দীপ জ্বেলে যাই
মেন্টাল অবজারভেটরি। ছবির মত ঝকঝক করছে বাড়িটা। সামনে-পিছনে বাগান। দুদিকের রাস্তাগুলো যেন কালো বার্ণিশ করা। ভিতরে জনা চল্লিশেক রোগী। রোগী বলা ঠিক হবে না। রোগিণীও আছে চৌদ্দ-পনের জন। আলাদা আলাদা ঘর। মক্তি বিকৃতির কারণ সকলের এক নয়। চিকিৎসা ব্যবস্থাও বিভিন্ন। ..
অদূরে নার্স কোয়াটার্স। বাঙ্গালী আর ফিরিঙ্গী মেয়ের জগা-খিচুড়ি। একে অপরের ইয়ারকি-ফাজলামোগুলো মক্স করে। দিশি মেয়ে মেম-সাহেবের বাংলা নকল করে মুখ ভেঙায়। মেমসাহেব দিশি মেয়ের পিঠে কিল বসিয়ে ছুটে পালায়। শিথিল অবকাশটুকু হাসি-ঠাট্টায় ভরাট থাকে।
তবু এরই মধ্যে একজনকে যেন সমীহ করে চলে ওরা। বাইরে নয়, মনে মনে। ঈর্ষা বলা যেত, কিন্তু সে কথা ভাবতে নিজেরাই লজ্জা পাবে। রেখা মিত্র, সিষ্টার ইনচার্জ। কর্তামো করে এ অপবাদ তার শত্রুও দেবে না। আগের বুড়ি ইনচার্জ যা। ছিল, বাবা। নাকের জলে চোখের জলে এক করে ছাড়ত। এ বরং ভালো, দরকার হলে উল্টে তড়পে আসা যায়। তাছাড়া ছিল তো ওদেরই একজন, এখন না হয় মাথার ওপর উঠে বসেছে। চ্যারিটি মিশনের মেয়ে না হলে এতদিনে বাড়ি-গাড়িওয়ালা ঘরে বরে ভরে যেত কোন কালে এ সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। সারা দেহে রূপ আর স্বাস্থ্য যেন একসঙ্গে মাথা খুঁড়ছে। কিন্তু এ নিয়েও কটাক্ষ করে না কেউ। কারণ নিজেই সে নিজেকে আগলে রাখতে ব্যস্ত। প্রাচুর্যের আভাসটুকু অবশ্য ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।
হাসপাতালের বড়কর্তা মনস্তাত্ত্বিক কর্ণেল পাকড়াশী। নামের মত মানুষটিও গুরুগম্ভীর। কাছে এলেই বুকের ভেতরটা গুরগুর করে ওঠে। নার্স, এ্যাসিসট্যান্ট সকলেরই। তারই দুদুটো উদ্ভট এক্সপেরিমেন্ট সফল করেছে রেখা মিত্র। নির্দেশ মত। নিখুঁত অভিনয় করেছে। এতটুকু ভুল হয়নি, এতটুকু ত্রুটি ঘটেনি। এক বছরের মধ্যে পর পর দুজন মৃত্যুপথযাত্রী বিকৃত-মস্তিষ্ক মানুষ সুস্থ নিরাময় হয়ে ঘরে ফিরে গেল। কর্ণেল পাকড়াশী লিপিবদ্ধ করছেন তাঁর গবেষণার ইতিবৃত্ত। হয়ত রেখা মিত্ররও নাম থাকবে তাতে। কিন্তু ইতিমধ্যে তৃতীয় রোগীর আবির্ভাব ঘটল। একই রোগ, একই কারণে মস্তিষ্ক-বিকৃতি। কর্ণেলর আগ্রহ বাড়ে। রেখা মিত্রর ডাক পড়ে তৃতীয় বারও। প্রথম সফলতার পরে সহকর্মিণীদের মনে হয়েছে মেয়েটা যেন বদলেছে একটু। দ্বিতীয় বারের পরিবর্তন আরো সুস্পষ্ট। কথা বলা কমিয়েছে। অকারণ হাসিখুশীটুকুও। চলনে বলনে কেমন যেন একটু বিচ্ছিন্নতা। ফিরিঙ্গি মেয়েরা সকৌতুকে নিরীক্ষণ করে তাকে। স্বজাতীয়দের মধ্যে চাপা অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করে ফেলে কেউ কেউ, যশস্বিনী হয়ে পড়েছেন, প্রশংসায় পঞ্চমুখ সকলে, মাটিতে পা পড়বে কেন!
