Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ডেভিলস আইল্যান্ড || Buddhadeb Guha

ডেভিলস আইল্যান্ড || Buddhadeb Guha

০১.

‘এলেম নতুন দেশে।
এ এ এ লেম, এলেম নতুন দেশে।
তলায় গেল ভগ্নতরী, কূলে এলেম ভেসে।’

বলে গান ধরে দিল তিতির। ঝিঙ্গাঝিরিয়ার মানুষখেকো শিকার করতে ঋজুদার সঙ্গী শুধু আমিই ছিলাম কিন্তু এবারে ঋজুদার সঙ্গে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে এসেছি তিতির, ভটকাই এবং আমি, ঋজুদা অ্যান্ড কোম্পানি ইন ফুল স্ট্রেংথ।

কলকাতা থেকে বেরোবার আগে ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে প্রতিবার বাইরে কোথাও যাওয়ার আগে আমাদের যেমন একটা গেট-টুগেদার হয়ই, ভটকাই-এর ঠিক করে দেওয়া মেনুমতো জম্পেশ করে খাওয়া-দাওয়াও হয়, এবারেও তেমনিই হয়েছিল। সেই গেট-টুগেদারেই ঋজুদা গদাধরকে বলে দিয়েছিল, দ্যাখো, মিস্টার গদাধর এবারে আর আমাদের জন্যে খামোকা চিন্তা কোরো না। এবারে শুধু বেড়াতেই যাচ্ছি আমরা। শুধু খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো। আর ঘুম। অনেকদিন হল এই তিনজনকে নিয়ে শুধুই বেড়াতে যাইনি কোথাওই।

কী করব আমরা সেখানে ঋজুকাকা? সত্যিই কি শুধু খাব-দাব আর ঘুমোব? তিতির জিজ্ঞেস করল।

বলতে গেলে তাইই। তবে আমার পুরনো বন্ধু ন্যাভাল কমোডর বাটলিওয়ালা বহুদিন হল নেমন্তন্ন করে রেখেছে। আমাদের একটা ভাল বোট দিয়ে দেবে নেভির। তাই ভাবলাম, তোদের মধ্যে কেউই যখন দেখিসইনি আন্দামান, তোদের ভাল করে ঘুরিয়েই আনি। নারির ওয়েস্টার্ন কম্যান্ডে চলে যাবার কথা আছে বদলি হয়ে কিছুদিনের মধ্যেই।

নারিটা কী বস্তু? নারী তো জানি।

ভটকাই ধন্ধে পড়ে বলেছিল।

নারি হচ্ছে বাটলিওয়ালার ফাস্ট নেম।

হেসে বলেছিল, ঋজুদা।

বালতিওয়ালা?

বালতিওয়ালা পদবি যে পারসিদের হয় না তা নয়, তবে নারি, বাটলিওয়ালাই।

ঋজুদা বলেছিল।

আজ সকালে সিনক আইল্যান্ডস-এর সমুদ্রের মধ্যে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, সত্যি! ভাগ্যিস এসেছিলাম আমরা। এ এক স্বর্গরাজ্য। আমরা তো ভারত মহাসাগরের বুকে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে গেছিলাম জলদস্যুদের গুপ্তধনের রহস্য উদঘাটন করতে। রংবেরং-এর প্রবালে ভরা নানা দ্বীপে, কিন্তু সে তো বিদেশে। আন্দামান তো আমাদের। স্বদেশ। নিজের দেশ, নিজের দেশ। তার সঙ্গে অন্য কোনও দেশের তুলনা চলে!

ভোররাতে উঠে পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সমুদ্রের মধ্যে এই অপরূপ সিনক আইল্যান্ডে এসে পৌঁছেছি আমরা। না এলে, সত্যিই বড় মিস করতাম। সমুদ্রে তখন ভাঁটি দিয়েছে। ছ’ বোনেরই মতো, সুনীল স্বচ্ছ জলের মধ্যে যেন হাত ধরাধরি করে নাচছে বড় সুন্দরী এই ছটি দ্বীপ।

তিতির সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে কাঁঠালিচাঁপা রঙা। সুইমিং ট্রাঙ্ক আমরাও কেউই আনিনি। সুইমিং-ট্রাঙ্ক পরে আসব কালকে, যখন জলিবয় আইল্যান্ডে যাব। সমুদ্রে যখন ভাঁটি দেয় তখন সিনক আইল্যান্ডস-এর ছটি দ্বীপের এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় রংবেরং-এর কোরালদের বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে। কত রকম মাছ যে চলে যাচ্ছে স্বচ্ছ জলের মধ্যে দিয়ে তাদের পিছল শরীরের হঠাৎ ছোঁয়া লাগিয়ে আমাদের পায়ে!

ভটকাই-এর একেবারে বাকরোধ হয়ে গেছে। ভয়ে বাকরোধ অনেকেরই হয় : কিন্তু সৌন্দর্যেও যে বাকরোধ হতে পারে তা ভটকাইকে দেখেই প্রথম বুঝলাম। তিতির চিৎকার করে উঠেছিল, অ্যান আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড প্লেস। আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড। ঋজুদা তার স্ট্র-হ্যাটের নীচের ছায়াঘেরা পাইপ-ধরা মুখে এক ভারী তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল, কী? তোদের বলেছিলাম না? পছন্দ?

পছন্দ? সারাটা জীবন ওখানে থাকার বন্দোবস্ত করতে পারো ঋজুকাকা, তোমার বন্ধু কমোডর বাটলিওয়ালাকে বলে? তিতির বলল।

দু’পায়ে সাদা বালি আর নীল জল ছিটকিয়ে ভটকাই বলল, যেখানে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে নীল সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে পায়ে হেঁটে পৌঁছনো যায় সেই সব দ্বীপের নাম সিল্ক আইল্যান্ড হয় কী করে! অবাক কাণ্ড। ডুবে যাওয়ার তো কোনও ব্যাপারই নেই এখানে।

ঋজুদা খুব জোরে হেসে উঠে বলল, ওরে গর্ধভচন্দ্র, Sink’ নয়, ‘Cinque’। ফরাসি শব্দ। মানে ছয়। ফরাসি-বিশেষজ্ঞ তিতিরকে জিজ্ঞেস কর না..বিশ্বাস না হয়। এই সিনক আইল্যান্ডস একটা ম্যারিন স্যাংচুয়ারি। আমাদের দেশে বাঘের জন্যে যেমন আছে করবেট, পালামৌ, মানস বা সুন্দরবন, হাতির জন্যে বক্সা বা পেরিয়ার, তেমনি হাজারো রকমের মাছ, রংবেরং-এর প্রবাল এবং নানারকম নানারঙা জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীকে বাঁচাবার জন্যেই নানারকম প্যাংকটকে, অ্যালগকে, ফাঙ্গিদের নির্বিঘ্ন করার জন্যে, এই অভয়াঞ্চল।

বলেই বলল, এবার তাড়াতাড়ি পা চালা উলটোদিকে। জোয়ার আসছে; যে দ্বীপে আমরা নেমেছি সেই দ্বীপে পৌঁছতে সাঁতরাতে হবে পরে তা না হলে।

আগে বলবে তো! সুইমিং ট্রাঙ্ক নিয়ে আসতাম। আমরা সমস্বরে বললাম।

বলেইছি তো! সে হবে কাল যখন জলিবয় আইল্যান্ডে যাব। সেখানে স্নারকেলিং আর স্কুবা ডাইভিংও করতে পারিস। ইকুইপমেন্টস সব ভাড়া পাওয়া যায়।

ম্যা গোঃ। পরের স্মরকেল আর স্কুবা-ডাইভিং-এর ইকুইপমেন্টস নিয়ে নামব সমুদ্রে! আমি নেই।

ঠিক আছে, সাঁতার তো সব সমুদ্রেই কাটা যায়, হাঁটা কি যায় সব সমুদ্রে? সমুদ্রে হাঁটার সুযোগ, এ জীবনে আর আসবে না–মনের সুখে হেঁটে নে।

তিতির হেসে বলল, কেন আসবে না? চিনিয়েই যখন দিলে ঋজুকাকা আমি এখানেই হানিমুন করতে আসব।

তা আসিস। সত্যি। হানিমুনের এমন জায়গা পৃথিবীতে কমই আছে। এ জন্মে বিয়ে করা তো আমার কপালে নেই, নইলে আমিও এখানে আসতাম।

সত্যি! আমি চুপ করে মোহাবিষ্টের মতো তাকিয়ে ছিলাম। হালকা নীল আকাশ, তার ছায়া-পড়া ঘননীল সমুদ্র, সাদা আর গেরুয়া বালি, হলদেটে, ছাইরঙা আর সবুজাভ সব প্রবালের ছড়া জলের নীচে নীচে, যেন বহুরঙা জলজ নেকলেস। পলশান’ শব্দটাই এখানে জানে না কেউ। আমাদের অদেখা অথচ এমন সুন্দর দেশ যে আমাদের ভারতেই ছিল তা ঋজুদা আমাদের আন্দামানে না নিয়ে এলে কি জানতে পারতাম?

আমরা ফিরে গিয়ে যে দ্বীপে আমাদের বোট থেকে নেমে সকলে প্রথমে গিয়ে পৌঁছেছিলাম তার বালিতে বসলাম সতরঞ্চি পেতে একটা গাছতলাতে। কী গাছ এটা কে জানে। এ এক আশ্চর্য দেশ! এখানের প্রায় গাছই আমার অচেনা। হোটেল থেকে প্যাকড-লাঞ্চ দিয়ে দিয়েছিল, স্যান্ডউইচ, কিছু ফল, জোড়া ডিমসেদ্ধ, কোল্ড চিকেন, হ্যাম, সঙ্গে মাস্টার্ড। আর প্রাইট। স্পাইট ঋজুদার খুবই প্রিয়। সবাই যা করে, ঋজুদা তা করে না। হাসতে হাসতে বলে, অকল লাগাও, দিখাপে মত যাও।’ ঋজুদার চেলা হিসেবে আমরাও স্প্রাইট ভক্ত হয়ে উঠেছি।

খেয়ে-দেয়ে আমাদের তারপরই রওনা দিতে হবে কারণ বিকেলের দিকে প্রায় রোজই এই সমুদ্রে ঝড় বৃষ্টি আসে। সমুদ্রের ওপর দিয়ে যেতে হবে ছোট মোটর বোটে করে। ছোট বোট বলেই সাবধানের মার নেই। এ বোটটি আমরাই ভাড়া করে এনেছি। ওয়ানডুর থেকেও আসা যেত কিন্তু তাতে সমুদ্রযাত্রা সংক্ষিপ্ত হত। তা ছাড়া ছাব্বিশ মাইল পথ পোর্ট ব্লেয়ার থেকে। মাইল মানে, নটিক্যাল মাইল।

খাওয়া-দাওয়া সেরে লাঞ্চ-প্যাকেটের মধ্যে সমস্ত টুকরো-টাকরা ভরে গাছের নীচের জায়গাটা পুরো সাফ-সুতরো করে দিয়ে আমরা বোটের দিকে চললাম। ততক্ষণে জোয়ারের জলে অনেকখানি ভরে গেছে সমুদ্র। টার্ন আর স্যান্ড পাইপার পাখিরা বালির ওপরে ওড়াওড়ি করছে। তাদের উড়ন্ত শরীরের মুঠিভরা নরম সাদা, ওই হালকা আর গাঢ় নীল পটভূমিতে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।

যেহেতু এই সিনক আইল্যান্ড বা জলিবয় আইল্যান্ড সবই ম্যারিন স্যংচুয়ারি, ওখানে কোনও রকম নোংরা ফেলে আসা একেবারে বারণ। রোজ পুলিশেরাও আসে বোটে করে নজরদারি করতে।

সাদা কাঠের ছোট্ট বোর্ড লাগানো আছে বালির উপরে পোঁতা বেঁটে খোঁটার T6 ‘Leave only your foot prints behind.’

ঋজুদা বলল এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার শিক্ষাটা আমাদের দেশের মানুষদের এখনও নেওয়া বাকি। শুধুমাত্র নিজেদেরটাই বুঝি আমরা। অন্যর প্রতি কিছুমাত্র consideration নেই। নিজেদের পিকনিক, নিজেদের আনন্দ হলেই হল, আমাদের পরে অন্যরাও যে আসবেন তাঁরাও যে পরিষ্কার দেখতে চান এসব জায়গা এই বোধটা জাগতে আমাদের মধ্যে আর কতদিন লাগবে কে জানে।

তিতির বলল, যা বলেছ। পুলিশরাও এখানে ভেসে না এলে হয়তো জায়গাটা এমন পরিচ্ছন্ন থাকত না। বড় লজ্জার কথা জাতি হিসেবে আমরা যেন এখনও প্রাপ্তবয়স্ক হইনি। কবে যে হব, কে জানে!

ছোট নৌকোতে করে বোটে পৌঁছতে হল। দুটি কারণে বোট দ্বীপ পর্যন্ত আসতে পারে না। প্রথম কারণ, জল কম। দ্বিতীয় কারণ, দ্বীপের চারপাশের কোরালদের ক্ষতি না করা। ওই ছোট ছোট নৌকো, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের তালের ডোঙার মতো, তারই নাম গ্লাস বটম বোট। নৌকোর তলাতে দু ফিট বাই চার ফিট মোটা ঘোলা কাঁচ বসানো একটা। সেই স্বচ্ছতার মধ্যে দিয়েই নৌকোতে বসে নীচের প্রবাল, মাছ, নানারঙা উদ্ভিদ দেখা যায়।

ঋজুদা বলছিল গ্লাস-বটম বোট দেখতে হয় প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াইয়ান আইল্যান্ডের ওয়াইকিকি আর ভারত মহাসাগরের স্যেশেলসে। তেমন বোট হয়তো আমাদের দেশেও হবে একদিন। কিন্তু কবে যে হবে তা ভগবানই জানেন।

আমাদের বোট ছেড়ে দিয়েছে। জোরে হাওয়া বইছে এখনই তবে আকাশে মেঘ নেই। ভয়ের কিছু নেই। বোটের মাথাতে ত্রিপল বেঁধেবঁধে চাঁদোয়ার মতো করা। রোদ-জল থেকে যাত্রীদের বাঁচাবার জন্যে। ভাবছিলাম স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে কত সুন্দর সুন্দর আর কতরকম বোটই না দেখেছিলাম। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর তুলনা নেই কিন্তু আমরা গরিব বলেই আমাদের সব ব্যাপারই সাদামাঠা? তবে কোনও কোনও ব্যাপারে আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞানেরও হয়তো খামতি আছে কিছুটা।

ঋজুদা একদিন বলেছিল আমাদের শান্তিনিকেতনে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে যে, Art is born out of superflirty. কথাটা নাকি আসলে রবীন্দ্রনাথেরই। রবীন্দ্রনাথের কাছে এক বিদেশি এসেছিলেন। তাঁরা দুজনে বসে নন্দনতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময়ে জানালা দিয়ে দেখা গেল রাধু মালি দুটি ক্যানেস্তারায় জল ভরে বয়ে নিয়ে আসছে বাঁকে করে। তার চলার গতিতে ছলাৎ ছলাৎ করে উপচে পড়ছিল ভর্তি ক্যানেস্তারার জল। সেদিকে অতিথির দৃষ্টি আকর্ষণ করে নাকি রবীন্দ্রনাথ সেই বিদেশিকে বলেছিলেন যে, ক্যানেস্তারাগুলি খালি থাকলে জল উপচে পড়ার উপায়ই থাকত না। প্রয়োজন পূরিত হবার পরেই যা উপচে পড়ে তাই আর্ট এর উপচার। কথাটা, শোনা কথা ঋজুদার।

ঋজুদার শোনা কথাটা যে আমরা খুব একটা বুঝেছিলাম তখন এমন নয়, তখন আমাদের বয়স আরও কম ছিল, কিন্তু শুনতে ভাল লেগেছিল। পুরোপুরি বুঝতে না পারলেও এসব কথা শুনতে ভাল লাগে। বোঝার আভাস পাওয়া যায়, আর তা গেলেই এইসব কথা যা আজকাল খুব কম মানুষকেই বলতে শুনি, আরও শোনবার একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে জাগে। এই মস্ত গুণ ঋজুদার। তার চেয়ে আমরা প্রত্যেকেই বয়স, জ্ঞান, বিদ্যা এবং বুদ্ধিতে অনেকই ছোট হলেও সে আমাদের কখনওই ছোট ভাবে না। আমাদের সঙ্গে সমান সমান ব্যবহার করে। আমাদের প্রত্যেককে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়, ভটকাই-এর ফাজলামোও অসীম ধৈর্যর সঙ্গে সহ্য করে আর তাই আমাদের প্রত্যেকেরই মধ্যে অবচেতনে ঋজুদার মতো হয়ে ওঠার একটা উচ্চাশা ক্রমশই গড়ে উঠতে থাকে, সেই উচ্চাশা ক্রমশ দীপ্তি পায়। এই কথা যে কত বড় সত্যি তার মস্ত বড় প্রমাণ ভটকাই। আমাদের দলভুক্ত হবার পর এবং বিশেষ করে ঋজুদার ছত্রছায়াতে এসে মাত্র কয়েক বছরেই ওর উন্নতিটা সত্যিই চোখে পড়ার মতো। ও নাকি স্কুলের লেখাপড়ার পরীক্ষাতেও আগের থেকে অনেক ভাল ফল করছে ইদানীং। ওদের পাশের বাড়ির বিল্ট বলছিল।

ঋজুদা সবসময়ই বলেছে আমাকে আর তিতিরকে, শুধু বই-মুখস্থ পড়াশোনা করলে জীবনে কিছুই হতে পারবি না, square হতে হবে, চৌকশ, তবেই না জীবনে অন্যদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারবি। দশজনের একজন হতে পারবি।

টক্কর দিতে পারব কী না জানি না, তবে শুধু ভটকাইরই নয়, আমাদেরও যে ঋজুদার সঙ্গে সঙ্গে থেকে অনেকই উন্নতি হয়েছে সব দিক দিয়েই সেটা নিজেরাও বুঝতে পারি।

ঋজুদা একটা কথা প্রায়ই বলে আমাদের হাসতে হাসতে: ‘জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল, অজ্ঞতার কোনও সীমা কখনও ছিল না।

সমুদ্রের মধ্যে একটা দ্বীপ আমাদের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। সূর্যের আলো পড়ছে নীল সমুদ্রের সবুজ দ্বীপের ওপরে। সেই দ্বীপের রং তো শুধু সবুজ নয়। সবুজের যে কত রকম, হলুদের, লালের, সাদারও, তা কী বলব! কত রকমের যে গাছ-গাছালি সেই দ্বীপে ক্রমশ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে–বোট যতই এগিয়ে যাচ্ছে সেই দিকে।

ওগুলো কি গাছ ঋজুদা, সাদা কাণ্ড, লম্বা, সব গাছের মাথা ছাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে?

তিতির শুধোল।

ঋজুদা ঘুরে বসে, ভাল করে দেখে বলল, ওড়িশার লবঙ্গীবনের গেণ্ডুলি, আর পালামৌর চিলবিল গাছের মতো দেখতে না অনেকটা? এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে গাছের মেলা। আর যেহেতু ওদের অধিকাংশই endemic, ওদের অন্য কোথাও দেখতেও পাবি না। একদিন তোদের সকলকে নিয়ে যাব চ্যাথাম আইল্যান্ডে।

চ্যাথাম আইল্যান্ডে কী আছে? আইল্যান্ড তো অনেক আছে, রসস আইল্যান্ড, ভাইপার আইল্যান্ড ইত্যাদি। চ্যাথামে কী?

ভটকাই বলল।

কী থাকবে? কাঠচেরাই-কল আছে। কাঠ চেরাই হয় সেখানে। সরকারি saw mil আছে মস্ত। সব গাছই এক সঙ্গে চিনিয়ে দিতে পারব তোদের সেখানে নিয়ে গেলে।

আমি বললাম, মরা গাছ কে দেখতে যাবে। গাছ মরে গেলে তো গাছ থাকে না, সে কাঠ হয়ে যায়। যাকে বলে শুষ্কং কাষ্ঠং।

সে তো গাছেদের কবর ভূমি, শ্মশান ভূমি। ওখানে যাব না। তুমি আমাদের জ্যান্ত গাছ চেনাও ঋজুকাকা।

তিতির বলল।

ঋজুদা হেসে বলল, কথাটা ভালই বলেছিস। এবং কথাটা ঠিকও বটে।

তিতির আবার বলল, বলো না ঋজুকাকা, ওই সাদা গাছগুলো কী গাছ? দ্যাখো, এখন আগের থেকে অনেকই কাছে এসে গেছে।

ঋজুদা বলল, সাদা দেখাচ্ছে, আলোর জন্যে। আসলে ওগুলো রুপোলি আর ছাই রঙে মেশা। গাছগুলোর নামও Silver-grey. আর ওই দ্যাখ, ওই পুবের দিকে, ওই গাছগুলোকে কাছ থেকে দেখলে তবে বুঝতে পারবি কী মসৃণ তাদের গা। নাম কী জানিস ওই গাছগুলোর?

কী?

Satin-wood.

বাঃ।

হ্যাঁ। আর ওই দক্ষিণ দিকে চেয়ে দ্যাখ, ওই গাছগুলোর নাম Marble Wood.

Marble Wood.

আমি অবাক হয়ে বললাম।

হ্যাঁ।

বলল, ঋজুদা।

তারপর বলল, চল, আশা করি ডেভিলস আইল্যান্ডে যখন তোদের নিয়ে যাব ১৩৮

তখন তোদের আরও অনেকরকম গাছ দ্যাখাতে পারব আন্দামানের।

ডেভিলস আইল্যান্ডে এখানকার সবরকমের গাছ আছে?

তিতির বলল।

ঋজুদা হেসে বলল, তুই একটি পাগলি। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে সবশুদ্ধ প্রায় ছশো প্রজাতির গাছ আছে। তার মধ্যে মাত্র চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ রকমের গাছের পরিচর‍্যা করা হয়। যে সবের বাণিজ্যিক মূল্য আছে আর কি। বাণিজ্যিক মূল্য অবশ্য তেমন আছে মাত্র ঊনত্রিশ-ত্রিশ রকমের গাছের। অন্যরা কম বেশি ব্রাত্য। চ্যাথাম আইল্যান্ডে গেলে বাণিজ্যিক গাছগুলোকেই দেখতে পাবি।

যাব না আমরা গাছেদের মর্গ-এ।

ভটকাই প্রতিবাদী গলাতে বলল।

তুমি এমনি করেই আমাদের গাছ চেনাও, আর ডেভিলস আইল্যান্ডে যখন যাব তখন তাদের কাছ থেকে গায়ে হাত দিয়ে দেখব।

তিতির বলল।

হাসল ঋজুদা। বলল, বেশ। তাই দেখিস।

তারপর বলল, এই মোটর বোটে বসে মনে হচ্ছে না যে দ্বীপটা, গাছগুলো সব দ্রুত পেছনে দৌড়ে যাচ্ছে এই নরম কোমল আলোতে? সুন্দরবনেও গোসাবা, বা বিদ্যা বা মাতলা অথবা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীতে বোটে বসে দ্বীপগুলোকে এইরকম সুন্দর লাগে। সুন্দরবনের মতো এমন সুন্দর ও ভয়াবহ জায়গা পৃথিবীতে খুব কমই আছে অথচ আমরা এমন একটি জায়গাকে পৃথিবীর পর্যটকদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখলাম। সুন্দরবনের গভীরে গেলেই মনের মধ্যে এক ধরনের uncanny, আধিভৌতিক অনুভূতি হয়, তীব্র ভয়-মিশ্রিত ভাল লাগার অনুভূতি, এমনটি আমার আর কোনও বনে গিয়েই হয় না, হয়নি। সুন্দরবনকে আমি চিরদিনই ভয় পেয়ে এসেছি।

সেই জন্যেই কি আমাদের নিয়ে একবারও যাওনি সুন্দরবনে তুমি?

ফাজিল ও দুঃসাহসী ভটকাই বলল।

ঋজুদা কিন্তু হাসল না। বলল, যাইনি, তোদর মারাত্মক বিপদের মধ্যে ফেলতে চাইনি বলেই। নিজের না হয় যা হবার হবে। তোদর দায়িত্বও তো আমারই।

তিতির বলল, আহা! সুকুমারমতি সব, কুসুমকোমল বালক-বালিকা যেন। আমরা একেবারেই অনভিজ্ঞ অনভিজ্ঞা!

তারপর বলল, কোন বিপদের মধ্যেই না তুমি নিয়ে গেছ বল আমাদের? মানুষ খেকো বাঘ কি আমরা ট্যাঁকস্থ করিনি অনেকবার?

ঋজুদা বলল, সে কথা নয়রে, সে কথা নয়। সুন্দরবন সুন্দরবনই। পৃথিবীতে সুন্দরবনের সঙ্গে আর কোনও বনেরই তুলনা চলে না।

আমরা একা একাই যাব একবার। তুমি নিয়ে না গেলে।

ভটকাই বলল।

আত্মহত্যা করতে চাস তো যাস।

ঋজুদা বলল।

তিতির বলল, একটা সোজা কাজের জন্যে অত কমপ্লিকেশানের কী দরকার। তুমি আমার সঙ্গে জয়িতাদের বাড়িতে চলো একদিন। চোদ্দোতলা বাড়ির খোলা বারান্দাতে তুলে দেব। নীচে লাফ দিয়ে পড়লেই তো কার্যসিদ্ধি হতে পারে, সে জন্যে সুদূর সুন্দরবনে, কীড়ে-মাকড়ের কামড় খাবার জন্যে, সাপ ও স্যালাসাল্ডারদের ছোবল খাওয়ার জন্যে এবং অবশেষে বাঘের পেটে গিয়ে ধন্য হবার দরকার কী?

ঠিক আছে। তোদের নিয়ে যাব একবার সুন্দরবনে।

ঋজুদাকে থামিয়ে দিয়ে তিতির আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, দ্যাখো দ্যাখো, পাখিটাকে। ওটা কী পাখি ঋজুকাকা?

