দনুজ-দলনী দেবী দুর্গা ও রক্ত-রসনা রৌদ্রমুখী (পুরাণ কথা,বিজ্ঞান ও বেদ)
স্মৃতিকথা পুরাণ শাস্ত্র বর্তমানে ভয়ঙ্কর ভাবে হিন্দুত্বের দাবী রাখে,অবশ্যই কিছু সংখ্যক জনগণকে।
বৈদিক পরবর্তীকালের পর পুরাণ কথা নিঃসন্দেহে আপাতদৃষ্টিতে আজগুবি বা কিম্বদন্তী মনে হলেও একটা অজানা জগতের সংস্কার দুর্বলতার প্রভাব বিস্তার করে , কিন্তু এতে বিশেষ এক সমাজ অনুশাসন আছে।
পুরাণ পড়ে মনে হয় এ এক বড়দের আদিরসাত্বক রূপকথা, কতটা বাস্তব কতটা নৈতিকতার প্রশ্ন, তা এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক বা দলগত মতবাদে দাঁড়িয়েছে।
দেবী দুর্গার কাহিনী পুরাণ গত, বেদ-গ্রন্থে এর কোন উল্লেখ নেই। কারণ বৈদিক যুগে প্রকৃতি-পূজা হতো, মাটি নদী আকাশ বায়ু,বৃক্ষ ইত্যাদি অর্থাত জীবন ধারণের জন্য যা যা প্রয়োজন, যজ্ঞ হতো নিরাকার ইন্দ্র এর রূপকে, এবং সর্বোচ্চ দেবতা নিরাকার পরম ব্রহ্ম। যদিও বৈদিক ঋষিরা সর্বচ্চশক্তি দেবতার সন্ধান চালিয়েও কৃতকার্য হন নি।
ঋকবেদের দশম মণ্ডলে যে “দুর্গা” স্তোত্র আছে তা হলো “রাত্রি”র উপাসনা, দশভুজা দেবী দুর্গা নন। অবাঞ্ছিত অন্ধকার রাত্রি অবসান হলে আলোর দিন আসবার প্রার্থনা । দুর্গা হলো রাত্রি আর স্ত্রীলিঙ্গ (রাত্রি) দুর্গার পুলিঙ্গ হলো দুর্গী।
অত্যচারী মহিষাসুরকে হনন করেন দেবী দুর্গা, দশভুজা, তিনি পুরাণ যুগের কাল্পনিক সাকার দেবী। তেমনই দেবী কালীকা বধ করেন নমর, রক্তবীজ প্রভৃতি অসুরদের — মহীষাসুর বধের প্রায় এক দেবীপক্ষকালের মধ্যে।
এর মাহাত্ম্য হলো –অশুভ শক্তির বিনাশ ও শুভ শক্তির প্রতিষ্ঠা।
তাহলে অশুভ শক্তি অসুরদের কথা ত সর্বপ্রথম জানতে হবে মহীষাসুর, নমর, রক্তবীজ– এদের কথা কিছু বলে নি– দেবতাদের মতোই অসুরেরাও পরম বিক্রমশালী,রূপ পরিবর্তনে পারদর্শী, মায়াবল ও অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। তফাৎ শুধুমাত্র ১) বুদ্ধিমত্তায় ২)বিনাশ ও অশুভ শক্তির আসক্তিতে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেন দেবতাগণ—যজ্ঞ পণ্ড করা, শুভকাজে বাঁধা , নানা ধ্বংসাত্বক কাজ, প্রবল হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপ যাকে বলে।
মহীষাসুর বধের মূল গল্পে আসি— পুরাণের আঠেরটি খণ্ডের প্রতিটিই স্বয়ং সম্পূর্ণ যদিও প্রতিটির সাথেই আবার যোগসূত্র আছে। আমার নিবন্ধে মহীষাসুর বধ ” বামন পুরাণ “এর অন্তর্গত।