কর্তব্যবোধে আর একজন হয়ত থামাতে চেষ্টা করে তাকে, এই, শুনলে দেবেখন।
-শুনুক, কর্ণেলের পকেট-ঘড়ি হয়ে থাকলে অমন বরাত সকলেরই খুলত।
-যাঃ, মেয়ের মত মানুষ করেছে, কি আবোল-তাবোল বকিস? বিরক্তি প্রকাশ করেছিল নার্স মহলের দ্বিতীয় তারকা বীণা সরকার। শিক্ষা এবং রুচিজ্ঞান আছে। বুড়ি সিস্টার-ইন-চার্জের পর সেই হতে পারত সর্বেসর্বা। কিন্তু দুবছর আগে কোথা থেকে হুট করে বদলি হয়ে এলেন কর্ণেল, সঙ্গে এল রেখা মিত্র। তার দিন গেল।
এরই মুখ থেকে প্রতিবাদ শুনে পূর্বোক্ত শুশ্ৰষাকারিণী চুপসে গেল যেন। প্রসঙ্গ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিল, সেকথা কে বলেছে, আমি বলছিলাম অমন জয়ঢাক বাজাবারও কোন মানে হয় না। আসলে পুরুষগুলিই সব ভেড়া-মার্কা, রূপসীর মুখে দুটো নকল ভালবাসার কথা শুনেই গলে জল হয়ে গেল। পাগল না হাতী।
কিন্তু এও যে রাগের কথা সকলেই উপলব্ধি করতে পারে। দ্বিতীয় রোগীটির ভার কর্ণেল প্রথমে বীণা সরকারকেই দিয়েছিলেন। রেখা মিত্রর মতই সুনাম অর্জনের আশায় প্রাণপণ চেষ্টা করেছে কর্ণেলের নির্দেশ কলের মত মেনে চলতে। অভিনয়ে এতটুকু ফাঁক বা ফাঁকি ছিল না তারও। তবু পারল না। তাকে সরিয়ে কর্ণেল রেখাকে নিয়ে এলেন আবার। এখনো ভেবে পায় না, সেই মুমূর্ষ উন্মাদকেও সে কি করে ছমাসের মধ্যে একটু একটু করে সম্পূর্ণ নীরোগ করে তুলল।
দুর্নিবার কৌতূহলে ঠাট্টার ছলেই সে রেখাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কি করে কি করলি রে?
নিজের ঘরের চৌকাঠের কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল রেখা মিত্র। প্রশ্ন শুনে তার চোখে চোখ রেখে নীরবে চেয়েছিল কিছুক্ষণ। পরে তেমনি হালকা জবাবই দিয়েছে, গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, ভালবাসি প্রিয়তম, আগের সব কথা ভোলো–
বীণা হেসে ফেলেছিল।–ভুলল?
শব্দ করে হেসে উঠেছিল রেখা মিত্রও।ভুললই তো।
বীণার মনে হয়েছে, ইচ্ছে করেই সে তার প্রশ্ন এড়িয়ে গেল, যশের ডালি ভবিষ্যতেও আর কাউকে ভাগ করে দিতে রাজি নয় বোধ হয়। ভু কুঁচকে বলল, তা এমন অভিনয় করিস যদি থিয়েটার বায়স্কোপে ঢুকে পড় গে যা না, হাসপাতালে পচে মরছিস কেন?