আমরা ঘাড় উলটোদিক করে সোজা উপরে চেয়ে দেখলাম, একটা বাজ জাতীয় পাখি, তার বিরাট ডানা মেলে, দুই ডানাতে বিকেলবেলার সামুদ্রিক রোদকে ছিটকোতে ছিটকোতে চক্রাকারে উড়ছে মাথার উপরে।

আমরা চুপ করে রইলাম। পাখিটাকে কেউই চিনতে পারলাম না। অনেক সময়েই নিজেদের জ্ঞান ভারে একেবারে পণ্ডিতপ্রবর বলে মনে হয় নিজেদের। তবে আনন্দর কথা এই যে, আমরা যে পরম মূর্খ তা আমরা সকলেই জানি। তবে ঋজুদার কাছে থাকলে শেখার যে অনেকই বাকি এই কথাটাই নতুন করে মনে হয়। আশ্বস্ত হই আমরা প্রত্যেকে।

ঋজুদা আমাদের সকলকেই চুপ করে থাকতে দেখে বলল, লক্ষ করেছিস, পাখিটার পেটটা রুপোলি। ওদের নাম সিলভার-বেলিড হক। এরা সমুদ্রের ও বড় জলার পাশে পাশে থাকে, বড় মাছ ধরার জন্যে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড হয় পাখিগুলো। সামুদ্রিক বাজ।

.

০২.

কী নাম বললে? ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

চিড়িয়াটাপ্পু।

কী বিদঘুটে নাম রে বাবা। টাপ্পু মানে কী?

টাপ্পু মানে, মনে হয় পাহাড় বা পাহাড় চুড়ো। ঠিক জানি না। ঋজুদা বলল।

কোন ভাষা এটা?

তাও বলতে পারব না। সম্ভবত আন্দামানি। নিকোবরি নয়।

কাল সকালে তা হলে আমরা যাচ্ছি সেখানে? অনেক চিড়িয়া আছে বুঝি?

তাই তো শুনেছি। চিড়িয়ার কলকাকলিতে মুগ্ধ হব। শুনেছি, যাওয়ার পথটিও ভারী সুন্দর। এর আগে তিন-তিনবার আন্দামানে এসেছি কিন্তু চিড়িয়াটাপ্পতে যাওয়া হয়নি। একা যেতে ইচ্ছে করেনি। এবারে তোরা এসেছিস, তাই যাওয়া যাবে সকলে মিলে।

তুমি বলেছিলে আন্দামানের মেগাপড পাখির কথা। দ্যাখা যাবে সেই পাখি চিড়িয়াটাপ্পতে গেলে?

এবারে আমি বললাম।

নাঃ। ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে যখন আমরা জলদস্যুদের গুপ্তধনের রহস্য সন্ধানে গেছিলাম তখনও কি নেনে পাখিদের দেখতে পেয়েছিলাম? স্যেশেলসের নেনে পাখিদের মতো এরাও প্রায় নিশ্চিহ্নই হয়ে গেছে। যে সামান্য ক’টি আছে তা আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অগণ্য দ্বীপের কোন দ্বীপে আছে তা কে জানে!

অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে এদের বংশ বাড়ালে হয় না?

না। এ পাখি endemic.

মানে?

মানে এদের শুধু এখানেই দেখা যায়। এখানের অনেক গাছও তাই। Endemic। অন্য জায়গাতে নিয়ে গিয়ে লাগালেও বাঁচানো যায় না।

আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে সবসুদ্ধ কতগুলো দ্বীপ আছে ঋজুদা?

সব দ্বীপ এখনও গোনাই হয়নি। অনেক দ্বীপই আছে uncharted.

তারপরই বলল, মেগাপড পাখির কথাতে মনে পড়ল যে, ওই পাখিরই মতো এখানকার আদিবাসীরাও endemic.

এখানের আদিবাসী কারা?

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে কতরকম মানুষের, মানে আদিবাসীদের বাস। যেমন ধর ওঙ্গে, আন্দামানি, জাবোয়া বা নিকোবরের শোম্পেনদেরও পৃথিবীর অন্য কোথাওই দেখতে পাবি না। এ এক আশ্চর্য সুন্দর দ্বীপমালা। আমার তো ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জ থেকেও ভাল লাগে এই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে।

তবে একটা কথা, আমি বললাম, আন্দামানে স্যেশেলস-এর মতো সুন্দর সৈকত নেই, নেই অত নানারঙা কোরাল-এর বাহার। চান করার সুখ নেই, যা আমাদের ওড়িশার পুরীতে পর্যন্ত আছে।

সেটা অবশ্য ঠিক। তবে এর সৌন্দর্যর রকম আলাদা। এর সৌন্দর্যর মধ্যে এক ধরনের উদাসী ভয়াবহতা আছে।

ঋজুদা বলল।

তিতির বলল, যাই বল ঋজুকাকা, সেলুলার জেল কিন্তু ফ্যানটাসটিক। আমি যে বাঙালি সে জন্যে ভারী গর্ব হচ্ছিল। এই কালাপানি পার করিয়ে এনে যত বন্দিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে ব্রিটিশরা নিত্য-নৈমিত্তিক অমানুষিক অত্যাচার করত তাদের মধ্যে অধিকাংশই যে বাঙালিই একথা জেনে কোন বাঙালির গর্ব না হয় বল? এই সত্যটা ভারতের অন্য সব প্রদেশের মানুষেরা কি জানেন?

ভটকাই ফুট কাটল, জানলেও কি মানেন?

তা ঠিক।

আর তাঁদের অপরাধটা কী ছিল? যার জন্যে এই দ্বীপে নির্বাসন? চুরি করেননি, ডাকাতি করেননি, খুন করেননি এমনকী ঘুষও খাননি৷ দেশকে ভালবেসেছিলেন, শুধুমাত্র এই ছিল তাঁদের অপরাধ।

ঋজুদা বলল, সত্যি!

কাল সন্ধেবেলা সেলুলার জেলে লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের শোটা দেখে এসে রাতে আমার ঘুম হয়নি ঋজুকাকা। অত অত্যাচারও করতে পারে মানুষ মানুষের উপরে?

তিতির বলল।

অত্যাচার করলে কী হয়? ওঁদের একজনও কি মাথা নুইয়েছিলেন?

না। তা কেউই নোয়াননি।

ভটকাই বলল।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন: A man can be destroyed but he cannot be defeated. ঋজুদা বলল।

শুধু মানুষ বলো না। মানুষের মতো মানুষ’ বলো। সব মানুষই কি এক ধাতুতে গড়া?

না, তা তো নয়ই! ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, মির সাহেবের একটি বিখ্যাত শায়রি আছে।

কী? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

হিয়া সুরত-এ আদম বহত হ্যায়, আদম নেহি হ্যায়।

ভটকাই বলল, মানে?

মানে, মানুষের চেহারার জীব এখানে গিজগিজ করছে, মানুষ নেই।

চুপ করে রইলাম তিনজনেই। ঋজুদা পাইপটাতে টোব্যাকো ভরে নিয়ে আবার আগুন জ্বালাল। সকাল থেকে খায়নি একবারও। তিন কাপ চা খাবার পরে তার প্রাণ এখন পাইপ চাইছে।

আমরা পোর্ট ব্লেয়ারের বে-আইল্যান্ড হোটেলের লবিতে বসেছিলাম। বাঁদিকে পোর্ট ব্লেয়ার। সামনেই সমুদ্রের মধ্যে একটি পাহাড়। তার ডান কোণে একটি লাইটহাউস। ঘড়ির কাঁটা ধরে আলোটা ঘুরে যায় রাতের বেলা। এই হোটলের উপরে যখন আলোটা ঝাঁপটা মারে তখন সমুদ্রমুখী সব ঘরের মধ্যেটা আলোকিত হয়ে যায় এবং পরমুহূর্তেই অন্ধকার। সন্ধের পর থেকে পরদিন ভোর অবধি এমনি করেই ঘোরে আলোটা। আমার খুব ইচ্ছা করে, দূর সমুদ্রের মধ্যের কোনও লাইটহাউসে কয়েকটা দিন কাটাই। এই লাইটহাউস তোপোর্ট ব্লেয়ারের কাছেই, মানে, লোকালয়ের কাছেই। তাই সেই ভয়াবহতা বা রহস্য নেই।

কাল রাতে আমরা যখন খাওয়ার আগে সমুদ্রের একেবারে উপরেই হোটেলের লবিতে বসেছিলাম তখন হঠাৎই ভটকাই চেঁচিয়ে উঠেছিল, দ্যাখ, দ্যাখ রুদ্র।

চমকে উঠে দেখি, একটা প্রকাণ্ড বড় সাদা-রঙা আলোঝলমল জাহাজ ওই লাইটহাউসটির ওপাশ থেকে ঘুরে সামনের সমুদ্রের খাঁড়িতে ঢুকল। পোর্ট ব্লেয়ারে যাবে। জাহাজটা এত বড় কিন্তু একেবারে নিঃশব্দে চলছে আর দেখে মনেই হচ্ছে না যে, আদৌ চলছে।

যে বেয়ারা একটু আগেই আমাদের ফ্রেশ-লাইম-সোডা দিয়ে গেছিল, সে-ই এসে ভটকাইকে বলল, খোকাবাবু, এহি হ্যায় হর্ষবর্ধন।

আমি বিস্ময়ে চেয়েছিলাম। তিতিরও, কলকাতা–পোর্ট ব্লেয়ার আর পোর্ট ব্লেয়ার কলকাতা করা বহুদিনের নাম-শোনা হর্ষবর্ধনের দিকে। তারপরেই হর্ষবর্ধন পাঁচ সেকেন্ডের জন্যে ভোঁ দিল। সমস্ত দ্বীপের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, উলটোদিকের পাহাড়ে, সেই ভয়ঙ্কর ভোঁ-এর অনুরণন উঠল। জঙ্গলে বড় বাঘ ডাকলে যেমন যেমন হয়, এই কালো, ভারী জলের আন্দামান উপসাগরে হর্ষবর্ধনের ডাক শুনে তেমনই এক অনুভূতি হল আমাদের। অনুভূতি’ শব্দটা বোধহয় ঠিক হল না, বলা উচিত অভিঘাত। অভিঘাতই হল।

আমাদের আসাটা হঠাৎই ঠিক হয়েছিল বলেই প্লেনে এসেছি। জাহাজে এলে, অনেক আগে থেকে বুকিং করতে হয়। কিন্তু তাতে এলে, বেশ কয়েকদিন মজা করতে করতে ধীরে-সুস্থে আসা যেত, যাকে বলে, সমুদ্রযাত্রা’ তাও হত। তবে সে ক্ষেত্রে অনেকদিন আগে প্ল্যান করে আসতে হত। তবে প্লেনে আসারও চমক আছে। নিঃসীম সমুদ্র পেরিয়ে এসে হঠাৎই যখন চাপ চাপ গাঢ় সবুজ অরণ্যে-ভরা ছোট-বড় দ্বীপের রাজ্যের উপরে প্লেনটা এসে উপস্থিত হয় তখন যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। প্রায় সকলেই নিজের নিজের সিট ছেড়ে একবার এদিকের জানালা আরেকবার ওদিকের জানালা করে, আর স্টুয়ার্ডেসরা তাদের সামলাতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সেই যে একবার পাঁচ সেকেন্ড ভোঁ দিল তো দিল, তারপর নিঃশব্দে বে-আইল্যান্ড হোটেলের সামনের খাঁড়ি থেকে বাঁদিকের অন্ধকারে মিশে গেল হর্ষবর্ধন। নিকষকালো অন্ধকার আর নিকষকালো কালাপানি যেন নিঃশব্দে গিলে ফেলল ঝলমলে জাহাজটাকে।

.

০৩.

আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারের বে-আইল্যান্ড রিসর্টে ঋজুদার ঘরে আমরা সবাই ঋজুদার খাটের উপর শুধুই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ম্যাপটাকে ছড়িয়ে দিয়ে খাটের তিন পাশে মেঝের কার্পেটে বসে ম্যাপটাকে দেখছিলাম ঋজুদার নির্দেশে। ঋজুদা বসেছিল সমুদ্রমুখী বারান্দা আর ঘরের মধ্যের কাঁচের স্লাইডিং-ডোরের পাশের ইজিচেয়ারে। কাঁচের দরজাটা বন্ধই ছিল। কারণ, ভিতরে এয়ার কন্ডিশনার চলছে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে যে কোনও সমুদ্রপারের জায়গারই মতো শীত তেমন একটা পড়ে না। মাসটা ডিসেম্বর হলে কী হয়, বেশ গরম এখনও।

ঋজুদা বলল, আজ আর কাল আরাম করে নাও। পরশু থেকে তো সমুদ্রের মধ্যে মোটর বোটে। থাকা ও খাওয়ার এমন ইলাহি বন্দোবস্ত তো আর থাকবে না বোটে।

ভটকাই বলল, ভজনং যত্র তত্র শয়নং হট্টমন্দিরে।

তিতির হেসে বলল, শব্দটা ভজনং নয় মিস্টার ভটকাই, ভোজনং।

আমি বললাম, বোকার মতো কথা বলিস না ভটকাই। শুনছিস যে মোটর বোটে থাকতে হবে, তার আবার যত্রতত্র কী?

ঋজুদা বলল, এই আরম্ভ হল তোদের চিটপিটানি আর ভাঁড়ামো। ম্যাপটাকে ভাল করে দ্যাখ, বুঝে নে।

তিতির বলল, বুঝব কী ঋজুকাকা। এ যে সবই একইরকম লাগে। আদিগন্ত জলের মধ্যে এই গুঁড়িগুড়িগুলো কী?

ওগুলো সবই দ্বীপ। বড়, মেজো, সেজো, ছোট। সবসুদ্ধ শপাঁচেক দ্বীপ আছে। হয়তো আরও বেশি আছে। ম্যাপে কিন্তু অনেক দ্বীপই নেই। মানে আনচার্টেড দ্বীপও আছে অনেক। এই পাঁচশো চার্টেড দ্বীপের মধ্যে আবার মাত্র ঊনচল্লিশটি দ্বীপে মানুষের বাস আছে।

মাত্র?

অবাক হয়ে বললাম আমি।

ইয়েস। মাত্র।

ঋজুদা বলল।

‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’ এই গুঁড়িগুড়িগুলোর মধ্যে কোনটা?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

হাঃ।

ঋজুদা পাইপটা মুখ থেকে নামিয়ে হাসি এবং ঠাট্টা মেশানো একটা আওয়াজ করল।

বলল, কোনটা? তা জানলে আর ভাবনা ছিল কী? তা ছাড়া ‘ডেভিলস আইল্যান্ড’ নাম হয়েছে একসময়ে এক বা একাধিক সাংঘাতিক মানুষ সেখানে থাকত বলেই। এখন সম্ভবত সেখানে কেউই থাকে না। আবার থাকতেও বা পারে। তবে এক বা একাধিক, সংখ্যায় সংখ্যাতে তারা যতই হোক, পার্মানেন্টলি কেউ থাকত না কোনওদিনই সেখানে। ওটা ছিল নানা শয়তান জলদস্যুদের ডেরা। তা ছাড়া, একই মানুষ বা একই দল কখনওই নিয়মিত সেখানে থাকত বলেও মনে হয় না। কোনও জায়গার শয়তানেরাই কোথাও থিতু হয় না। মানুষখেকো বাঘ থেকে ডাকাত, সবই। পার্মানেন্টলি থাকলে এখানের হ্যাঁবিটেবল দ্বীপের সংখ্যা ঊনচল্লিশ নয়, চল্লিশটি হত।

তা ঠিক।

তিতির বলল।

এইসব দ্বীপে কারা থাকে ঋজুদা? মানে, ঊনচল্লিশটি দ্বীপে?

মানুষের বাস যেসব দ্বীপে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেই সব দ্বীপে ওঙ্গে, আন্দামানি, এবং জারোয়াদের দেখা যাবে। নিকোবরে নিকোবরি শোম্পেনদের দেখা যাবে। দেশ ভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে ছিন্নমূল বেশ কিছু বাঙালি উদ্বাস্তুরাও এসে কিছু কিছু দ্বীপে বসবাস শুরু করেছেন।

আবারও বলল, জানিস তো, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে ভারতীয় লোকসভার একটি মাত্র আসন এবং সেটিতে অনেকই দিন হল এক বাঙালি উদ্বাস্তু ভদ্রলোকই নির্বাচিত হয়ে আসছেন।

কী নাম তাঁর?

তাঁর নাম শ্ৰীমনোরঞ্জন ভক্ত।

তারপরই বলল, জানিস তো? এখানের মানুষেরা তো বটেই, অনেক পাখ-পাখালির মতোই গাছ-গাছালিরাও সব endemic। বলেছি?

বলেছ আগে কিন্তু endemic শব্দের মানে?

ইংরেজিতে পণ্ডিত ভটকাই বলল।

সত্যি কথা বলতে কি আমিও শব্দটির মানে জানতাম না। আমি রুদ্র রায় মনে মনে কবুল করলাম কিন্তু আমার অজ্ঞতা ‘পেকাশ’ করলাম না।

তিতির বলল, endemic মানে, native বুঝলি না?

ঋজুদা বলল, তা ছাড়া, যাদের অন্য কোথাওই আর দ্যাখা যায় না। দ্যাখা তো যায়ই না, জোর করে সেই মানুষদের অন্যত্র নিয়ে গিয়ে তাদের পুনর্বাসন করালে, কী গাছেদের, অন্যত্র নিয়ে গিয়ে লাগালে তারা হাসে না, হয়তো বাঁচেও না।

তাই? আশ্চর্য তো!

চিন্তিতমুখে বলল, ভটকাই।

ঋজুদা বলল, মনে আছে তোদের? আমরা যখন ভারত মহাসাগরে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে সেই ফরাসি জলদস্যুদের গুপ্তধনের রহস্যভেদ করতে গেছিলাম তখন আমাদের দেশের কৃষ্ণচূড়ার চেয়েও অনেক বেশি ঝলমলে একরকমের গাছ। দেখেছিলাম, রঙিন ফুলে-ফুলে ছাওয়া…। মনে নেই? কী রে তিতির?

বললাম, ফ্ল্যামবয়ান্ট। তাই না ঋজুদা, তাদের নাম? মনে আছে নিশ্চয়।

ভটকাই বলল, তিতির জানবে কোত্থেকে? সে কি সঙ্গে গেছিল আমাদের। তুমি ওই হাইলি-ডেঞ্জারাস মিশানে খুকিকে তো আর নিয়ে যাওনি।

তিতির হেসে বলল, ‘দু’দিনের সন্ন্যাসী, ভাতকে বলে অন্ন। রুআহাতে যেতে পারলাম আর…তোমাকে দলে এনে রুদ্র সত্যিই খাল কেটে কুমির এনেছে।

ঋজুদা কথা কেটে বলল, ইয়েস! এই ফ্ল্যামবয়ান্ট গাছই এখানের একটি দ্বীপে একজন এনে লাগিয়েছেন ভারত মহাসাগরের স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জ থেকে। শুধু লাগিয়েছেন যে তাই নয়, সে গাছ তরতর করে বড়ও হয়েছে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। গতবারে আমি দেখে গেছি। অথচ আশ্চর্য! ফ্ল্যামবয়ান্ট গাছ স্যেশেলস-এর endemic। আন্দামানে বাঁচবার কথা নয়।

কোন দ্বীপে? ঋজুকাকা?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

সেই দ্বীপও ওই ঊনচল্লিশটি দ্বীপের মধ্যে পড়ে না। সেটিও আনচার্টেড। তার নাম দ্য হর্নেটস নেস্ট।

নামটা তো দারুণ।

আমি বললাম।

‘To stir a hornet’s nest!’

ভটকাই বলল।

খাইছে!

তিতির বলল।

আমরা সকলেই হেসে উঠলাম জোরে।

ভটকাই বলল, ইংরেজিটা শেখার চেষ্টা করছি, তাতেও ঠাট্টা! আমি তো আর তোমাদের মতো ইংলিশ-মিডিয়াম স্কুলে পড়িনি।

বেশ করেছিস। ইংরেজি-মিডিয়াম স্কুলে পড়লেই কি লেজ গজায় নাকি?

বরং ফালতু গুমোর বাড়ে।

তিতির বলল।

সেই দ্বীপে যিনি থাকেন তিনি এক দারুণ মানুষ। বুঝলি? মাত্র দু’জন মানুষ থাকেন ‘দ্য হর্নেটস নেস্ট-এ। মাঝে মাঝে একজন আবার চলে আসেন রসস আইল্যান্ডে। কখনও অন্যজন আসেন পোর্ট ব্লেয়ারে।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, আচ্ছা, ঋজুদা সেই ভদ্রলোকের নাম কি মিঃ আহুক বোস? আর তাঁর সঙ্গীর নাম কি গুচ্ছাপ্পা ভীরাপ্পান?

ঋজুদা অবাক হয়ে বলল, তুই কী করে জানলি? আশ্চর্য তো!

আমি আন্দামানের পটভূমিতে লেখা একটি উপন্যাসে পড়েছিলাম ‘দ্য হর্নেটস নেস্ট’-এর কথা। সেখানে পাখির-বাসার ব্যবসা করেন তো ভদ্রলোক? তাইওয়ানে রপ্তানি করার জন্যে, তাই না?

পাখির বাসা? তা দিয়ে কী হয়?

আমি অবাক হয়ে বললাম।

আরে, চিনেরা ভালবেসে খায়।

তিতির বলল, কলকাতার তাজ বেঙ্গলে’ বা ‘মেইনল্যান্ড চায়না’তে বার্ডস-নেস্ট সুপ কি পাওয়া যায়?

ঋজুদা বলল, খেয়াল করিনি। তবে বম্বের তাজমহল হোটেলে পাওয়া যায়, খেয়েছি।

কী পাখির বাসা ওগুলো ঋজুদা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সুইফট-লেট পাখি।

ফটিকজল পাখি দেখেছিস?

হ্যাঁ।

তাদেরই ক্ষুদে সংস্করণ। পাখিরা তাদের মুখের লালা দিয়ে বানায় সেই বাসা।

যে বইয়ের কথা তুই বললি ভটকাই, সে বই তো বড়দের বই। আমি জানি। মা আমাকে পড়তে দেননি।

তিতির বলল।

কী বই রে?

ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।

সমুদ্র মেখলা।

ভটকাই, টক খেলে মুখ যেমন ভ্যাটকায় তেমন করে বলল।

একটা কথা তিতির। তোর মাকে বলিস যে আমি বলেছি, বই পড়ে কেউই কোনও দিন খারাপ হয়নি।

ঋজুদা বলল।

না, মা তো নিজেই খুব রেলিশ করে পড়লেন বইটি তারপর মাসিকেও পড়তে দিলেন। অবশ্য খারাপ হওয়ার কথা বলেননি, বলেছিলেন, মনের গভীরতা বাড়ার পরে ও-বই পড়তে।

বয়স বাড়লেই কি সব সময়েই মনের গভীরতা বাড়ে? বইটির প্রকাশক কে?

দে’জ পাবলিশিং।

পড়ে দেখতে হবে তো! আহুক বোস আর হর্নেটস নেস্ট নিয়ে কে লিখলেন বই? আর কেমনই বা লিখলেন?

‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’ কোনটা?

ম্যাপটা দেখিয়ে, ভটকাই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে প্রশ্ন করল ঋজুদাকে।

ঋজুদা ইজিচেয়ার ছেড়ে নিজেও মেঝের কার্পেটের উপরে নেমে এল। তারপরে হাঁটু মুড়ে বসে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ম-ব্লা কলমটা বের করে সমুদ্রের মধ্যে একটি জায়গার ছোট বড় কয়েকটি বিন্দুকে মাঝখানে রেখে একটি গোল্লা এঁকে দিল। বলল, এই যে ছোট-বড় মিলিয়ে পাঁচ-ছটি দ্বীপ দেখছিস, তারই মধ্যে একটি হল দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড। ঠিক কোনটি যে তা আমি নিজেও জানি না।

আমাদের করণীয়টা কী? এই আরামের হোটেল ছেড়ে, এখানে দেখার মতো কত কিছু আছে সে সব কিছু ভাল করে না দেখে, সমুদ্রের মধ্যে মোটর বোটে করে মোচার খোলার মত ভাসতে ভাসতে অজানা দ্বীপের দিকে কী করতে যাব আমরা?

যাব, দেশের কাজে। কিছু তথ্য জোগাড় করে ইন্ডিয়ান নেভিকে দেব আমরা। তাতে তাদের কাজের সুবিধে হবে। তা ছাড়া সকলেই যা করে তা না করাটাই তো ব্যতিক্রমী মানুষদের কাজ। কুণ্ডু স্পেশাল বা অন্য অনেক টুর কোম্পানিই তো পর্যটকদের নিয়ে আসেন আন্দামানে, সেই সব পর্যটক কি ‘দ্য হর্নেটস নেস্ট’ বা ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’ দ্বীপের নাম শুনেছেন, না যাবেন কখনও সেখানে? ইচ্ছে থাকলেও কি যেতে পারবেন?

তা বুঝলাম, কিন্তু দেশের কাজের ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

ভটকাই বলল।

সত্যি! তুমি মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করো না ঋজুকাকা!

এই কাজটি কি খুব বিপজ্জনক? মানে, ‘ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ যাওয়াটা?

আমি বললাম এবারে।

ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, এমনিতে বিপদ হওয়ার তো কথা নেই কোনও। তবে চাং ওয়ান যদি বিপদ ঘটাতে চায়, তবে আমরাও তার বিপদ ঘটাব। গায়ে পড়ে আমরা কিছুই করব না। তা ছাড়া আমরা তো কিছু তথ্যই সংগ্রহ করতে যাচ্ছি মাত্র।

চাং ওয়ান মানুষটি কে?

তিতির বলল।

জানবি জানবি, সবই জানতে পারবি সময়ে।

গুপ্তচরবৃত্তি বিপজ্জনক নয় কি?

ভটকাই বলল।

গুপ্তচরবৃত্তি হবে কেন? এই সমুদ্র, এই সব দ্বীপপুঞ্জ আন্দামান উপসাগর, বঙ্গোপসাগর সবই তো আমাদের। মানে ভারতেরই। এখানে বার্মা, থুরি মায়ানমার আর থাইল্যান্ড-এর বেশ কিছু মাছ-চোর আর কাঠ-চোরেরা এসে হামলা তো করেই চলেছে। তা ছাড়া আরও সাংঘাতিক কিছু করতে চলেছে তারা। মানে, চাং ওয়ান অ্যান্ড কোম্পানি। তাদের মদত জোগাতে পারে মেইনল্যান্ড চায়না, বা মায়ানমারের জঙ্গি সরকার। এমনকী পাকিস্তানও। সেই জন্যেই আমাকে এবারে এখানে আসতে বলা।

কে বলল আসতে?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

ইন্ডিয়ান নেভির ইন্টেলিজেন্স উয়িং।

ভারতীয় নৌবহর নিজে করতে পারল না কাজটা?

করতে পারত সহজেই। কিন্তু তাঁরা কারওকে বুঝতে দিতে চান না যে তাঁরা নিজেরা এই ষড়যন্ত্রর কথা বুঝতে পেরেছেন। মানে, ওঁরা যে ন্যাকা সেজে রয়েছেন একথা আমাদের শত্রুদের বুঝতে দিতে চান না।

বাংলাদেশিরা আসে না এখানে মাছ চুরি বা কাঠ চুরি করতে?

