
রাসুমামা বলে,– পোলট্রি ফার্মের ওদিকে দুটো চিতা ঘুরছে। তাই ওগুলোকে তাড়াতে গেছলাম। বুঝলি সরকার আইন করেছে বন্যপ্রাণী মারা যাবে না। তখন তো কত কি মেরেছি। সম্বর, হরিণের মাংস ছাড়া ভাত খাইনি।
আমার ঠাকুরদা প্রথম এদিকে এসে ওই নদীর ধারেই বাঘ মেরে শিকারে হাতেখড়ি দেয়। তারপর তো কত হাতি, বাঘ, বাইসন মেরেছে তার হিসাব নেই। বাবাও …
রাসুমামার গল্প শুরু হলে থামে না। হোঁৎকা বলে,—তা এহন হরিণ টরিণ মারতি পারেন না ?
রাসুমামা বলে,—আইন বড় কড়া। তা সারান্দার বাংলোতে যাচ্ছ তো?
পটলা বলে, সেই সব পারমিশান নিয়েই এসেছি।
—গুড! কোনো ভাবনা নেই। যাবার সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে। আমি আছি যখন, কোনো অসুবিধাই হবে না।
আমি বলি,—তা জানি।
রাসুমামা বলে,—তখন কত শিকার করেছি। অন ফুট। এখন সব মাচানে বসে।
হোঁৎকা বলে,—শিকারি তাহলে আছে এখনও !
রাসুমামা চায়ের কাপে চুমুক দিতে বলে,—শিকারি ! এখন আর কেউ শিকারি আছে নাকি ?
আমিই কিছু শিখেছিলাম গুরুর কাছে।
শিকারের পরম্পরা, গুরু, এসব আছে নাকি? —বলে উঠি।
রাসুমামা বলে,শিওর, সব কিছুই শিক্ষা করতে হয় গুরুর কাছ থেকে
ফটিক বলে, – নিশ্চয়ই। গুরুর ঘরওয়ানা থাকবে, সাধনা থাকবে।
রাসুমামা ফটিকের কথায় খুবই খুশি। বলে,–তুমিও শিকার করো নাকি ? আমিই বলি,–ও গান-টান গায় ।
রাসুমামা যেন আশমান থেকে ধপাস করে পড়ে,-গান গাও !
তারপর বলে,—তবে গুরুর কথা যা বললে সেটা খাঁটি সত্যি। কাউকে দিয়ে যাননি।
তখন সন্ধ্যা নেমেছে। পাহাড়গুলো যেন আঁধার পাঁচিলের মত আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে স্তব্ধতা নেমেছে, মাঝে মাঝে বনের দিক থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে আসে। ওদিকে কিরিবুরুর পাহাড় চূড়ায় স্টিল কলোনির দু’চারটে আলো দেখা যাচ্ছে। যেন আকাশে তারা উঠেছে।
এই পরিবেশে আদিম আরণ্যক রূপটা যেন ফিরে এসেছে।
নসুমামা বলে,—রাসু, তোর গুরুর চেয়ে আমার গুরুর নামডাকই ছিল বেশি।
রাসুমামা চটে ওঠে,—থাম তো! আমার গুরু ধম্মদেওজির কথা এখানে সবাই জানে।… বুঝলে—বুনো হাতি, বাঘ, সকলের ভাষাই বুঝতেন তিনি। বনে গিয়ে গন্ধ শুঁকে জানতে পারতেন বাঘ, হাতি কোন্ দিকে গেছে। স্বচক্ষে দেখা হে, মাত্র একটা গুলি। ব্যস—এত বড় হাতির মাথা দিয়ে গুলি ঢুকলো আর সেই গুলি করাতের ফালার মত ইয়া বড় হাতিকে সমান দু’খণ্ড করে বের হয়ে গিয়ে পরের শিকারে লাগল। হাতি দু’খণ্ড হয়ে ছিটকে পড়ল দুদিকে। তাঁর গুলি কখনও ফসকাতে দেখিনি। গুলি ফসকালে, গুলি নিজেই ঘুরে এসে লক্ষ্যে ঠিক লাগত।
-সে কি !
আমার কথায় রাসুমামা বলে,—স্বচক্ষে দেখা হে। তাজ্জব ঘটনা।
নসুমামা বলে,—শুধু কথাতেই বাঘ মারতেন ওর গুরু।
রাসুমামা গর্জে ওঠে,—থামবি নসু? শিকারের তুই কি জানিস, তোর গুরু ওই নকুল মাহাতো কি জানত? আমার গুরু বন্দুকই ব্যবহার করত না। ভালুক টালুক তো গরু বাঁধা গোঁজ দিয়ে পিটিয়েই মারতেন। গরু বাঁধার খোঁটা দিয়ে কত ভালুক মেরেছেন তার হিসাব নেই ।
নসুমামা বলে,–কি গুরুরে তোর রাসু? বনে বনে কষ্ট করে ঘুরে শিকার করত? আমার গুরুদেব একেবারে সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। বনে জঙ্গলে যেতেই হত না ।
আমরা অবাক হই ।
—কি বলছ? বনে না গিয়ে শিকার করবে কি করে?
নসুমামা এবার লাইনে এসেছে। বলে,—তবে আর মহাশিকারী কি! আমার গুরুদেবকে সারা এলাকায় মুণ্ডা হো’রা বলতো—মারাং শিকারি। মানে সবচেয়ে বড় শিকারি ।
তখন তো সর্বত্র বন, গভীর বন। কোথাও বাঘের উৎপাত হচ্ছে, কোনো গাঁয়ে পাগলা হাতির উৎপাত শুরু হয়েছে—মানুষ মেরে তছনছ করছে, কোনো অঞ্চলে বাইসন ক্ষেপে গিয়ে ঘরবাড়ি ভাঙছে—বিভিন্ন গাঁয়ের মানুষ আসত গুরুদেবের কাছে খবর দিতে।
গুরুদেবের চ্যালা হিসাবে আমার কাজ ছিল একটা খাতায় কোন্ গ্রামে বাঘ মানুষ মারছে, কোন্ বসতিতে হাতি মানুষ মারছে, কোথায় বাইসন মানুষের সর্বনাশ করছে—এই সব লিখে রাখা। খাতাতে এক নম্বর, দু’নম্বর করে নাম্বার দিয়ে ওই সব লিখতাম।
—তারপর সেই সব বনে যেত শিকার করতে?
গোবরার কথায় নসুমামা বলে, – ধ্যাৎ, মহাপুরুষ মারাং শিকারি। ওদের ব্যাপারই আলাদা । সন্ধ্যার পর গুরুদেব পূজা অর্চনা সেরে কপালে প্রসাদী তিলক পরে বাইরে এসে হাঁক দিত, –বন্দুক লাও, গুলি লাও ।
আমরা এনে দিতাম বন্দুক। আর খাতা হাতে রেডি। গুরুদেব বলতেন,—পড়ো। এক নম্বর-
আমি পড়ে যেতাম,—কুদলিবাদে একটা বুনো হাতি ….
গুড়ুম! গুরুদেব একটা গুলি করলেন,—দুসরা ?
আমি পড়ে গেলাম,—এদেলবাও-এ একটা বাঘ…
গুড়ুম! আবার গুলি। এমনি পর পর পড়ে গেলাম বসতির নাম আর জানোয়ারের নাম, আর এক একটা গুলি ছুটল।
—তারপর।
নসুমামা বলে,—ওই এক একটা বসতির এক এক জানোয়ারের নামে ছোঁড়া গুলি ঠিক গিয়ে তাদেরই কানে কপালে মোক্ষম জায়গাতেই লাগবে। আর খবর আসত ত্যানারা সব নিকেশ হয়ে গেছেন। ঘরে বসেই শিকার।
আমরা হতবাক ।
রাসুমামা বলে,-গুলিবাজ নয়তো গুলবাজ ।
নসুমামা বলে,—ওই বিদ্যাটা শিখতে পারলাম না। গুরু অকালে সাপের ছোবলে মারা গেছল।
গল্প ভালোই জমেছে। এমন সময় খাবার ডাক আসাতে আড্ডা থামিয়ে উঠতে হল। তবে মহান ওই শিকারিদের চ্যালাদের এলেম দেখার বাসনাটা প্রবল হয়ে উঠল।
ক’দিন এখানে থাকতে হবে, কারণ সারান্দার বনের ভিতর বনবাংলোয় থাকতে গেলে বনবিভাগের বিশেষ অনুমতিপত্র চাই। সেটা আনতে হবে চাইবাসার বন অফিসের থেকে।
বড়মামা খুবই কর্মব্যস্ত লোক। ব্যবসাপত্রের কাজে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়, জেলার কর্তাদের কাছেও যেতে হয়। বড়মামার ম্যানেজার, অন্য কর্মচারীরা অবশ্য আছে। আর তার এই দুই ভাই আমাদের নসুমামা আর রাসুমামা কাজের থেকে অকাজই করে বেশি। রাসুমামা তো জিপ নিয়ে ওই শিকারির বেশেই বনপাহাড়ে ঘোরে। আর নসুমামা ঘরে বসেই তস্য গুরুদেবের মত কামান দেগে অমুক বসতির হাতি, তমুকবনের বাঘ মারেন।
সেদিন সকালে আমাদের বনে যাবার কথা শুনে রাসুমামা বলে,–নো ফিয়ার, চল আজই বনে যাবি। বাংলো-ফাংলো সব ব্যবস্থা করে দেব।
বড়মামা বলেন,—থাম রাসু। অনেক করেছিস, বিনা পারমিটে বনে ঢুকে এদের বিপদে ফেলিস না।
তবে কি বনে থাকা যাবে না? –পটলা বলে।
বড়মামা বলেন,–এই সপ্তাহেই চাইবাসা যাব ব্যবসার কাজে। ডি. এফ. ও সাহেব আমার চেনা জানা। তোমাদের পারমিট, বাংলোর ব্যবস্থাও করে আনব।
রাসুমামার গুরুত্ব যেন কমছে। সে বলে,—করো তাহলে। বনে যাবে তার আবার অনুমতি! রামচন্দ্র বনে গেছল কার কাছে পারমিট নে?