–পারি। হলিউড থেকে ডেকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি গেলে তোর ছোট ডাক্তার হার্ট ফেল করবে, সেজন্যেই যেতে পারছি না।
হাসতে হাসতে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। বীণা সরকার স্তব্ধ। …ছোট ডাক্তার নিখিল গুহ। রেখা মিত্র না এলে এতদিনে সত্যিই একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারত। সে জ্বালা আছেই। কিন্তু তবু রাগতে পারেনি। কারণ, আজ পর্যন্ত ছোট ডাক্তার এই মেয়েটির কাছ থেকে শুধু নীরস অবহেলা ছাড়া আর কিছু পায়নি। কর্ণেলের হাতের মেয়ে না হলে এতদিন এখানে আর চাকরী করতে হত না ওকে।
কিন্তু পুরানো কথা থাক। তিন নম্বর রোগী এসেছে। তৃতীয় বার ডাক পড়েছে। রেখা মিত্রর। নার্স কোয়ার্টারের আবহাওয়া চঞ্চল। কর্ণেলের তলব শুনলে পড়িমরি করে ছুটে যাওয়াই রীতি। কিন্তু ওর ঘরের দরজা বন্ধ এখনো। করছে কী? ঘুমুচ্ছে? না সাজছে?
কিন্তু রেখা মিত্র কিছুই করছে না। শিথিল আলস্যে স্রেফ শুয়ে আছে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে। বুকের ওপরের বইখানা দেখলেও সহকর্মিণীরা হাঁ করে ফেলত হয়ত। বিবেকানন্দের কর্মযোগ। তুলে নিল। উল্টে-পাল্টে দেখল একবার। হঠাৎ ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। ঘরের কোণে আলনার নীচে গিয়ে আশ্রয় নিল সেটা। উঠে বসল পা ঝুলিয়ে। পরনের বেশ-বাসের দিকে তাকালো একবার। চলে যাবে। ঠোঁটের কোণে হাসির আভাস। চোখের সামনে ভাসছে দুটি মুখ। সমরেশ চক্রবর্তী আর মাধব সোম। সুপুরুষ দুজনেই। কিন্তু পাগল হলে কি বীভৎসই না হয় মানুষ। প্রাণের জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে বলে গেছে। রেখা মিত্র নিজের মনেই হেসে উঠল।…তা থাকবে হয়ত।
আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল। একটু প্রসাধন দরকার। বুড়ো কর্ণেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে আবার। চোখ নয় ত, যেন দুখানা এক্স-রের কাঁচ। কিন্তু আয়নার দিকে চেয়ে চেয়ে আত্মবিস্মৃত তন্ময়তা নেমে এলো কেমন। চেয়েই আছে। দেখছে। কিন্তু কে দেখছে কাকে? কে রেখা মিত্র? ওই শুভশ্রী নারীমূর্তি? কি আছে ওতে।…রক্ত, মাংস, নীল নীল কতগুলো শিরা-উপশিরা। গা ঘিন ঘিন করে উঠল। তারপর?…শুকনো, কঠিন, কুৎসিত কঙ্কাল একটা। শিউরে উঠল আবারও। তাহলে কে দেখছে? আর বাকি থাকল কী?
দরজার গায়ে শব্দ হল ঠক ঠক করে। বিষম চমকে উঠল সে। আবার বেয়ারা পাঠিয়েছে নিশ্চয়। দরজা না খুলেই জবাব দিল, বলো গিয়ে এক্ষুনি যাচ্ছি। বুড়ো দেবে দফা সেরে। চটপট এপ্রোন পরে নিয়ে হুডটা মাথায় চড়ালো। জুতো বদলাতে গিয়ে আলনার নীচে কর্মযোগের দুর্দশা দেখে জিভ কাটল তিন আঙুল। তুলে নিয়ে ঝেড়ে-ঝুড়ে একবার কপালে চুঁইয়ে ড্রয়ারে রেখে দিল বইখানা।
নাকের ডগা থেকে চশমা কপালে তুলে দিলেন কর্ণেল।-বোসো। পেশেন্ট দেখেছ?
