ঠিকানা
পার্কের একপাশে একটা বেঞ্চে একাকী বসে পড়লেন দীনোনাথবাবু। মনটা আজ বড়োই বিষন্ন, বিক্ষিপ্ত।
মনে পড়ছে কেতকীর সাথে দেখা হওয়ার প্রথম দিনের কথা। কয়েকদিন হল কেতকী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার চলে যাওয়াটা দীনোনাথ বাবু কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি।
আজ পঞ্চাশ বছর কেতকী আর দীনোনাথ একে অন্যের পরিপূরক। ভাবলে যেন মনে হয় এইতো সেদিনের কথা কেতকী লাল বেনারসী পরে নববধূ রূপে তার সংসারে এলো। এক বছরের মধ্যেই খোকা এলো। খোকার জন্মের সময়তো কেতকীর যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা, অনেক কষ্টে জীবন যুদ্ধে জয়লাভ করে ও খোকাকে নিয়ে বাড়ি ফেরে।
এই কেতকী চলে যাওয়ার পরই তাদের একমাত্র সন্তান সোহম বৌমার সাথে পরামর্শ করে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত দীনোনাথবাবু বিনা বাক্যব্যায়ে মেনে নিয়েছেন। দীনোনাথবাবু অনেক কষ্টে শরীরটাকে পার্কের বেঞ্চ থেকে টেনে তুলে এগিয়ে চললেন বাড়ির দিকে। এই পার্কের সাথে তার অনেক বছরের সম্পর্ক। কেতকীর সাথে প্রথম দেখা এই পার্কেই।এখান থেকেই তাদের একসাথে পথ চলা শুরু হয়েছিল। কিন্তু কেতকী তো তাকে ছেড়ে একাই চলে গেল। আজ দীনোনাথবাবুও চলে যাচ্ছেন! এই পার্ক ছেড়ে কোনো এক অজানা ঠিকানায়। বাড়ি পৌঁছে দেখলেন ছেলে রেডি বাবাকে নিয়ে যাবার জন্য। তিনিও তার ব্যাগটা গুছিয়েই রেখেছিলেন যাবার জন্য। ছেলের সাথে রওনা হলেন নতুন ঠিকানায়।
পরিবেশটা ভালোই, অনেক বড় জায়গা নিয়ে আশ্রমটা গড়ে উঠেছে, সামনে খানিক বাগান ও আছে। একজন মালী বাগানের গাছে জল দিচ্ছে। সূর্য অস্ত গেলেও এখনো পুরো অন্ধকার নামেনি। সেই নিভু আলোয় দীনোনাথবাবু দেখলেন, বাগান পেরিয়ে একটা চাতাল মতো জায়গায় একটা রাধাকৃষ্ণ মন্দির রয়েছে,সেখানে সন্ধ্যারতির ব্যবস্থা হচ্ছে। বেশ কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসে বসেছে চাতালে। সোহম বাবাকে নিয়ে এগিয়ে চলল রিসেপশনের দিকে। আগে থেকেই সব ঠিকঠাক করা ছিল। সোহমকে দেখে চেয়ারে বসা ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন
“আরে আসুন আসুন।”
“হ্যাঁ, ইনি আমার বাবা, এনার কথাই বলেছিলাম। মাত্র কয়েক মাস হলো আমার মা গত হয়েছেন তার পর থেকে উনি খুব একা হয়ে গেছেন। আমার মনে হলো এখানে থাকলে উনি সমবয়সী কিছু মানুষ পাবেন যাদের সাথে কথাবার্তা বললে ওনার একাকীত্ব কিছুটা হলেও কাটবে।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ সে তো বটেই, আর আমাদের এখানে যারা থাকেন সবাই একটা পরিবারের মতো হয়ে যান।আপনার বাবা ভালোই থাকবেন”
সেই ভদ্রলোক ওনাদের নিয়ে এলো একটা ঘরে।ঘরটা ছোট দুপাশে দুটো বিছানা, পাশে বেডটবিল, দেয়ালে ঝোলানো একটা আয়না আর দুটো ছোট আলমারি। ঘরের লাগোয়া একটা ছোট বাড়ান্দাও আছে। দীনোনাথবাবু দেখলেন ব্যবস্থা মোটামুটি খারাপ না। একজন ওনার বয়সী লোক ওই ঘরে আগে থেকেই আছেন।তিনি জিজ্ঞেস করলেন
” আপনি কি এখন থেকে এই ঘরেই থাকবেন?”
দীনোনাথবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন
“হ্যাঁ এটাই এখন আমার নতুন ঠিকানা।”
দীনোনাথবাবু তার নতুন ঠিকানা মেনে নিলেন কোনো কথা না বলে। কিন্তু মনে মনে ছেলের উপর খুব অভিমান হলো। অভিমান হলো কেতকীর উপর। নীরব অভিমানে দীনোনাথ বাবুর চোখদুটো ভিজে উঠলো।কিন্তু পাছে কেউ দেখতে পায় তাই সবার অলক্ষ্যে চশমা খুলে চোখদুটো মুছে নিলেন।
“বাবা, এখানে তোমার খুব ভালো লাগবে দেখো। সবার সঙ্গে কেমন বন্ধুত্ব হয়ে যাবে, তুমি কথা বলার লোক পাবে। বাড়িতে আমরা সবাই ব্যস্ত কেউ তোমাকে সেভাবে সময় দিতে পারি না,এটাই ভালো হলো।”
“হ্যাঁ, এই বেশ ভালো হলো, তোদের আর কোনো অসুবিধা হবে না এই বুড়ো বাবাটাকে নিয়ে।”
“বাবা এ তোমার কেমন অভিমানের কথা? আমরা কি অসুবিধার জন্য তোমাকে এখানে রেখেছি? তোমার একাকীত্ব কাটানোর জন্য এই ব্যবস্থা করেছি।”
মুখে বলল ঠিকই কিন্তু সোহম নিজেও জানে দক্ষিণের ওই ঘরটার প্রতি সুমনার বরাবরই নজর ছিলো,কিন্তু ওটা বাবা-মা’র ঘর, তাই কিছু বলতে পারতো না। মা মারা যাবার পর সুমনা একরকম জোর করেই বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখার জন্য জেদ শুরু করে ছিলো।এই নিয়ে নিত্য দিন স্বামী-স্ত্রী’তে অশান্তি লেগেই থাকতো।তার পর কিছুটা বাধ্য হয়েই সোহম বাবাকে নিয়ে আসে এই বৃদ্ধাশ্রমে। বাড়ি থেকে অনেকটাই দূরে এই বৃদ্ধাশ্রম কিছুটা গ্রাম্য পরিবেশে গড়ে উঠেছে। আশ্রমের মালিক কিছুটা সেবার মনোভাব নিয়েই এই আশ্রম শুরু করেছেন। যদিও সামান্য কিছু ডিপোজিট মানি আর মাসে মাসে খাওয়া খরচ বলে কিছু টাকা দিতে হবে, তা সে অংকটা তেমন কিছু নয়। অন্তত নিজের সংসারে অশান্তির তুলনায় এই টাকাটা খুবই সামান্য।
দীনোনাথবাবু বললেন “হ্যাঁ বাবা তুই ঠিকই বলেছিস এখানে আমার একটুও অসুবিধা হবে না। আমি এখানে খুব আনন্দেই থাকবো,তুই কিচ্ছু চিন্তা করিস না।”
এরপর ছেলে আশ্রমের আনুষ্ঠানিক রীতিনীতি সম্পূর্ণ করে বাবার কাছথেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। দীননাথ বাবু ছেলের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন যত দূর দেখা যায়।
সোহম বাড়ি ফিরে দেখলো ছেলেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সোহমের স্ত্রী তাকে বলল “ছেলে এই ঘরে বসেই খেলছিল,কিন্তু দাদু চলে যাওয়ায় ও বার বার আমাকে জিজ্ঞেস করছিল দাদুকে বাবা কোথায় নিয়ে গেলো?আমি অনেক করে বোঝালাম যে দাদু একটা নতুন জায়গায় গেছে।ও বায়না ধরতে লাগলো দাদুর সাথে তাকে কোনো নিয়ে যাওয়া হলো না? আমি কিছুতেই ওকে বুঝিয়ে পারলাম না,তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো,আমি ভাবলাম ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাই আর ঘরের দিকে যাই নি। কিন্তু অনেক্ষন হয়ে যাওয়ার আমি ঘরের দিকে যাই। গিয়ে দেখি ও ঘরে নেই,সব জায়গা খোঁজখুঁজি করেও ওকে কোথাও পেলাম না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছে, ও কোথায় গেলো বলতো?”