আসত অবশ্যই। যদি এইসব উপসাগর ও সাগর বাংলাদেশের কাছে হত। তাদের দৌরাত্ম সুন্দরবন অঞ্চলে, বঙ্গোপসাগরের মুখে। তারা অবশ্য ডাকাতিতে পুরোপুরিই সিদ্ধহস্ত। চুরি করে পশ্চিমবঙ্গীয় সুন্দরবনে মাছ মারা, গাছ কাটা, ডাকাতি করা, বাঘ ও হরিণ মারা ইত্যাদি তো তারা নিয়মিতই চালিয়ে যাচ্ছে।

তা আমরা কী করছি?

ভটকাই বলল।

কী আর করব!

আমরা ভারতীয়রা বড় ম্যাদামারা। যারা যে ভাষা বোঝে, তাদের সঙ্গে যে শুধু সে ভাষাতেই কথা বলতে হয়, অন্য ভাষাতে যে তাদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করা যায় না, এই সহজ কথাটা আজ অবধিও আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না। জানি না, কবে আমাদের চোখ ফুটবে।

ভটকাই বলল, যা বলেছ। আমাদের wave-length হচ্ছে, ‘মেরেছ কলসির কানা তাই বলে কি প্রেম দেব না? আর সেই জন্যেই সকলেই আমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছে।

তোমার ওই সাংঘাতিক কিছুটা কী ঋজুদা?

একটু যেন ভয় পাওয়া গলাতেই বলল, তিতির।

ঋজুদা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, হঠাৎ গলা নামিয়ে, প্রায় ফিসফিস করে বলল, দেখে আয় তো ভটকাই, আর ঘরের দরজার বাইরে কেউ আছে কি না?

বলেই বলল, দরজাটা এক ঝটকাতে খুলবি।

ভটকাই উঠে গিয়ে ঋজুদার ঘরের দরজাটা এক ঝটকাতে খুলেই মুখ বাড়িয়ে তাকিয়ে পাঁচ-সাত সেকেন্ড পরেই আবার বন্ধ করে দিল।

ও ভিতরে এলে, ঋজুদা বলল, দেখলি কী?

কেউ একজন দরজার সামনেই ছিল। সম্ভবত আমাদের কথা শুনছিল। হঠাৎ করে দরজা খোলাতে চমকে উঠে তাড়াতাড়ি রিসেপশানের দিকে চলে গেল।

লোকটাকে দেখতে পেলি কি?

হ্যাঁ। পেছন থেকে। এক ঝলক।

কী পোশাকে ছিল?

ফেডেড জিনস আর হলুদ গেঞ্জি।

কোনও বিশেষত্ব নজর করলি?

এক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ভটকাই বলল, হ্যাঁ।

কী?

লোকটা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে।

কোন পায়ে খুঁত?

দাঁড়াও, ভাবি একটু।

তারপরই বলল, ডান পাটা বোধ হয় একটু ছোট, বাঁ পায়ের চেয়ে।

মাথার চুলের ছাঁট কীরকম?

বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের চিনে-জুতোর দোকানের চিনেদের মতো।

হুম।

বলল ঋজুদা। তারপর বলল, গায়ের রং কেমন?

ভটকাই বলল, ইট-চাপা ঘাসের মতো।

তার উপমা শুনে টান টান উত্তেজনার মধ্যেও ঋজুদা সমেত আমরা তিনজনেই হেসে উঠলাম।

চিনে হতে পারে?

ঋজুদা ভটকাইকে শুধোল।

হ্যাঁ। হতে পারে।

ঋজুদা আরেকবার বলল, হুম।

একটু পরে ঋজুদা বলল, কাল সকালে আরও তিনটি ম্যাপ আমাদের জন্যে পাঠিয়ে দেবে পোর্ট-ব্লেয়ারের ন্যাভাল কম্যান্ড থেকে। তবে দেখে মনে হবে, তিনটি বইই বুঝি। সেগুলো তোরা নিজের নিজের কাছে রাখবি, নিজের নিজের সুবিধে মতো দাগ বা চিহ্নও দিয়ে রাখবি। একজনের ম্যাপ অন্যকে দিবি না।

আমি বললাম, ঋজুদা, তোমার সঙ্গে সঙ্গে এ পর্যন্ত দেশে বিদেশে এত জায়গাতে এতরকম বিপজ্জনক অ্যাডভেঞ্চারে গেলাম, কত জায়গার মানুষখেকো বাঘ, গুণ্ডা হাতি শিকার করলাম, গোয়েন্দা শিরোমণি হয়ে কত রহস্য ভেদ করলাম কিন্তু ঠিক এইরকম বিপজ্জনক কোনও মিশান-এ আমরা আগে এসেছি বলে আমার তো মনে পড়ছে না। পুব আফ্রিকার রুআহাতে, কিলালা এবং আন্তর্জাতিক চোরা শিকারিদের সঙ্গে আমাদের রীতিমতো যুদ্ধই লড়তে হয়েছিল কিন্তু এই আন্দামানের ব্যাপারটা একেবারেই অন্যরকম বলে মনে হচ্ছে।

ঋজুদা গম্ভীর হয়েই ছিল। গম্ভীরতর মুখে আমাদের দিকে চেয়ে বলল, তা ঠিক। এখন ভাবছি, একাই যাব পরশু। তোরা এই হোটেলেই থাক, মজা কর, যা যা দ্যাখার জায়গা আছে সব দ্যাখ-ট্যাখ, আমি ফিরে আসব দিন সাতেক পরে।

বললেই হল? আমরা কি….

ভটকাই তিতিরের মুখ থেকে কথা কেড়ে বলল, পোলাপান?

তিতির বলল, নো-ওয়ে। তোমাকে আমরা ছাড়ছি না, তুমিও আমাদের ছাড়ছ না। তবে একটাই অনুযোগ আমাদের। তুমি এবারে আমাদের একেবারে অন্ধকারে রেখে দিয়েছ।

ঋজুদা হাসল অনেকক্ষণ পরে। বলল, তোরা সকলে মিলে প্রার্থনা কর ‘Let there be light.’

তারপরে বলল, যাও, নিজের নিজের ঘরে বিশ্রাম করো গিয়ে। তোমাদের নিয়ে বিকেলে বেরোব সাড়ে চারটেতে। অ্যাকোয়া স্পোর্টস কমপ্লেক্সে’ যাব। সেখানে গিয়ে যার যা খুশি কোরো, সমুদ্রের জলে স্কুটার চালিও, ওয়াটার-স্কি কোরো, স্পিডবোট চালিও, কিন্তু দেখো, দয়া করে সমুদ্রে ডুবে মরো না। লাইফ-জ্যাকেট পরে নেবে সকলেই, সমুদ্রের মধ্যে চিতপটাং হলে যাতে তোমাদের উদ্ধার করা যায়। ওরাই অবশ্য জোর করে পরিয়ে দেবে।

ভটকাই বলল, আমরা কি পাগল? সবে চাং ওয়ান-এর আভাস পেলাম আর এখুনি জলে ডুবে মরব?’ ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’ না দেখেই।

ঋজুদা ভটকাই-এর কথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, ঠিক সাড়ে চারটেতে লবিতে দেখা হবে। যে টাটা সুমোটা আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এসেছিল হোটেলে পরশু দিন সকালে, সেইটাই আসবে। লালরঙা।

ঠিক আছে।

বলে, আমরা তিনজন ঋজুদার ঘর থেকে চলে এলাম।

করিডর-এ বেরিয়ে তিতির বলল, দুপুরবেলাতে আবার বিশ্রাম কি? আমরা কি বুড়ো নাকি? ঋজুদা নিজেই থোরি বিশ্রাম নেবে। চলো সবাই আমার ঘরে।

ভটকাই বলল, চলো।

.

০৪.

তিতিরের ঘরে ঢুকে একজন ইজিচেয়ারে আর দু’জন খাটে উঠে বসলাম। একটা বালিশ টেনে নিয়ে ভটকাই বলল, আমার নাম ভটকাই, তোমার বালিশ চটকাই।

তিতির ভটকাই-এর বোকা বোকা রসিকতাতে কান না দিয়ে বলল, যাই বলো রুদ্র, ভাবতেই অবাক লাগছে যে ঋজুদার সঙ্গে আমরা কোথাও জাস্ট বেড়াতেই এসেছি। সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র নেই, টেনশন নেই, ছদ্মবেশ ধারণ নেই, শুধু খাওয়া-দাওয়া বেড়িয়ে বেড়ানো আর গল্প করা।

ভটকাই বলল, ওরকম বোলো না। Keep your fingers crossed.

আমি বললাম, বাবাঃ হলটা কী? এ যে দেখি সাহেব হয়ে গেছে। যখন তখন ইংরেজি ফুটোচ্ছে।

তিতির বলল, কিন্তু ও কথা কেন ভটকাই? হোয়াই শুড উই কিপ আওয়ার ফিঙ্গার্স ক্রসড?

কখন যে কোন নতুন মূর্তিমান এসে হাজির হয়ে ঋজুদার সাহায্য চেয়ে বসবে আর আমাদের বেড়াতে আসার বারোটা বাজবে তা আগে থেকে কে বলতে পারে! আমার তো মনে হয় যে ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডই যথেষ্ট কমপ্লিকেটেড ব্যাপার।

তা যা বলেছিস। হাজারিবাগের মুলিমালোয়তে বেড়াতে গিয়ে যেমন সেবারে ঋজুদার আর আমার অ্যালবিনো বাঘ আর জোড়া খুনের রহস্যভেদ করতে হল।

আমি বললাম।

কেন? পুরানাকোটে গিয়েই বা কী হল?? সাতকোশিয়া গণ্ড অভয়ারণ্য দেখতে গিয়ে কী সাংঘাতিক মানুষখেকো বাঘের সঙ্গেই না টক্কর দিতে হল তোমার আর ঋজুকাকার।

এবার তিতির বলল।

ভটকাই বলল, যাই বলিস রুদ্র, তোর লাকটাই আলাদা।

কেন?

আফ্রিকার সেরেঙ্গেটিতেই হোক, কি ওড়িশার পুরানাকোটে, আহত ঋজুদাকে তুইই তো বারবার বাঁচিয়ে হিরো হলি। আর আমি জিবরাই রয়ে গেলাম।

বাঁচাতে না পারিস তুই আমাকে আর ঋজুদাকে মারার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা করে ফেলেছিলি নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে।

তারপর বললাম, তা নয়, মানে আমি হিরো নই। মধ্যপ্রদেশের ঝিঙ্গাঝিরিয়াতে কী হল? ঋজুদা না বাঁচালে ঝিঙ্গাঝিরিয়ার বাঘ তো কম্মোফতে করে দিয়েছিল আমার।

সে কথা ঠিক। তবে it was very mean of you রুদ্র।

কোনটা? কীসের কথা বলছ?

আমি জিজ্ঞেস করলাম তিতিরকে।

ঝিঙ্গাঝিরিয়াতে ভটকাইকে তো বটেই আমাকেও না নিয়ে যাওয়াটা।

বাঃ রে। সব জেনেশুনেও যদি আমাকে দোষী করো তো আমার বলার কিছুই নেই। আমি তো তল্পিবাহক। সব কম্মোই তো কর্তারই ইচ্ছায়।

ভটকাই, for a change, অত্যন্ত উদার এবং ন্যায়পরায়ণ হয়ে গিয়ে বলল, এ কথা তো আমাদের ভুলে গেলে চলবে না তিতির যে, রুদ্র রায়ই ঋজুদার আদি ও অকৃত্রিম সাগরেদ, অরিজিনাল। আমরা তো এসেছি অনেকই পরে।

তিতির বলল, তা ছাড়া, এও ভুললে চলবে না, রুদ্রই সব ঋজুদা কাহিনীগুলি লিখে ফেলে ঋজুদাকে সমস্ত বাঙালি পাঠক পাঠিকার কাছে পৌঁছে দিয়েছে। আজ যে বাঙালির প্রতিটি দ্বিতীয় পরিবারের ছেলেদের মধ্যে একজন করে ঋজু পাওয়া যাচ্ছে এর পিছনে রুদ্রর লেখা ঋজুদা কাহিনীগুলির অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। উই মাস্ট গিভ দ্য ডেভিল ইটস ডিউ।

ওসব কথা তো সকলেরই জানা। এসব কথা থামিয়ে বললো তো এখন ভটকাইবাবু আমরা যখন ঋজুদার ঘরে বসে ম্যাপ দেখছিলাম তখন যে লোকটা বন্ধ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছিল সে লোক্টা কে?

সেটাই রহস্য। ঋজুদাও তো ভাঙল না। চাং ওয়ান না কার নাম বলল, সে নয় তো?

কী করে বলব বল? তোরা কি আর ঋজুদাকে জানিস না? যখন তার ইচ্ছে হবে তখনই এই রহস্য ফাঁস করবে। তার আগে জানার কোনও উপায়ই নেই।

এই ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ আমরা যাচ্ছি কেন?

ভটকাই বলল।

আমার মনে হয়, গাছ-গাছালি পাখ-পাখালি চেনবার জন্যে। মাছও চেনা হতে পারে। কোরালও থাকতে পারে সেখানে।

তিতির বলল।

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে এটা কি আমাদের ফ্যামিলিয়ারাইজেশান ট্যুর?

সেইরকমই আর কী! আন্দামানে তো প্রতিবছরই কত বাঙালি বেড়াতে আসছে, হানিমুনে আসছে, তাদের দেখা আর ঋজুদার সঙ্গে যারা আসছে তাদের দ্যাখা তো কখনওই এক হতে পারে না। দ্যাখার যে অনেক রকম থাকে।

তা তো ঠিকই।

আমাদের কথার মধ্যে ঢুকে পড়ে ভটকাই বলল, দ্যাখ দ্যাখ রুদ্র, ওই নৌকোটাকে দ্যাখ। এখানে এসে অবধি দেখছি চারদিক খোলা অথচ ছাদওয়ালা মোটর বোটটা বালি বোঝাই করে আসছে, পোর্ট ব্লেয়ারের দিক থেকে, সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে। সামনের ডান দিকের দ্বীপটার আড়ালে চলে যাওয়াতে সমুদ্রের ঠিক কোথায় যে যাচ্ছে তা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বালিগুলো কোথাও ফেলে দিয়ে আবারও ফিরে যাচ্ছে পোর্ট ব্লেয়ারের দিকে। এমন করে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত যাওয়া-আসা করছে। কালও দেখেছি। কেন? বলতে পারিস?

তিতির বলল, আমিও লক্ষ করেছি।

তারপর বলল, আমার মনে হয়, পোর্ট ব্লেয়ারে ড্রেজিং হচ্ছে, পাচ্ছে বন্দরের নাব্যতা কমে যায় তাই ড্রেজার বালি খুঁড়ছে এবং নৌকোটা সেই বালি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দূরের গভীর সমুদ্রে ফেলবে বলে। নয়তো…

ড্রেজার বালি তুললে এইটুকু নৌকোতে তা মোটেই আটত না। তা ছাড়া ড্রেজার বালি তুলে তার নিজের পেটেই রাখে তখনকার মতো। আমার মনে হয় ওই বালি রসস আইল্যান্ড বা ভাইপার আইল্যান্ড বা অন্য কোনও দ্বীপে বাড়ি ঘর বানাবার বা অন্য কনস্ট্রাকশানের কাজে লাগবে বলে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোটা।

তিতির বলল।

আমি বললাম, চুলোয় যাক গে বালি-বোঝাই নৌকো। তার চেয়ে তিতির আমাদের মেগাপড পাখির কথা বলল। তুমি তো শুনলাম আন্দামান সম্বন্ধে প্রচুর পড়াশোনা করে এসেছ।

ছাড়ো তো৷ ঋজুকাকার কথা! সবতাতেই বাড়িয়ে বলে।

মোটেই নয়, ঋজুদা যখন বলেছে তখন ঠিকই বলেছে। আমাদের তিনজনের মধ্যে তুমিই পণ্ডিত, কত পড়াশুনো তোমার, কতগুলো ভাষা জানো তুমি। আমি আর রুদ্র হচ্ছি ঋজুদা অ্যান্ড কোম্পানির মাসমেন, দমাদ্দম গুলি চালিয়ে শত্রু সাফ করতে পারি আর তুমি হচ্ছ গিয়ে আমাদের থিংকট্যাঙ্ক।

আমাদের মস্তিষ্ক।

ভটকাই ফুট কাটল।

এরকম করে আমার পেছনে লাগলে আমি চললাম।

কোথায়?

ওই সামনের ছোট্ট জেটিতে গিয়ে বসে সমুদ্র দেখি গিয়ে।

সত্যি! কী সুন্দর না? জেটিটা। আগে নিশ্চয়ই ওই জেটি ব্যবহৃত হত সমুদ্র থেকে এই হোটেলে যাওয়া-আসার জন্যেই।

এখনও হতে পারে। কোনও কারণে হয়তো এখন তালা মারা আছে।

তালা মারা আছে অন্য কারণে।

ভটকাই বলল।

কী কারণে?

ব্যর্থ প্রেমিক আত্মহত্যা করতে পারে। ওইখান থেকে এক ঝাঁপ মারলেই তো কালাপানিতে প্রাণ যাবে। জল ওখানে কত যে গভীর বুঝতেই পারছ-হর্ষবর্ধনকে যখন কোল দিচ্ছে ওই খাঁড়ি। তা ছাড়া স্রোতও তো সেরকম। ঐরাবত ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তা ছাড়া লক্ষ করেছ যে কোনও তটভূমি নেই। দু’পাশের পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বইছে সমুদ্র। সমুদ্র আছে অথচ বালুবেলা নেই, ভাবা যায় না।

ভটকাই বলল।

আত্মহত্যার কথাটা খুব ভুল বলেনি ভটকাই। এত বড় হোটেলে দু’-একজন ব্যর্থ প্রেমিক-প্রেমিকা তো থাকতেই পারে।

তা ছাড়া, হানিমুনিং কাপলসও আসে অনেক।

তাদের মধ্যেও নতুন বিয়ে হওয়া সেন্টিমেন্টের বড়িও কেউ কেউ থাকতে পারে।

আনকোরা নতুন স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেও আত্মহত্যা করতে পারে।

এই বে-আইল্যান্ড হোটেলই কী সবচেয়ে বড়?

পোর্ট ব্লেয়ারে?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল আমাকে।

আমি হেসে বললাম, তুই কি আমাকে আন্দামানের উপরে অথরিটি ঠাউরিয়েছিস না কি?

তিতির বলল, বড় তো বটেই, বনেদিও। আই.টি.সি’র এই হোটেল হওয়ার পরে অবশ্য অনেক ভাল ভাল হোটেল হয়েছে, সরকার এবং বেসরকারি। পিয়ারলেস কোম্পানি বড় হোটেল করেছেন একটা, সিনক্লেয়ারসও করেছেন শুনেছি। সরকারি নতুন হোটেলটিও চমৎকার–সমুদ্রর সৌন্দর্য যেখান থেকে আরও ভাল দেখা যায়। বে-আইল্যান্ড তো পোর্ট ব্লেয়ারের এক দিক থেকে আসা সব জলযানেরই ‘পোর্ট সাইডে’ পড়ে। এই খাঁড়ি দিয়ে কলকাতা, মায়ানমার, ফিলিপিন্স ইত্যাদি জায়গা থেকে যে সব জাহাজ আসে সেই সব জাহাজ যায়, তা এই হোটেলে বসেই দেখা যায়। উলটোদিকের পাহাড়ের শেষ প্রান্তের লাইটহাউসটাও এখানে যাঁরা থাকেন তাঁদের উপরি পাওনা।

ভটকাই বলল, ‘পোর্ট সাইড’ মানে?

ওঃ। তিতির বলল, কোনও জাহাজ এমনকী এয়ারক্র্যাফটেরও বাঁদিককে বলে ‘পোর্ট সাইড’ আর ডানদিককে বলে–স্টারবোর্ড সাইড। যেহেতু প্রতিটি জাহাজ বা নৌকোর বাঁদিকটাই ডাঙার দিকে থাকে এবং বন্দর তো ডাঙাতেই থাকে, তাই বাঁদিকটার নাম পোর্ট সাইড। আর উড়োজাহাজও যেহেতু আকাশের জাহাজ তাদের বেলাও সেই একই নাম।

যেদিকে এয়ারপোর্ট সেটি এরোপ্লেনের পোর্ট সাইড। ওয়াটার craft-ই হোক কি এয়ার craft সকলেরই বাঁদিক ডানদিককে পোর্ট সাইড আর স্টারবোর্ড সাইড বলে।

ভটকাই বলল, মিস্টার রুদ্র রায়, কিছুদিন হল তোমার লেখার সমালোচকেরা বলতে আরম্ভ করেছেন যে তোমার লেখা নাকি বড় বেশি ইনফরমেটিভ। তাঁরা হয়তো ভুল বলছেন না।

সেটা কি দোষের?

আমি বললাম।

তাঁরা তো দোষেরই বলেন। জানি না, হয়তো অন্য কোনও দোষ খুঁজে পান না বলেই বলেন।

তিতির বলল, শিক্ষিত মানুষদের লেখা তো ইনফরমেটিভই হওয়া উচিত। বিশেষ করে রুদ্র যখন মুখ্যত কিশোরদের জন্যেই লেখে।

বাঃ তা কেন? রুদ্রর ঋজুদা কাহিনীগুলো তো আমার দাদু থেকে পুঁচকে পটকাই সকলেই সমান আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখি।

তোমার ছোট ভাই স্নিগ্ধর ডাক নাম কি পটকাই না কি?

তা কেন হবে? ওর নাম স্নিগ্ধই। ডাক নাম স্নি। কিন্তু আমি ডাকি পটকাই বলে। তোরা আমাকে যখন তখন দুহাতে চটকাবি, বলবি, ‘ওরে ওরে ভটকাই, আয় তোরে চটকাই’ আর আমি আমার একমাত্র ছোট ভাইকে একটু পটকাব না।’ বাড়িতে আমি একাই ওকে পটকাই বলে ডাকি, মা এবং অন্য সকলের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও।

তিতির বলল, কারা রুদ্রর লেখাকে ইনফরমেটিভ বলে দোষারোপ করেন জানি না কিন্তু বাংলার শিশু ও কিশোর পাঠ্য সাহিত্যে ইনফরমেশানের অত্যন্তই অভাব ছিল। কিছু লেখকদের আই-কিউ, সাধারণ জ্ঞানের লেভেল, এতই নিচু যে, তাঁদের কাছ থেকে ইনফরমেটিভ লেখা আশাই করা যায় না। তার ফলে শিশু ও কিশোররা শুধু মনগড়া, আজগুবি এবং কষ্টকল্পিতই নয়, পুরোপুরি point less সাহিত্য পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আজকাল বাংলা বই পড়ার প্রবণতা যে তাদের মধ্যে ক্রমশই কমে যাচ্ছে সে জন্যে লেখকদের একটি বড় অংশও কম দায়ি নয়।

এটা অবশ্য তুমি ঠিকই বলেছ। বাংলা গোয়েন্দা কাহিনীতে গোয়েন্দা পিস্তল নিয়ে খুনির ডেরাতে গিয়ে পৌঁছে কোমরের ‘রিভলবার’ দিয়ে দমাদ্দম গুলি ছোড়েন। এ একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। পিস্তল আর রিভলবারের মধ্যে যে তফাত আছে এবং তফাতটা কী তা কিশোর কিশোরীদের আরও অন্য অনেক কিছুরই মতো জানা উচিত। সব লেখকই তো আর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা খগেন মিত্র নন। চাঁদের পাহাড়’, মরণের ডংকা বাজে’ বা ‘ভোম্বল সর্দার’ বা তারও আগে গিয়ে বলতে পারি ছবি-লেখা অবনঠাকুরের ‘রাজকাহিনী’র মতো বই নেহাত সাহিত্যগুণেই উতরে যেতে পারে কিন্তু আজকালকার লেখকদের সব জোলো অন্তঃসারশূন্য পয়েন্টলেস লেখা কোন উপকারটা করে? সে সব লেখা কি তারা মনে করেও রাখে? পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তো ভুলে যায়। ভুলে যায় শুধু তাই নয়, মনে হয়, ভুলে যেতে পারলে বেঁচে যায়।

তিতির বলল।

তোমরা এ কথা বলছ বটে তিতির কিন্তু সাহিত্য তো উপকারের উপাদান নয়। উপকার হওয়ার জন্যে কেউ বই পড়ে না। উপকার করার জন্যেও কেউ বই লেখেন না।

আমি বললাম।

তিতির বলল, ভুল কথা। কিছু জোর করে শেখানোটা সাহিত্য আদৌ নয়, সেটা আমি মানি কিন্তু যে সাহিত্যে কোনও আদর্শ নেই, কিছুমাত্র শেখবার নেই, কিশোর-কিশোরীদের চরিত্র গঠনেরও কোনও ব্যাপারই নেই, সেই সাহিত্য আমাদের মতো কিশোর-কিশোরীরা না পড়লেও কিছুমাত্র যায় আসে না। শিক্ষণীয় যা, তা লেখার মধ্যে এমনভাবে মিশিয়ে দেওয়া উচিত যাতে পড়ুয়ারা বুঝতেই না পারে যে, তারা কিছু শিখছে। তবেই না তারা সে বই পড়বে। নইলে তো পাঠ্যপুস্তকেরই মতো তা পড়তে গাঁই ছুঁই করবে। তাই না রুদ্র?

সেটা অবশ্য ঠিক।

আমি বললাম।

তারপরে বললাম, কে কী বলল তাতে আমার বয়েই গেল। ঋজুদা কাহিনীগুলি আমি লিখি আমারই আনন্দের জন্যে। এই সব লেখাতে আমাদের দলের এই কজনের, ডাইরির মতো, দলিলের মতো, গ্রুপ ফোটোর মতো আমাদের এক এক জায়গার অভিযান, শিকার, রহস্য উদঘাটনের স্মৃতি অথবা এবারের মতোই নিছক বেড়ানোরই স্মৃতি নথিবদ্ধ হয়ে থেকে যায়। অনেকদিন পরে যখন আমার লেখা বইয়ের পাতা ওলটাই কত পুরনো কথা, পুরনো স্মৃতি চোখের সামনে জলজ্যান্ত ভেসে ওঠে–ওইটাই তো আমার এবং আমাদের মস্ত লাভ। অন্যে পড়ল কি পড়ল না তাতে বয়েই গেল!

.

০৫.