রেখা ঘাড় নাড়ল, দেখিনি।
–হাউ এ্যাবসার্ড। –এ থার্ড কনসিকিউটিভ সাকসেস উইল মেক ইউ এ ফিনিসড় এ্যাকট্রেস মাই ডিয়ার। হেসে কাজের কথায় এলেন, সেই কেস, সেইম ট্রিটমেন্ট। কিন্তু একটু গণ্ডগোল আছে।…নাটক নভেল কি সব লিখত টিকত। ইউ শুড বি মোর এলার্ট, এমনিতেই আধ পাগল এসব লোক। টাইপ-করা কেস-হিস্ট্রি বাড়িয়ে দিলেন তার দিকে, দেখো।
কাগজগুলো নিয়ে রেখা চোখ বুলোতে লাগল। এক অক্ষরও পড়ল না। কারণ, এবারে আর রোগী ভালো হবে না সে জানে। আর কিই বা হবে পড়ে! নিঃস্ব, রিক্ত, সর্বগ্রাসী শূন্যতার মাশুল দিচ্ছে সেই ইতিহাসই তো! তাকে নতুন করে রোগে ফেলতে হবে আবার। ভালবাসার রোগ। যে নারীর অমোঘ স্মৃতি মানুষটাকে দেউলে করেছে, বিকল করেছে, তার মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেলতে হবে। কিছুদিনের জন্য তার মানসপটে অধিষ্ঠাত্রিণী হবে রেখা মিত্র। এটুকুই চিকিৎসা। তারপর এই নতুন রোগ আর কাঁচা মোহ ছাড়াবার কলাকৌশল ভালই জানেন মনোবিজ্ঞানী কর্ণেল। ছদ্ম-গাম্ভীর্যের আড়ালে রেখা হাসছে মনে মনে। বুড়োর সকল আশায় ছাই পড়বে এবার।
কিন্তু রেখা মিত্রর সঙ্কল্পে ছেদ পড়ল বোধ করি প্রথম দিনই। দোতলায় কোণের দিকে ঘর। কান পেতেও কোন সাড়াশব্দ পেল না। দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল। স্প্রীং-বসানো দরজা আপনি আবজে যায় আবার।
বাহুতে চোখ ঢেকে শুয়ে আছে লোকটি। আধ ময়লা, রোগা মুখে এক-আধটা বসন্তের দাগ। সুশ্রী বলা চলে না কোন রকমে। পায়ের শব্দে চোখের ওপর থেকে হাত সরালো সে। হাসল একটু, নমস্কার, বেশ ভালই আছি আমি।
আগের দুজন রোগীর কাছে যাওয়াটাও নিরাপদ ছিল না প্রথম প্রথম। চোখে চোখ রেখে রেখা দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। সে আবার বলল, আপনাদের এই জায়গাটা, ভালো, বেশ নিরিবিলি, কোন অসুবিধে হচ্ছে না আমার। চোখের ওপর হাত নেমে এলো, আচ্ছা, দরকার হলে খবর দেবখন।
রেখা এগিয়ে এসে রোগীর চার্ট দেখে নিল, ঠিক ঘরে এসেছে কি না। অমর। দত্ত…। ঠিকই আছে। রকিং চেয়ারটায় এসে বসল। আধ ঘণ্টা কেটে গেল, টু-শব্দটি নেই। স্থাণুর মত পড়ে আছে মানুষটা। তারপর এক সময় হাত সরে গেল আবার। সবিস্ময়ে তাকালো সে, কি আশ্চর্য। সেই থেকে বসে আছেন আপনি? মিথ্যে কষ্ট করছেন কেন, দরকার হলেই আমি ডাকবখন, আপনি যান।
বিস্মিত রেখাও কম হয়নি।–আপনি ভাবচেন কী?
অস্ফুট শব্দ করে হেসে উঠল সে।একটা লাইন কিছুতে মনে করতে পারছি। নে সেই থেকে। সব দিতে সব নিতে যে বাড়াল কমণ্ডলু দ্যুলোকে ভুলোকে…তার। পর ভুলে গেছি। রবি ঠাকুর চুরি করেছে।…চুরি ঠিক নয়, আগে ভাগেই লিখে বসে। আছে। নইলে আমি লিখতুম। কিন্তু তার পরের কথাগুলো…
নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল রেখা মিত্র। হিরনেত্রে চেয়ে রইল।
–আপনার জানা আছে? নেই, না? সুলেখা কিন্তু ফস করে বলে দিত।
নামটা বলার সঙ্গে সঙ্গে যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে চমকে উঠল নিজেই। বিহ্বল, বিমূঢ়। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। কঠোর কঠিন কতগুলো রেখা সুস্পষ্ট হল সারা মুখে। চোখের দৃষ্টি গেল বদলে। দুই চোখে আগুনের হল্কা। ঝুঁকে এলো সামনের দিকে।
–আপনি, আপনিও তো মেয়েছেলে?
