দূরদেশের এক আপনজন
সারা শহর জুড়ে মানুষের আনাগোনা। কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনে প্রতিযোগীতার যেন হিরিক পড়ে গেছে। আজকের সভ্য সমাজের লোক আতিথ্যের খাতিরে ভাল মানুষ সাজার বৃথা চেষ্টায় ক্রন্দন করে না। পথের ধারে দুঃস্থ কাউকে দেখেও লজ্জিত না। বড় শহরের বড় অট্টালিকার মাঝে রয়েছে শুধু ছোট ছোট প্রাণ। সাদা মনের মানুষ যেন খুঁজে পাওয়া বড় ভাগ্যের ব্যাপার।
অনেক পথ পেরিয়েও একটু আশ্রয়ের সন্ধান পাওয়া গেল না। ভেবেছিলাম আজকের মত এখানেই থাক। আবার কাল চেষ্টা করে দেখা যাবে। না, এসে যখন গেছি নীলাচলের সান্নিধ্যে তবে আর ভাবনা কিসের? যেই ভাবনা সেই কাজ। সবুজ-শ্যামল পাহাড়ের গা ঘিয়ে রয়েছে অগনিত অট্টালিকা। দু-ধারে বহু অট্টালিকা পার হয়ে অবশেষে বহু আকাঙ্খিত আশ্রয়ের সন্ধান পেলাম। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম এ বাড়ীতে মোট তিনজন প্রাণীর বাস। দম্পতি ও তাদের একমাত্র পুত্র। ভাবলাম পড়াশুনার জন্যে এরচেয়ে ভাল বাড়ী আমার সীমিত বাজেটের মধ্যে পাওয়া বেশ কষ্টসাপেক্ষ। বাড়ীটিতে একদিকে যেমন প্রাণের ছোঁয়া আছে আবার অন্যদিকে অধ্যয়নের এক অপরূপ পরিবেশ আছে। মোটের উপর গৃহকর্তার আচরণে আমার মনে কোনরূপ বিরূপ ভাবের উদয় হয়নি। একেবারে সাধাসিধে। অত্যন্ত পরিশ্রমী আর দুচোখ ভরা রয়েছে এক অটল স্বপ্ন। গৃহকর্ত্রীও ততটাই কর্মঠ এবং অতিশয় মিশুক প্রকৃতির মানুষ যার মধ্যে মাতৃত্বের কোমল হৃদয়ের সাড়া পাওয়া যায়।
নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে খুব একটা পরিশ্রম করতে হলো না। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো ক্রমেই দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে কেটে যেতে লাগল। আবার জীবন হয়ে উঠল ব্যস্তময়। এই ব্যস্তময় কর্মজীবনের এক সকালে এক বালতি কাপড় ভিজিয়ে রেখে ছিলাম এই ভেবে যে একটু সময় করে সেগুলি ধুয়ে রেখে যাব। কিন্তু ক্লাশে যাবার ব্যস্ততায় তা আর হয়ে উঠল না। ক্লাশে রকমারি কাজের চাপে সেদিন সঠিক সময়ে বাড়ী ফেরা হলো না।
ক্লান্ত দেহে বাড়ী ফিরে এসে একটু খাওয়া দাওয়া করে সকালের সেই কাপড়গুলো ধুতে গেলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি বালতি পড়ে আছে, কাপড়গুলো নেই। কি আশ্চর্যা ! কোথায় গেল সেগুলো? কাকেই বা জিজ্ঞেস করি? এদিক সেদিকে কারো কোন সাড়া নেই। যাই ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করি। সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহে তন্দ্রার ভাব এলো। মুহূর্তেই ঘুমের ঘোরে চলে গেলাম, কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানা নেই। হঠাৎ দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ শুনা গেল। চোখ কিছুতেই খুলতে পারছি না। শুধু বুঝার চেষ্টা করছি কে যেন ডাকছে আমাকে। দরজা খুলে দেখি গৃহকর্ত্রী স্থির নয়নে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নম্রস্বরে জিজ্ঞেস করলাম, “পিসিমা, আমায় ডাকছেন?” উত্তরে পিসিমা বললেন, “হ্যা বাবা, তোমার এই কাপড়গুলো, আমি ধুয়ে শুখিয়ে রেখেছি, তোমাকে এগুলো দিতে এসেছি।”
— আপনি কেন এসব করতে গেলেন পিসিমা ?