বড়মামা বলেন,—তখন রামরাজত্ব, ওসব লাগত না। এখন মানুষের রাজত্বে মানুষের এসব লাগে। তোর মত মর্কটদের অবশ্য এখনও এসবের দরকার নেই।
রাসুমামা চুপ করে যায়।
এর মধ্যে আমরা বড়বিল শহরটাকে দেখে ফেলেছি। ছোটশহর, চারদিকে ঘন বনে ঢাকা পাহাড়। পাহাড়ের শ্রেণী চলে গেছে সারান্দার দিকে।
ওদিকের নদীটার নাম কারো। দুদিকে শাকসবজির খেত। ধানও কিছু হয়েছে। মাটি খুবই উর্বর। কিন্তু বন থেকে হরিণের পাল নামে। আসে বন শুয়োরের দল। বুনো হাতির দেখা তো পথেই মেলে। বনপাহাড় ছেড়ে তারাও মাঝে মাঝে শহরের আশেপাশে এসে কলাবাগান, আখখেত তছনছ করে যায়। আর আসে ভালুকও। তাই বড়মামা বলেন,–বেশি দূরে যেও না। এসব জায়গা সেফ নয়।
সেদিন সকালে নসুমামার সঙ্গে বের হয়েছি ওদের খামারের দিকে। ওদিকের পাহাড়ের কোলে বিস্তীর্ণ ঢালু জমিতে আখ, আলু, ধান, আনাজপত্রের চাষ হয়। তার ওদিকে নদীর ধার ঘেঁষে মুরগির খামার ।
এককালে এসবই বনে ঢাকা ছিল। মানুষ বন কেটে এসব জবর দখল করে চাষ আবাদ করছে বনের পশুদের তাড়িয়ে।
তবু তারা মাঝে মাঝে এসে হানা দেয় খেতে। মাঠে সবুজ সতেজ আলু, আখ হয়েছে। সেই আলুর ভেলি বেশ কয়েকটা কারা যেন কোদাল দিয়ে খুঁড়ে নীচেকার নধর আলু সব খেয়ে গেছে। কিছু পড়ে আছে, দাঁতের ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ।
আমি বলি,—এত আলু তোলা হয়েছে?
মজুরার বলে,—না, বাবু ।
রাসুমামা নিরীক্ষণ করে বলে,– দেখছিস না, বন শুয়োরের পাল নেমেছিল। তারাই দাঁত দিয়ে ভেলি উলটে সব আলু শেষ করেছে।
স্থানীয় মুণ্ডা মজুররা বলে,—সুলুক সন্ধান পেয়েছে, এবার রোজই নামবে। ওদিকে হরিণের পালও আসছে। সব শেষ হয়ে যাবে।
নসুমামা বলে,–আজ রাতেই আসছি রেডি হয়ে। বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা ! ওই বনশুয়োর হরিণ যা পাব তাই মারব।
রাসুমামাকে বলি,—আমরাও তোমার সঙ্গে আসব মামা। তোমার শিকার করা দেখব। দেখবি!—রাসুমামা বেশ গৌরবান্বিত বোধ করে। তবু বলে, তবে কাউকেই বলবি না । একদম সায়লেন্ট থাকবি। বড়দা, বিশেষ করে ওই গুলবাজ নসুকে একদম বলবি না। হান্টিং কাকে বলে তোদের দেখাব। তোরাও বল্লম, লাঠি, টাঙ্গি হাতে রাখবি। অবশ্য দরকার হবে না, আমি আছি। তবু হাতে একটা হাতিয়ার থাকলে মনের জোর বাড়ে।
সত্যিই শিকার দেখা যাবে। পটলা বলে,–বনে এসে এসব না দেখলে চলে ?
হোঁৎকা বলে,—তা যা কইছিস।
বাড়ি ফিরে চুপচাপ রইলাম। নসুমামা শুধোয়,—কোথায় গেছলি?
ফটিক ওইসব এড়াবার জন্য বলে,—শহরের এদিক ওদিক ঘুরছিলাম।
নসুমামা বলে,—বাইরে যাবি না। এখন বুনোশুয়োর, ভালুক, একটা দুটো চিতে বাঘও নাকি আসছে নদীতে জল খেতে। একা দূরে যাবি না। কাল তোদের মুর্গা মহাদেও দেখাতে নিয়ে যাব। পাহাড়ের মধ্যে ঝর্না—সেখানে মন্দির ঘন বনের মধ্যে। লাকে থাকলে বুনো হাতিও দেখতে পাবি ।
গোবরা বলে,—তাড়া ফাড়া করবে না তো মামা?
নসুমামা বলে,–এ শর্মাকে বনের হাতিরাও চেনে। নকুল মাহাতোর সাগরেদকে বনের সবাই সমীহ করে। কোনো ভয় নাই। রেডি থাকবি কাল সকালে।
দুইমামার দয়াতে অনেক কিছুই দেখা যাবে। আজই তো যাচ্ছি বরাহ শিকারে। দিনটা চুপচাপই কেটে গেল। বড়মামাও চলে গেলেন চাইবাসা। পরশু ফিরবেন জঙ্গলে যাবার পাশ নিয়ে।
তিথিটা বোধহয় পূর্ণিমা, শীতের শুরু। আকাশ বেশ ঝকঝকে। চাঁদের আলোয় বনপাহাড় স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। আমরা পাঁচমূর্তি আর রাসুমামা বের হলাম চুপিসাড়ে। রাসুমামার পরনে হাফপ্যান্ট, পায়ে মোজা—হান্টিং সু, গায়ে শার্টের উপর একটা কালো রং-এর গোবদা সোয়েটার, মাথায় টুপি। হাতে বন্দুক, গলায় টোটার মালা ।
আমাদের বলে,—নসুকে কিছু বলিসনি তো?
পটলা বলে,না, না ।
গোবরা বলে,—ও কাল আমাদের মুর্গা মহাদেব দেখাতে নিয়ে যাবে। বুনো হাতিও দেখাবে
বলেছে।
রাসুমামা বলে,—এখন তোদের শুঁড়কাটা হাতির বাচ্চার পালই দেখাব চল।
শুয়োরগুলো বেশ নাকি নধর। হাতির বাচ্চার মতই দুদিকে দুটো ধারলো দাঁত বের হয়ে থাকে। ওই দিয়েই তারা মাটি খুঁড়ে কন্দ মূল বের করে। আলুর ভেলি সাফ করেছে ওই দাঁত দিয়েই ।
হোঁৎকা বলে,—শুয়োর তো খাই না মামা, একখান হরিণ যদি মারতি পারো।
রাসুমামা তখন বীরদর্পে এগিয়ে চলেছে। আমরা চলেছি তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে। রাসুমামা বলে,—চান্স পেলে হরিণই খাওয়াব তোদের।
খামারের ওখানে একটা লম্বা শেড মত আছে। তখন রাত বেশ গভীর। চারিদিক নিস্তব্ধ ৷ মুণ্ডা মজুরদের সর্দার কালু মুণ্ডাও জেগেই ছিল। তবে ঠিক সজ্ঞানে নেই। মহুয়া ওদের চাই-ই। মহুয়া পান করে তখন তার দাঁড়াবার মত অবস্থা নেই, টলছে। তবে ওতে ওরা অভ্যস্ত। টলতে টলতেই ওরা সব কাজ করে।
এর মধ্যে এখান ওখান থেকে খান দুয়েক বল্লম, লোহার রড, লাঠিও জোগাড় হয়ে যায় আমাদের জন্যে।
রাসুমামা বলে,—মুণ্ডা তুই-ও চল খেতে।
মুণ্ডা চোখ বুজেই বলে,—তোরাই যা। আমি এখন নিদাবো, নিদ আইছে।
ওইখানেই একটা বস্তার গাদার উপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে। নেশায় না ঘুমে বুঁদ হয়ে
যায় তা বুঝতে পারি না। তবে আর ওর সাড়াশব্দ মেলে না।
আমি বলি,–কি হবে মামা। গাইড তো আউট।
রাসুমামা বলে,–কোনো ভয় নাই। আমি তো আছি। চল।
বেশ কিছুটা মাঠ দিয়ে এসে আলুর খেত। আলের এদিক ওদিকে কালো পাথর মাথা তুলে আছে। পাশেই নদী। কিছু জায়গা আবার নিচু। সেই নিচুটায়, নদীর জল ঢুকে কাদা-কাদা হয়ে আছে। জলও আছে সামান্য।
নদীর ধারে বেশ কিছু শাল মহুয়ার জঙ্গল। আদিম অরণ্যের কিছু ঘাস এখানে রয়ে গেছে। রাসুমামা বলে,—শুয়োরগুলো পাহাড় বনের দিক থেকে নামে দল বেঁধে। আমি ওই পাশে ওদের পথের ধারে থাকছি, তোরা এদিক ওদিকে গুঁড়ি মেরে পাথরের আড়ালে বসে থাকবি । কোনো শব্দ করবি না।
আমরা এক এক জন পাথরের আড়ালে বসেছি। আমার হাতে নড়বড়ে একটা বর্শা—তার ফলাটা লাঠিতে ঠিকমত বসেও নি। ওই মোক্ষম অস্ত্র দিয়ে কি হবে জানি না। হোঁৎকার হাতে একটা লাঠি।
গভীর রাত্রি। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় সব স্পষ্ট দেখা যায়। বন পাহাড়গুলো যেন রাতে ঘুমোচ্ছে। ঠান্ডাও বাড়ছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তখনও কোনো কিছুর দেখা নেই । জায়গাটা ঢালু হয়ে নদীর দিকে নেমেছে। স্তব্ধতার মাঝে নদীর কলকল শব্দ শোনা যায়। রাসুমামাও বন্দুক রেডি করে ঢালুর মাথায় বসে আছে পাথরের আড়ালে।