রেখা চেয়ার ছেড়ে এক পা অগ্রসর হতেই সে গর্জে উঠল আবার।–দাঁড়ান। ওখানে। আমি জানতে চাই আপনি মেয়েছেলে কি না?
রেখা ঘাড় নাড়ল, মেয়েছেলেই বটে।
–যান আমার সুমুখ থেকে। আর কখনো আসবেন না। মেয়েদের আমি আর দেখতে চাই নে কোন কালে। কোন দিন না। এত বড় অভিশাপ আর নেই। দাঁড়িয়ে আছেন কি? যাবেন না? যান, যান, বলছি!
চোখে পলক পড়ে না রেখা মিত্রর। অদ্ভুত রূপান্তরটা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে। ঠক ঠক করে কাঁপছে মানুষটা। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে।
দরজা খুলে রেখা বাইরে এসে দাঁড়াল। অমর দত্ত বিড় বিড় করে বকে চলেছে। তখনো। উত্তেজনা বাড়ছেই। একটা ইনজেকশান নিয়ে রেখা আবার ভিতরে এলো। কনুইয়ে ভর করে অমর দত্ত আধা-আধি উঠে বসল প্রায়।আবার এসেছ? সুলেখা পাঠিয়েছে, কেমন? তোমাদের ভয়-ডর নেই? আমার কলমের ডগায় কত বিষ জানো?
-জানি, শুয়ে পড়ুন।
–ফাস্ট, ইউ গেট আউট।
ইনজেকশান আর আরকের তুলোটা এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে করে রেখা। তার কাঁধে আচমকা ধাক্কা দিয়ে শুইয়ে দিল। এরকম একটা সবল নিষ্ঠুরতার জন্য রোগীও প্রস্তুত ছিল না। হকচকিয়ে গেল কেমন। ততক্ষণে তার সামনের বাহু উঠে এসেছে ওর শক্ত হাতের মুঠোয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ইনজেকশান শেষ।
…পাঁচ মিনিটও গেল না। চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে রোগীর। তবু যতক্ষণ পারল চোখ টান করে সে দেখতে চেষ্টা করল এই নির্মম শুশ্ৰষাকারিণীকে।
ইনজেকশান রেখে নীরবে অপেক্ষা করছিল রেখা। সে ঘুমিয়ে পড়তে কাছে। এসে দাঁড়াল। বিছানাটা অবিন্যস্ত হয়ে আছে। টান করে দিল। চুলগুলো কপালের ওপর দিয়ে চোখে এসে পড়েছে। সরিয়ে দিল। গায়ের চাদরটা টেনে দিল বুক পর্যন্ত। নিঃশব্দে চেয়ে রইল তার পর। ঘুমন্ত মুখেও বহু দিনের একটা ক্লিষ্ট যাতনা সুপরিস্ফুট যেন। লোকটা ভালো কি মন্দ সে কথা এক বারও মনে আসছে না তো! তাদেরই এক জনের জন্য এই মানুষের সকল বৃত্তি হারাতে বসেছে। হঠাৎ মনস্তাত্ত্বিক কর্ণেলের ওপর ক্ষেপে আগুন হয়ে গেল রেখা মিত্র। তার সকৌতুক কণ্ঠস্বর যেন গলানো সীসে ঢেলে দিতে লাগল কানে, এ থার্ড কনসিকিউটিভ সাকসেস…।
এর পরের দুতিন মাসের চিকিৎসা-পর্বে নতুন করে বর্ণনার কিছু নেই। এক নারীর স্মৃতি মনে এলেই অমর দত্ত চিৎকার-চেঁচামেচি করে ওঠে তেমনি, নিঃস্ব হিম শীতল জীবনের হাহাকারে জলে-পুড়ে খাক হয়ে যায়। রেখা কখনো ঘর ছেড়ে চলে যায় তার কথা মত, কখনো বা উল্টে ধমকে ওঠে সুষ্ঠু অভিনেত্রীর মত, কখনো বা প্রণয়িনীর আকুলতায় কাছে এসে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। শেষের দিকে একটু পরিবর্তন যেন উপলব্ধি করতে পারে। তর্জন-গর্জন তেমনি আছে, কিন্তু বেশিক্ষণ সে অনুপস্থিত থাকলে অসহিষ্ণুত্তাও বাড়ে।
-এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?