দারুণ জায়গা এই চিড়িয়াটাপ্প। সত্যিই দারুণ। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে এখানে আসার পথটি ধরে এগোতে এগোতেই তা বুঝতে পারলাম। পথই যদি এত সুন্দর হয় তবে গন্তব্য না জানি আরও কত সুন্দর হবে।

পুরো পোর্ট ব্লেয়ারটিই একটি মস্ত দ্বীপ। পাহাড়, নদী এবং সৈকতে ভরা। উঁচু নিচু পথ দিয়ে চমৎকার নিসর্গর মধ্যে দিয়ে গিয়ে আমরা পৌঁছব এই গভীর। আদিম বনের মধ্যের ছায়াচ্ছন্ন চিড়িয়াটাপ্পুতে।

ঋজুদা বলছিল, এখানেও একটি সৈকত আছে শুনেছি কিন্তু তেমন সুন্দর নয়। রুক্ষ। স্নান করারও অযোগ্য। বেলাভূমি বলতে পুরী বা দিঘা বা গোয়া বা কোভালম যা বোঝায় তা ওখানে নেই কিন্তু আন্দামান, আন্দামানই। এই সব পাহাড়, নিবিড় বন এবং সমুদ্রর মধ্যে এক আদিমতার গন্ধ আছে। প্রাক-ইতিহাস এখানে নীরবে কথা বলে।

পোর্ট ব্লেয়ারের বে-আইল্যান্ড হোটেল থেকে সকালে ব্রেকফাস্ট করে সাড়ে ন’টা নাগাদ সঙ্গে প্যাক-লাঞ্চ নিয়ে আমরা চিড়িয়াটাপ্পর দিকে বেরিয়েছিলাম। ঋজুদা বসেছিল টাটা সুমোর সামনের সিটে। তার পাইপের গোল্ড ব্লক তামাকের সুগন্ধ আর আমাদের তিনজনের নানা সওয়ালের লাগাতার জবাবে টাটা সুমোর ভিতরটা ভরে উঠছিল। আমরা যেভাবে প্রশ্ন করছি তিনজন ঋজুদাকে সকালে এবং ঋজুদাও বিনা প্রতিবাদে জবাব দিয়ে যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ঋজুদা যেন কোনও ট্যুর-অপারেটরের গাইড। পথের দুপাশের সব কিছু দেখাতে দেখাতে, চেনাতে চেনাতে চলেছে। কারণ ওটাই তার কর্তব্যকর্ম।

ছাব্বিশ কিমি পথ। কিন্তু কী সুন্দর। উপরে ঘন নীল আকাশ। পথের এক পাশে নীল সমুদ্রর দাপাদাপি ও উচ্ছ্বাস কখনও দেখা যায় কখনও আবার উঁচু নিচু জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি পথের আড়ালে সে মুখ লুকোয়। গাছেদের মধ্যে দেখলাম একমাত্র নারকোল গাছই চিনি এখানের আর সব গাছই প্রায় অচেনা। গাছপালা কিছু চিনি বলে মনের মধ্যে অজানিতে যে গর্বের বেলুন ফুলেছিল তা এখানে আসার পরই নিঃশব্দে ফেটে গেছে।

ঋজুদা শান্তিনিকেতনী কায়দায় গলা তুলে বলল, লাগল কেমন?

আমরাও সমস্বরে শান্তিনিকেতনী কায়দায় জোর গলাতে বললাম ভা–লো।

ঋজুদা বলল, আমরা যেখানে গিয়ে থামব চিড়িয়াটাপ্পর শেষ প্রান্তে সেই জায়গাটার নাম কারবাইনস কোভ। দক্ষিণ আন্দামানের শেষ প্রান্ত হচ্ছে। চিড়িয়াটাপ্পর এই কারবাইনস কোভ। সেখানে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ জঙ্গল আছে। সমুদ্রের মধ্যের পনেরোটা দ্বীপ নিয়ে প্রায় তিনশো বর্গমাইল জুড়ে একটি ন্যাশানাল পার্কও নাকি গড়ে উঠেছে ওই দক্ষিণ সমুদ্রে।

তারপরে বলল, আমরা কারবাইনস কোভ-এর ছায়া সুনিবিড় বনের কোনও বড় গাছের ছায়াতে বসে কফি খাব। কী রে তিতির? খাব তো?ফ্লাস্কে করে এনেছিস তো কফি? নাকি ভুলে মেরে দিয়েছিস?

তুমি কিচ্ছু ভেবো না। প্লাস্টিকের গ্লাস, দু’ ফ্লাস্ক ভর্তি কফি, বালির উপরে বিছিয়ে বসার জন্যে তোয়ালে, এমনকী রাক্ষস দু’জনের জন্যে বিস্ক-ফার্মের চকোলেট বিস্কিটস পর্যন্ত।

সে কী রে! এই তো জম্পেশ করে ব্রেকফাস্ট খেলি কর্নফ্লেকস, দুধ, বেকন ও হ্যাম, কষে সরষে দিয়ে। গোটা দুয়েক করে টোস্টও তো খেলি দেখলাম সঙ্গে। আর এরই মধ্যে…

শুধুই টোস্ট ঋজুকাকা! তুমি জ্যাম আর মাখনের পুলটিসগুলো লক্ষ করনি টোস্টগুলোর উপরে? এক একটা এক এক ইঞ্চি। সত্যিই এরা রাক্ষস।

তিতির বলল।

তুমি ফিগার করো। সুন্দর ফিগার না হলে তো মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না আজকাল, আমাদের ডায়েটিং করার কী দরকার।

আমাদের খাওয়া নিয়ে খোঁটা দেওয়াতে রেগে গিয়ে বলল ভটকাই তিতিরকে।

আজকালকার মেয়েদের বিয়ে হয় না মিস্টার ভটকাই।

চুল ঝাঁকিয়ে বলল তিতির।

তবে কী হয়?

আজকালকার মেয়েরা বিয়ে করে। বিয়ে হওয়া আর বিয়ে করার মধ্যে বিস্তর তফাত মিস্টার ভটকাই।

বিয়ে কোনও ভদ্রলোক করে? যাদের জীবনে কিছুই করার নেই তারাই করার মধ্যে একটা বিয়ে করে ফেলে। ভাবা যায় না!

ভটকাই বলল, আক্রমণের সুরে।

আমি বললাম, তোমরা বড় দূরে চলে যাচ্ছ প্রসঙ্গ থেকে। হচ্ছিল ফিগারের কথা। আমি বলব, খাও, তারপর একসারসাইজ করে বার্ন-আউট করো। সেটাই সবচেয়ে ভাল।

ঋজুদা বলল, রাইট।

তারপরই বলল, ওই দ্যাখ, ওই গাছটা প্যাডক। এখানের বিশেষ গাছ। খুব বড় হয় গাছগুলো। এর কাঠেরও খুবই কদর।

বাবাঃ কী বড় গাছ রে বাবা! প্রাগৈতিহাসিক গাছ নাকি?

ভটকাই বলল।

এই প্যাডক আন্দামানের endemic। আসলে এখানের সব গাছই যে endem ic তা তো নয়, যদিও সে দিন তাই বলেছিলাম। ভুল বলেছিলাম, অন্যমনস্কতায়। উদ্ভিদও আছে এখানে প্রায় দুহাজার রকম। তার মধ্যে শুনেছি প্রায় আড়াইশো রকম endemic

আর পাখি?

তিতির বলল।

প্রায় আড়াইশো রকম পাখি আছে তার মধ্যে প্রায় আশিটা endemic। প্রায় আশি রকম সরীসৃপও আছে। এই জঙ্গলে মাংসাশী জানোয়ার তো নেই তবে বিষধর সাপ আছে নানারকম। জলে এবং জঙ্গলে। হরিণ ছিল অগণ্য। এক সময়ে কেউ হরিণ শিকার করে হরিণের দুটি কান বনবিভাগে নিয়ে গিয়ে দেখালে তাকে শটগানের একটি গুলি, এল জি বা এস জি, আর দুটি করে টাকা দেওয়া হত। হরিণের জন্য আন্দামানে চাষবাস করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

আর এখন?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

এখন সব জায়গারই মতো কমে এসেছে হরিণের সংখ্যা। কমবেই। মানুষ যেখানেই বসতি করবে সেখানেই প্রকৃতির উপরে চাপ আসবে–পশু, পাখি, প্রজাপতি সবই কমে আসবে ক্রমশ। এমন সর্বভূক, সর্বগ্রাসী জানোয়ার বিধাতা তো আর দুটো তৈরি করেননি।

মেগাপড পাখির কথা সেদিন বলতে গিয়ে থেমে গেলে। বলল না ঋজুকাকা। মেগাপড কি একটাও দেখা যাবে না?

আছে হয়তো, আমার ঠিক জানা নেই, তবে সংখ্যাতে নিশ্চয়ই কমে গেছে, যদি থেকেও থাকে।

এখানে মেগাপড নামের একটি দ্বীপ আছে শুনেছি মেজোমামার কাছে।

তিতির বলল।

আছেই তো! একটি রেস্তোরাঁও আছে। এই সব দেখেই মনে হয় যে মেগাপড বোধহয় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাই এখন দ্বীপের নাম আর রেস্তোরাঁর সাইনবোর্ডেই বেঁচে আছে। মেগাপড পাখি যে ডিম পাড়ে তা থেকে বাচ্চা ফুটে যখন বেরোয়, তখন তারা পুরোপুরিই স্বাবলম্বী। অনেকটা হাঁসের বাচ্চাদেরই মতো।

ভারী ওস্তাদ তো তারা। উড়তে পারে জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই? হাঁসের বাচ্চারা যেমন সাঁতার কাটতে পারে।

ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

দূর। মেগাপড যে উড়তেই পারে না! আর উড়তে পারে না বলেই তো ওদের বংশ অত সহজে নাশ করতে পারল মানুষে। এই পৃথিবীর উপর তার একারই যে একমাত্র দাবি নেই, অগণ্য পশু-পাখি প্রজাপতি সরীসৃপের এমনকী পোকা-মাকড়েরও আছে, এই সহজ ও স্বাভাবিক সত্যটা মানুষে কখনওই যে। মেনে নিতে পারল না।

ঋজুদা বলল।

এখন মানছে।

তিতির বলল।

না মেনে উপায় নেই বলেই মানছে। একেই বলে ঠেলার নাম বাবাজি।

ভটকাই যথারীতি ফুট কাটল।

ছাব্বিশ মাইল পথ, আমরা যেন আকাশ আর সমুদ্র, আদিম রেইন ফরেস্টস আর মানুষের লাগানো নারকোল বীথির মধ্যে উঁচু নিচু পথের নাগরদোলায় চেপে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই এসে পৌঁছে গেলাম চিড়িয়াটাপ্লুতে। পথটা ক্রমশ বনবীথিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। দু’পাশ থেকে জঙ্গল চেপে ধরছিল, যেন চেপেই মারবে। জায়গায় জায়গায় আকাশও দ্যাখা যাচ্ছিল না। আর তার বদলে বনের চন্দ্রাতপ বিছিয়ে দিয়েছিল কোনও অদৃশ্য নিপুণ হাত যেন।

ঋজুদা বলল, আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।

কারবাইনস কোভ-এ গাড়ি থেকে নেমেই ভটকাই বলল, যাই বল আর তাই বল ঋজুদা, আন্দামানকে তেমন করে উপভোগ করতে হলে বর্ষাকালে একবার আসতে হবে। বর্ষাকালে ওই দ্বীপপুঞ্জের চেহারাটা ঠিক কেমন হয়, সামুদ্রিক ঝড় আর বৃষ্টি কেমন করে ওয়াশিং-মেশিনের মতো একে বোয়া-পাকলা করে তা নিজের চোখে একবার দেখবই।

ধোয়াটা তো জানি, পাকলাটা কী ব্যাপার?

তিতির জিজ্ঞেস করল ভটকাইকে।

ভটকাই হেসে বলল, ফরিদপুরিয়া শব্দ, এখন বাংলাদ্যাশি। আমার বড় ঠাকুমা ফরিদপুরের মেয়ে। তাঁর মুখেই শুনেছি এই ধোয়া-পাকলা শব্দবন্ধ। কচলে কচলে বোয়াকে বোধহয় পাকলানো বলে।

আমি বললাম, ভটকাইকে চটকালে যেমন হয় আর কী!

সকলেই হেসে উঠল আমার সেই কথায়, মায় ভটকাইও।

সমুদ্র থেকে মৃদুমন্দ হাওয়া আসছে। কিছু দূরেই একটা দ্বীপ। সেদিকে ম্যানগ্রোভ বেশি। এদিকের বনের মধ্যেটাও যেন নিচ্ছিদ্র। প্রায় এই ডিসেম্বরের উজ্জ্বল সকালেও ঘোরান্ধকার। ছোট ছোট ঢেউ এসে কারওর আদরের মৃদু চাপড়ের মতো সমুদ্রবেলাতে চাপড়াচ্ছে আর অস্ফুট এবং নিরবচ্ছিন্ন শব্দ উঠছে একটা। আর সেই শব্দটাকে, গুলি লাগা জল-পাখির মতো মুখে করে কোনও অদৃশ্য গোল্ডেন-রিট্রিভার কুকুরের মতো হাওয়াটা নিমেষে নিয়ে আসছে আমাদের দিকে তারপর বনের গভীরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে শব্দটাকে।

ছটফট করাটা ভটকাই-এর স্বভাব। তিতির যখন শুকনো বালিতে, একটি মস্ত নাম-না-জানা গাছের তলাতে তোয়ালে পেতে কফির ফ্লাস্ক ও বিস্কিটের হ্যাঁম্পার বের করে চিরকালীন মেয়েলি দক্ষতাতে সাজিয়ে গুছিয়ে বসেছে ঠিক সেই সময়ই ভটকাইচন্দ্র বলল, চল রুদ্র, জঙ্গলের ভিতরটা একবার ইনসপেক্ট করে আসি। তুই তো দেখছি বুড়ো মেরে গেলি।

ভেবেছিলাম, আন্দামান সম্বন্ধে তিতিরের মুখ থেকে কিছু শুনব, তা না সব ভেস্তে দিল ভটকাই। আমার মনে এ কথা আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ং ঋজুদাই ‘ভেটো প্রয়োগ করল। ভটকাইকে বলল, কোথায় যাবি মিছিমিছি সাপ-কোপের কামড় খেয়ে মরতে। কাল সকালেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে, একেবারে ভোরেই, এক কাপ করে চা খেয়ে দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’-এর উদ্দেশ্যে। সেখানে পৌঁছে যত ইচ্ছে অ্যাডভেঞ্চার করিস তখন। তোর জন্যে রহস্যর মৌচাক ঝুলবে সেখানে গাছে গাছে তার উপর বিপদও থাকবে হয়তো নানারকম। আর চাং ওয়ানের বা উ থান্টের দয়া হলে তো কথাই নেই।

যে ভটকাই উত্তেজনার গন্ধ পেয়েই ফক্স-টেরিয়ার কুকুরের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠে বাধ্য ছেলের মতো বসে পড়ল বিছানো-তোয়ালের উপরে।

তিতির বলল, উ থান্টকে আবার কোথা থেকে আমদানি করলে?

আমি বললাম, ঋজুদার প্যান্ডোরাজ বক্স-এ যে কত কিছুই থাকে। উ থান্ট তো কিছুই নয়।

ঋজুদা বলল, সব ঔৎসুক্যর নিরসন এক সঙ্গে হয়ে যাওয়াটা মনের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল নয়। সময়েই সব জানবে। এখন তিতির তোমাদের আন্দামান সম্বন্ধে কিছু জানাবে। আমি তো ওকে বলিনি হোমওয়ার্ক করে আসতে অথচ ও নিজের থেকেই করে এসেছে মাত্র দশদিনের নোটিসে। শিক্ষিত মানুষের দেশভ্রমণ আর অশিক্ষিতর দেশভ্রমণে তফাত থাকেই। তোরা তিতিরকে দেখেও কিছু শিখলি না যে এত দিনেও এটা ভেবেই দুঃখ হয়।

তিতির বলল, লজ্জা দিয়ো না ঋজুকাকা। যাই শেখার তার সবই তো তোমার কাছ থেকেই শিখেছি। রুদ্রও শিখেছে। রুদ্রও কি পড়েশুনে আসেনি? নিশ্চয়ই এসেছে। কিন্তু ও হল ছুপা-রুস্তম। আগবাড়িয়ে কিছু বলতে যায় না।

এবার আমি লজ্জা পেলাম। বললাম, জানিই না কিছু, তার বলব কী।

ভটকাই বলল, ভাবছ এখানে আমিই একমাত্র মূর্খ। কিন্তু আসলে তা নই।

যে হোম-টাস্কটা তিতির আর রুদ্র এবং ঋজুদাও বটেই, আমার জন্যে আগে ভাগে সেরে রেখেছে এবং রাখে সব সময়ই তা আমি নিজে কোন দুঃখে করতে যাব? সময়টা কাজে লাগানোর জন্যে, নষ্ট করবার জন্যে নয়। ম্যানেজমেন্টের কথা এটা, পার্সোনাল টাইম ম্যানেজমেন্ট।

আমরা সবাই এক সঙ্গে হেসে উঠলাম।

তিতির বলল, কোথায় পড়তে যাবে ম্যানেজমেন্ট? ভটকাই?

আমি তো আর বড়লোকের পোলা নই যে ইংল্যান্ড আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাব পাত্তির জোরে। আমাকে এন্ট্রান্স পরীক্ষাতে বসে জোকা, কি আহমেদাবাদ বা অন্য কোথাওই পড়তে হবে।

সেখানেও তো টাকা লাগবে পড়তে। তারা তো স্কলারশিপ দেয় না, যদিও দেওয়া অবশ্যই উচিত।

আমি বললাম।

সে টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। তোরা সকলে মিলে দিবি ধার। নইলে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ধার নেব। আজকাল তো ব্যাঙ্কও ধার দিচ্ছে মেধাবী ছাত্রদের। আর তাও যদি না পাই তবে তোর পিস্তলটা একদিনের জন্যে ধার নিয়ে কোনও বড়লোকের নিগুণ কোনও ব্যাটা বা জামাইকে ভড়কানি দিয়ে টাকা জোগাড় করে নেব। হোয়ার দেয়ার ইজ এ উইল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে। পড়িসনি?

ঋজুদা বলল, ভটকাই, তিতির তোকে আগেও একদিন বলেছে ও কথা। ভুলে মেরে দিয়েছিস দেখছি।

কী কথা ঋজুদা?

ইংরেজিতে ‘এ’ বলে কোনও উচ্চারণ নেই। ওটা হবে ‘আ’। তা ছাড়া The শব্দটার উচ্চারণ ‘দিও হয়, ‘দ্যও হয়। কোনও স্বরবর্ণর শব্দর আগে the থাকলে তার উচ্চারণ হয় ‘দি’ আর ব্যঞ্জনবর্ণের আগে থাকলে হয় দ্য।

স্বরবর্ণ মানে?

মানে, ভাওয়েল।

আর ব্যঞ্জনবর্ণ?

কনসোনেন্ট!

আমি বললাম।

বাংলা-মিডিয়াম স্কুলে পড়েও তো ইংরেজি ফোঁটাচ্ছে কম নয় দেখি। বাংলা শব্দ জানো না, ইংরেজি প্রতিশব্দ জানো।

ভটকাই হেসে বলল, ওই আর কী! তারপর বলল, থ্যাঙ্ক ইউ। পরে আর কখনও ভুল করব না। দি আউল, দ্য কাউ, দি এনিমি, দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড। ঠিক আছে?

আজকাল ভটকাই এসব কচ্ছে। সময়ের দাম সম্বন্ধে সে এতটাই সচেতন হয়ে উঠেছে যে, সেকেন্ডকে ‘সেক’, ঠিককে ‘ঠি, দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সকে ‘ডি স্কুল’ বলছে। প্রোমো’ ‘রিক্যাপ’ এসব তো বলছেই।

অবশ্য সকলেই আজকাল তাই বলছে। হঠাৎ-ই সময়ের দাম এত বেড়ে গেল কেন তাই ভাবছিলাম আমি। যে সময়টা মানুষ এখন নানাভাবে বাঁচিয়ে ফেলছে, ই-মেইল, ইন্টারনেট-এর মাধ্যমে, সেই উদ্বৃত্ত সময় নিয়ে মানুষ কী করছে, কোন কোন বিশেষ কাজে লাগাচ্ছে তা জানতে খুবই ইচ্ছে করে। ইনফরমেশান টেকনোলজির এই রমরমার দিনে, যোগাযোগের এতরকম সুবিধে পেয়ে আমরা মানুষ হিসেবে কতটুকু উন্নতি করেছি আগের থেকে সে বিষয়ে একটা সমীক্ষা অবশ্যই হওয়া উচিত। মনুষ্যত্বর উন্নতি হয়েছে না অবনতি, সেটাও জানা অবশ্যই প্রয়োজন।

ভাবলামই। সব কথা, সব জায়গায়, সব সময়ে সকলকে বলা যায় না।

আমার ভাবনার ঘোর কাটিয়ে দিয়ে ঋজুদা বলল, এবারে এক কাপ করে কফি খেয়ে গায়ে জোর করে নিয়ে তিতির দিদিমনির দেওয়া আন্দামানের Intro শোনার জন্যে তৈরি হও।

বলেই, ভটকাই-এর দিকে চেয়ে বলল, কী রে! পার্সোনাল টাইম ম্যানেজার, শিখেছি কি একটু একটু?

ভটকাই লজ্জা পেয়ে বলল, ভাল হচ্ছে না কিন্তু ঋজুদা।

কফি আর বিস্ক-ফার্মের চকোলেট ক্রিম বিস্কিট এবং নোন্তা বিস্কিট খাওয়ার পরে ঋজুদা বলল, এবারে শুরু কর তিতির।

হুঁ। বলে, তিতির যেন শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে বসে ছোট ছেলেমেয়েদের বাংলা পড়াচ্ছে এমনি ভাবে শুরু করল। তিতিরের মধ্যেই একজন বর্ন-দিদিমনি আছেন। পড়াশুনো শেষ করে ও অধ্যাপনাই করবে এমনই ওর ইচ্ছা যে, সে কথা আমাকে বহুবার বলেছে।

তিতির বলল, আমি কিন্তু নিকোবর সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারব না এখন। নিকোবর গ্রুপে আছে গ্রেট নিকোবর, কাঁচাল, নানকৌড়ি, চাওরা, টেরিজা এবং ক্যাম্পবেল বে, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ নর্থ আন্দামান, সাউথ আন্দামান, মিডল আন্দামান ও লিটল আন্দামান নিয়ে। চিড়িয়াটাপ্পর এই কারবাইনস কোভ, সাউথ আন্দামানের দক্ষিণের একেবারে শেষাংশ। আন্দামানের মধ্যে অনেকই দেখার মতো দ্বীপ আছে যেমন জলিবয়, আমরা দেখেছি সাউথ সিনক, রেড স্কিন, মধুবন, রসস, ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই সব সুন্দর ছবির মতো দ্বীপের কোনওটিতেই বিদেশিদের রাতে থাকার অনুমতি মেলে না। দেশিরাও যাঁরা যান দিনে দিনেই ফিরে আসেন। রাতে জনমানবহীন এইসব সুন্দর দ্বীপে ডাইনি জ্যোৎস্নার মধ্যে বোধ হয় পরী আর মৎস্যকন্যারা জলকেলি করে বেড়ায়। ভাবলেও গা ছমছম করে। না?

বিদেশিরা থাকতে পারে না বটে কিন্তু ঋজুদার বন্ধু চাং ওয়ান বা উ থান্টদের কথা আলাদা।

আলাদা বলেই তো আমরা কাল যাচ্ছি দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডে।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, জাস্ট আ সেক তিতির।

ঋজুদা বলল, বাবাঃ ভটকাইচন্দ্র যে ভারী সাহেব হয়ে উঠল রে রুদ্র। কী করা যায়?

তাই তো দেখছি।

আমি বললাম।

কী বলছ, বলো?

তিতির বলল।

আন্দামান নামের কোনও ইতিহাস আছে কি?

অবশ্যই আছে। অনেকের মতে লর্ড হন্ডুমান বা হনুমান থেকেই এই দ্বীপপুঞ্জের নাম হয়েছে আন্দামান।

কেন হনুমান আবার এর মধ্যে এল কী করতে? তুমি কি বি জে পি-তে যোগ দিলে না কি?

না, যোগ দিইনি। কিন্তু দিলেও বা দোষের কী? বি জে পিও তো দেশের একটি স্বীকৃত দলই। পশ্চিমবঙ্গের মতলববাজ আঁতেলরা তাঁদের নিজ নিজ গূঢ় স্বার্থর কারণে কী ভাবেন বা কী বলেন তা নিয়ে আমার কোনওই মাথাব্যথা নেই। হনুমান এলেন এই জন্যে যে অনেকের ধারণা হনুমান লঙ্কাতে লাফ দিয়ে যাবার সময়ে তাঁর, মানে হনুর ‘ধাপ’ অর্থাৎ পা পড়ত এই দ্বীপশিরে। মানে, ইংরেজিতে থাকে বলে স্টেপিং-স্টোন আর কী!

একটু থেমে তিতির বলল, আন্দামান তো আর সল্টলেকের জলার দ্বীপ নয়। এ বহু পুরনো ব্যাপার। রামায়ণে তো এর উল্লেখ মেলেই। টলেমি ও জেরিনির লেখাতেও এর উল্লেখ মেলে।

ভটকাই বলল, রামেরই অস্তিত্ব নেই আর রামায়ণ।

তিতির বলল, তা বটে। মহম্মদ, যিশুখ্রিস্ট, গৌতম বুদ্ধ, সকলেই ছিলেন, সকলেই মান্য, শুধু রাম বলেই কেউ ছিলেন না। ভারতবর্ষ দেশটা সম্বন্ধে যাদের সামান্যতম ধারণাও আছে তারা এমন গণ্ডমূর্খের মতো কথা কখনও বলবেন না। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটা ভারতবর্ষের বাইরে নয়, সেখানে কোনও অন্য গ্রহের জীবেদের বাসও নয়। ঋজুকাকার সঙ্গে বারবার ভারতদর্শন করার পরেও যে তুমি এমন মূর্খের মতো কথা বলতে পারলে তা দেখে আমি অবাক হচ্ছি।

ঠিক আছে। উইথড্র করছি কথাটা। আগে বাড়ো।

রোম্যান জিওলজিস্টরা তাঁদের তৈরি করা বিশ্বর মানচিত্রে এই দ্বীপের উল্লেখ করেছেন ‘গুড ফরচুন’ বলে। তারপরে বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পর্যটক হিউয়েন সাঙও তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে এই দ্বীপপুঞ্জের উল্লেখ করেছেন নগ্ন মানুষের দেশ বলে। চোল রাজারা তাঁদের তাঞ্জোর শিলালিপিতেও একে ‘Nakkavaram’, মানে,নগ্ন মানুষের দেশ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে অনেকেরই ধারণা আন্দামান নামটি এসেছে মার্কো পোলোর উল্লিখিত Andamnian থেকেই।

পোর্ট ব্লেয়ার কি কারও নামানুসারে হয়েছে? ব্লেয়ার কি কোনও সাহেবের নাম ছিল?