কতক্ষণ ঠান্ডায় বসে আছি জানি না, হঠাৎ রাসুমামার সিগন্যাল পেয়েই আমরা চেয়ে দেখি বনের দিক থেকে গোটা কয়েক বেশ নধর সাইজের শুয়োর এসে আলুর খেতে নেমে, এদিক ওদিক দেখে, এবার দাঁত দিয়ে আলুর ভেলি ফালাফালা করছে। যেন লাঙল চষছে। গাছগুলো উলটে পড়ছে, আর নরম নিটোল আলু খেয়ে চলেছে।
এত কাণ্ড ঘটছে কিন্তু বন্দুক হাতে রাসুমামা নির্বিকার। কাছেই ওই ভাবে আলু খাচ্ছে, কিন্তু গুলি ছোটাচ্ছে না। স্তব্ধ রাসুমামা।
ওদিকে হোঁৎকা বসেছিল লাঠি হাতে, আমার হাতে বল্লাম—তাও নড়বড় করছে। এসব হাতিয়ার দিয়ে ওই ভয়াল শুয়োর মারার চেষ্টা করা মানেই, নিজেদের শিকারে পরিণত করা।
পটলা কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের আড়াল থেকে বের হয়ে সন্তর্পণে চলেছে রাসুমামার দিকে। ওকে গুলি করার জন্য বলতে হবে।
পটলা দেখে, রাসুমামা বন্দুক তাক করে বসেই আছে। গুলি করার নাম নেই। পটলা রাসুমামাকে ঠেলা দিয়ে সংকেত করতে চেষ্টা করে, তাতেও সাড়া নেই। জোরে ঠেলতে রাসুমামা কাত হয়ে পড়ে, আর বেশ ভারী দেহ ঢালুর মুখে গড়াতে শুরু করে।
বন্দুক পড়ে রইল ওখানে, রাসুমামা কুমড়োর বস্তার মত গড়াচ্ছে ঢালু বেয়ে। ক্রমশ গতিবেগ বাড়ছে।
রাসুমামা ওই শুয়োরের দলকে দেখেই জ্ঞান হারিয়েছে। ওই ভাবেই পাথরের খাঁজে স্ট্যাচুর মত আটকে ছিল। পটলার ধাক্কায় মামার জ্ঞানহীন দেহটা গড়াতে গড়াতে এসে সশব্দে ওই নীচের জলকাদায় পড়ে। ছপাং করে শব্দটাও বেশ জোরেই হয়।
আমরা তো হতবাক। এদিকে ওই শব্দটা রাতের স্তব্ধতার মাঝে বেশ জোরেই শোনা যায় । সেই শব্দ শুনে বুনো শুয়োরের দলও সাবধানী হয়ে ওঠে। মাথা তুলে এদিকে চাইতে, বোধহয় আমাদের অস্তিত্বের খবর পেয়েই একেবারে মাথা নিচু করে আমাদের দিকে তেড়ে আসে।
রাসুমামা তো তখন জলাশয়ে। বন্দুক ওই পাথরের মাথায়। আমরা তখন অনাথ। হাতের ওই ডাণ্ডা-ফাণ্ডা ফেলে তখন দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়েছি।
গোবরা দৌড়ে গিয়ে নদীর ধারে একটা গাছ পেয়ে তাতেই তরতর করে উঠে পড়ে। আমি পাশেই একটা ঝোপের মধ্যে সেঁধিয়েছি। হোঁৎকা, পটলা, ফটিকদের সন্ধান জানি না। তখন অবস্থা—চাচা আপন পরাণ বাঁচা ।
গোবরার চেহারাটা বেশ ওজনদার। কুমড়োর মত নিটোল দেহ নিয়ে প্রাণভয়ে গাছে উঠেছে। একটা ডাল ধরে আরও উপরে উঠে যাবার চেষ্টা করে। আর সেই ডালে ছিল একটা মৌচাক ।
ওদিকে বুনো মৌমাছিরা অনেক গাছেই ছোট বড় সাইজের মৌচাক করে । ভালুকদের খুবই প্রিয় খাদ্য মৌচাক। মৌচাক দেখলে ভালুকও তার পিছনে থাকে। মৌমাছির কামড়ের ভয়ও আছে, তাই ভালুকগুলো কোনো জলার কাদায় আচ্ছাসে গড়াগড়ি দিয়ে, সর্বাঙ্গে পুরু করে কাদা মাখে। তাদের শক্ত বড়বড় লোমের সঙ্গে সেই পুরু কাদা পুলটিশের মত জমে যায়। মাথা গা সব জমে তখন কালো পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়, চোখ দুটো পিট পিট করে। সর্বাঙ্গে কাদার আবরণ থাকার জন্য মৌমাছির কামড় আর গায়ে বেঁধে না। সেই দেহ নিয়ে ভালুক গাছে উঠে, না হয় ডাল নাড়িয়ে, মৌচাক ভেঙে ফেলে মধু খায় ৷
ওই গাছে মৌচাকের সন্ধান পেয়ে একটা ব্যাটা গোদা ভালুক এর আগেই সর্বাঙ্গে কাদার মেক-আপ নিয়ে ওই গাছতলায় বসে মৌচাক ভাঙার প্ল্যান করছিল।
ঠিক সেই সময়েই শুয়োরের তাড়া খেয়ে গোবরা ওই গাছেই উঠেছে। আর অন্ধকারে প্রাণের দায়ে ওই মৌচাকের ডালটাই ধরেছে। মড়াক্ করে ডাল ভেঙে মৌচাক আর গোবরা দুজনেই এসে পড়ে নীচে অপেক্ষমান সেই ভালুক বাবাজির উপর।
আচমকা দেড়মণি কোনো মানুষের লাশ এর আগে কখনও ওই ভালুকের উপর পড়েনি। ভালুক আর্ত চিৎকার করে পিঠ থেকে ওই মাল ঝেড়ে ফেলে মধুর আশা ত্যাগ করে দৌড়তে থাকে।
হোঁৎকা ব্যাপারটা বোঝেনি। ধাবমান মূর্তিকে দেখে ভেবেছিল, পাথরের আড়াল থেকে কালো সোয়েটার পরা মামাই বের হয়েছে। তার মানে রাসুমামা খালি হাতেই বন্যবরাহের সঙ্গে লড়াই করতে যাচ্ছে। বিপদ হবেই। তাই হোঁৎকা ওই ধাবমান মূর্তিকে ধরে চিৎকার করে, —রাসুমামা, যাইবা না। তোমারে বুনোশুয়ারের সাথে ফাইট করতি দিমু না। ওগোরে যাতি দাও ৷
পিছন থেকে হোঁৎকা মামার ওই গোদা হাতটাই খাবলে ধরেছে। বাধা পেয়ে ভালুক বাবাজি এবার আরও ঘাবড়ে গেছে। একটু আগেই এক দুপেয়ে জীব তার ঘাড়ে চেপেছিল, কোনোরকমে তার কবলমুক্ত হয়ে দৌড়চ্ছে। আবার একজনকে ওইভাবে আটকে ধরতে দেখে ফিরে চাইল ভালুক বাবাজি ।
হোঁৎকাও চাঁদের আলোয় এবার ভালুকের লম্বা মুখ, কুতকুতে জ্বলন্ত চোখ দেখে ঘাবড়ে গেছে।
–তুমি মামা নও, আয় বাপ্ রে। ভালুক-
কে কাকে ভয় পেয়েছে জানা যায় না। হোঁৎকা মামার হাত ছেড়ে সিধে দৌড়, ভালুকও লদপদ করে দৌড়চ্ছে বনের দিকে।
বন্যবরাহ, বন্যভালুক দুপক্ষই উধাও। কিন্তু এবার ওই চাঁদনি রাতে আমাদের কত্থক কথাকলি নৃত্য শুরু হয়। বৃত্তচ্যুত মৌচাক থেকে পালে পালে ক্রুদ্ধ মৌমাছিল দল এবার পাঁচ মূর্তিকে আক্রমণ করেছে।
আমাদের চিৎকারে খামার বাড়ির দিক থেকে মুণ্ডা সর্দার, অন্যদের নিয়ে লাঠি সড়কি হাতে, হ্যারিকেন মশাল নিয়ে দৌড়ে আসে।
মশালের আগুন ও ধোঁয়ায় মৌমাছিরাও পালায় ।
এমন সময় দেখি সেই কাদামাখা ভালুকটা আবার এই দিকেই আসছে। বোধহয় এবার ওটা আমাদেরই আক্রমণ করবে।
পটলা চিৎকার করে,—ভালুকটা এবার ফিরে এসেছে, অ্যাটাক করবে—
মুণ্ডারা এসব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে জানে। ওরা টাঙি বল্লম নিয়ে তৈরি। হঠাৎ সেই মূর্তি আর্তকণ্ঠে বলে,–ভালুক নই। আমি রাসুমামা- তোদের রাসুমামা রে। রাসুমামা অজ্ঞান অবস্থাতেই জলায় গড়িয়ে পড়েছিল, এবার ওই কর্দমাক্ত দেহ নিয়ে উঠে এসেছে। শীতে ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছে। আমাদেরও মৌমাছির কামড়ে আর টেনশনে তখন কাঁপ ছটকানো অবস্থা। রাসুমামাকে দেখে হোঁৎকা গর্জে ওঠে,–এই কাণ্ড তোমার! শিকার করবা কি, বুনোশুয়োর দেখ্যাই ‘ফিট’।
খেয়াল হয়নি এতক্ষণ। এবার দেখি এইসব কাণ্ড ঘটতে ঘটতে আকাশ সামান্য ফরসা হয়ে গেছে।
রাসুমামা বন্দুক ঘাড়ে চুপ করেই ফেরে। আমরাও কমবেশি চোট পেয়েছি।
নসুমামার ভোরে মর্নিংওয়াক করা অভ্যাস। এই ক’দিন সে আমাদের ডেকে নিয়ে মর্নিংওয়াকে যেত। আজ ক্যাম্প খালি, রাসুও নেই দেখে সে চিন্তিত।
এমন সময় শোভাযাত্রা করে ওই ছত্রভঙ্গ অবস্থায় আমাদের ফিরতে দেখে, আর রাসুকে ওই কর্দমাক্ত ভালুকের মত দেখে বলে,—ই কি রে! কোথায় গেছলি? কাদা মেখে ভূত হয়ে ফিরছিস! গোবরা তোকে চিনাও যায় না, চোখ ঢেকে গেছে। হোঁৎকা তোর জামাটা ফর্দাফাই— সব শুনে নসুমামা বলে,–রেসো, তোর গুরু এই শিকার শিখিয়েছিল? অ্যা—গুরু মারেনি টিকটিকি-তার শিষ্য গুলন্দাজ!