না বাবা, মনে কিছু করো না— ভাবলাম তুমি ভুলে কাপড়গুলো রেখে গেছো। তাছাড়া তুমিও আমার ছেলের মতো। তাই…।”
আমার মুখে আর কোন ভাষা এলো না। নিরবে হাসি মুখে গৃহকর্ত্রীর এই উপকারটুকু আমার অন্তরে স্থান দিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলাম। আধুনিকতার উচ্চ আকাশে আজও যে পাথরের বুকে জল ঝরে নীলাচলের এই গৃহকর্ত্রীর মর্মবেদনার স্পর্শে একেবারেই পরিস্কার।
দিনের পর দিন কেটে যাচ্ছে— এক বসন্ত পার হয়ে ফিরে আসে আর এক নতুন বসন্ত। নীলাচলের শ্যামল বৃক্ষরাজীতে লাল হলুদের বাহার। তারই মাঝে বিরাজমান শত শত বসন্তপাথী। মনের কোকিল যেন আজ মুক্তকণ্ঠে গান গাইছে। মনে যে কি আজ বিচিত্র আনন্দের অনুভূতি। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমি অভ্যাস মত বই পড়ছি। দৃষ্টি পড়েছে পৃষ্ঠার কালো অক্ষর গুলিতে। কিন্তু মনের আঙ্গিনায় অন্যকিছুর আবির্ভাব। মন আজ বাধনছাড়া। ঠিক এমন সময় গৃহকর্তার উপস্থিতি অনুভব করতে পেলাম । রোজ এই সময়টায় গৃহকর্তা বাড়ীতে এলে গৃহিনী উনার জন্য মিষ্টি করে চা বানিয়ে সঙ্গে আরওকিছু সহযোগ করে দুজনে সারা দিনের নতুন কিছু অভিজ্ঞতার কথা আদান-প্রদান করেন। এতদিন উনাদের কথায় কোনরূপ কান দেইনি। সংসার জীবনের নানান দুঃখকষ্টের মধ্যেও মামার বাড়ীতে পাঠরত একমাত্র সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিষ্ঠা সুনিশ্চিত করা তাদের প্রধান চিন্তার বিষয়। ধীরে ধীরে গৃহস্বামীর কন্ঠস্বর পরিস্কারভাবে আমার কানে আসতে লাগল। দুজনের আলাপ যেন আরও জমে উঠল। পিসেমশাই সেই ভোরে বাড়ী থেকে রেরিয়ে যান প্রাইভেট কম্পানিতে কাজের উদ্দেশ্যে। আর যখন বাড়ীতে ফিরেন তখন সন্ধ্যা পার হয়ে আসে। কাজেই উনার দর্শন না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।
পিসেমশায় পিসিমাকে বললেন: “জান, রোজ ভোরে এই কয়েক কিলোমিটার পথ হেটে কাজে যাবার পর আমার ক্ষিধে পেয়ে যায়।” পিসিমা বললেন: “বেশ তো, তাহলে তোমার জন্যে যে টিফিন দিয়ে দেই তা খেয়ে নিও।”
–সে নিয়ে তো কোন চিন্তা নেই সুশীলা। তবে কিসের ভাবনা?
—রোজ বিকেলে অফিসের সবাই এককাপ করে চা খায়। তুমিও তো খেতে পার।
—খেতে তো পারি, কিন্তু এক কাপ চায়ের দাম দুইটি টাকা। প্রতিদিন দুইটি করে টাকা চলে গেলে ত্রিশদিনে ষাট টাকা চলে যাবে। আর এই ষাট টাকা বাঁচাতে পারলে আমাদের সংসারের সাতদিনের খরচ চলে যায়।
তারপর হঠাৎ দুজনের মধ্যে এক বিরাট নিঃস্তব্ধতা দেখা দিল। তাদের কথা শুনে আমি অতিশয় স্তব্ধ হয়ে রইলাম। আমার কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারলাম না। শুধু ভাবে বিভোর হয়ে রইলাম। দুটি টাকার এক কাপ চা চুমুক দিলেই যে মাস শেষে ষাটটি টাকা চলে যেতে পারে তা তো কখনও এমন করে ভেবে দেখিনি। মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজের পড়াশুনার জন্য একাউন্টে যে কয়েক হাজার টাকা বাবা পাঠিয়ে দেন, তা দেখে কখনও তো আমার মনে হয়নি “ষাটটি টাকা দিয়ে আমার এক সপ্তাহের খরচ চলে যাবে।” রেস্টুরেন্ট-এ বন্ধুদের নিয়ে জমিয়ে কত আড্ডা দিয়েছি, প্রিয় বান্ধবীকে তার জন্মদিনে গ্রিটিংস কার্ডটির উপরে সেই দুর্লভ প্রজাতির লাল গোলাপটি উপহার দিতে গিয়ে যখন কয়েক শত টাকা বেরিয়ে যেত তখন তো কখনও এভাবে ভেবে দেখিনি “ষাট টাকা দিয়ে এক সপ্তাহের সংসার খরচ চলে যেতে পারে।” শুধু বুঝতে শিখলাম পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ এক অতীব পণ্য কর্মের ফল।
সেদিনের অতি ক্ষুদ্র অথচ প্রখর মুহূর্তটি আজও মনের কোণে উকি মারে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পিছনে সেদিনের অনুপ্রেরণা আজও নির্মল ও পবিত্র হয়ে আছে। তাই কয়েক বছর পর আজ এক বিশেষ মুহূর্তে এই নীলাচলের সেই আশ্রয়টির কথা ভুলতে কি পারি ! দুচোখ সেই কুটিরের দিকে ধাবিত হল। কিন্তু একি অদ্ভুদ কাণ্ড! কুটিরটির জায়গায় এক অতিসুন্দর অট্টালিকা স্থান পেয়েছে। সম্মুখে গিয়ে দরজার নিকটে দাঁড়াতেই নেমপ্লেট-এ দেখতে পেলাম পিসেমশাই-এর নাম “শ্রীযুক্ত সত্যব্রত রায়”। তৎক্ষনাৎ কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে বের হয়ে এলেন, সেই মানবদরদী পিসিমা। পিসিমাকে প্রণাম করে ঘরে গিয়ে বসলাম। তারপর পিসিমা নিজের হাতে এক কাপ চা করে আমার জন্য নিয়ে এলেন। আর চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই বুঝলাম পিসেমশাইকে এটার জন্য রোজ রোজ দুটি করে টাকা খরচ করতে হয় না !