পুরাকালে রম্ভ ও করম্ভ নামে দুই সহোদর অসুর রাজের নানা অত্যাচারে স্বর্গ মর্ত পাতাল অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তারা অপুত্রক ছিলেন । সেজন্য তারা পুত্র কামনায় ফলবটাক্ষ যক্ষের কাছে তপষ্যায় মগ্ন থাকেন। কুরম্ভ নদীর গভীর জলে তপস্যা সুরু করেন , আর ইন্দ্র তখন সুযোগ বুঝে কুমিরের রূপ ধরে তাকে গিলে ফেলেন। ভাইয়ের মৃত্যুতে রম্ভও মনের দুঃখে অগ্নিতে ঝাপ দিয়ে আত্মহননের চেষ্টা করলে স্বয়ং অগ্নিদেব/পক্ষান্তরে ব্রহ্মা দেখা দিয়ে বিরত করেন এবং বর প্রদান করতে চাইলেন। রম্ভ চাইলেন এমন এক প্রবল শক্তিমান পুত্র যাকে সুরলোক নরলোকের কোন দেব , যক্ষ, নর, বা পশু পরাস্ত করতে পারবে না। “তথাস্তু” , অগ্নিদেব বললেন, তুমি এখন থেকে প্রথমেই যে নারীর( দেবী , যক্ষী,নারী বা পশু নারীর) প্রতি আসক্ত হবে, ঠিক তার গর্ভেই তোমার তেমন পুত্র জন্মাবে। এরপর রম্ভ এদিক ওদিক ঘুরে হাজির হলেন যক্ষপুরীতে। সেখানেই তিনি এক মহিষ-বালিকার প্রতি আসক্ত হন, অতএব তাকে বিবাহ করে অসুরপুরীতে নিয়ে এলেন।
কিন্তু অসুর প্রজারা কেউ রম্ভর মহিষপত্নীকে পছন্দ না করায়, রম্ভ তাকে আবার যক্ষপুরীতে রেখে আসেন, পরে সেখানে সে এক পুত্র সন্তান প্রসব করেন, তিনিই হন অগ্নিদেব বরপুত্র—- ” মহিষাসুর ” ক্রমে সে ভয়ঙ্কর এক আসুরিক রূপ ও শক্তির প্রতীক হয়ে উঠতে থাকে।
এদিকে তার মায়ের প্রতি এক উচ্ছৃংখল মহিষ যুবকের দৃষ্টি পড়ে ও রম্ভ পত্নীকে উত্যক্ত করতে থাকায় খবর পেয়েই রম্ভ আসেন এবং সেই মহিষ যুবকের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে লিপ্ত হন।
কিন্তু এ সমরে রম্ভ পরাজিত ও নিহত হলেন। শোকে দুঃখে রম্ভপত্নী আগুনে ঝাপ দিয়ে প্রাণত্যাগ করেন। সেই আগুন থেকেই এক মহা শক্তিধর পূর্ণ- বয়স্ক অসুর জন্ম নেন, তার নাম “রক্তবীজ “, কারণ তাঁর শরীর থেকে এক ফোঁটা রক্ত জমিতে পড়লেই জন্ম নেয় আবার সহস্র অসুর।
এসব কারণে যক্ষরা খুবই ক্ষেপে গিয়ে সকলে মিলে ঐ অনর্থের মূল মহিষ যুবকের প্রতি আঘাত হানেন। বেগতিক দেখে সেই মহিষ তখন প্রকান্ড সরোবরে ঝাপ দিয়ে পড়ে ডুবে মারা যায়। সেই সরোবর থেকে উঠে আসে আর এক বলিষ্ঠ অসুর, যার নাম হলো ” নমর” তো…. নমর , রক্তবীজ ও মহিষাসুর, তিন ভয়াবহ অসুরের দাপটে অস্থির হয়ে উঠলো ত্রিভুবন। হ্যাঁ, দেবতাদের ত ক্ষুরধার বুদ্ধি, অসুরদের চেয়ে অনেক বেশি IQ(Intelligence quotient)।