রাসুমামা বলে,—আজ মিসটেক হয়ে গেছে। পরে দেখবি এই রাসু বোসের এলেম। আমি ঘরে বসে বাঘ মারি না তোর গুরুর মত। আমি রীতিমত অ্যাকশন করি।
গোবরা তো ফুলে ঢোল। মুণ্ডা সর্দারই বন থেকে কোনো গাছের শিকড় পাতা এনে বেটে খেতে দেয়, গায়ে মাখায়। তাতে আশ্চর্য ফল হয়।
নসুমামাও বিব্রত। বলে,—এই অকম্মার সঙ্গে রাতদুপুরে বেরিয়েছিলি! যদি বাঘ হাতির পাল্লায় পড়তিস কি সর্বনাশ যে হত! এখন বড়দা ফেরার আগে সেরেসুরে ওঠ। না হলে রেসোকেও ছাড়বে না বড়দা, আমাকেও কথা শোনাবে। আজ কমপ্লিট রেস্ট নে।
আমাদের এক রাতের শিকার দেখেই নাজেহাল অবস্থা। তাই আজকের দিনটা খেয়ে
ঘুমিয়েই কাটাই। এরপর আসল অভিযান বাকি। দু’একদিনের মধ্যেই সারান্দার জঙ্গলে যেতে হবে। হোঁৎকা বলে,—পটলা, তর ওই দুইখান মামারেই ক্যানসেল কইরা বনে যামু।
বড়মামা বনবিভাগ থেকে বনে ঢোকার অনুমতি মায় বনবাংলোও বুক করে এসেছে আমাদের জন্যে। অবশ্য আমরা কেউই বড়মামাকে সেই রাতের ওই শিকারের বিচিত্র কাহিনির কিছুই জানাইনি ।
কিন্তু বড়মামা বোধহয় ফার্মের কাজের লোকজন, যারা শেষরক্ষা করেছিল আমাদের, তাদের কাছ থেকেই জানতে পারেন ব্যাপারটা। তখন অবশ্য গোবরা অনেকটা সেরে গেছে। কিন্তু রাসুমামা ওই গোবদা সোয়েটার সমেত ঠান্ডায় জলকাদায় ঘণ্টাখানেক পড়ে থাকার জন্য জ্বরে পড়েছে।
বড়মামা বলেন,—রাসু, একটু জ্ঞান আক্কেল তোর হবে না কোনোদিন! মুরোদ নাই বন্দুক ঘাড়ে ঘুরবি, আর শিয়াল দেখেই মূর্ছা যাবি। কি কাণ্ড করেছিলি বল দেখি !
রাসু বলে,—আর হবে না দাদা। বনে গিয়ে কোনো অঘটন ঘটাবো না, বিশ্বাস করো। নসুমামা বলে,—না দাদা, ওকে বিশ্বাস নেই ।
আমরাও মুখে কিছু না বলে মনে মনে সায় দিই। ওই রাসুমামা যেন না যায়। তবু নসুমামাকে ভরসা করা যায়।
শেষ অবধি রাসুমামা ক্যানসেল হয়ে গেল। নসুমামা বলে,–রেসো শিকার করার আগে বন্দুক ধরতে শেখ, বুকে সাহস আন ।
নসুমামাই এখন আমাদের সহায়, ভরসা।
সারান্দার বনের ভিতরে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে গহন বনের মধ্যে থলকোবাদ বাংলো। সভ্যজগতের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধই নেই। বনে সেগুন, শাল, রোজউড গাছ আছে। আর আছে বাঘ, হাতি, বাইসন, হরিণ, সম্বর নানা প্রাণী।
একটা গাছের দাম লাখ টাকা, বাঘের চামড়ার দাম চোরাবাজারে কয়েক লাখ টাকা। হাতির দাঁতের এক কেজির দামই আমি শুনেছি দশ হাজার টাকা। একটা দাঁতাল হাতির দুটো দাঁতের ওজন নিদেনপক্ষে পনেরো কেজি হবে। অর্থাৎ দাঁতের দামই দেড় লাখ টাকা। এছাড়া হাতি মেরে চোরা শিকারির দল হাতির দাঁত দুটো কেটে বাকি দেহটা বনের গভীরে পুঁতে রাখে । পরে এসে ওই হাড়ের স্তূপ তুলে নিয়ে যায় বাইরে। সেই হাড়ের দামও লাখ খানেক।
এইসব কারণে ইদানীং বনের গভীরে চোরা কাঠ কাটাই-এর দল, চোরা শিকারির দল ও সক্রিয়। এরা নানাভাবে ছলে-বলে-কৌশলে বনের দামি কাঠ, বনজ প্রাণীদের অন্যায়ভাবে মেরে পাচার করে লাখ লাখ টাকা রোজগার করে।
ইদানীং সারা বনে তাদের খুবই দৌরাত্ম্য চলেছে। একটা দলের কয়েকজনকে ধরার পর পুলিশ, বনবিভাগ সতর্ক হয়ে নজর রাখছে চারদিকে।
বড়মামা বলেন,—নসু, তুই ওদের সঙ্গে যা। আর সাবধানে যাবি, কাল জিপ তোদের গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে। ওই বাংলোতেই থাকবি। চৌকিদারই রান্নার লোক দেবে। মালপত্র কিছুই মেলে না বনের মধ্যে, সব নিয়ে যাবি। বনের মধ্যে যাবি না, বাংলোর আশেপাশেই ঘুরবি।
চারদিন পর জিপ তোদের গিয়ে নিয়ে আসবে। মালপত্র সব দেখে শুনে নিয়ে যাবে। এদের
যেন কোনো অসুবিধা না হয় ।
নসুমামা এহেন দায়িত্ব পেয়ে রাসুর দিকে চাইল। রাসু তখন মাথা নিচু করে ফুঁসছে। দাদার সামনে কিছু বলতে পারে না।
নসুই বলে,—ওসব নিয়ে তুমি ভেবো না বড়দা। আমি সব জিনিসের লিস্টি বানিয়েছি। এই দ্যাখো—
বড়মামা চোখ বুলিয়ে বলেন, – এসব বড়বিল বাজার থেকে নিয়ে আয় এখনই। আর সঙ্গে কিছু সর্দিজ্বর, পেটের অসুখের ওষুধও নিবি। বনের মধ্যে ওসব মেলে না।
নসুমামা এবার মার্কেটিং শুরু করে। চারদিনের মত চাল, ডাল, নুন, তেল, মশলার প্যাকেট, আলু, পিঁয়াজ, আদা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টম্যাটো সস, মাখন, ডিম, মোমবাতি সবই নিতে হয়েছে। মায় হেরিকেনের কেরাসিন তেল, দেশলাই অবধি! এছাড়া চা বিস্কুট পাউরুটিও আছে।
সব মাল তুলে আমাদের শীতের পোশাক নিয়ে জিপে উঠছি, মামাবাবু বলেন,–নসু, বনে যাচ্ছিস, পারমিট গেট পাশ ওসব নিয়েছিস তো?