আমি বললাম।

রাইট।

তিতির বলল। তারপর বলল, সতেরোশো ঊনব্বইতে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস-এর জমানাতে তিনি হাইড্রোগ্রাফার, ক্যাপ্টেন আর্চিবল্ড ব্লেয়ারকে বাংলা থেকে পাঠান এই দ্বীপপুঞ্জে সমুদ্রের ম্যাপ করতে। ডাঙায় যেমন ভূতত্ত্ববিদ, সমুদ্রে তেমন সমুদ্রতত্ত্ববিদ। হাইড্রোগ্রাফির বাংলা কি ঠিক বললাম ঋজুকাকা?

আমি কি তোর চেয়েও পণ্ডিত?

পাইপ ধরাতে ধরাতে বলল ঋজুদা। একটু হেসে।

তারপর বলল, কলকাতাতে ফিরে শঙ্খদার সঙ্গে কথা বলিস। ফোন নাম্বার দিয়ে দেব।

কে শঙ্খদা? শঙ্খ চৌধুরী? স্কালপটার?

না রে! তিনি তো দিল্লিতে থাকেন। কবি শঙ্খ ঘোষ। ফরফরিয়ে বেড়ান অনেকেই চেলা-চামুণ্ডা নিয়ে অল্পজলের পুঁটি মাছের মতো। কিন্তু বাংলা ভাষাটাকে গুলে খেয়েছেন শঙ্খদা। নীরেনদাকেও জিজ্ঞেস করতে পারিস। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। তবে শঙ্খদার মতো অমন প্রচার বিমুখ, লাজুক, কবিসুলভ কবি জীবনানন্দর পরে সম্ভবত বাংলাতে আর কেউই হননি।

তারপর বলল, বল তিতির। ভাগ্যিস তুই ছিলি। কত কী জানছি বল তো?

তিতির কপট রাগের সঙ্গে ঋজুদাকে শাসন করে বলল, ভাল হচ্ছে না কিন্তু। ঋজুকাকা।

বলেই, শুরু করল, আর্চিবল্ড ব্লেয়ার চ্যাথাম আইল্যান্ডে এসে আস্তানা গাড়েন। চ্যাথাম আইল্যান্ড, যেখানে করাত কল আছে, এই দ্বীপপুঞ্জেরই একটি দ্বীপ এবং তা আন্দামানের মিউনিসিপ্যালিটির মধ্যেই পড়ে। দুই দ্বীপের মধ্যে একটা ছোট সেতুরই ব্যবধান মাত্র। সেই আর্চিবল্ড ব্লেয়ারের নামেই নাম হয় এই দ্বীপের, পোর্ট ব্লেয়ার।

তারপর একটু থেমে বলল, সেদিন আমাদের হোটেলের সামনে দিয়ে যে হর্ষবর্ধন জাহাজ গেল বন্দরে তা পোর্ট ব্লেয়ারের হ্যাঁডো হাফ’ বন্দরে। অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া। দুইই পোর্ট ব্লেয়ারেই। পোর্ট ব্লেয়ারের পত্তন হবার পরে মনে হয় স্কটসম্যানদের আধিপত্য ছিল এখানে নইলে দেখলে না শহরের মধ্যে এত স্কটিশ জায়গার নামের ছড়াছড়ি! অ্যাবারডিন বাজার।

ভটকাই হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, বাবারে! আর তিতির দিদিমনির জ্ঞান ভাল লাগছে না। চলো ঋজুদা সকলে বনের মধ্যে কিছুটা হেঁটে আসি৷ ফরেস্ট বাংলোতে গিয়ে যে লাঞ্চ খাব, খিদে করতে হবে না?

কথাটা মন্দ বলেনি ভটকাই। তোর সেকেন্ড ক্লাস হবে লাঞ্চের সময়ে চিড়িয়াটাপ্পর বন-বাংলোতে। বুঝলি তিতির।

ঠিক আছে। ভালই হল। তুমিই তো ক্লাস নিতে বাধ্য করলে আমাকে। লাঞ্চের পরে রুদ্রর গান শুনব। যে যার মতো করে জেনে নেবে যা সে জানতে চায়, জোর করে জানানোর কোনও মানেও হয় না, ফতেপুর সিক্রি বা তাজমহলের বা আগ্রা ফোর্টের গাইডদের মতো।

ঠিকই বলেছিস।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, ভটকাই-এর যদি আন্দামান সম্বন্ধে আরও জানার ইচ্ছে থাকে তো সে জেনে নিজেই নেবে। তুই উলুবনে মুক্তো ছড়াতে যাবি কোন দুঃখে।

.

০৭.

ঝকঝক করছে রোদ্দুর দিগন্তলীন নীলচে কালো সমুদ্রে আর সুনীল আকাশে। হু হু করে হাওয়া এসে আমাদের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমরা মোটর বোট-এর ছাদে বসে আছি সাদা ডেকচেয়ারে। এখন এগারোটা বাজে প্রায়। আমরা মানে, ঋজুদা আমি আর তিতির। তিতির উড়াল চুলের পাগলামি থামাতে মাথায় একটা সিল্কের লাল-রঙা স্কার্ফ বেঁধেছে। ভটকাই বোটের একেবার সামনে ক্যাপ্টেন ভাদেরা যেখানে স্টিয়ারিং-এর সামনে বসে আছেন সেইখানে গিয়ে জমেছে। এরোপ্লেনের মতো না হলেও সেখানে আধুনিক গাড়ির ড্যাশবোর্ড-এর চেয়ে অনেক চওড়া ড্যাশবোর্ডে নানারঙা আলো জ্বলছে এবং নিভছেও। কমলা, লাল, নীল, সবুজ এবং লাল। কী করে মোটর বোট চলে এবং তাকে চালানো হয় সেই রহস্য জানবার জন্যই সেখানে গেছে ভটকাই। গেছে ভাল কথা কিন্তু আমার মতো ইঞ্জিনিয়ারিং না করলেই হয়। ভাবছিলাম আমি। বড় পিসেমশাই-এর একটি দারুণ ট্যাঁকঘড়ি ছিল। আমার ছেলেবেলাতে তিনি বম্বে থেকে একবার কলকাতাতে যখন এসেছিলেন পুজোর সময়ে তখন সেই দারুণ ঘড়ির মধ্যের যন্ত্রটা কী করে টিক টিক করে তা জানার উদগ্র উৎসাহে সেটাকে কয়লাভাঙা হাতুড়ি দিয়ে ভেঙেছিলাম। তারপরে অবশ্য আমার পিঠও ভেঙেছিল। ভটকাই এর যন্ত্র সম্বন্ধে উৎসাহের পরিণতি আমার মতো করুণ না হলেই হল।

ঋজুদার মাথায় হ্যাট। ঋজুদা সাহেবদের চেয়েও সুন্দর দেখতে আর তার স্মার্টনেসের কোনও তুলনা নেই। একটা ফেডেড জিনস আর হালকা মেরুন রঙা কলারওয়ালা গেঞ্জি পরেছে। দারুণ দেখাচ্ছে। তিতির ফোটো তুলল একটা ওর ক্যামেরা দিয়ে।

আমার ফোটো তুলে ফিল্ম নষ্ট করিস না। ডেভিলস আইল্যান্ডে অনেক কাজে লাগবে। সেখানে ফিল্ম ফুরিয়ে গেলে তো আর পাবি না। জানিস, আমার ভাবতেই ভাল লাগছে যে অনেক দিন পরে সমুদ্রে মাছ ধরতে পারব।

কী করে ধরবে? এই বোটে বসে? এত লম্বা লাইন কি তোমার হুইলে আছে?

আমি বললাম।

লাইন অনেকই লম্বা, মাছকে খেলাতে হবে না? তা ছাড়া এটা কি তোর পুনুদাদার সিঙ্গুরের পুকুর। এ যে সমুদুর রে! এখানের মাছেদের ব্যাপারই আলাদা। তবে ধরব তো ওই জলি-বোটেই বসে। বলেই, হাতের পাইপটা দিয়ে বোটের পেছন দিকে দেখাল। দেখি, সত্যিই তো! এতক্ষণ খেয়াল করিনি একটা ছোট নৌকো, সাদা রঙা, বসে আছে সাদা রাজহাঁসের মতো সেখানে। বোট সমুদ্রে কাপুত’ হলে এই ছোট নৌকোই লাইফ সেভিং বোটের কাজও করবে হয়তো। ভার্সেটাইল বোট।

অতটুকু নৌকোতে? ডুবে যাবে যে!

তিতির চিন্তিত হয়ে বলল।

ডুবব না রে, ডুবব না। তা ছাড়া বেশি গভীরে তো আর যাব না। দ্বীপের আশেপাশেই থাকব এবং বোটেরও কাছাকাছি। ডুবে গেলে তোরা উদ্ধার করবি।

কত বিপদে আর ফেলবে আমাদের তুমি আন্দামানে বেড়াতে এনে। চাং ওয়ান, উ থান্ট, ডেভিলস আইল্যান্ড তার উপরে আবার নৌকাডুবি?

তিতির বলল।

খুব জোরে হেসে উঠল ঋজুদা। এবং সেই হাসির শব্দ মিলিয়ে যাবার আগেই ভটকাই এসে হাজির হল রঙ্গমঞ্চে। নীচ থেকে। এসেই স্ট্রেট তিতিরকে বলল, নটিক্যাল মাইল কাকে বলে বলো তো? জলে বা আকাশে তো ডাঙার মাইল বা কিমি দিয়ে দূরত্ব মাপা হয় না, নটিক্যাল মাইলেই হয়। কিন্তু নটিক্যাল মাইল ব্যাপারটা কী?

তাই? সে তো আমরা জানিই।

তিতির বলল।

আমি বললাম, তুই কি কুইজ-মাস্টার নাকি? তাও যদি অমিতাভ বচ্চনের মতো ক্রোড়পতি করতে পারতিস তো বুঝতাম।

ভটকাই আমাকে পাত্তা না দিয়ে তিতিরকেই বলল, তা তো জানি। এক মাইলে কত মিটার বলো তো?

তিতির বলল, মিটার বলতে পারব না তবে সতেরোশো ষাট গজে এক মাইল যে সেটা জানি। মিটারে কনভার্ট করে নাও।

আর নটিক্যাল মাইলে?

আমরা সকলেই কবুল করলাম যে, জানি না।

ভটকাইকে খুব খুশি দেখাল।

তিতির বলল, তুমি কি ক্যাপ্টেন ভাদেরাকে এইসব জিজ্ঞেস করেছিলে না কি? ভালই!

‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডে’ আর পৌঁছনো হবে না আমাদের, তার আগেই বোটের ক্যাপ্টেন নিজের প্রাণ বাঁচাতে সমুদ্রে ঝাঁপ দেবেন। প্রথম থেকেই অমন অত্যাচার শুরু করো না। সইয়ে সইয়ে করো। তোমাকে আমরা সইয়ে নিয়েছি নতুন’ মানুষে পারবেন কী করে!

তিতির বলল।

হায়। হায়। যার জন্যে চুরি করি সেই বলে চোর।

ভটকাই বলল।

তারপর বলল, আমি কি একার জন্যে জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াচ্ছি নাকি আমার?

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, ভালই বলেছিস। জ্ঞানভাণ্ডার! শুনেছিস রুদ্র?

শুনছি তো। আর ভাবছি, কী ছিল আর কী হল এ ছেলে?

ভটকাই একপাক নেচেই গেয়ে উঠল।

অস্তি গোদাবরী তীরে বিশাল শাল্মলী তরু, গোদা রে-এ-এ-এ

কোথায় ছিল? কে আনিল? অস্তি গোদা-আ-আ

তিতির বলল, থামো। থামো। ক্যাপ্টেন আর ক্রুরা ভাববেন বোটে ডাকাতই পড়েছে বুঝি।

পরক্ষণেই ভার্সেটাইল ভটকাই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলল, দুপুরের খাওয়াটা জমে যাবে। কিচেন ইনসপেকশান করে এলাম। কুককেও ইন্টারভিউ করে এলাম। ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে ইদ্রিস আলি। স্ক্র্যাম্বলড এগস, টোস্ট, কমলালেবু, হর্ষবর্ধনে করে এসেছে কলকাতা থেকে, আর সাউথ ইন্ডিয়ান কফি। আধপেটাই খেতে হবে।

আর দুপুরে?

তিতির বলল।

বলব না। খাটাখাটনি সব আমি করব আর খাবে তোমরা। নিজেরা যাও, খোঁজখবর করো। খাটো, খাটো, উ্য মাস্ট আর্ন ইওর লাঞ্চ।

আমাকে ধমকেই বলল ভটকাই।

ঋজুদা আবার হেসে ফেলল, বলল, আমাদের আসল বিপত্তি দেখছি চাং ওয়ানও নয়, উ থান্টও নয়, এই ভটকাইই।

তিতির হেসে বলল, ঠাকুর, রক্ষা করো।

আমি বললাম, সদ্য শেখা জ্ঞানটা এবারে আমাদের বিতরণ করে দে।

কী?

নটিক্যাল মাইলের রহস্য।

ও হ্যাঁ। Nautical মাইল অথবা কিমি দিয়েই আকাশ বা সমুদ্রর দূরত্ব মাপা হয়। ব্রিটিশরা নটিক্যাল মাইলকে ‘অ্যাডমিরালিটি মাইল’ও বলেন। ব্রিটিশ মতে, এক নটিক্যাল মাইলে ছ হাজার আশি ফিট বা এক হাজার আটশো তেপান্ন, পয়েন্ট দুই মিটার। ইউ এস এ তে উনিশশো ঊনষাটের পয়লা জুলাই থেকে যে নটিক্যাল মাইল মানা হচ্ছে তা হল ছ হাজার ছিয়াত্তর পয়েন্ট এক এক পাঁচ ফিট বা আঠারোশো বাহান্ন মিটার।

আমি জিজ্ঞেস করলাম সমুদ্র আর আকাশের জন্যে দূরত্বর অন্য মাপের প্রয়োজন হল কেন? ডাঙার মাপ কী দোষ করল?

ভটকাই চুপ করে রইল।

তিতির বলল, ঋজুকাকা তুমি কি জানো?

ঋজুদা বলল, ঠিক বলতে পারব না। তবে মনে হয় যে, পৃথিবী তো পুরোপুরি গোল নয়, মানে, যাকে perfect sphere বলা চলে আর কী। তাই বোধহয় সমুদ্র বা আকাশের দূরত্ব মাপতে অন্য পন্থা নিতে হয় এবং মাপের তারতম্যও ঘটে। আমি ঠিক জানি না। তবে আমি শুনেছিলাম যে এক নটিক্যাল মাইল বা নট’ আমাদের ডাঙার মাইলের চেয়ে আটশো মিটার বেশি। ভটকাই ভাল বলতে পারবে।

ঋজুদাও জানে না, এমনও যে অনেক কিছু আছে, তা জেনে অবাক হলাম আমরা সকলেই। আবার আশ্বস্তও হলাম, ঋজুদা সর্বজ্ঞ নয় বলেও। ঋজুদা নিজে অবশ্য সব সময়েই বলে, জ্ঞানের সীমা চিরদিনই ছিল, অজ্ঞতাই চিরদিন সীমাহীন।

ভটকাই বলল, তোমার নারী বালতিওয়ালা এক নম্বরের গুলবাজ।

নারীও নয় বালতিওয়ালাও নয়, নারি বালিয়ালা। কিন্তু গুলবাজ কেন?

কই? আমাদের তো ম্যাপ পাঠাল না।

পাঠায়নি বুঝি? তা পোর্ট ব্লেয়ারে থাকতে থাকতেই মনে করাবি তো! যাকগে, ভাল মনে করেছিস, নীচের কেবিন থেকে আমার ম্যাপটা নিয়ে আয় তো। টেবিলের উপরে রাখা আছে।

ভটকাই ম্যাপটা নিয়ে এলে ডেকচেয়ার থেকে নেমে ডেকের উপরে বাবু হয়ে বসে ম্যাপটা ছড়িয়ে দিয়ে বলল, দ্যাখ এবারে। ভটকাই ম্যাপের কথাটা মনে করিয়ে ভালই করেছে।

তারপর ম্যাপে আঙুল ছুঁইয়ে বলল, এই দ্যাখ, আমরা এখন সমুদ্রের এইখান দিয়ে যাচ্ছি।

এটা কি বঙ্গোপসাগর?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

না। বে-আইল্যান্ড হোটেলের সামনে যে সমুদ্র দেখা যায় তা বঙ্গোপসাগর। আমরা কিছুক্ষণ আগে বঙ্গোপসাগর ছেড়ে আন্দামান উপসাগরে এসে পড়েছি। পড়ে, উত্তর পুবে যাচ্ছি। ডেভিলস আইল্যান্ডের দিকে। এবারে দ্যাখ, এই মায়নামার, মানে আগের বার্মা, আর এই হচ্ছে থাইল্যান্ড। আন্দামান উপসাগরের বেশ কাছেই থাইল্যান্ডের টেনাসেরিস অঞ্চল। আর ওই দ্বীপপুঞ্জ থেকে আসে থাই জাহাজ আর ট্রলারগুলো।

তারপর একটু চুপ করে থেকে পাইপে দু’টান মেরে বলল, তোরা মগ দস্যুদের নাম শুনেছিস? মগের মুল্লুক’ বলে কথাই আছে। মগ বাবুর্চিরাও বিখ্যাত পৃথিবীময়।

বর্মীদের, থুরি মায়নামারের মানুষেরই তো আরেক নাম মগ। বাংলাদেশের চাটগাঁওর আর মায়নামারের আরাকানের বাবুর্চিদের হাতের খানা যে না খেয়েছে। তার জীবনই বৃথা।

ভটকাই বলল, ইদ্রিস আলিকে জিজ্ঞেস করব তত তার বাড়ি চাটগাঁয়ে কী না!

ঋজুদা তারপরে বলল, ভাল করে ম্যাপে লক্ষ করে দ্যাখ, মায়নামারের প্রধান নদী ইরাবতীও আমাদের গঙ্গারই মতো অনেক ছোট বড় ব-দ্বীপ সৃষ্টি করে নানা নামে, নানা শাখা-উপশাখাতে বিভক্ত হয়ে সমুদ্রে এসে পড়েছে।

মায়নামার থেকে মাছ ধরা ট্রলার ও জাহাজ যে শুধু আন্দামান উপসাগরে চলে আসে তাই নয়, তারা বঙ্গোপসাগরেও চলে যায়। এই দ্যাখ, উত্তর আন্দামানের এই কোকো দ্বীপ থেকে মায়নামারের প্রেপারিস দ্বীপ খুবই কাছে। গাল্ফ অফ মার্তাবন হয়ে আসে চোরারা। শান্তির সময়ে শুধু মাছ চোরেরাই আসে আর যুদ্ধ লাগলে শত্রুপক্ষ এইসব দেশকে হাত করে তাদের যুদ্ধজাহাজ আর সাবমেরিনও ওই দিক দিয়েই পাঠাবে। এবারে দ্যাখ, আমার নিজের হাতে আঁকা এই ছোট্ট পুটকিটা, যা ছাপা ম্যাপে নেই। এই হচ্ছে ‘ডেভিলস আইল্যান্ড। ডেভিলস আইল্যান্ড থেকে মায়নামার এরং থাইল্যান্ড এই দু’ দেশের থেকে আসা সব জলযানের উপরেই নজর রাখা যায়। শুধু তাই নয়, ডেভিলস আইল্যান্ডে একটা গুহা আছে মস্ত বড়, সেটার এক মুখ সমুদ্রের দিকে, অন্য মুখ ডাঙাতে। আদিম জঙ্গলের গভীরে।

তুমি এমন করে বলছ ঋজুকাকা, যেন তুমি সেখানে গেছো অনেকবার আগে, নিজের চোখেই সব দেখেছ।

তিতির বলল।

নিজের চোখেই দেখেছি, তবে সশরীরে যাইনি। নারি আমাকে ভি ডি ও ফিল্ম দেখিয়েছিল, গতমাসে, যখন কলকাতাতে এসেছিল।

তাই?

আমরা সমস্বরে বললাম অবাক হয়ে।

হ্যাঁ।

ডেভিলস আইল্যান্ড-এর ওই গুহাটার কথা বললে কেন ঋজুদা? ওর বিশেষ কোনও তাৎপর্য আছে কি?

আছে।

তারপর বলল, তোরা কেউ ‘গানস অফ নাভারোন’ ছবিটা দেখেছিলি? গ্রেগরি পেক, অ্যান্থনি কুইন এরা সব ছিলেন যে ছবিতে।

আমি আর তিতির বললাম, একবার নয়, বহুবারই দেখেছি। জার্মানরা গ্রিসের নাভারোনের পাহাড়ের গুহাতে দুটো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড কামান বসিয়েছিল, যে কামান দুটো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মিত্রপক্ষের সব জাহাজ ডুবিয়ে দিত ক্রেট-এর সমুদ্রে। ওই জলপথটা যেহেতু প্রধান জলপথ ছিল, মিত্রপক্ষের জাহাজদের ওই পথ দিয়ে না গিয়েও উপায় ছিল না। ওই গুহার মধ্যে কামান দুটো থাকার জন্যে মিত্রপক্ষের উড়োজাহাজও কোনও ক্ষতি করতে পারত না কামান দুটোর।

কেন পারত না?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল ঋজুদাকে।

এরোপ্লেনের পক্ষে অসুবিধের কী ছিল।

যদি কোনও পাইলট প্লেন নিয়ে গুহা মুখে ঢুকে পড়তে পারত–জাপানের কামেকাজে’ পাইলটদের, মানে আত্মঘাতী পাইলটদের মতে, তা হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল কিন্তু মিত্রশক্তির পাইলটদের মধ্যে অমন দেশপ্রেম বড় একটা দেখা যেত না। তখনকার দিনে তো আর মিসাইলস ছিল না। আজকালকার দিনে গুহার মধ্যে লুকিয়ে রাখা কামানকে এরোপ্লেন থেকে মিসাইল ছুঁড়ে স্তব্ধ করে দেওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়।

তারপরই বলল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জাপানি সাবমেরিনে করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এসেছিলেন আন্দামানে, জানিস তোরা? মণিপুরেরই মতো এখানেও, মানে পোর্ট ব্লেয়ারের সেলুলার জেলেও আমাদের তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এই আন্দামানই সবচেয়ে প্রথমে ভারতবর্ষের মধ্যে স্বাধীন হয়েছিল।

তারপর মণিপুর থেকে নেতাজিকে ফিরে যেতে হয়েছিল বার্মা হয়ে কিন্তু আন্দামানে জাপানি মদতে আই এন এর আধিপত্য বেশ কিছুদিন ছিল। ইন ফ্যাক্ট, ওই ডেভিলস আইল্যান্ডেই জাপানিরা নাভারোনের মতো কামান বসাবার মতলবও করেছিল।

নেতাজি কবে এসেছিলেন এখানে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

উনিশশো তেতাল্লিশের নভেম্বরের ছ তারিখে জাপান গভর্নমেন্ট প্রভিশনাল গভর্নমেন্ট অফ আজাদ হিন্দকে আন্দামান হস্তান্তরিত করে দেন।

জাপানিরা নিজেরা কবে দখল করেছিলেন আন্দামান?

উনিশশো বেয়াল্লিশের তেইশে মার্চ। ওঁরা দখল নিয়ে রাস্তাঘাট এয়ারপোর্ট, জাহাজঘাটা, এই সব তৈরি করতে লেগে যান কিন্তু নানা কারণে পরে আজাদ হিন্দ ফৌজকেই আন্দামান হস্তান্তরিত করেন। ব্রিটিশরা অবশ্য আবার উনিশশো পঁয়তাল্লিশেই আন্দামান পুনর্দখল করে নেয়, আর সাতচল্লিশে পুরো ভারতই স্বাধীন হয়ে যায়।

ভটকাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল। ঘটনার মতো ঘটনা। সবই ঘটে গেল আমাদের জন্মের কত আগে! সত্যি! আমরা না দেখলাম রাজা-মহারাজা আর জমিদারদের বৈভব, না দেখলাম ব্রিটিশের মহিমা আর অত্যাচার। না জানলাম পরাধীনতার জ্বালা। লাইফটাই বৃথা হল।

ঋজুদা বলল, শুনছিস তোরা? ‘বৈভব’, মহিমা, কী সব শব্দ ব্যবহার করছে ভটকাই আজকাল?

তিতির বলল, তাই তো দেখছি। গোপনে ও খুব জোর সাধনা করছে।

ভটকাই বলল, তাতে দোষের কী?

বলেই বলল, বলল ঋজুদা, থামলে কেন?

ভারতীয় নৌবাহিনীতেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে ওই গুহার মধ্যে খুব শক্তিশালী মিসাইল-লঞ্চার বসানো যায় কী না সেই কথা নিয়ে ভাবনাচিন্তা হচ্ছিল বেশ কিছুদিন হল।

তারপরে? আমরা সমস্বরে বললাম।

গত মাসেই আইডিয়াটা ড্রপড হয়েছে।

তবে? চাং ওয়ান আর উ থান্ট এর কী ইন্টারেস্ট রইল তা হলে আর ডেভিলস আইল্যান্ডে?

ইন্টারেস্ট তো নেই কোনও।

আমাদের স্তম্ভিত করে ঋজুদা বলল।

তার মানে?

তিতির বলল।

মানে, চাং ওয়ান আর উ থান্ট বলে কারওকেই আমি চিনি না।

কী বলছ, বুঝতে পারছি না।

ভটকাই একেবারে ভেঙে পড়ে হতাশ গলাতে বলল এবারে।

আমি বললাম, তা হলে চলো ফিরেই যাই। আমাদের জলিবয় দ্বীপ দেখা হল না।

ঋজুদা ধীর স্থির গলাতে বলল, যাবি রে যাবি। আগে ডেভিলস আইল্যান্ডে পৌঁছ, দ্যাখ, পছন্দ হয় কী না! পছন্দ হলে এখানেই হানিমুন করতে আসিস যখন বিয়ে-টিয়ে করবি।

ভটকাই কথা কেড়ে বলল, ওসবের মধ্যে আমি নেই। কিন্তু এলেও থাকব কোথায়? খাব কী?