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ঠিক করলেন, মহিষাসুর বর পেয়েছিলেন কোন দেব, যক্ষ, নর, অসুর, পশু তাকে বধ করতে পারবে না। ঠিক কিন্তু, কোন দেবী বা যে কোন নারী ত তাকে হনন করতে পারবেন। তাই তারা সকলে মিলে তৈরি করলেন এক অসামান্য রূপসী ও অমিত শক্তিশালী এক ষোড়শ বর্ষীয়া নারীর। তাঁর আঠেরোটি হাত, দশ নয়। নাম দিলেন “কাত্যায়নী” এই কাত্যায়নীর নানা রূপ— দশভুজা দুর্গা, চারিহস্ত কালিকা, চণ্ডী, বিজয়া,তাড়া, বগলা,অভয়া,বরদা ইত্যাদি। আবার দেবী কালিকার ১০৮ টি নামের মধ্যে একটি নাম — “রৌদ্রমুখী” ।
সকল দেবতা তার আঠারো হস্তে দিলেন সর্বোচ্চ শক্তিশালী অস্ত্র। লাস্যময়ী রূপে দেবী কাত্যায়নী এক সিংহের পৃষ্ঠদেশে সমারূঢ় হয়ে বনে,চরে , এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতে লাগলেন উদ্দেশ্য মহীষাসুরকে আকৃষ্ট করবার।
খবর পৌছাল মহীষাসুরের কাছে, কৌতুহল বশে এসে সম্মুখীন হলেন সিংহবাহিনী দেবী কাত্যায়নীর , আর নানা অলংকারে সজ্জিতা, সুশোভনা বস্ত্র পরিহিতা চোখ ঝলসানো লাস্যরূপা দেবীকে দেখে তৎক্ষনাৎ প্রেমে পড়লেন — সুন্দর যুবকের রূপ ধরে প্রস্তাব দিলেন বিবাহের। ছলাকলা বিদ্যার পরাকাষ্ঠায় তখন দেবী, আর সঙ্গে সঙ্গেই রাজী হলেন। মহীষাসুর আনন্দে ত আটখানা। দেবী কাত্যায়নী বললেন কিন্তু একটা সর্ত আছে সর্ত? হ্যাঁ আমি বরমাল্য দেবো তারই গলে যে পুরুষ আমাকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারবেন।
মহীষাসুর নিজরূপ ধরে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে অট্টহাস্য করে উঠলেন। হাঃ হাঃ হাঃ…. ভাবলেন, বলে কি, ত্রিভুবন যার দাপটে ত্রাহিরবে আচ্ছন্ন, আর এ তো সামান্য এক নারী!!!! দেবী কাত্যায়নী ভাবলেন, একে পরাস্ত করতে দশ হাতের অস্ত্রই যথেষ্ট তাই রূপ ধরলেন “দশভুজা দুর্গা”র । তারপর প্রচন্ড যুদ্ধের পর দেবী মহীষাসুরকে বধ করে হলেন দেবী ” বিজয়া”। আর সেই দেবী পক্ষেই দুর্গার আর এক রূপ মা কালিকা রূপে বধ করলেন “রক্তবীজ ” ও “নমর” অসুরদের— সর্বত্র নেমে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস।
একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পূর্ণ বিজ্ঞান মনস্ক হয়েও আশাবাদী মন চায় পুরাণ যুগের কল্পনার শিকার হতে, শুধুমাত্র অসুর নিধন নিমিত্ত।
দেবী দুর্গা কতটা অশুভ শক্তি দূর করেছেন জানবার আমাদের ক্ষমতা নেই।
তবু যেন আর একবার প্রার্থনা— আগামী দীপাবলীতে দেবী কালিকা ধ্বংস করুন না হয় যাবতীয় অশুভ রূপ বদলের ক্ষমতাশালী দুর্বৃত্তদের, তা সে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা মনুষ্যরূপী হিংসাশ্রয়ী জানোয়ার বিশেষ……
যাই হউক না কেন ……