“সুমনা তুমি জানতে ও ওর দাদুকে কতটা ভালোবাসে।ঠাকুমা মারা যাবার পরেও ও এতোটা ভেঙে পড়েনি আজ দাদু চলে যাবে শুনে ও যা কান্নাকাটি করছিলো, তাও তোমার কাছে ওই ঘর, একা স্বাধীন ভাবে থাকা, এই আনন্দটা এতই প্রাধান্য পেলো যে তুমি অত্যন্ত স্বার্থপর হয়ে গেলে,একবারও ভাবলে না তোমার ছেলেটার কথা। না, বাবার কথা ভাবার কথা আমি তোমাকে বলছি না,সে আশাও করি না, কিন্তু নিজের সন্তানের ভালোমন্দ টা তো একবার ভাবতে পারতে! এখন দেখো ছেলেটা কোথায় গেলো? কোথায় খুঁজবো আমি ওকে? এবার তুমি খুশি হয়েছ তো? তোমার সংসারে দেখো কেমন অখন্ড শান্তি, কেমন স্বাধীনতা, ভোগ করো তুমি এসব!”
“তুমি আমাকে এসব বলে সময় নষ্ট না করে দেখো না ছেলেটা কোথায় গেলো?”
খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলো। না, ছেলেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ওরা স্বামী-স্ত্রী ঠিক করলো পুলিশে খবর দেবে। পুলিশ স্টেশনের দিকে সবে মাত্র বেরোতে যাবে এই সময় ডোর বেল বাজার আওয়াজ। দরজা খুলে সোহম দেখে একজন পুলিশ অফিসার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
“কি ব্যাপার অফিসার কি হয়েছে?”
আপনাদের বাড়ির ছেলে কী বাড়িতে আছে?
ন..না ওকে বিকেল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমরা পুলিশে ডাইরি করতেই যাব বলে বেরহচ্ছিলাম। আপনি কি আমাদের ছেলের কোনো খোঁজ পেয়েছেন?”
“আপনারা আমার সাথে একবার থানায় আসুন।”
দুজনে কাঁপা পদক্ষেপে অফিসারের গাড়িতে উঠে থানায় গেলো। দেখলো অদূরে একটা ট্রলিতে একটা ছোট শিশুর দেহ চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা আছে। চাদরের চারিদিকে চাপ চাপ রক্ত লেগে রয়েছে।
সোহম আর সুমনা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল।
অফিসার বলল “দেখুন তো এই শিশু কি আপনাদের হারিয়ে যাওয়া শিশু?”
সুমনা ডুকরে কেঁদে উঠলো, সোহম মুখে রুমাল চাপা দিয়ে প্রাণপন নিজেকে স্থির রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।
অফিসার সহোমকে বলল “শান্ত হন, ও কেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছিলো জানেন?”
“না!”
“ও ওর দাদুকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছিলো। এই দেখুন ওর পকেট থেকে এই চিঠিটা আমরা পেয়েছি। দেখুন তো এটা আপনার ছেলের হাতের লেখা কিনা?”
“হ্যাঁ এটা তো ওরই হাতের লেখা। কিন্তু কিভাবে এটা ঘটল?”
“হাই-ওয়ে পার হতে গিয়ে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খায়।”
দেহ শনাক্ত করে পোস্টমর্টেম এর পর ছেলের ছোট্ট দেহটাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে পরদিন সকাল গড়িয়ে যায়।এতটা সময় কেউ মুখে একফোঁটা জল পর্যন্ত তুলতে পারে নি। বাড়ি ফেরার পর সুমনা সহোমকে বলল “তুমি বাবাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনো। আমার আর দক্ষিণ খোলা ঘর চাই না। আমার ছেলে দাদুর বিচ্ছেদের অভিমানে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো, আমাকে আমার কর্মের যোগ্য শাস্তি দিয়ে আমার জন্য রেখে গেলো আজীবনের চোখের জল। আমি বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে নেব।তুমি বাবাকে ফিরিয়ে আনো, আমাকে আর শাস্তি দিও না আমি আর সহ্য করতে পারছি না।” বলে সুমনা ওখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
সোহম সুমনাকে ঘরে শুইয়ে দিয়ে কাজের মেয়েটাকে বলে গেল ওর সুস্রসা তোমরা করো, আমি বাবাকে ওঁর নিজের ঠিকানায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে যাচ্ছি।সুমনা এই ছোট্ট কথাটা বুঝতে এতো সময় নিলো যার দাম অতি বড় মূল্য দিয়ে চোকাতে হলো। কাউকে ঠিকানা হীন করলে ঈশ্বরও তাকে ক্ষমা করে না। জানিনা আমাদের এই ভাঙা ঠিকানা আর কখনো জোড়া লাগবে কি না তবু দেখি একবার শেষ বারের মতো চেষ্টা করে ঠিকানা মেলে কিনা!