কেন? তুই তো আগেই বলেছিস ‘ভজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’।

তারপর বলল, আমার তো বয়স হচ্ছে। কতদিন আর দেশের আর ভিন দেশের মানুষদের অর্ডার সাপ্লাই করব বল? কোথায় কার গুপ্তধন কে হাতিয়ে নিল, কোথায় কার বহুমূল্য হিরে কে চুরি করল, কোথায় কে কাকে খুন করল, কোথায় মানুষখেকো বাঘ বা গুণ্ডা হাতি মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলল তার সব জিম্মাদারি কেন শুধু ঋজু বোসকেই নিতে হবে বারবার? তোরাই বল? নাঃ এবার আমি রিটায়ার করব। আমি দুর্বল হয়ে পড়ছি।

তোমার যেটা দুর্বলতা সেটাই আমাদের বল ঋজুকাকা।

তিতির বলল।

ভটকাই বলল, তোমার বুড়ো হওয়ার সঙ্গে ডেভিলস আইল্যান্ডের কী সম্পর্ক?

এই দ্বীপটা আমি কিনে নেব ভাবছি। মানে, লিজে নেব পঞ্চাশ বছরের। আরও পঞ্চাশ বছর তো বাঁচব না আমি। যত দিন বাঁচি, এই নির্জনেই থাকব। সাধু সন্ন্যাসীরা পাহাড়ে পর্বতে নদীতীরে, মরুভূমিতে গিয়ে একা থাকেন, ঈশ্বর চিন্তা করেন। আমরা ঈশ্বর তো প্রকৃতিই। তাঁর সান্নিধ্যেই বাকি কটা দিন কাটিয়ে দেব। জানিস তো! নির্জনতা কখনও কাররওকে খালি হাতে ফেরায় না। নির্জনতা দু’ হাত ভরে দেয়। সারাজীবন যত কথা বলেছি, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব এই সমুদ্রের মধ্যের জনমানবহীন দ্বীপে বাক্যহীন বাস করে। কথা আর বলব না, শুনবই শুধু। গাছেদের কথা, পাহাড়ের কথা, পাখিদের কথা, সমুদ্রের কথা, মাছেদের কথা, তারাদের কথা, চাঁদ-সূর্যের কথা। নৈঃশব্দ্যর মতো শব্দময়তা যে আর কিছুই নেই সে কথা হৃদয়ের অন্তস্থলে অনুভব করব।

ভটকাই অত্যন্ত বিরক্ত গলাতে বলল, ওসব বললেই তো আর হল না। ওড়িশার কালাহান্ডি থেকে চারবার টেলিগ্রাম এসেছে। অরাটাকিরির মানুষখেকো বাঘটাকে মেরে দেবার জন্যে। তুমি অত মানুষকে ফেরাবে?

ফেরাব। আমার নিজেরও তো নিজের উপরে কিছু দাবি আছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি ঘোরাঘুরি করেছি পনেরো বছর বয়স থেকে নানা পাহাড়ের জঙ্গলে নদীতে বাদাতে ঘাসবনে, দেশে বিদেশে। এবার আমার নিজস্ব পাহাড়ে জঙ্গলে এই সমুদ্র মার আকাশের মধ্যে থিতু হব।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতাটা পড়িসনি কি তোরা?

কোন কবিতা?

আমরা সমস্বরে বললাম। ‘বোঝাপড়া’। ‘ক্ষণিকা’তে আছে।

না তো।

তোদের জীবন বৃথা রে পোলাপানগুলান।

বলো না কবিতাটা?

নিজেরে আজ কহ যে,
ভালমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে।

বাঃ। কী সুন্দর।

তিতির বলল। ঋজুদা আবার আবৃত্তি করল:

সব কিছুরই একটা কোথাও করতে হয় রে শেষ
গান থামিলে তাই তো কানে থাকে গানের রেশ
জীবন অস্তে যায় চলি তার রংটি থাকে লেগে
প্রিয়জনের মনের কোণে শরৎসন্ধ্যা মেঘে।
নিজেরে আজ কহ যে,
ভাল মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে।

.

০৮.

যখন আমরা ডেভিলস আইল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছলাম তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। এই পুরো সামুদ্রিক অঞ্চলেই সন্ধে হয় প্রায় সাতটাতে। তা ছাড়া, সমুদ্রের উপরে আলোও থাকে অনেকক্ষণ। জল মাত্রই তো স্থলের চেয়ে অনেক বেশি আলো প্রতিফলিত করে। বিকেলের আলোতে ছোট্ট, বহুবর্ণ দ্বীপটিকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল। কত রকমের যে গাছ সেখানে। পাখি কিন্তু সেই তুলনায় মনে হল কমই ছিল। আমাদের বোটট্রা দ্বীপটিকে আধাআধি পরিক্রমা করে ওদিকে গিয়ে পৌঁছতেই চোখে পড়ল এক ফালি তটভূমি। তার বালিতে কয়েকটা সামুদ্রিক টার্ন নেচে বেড়াচ্ছিল। তটভূমির কাছে নোঙর করা যায় না। কারণ সেখানে জল কম। আমরা তটভূমির পাশে যেখানে দ্বীপ সোজা উঠেছে জল থেকে, সেখানে নোঙর করলাম। তাও নোঙর জলে ফেলে নয়। কারণ, এখানে জল খুবই গভীর। পারের একটা মোটা প্যাডক গাছের সঙ্গে মোটা দড়ি বেঁধে দেওয়া হল। দু’জন খালাসি লাফিয়ে নামল বোট থেকে পাড়ে সেই দড়ি ভাল করে বাঁধবার জন্যে।

ঋজুদা বলল, ওইখানে যে তটভুমি দেখছিস তা এই পাহাড়ের পাথর, স্যান্ডস্টোন, বহুযুগ ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে হয়েছে। নইলে আন্দামানের প্রায় সব দ্বীপই এক একটা পাহাড়, মানে, পাহাড়চুড়ো। জলের মধ্যে থেকে মাথা উঁচিয়ে আছে। যেটুকু আমাদের দৃষ্টিগোচর সেটুকুই দ্বীপ। সেই জন্যেই জল সব দ্বীপের চারদিকেই এত গভীর এবং জলে সাঁতরে এলে পাড়ে একটু হাত পা রাখারও জায়গা থাকে না এখানের অধিকাংশ দ্বীপেই।

আমি বললাম, তাই? এতদিনে বুঝলাম যে ডাঙার পরই জল কেন এত গভীর প্রায় সব দিকেই।

দড়িটা ভাল করে বাঁধা হলে আমরা সবাই একে একে নামলাম দ্বীপে দড়ি ধরেই। ক্যাপ্টেন ভাদেরা ততক্ষণে জলি-বোটটাকে খুলে ফেলে জলে নামানোর বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। জলি-বোটটা বড় বোটের গায়ে বাঁধা থাকলে আমাদের ওঠানামার যেমন সুবিধা হবে তেমন ঋজুদা ইচ্ছে করলে বোট খুলে নিয়ে সমুদ্রে মাছও ধরতে যেতে পারে। জলি-বোটের সঙ্গে একটি আউট-বোর্ড এঞ্জিন লাগানো আছে। সমুদ্রের স্রোতে হাতে দাঁড় বেয়ে নৌকো চালানো সহজ নয়। আগেকার মানুষেরা পারতেন।

ভটকাই চেঁচিয়ে বলল, চলে আয় রুদ্র। ডেভিলস আইল্যান্ডকে এক্সপ্লোর করি।

ঋজুদা বলল, আজ একদম নয়। কাল সকালে হবে। সকলেই যাব একসঙ্গে। সবতাতে ইয়ার্কি নয়।

ইতিমধ্যে তিতির চেঁচিয়ে বলল, দ্যাখো ঋজুকাকা কীরকম অন্ধকার করে আসছে। পূবের আকাশে কেমন মেঘ জমছে দেখেছ?

হুঁ।

আমি বললাম, সত্যি! কে বলবে ডিসেম্বর মাস।

এখানে সন্ধের দিকে ডিসেম্বরেও ঝড় বৃষ্টি হয়। ঝড় না হলেও বৃষ্টি হয়ই। প্রায় রোজই। ঋজুদা বলল।

বলেছিলাম না। এখানে বর্ষাকালে একবার আসতেই হবে। আহা। এখানে শ্রাবণের যা রূপ হবে না! কল্পনা করেই সুখে মরে যাচ্ছি।

ভটকাই বলল।

পোর্ট ব্লেয়ারে এসে হোটেলে থাকতে পারো। এইরকম বোটে করে বর্ষার সমুদ্রে যাওয়াআসা অসম্ভব বর্ষাতে।

তিতির বলল।

সেটা ঠিক।

ঋজুদা বলল।

তা ছাড়া, একা এলে তাকে বোট দিচ্ছেটাই বা কে?

সেটা অন্য কথা। আমার ক্যালি সম্বন্ধে তোদের ধারণাই নেই। কিন্তু না। তুমি সত্যিই একজন রিটায়ার্ড বোরিং বুড়ো হয়ে যাচ্ছ ঋজুদা। এবার থেকে সকাল বিকেলে তুমিও দেখছি কেডস পরে ছাতা বা লাঠি হাতে মর্নিং ওয়াক আর ইভনিং ওয়াক-এ যাবে আর পার্কের বা লেকের বেঞ্চে একদল বুড়োদের সঙ্গে বসে পরনিন্দা পরচর্চা করবে।

তা যাতে করতে না হয় সেই জন্যেই তো ডেভিলস আইল্যান্ডে এসে থিতু হব। তা ছাড়া, নিন্দা তো করে বুড়োরা ছেলে বউ-এর, আমার তো সেই বালাইই নেই।

আমরাই তো তোমার ছেলে মেয়ে। আমরা কি তোমার বালাই?

বলেই, ভটকাই আকাশে আঙুল তুলে কাঁপা কাঁপা ভয়ার্ত গলাতে বলল, ঋজুদা-আ-আ-ওই দ্যাখো, পুবাকাশে কুমুলো-নিম্বুলো মেঘ। কেলো হবে এবারে।

আমরা সকলেই সেদিকে চেয়ে আকাশের অবস্থা দেখে সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম।

ঋজুদা বলল, বোটে উঠে আয় রুদ্র। যদি ঝড় আসে, তবে ঝড়ের দিক ও গতি বুঝে দ্বীপের অন্য দিকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে হতে পারে আমাদের। ঝড়ের দাপট থেকে বাঁচতে। আমি অবাক হয়ে বললাম, এই সুন্দর রোদ ছিল হঠাৎ এরকম কালো হল কী করে।

আমার কথার কেউই উত্তর দিল না।

জলি-বোটটা কী তা হলে তুলে নেবে উপরে?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

না, তা কেন? জলি-বোট বাঘের পেছনে পেছনে যেমন ফেউ যায় তেমনই দড়ি বাঁধা অবস্থাতে পেছন পেছন যাবে। কান টানলেই মাথা আসবে।

আমরা বোটে উঠে আসতেই ইদ্রিস আলির অ্যাসিস্ট্যান্ট গোপালন ট্রেতে করে ধুয়ো ওঠা কফি আর খুব করে শুকনো লঙ্কা ঠাসা গরম গরম পেঁয়াজি নিয়ে এল।

এত শুকনো লঙ্কা দিতে কেউ কি বলেছিল?

তিতির জিজ্ঞেস করল, ঝালে মুখ বিকৃত করে।

গোপাল ভটকাইকে দেখিয়ে দিল তার ড্যাব ড্যাবা চোখ দিয়ে।

ঈস, অত ঝাল যে, মুখে দেওয়া যাচ্ছে না।

আমি বললাম। যদিও আমার খেতে আদৌ খারাপ লাগছিল না। তিতির আসলে ঝাল একেবারেই খেতে পারে না।

খাস না। ফেলে দে।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা এক কামড় পেঁয়াজি খেয়ে বলল, কেন, ভালই তো হয়েছে খেতে, এমন কিছু ঝাল তো হয়নি। শুধু নিন্দার জন্যেই নিন্দা করিস না রুদ্র। তাতে নিজের অজানিতেই স্বভাব খারাপ হয়ে যায় মানুষের।

আমি চুপ করেই রইলাম। ঋজুদার জন্যেই বাঁদরটা এত বড় হনুমান হয়ে উঠল দিনে দিনে। কাকে আর বলব! খাল কেটে কুমির তো আমিই এনেছি।

ঋজুদা ভটকাইকে জিজ্ঞেস করল, পাইপে টোব্যাকো ভরতে ভরতে আকাশের দিকে তাকিয়ে, কী যেন বললি তুই একটা ভটকাই? কুমুলো-নিম্বুলো মেঘ, না কী যেন!

হ্যাঁ। ওইরকম কালোলা মেঘের নাম কুমুলোনিম্বুলো নয়?

ঋজুদা হেসে বলল, কিউমুলো নিম্বাস। কাছাকাছি গেছিস। কিন্তু…তারপর বলল, ওগুলোকে বলে Cumulo-nimbus. Nimbus এক ধরনের জলবাহী মেঘ আর সেই মেঘই যখন পুঞ্জীভূত হয় তখন তাদের বলে Cumulo-nimbus। উপরটা সাদা থাকে আর নীচে ঘন কালো মেঘপুঞ্জ।

তুমি এসব জানলে কী করে ঋজুকাকা?

তিতির মুগ্ধ গলাতে বলল।

আমার বন্ধু আছে না? ক্যাপ্টেন চৌধুরী রে, তোরা দেখেছিস আমার বাড়িতে, এয়ারবাস-এর ক্যাপ্টেন–ওর কাছ থেকে ধীরে ধীরে শিখেছি। যদি আমার কোনও ফ্লাইটে ও ক্যাপ্টেন থাকে তো ককপিটে ডেকে নেয় আমাকে টেক-অফ-এর পরেই। ওদের বাঁচা-মরা তো নির্ভর করে এই সব জ্ঞানের উপরেই আর ওদের সঙ্গে যাত্রীদের বাঁচা-মরাও–তাই ওদের বাধ্যতামূলক ভাবেই এসব শিখতে হয়, আমার তোর মতো শখের কারণে নয়।

বলো না আমাদের ঋজুদা, কত রকমের মেঘ হয়?

আমি বললাম।

তিতির বলল, কবি কালিদাসও সম্ভবত মেঘের এই নানারকমের কথা জানতেন নইলে তাঁর বার্তা কাকে দিয়ে পাঠাবেন তা ঠিক করতেন কী করে।

ঋজুদা পাইপটা ধরিয়ে বলল, হয়তো জানতেন।

তারপর ভটকাইকে বলল, নীচে গিয়ে ক্যাপ্টেন ভাদেরাকে এপারে আসতে বল তো একবার। ভাদেরা আমার ভুল হলে শুধরে দেবে।

উনিও জানেন এসব?

ভটকাই অবাক হয়ে বলল।

নেভিতে যাঁরা আছেন, এয়ারফোর্সে যাঁরা আছেন তাঁরা জানবেন না, না কি আমি জানব! আকাশ আর মেঘ আর সমুদ্রের সঙ্গেই তো ওঁদের ঘর করা। ডাক, ওঁকে। ওঁর সঙ্গে অন্য কথাও আছে।

একটু পরেই ভাদেরা সাহেব এলেন। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স। ঝকঝকে যুবক। এখন নেভি অফিসারের পোশাকে নেই, মুফতিতে আছেন, এই কাজ তো তাঁর অফিসিয়াল অ্যাসাইনমেন্ট নয়, যদিও ডিউটির মধ্যেই পড়বে।

গুড ইভনিং স্যার। অ্যাটেনশনে দাঁড়িয়ে ভাদেরা বললেন ঋজুদাকে।

ভেরি গুড ইভনিং স্যার।

ঋজুদা বলল।

মনে মনে বললাম, রাজা সবারে দেন মান। সে মান আপনি ফিরে পান।

দুটো শটগান আছে তো সঙ্গে?

ইয়েস স্যার।

গুলি? কী গুলি?

এল. জি. এস. জি. আর এক নম্বর শটস।

কী শটগান?

ইন্ডিয়ান অর্ডন্যান্স-এর। টুয়েলভ বোর, ডাবল-ব্যারেলড।

ফাইন। আশা করি প্রয়োজন হবে না ব্যবহারের। তবে এই ডেভিলস আইল্যান্ডে সাপ তো আছে অনেকই, না কি?

থাকা তো স্বাভাবিক স্যার।

তিতির ক্যাপ্টেন ভাদেরার হাতে কফির কাপ তুলে দিল। কিন্তু উনি নিলেন না, বললেন, এখুনি খেয়ে এলাম। থ্যাঙ্ক ইউ।

ঋজুদা বলল, ক্যাপ্টেন আমি ওদের মেঘ চেনাব। আমার ভুল হলে আপনি একটু শুধরে দেবেন। আপনি যখন সঙ্গে আছেনই, আপনার সাহায্য না নেওয়াটা মূর্খামি হবে। আমি আর কতটুকু জানি!

ক্যাপ্টেন ভাদেরা বললেন, মাই প্লেজার স্যার।

ঋজুদা অ্যাটেনশানে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেনকে বসতে বলল। ভাদেরা আকাশের দিকে মুখ করে ডেক চেয়ারে বসলেন।

ইতিমধ্যে মেঘের রং ও অবস্থান বদলে গেছে অনেকই। হাওয়া দিয়েছে একটা। ডেভিলস আইল্যান্ডের হাজার হাজার সবুজ আর সাদা হাত হাতছানি দিচ্ছে আমাদের। হাওয়াতে পাতারা উলটে যাচ্ছে, পাতাদের সাদা বুক দেখা যাচ্ছে আবার পর মুহূর্তেই উলটে গিয়ে সবুজ বা লালচে বা খয়েরি হয়ে যাচ্ছে। নানা জলজ আর বনজ গন্ধে হাওয়াটা ভারী হয়ে গেছে। এই গন্ধবন্ধ আমাদের অচেনা। এতে জলের গন্ধ, মাছের গায়ের গন্ধ, মেঘের গায়ের গন্ধ, নানা অচেনা গাছের গায়ের গন্ধ মিশে আছে। সিঁদুরে লাল মাটির যতুটুক দেখা যাচ্ছে ডেভিলস আইল্যান্ডের সবুজের ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টিস্নাত, তা থেকেও সোঁদা গন্ধ উঠছে। যে গন্ধ একমাত্র মাটিরই।

সত্যি! প্রকৃতির কী লীলা খেলা! ভাবছিলাম, আমি।

ঋজুদা বলল, পাতলা পাতলা পেঁজাতুলোর মতো, ঊর্ধ্বমুখী সাদা মেঘকে বলে Cirrus। তারাই যখন আবার কেটে যাওয়া ছানার মতো ছাড়া ছাড়া হয়ে যায়, তখন তাদের বলে Cirro-cumulus. আবার Cirro যখন সমান্তরাল গড়নে দেখা যায় তখন তাদের নাম হয়ে যায় Cirro-stratus Strata থেকে Stratus বুঝলি তো?

এই অবধি বলে, ক্যাপ্টেন ভাদেরার দিকে ফিরে ঋজুদা বলল। ঠিক বলছি তো? আপনি তো বাংলা বোঝেন না–

তবে মেঘের নামগুলো নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?

বাংলাও বুঝি একটু একটু।

আমাদের অবাক করে দিয়ে ক্যাপ্টেন ভাদেরা বাংলাতেই বললেন। তারপর বললেন, আমার গার্ল ফ্রেন্ড, ন্যাভাল কমোডর সেনগুপ্তর মেয়ে। ওঁরা তো বাঙালিই। আমাদের এনগেজমেন্ট হবে সামনের মাসে। বিয়ে আগামী বছরের মার্চ মাসে।

ও তাই? কনগ্রাচুলেশানস। বাঃ বিয়ে করলে মার্চ মাস অবধিই করা ভাল ডিসেম্বর থেকে।

ভাদেরা অবাক হয়ে বললেন, কেন স্যার?

বাঙালি শ্বশুর তো, মার্চ অবধি লেপ-কম্বল দেবে।

ভাদেরা হেসে ফেললেন, আমরাও সকলেই হেসে উঠলাম বহুবার বিয়ে করা ঋজুদার এই কথা শুনে। তারপর আমরাও বললাম, কনগ্রাচুলেশানস।

আপনি কি কমোডর সেনগুপ্তকে চেনেন?

ভাদেরা জিজ্ঞেস করল।

ঋজুদা বলল, তেমন চিনি না, তবে গতবারে যখন এসেছিলাম তখন নারির একটা পার্টিতে দেখা হয়েছিল। কমোডর সেনগুপ্তর কথা মনে আছে। নাইস জেন্টেলম্যান। মিসেসকেও মিট করেছিলাম। প্রেটি লেডি। আই হোপ, মিস সেনগুপ্ত ইজ লাইক মাদার লাইক ডটার।

ক্যাপ্টেন ভাদেরা লজ্জাতে মেয়েদের মতো ব্লাশ করে বললেন, আই ডোন্নো।

তা হলে আবার শুরু করি? ঋজুদা বলল।

সার্টেনলি স্যার। ইউ নো অ্যাজ মাচ অ্যাজ উই ডু। মে বি, মোর।

ভাদেরা বললেন।

দেয়ার শুড বি আ লিমিট টু মডেস্টি ক্যাপ্টেন।

ঋজুদা বলল, Stratus যখন পুঞ্জীভূত হয়ে যায় তখন তা হয়ে যায় Stratus stratoccumulus। যখন ঘোর কালো দেখায় Stratus-দের তখন তাকে বলে Alto-stratus!

ভটকাই প্রশ্ন করল, এই সব মেঘই কি খুব উঁচুতে থাকে? মানে, যতখানি উঁচু দিয়ে প্লেন ওড়ে?

না, তা নয়। Stratus থাকে সবচেয়ে নীচে।

মানে? কত নীচে?

তিতির জিজ্ঞেস করল।

এই ধর পনেরো-ষোলোশো ফিট উঁচু মাটি থেকে। তার উপরে প্রায় ছ হাজার ফিট অবধি দেখা যায় অন্যদের। হাজার থেকে কুড়ি হাজার ফিট অবধি দেখা যায় Alto-cumulos,Cumulo-nimbus, Alto-stratus এবং Cirro-stratus-দের। যদি আরও উপরে উঠিস, মানে, যে উচ্চতা দিয়ে প্যাসেঞ্জার জেট-প্লেন সাধারণত ওড়ে, চল্লিশ হাজার ফিট মতো, তখন দেখা যায় Cirrus আর Cirro cumulus-দের। আর চল্লিশ হাজার ফিটেরও উপরে, তুই হয়তো দেখে থাকবি রুদ্র স্যেশেলস-এ যাওয়া আসার সময়ে বা ঝিঙ্গাঝিরিয়া থেকে থুরি, বেনারস থেকে ফেরার সময়ে, দিনের বেলা প্লেনের জানালা দিয়ে, এক ধরনের বহুরঙা, রামধনুর মতো স্বপ্নময় সমান্তরাল মেঘপুঞ্জ। তাদেরই নাম Iridescent clouds..

বাবা! ভটকাই বলল, নিজেদের মনে হচ্ছে আমরাই যেন জেট-প্লেনের পাইলট।

যদিও মেঘ সেজেছিল পরতের পর পরত কিন্তু বৃষ্টিটা তখনকার মতো এল না।

ঝড়ও নয়। তবে মনে হল রাতে বৃষ্টি আসবে। তা আসুক, খাওয়া-দাওয়ার পর সমুদ্রের আর ডেভিলস আইল্যান্ডের ওপরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ব আমরা। এও তো এক নতুন অভিজ্ঞতা। সমুদ্রের বুকের এত কাছে কান পেতে বৃষ্টির শব্দ শোনার অভিজ্ঞতা তো আগে হয়নি কখনও। ঢেউগুলো ছলাৎ ছলাৎ করবে। ছোট মাছের ঝাঁক গা ঘষে দিয়ে যাবে হয়তো বোটের স্টারবোর্ড সাইডে কিংবা কোনও মস্ত টুনা মাছই, আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি-র’ বড় এবং বুড়ো মাছটার মতো।

আমার ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিয়ে ভটকাই বলল, বুঝলে ঋজুদা, রাতে আর বিশেষ ঝামেলা করতে মানা করলাম।

কীসের ঝামেলা?

ঋজুদাও যেন কী ভাবছিল, তার ভাবনার জাল ছেঁড়াতে সেও বিরক্ত হল।

মানে, ডিনারের মেনুর কথা বলছি।

ভটকাই বলল।

সত্যি! তুই একটা পেটুক দামু। অত খাওয়া-দাওয়া যদি করিস তা হলে তো বাড়িতে থাকলেই পারিস। তোকে আর নিয়ে আসব না কোথাওই।

আহা! রাগ করো কেন? একজনের তো ওদিকটা দেখতে হবে। খাবার বেলা তো রুদ্র আর তিতির চেটেপুটে খাবে আর বন্দোবস্তটা যে করছে সে খালি গালিই খাবে।

এবারে গুলি খাওয়াব তোকে।

আমি বললাম।

ভটকাই আমার কথাতে কান না দিয়ে, আমাকে পুরোপুরি ইগনোর করে ঋজুদাকেই বলল, মুগের ডালের খিচুড়ি। ভুনি খিচুড়িই করতে বলেছি। ডিরেকশান তো দিয়েছি, এখন কেমন করে দেখি! সঙ্গে বলেছি, মুচমুচ করকে আলু ভাজা আর সার্ডিন মাছ ভাজা। শুকনো লঙ্কা ভাজা আর আমের আচার। দেখলাম, অ্যাবারডিন বাজার থেকে কেনা বাঙালির দোকানের রসগোল্লাও আছে। এই বোটে ফ্রিজও আছে ঋজুদা, ব্যাটারিতে চলে। সোলার ব্যাটারি। হয়ে যাবে রাতের খাওয়াটা মোটামুটি আর কী! আরও কিছু কি করতে বলব? ঋজুদা তুমিই তো চিফ-গেস্ট।

থাম তো তুই এবারে।

ঋজুদা এবারে সত্যিই বিরক্ত হয়ে বলল।

.

০৯.