নসুমামা ওদিকে দাঁড়ানো রাসুকে দেখে নিয়ে বলে,—তুমি কি আমাকে রেসো পেয়েছ, অ্যাই দেখো।
প্যান্টের পকেট থেকে বনবিভাগের অনুমতিপত্র, বাংলোর অনুমতিপত্র সবই দেখায়। আমরা নিশ্চিন্ত হই। পটলা বলে,—নসুমামার নজর স-সব দিকেই। হুঁশিয়ার লোক। গোবরা মালপত্র দেখে বলে,—খান দুই কুমড়ো নিলে হত। কুমড়ো তিন চারদিন ফ্রেশ থাকে। খেতেও ভালো।
হোঁৎকা গর্জে ওঠে,—থাম গোবরা, কুমড়ো অযাত্রা, ওর নাম করলি তরে মার্ডার করুম। কুমড়োর ব্যবসা করে নিজেই তো একখান কুমড়ো বনছিস। চুপ মাইরা থাক ।
আমি থামাই,—যাত্রার সময় মাথা ঠান্ডা করে চল।
নসুমামা এবার আমাদের দলপতি। পরনে প্যান্ট, শার্টের উপর হাফসোয়েটার আর তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে ওই টিকটিকে দেহের উপর বসানো মস্তকটিও আবৃত করেছে একটা বারান্দাওয়ালা টুপি দিয়ে
এখানে পথে ঘাটে লাল ধুলোর পাহাড়। লোহা পাথরের খনি এলাকা। ওদিকের পাহাড়ের মাথা কামিয়ে গাছপালা শেষ করে ব্লাস্টিং করে আয়রন ওর তোলা হচ্ছে। লাল ধুলোর আধিক্য এত বেশি যে একবার বের হলে জামা কাপড় সবই লাল হয়ে যায়। মাথার চুলে সাবান দিলে লাল কাদা ফেনা হয়ে বের হয় ।
তাই পথে সাধারণ পোশাক পরেই বের হয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ওই ধুলোয় জামা দেহ সব গেরুয়া হয়ে যাবেই।
জিপটা চলেছে লোকালয় ছাড়িয়ে মোরামের রাস্তা ধরে। দুদিকে ঘন বন। বেশ খানিকটা এসে এবার বড়রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে বেঁকে ফরেস্ট রোড ধরে এগিয়ে যেতে–বনে ঢোকার গেট।
জিপ থামতে বনের রক্ষীরা এসে জিপ তন্ন তন্ন করে খোঁজে। আপত্তিকর কোনো বস্তু, কোনো অস্ত্রশস্ত্র, বন্দুক আছে কিনা দেখে তারপর সেই অনুমতিপত্রটা দেখে ভালো করে, জিপের নাম্বার-ঢোকার সময় সব খাতায় লিখে, নসুমামাকে দিয়ে সই করায়। এত কিছু করার পর গেটের কাঠটা একজন তুলে ধরতে আমরা বনরাজ্যে ঢুকলাম ।
রাস্তা বলতে এখানে পাহাড়ের বুকে মোরাম —লালধুলো ঢাকা একটা পথ। ওদিকে দেখা যায় বিস্তীর্ণ বনভূমি। বনরাজ্য রোদে ঝলমল করছে। ধাপে ধাপে পাহাড়ের গায়ে শাল, সেগুন, আবলুস, গামার—নানা গাছের অরণ্য।
গাছের ডালে জিপের শব্দ শুনে বাঁদরগুলো কিচির মিচির শুরু করে। ডানা মেলে বিশাল ময়ূর এ ডাল থেকে ও ডালে ঝটপট করে উড়ে যায়। বনে ঢুকে আমরা যেন ওদের শান্তি নষ্ট করেছি। যে কোনো মুহূর্তে হাতির পাল বেরুতে পারে। পথে দেখি হাতির লাদ। ড্রাইভার শম্ভু মুণ্ডা বলে,–থোড়া আগেই গেছে।
কোনোমতে গিয়ে পৌঁছলাম বাংলোয়। চৌকিদার তখন গড়াগড়ি খাচ্ছে। এখানে মহুয়ার ছড়াছড়ি। ওদিকে একটা আদিবাসী বস্তি। বনের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে বেশ কয়েকঘর আদিবাসী ঘরবাড়ি। এরা বনেই চাষবাস করে। অন্য কাজও করে। গরুবাছুরও আছে, মাঠে চরছে।
বাংলার চৌকিদারকে এসময় জাগানো ঠিক হবে না। তার সহকারীই আমাদের ঘর খুলে দেয়। এই গহন বনে লোকজন খুব বেশি আসে না। নসুমামাই মুণ্ডারী ভাষাতে বলে লোকটাকে। সে জিপ থেকে মালপত্তর নামিয়ে নেয়, আর দুটো ঘরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে। তারপর সে রান্নার ব্যবস্থা করতে থাকে। বেলা তখন প্রায় একটা।
জিপের ড্রাইভারকে ফিরতে হবে ওই বনের মধ্য দিয়ে। সে-ও বেলাবেলি ফিরতে চায় ৷ এখানে সূর্য অস্ত গেলে বৈকাল হয় না, চারিদিকে উঁচু পাহাড়, তার আড়ালে সূর্য ঢলে পড়লেই বৈকাল নামে। তখন বনের রূপও বদলে যায়। তাই সে বলে,—হম অব চলে নসবাবু !
নসুমামা ওদিকে তখন কাজের তদারকিতে লেগে গেছে। ওই লোকটাকে দিয়ে মাটির কুঁজোয় খাবার জল ভর্তি করিয়ে আর একজনকে দিয়ে বাঁকে করে নীচের পাহাড়ি নদী থেকে বাথরুমের জল তোলাচ্ছে।
ইতিমধ্যে খিচুড়ি চাপিয়েছে লোকটা। ওতেই ফুলকপি মটরশুঁটি আলু ফেলে দেবে। আর বললে মামলেটও করতে পারে। আজকের মেনু খিচুড়ি আর মামলেট।
বাংলোটা একটা ছোট পাহাড়ের উপর—সমতলে। সামনে সুন্দর বাগান, ফুলের গাছ। রাস্তাটা পাহাড়ের নীচে থেকে একটা ব্রিজ পার হয়ে উপরে উঠেছে। নীচে ছোট একটা নদী। ওই নদীর জলই তুলে আনা হয় বাংলোয় ।
লাল ধুলোতে সর্বাঙ্গ ভরে গেছে। নসুমামা বলে,—জল তুলে চান করতে দেরি হবে। তার চেয়ে চলো ওই নদীতে, ওখানেই চান করা যাবে আচ্ছাসে। কাপড়গুলোতেও সাবান দেওয়া যাবে।
প্রস্তাবটা ভালোই। ঝকঝকে রোদে ওই নদীতে স্নান করতে ভালোই লাগবে। আমরা সাবান, তেল, গামছা নিয়ে নেমে যাই ওই নদীতে।
নদীটা ছোট, তবে হাঁটুভর জল বইছে। পরিষ্কার জল। মাঝে মাঝে বাঁকের মাথায় একটু গভীর। তবে বড়জোর কোমর না হয় বুক সমান। পাথরও রয়েছে। ওই পাথরে বসে জামা প্যান্ট সাবান দিচ্ছে নসুমামা। আমরাও রোদে পিঠ করে সানবাথিং করছি।
হঠাৎ নসুমামা আর্তনাদ করে ওঠে,—অ্যাই রে !
কি হলো?—চাইলাম আমরা ।
নসুমামা তখন প্যান্টে সাবান দিয়ে পাথরে সেই প্যান্টকে ধোবী আছাড় দিচ্ছিল। এবার থেমে গিয়ে বলে,প্যান্টের পকেটে বনের পারমিট, বাংলোর পাশগুলো ছিল।
বের করি কাগজগুলো। একটা প্লাস্টিকের খোলে ছিল বলে সেগুলো ভিজলেও কিছু রয়েছে। নসুমামা সেই ভিজে কাগজ দুটো বের করে ওদিকে একটা পাথরের ওপর রোদে রেখে ছোট পাথরের নুড়ি চাপা দেয়।
আমরাও নিশ্চিন্ত হই—যাক্, ভিজে গেলেও নষ্ট হয়নি ওগুলো।
স্নান পর্ব চলছে। নসুমামা জামা আছড়াচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার করে পটলা ছুটে যায়। নদীর ধারে মাঠে কয়েকটা গরু চরছিল। ওদের দল থেকে একটা নধর এঁড়ে গরু নসুমামার রাখা ওই কাগজগুলো দেখে এগিয়ে এসে জিবের একটা সাপটে সেই কাগজগুলো মুখে পুরেছে। কিছুটা বাইরে দেখা যায়। নসুমামাও কেসটা দেখে এবার জামা ফেলে লাফ দিয়ে এসে এঁড়ে গরুর মুখটাকেই ধরে চিৎকার করে,—অ্যাই, খাসনে! খাসনে !
এঁড়ে গরু চোখ বুজে চিবুচ্ছিল, হঠাৎ এভাবে বাধা পেতে সে-ও মাথা নিচু করে নসুমামার সরু কোমরটা দুই শিং-এর ফাঁকে ধরে শূন্যে তুলেছে। আমরা হতবাক। নিমেষের মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে যায়। ষাঁড়ের দুই শিং-এর মধ্যে শূন্য পথে দুলছে নসুমামার পটকা শরীর। আর আর্তনাদ করছে,—অ্যাই ! অ্যাই !
ষাঁড়টা পুরো কাগজগুলো মুখগহ্বরে পুরে নিজেই যেন জঞ্জালমুক্ত হবার জন্য শিংটা জোরে নাড়ে। নসুমামার আর্তনাদ আর শোনা যায় না। নদীর জলে সশব্দে কি একটা পড়ে। তারপর সব স্তব্ধ। এঁড়ে গরুটাও এবার সেদিকে হেলে দুলে ফিরে যায়। নিজের দলে।
—নসুমামা কই?