–বাইরে।
–কেন?
–আপনিই তো ঘর থেকে বার করে দিলেন।
–আপনি গেলেন কেন?
রেখা হেসে ফেলে, আচ্ছা, আর যাব না। কিন্তু আবারও তাকে যেতে হয়, আবারও আসতে হয়। তবু রেখা বোঝে, দিন বদলাবে। অনেক বদলাবে। কিন্তু বলে না কাউকে কিছু। কর্ণেলের নীরব প্রশ্ন এড়িয়ে যায়। সহকর্মিণীদের কৌতূহলও জানবার। বিশেষ করে বীণা সরকার ছাড়বার পাত্রী নয়।
–নতুন নাগরটি কেমন?
–ভালো।
–তবু, নমুনাটা শুনিই না একটু?
–মর্কটের মত।
–আঁচড়ে কামড়ে দেয়?
–দেয়নি, দিতে পারে।
বীণা সরকার হেসে ওঠে, কিছুতে পোষ মানছে না বল?
হেসে টিপ্পনী কাটে রেখা মিত্রও, ছোট ডাক্তারকে নিয়ে পড় গে না, আমাকে নিয়ে কেন।
অমর দত্ত ভালো হবে। এবারও এই বিধিলিপি। আরও মাস দুই পরের সেই বিশেষ মুহূর্তটির অপেক্ষা শুধু। রেখা রকিং চেয়ারে বসে হাসছে মৃদু মৃদু। অল্প অল্প দুলছে চেয়ারটা। অমর দত্ত নির্নিমেষ নেত্রে তার দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখছে।
রেখা উঠে গায়ের এপ্রোনটা খুলে চেয়ারের কাঁধে রাখল। মাথার হুডটাও। খোঁপার আধখানা পিঠের ওপর ভেঙ্গে পড়ল। বসল আবার। রকিং চেয়ার সজোরে দুলে উঠল।
-কি হল?
–গরম লাগছিল।
–হাসছেন যে?
–এমনি।
–এমনি কেউ হাসে?
–তাহলে আপনাকে দেখে।
–আমি তো কুৎসিত দেখতে।
–ছিলেন, এখন মোটামুটি মন্দ নয়।
অমর দত্তও হাসতে লাগল। একটু বাদে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, আপনি। আমার জন্য এতটা করেন কেন?
-কতটা করি?
–বলুন না শুনি?
-আপনি একজন এত বড় লেখক, আপনার জন্য করব না তো কার জন্য করব! কত লোক কত কিছু আশা করে আপনার কাছে।
হঠাৎ যেন একটা ঝাঁকুনি খেল অমর দত্ত। সমস্ত রক্ত যেন উবে গেল মুখ থেকে। নিঃসাড়, পাণ্ডুবর্ণ। আর্তকণ্ঠে বলে উঠল, এ তো সুলেখার কথা! সুলেখা বলত। আমার মত লেখক নেই, আমার জন্য সব পারা যায়, সব করা যায়। এর পর তারই মত বলে বেড়াবেন তো, আমি গরীব, খেতে-পরতে পাই নে ভালো করে, মুখে বসন্তের দাগ, পাগল-ছাগলের মত লিখি যা মনে আসে, দুরাশা দেখে হাসি পায়–বলবেন? বলবেন তো?
স্থির, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল রেখা। উঠে কাছে এলো।–সুলেখা এসব বলেছে?
-হা বলেছে, সর্বত্র বলেছে, হেসে আটখানা হয়ে বলেছে। আপনিও বলবেন, হাত বাড়ালেই বলবেন। আবার সে কাঁপতে সুরু করেছে, মুখে দুঃসহ যাতনার চিহ্ন।
কণ্ঠস্বর কান্নার মত শোনায় এবার।–আমি তো কোন অপরাধ করিনি। বুকের ভেতরটা জ্বলে-পুড়ে যেতে দেখলে আপনাদের এত আনন্দ হয় কেন? ভয়াবহ নিঃসঙ্গতায় হাড়-পাঁজর শুদু যখন ভেঙ্গে দুমড়ে একাকার হয়ে যায়, সে যাতনা বোঝেন? আকণ্ঠ পিপাসায় যখন…
আর কথা বেরুল না। বাহুতে মুখ ঢেকে ফেলল সে। রেখা আস্তে আস্তে হাতখানি সরিয়ে দিল আবার। এক পা মাটিতে রেখে শয্যায় ঠেস দিয়ে বসেছে। শুভ্র, নিটোল দুই হাতে মুখখানা ঘুরিয়ে দিল নিজের দিকে ঝুঁকে এলো আরো কাছে।
দু-চার মুহূর্তের নিঃশব্দ দৃষ্টি বিনিময়।
অমর দত্তর ঠোঁট দুটো আর একবার থর-থর করে কেঁপে উঠল শেষ বারের মত। তার পর এক বিস্মৃতিদায়িনী, স্পর্শের মধ্যে নিবিড় করে আশ্রয় পেল তারা। এত কালের হাড় কাঁপানো হিমশীতল অনুভূতিটা যেন নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে। উষ্ণ। …নরম।…তন্দ্রার মত।…ঘুমের মত।…ঘুমিয়েই পড়ল।
পরের কটা দিনের তুচ্ছতা বাদ দেওয়া যাক। নির্দেশ মত তাকে নিয়ে বাইরে। বেড়ানো, সিনেমা দেখা, থিয়েটার দেখা।
রেখা তাগিদ দিল কর্ণেলকে, এর পরে মুশকিলে পড়ব, তাড়ান শীগগির।
কর্ণেল হাসেন, ইউ প্রেটি উইচ।
রেখা প্রতিবাদ করে, ফিনিল্ড এ্যাকট্রেস।
এর পর কদিন ধরে কর্ণেলের ঘরে বসে নিজের রোগজীর্ণ প্রতিচ্ছবিটি দেখেছে অমর দত্ত। বৈজ্ঞানিক রেকর্ডে নিজেরই দুই একটা পাগলামীর নমুনা শুনে শিউরে উঠেছে। আগের দুজন রোগীকে কি করে ভালো করেছে রেখা মিত্র তাও শুনল। সব শেষে, একই উপায়ে নিজের আরোগ্য লাভের ইতিবৃত্ত। নিপুণ মনোবিজ্ঞানীর পরামর্শ এবং সারগর্ভ উপদেশ শিরোধার্য করে গৃহপ্রত্যাবর্তনের উদ্যোগ করল যখন, তখন মনটাই শুধু ভারাক্রান্ত হয়ে আছে ক্লান্তিকর বোঝার মত। এ ছাড়া আর কোন উপসর্গ নেই।
রেখার প্রতীক্ষা করছিল। সে এলো।
–যাবার সময় হলো, এই জন্যেই ডেকেছিলাম।…আপনাকে চিরকাল মনে থাকবে আমার।
সমরেশ চক্রবর্তী বলেছিল। মাধব সোমও বলেছিল। রেখা হাসল।–সেটা কি খুব ভালো কথা হবে?
দুই-একটা মৌন মুহূর্ত। অমর দত্ত হাত তুলে নমস্কার জানালো, আচ্ছা, চলি।
হাত তুলে প্রতি নমস্কার করল, রেখাও, হ্যাঁ, আসুন।
অমর দত্তর কাহিনী শেষ হয়েছে। কিন্তু এ কাহিনী অমর দত্তর নয়। রেখা মিত্রর। অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছে বীণা সরকার, রেখা মিত্রর রোগী ভালো করবার রহস্যটুকু কি! অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছেন মনোবিজ্ঞানী কর্ণেল পাকড়াশী, কোন নির্দেশই তার মেনে চলেনি রেখা মিত্র। অনেক, অনেক দেরীতে জেনেছে বাকি সকলে, রেখা মিত্র রোগী ভাল করেছে, ফাঁকি দিয়ে নয়, ভালবাসার অভিনয় করে নয়, সত্যিকারের ভালবেসে। পর-পর তিন জনকেই।
হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা আর একজন বেড়েছে। রোগী নয়, রোগিণী। সে রেখা মিত্র।