এখন বোট-এর সব আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। চারটি কেবিন। একটিতে ঋজুদা, একটিতে ক্যাপ্টেন ভাদেরা, একটিতে তিতির আর অন্যটিতে আমি আর ভটকাই। তিতির বাথরুমের আলোটা জ্বালিয়ে রেখে বাথরুমের দরজাটা ভেজিয়ে রেখেছে।

শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছে ভটকাই। রাতের খাবারটা কিন্তু দারুণই হয়েছিল। কৃতিত্ব ভটকাই-এরই, যদিও বেচারি গালাগালি খেয়েছে সকলেরই।

খেতে খেতে ঋজুদা এখানের সামুদ্রিক মাছেদের কথা বলছিল। ক্যাপ্টেন ভাদেরাও জানেন। কারণ পোর্ট ব্লেয়ারেই নাকি আছেন গত দু’বছর। বিয়ের পরে কোচিন-এ পোস্টিং হবে নাকি।

মাছ তো সমুদ্রে হাজারো রকমের হয় কিন্তু সব মাছ তো খায় না মানুষে। যে সব মাছ খায় এ অঞ্চলের মানুষে তার মধ্যে সুরমেই, কোরাই, ম্যাকারেল, সিলভার বেলিজ, রুপোলি পেটের মাছ, অ্যাকোরিজ, সার্ডিনস, সিয়ার ইত্যাদি মাছ আছে। সার্ডিনের আবার দু’রকমের কথা জানেন ক্যাপ্টেন ভাদেরা, হয়তো আরও রকম আছে। আছে হারমেগুলা আর ডসুমেরিয়া অ্যাকুয়া। এ ছাড়াও আছে রেজ, বারাকুড়া, মুলেট। জেলি ফিশ। নানারকম অক্টোপাস। শামুক, জার্মানরা যাকে বলে মুশেলস। কাঁকড়া। চিংড়ি নানা মাপের, বেশিই গলদা। বাগদাও পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরা নানা দ্বীপে মিষ্টি জলের পুকুর করে, সেখানে রুই, কাতলা, মৃগেল, ল্যাটা, শিঙ্গি, মাগুর, কই ইত্যাদি মাছ ছেড়েছে। মাঝে মাঝে বাজারেও ওঠে সেসব মাছ। তবে এই সমুদ্র-মেখলা দ্বীপগুলিতে এখনও মানুষের প্রধান খাদ্য সামুদ্রিক মাছই। শুঁটকি মাছও খায় অনেকেই।

বড় মাছের মধ্যে টুনা আছে। ওদের একটা প্রজাতি পাঁচ মিটার অবধি লম্বা হয়। তাদের বলে ব্লু-ফিন টুনা। ঋজুদা নাকি ব্লু-ফিন টুনার জন্যেই পরশু সারাদিন নৌকো ভাসিয়ে পড়ে থাকবে গভীর জলে। কী টোপ দেবে কে জানে! বড় বড় টুনা মাছগুলোর পিঠটা নীলচে-কালো হয়। আর পেটটা সাদা। অত বড় টুনা মাছ তো ইচ্ছে করলে ওই ছোট্ট জলি-বোটকে ডুবিয়েও দিতে পারে নীল তিমি মবিডিক যেমন ডুবিয়ে দিয়েছিল তিমি-মাছ ধরতে-যাওয়া জাহাজকে। অত বড় মাছ হলেও টুনা মাছ অন্যান্য মাংসাশী মাছের মতো কিন্তু অন্য ছোট মাছ খেয়ে বাঁচে না। এরা নিরামিশাষী। নানারকম প্ল্যাংকটন খেয়েই বাঁচে তারা। মাছেদের মধ্যে ওরা অন্যরকম।

বড় বড় টাইগার শার্ক হাঙর ঝড়ের গতিতে এসে স্যামন আর সার্ডিনের ঝাঁকে এসে পড়ে কাঁচের পাতের মতো জলকে টুকরো টুকরো করে আলোকিত সমুদ্রতলে মাছেদের ছত্রখান করে দেয়, দলছুট হয়ে তারা যে যেদিকে পারে সাঁতরে যায় অপূর্ব সব তাৎক্ষণিক জলজ আলোছায়ার জ্যামিতিক নকশা এঁকে।

সমুদ্রে কত দেবদেবীও আছেন। মানুষের ভূমিকা যেখানে সামান্য, নগণ্য, যেখানে সে অসহায় প্রকৃতির কাছে সেখানে দেবদেবীদের মানতেই হয়। অশাণ্ডিমারু, জরুইন, আরও কত।

ঋজুদা বলছিল, ইগুয়ানাও খায় অনেকে, তারা উভচর জীব। স্যালামান্ডারদের থেকে বড়। ফল খাওয়া বাদুরের মাংসও নাকি খুব স্বাদু হয়। কম্যান্ডো-ট্রেনিং-এর সময়ে সর্বভূক হতে হয়েছিল ঋজুদাকে। খেয়ে ছিল সব কিছুই। ঋজুদার ভাষায়, কীরে-মাকড়ে’ পর্যন্ত। সামুদ্রিক সি-কিউকুম্বার, সি-আর্চিস এসবও খায় মানুষে।

কাল সকালেই আমরা নামব ডেভিলস আইল্যান্ডে। রাতে তাই উত্তেজনাতে ঘুম হচ্ছে না আমার। সত্যিই কী এখানেই পাকাঁপোক্তভাবে থাকবে ঋজুদা? নাকি আমাদের ভয় দেখাচ্ছে, কে জানে!

হাওয়া বয়ে আসছে সমুদ্রের উপরে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হাওয়ার বাড়া-কমার সঙ্গে বৃষ্টিও বাড়ছে কমছে। কে জানে এই হাওয়া কলকাতা থেকেই আসছে কী না। কলকাতা কত দূর? মাঝে শুধু জল, অথৈ জল। ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগছে।

আন্দামানে চারটি দ্বীপপুঞ্জের জটলা। নিকোবরের সঙ্গে এর সম্বন্ধ নেই। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে নিকোবরের দ্বীপগুলি অনেক বেশি নির্জন, বিচ্ছিন্ন এবং রোমাঞ্চকর। এর পরে একবার আসব নিকোবরের দ্বীপগুলিতে, ঋজুদা যদি নিয়ে আসে। আন্দামানের চারটি ভাগ, উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ এবং লিটল আন্দামান। আর এদের দু’পাশে কত যে দ্বীপ, আগ্নেয়গিরিও আছে, আর কত যে দ্বীপের খোঁজ এখনও হয়নি তা কে বলতে পারে। কত নামের সব দ্বীপ, প্যাসেজ আর বে। মানে ক্ষুদে উপসাগর। একটা প্যাসেজের নাম, ইন্টারভু প্যাসেজ। কত straits সেন্টিনেল আইল্যান্ড, রসস আইল্যান্ড, স্পাইক আইল্যান্ড, রাটল্যান্ড আইল্যান্ড, ব্রাদার আইল্যান্ড, সিস্টার আইল্যান্ড, সব নাম বলতে গেলে নামের জপমালা হয়ে যাবে। ব্যারেন আইল্যান্ডের আগ্নেয়গিরি থেকে সাম্প্রতিক অতীতেও অগ্ন্যুদগার হয়েছিল।

আন্দামান আর নিকোবরের মধ্যে অত্যন্তই গভীর সমুদ্র। মধ্যে দিয়ে দশ ডিগ্রি ল্যাটিচ্যুডের চ্যানেল গেছে। খুব বড় বড় ঢেউ ওঠে ওই মধ্যবর্তী সমুদ্রে। সত্যি কথা বলতে কী ওই ক’দিন পোর্ট ব্লেয়ারের আলো-ঝলমল হোটেলে আধুনিকতম সুযোগ সুবিধের মধ্যে থেকে সমুদ্রর যে মানুষের মনের উপর কেমন অভিঘাত তা ঠিক বুঝতে পারিনি। রাতে ওই নিঃসীম সমুদ্রের মধ্যে কাগজের নৌকোর মতো অলকা-পলকা বোটে শুয়ে ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডের নানা রাতচরা পাখির ডাক শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল আজ রাতে ঘুমোব না, সারারাত জেগেই থাকি। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে সমুদ্রের মধ্যের এই ভয়াবহ নামের দ্বীপটির সান্নিধ্য উপভোগ করি।

হঠাৎই বিদঘুটে এবং প্রচণ্ড আওয়াজ করে কী একটা জন্তু ডেকে উঠল দ্বীপ থেকে। ওই ডাক কখনও শুনিনি। চমকে তো উঠলাম, ভয়ও পেলাম প্রকট। ভয় পেতে কেমন যে লাগে তা ভুলেই গেছি ঋজুদার কল্যাণে। তাড়াতাড়ি বালিশের তলা থেকে পাঁচ ব্যাটারির টর্চটা বের করে নিয়ে যথাসম্ভব কম শব্দ করে বোটের ডেকে উঠতে যেতেই ঋজুদা গলা নামিয়ে বলল, শুয়ে পড়। ও পাহাড়ের উপরে আছে। দেখতে পাবি না।

ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, কী ওটা ঋজুদা?

ঋজুদা মাঝরাতেও রসিকতা করল জুরুইন ভূত নয়, ও আন্দামানি পেঁচা। এত বড় পেঁচা ভারতের মূল ভূখণ্ডেও নেই। কালপেঁচার চেয়েও অনেক বড় হয়। বিরাট বিরাট লাল চোখ।. আমিও প্রথমবার ওর ডাক শুনে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম। যা, শো গিয়ে।

ভাবছিলাম, অজ্ঞান তো তেমন তেমন শহুরে মানুষে গভীর জঙ্গলের গভীরে চরে বেড়ানো গোরুর ডাক শুনেও হয় কিন্তু, এ যে একেবারে আক্কেলগুড়ুম ডাক। দশ বছর বয়স থেকে ঋজুদার অ্যাসিসটেন্সগিরি করছি, কতরকম ভয়ের মধ্যে দিয়ে পার করে দিয়েছি দেশ-বিদেশের কত রাত-বিরেত কিন্তু এমন সাংঘাতিক ভয় আগে কখনওই পাইনি।

ফিরে এসে শুতে শুতে অনেকদিন আগে বলা ঋজুদার একটা কথা মনে পড়ে গেল। ঋজুদা বলেছিল, ভয়ের জনক হচ্ছে অজ্ঞতা। জিম করবেট-এর জাঙ্গল লোর’-এর সেই বনশি’-র কথা পড়িসনি? যেদিন হঠাৎ করে এক দারুণ ঝড়-ওঠা বিকেলে বনশি’র উৎস কিশোর জিম আবিষ্কার করলেন জঙ্গলের গভীরে, সেদিনই সেই হাড় হিমকরা বনশি-ভীতি মরে গেল।

বুঝলাম, যে ওই ডাক আগে কখনও শুনিনি বলেই, আমার অজ্ঞতার কারণেই, ভয় পেয়েছিলাম।

.

১০.

অন্ধকার মানেই সংশয়, অসহায়তা, ভয় এবং অনিশ্চিত আর আলো মানেই সব সংশয়ের অবসান, আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং নিশ্চয়তা। প্রতিটি তমসানাশিনী সকালই যে আমাদের জন্যে কী বয়ে আনে তা এই ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডের পাশে নোঙর করা ছোট্ট বোটে রাত না কাটালে নতুন করে বুঝতে পারতাম না। মানুষখেকো বাঘের অপেক্ষায় থাকা, অনেক ডাকাত ও খুনির সঙ্গে মোকাবিলা করার অপেক্ষাতে ঋজুদার সঙ্গে অথবা ঋজুদার নির্দেশে অনেকই বিনিদ্র রাত কাটিয়েছি আজ পর্যন্ত। আজ এই আন্দামান উপসাগরেও সকাল হল অনেক জানার মধ্যে দিয়ে। পৃথিবীর তিন ভাগই যে জল, মাত্র একভাগ স্থল একথা শিশুকাল থেকেই জেনে এসেছি কিন্তু সেই জানাটার তাৎপর্য যে ঠিক কী তা গত রাতে যেমন করে জানলাম তেমন করে আগে কখনও জানিনি।

এতদিন জানতাম পাহাড় দারুণ ব্যক্তিত্বময়, প্রত্যেক পাহাড়েরই আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে কিন্তু এখন জানছি সমুদ্রের ব্যক্তিত্ব হয়তো পাহাড়ের চেয়েও বেশি। তার প্রধান কারণ হয়তো এই যে, পাহাড় পর্বত অনড় কিন্তু সমুদ্র গতিশীল, বিচিত্র তার রূপ, বিচিত্রতর তার মন।

ঋজুদা বলল, ব্রেকফাস্ট খাওয়া-টাওয়া হবে না আজ। ভটকাইকে বলে দে রুদ্র, একটু আগেই দেখলাম কিচেনে গিয়ে কী ফিসির ফিসির করছে বাবুর্চির সঙ্গে। এক কাপ করে কফি আর দুটি করে বিস্কিট খেয়েই পনেরো মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে যাব আমরা। বন্দুক দুটো চেয়ে নিস ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে। আর জলের বোতল, মানে প্লাস্টিকের, নিয়ে নিস দুটো।

ক্যাপ্টেন ভাদেরা তো যাচ্ছেন আমাদের সঙ্গে।

তাই? তা হলে তো ভালই। উৎসাহ আছে ছেলেটির। ওর ফার্স্ট নেম কী? জানিস নাকি?

যুবরাজ। ভটকাই দোস্তি করে ফেলেছে।

করল কী করে? ইংরেজি তো ভাল বলতে পারে না।

উনি তো বাংলা জানেন একটু একটু, তা ছাড়া বডি ল্যাঙ্গোয়েজ।

বাঃ। চেহারাটি অবশ্য যুবরাজেরই মতো। সেনগুপ্ত সাহেবের ভাগ্য ভাল অমন জামাই পেয়েছেন। কী বল তিতির?

বিয়েতে অবিশ্বাসী তিতির কী বুঝল জানি না, একটু লজ্জা লজ্জা মুখ করে, গলাতে অনাবশ্যক জোর এনে বলল, নিশ্চয়ই!

কফি খেয়ে আমরা উঠে পড়লাম ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ। আগে আমি, ভটকাই আর ভটকাই-এর সদ্য-লব্ধ যুবরাজ দাদা। ভটকাই কোন মন্ত্রবলে ইতিমধ্যেই তার সঙ্গে দাদা পাতিয়ে ফেলেছে কী জানি! উপরে ওঠার পরেই আমাদের বোটটি যে কী সুন্দর তা বোঝা গেল। ফুটফুটে এক মেমসাহেবের মতো বসে আছে যেন সাদা টপ পরে আর নীচে সমুদ্র মেখলার নীল স্কার্ট পরে। সাদার উপর কালো রং দিয়ে তার নাম লেখা আছে: The Bad Guy। এতক্ষণ নামটি লক্ষ করিনি। দ্য ব্যাড গাই না হলে অবশ্য ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ডে’ আসবেই বা সে কেন?

উপরে উঠতে যে একটু কষ্ট হল না তা নয়, পরে নিশ্চয়ই অন্য কোনও দিক দিয়ে উঠলে চড়াইটা কম পড়বে তা খুঁজে বের করতে পারা যাবে। এর চেয়ে কম। খাড়াই নিশ্চয়ই থাকবে অন্য কোনও দিকে। কিন্তু এদিকে যে এক ফালি তটভূমি আছে সেখানে আমরা চান করতে পারব এবং রাতে পিকনিক করব ক্যাম্পফায়ার করে। সেই লোভেই এখানে নৌকো বাঁধা। কোথায় যে নৌকো বাঁধব সেই সিদ্ধান্ত জলে এবং জীবনেও সমান জরুরি, কারণ, নৌকো বাঁধার প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

উপরে উঠেই সত্যিই চোখ জুড়িয়ে গেল। উপরটা একটা মালভূমির মতো। কত রকমের যে গাছ! আদিগন্ত চারদিকে নীল সবুজ সমুদ্র দিয়ে ঘেরা। একদল টিয়া উড়ে গেল। ছোট ছোট একরকমের পাখি, দল বেঁধে ওড়াওড়ি করছিল ফিচ ফিচ করে ডাকতে। ফটিক জল-এর চেয়েও ছোট, এগুলোর নামই বোধহয় বলেছিল ঋজুদা সুইফট-লেট। এরাই থুথু দিয়ে বাসা বানায় আর সেই বাসা আদর করে খায় চিনারা। Bird’s nest soup!

ঋজুদা বলল, দ্যাখ এটা গুর্জন গাছ। সুন্দর নয়? এর চেয়েও সুন্দর গাছ অবশ্য অনেক আছে এখানে। ডানদিকে দ্যাখ, ওই গাছটার নাম বাদাম। ওর বাঁদিকে ওটা কোকো। ওগুলো সবই হার্ড-উড। নীচে যখন নামব তখন দ্যাখাব সিলভার-গ্রে গাছ। তাদের কাণ্ডর অনেকখানিই রুপোলি-ধূসর রঙের। তোরা আগে আগে গেলি তো, তাই দ্যাখাতে পারলাম না ওঠার সময়ে। চাঁদনি রাতে ভারী সুন্দর দেখায় এই গাছগুলোকে। পালামৌর চিলবিল বা ওড়িশার গেণ্ডুলি গাছেদের মতো।

আজ চাঁদ উঠবে?

তিতির বলল।

চাঁদকেই জিজ্ঞেস কর। পক্ষটা তো শুক্লপক্ষই। গত রাতে তো বিকেল থেকেই মেঘে আকাশের মুখ ঢেকে ছিল।

আরে। আরে। এ যে বটানিকাল গার্ডেনেই এসে পৌঁছলাম আমরা। এই ডেভিলস ডেন দ্বীপে দেখছি আন্দামানে যত গাছ হয় তার প্রায় সবই আছে। স্বাভাবিকভাবে এমনটা হতেই পারে না। এক বা একাধিক কোনও রসিক ফরাসি বা ইংরেজ বা ডাচ জলদস্যুই হয়তো এনে লাগিয়েছিল।

তুমি, মধ্যপ্রদেশ থেকে কিছু সরু বাঁশ, হালকা বেগুনি ফুলের জ্যাকারান্ডা আর বাসন্তী রঙা ফুলের অমলতাস বা বাসন্তীই এনে লাগিও এখানে ঋজুকাকা।

তিতির বলল।

আমি আর ভটকাই বললাম, আমরা এখানে ঋজুদাকে আর আসতেই দেব না।

ভটকাই-এর যুবরাজ দাদা বলল, কোনও মারাঠি জলদস্যুও এনে লাগাতে পারে অথবা কনৌজি আংরে। তিনি তো এই সব সাগর উপসাগরে কম লড়াই করেননি বহু বিদেশির সঙ্গে।

তিতির বলল, সত্যি! ভাবা যায়! কোথায় মহারাষ্ট্র আর কোথায় আন্দামান। এ তো আর প্লেনে করে উড়ে আসা নয়। পুরো ভারতবর্ষকে পাক দিয়ে সমুদ্রপথে পশ্চিম ভারত থেকে এখানে আসা কি সোজা কথা।

আমি বললাম, সে কালের মানুষেরা সব অতিমানব ছিলেন। শিবাজিই বলল আর জাহাঙ্গিরই বলল, কি ঔরঙ্গজেব। ঘোড়ায় চড়ে তাঁরা ভারতের এপার থেকে ওপার করতেন অবহেলে।

ভটকাই বলল, নবাবদের সঙ্গে আবার থাকত পোবা, নাপিত, বাবুর্চি, বেয়ারা, ডাক্তার, নার্স, শয়ে শয়ে বউ। তাঁরা যুদ্ধও করতেন আবার কবিতাও লিখতেন। মার মতো, শোনগড়-এর মতো দুর্গ আকছার বানিয়েও ফেলতেন যখন তখন। অরণ্য-দুর্গ, পর্বত-দুর্গ, মরু-দুর্গ, জয়সলমিরের মত, আবার সমুদ্র-দুর্গও, জিনজিরার মতো। সত্যিই ভাবা যায় না।

ঋজুদা বলল, সেই বইটা পড়েছিস কি তোরা? ক্যাপ্টেন আপনি পড়েছেন কি?

কোনটা ঋজুদা? তিতির বলল।

ভাদেরাও জিজ্ঞাসু চোখে ঋজুদার চোখে তাকাল।

‘The Wonder that was India’

কার লেখা?

A.L. Basham.

না, পড়িনি।

কলকাতা ফিরেই পড়ে ফেলবি। ভটকাই, তুইও পড়বি।

আমি কি সায়েবের ইংরেজি বুঝব ঋজুদা?

ভটকাই মিচকেমি করে বলল।

তিতির বলল, ন্যাকামি কোরো না। পাক্কা সাহেব হয়েছ আজকাল, আর…তারপর যুবরাজকে বলল, আন্দামানের ন্যাভাল লাইব্রেরিতে পেয়ে যাবেন বইটি ভাদেরা। এই বই না থেকেই পারে না। প্রত্যেক ভারতীয়রই এ বই পড়া উচিত।

ঋজুদা বলল, এবার গাছগুলোকে চিনে নে। এখানে চিরহরিৎ গাছ যেমন আছে, পর্ণমোচীও আছে।

পর্ণমোচী মানে?

তিতির বলল।

পর্ণমোচী মানে deciduous মেমসাহেব। যে গাছেদের পাতা ঝরে গিয়ে আবার গজায়। মানে, যে গাছ coniferous নয়।

তারপর বলল, তোদের বাদাম গাছ তো দেখালাম, না? হার্ড-উড!

এখানে একরকম গাছ আছে তার নাম ডিডু।

ডিডু? কী নাম রে বাবা!

ইয়েস। ডিডু।

ওই দ্যাখ, সাদা চুগলাস, টঙ্গপিন, লাল ধুপ, আর সমুদ্র-মওহা।

মওহা মানে? মহুয়ার কাজিন-টাজিন না কি?

হতে পারে। আর ডিডু কিন্তু আসলে শিমুল। এখানে শিমুলকেই ডিডু বলে।

হার্ড-উড আছে, তো সফট-উড নেই?

যুবরাজ, বাঙালির ভাবী-জামাই জিজ্ঞেস করল।

নিশ্চয়ই আছে। সাদা ধূপ, বাকোটা, পপিতা, লম্বাপাত্তি। এবং ডিডুও সফট-উডই।

হার্ড এবং সফট-উড ছাড়াও এখানে অনেক ornamental গাছও হয়।

গাছ আবার ornamental হয় না কি?

ভটকাই বলল।

হয়, হয়, ভটকাইচন্দ্র। এখানে সবই হয়। নতুন দেশে এসেছ না?

তিতির জলিবয় আইল্যান্ডে সেই গানটা গাইছিল না? এলেম নতুন দেশে, তলায় গেল ভগ্নতরী কূলে এলেম ভেসে।

অর্নামেন্টাল গাছ কোথায়?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ওই দ্যাখ, আগেই দেখিয়েছি সিলভার গ্রে। তা ছাড়া, আছে উড। সাটিনের মতো মসৃণ, বুঝলি। ওই দ্যাখ ওই উপরে ওই গাছটার নাম মাৰ্বল-উড।

সত্যি!

তিতির বলল।

আর যে মস্ত গাছটার ঠিক নীচে তুই দাঁড়িয়ে আছিস সেটার নাম জানিস কি?

কী?

চুল।

সত্যিই চুল?

আমি বললাম।

হ্যাঁ রে। চুল-এর বটানিকাল নাম Sagerala Eliptics.

বলেই বলল, আর ওই দ্যাখ, ওই প্রাগৈতিহাসিক মহীরুহ, চিড়িয়াটাপ্পর পথে দেখেছিলি দু’-একটা–এখানের সবচেয়ে সুপরিচিত গাছ প্যাডক।

তিতির বলল, এর পরও চ্যাথাম আইল্যান্ডে চেরাই করা কাঠ দেখতে যাচ্ছি না। করাতকল তো নয়, গাছেদের লাশ কাটা ঘর।

বাঃ। ভাল বলেছিস।

ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, তুমি এবারে তোমার বটানির ক্লাসটা বন্ধ করো। চলো, গুহাটাকে আবিষ্কার করি আমরা। বাবাঃ এত গাছ কি এক সঙ্গে হজম করা যায়। সবই গুলিয়ে গেল। কাল রাতের সার্ডিন ভাজাই হজম হয়নি তার উপরে এত বড় বড় সব বিদঘুটে নামের গাছ।

ঋজুদা হেসে বলল, ভটকাইকে, হ্যাঁ। ঠিকই বলেছিস, গুহাটা কোনদিকে, তা তোরা স্কাউটিং করে বের কর। একেকজন একেক দিকে চলে যা। আর গুহাটা খুঁজে পেলে গুহার মধ্যে তোদের কার ঘর কোনদিকে হবে তা এখন থেকেই ঠিক করে নে। ফার্স্ট কাম ফাস্ট-সার্ভড। কলকাতা থেকে আর্কিটেক দুলাল মুখার্জি আর মিহির মিত্রকে নিয়ে আসব। দ্য ডেভিলস ডেন-এ আমার ভিলার প্ল্যান করার জন্যে। আমার বাড়ি হবে, আর সেখানে তোদের আলাদা আলাদা ঘর থাকবে না, তা কি হতে পারে!

চাই না ঘর আমাদের। এখানে তোমাকে আর আসতেই দেব না।

যুবরাজ ভাদেরা আমাদের ঝগড়া দেখে হাসছিলেন।

ঋজুদা বলল, তোরা তিনজনেই গুহার খোঁজ কর আমি আর ভাদেরা যাই পুকুরটার খোঁজে। নারি বলেছিল এখানে একটা মিষ্টি জলের পুকুর আছে।

পাহাড়চুড়োয় পুকুর? আজব কাণ্ড তো!