পটলা বলে,–কো-কোথায় গেল রে মামা ?
মামা বিহনে এই বনে আমরা অনাথ। হঠাৎ ওদিক থেকে জলের মধ্যে এবার মামার মুখটা ভেসে ওঠে,–আমি এখানে !
মামা তখন জল থেকে উঠে দুশোমিটার সাঁতরে বিজয়ীর মত ক্লান্ত পরিশ্রান্ত অবস্থায় পাথরে বসে আর্তনাদ করে,–গেছিরে! কোমরটা ভেঙেই গেছে বোধ হয় ৷
কোনোরকমে ধরে তুলি মামাকে। ভাগ্যি ভালো ওই ষণ্ডমহারাজ ওকে জলে ফেলেছিল তাই এ যাত্রা বেঁচে গেছে। না হলে ডাঙায় আছড়ালে কোমরই ভাঙত।
স্নান করার পর এবার খিদেটাও চাগিয়ে ওঠে। খাবার টেবিলে বসেছি। এককালে ইংরেজ আমলে এখানে প্রভুদের আনাগোনা ছিল, তাই এখনও সাহেবিয়ানা কিছু রয়ে গেছে। আসবাবপত্র পুরোনো আমলের, বাসনপত্রও আছে।
কিন্তু খেতে বসে দেখি খিচুড়ি তো নয়, যেন জ্বলন্ত আগুন। আর চাল সেদ্ধ হয়েছে তো ডাল চেয়ে আছে। তেমনি লঙ্কা ঠেসেছে। আর ডিমের ওমলেট-এ কাঁচা লঙ্কার চাষ করেছে। তেমনি নুন ।
খিদের চোটে হাপুস নয়নে কেঁদে কেঁদে খেতে হচ্ছে।
বংশী মুণ্ডা, সেই অপূর্ব রাঁধুনির নাম। বংশী শুধোয়,—ঝাল লাগিছু?
ব্যাটা উড়িয়াভাষায় কথাও বলে তাহলে। আধখাওয়া করে উঠে পড়ি। গোবরা বলে—রাতের রান্নার সময় আমি থাকব। এত লঙ্কা দেবে না।
—ঠিক আছি।
পরে বোঝা গেল লঙ্কা এত দেবার কারণ। দেখি বংশী, আর তার বৌ বোধহয়, দু’তিনটে ছেলেকেও ডেকে এনেছে। সবাই মিলে খাচ্ছে সেই খাবার—বেশ উপভোগ করে ।
হোঁৎকা বলে,–খাতি দে। বেচারাদের ভরপেট খাবারও জোটে না রে। খুবই গরিব এরা। বৈকালে ওদিকে বস্তিতে বের হই। দেখি একটা মাটির ঘরের বারান্দায় ছেলেমেয়েরা পড়ছে, বোধহয় পাঠশালা। আর ওদিকে কিছু মহিলা শালপাতার থালা বুনছে। ওদের কুটির শিল্প। বাঁশ কিনতে পারলে বেশি কাজ করা যায়।
মাস্টারমশাই কোথায়? –নসুমামা একজন ছাত্রকে শুধোয়। ছেলেটা হাত দিয়ে আকাশের দিকে দেখায় ৷
তাহলে মরে গেছে নাকি রে?–আমি বলি।
হঠাৎ ওদিকের একটা পেয়ারাগাছের মগডাল থেকে জবাব আসে,—এই যে, হম্ ইধার হ্যায়। পেড়মে।
মাস্টারমশায়কে কোনো গাছের মগডালে কাপড় সেঁটে বিচরণ করতে দেখব—তা ভাবিনি। একটা ঝোলায় গাছের নিটোল পেয়ারা পাড়তে ব্যস্ত।
আমাদের দেখে নেমে এল তরতর করে। মুখে হাসি এনে ভাঙা হিন্দি বাংলায় বলে, —নমস্কার। কাল মনোহরপুরের হাট আছে না, ওহি বাস্তে সব আমরুদ পাঠানে হোগা। কুছ রুপেয়া মিলবে। ইস্কুলের বিদ্যার্থীলোকা কিতাব খরিদ নে হোগা ।
ক্রমশ আলাপ হল যুবকটির সঙ্গে। ওর বাড়ি রাঁচি জেলার কোন্ গ্রামে। হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে এই দূর বনের মধ্যে এসেছে।
এখানেই রয়ে গেছে এদের মধ্যে লেখাপড়ার শেখানোর কাজ নিয়ে। সামান্য সাহায্য পায়, তাতে ছেলে মেয়েদের বই শ্লেটও জোটে না। তবু সে চেষ্টা করে এই কাজ চালাতে। আর এখানকার মহিলাদের নিয়ে বনের পাতা, বাঁশ এসব দিয়ে কিছু জিনিস তৈরি করে বিক্রি করে ওদেরই দেয়।
কিন্তু টাকার অভাবে কোনো কাজ তেমন হচ্ছে না। এই গরিব অসহায় বনবাসীদের জন্য কেউ ভাবে না, কিছু করে না। সামান্য টাকা পেলে এরা অনেক কিছু করতে পারে।
হঠাৎ কথাটা শুনে পটলা বলে,—নসুমামা, সেই গার্ডসাহেবের দু’নম্বরী রোজগারে টাকাটা তো সঙ্গেই রয়েছে।
নসুমামারও মনে পড়ে। বলে,—এনেছি।
হোঁৎকা বলে ওঠে,–হেই পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তেই লাগাই দে। মাস্টার ছোকরা কাজের পোলা ।
পটলা তাকে বলে কথাটা,—আপনাদের কাজে কিছু সাহায্য করতে চাই। কিছু টাকা দেব—নেবেন ?
এর মধ্যে বস্তির বেশ কিছু লোকও জুটে গেছে। তারাও শুনছে আমাদের টাকা দেবার কথা। মাস্টার বলে,—দেবেন? তাহলে তো খুবই কাজে লাগে স্যার। বহুৎ কামমে আয়েগা। নসুমামা বলে, প্রায় হাজার তিনেক হবে।
বহুৎ মেহেরবানি স্যার।—মাস্টার, অন্যরাও খুশি।
দু’একজন লোক ওদিকে শুনছে আমাদের কথা। ওরা খুশি হয়নি তা বুঝেছি। ওদের একজন বলে,—ওহি রুপেয়া পঞ্চায়েতকো দিজিয়ে সার।
লোকটার চোখ দুটো পিটপিট করছে। শয়তানের মত চাহনি।
বলি,—পঞ্চায়েত তো অনেক সরকারি টাকা পায়। তাদেরই এই ভালো কাজে টাকা দেওয়া দরকার। তা তো দেয় না, তাহলে এদের যা দেব, তাতে আপনারা কেন ভাগ বসাবেন ? লোকটা জবাব দিল না। অন্যজন বলে,—মুখিয়াজির বাত শুনলে ভালোই হত। ঠিক আছে, আপনাদের যা মর্জি করুন। চলো মুখিয়াজি।
লোকদুটো চলে গেল। পটলা বলে,—মাস্টারজি, আপনি বাংলোয় আসুন, টাকাটা নিয়ে যাবেন।
মাস্টারমশাই বোধহয় জীবনে এতটাকা একসঙ্গে হাতে কোনোদিন পায়নি। নসুমামার ব্যাগেই ছিল টাকাগুলো। আমরাও সঠিক গুনিনি। ও পাপের টাকা ছুই-ও নি। এখন গুনে দেখা গেল প্রায় চারহাজার টাকা আছে।
টাকা পেয়ে মাস্টারজি বলে,—বড় উপকার করলেন সার। এবার বেশ কিছু মাল তৈরি করে তার লাভ থেকেই বাচ্চাদের বই শ্লেট সব দিতে পারব। বহুৎ-বহুৎ ধন্যবাদ স্যার।
নসুমামাও খুশি। বলে,-সত্যি একটা ভালো কাজই হয়েছে। ব্যাটাকে জব্দ করার জন্য রাগে ওর মাল সাফ করেছিলাম, আজ বোঝা নামিয়ে খুশি হলাম।
কিন্তু ইতিমধ্যে বস্তিতে রটে গেছে কথাটা। মুখিয়া, তার চ্যালা ভেবেছিল দমকা কিছু রোজগার হবে তাদের। ওদের সামান্য কিছু দিয়ে বাকিটা নিজেরাই পকেটস্থ করবে। কিন্তু তা না হতেই এবার তারাই খেল শুরু করে।
বিট অফিসার, ফরেস্ট গার্ডরা মুখিয়াকে চেনে জানে। কারণ বনের দামি কাঠ, মায় বেআইনি ভাবে বাঘ মেরে চামড়া, হাতির দাঁত এসব তারাই গোপনে পাচার করে। লাখ টাকার ভাগও তাদের মধ্যে ভাগ হয় ৷
মুখিয়ার দল পুলিশের কড়া নজর এড়িয়ে কাজ করে। বনের কর্তারা, পুলিশ এখন সজাগ। তাই মুখিয়াও যেন ওদের সহযোগিতাই করতে চায়—এই ভাব দেখিয়ে ওই বিট অফিসার মায় টহলদার পুলিশ পার্টিকেও বলে,—বাংলোয় কারা এসে গাঁ বস্তিতে যেচে টাকা দিচ্ছে স্যার। বিট অফিসার বলে, – বনবাংলোয় কারা এসেছে?
মুখিয়া বলে,–সে তো আপলোগ জানতা সার। ওদের হাব-ভাব আচ্ছা ঠেকল না।
পুলিশও বলে,—আমাদেরও তাই মনে হচ্ছে। না হলে যেচে কেউ বস্তির লোকদের টাকা দেয়। ঠিক কোনো বুরা কামধান্দা করে ওরা। সেদিন ভি একটা বাঘ মেরেছে কারা। চামড়াটাও পাওয়া যায়নি। গত মাসে বনে হাতি মেরে বড় বড় দুটো দাঁত কেটে লিয়ে গেছে। ই লোক কৌন হ্যায় পাতা কিজিয়ে বিটবাবু। নেহি তো কোই গড়বড় হলে আপনি ভি চক্করমে ফাঁসিয়ে যাবেন।
সন্ধ্যা নামার পর বনভূমির রূপ বদলে যায়।
চারিদিকে নামে নিথর স্তব্ধতা। তার মাঝে নদীর শব্দের সঙ্গে মেশে ঝিঁঝির একটানা ডাক। আকাশের বুকে তারাগুলো ঝকমক করে। চা খাবার পর এবার নসুমামা জমিয়ে বসে তার গুরুর বিচিত্র শিকার কাহিনি শুরু করেছে।
সেবার একটা পাগলা হাতিকে কি করে জব্দ করেছিল স্রেফ মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে, তারই কাহিনি শুনছি। হোঁৎকা নিবিষ্ট মনে চিনেবাদাম পেয়ারা চিবুচ্ছে। হঠাৎ সদলবলে কাদের আসতে দেখে মুখ তুলে চাইলাম।
জিপ থেকে নামছে কয়েকজন। জোরালো টর্চের আলো জ্বলে ওঠে। বাংলোয় জ্বলছে হ্যারিকেন। ইউনিফর্ম পরা কয়েকজন পুলিশও রয়েছে। চৌকিদারও ছুটে সেলাম করে।
হঠাৎ বিটবাবু, পুলিশদের দেখে একটু বিব্রতই বোধ করে। ফরেস্টের বিটবাবুই এখানে অফিস, বাংলোর চার্জে। সে এবার আমাদের আপাদমস্তক দেখে, নসুমামাকে শুধোয়, – কোথা থেকে আসছেন –
নসুমামা জানাতে বিট অফিসার শুধোয়, –বাংলোর পারমিট দেখান।
এবার চমকে উঠি। নসুমামা বলে, আছে। চাইবাসা থেকে এনেছি। সেটা দেখান! —ধমকে ওঠে বিট অফিসার।
নসুমামা বলে,–এই স্যার! না—ছিল-এখন নাই।
-মানে।
-এখানের একটা গরু সেটাকে খেয়ে ফেলেছে স্যার। বিশ্বাস করুন।
নসুমামার কথায় বিট অফিসার এবার ধমকে ওঠে,—ইয়ার্কি হচ্ছে? গরুতে বাংলোর পারমিট, ফরেস্টের পাশ খেয়ে ফেলেছে ?
পটলা বলার চেষ্টা করে,—স-সত্যি স্যার।
চোপ! মোটকা এক পুলিশ অফিসার গর্জে ওঠে, দিল্লাগি হোতা হ্যায়। নিকালো পাশ। কোথায় পাশ। ব্যাটা এঁড়ে গরুটা এভাবে পাশ গিলে খেয়ে আমাদের আছোলা বাঁশ দেবে তা কোনোদিনই ভাবিনি। বলি,বিশ্বাস করুন স্যার, সব ছিল ।
অ্যাই থাম।—বিট অফিসার আমাকেও থামিয়ে দেয়।
এবার পুলিশের সেই মোটা লোকটা বলে,—সার্চ করো এদের মালপত্র
মানে! আমরা কি করেছি যে এসব করবেন! – গোবরা বলে ওঠে।
দারোগা বলে,—কি করো, তা আমরা বুঝেছি। এবার সেটা তোমাদেরও বুঝিয়ে দোব। এই বনে বিনা পাশে ঠাটেবাটে ঘোরা হয়, আদিবাসীদের হাতে করে যা ইচ্ছে তা করো, বনে বনে যত বেআইনি কাজের মূলে তোমাদের মত গ্যাং-ই…
–কি বলছেন স্যার? কিছুই বুঝতে পারছি না ।
পটলার কথায় ধমকে ওঠে পুলিশের মোটকা লোকটা,—এবার বুঝিয়ে দোব।
বিট অফিসার বলে,—বাংলোর পারমিট নাই, মিথ্যা কথা বলে এখানে ঢুকেছ। এই মুহূর্তেই বের হয়ে যাও, বাংলোয় থাকা যাবে না। চৌকিদার –
যে চৌকিদার এতক্ষণ আমাদের সেবা করতে ব্যস্ত ছিল, বস্তি থেকে মুরগি কিনে এনেছে আমাদের জন্য, সেই চৌকিদার বলে,—বাহার যাইয়ে বাবু। সামান বাহার লে যাইয়ে। রুম লক্ করনে হোগা।
এবার আমাদের অবস্থা করুণ। এই গহন বন, বাঘ হাতির রাজ্যে রাতে কোথায় থাকব জানি না। ওদিকে কিচেনে তখন চারপাঁচটা মুরগির কারির খোসবু উঠছে। পেটেও খিদে। বলি, —এই শীতে বনের মধ্যে কোথায় থাকব স্যার। সব কাগজপত্র ছিল। আপনাদের কপিও এসেছে।
বনের মধ্যে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা তেমন নাই। সুতরাং ওসব ওরা পায়নি। পেলেও চেপে গেছে।
বিট অফিসার বলে,–বেআইনি ভাবে বনে ঢুকেছ, বিনা পাশে বিনা পারমিশনে বাংলো দখল করেছ।
দারোগা গর্জে ওঠে,–বেআইনি কাঠ পাচার, বন্যপ্রাণী শিকার করে দাঁত চামড়া পাচার
চক্রের লোক তোমরা।
কি বলছেন এসব?—পটলা গর্জে ওঠে। তার তোতলামি বেড়ে যায়, ক-কলকাতার নামি ফ্যামিলি আমরা, এরা সবাই ভালো ছেলে। ইনি নসুমামা, বড়জামদার মিত্র ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পার্টনার ।
পুলিশের কাছে ওসব তুচ্ছ ব্যাপার। তাই বলে,—ছোড়িয়ে ফালতু বাত। চলো থানায়—ফাটকমে ঘুসা দেগা। চলো।
বনের মধ্যে এরাই রাজা। কেবল মাত্র পাশটার জন্যই এই হাল ।
এবার বিট অফিসার আর দারোগাবাবুদের মধ্যে কি কথা হতে, দারোগাবাবু ঘোষণা করে, —আপনাদের থানায় যেতে হবে।
ম-মানে!—পটলা বলে ওঠে।
—সেটা গিয়েই বুঝবে ছোকরা। বহুৎ তড়পাতা হ্যায়। অ্যাই—উঠাও গাড়িমে সবকোইকো।
কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে নাকি বত্রিশ ঘা। টাকা খরচ করে বনভ্রমণে এসে এভাবে শীতের রাতে পুলিশের হাতে পড়ে থানায় যেতে হবে বিনা দোষে—তা ভাবিনি।
পড়ে রইল রুটি, মুরগির মাংস। ওসব বিটবাবুর চৌকিদারের সেবায় লাগবে হয়তো। আমরা খালি পেটে চলেছি থানাতে।
এর মধ্যে বস্তির লোকজনও জুটেছে। রটে গেছে পুলিশ নাকি ডাকাতের দলকে ধরেছে। ভিড়ের মধ্যে সেই মাস্টারজিকেও দেখি। সে কী বলতে এসেছিল। তার কথা কেউ শোনেনি। মুখিয়াও এসেছে। সে হাসছে। প্রতিশোধের হাসি ।
তবু নসুমামা বলে,—গুয়া থানায় গেলে কোনো ভয় নাই। বাড়িতে খবর দোব।
কিন্তু শুনি-গুয়া থানায় নয়, এটা বনের অন্যদিকে মনোহরপুর থানার এলাকা। আমাদের সেইখানেই নিয়ে যাচ্ছে এরা।
মাঝরাতে থানায় এনে ঘুমন্ত কনস্টেবলকে ডেকে তুলে দারোগাবাবু হুকুম দেয়,—ইন্ লোককো লক্আপ্মে ঘুসা দেও ।
বলার চেষ্টা করি,—স্যার, পালাব না। বাইরেই থাকতে দিন ।
—চোপ? লে যাও লক্আপ্মে।
টেনে নিয়ে গিয়ে গরাদ-এর গেট খুলে একটা প্রায়ান্ধকার হলঘরে আমাদের সবাইকে পুরে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে তালা দিয়ে চলে গেল।
লক্আপেও থাকতে হল! এর জন্য দায়ী নসুমামাই ।
এতক্ষণ দেখিনি ঘরের ভিতরটা। কটা প্রাণী এদিক ওদিক শুয়েছিল। তারা এইবার জেগে ওঠে। নসুমামার পরনে দামি সোয়েটার টুপি। হোঁৎকার গায়ে একটা উইন্ড চিটার। পটলার গায়ে গলাবন্ধ দামি সোয়েটার।
এবার ওই গজিয়ে ওঠা মূর্তিগুলো সজীব হয়ে ওঠে। মনে হয় সবকটা সিঁটকে চোর, পকেটমার। একজন লম্বা বলিষ্ঠ লোক ধরেছে নসুমামাকে,- দে বে সোয়েটারটা দে। —আমারটা নে।
একটা ছেঁড়া মলিন জামা এগিয়ে দেয়। নসুমামা বাধা দিতে লোকটা বলে,–শেষ করে দেব।
কোমর থেকে একটা ছবি বের করে। নসুমামার গেল সোয়েটার, টুপি; হোঁৎকার উইন্ড-চিটার। পটলার জামাও গেছে অন্য একজনের গায়ে। আমার পুলওভারটা বিনা বাধাতেই দিয়ে দিলাম। লোকটা শীতে আমাকে কাঁপতে দেখে তার ময়লা দুর্গন্ধময় চাদরখানা দিয়ে বলে,–লে বে ।
প্রথম দফাতেই জামাগুলো বেহাত। টাকা পয়সাও কেড়ে নিল তারা। বাধা দিতে বাইরের ঘুমন্ত পাহারাদার গর্জন করে,—হল্লা করনেসে পিটেগা সব কোই কো। নিদ্ যাও শান্তিসে। আমাদের অবস্থা এখন পথের ভিখারিদের মতই।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙে বাইরের তর্জন গর্জন শুনে। সেই মোটকা দারোগা ফিরে এসেছে।
এবার ওই ঘর থেকে বের করে সকলকে ভাঁড়ে চা আর খানদুয়েক লেড়ে বিস্কুট দিয়ে বলে,—বসে বসে সরকারি অন্ন ধ্বংস করা চলবে না। অ্যাই এদের বাগানে নিয়ে গিয়ে কাজে লাগা।
বরাতে আবার কি দুঃখ আছে কে জানে!
শীতের পোশাক নেই। সব বেহাত হয়ে গেছে। নসুমামার গায়ে ছেঁড়া চটের মত একটা জামা, হোঁৎকার গায়ে দু’সাইজ বড় একটা কাঁধ ফাটা ময়লা কোট, পটলার জুটেছে একটা জিনস্-এর জামা—বোতামও নেই। গায়ে ঢলঢল করছে বেগুন খেতের কাকতাড়ুয়ার মত। আমার গায়ে সেই বোঁটকা গন্ধওয়ালা ছেঁড়া চাদর ।
কনস্টেবল ক’জনে আমাদের দারোগাবাবুর জমিতে এনে কোদাল, ঝুড়ি দিয়ে বলে,—মাটি কেটে জমিন সমান কর।
অর্থাৎ দারোগাবাবু হাজতের লোকদের দিয়ে তার জমি তৈরি করাচ্ছে বিনাপয়সায়। শক্ত পাথুরে মাটি, তাই প্রায় তিন ফুট কেটে জমি হচ্ছে দারোগাবাবুর।
ভাবতে পারি না এই যন্ত্রণা থেকে কিভাবে মুক্তি পাব? এরপর আদালতে পেশ করা হবে। আমাদের নাকি জেলই হবে।
মনে পড়ে কলকাতার কথা। পটলা বলে, —খবরও পাঠানো যাবে না। সর্বনাশ হবে।
বনের অ্যাডভেঞ্চার মাথায় উঠেছে।
দিনরাত সব একাকার হয়ে গেছে। কি তারিখ, কি বার জানি না। জামা প্যান্ট আর পরা যায় না। ঘামে ধুলোয় বিবর্ণ। মুখ চোখ বসে গেছে। ক’টা দিন কেটেছে জানি না।
দারোগা শাসায়,জেলে গেলে বুঝবে ক্যামন মজা। এখন থেকেই শয়তানি শিখেছ । সমাজের শত্রু, দেশের শত্রু তোমরা ।
হোঁৎকা বলে,—আপনিই কি কম! যাদের ধরছেন তাদের দিই ওই জমি কাটান, ঠিকমত খাইতেও দ্যান না-
—চোপ! হম্কো আইন মৎ শিখাও। আজ তুমহারা খানা বন্ধ।
খাবার বলতে লাল চালের ভাত, জলের মত ডাল আর একটা লাবড়া জাতীয় তরকারি। খাওয়াও যায় না। তাও বন্ধ।
এবার আমরাও বলি, —- খাবার বন্ধ করতে হবে না, আমরাই খাব না। না খেয়েই থাকব। এই অন্যায় জুলুম সইব না। কি করেছি আমরা? বিনা বিচারে আটকে রেখে মজুর খাটাবেন ? দারোগা গর্জে ওঠে,–পিটিয়ে ঠান্ডা করে দেবো।
তাই মারুন। —আমরাও মরিয়া হয়ে উঠেছি।
নসুমামা বলে, – কিছুই করিনি। তবু আনলেন-
এমন সময় জিপটা এসে হাজির হয়। আমরাও দেখি বড়মামা নামছেন, সঙ্গে সেই বনের ইস্কুলের মাস্টারজি, একজন উকিলবাবু এবং একজন ভদ্রলোক।
দারোগা আমাদের বেয়াদপির জন্য এবার রুল তুলেছে, পিটিয়ে ঠান্ডা করবে। এমন সময় উক্লিবাবু বলে,—ওটা নামান দারোগাসাহেব।
তারপর আমাদের জামা কাপড়, আর আমাদের হাল দেখে উকিল বলেন,–এদের দিয়ে ওই খেতের মাটি কাটাচ্ছেন?
-না তো?
হোঁৎকা বলে, –মিথ্যাবাদী! দ্যাখেন স্যার–কোদাল চালাই হাতে ফোস্কা পড়ে গেছে। নসুমামাকে দেখে বড়মামা বলেন,–বাঃ। তুই এখানেই থাক নসু। মাটির ঝুড়ি বয়ে কাজ করার অভ্যাসটা কর। তা জামা, সোয়েটার কোথায় গেল তোদের।
আমি বলি,—লুট হয়ে গেছে সব।
দারোগাবাবু একটু ঘাবড়ে গেছে। শহরের পুরসভার চেয়ারম্যান বড়মামার বন্ধু। ওই মাস্টারজি আমাদের ওই ভাবে থানায় চালান করতে দেখে, পরদিন নিজে ওই বনপাহাড় টপকে বড়বিলে এসে বড়মামাকে খবরটা দেয় সন্ধ্যার মুখে। জানায় ফরেস্টের পাশ, বাংলোর পাশ সঙ্গে ছিল না—সেই সুযোগ নিয়েই ওই বদমাইস মুখিয়া ওদের মিথ্যা অভিযোগ করে পুলিশে দিয়েছে। মনোহরপুর থানায় নিয়ে গেছে ওদের।
পরদিন রবিবার। চাইবাসার ফরেস্ট অফিস বন্ধ। কিছু করা যায়নি। সোমবারই বড়মামা সেখানে এসে ওদের নামলেখা পারমিট, বাংলোর পারমিট সব কিছুর ডুপ্লিকেট কপি নিয়ে উকিলকে গাড়িতে তুলে বেশ দূর পথ ভেঙে এই শহরে এসেছেন।
এবার চেয়ারম্যান বলেন, – দারোগাবাবু, এঁদের বিনা দোষে ধরেছেন। দারোগা বলে,—বিনা অনুমতিতে বনে ঢুকেছে, বনবাংলোয় থেকেছে।
বড়মামা এবার কাগজপত্রগুলো দেখিয়ে বলে, — অরিজিন্যাল কাগজ ওদের হারিয়ে গেছে, এগুলো দেখুন। এতে ওদের বনে অনুমতি আছে। বাংলোর বৈধ পাশও রয়েছে।
উকিলবাবু বলেন,—এদের বিনা দোষে আটকে রেখেছেন, এই ভাবে অত্যাচার করেছেন কেন ?
দারোগাবাবু এবার ঘাবড়ে গিয়ে বলে,–বিট অফিসার বললে।
আর তুলে আনলেন? — উকিলও জেরা শুরু করে।
শেষ অবধি দারোগাবাবু আমাদের ছেড়ে দিয়ে বলে,—ওদের ছেড়েই দিচ্ছি স্যার। এ নিয়ে আর ঝামেলা করবেন না।
এবার ফিরে আসি বড়জামদায়। তখন আমাদের দেখে বড়মামিমার চোখে জল আসে। —একি হাল করেছে তোদের। এখন কলকাতার ওরা কেউ এলে কী জবাব দেব? বড়মামা বলে,—এসব ঘটেছে ওই নসুর জন্যেই। কাগজপত্র কিনা গরুকে খাইয়ে দিল। রাসুমামা এইবার তাক্ মত বলে,–ও নিজেই একটা বলদ। দ্যাখ না সব হারিয়ে কার চামচিটকে একটা জামা পরে ভূতের মত ফিরেছে।
বড়মামা আমাদের বলেন,–ক’দিন বাড়িতে রেস্ট নে। খাওয়া দাওয়া করে সুস্থ হ। তারপর কলকাতায় ফিরবি। তবে যে ক’দিন থাকবি ওই নসুরাসু দুটোর থেকেই দূরে থাকবি ।
ক’দিন মামার বাড়িতে থেকে বেশ যুৎ করে খেয়ে দেয়ে আবার নতুন তাগদ্ নিয়ে ফেরার সময় নসুমামা বলে, ওদের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি।
বড়মামা বলেন,—না। তোকে বিশ্বাস নেই। কলকাতা যাবার গাড়িতে তুলতে গিয়ে নাগপুর যাবার গাড়িতেই হয়তো তুলে দিবি। তোর এলেম জানা আছে। আমিই টাটানগর গিয়ে ওদের তুলে দেব !
সেবার নিরাপদেই ফিরেছিলাম।