জল তো আর নীচ থেকে ওঠেনি। পুকুর খুঁড়েছিল কেউ কোনও সময়ে। তারপর বৃষ্টির জল জমে জমে পুকুর হয়ে গেছে। এখানকরা স্যান্ডস্টোন যদিও কোয়ার্টজাইট বা ব্যাসাল্ট বা মাৰ্বল বা গ্রানাইটের মতো ওয়াটারটাইট নয়, মানে ওইসব পাথরের তুলনাতে পোরাস’, তবু পাথর তো৷ পুকুর যদি খুঁজে পাই তা হলে সেখানে আমিও রুই কাতলা কই-মাগুর সব ছাড়ব। আর তেলাপিয়াও। বাঙালির পো, মিষ্টি জলের মাছ ছাড়া চলে? বল? আর গদাধরকেও নিয়ে আসব। কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে তেল কই রাঁধবে সে জম্পেশ করে। পেঁয়াজ কাঁচালঙ্কা বা সরষে দিয়ে তেলাপিয়া।

আমি বললাম, তুমি মাসে এক লক্ষ টাকা মাইনে দিলেও গদাধরদা আসবে না মরতে এখানে। দোখনো বাদার মানুষ তার মদনটাকির ফির দেশ ছেড়ে সে থোড়াই এই মেগাপড়ের দেশে আসবে। তা ছাড়া, আমি তো গিয়েই জুরুইন ভূতের গল্প করব তার কাছে। আর দেখতে হবে না।

ঋজুদা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, তা তো করবিই! বুড়ো বয়সে যে এই ডেভিলস ডেন-এর টঙে বসে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখব আর আবৃত্তি করব I am the monarch of all I survey’–সেই সুখ কি আছে আমার কপালে! তোরা তো আমার মিত্র নোস, শত্রুই।

তারপর বলল, তোদের কাছে একটা বন্দুক রাখ, গুলি ভরেই রাখ, আর অন্যটা আমাকে দে। সেটাও গুলি ভরে দে। সাপ দেখলেই ট্রিগার-হ্যাপি মিস্টার ভটকাই। গুলি চালাবে না। বুঝেছ। সাপ যদি তোমাদের দিকে তেড়ে আসে তবেই মারবে। মনে থাকে যেন। আমার জমিদারিতে অযথা খুন-খারাপি ঘটাতে দেব না আমি। একে এক অভয়ারণ্য করে গড়ে তুলব।

ঋজুদা আর ভটকাই-এর যুবরাজ দাদা দ্বীপের উত্তর দিকে চলে গেল, আমরা দক্ষিণ দিকে এগোলাম।

‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’-এর এলাকা কত হবে তা এখনই বোঝা যাচ্ছে না। তবে এক থেকে দেড় বর্গ কিমি তো হবেই কম করে।

তিতির বলল।

ভটকাই বলল, একবার চিন্তা কর রুদ্র। আমার এক পিসতুতো জামাইবাবু সল্টলেক-এ পাঁচ কাঠা জমি কিনে গর্বে বেঁকে গেছে। আবার বলে, আমেরিকান কায়দায়, সল্টলেক সিটি। দেড় দু’বর্গকিমিতে কত কাঠা জমি থাকে রে রুদ্র?

এমন সুন্দর জায়গাতে আমাকে দিয়ে অঙ্ক করাস না। ক্যালকুলেটরও নিয়ে আসিনি।

আমি বললাম।

থাকগে। ওই অঙ্ক আমি ওই জামাইবাবুকে দিয়েই কষাব। অঙ্ক কষতে কষতে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যাবে।

কেন?

কেন আবার? জে ফর জেলাসি।

আমি আর তিতির হেসে উঠলাম। ভটকাই-এর হরকতে।

একটু এগোতেই আমরা একটা ঘাসবনে এসে পড়লাম। সুন্দর একরকম ফিকে গোলাপি ফুল ফুটেছে সেই ঘাসে। প্রভাতী হাওয়ায় সুন্দর একটা আলতো গন্ধও ভাসছে সামুদ্রিক হাওয়াতে। পলিউশন যে কাকে বলে, তা ভুলেই গেছি পোর্ট ব্লেয়ারে প্লেন থেকে নামার পরে। আর ‘দ্য ডেভিলস আইল্যান্ড’-এ হাওয়াতে যে পরিমাণ অক্সিজেন তাতে বছর খানেকের জন্যে গড়িয়াহাটের মোড় বা ডালহৌসি স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে থাকলেও ফুসফুঁসের কিচ্ছু ক্ষতি হবে না।

ভটকাই দেখি, ডাঙায় তোলা কই মাছের মতো মুখ হাঁ করে প্রশ্বাস নিচ্ছে। মুখ খুলছে আর বন্ধ করছে।

কী রে?

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, ফুসফুসটাকে সার্ভিস করে নিয়ে যাচ্ছি। সত্যি। ঋজুদা এখানে থাকলে মন্দ হয় না কিন্তু। বছরে একবার করে জাহাজের ডেকে শুয়ে সবচেয়ে কম পয়সার টিকিটে কলকাতা থেকে চলে আসতে পারলে বাকিটা তো কেয়ার-অফ ঋজু বোস হয়ে যাবে। ঋজুদার বোট আনতে যাবে আমাদের পোর্ট ব্লেয়ারে। তারপর গুহার মধ্যে নিজের ঘরের বারান্দাতে পায়ের উপর পা তুলে বসে শুধু প্রশ্বাস নিয়ে যাব।

এই ফুলগুলোর কী নাম, জানো রুদ্র?

তিতির বলল।

না, জানি না, জানতে চাইও না। তোমাকে দেখি আধুনিক মানুষের রোগে ধরল।

মানে?

মানে, এই পৃথিবীতে জানার অনেক কিছুই আছে কিন্তু তা বলে সব কিছুই জানতে চাইতে নেই তিতির। কিছু জানার বাকি থাক, রহস্য থাক কিছু অমীমাংসিত। সবজান্তা মানুষের বড়ই বিপদ।

কেন?

কারণ, সে বড় রিক্ত।

সে আবার কী কথা।

এটা ভাববার কথা। ভেবে দেখো। শুধুমাত্র এই কারণেই আধুনিক মানুষদের জন্যে আমার মাঝে মাঝে বড় কষ্ট হয়। চাঁদে কী আছে? বৃহস্পতিতে প্রাণ আছে কি না? সমুদ্রের গভীরে কী কী থাকে? তার সব মাছ, সব প্রাণী, অক্টোপাস, তিমি, হাঙর, সব ফাঙ্গি, প্ল্যাংকটন, অ্যালগিকে চিরে চিরে না জানলে মানুষের শান্তি নেই। প্রকৃতির মধ্যের সব রহস্যই যেদিন মানুষ জেনে যাবে, সেদিন তার রিক্ততার আর শেষ থাকবে না। রহস্যময়তাই সব সৌন্দর্যর, ভাললাগা, ভালবাসার গোড়ার কথা। তা, তোমার মতো সুন্দর কোনও মেয়ের রহস্যময়তাই হোক, কি সমুদ্র বা পাখি বা প্রজাপতি বা কোনও ফুলের।

তারপর বললাম, জানি না, বুঝিয়ে বলতে পারলাম কিনা। কিন্তু এমনই মনে হয়।

ভটকাই বলল, খাইছে। পোলাড়া দেহি এক্কেরে ফিলসফার হয়্যা গেল গিয়া। হায়! হায়! কলকাতা ফিরেই মাসিমাকে বলতে হবে তোকে চোখে চোখে রাখতে।

সামনেই বড় বড় গাছের একটা দঙ্গল। তার মধ্যে প্যাডক আর ডিডু চিনলাম। অন্য গাছগুলোর পরিচয় ঋজুদা এক সঙ্গে আমাদের ক্যাপসুলে ভরে বলে দিল বলেই গুলিয়ে গেছে। মানুষ চেনারই মতো, গাছ চেনাও সহজ নয়। ওই জঙ্গলের আড়ালে কী আছে দেখা যাচ্ছে না। হয়তো আরও জঙ্গলই আছে। মাটিতে ও গাছে সাপের জন্যে চোখ রেখে ওই গাছের জঙ্গলের মাঝামাঝি আসতেই ভটকাই চেঁচিয়ে উঠল, ওই তো গুহাটা।

আমরা তিনজনেই সেদিকে তাকিয়েই স্তব্ধ হয়ে গেলাম। ঋজুদার সঙ্গে কম জঙ্গলে তো ঘুরিনি দেশে-বিদেশে, কম পাহাড়ে চড়িনি, কম গুহাও দেখিনি কিন্তু এক ঝলক দেখেই মনে হল, এই গুহাটার মধ্যে কেমন এক প্রাগৈতিহাসিকতা আছে যেন। তার মুখের সামনে আগাছার জঙ্গল। নানা লতা লতিয়ে উঠেছে ছাদে। মধ্যপ্রদেশের হাম্পি বা বিজয়নগরে একা একা গেলে যেমন গা ছমছম করে এই গুহাটা দেখেও তেমনই গা ছমছম করে উঠল।

গুহার মুখটা প্রকাণ্ড। চার পাঁচটা হাতি ঢুকে যেতে পারে সহজেই পাশাপাশি। সাবধানে আমরা গুহার মুখে গিয়ে পৌঁছলাম জঙ্গলটা পেরিয়ে। তার মধ্যে কোন জন্তু জানোয়ার বা সাপ-খোপ আছে তা কে জানে! মস্ত লম্বা তার মধ্যেটা। খুব উঁচুও। পেছনের মুখটাও খোলা। তবে সেটা ঢোকার মুখের মতো অতখানি চওড়া নয়। গুহার পেছনের খোলা মুখ দিয়ে আকাশের নীল আর সমুদ্রের সবুজ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের নিজের তো কোনও রং নেই, জলের গভীরতার জন্যে কোথাও সবুজ, কোথাও নীল বা কোথাও কালো মনে হয় আর আকাশ তার রং ধার দেয় সমুদ্রকে, ধার দেয় চাঁদ এবং সূর্যও। সমুদ্রের বুকে অনেকই আঁটে। অন্ধকার রাতে সমুদ্রের আবার অন্য রূপ। কখনও কখনও ফসফরাস জ্বলে ঢেউ-এর মাথায় মাথায় জলপরী আর মৎস্যকন্যাদের কোনও উৎসবের দিনে।

গুহার ভিতরে পা বাড়াতেই ভিতরে যেন একটা ঝড় উঠল। আর তার সঙ্গে উৎকট দুর্গন্ধ। বাঘের গুহাতে যেমন দুর্গন্ধ থাকে, তেমন। প্রায় দু-তিনশো বাদুর তাদের ডানারফটাফট শব্দে পাখিদের পাখসাটের চেয়েও অনেক জোরদার শব্দ করে। একই সঙ্গে গুহার বাইরে আসতে লাগল। উড়ে। আমরা কী করব বুঝতে না পেরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম তিনজনেই। কিছু উড়ে গেল পেছনের মুখ দিয়েও সমুদ্রের উপরে। ভটকাই বলল, ফ্লাইং মারব? শটগান দিয়ে? কী রে রুদ্র? এক নম্বর দিয়ে মারলে গোটা চারেক কি বেশিও নির্ঘাত পড়ে যাবে। এরা সব ফল-খাওয়া বাদুড়। এদের মাংস যা রোস্ট হবে না! লাজোয়াব!

তিতির নাক কুঁচকে বলল, খবরদার নয়। মরে গেলেও ওই দুর্গন্ধ প্রাণীর মাংস আমি খাব না। মেরো না রুদ্র।

বাদুড়দের মেঘ মাথার উপর দিয়ে উড়ে বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে গেল ডেভিলস আইল্যান্ডের আকাশে। নানা গাছে গিয়ে বসল বোধ হয়।

তারপর তিতির বলল, এখানে মারামারি নয়। ঋজুদানা বলেছে এখানে অভয়ারণ্য গড়বে!

ছাড়ো তো ঋজুদার কথা। সারাজীবন জন্তু-জানোয়ার মেরে ঢিবি করে দিয়ে এখন বড় ধার্মিক হতে চাইছে। ঋজুদার মতিভ্রম হয়েছে।

আমি রুদ্রকে বললাম, তোর বড় বাড় বেড়েছে ভটকাই।

ঠিক সেই সময়েই মালভূমির অন্যদিক থেকে ধ্বপ করে একটা গুলির আওয়াজ হল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে শটগানের গুলির আওয়াজ ওরকমই শোনায়।

আমাদের কথার মধ্যেই বাদুড়গুলো গুহা খালি করে দিল আমাদের জন্যে। প্রোমোটারেরা যেমন পুরনো বাড়ির গরিব ভাড়াটেদের নির্দয়ভাবে উৎখাত করে, আমরাও আমাদের নতুন আস্তানার জন্যে বাদুড়দের উদ্বাস্তু করে দিলাম। বেচারিরা কোথায় থাকবে এখন, কে জানে! তিতির তখনও বাঁ হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে নাক চেপে ছিল। সত্যিই ভীষণই দুর্গন্ধ। এখানে যে কত পেটি রুম-ডেওডরান্ট লাগবে গন্ধ মারতে তা ঈশ্বরই জানেন। দুর্গন্ধটা কোনওরকমে সহ্য করে আমরা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম এবং এগিয়ে যেতেই এক জায়গাতে চার-পাঁচটি নরকঙ্কাল দেখতে পেলাম। কঙ্কালদের গায়ের পোশাক ধুলো হয়ে গেছে। কিন্তু মাথার রংচঙে টুপিগুলো প্রায় অক্ষতই আছে। ইংরেজি ছবিতে জলদস্যুরা যেমন টুপি রত তেমনই টুপিগুলো।

ভটকাই বলে উঠল ইরিবাবা। ওদের খুন করা হয়েছিল না নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল কে জানে কোন দেশি মানুষ এরা তাই বা কে জানে। এক পাশে দেখলাম একটা লম্বা দূরবিন পড়ে আছে যেমন তালের ভেঁপুর মতো দুরকিন আগে ব্যবহার হত সমুদ্রে।

এসব পাশ কাটিয়ে গিয়ে আমরা গুহার অন্য মুখে গিয়ে পৌঁছলাম। আর পোঁছেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গুহাটার বাইরে অনেকখানি অনাবৃত পাথুরে জায়গা, ইংরেজিতে যাকে বলে ledge তাই আছে। খোলা বারান্দার মতো। আর সেখানে দাঁড়ালে সমুদ্রর যা দৃশ্য তা কী বলব! একবারে খাড়া প্রায় ছ-সাতশো ফিট নীচে সমুদ্র। ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে ডেভিলস আইল্যান্ডের পায়ের পাথরে। তটভূমি নেই। আসলে এই দ্বীপও তো একটি পাহাড়ই। প্রায় হাজারখানেক সাদা সিগাল আর টার্নচক্রকারে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের কিছু কিছু মাঝে মাঝেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তার মানে, এই পাহাড়ের খাড়া গায়ে ওদের বাসা আছে। ওদের তীক্ষ্ণ কিন্তু বিলাপের মতো ডাকের মধ্যে এক গভীর বিষণ্ণতা আছে। যে বিষণ্ণতা সমুদ্রের জলে এবং ওই গুহাতেও ছড়িয়ে যাচ্ছে, আবিরের মতো উড়ে যাচ্ছে সামুদ্রিক হাওয়ার দমকে দমকে।

আমরা তিনজনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেই প্রাকৃতিক বারান্দাতে। অনেকক্ষণ। কোনও কথা সরছিল না কারও মুখেই। অনেকক্ষণ পরে বাঁচাল ভটকাই বলল, সত্যিই যদি ঋজুদা এখানে আস্তানা গাড়ে তা হলে আমি কিন্তু ঋজুদার ফ্রাইডে হয়ে সেঁটে যাব। আঃ কী জীবন। চিন্তা করা যায় না। বল রুদ্র?

তিতির স্বগতোক্তি করল, ঋজুকাকার কোনও বিপদ হল না তো! গুলি ছুঁড়তে হল। কেন? আমাদের উচিত একবার ওদিকে গিয়ে খোঁজ করা।

ঠিক বলেছ। বলে, আমরাও সেই স্বর্গের বারান্দা ছেড়ে সেই গা-ছমছম করা প্রায়ান্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকে এলাম আবার।

ভটকাই বলল, এখান থেকে সানরাইজ আর সানসেট কেমন দেখাবে বলত রুদ্র।

তিতির সঙ্গে সঙ্গে সুইজারল্যান্ড থেকে তার বড় মামার এনে দেওয়া ঘড়ির ব্যান্ডে লাগানো কম্পাসে চেয়ে বলল, বাঃ। গুহাটা উত্তরমুখো। তার মানে, ওই বারান্দাতে দাঁড়িয়ে ডানদিকে চাইলে সানরাইজ আর বাঁদিকে চাইলে সানসেট দেখা যাবে। ফার্স্টক্লাস।

গুহা থেকে বেরিয়ে আমরা বাইরে পড়ে কিছুটা যেতেই ঋজুদা আর যুবরাজের গলার স্বর শুনতে পেলাম। ওরা এদিকেই আসছেন। ভটকাই গলা তুলে বলল, ঋজুদা, আমিও একটা বই লিখব ঠিক করলাম।

কী বই?

দূর থেকেই বলল, ঋজুদা।

‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়ার সেকেন্ড পার্ট।

তারপরই বলল, গুলি চালালে কেন?

এবার ওঁদের দেখা গেল। ঋজুদা বলল, এমার্জেন্সি হয়েছিল। বাঙালির ভাবী জামাই-এর প্রাণ বাঁচাতে গুলি চালাতে হল। নইলে, এতক্ষণে শঙ্খচূড় সাপে তার মাথাতে ছোবল মারায় সে ‘ফিনিতে’ হয়ে যেত। বাপরে বাপ। কত বড় সাপ। সাপটার সঙ্গে বোধহয় যুবরাজের ফিয়াসেরও প্রেম আছে নইলে যুবরাজকে দেখেই সে অমন তেড়ে আসবে কেন? আমিও তো পাশেই ছিলাম।

যুবরাজ ভাদেরা হাসছিল। বলল, রিয়্যালি আই উড হ্যাভ বিন ডেড অ্যাজ হ্যাম বাই নাউ। থ্যাঙ্কস টু মিস্টার বোস।

তিতির উত্তেজিত গলায় বলল, কী দুর্গন্ধ জানোনা ঋজুকাকা। অসংখ্য বাদুড়। তা ছাড়া কঙ্কাল আছে গুহার মধ্যে, জানো ঋজুকাকা। বিদেশি নাবিকদের।

কী করে বুঝলি যে বিদেশি নাবিকদের?

টুপি আর দূরবিন দেখে।

ভালই হল। নিয়ে যেতে হবে মেমেন্টো হিসেবে। একটা টুপি যুবরাজকে দিয়ে দেব, ভাল করে ড্রাই-ক্লিনিং করে মেমেন্টো হিসেবে ওর ফিয়াসেকে প্রেজেন্ট করবে। শঙ্খচূড়ের চামড়াটাও ‘স্কিন’ করে দিস তো রুদ্র।

আমি কিছু বললাম না। গুহাটা দেখে এতই অভিভূত হয়ে গেছিলাম যে, অত কথা তখন ভাল লাগছিল না। আবার আমরা ঋজুদাকে আর যুবরাজদাদাকে নিয়ে গুহার মধ্যে ঢুকলাম। বাদুড়ের কথা শুনে ঋজুদা উত্তেজিত হয়ে উঠল। বলল, বাদুড়গুলোর যা রোস্ট হত না, মারলি না কেন গোটা চারেক? তা ছাড়া খারাপ কি গন্ধটা? আমার তো বেশ ভালই লাগে।

ভটকাই বলল, ওই যে! তোমার চেলা-চেলিদের জিজ্ঞেস করো।

ঋজুদা বলল, কঙ্কালগুলোও নিয়ে যেতে হবে। নৃতত্ত্ববিদদের কাছে পাঠাব। তাঁরা এইসব কঙ্কালের মালিক মানুষেরা ঠিক কত বছর আগের তা বলে দিতে পারবেন পরীক্ষা করে। এখানে কঙ্কাল তো থাকতেই পারে। খুনখারাপি তো হতই, আবার–খেয়েও মরে থাকতে পারে এরা। ধরো আমরা যাবার সময়ে যদি ভটকাইকে এখানে নামিয়ে দিয়ে চলে যাই, তবে বাদুড় আর ফল খেয়ে আর কতদিন বাঁচবে। ছমাস পরে এলে আমরাও ভটকাই-এর কঙ্কালও পাব, এই নীলরঙা জামাটা গায়ে দেওয়া অবস্থাতেই।

ভটকাই তাকে নিয়ে বদ রসিকতাতে চটে গিয়ে বলল, মরে গেলে দাহ না হলে সকলেই তো কঙ্কাল হবে। তা আমিও হব। তাতে আর কী?

বাইরের খোলা বারান্দাতে পৌঁছে ঋজুদা বলল, বাঃ যেমনটা ভেবেছিলাম, ঠিক তেমনই। এখানে না থাকলেইনয়। এই দ্বীপ থেকে কোনও বাণিজ্যিক জাহাজও দেখা যাবে না কারণ এর ধারেকাছে কোনও শিপিং চ্যানেলই নেই। তবে যুদ্ধজাহাজ দেখা যেতে পারে।

ভাদেরা বলল, সাবমেরিনও মাঝে মাঝে দেখা যেতে পারে। জলের নীচ থেকে দেশি বা বিদেশি সাবমেরিন পেরিস্কোপ তুলে দেখে যাবে আপনাকে। কখনও বা অক্সিজেন ভরার জন্যে সাব’ ভেসে উঠলেও দেখতে পারেন প্রকাণ্ড, কালো, তিমি মাছের মতো তার শরীরের পিঠের উপরের কনিং-টাওয়ারে’ ক্যাপ্টেন আর ক্রুরা দাঁড়িয়ে আছে।

এই গুহাটা কিন্তু ইন্ডিয়ান নেভি সহজেই রকেট-লঞ্চার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। লং-রেঞ্জ রকেট লঞ্চার। আজকাল তো নিশানা নেওয়ারও দরকার নেই। Heat-Seeking Rocket নিজেই শত্রুপক্ষের প্লেন বা জাহাজ বা সাবমেরিনকে খুঁজে নেবে।

তা ঠিক। ভাদেরা বলল। তারপর বলল, ব্যবহৃত হবেও হয়তো কখনও। কে বলতে পারে। আমাকে একটা রিপোর্টও দিতে বলেছেন কমোডর বাটলিওয়ালা।

নানা জনে নানা কথা বলছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে। ওই সামুদ্রিক হাওয়ার মধ্যে, টার্ন আর সি-গালেদের সংক্ষিপ্ত কিন্তু চাবুকের মত ডাকের মধ্যে, ডেভিলস আইল্যান্ডের সেই উঁচু, খোলা পাহাড়ি বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আমি ভাবছিলাম, আমি আরও বড় হয়ে, সচ্ছল হয়ে নিজস্ব মালিকানার এমন একটি দ্বীপের বাসিন্দা হব। সেখানে বসে লিখব, ছবি আঁকব, গান গাইব আর ভাবব। হেনরি ডেভিড থোরোর The Walden’-এর মতো, ওয়াল্ট হুইটম্যানের The Leaves of Grass’-এর মতো, শ্রীঅরবিন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দ বা রবীন্দ্রনাথের মতো লেখা লিখব, যা পড়ে, আমার পরের পরের পরের প্রজন্মর মানুষেরা মানুষের মতো মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। শুধু মানুষের চেহারা থাকলেই তো আর কেউ মানুষ হয়ে ওঠে না, ওই সব লেখা পড়েই তো আমার মতো সাধারণেরও মানুষের মতো মানুষ হয়ে ওঠার ইচ্ছা জাগে মনে।

ঋজুদা হঠাৎ বলল তিতিরকে, তিতির, আয় আমরা সবাই এখানে বসি কিছুক্ষণ। মৃত বিদেশিদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি কিছুক্ষণ নীরব থেকে। বলে, নিজেই আগে পাথরের উপরে পা মুড়ে থেবড়ে বসে পড়ল। সর্বক্ষণ হাওয়া চলে, তাই পাথরের উপর কোনও ধুলোবালি ছিল না। এমনিতে মসৃণও।

আমরাও সকলে বসলে কিছুক্ষণনীরবতা পালনের পরে ঋজুদা বলল, সেই গানটা শোনা তো তিতির। পুরোটা গাইবি কিন্তু। আস্তে আস্তে, তাড়াহুড়ো করবি না।

কোন গানটা তা তো বলবে?

তিতির বলল।

ও হ্যাঁ।

সেই যে, ‘ঘাটে বসে আছি আনমনা’।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিতির বলল কথা যে মনে নেই।

এই তো তোদের দোষ।

ঘাটে বসে আছি আনমনা যেতেছে বহিয়া সুসময়
সে বাতাসে তরী ভাসাব না যাহা তোমা পানে নাহি বয়।

তারপরে কী তা আমিও ভুলে গেছি। শেষটা মনে গাছে। গানটা ধরই না। ধরলেই মনে পড়ে যাবে।

শেষটাই বলো তুমি। তিতির বলল।

এতদিন তরী বাহিলাম যে সুদূর পথ বাহিয়া–
শতবার তরী ডুবুডুবু করি সে পথে ভরসা নাহি পাই।
তীর সাথে হেরো শত ডোরে বাঁধা আছে মোর তরী খান–
রশি খুলে দেবে কবে মোরে, ভাসিতে পারিলে বাঁচে প্রাণ।
কবে অকূলে খোলা হাওয়া দিবে সব জ্বালা জুড়ায়ে
শুনা যাবে কবে ঘন ঘোররবে মহাসাগরের কলগান ॥

ঋজুদা সুললিত গলায় আবৃত্তি করল। নিজে গাইলেই পারত। ভারী ভাল গায় অথচ গাইবে না। তবে আমার কখনও কখনও শোনার সৌভাগ্য হয়েছে।

ঋজুদা বলে, সব কিছুকেই কি বাজারে আনতে হয়? কিছু তো আমার নিজস্ব থাকবে!

কথাটা আমার খুবই ভাল লেগেছিল। আজকের এই আদেখলাপনার যুগে মঞ্চে উঠে নিজেকে নির্লজ্জর মতো প্রচার করার যুগে এমন মানসিকতা খুব কম মানুষেরই মধ্যে দেখতে পাই।

তিতির ধরল গানের মুখটা। রবীন্দ্রনাথের বা অতুলপ্রসাদের কিছু কিছু গান কোনও কোনও পরিবেশে কোনও সাধারণ গাইয়ের গলাতেও এমন গভীরতা ও দীপ্তি পায় যে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়।

গান শেষ হবার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত আমরা সবাই-ই চুপ করে বসে রইলাম। ঋজুদার পাইপ অনেকক্ষণ নিভে গেছিল কিন্তু নতুন করে আর ধরাল না। সমুদ্রের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইল আত্মস্থ হয়ে। ওই মানুষটির মধ্যে যে কতজন পরস্পর-বিরোধী মানুষ আছে তা শুধু আমরা তিনজনই জানি। অন্যেরা ঋজুদার তল পাবে না।

গান শেষ হলে ভাদেরা লাজুক মুখে নরম করে বলল, ও ও রবীন্দ্রসংগীত গায়।

ঘোর ভেঙে ঋজুদা বলল, ও কে?

মানে, আমার ফিঁয়াসে।

ও। আই সি।

ঋজুদা হেসে বলল।

তারপর বলল, তুমি বাংলা শিখছ, রবীন্দ্রনাথকে ভাল করে পড়ো। সত্যিই যদি পড়ো, যদি তাঁর গানকে হৃদয়ের শরিক করে তুলতে পারো, তবে কোনওদিন বা তোমারও উত্তরণ হবে। উ্য আর ভেরি লাকি দ্যাট উ্য আর গোয়িং টু ম্যারি আ বেঙ্গলি গার্ল হু সিংগস টেগোর সঙস।

ভটকাই-এর যুবরাজদাদা চুপ করেই রইল মাথা নামিয়ে। আমরাও চুপ করে রইলাম।

সব জায়গাতে, সব সময়ে কথা শুনতে তো ভাল লাগেই না, বলতেও নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress