ঝম ঝম নূপুর বাজে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়ায় বৃদ্ধা শোভাদেবীর কাজের ক্ষমতা আর আগের মত নেই। টিপটিপ করে সেই সকাল থেকে চলছেই। সময় মত কাজগুলো না করলেই যে নয়। হাত পায়ের শক্তিটুকু কমে গেলেও মনের জোর কমে যায়নি। ঠিক সেই সময়েই ওঘর থেকে খোকাবাবুর আওয়াজ এল— “মা ভাত হয়েছে কি? আমার যে দেরী হয়ে যাচ্ছে?”
—এই তো হয়ে এল, তুমি বস আমি এক্ষনি নিয়ে আসি।
খোকাবাবুর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু মায়ের কাছে আজও খোকাই রয়ে গেছে। খোকাবাবু কোনো অফিসে যান না। তবুও সময় মত বেরিয়ে পড়তে হয়। কত জানা, কত অজানা পথ পেরিয়ে সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে হয়। বৃদ্ধা মায়ের সেবাযত্ন বলে কথা। একা মাকে ফেলে রেখে বেশীক্ষণ বাড়ীর বাইরে যাওয়া যে মোটেই নিরাপদ নয়।
মায়ের সযত্নে রান্না করা খাবার খেয়ে খোকাবাবু ঝটপট তৈরী হয়ে পরলেন। পরনে লম্বা হাতা জামা ও ঢোলা পায়জামা। সমস্তটাতেই লাল, নীল, হলুদ, সবুজ- নানান বর্ণের গোলাকার বৃত্তে আবৃত। ঠিক তেমনি মাথায় রয়েছে একখানি চোখা টুপি। অনেকটা সার্কাসের জোকারদের মত দেখতে। দুপায়ে রয়েছে দুই গোছা নূপুর। চলার পথেই বেজে উঠে ঝমঝম্। গলায় ঝুলানো রয়েছে একটি টিনের বাক্স। সামনটা কাঁচে বাঁধানো। আর সেই কাঁচের মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেকগুলো ‘শনপাপড়ি। কাচের উপর লেখা ‘খোকাবাবুর শনপাপড়ি’। হাতে রয়েছে একটি ডমরু। নূপুরের ঝমঝম ধ্বনি, ডমরুর টমটম আর রংবাহারী পোষাকের আকর্ষণে বালক বালিকাদের মন ঐ শনপাপড়ি খাবারের টানে আকৃষ্ট হয়ে পরে।
সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে এল । খোকাবাবুর শনপাপড়িও খানিকটা বিক্রি হয়ে গেল। এবার তিনি চলে গেলেন এক বিদ্যালয়ের পাশে অতি সুউচ্চ বৃক্ষের নীচে। এই জল খাবারের সময় ছেলে মেয়েরা দূর থেকে ঝমঝম শব্দ শুনতে পেয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলে এল খোকাবাবুর শনপাপড়ি খাবারের আশায়। একসঙ্গে অনেকগুলি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে খোকাবাবুর দিকে। কেউবা বলছে: ‘আমায় আগে দিন’ আবার কেউ বা বলছে: “আমাকে একটি টাকার দিন — আমাকে দুটি টাকার দিন।” ভীর শেষে একখানি ছোট হাত সামনে এল। বলে উঠলো শনপাপড়িওয়ালা, আমায় একটু দেবে?
খোকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন: বল দেখি মা ক-টাকার নিবে?
— জানি না।
খোকাবাবু বললেন: তা হলে কি করে বুঝবো যে তোমার কতটুকু লাগবে?
–বাবা এলে তোমায় দিয়ে দিব।
এই ছোট্ট খুকির পানে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে তাকিয়ে থেকে খোকাবাবুর মনে স্নেহ জন্মাল। বলে উঠলেন: ‘দাঁড়াও দিচ্ছি, তবে তোমার কাছে টাকা নিব না।’ এই বলে বালিকার ছোট্ট হাতে শনপাপড়ির এক টোপলা দিয়ে দিলেন। কাগজে মোড়ানো শনপাপড়ি পেয়ে মেয়েটির মুখে আনন্দের জোয়ার এল।
খোকাবাবুর খরিদ্দার বলতে ঐ ক্ষুদে ছেলেমেয়েরাই। বয়স্ক লোকের ভীর খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। খোকাবাবুর বাহ্যিক আবরণ যেমন ক্রেতাদের সহজেই আকৃষ্ট করে তুলে, ঠিক তেমনই বালক বালিকার অকপট হৃদয়ের স্পর্শ খোকাবাবুর পরন্ত বয়সের মনকে সজীব করে তুলে।
কখনও নতুন পথ ধরে নতুন গাঁয়ে পসরা করা, আবার কখনও সেই পুরাতন গাঁয়ে নতুন খরিদ্দারের আগমন। খোকাবাবুর এক বিচিত্র স্বভাব এই যে সেটা হল নতুন ক্রেতাদের সঙ্গে আন্তরিক পরিচিতি লাভ করা। গোল মতন এক শুভ্র চেহেরার বালককে জিজ্ঞেস করলেন: বাপু, তোমার কি নাম হে? মনে হচ্ছে তুমি আমার নতুন খোদ্দের ?
একটু হা করে তাকিয়ে থেকে বালকটি উত্তর করল: আজ্ঞে, আমার নাম শ্রী বাদল রায়।
— তাহলে কি তোমার বাবার নাম—
অমনি বালকটি ঝট্ করে উত্তর করল: শ্রী বিমল রায়। আপনি কি বাবাকে চেনেন ?
—“সে কি আর বলতে আছে। এ পাড়াতে ঐ একখানিই রায় বাড়ী। তাহলে তুমি হলে আমার পুরুষানুক্রমিক খোদ্দের। তোমার বাবা আমার এই বাক্সের শনপাপড়ি কত খেয়েছে।” এই বলে বালকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ।
সারাটা দিন পায়ে হেঁটে পসরা করে শনপাপড়ি একেবারে শেষ। এবার বাড়ী ফিরার পালা। হাতের ডমরুটি বাজানোর আর দরকার নেই। শুধু বেজে চলেছে নূপুরের ঝম ঝম ধ্বনি। বিকেলের পরন্ত বেলায় পরিশ্রান্ত দেহ ও মনে বাড়ীতে ফিরার পথে ছোট্ট একটি বাজার পার হতে হয়। খোকাবাবু এখান থেকেই দৈনন্দিন জীবনের পণ্য সামগ্রী বাড়ী নিয়ে যান। দূর থেকে তিনি সেই বাজারের এক মিষ্টান্ন ভান্ডারের সম্মুখে তার বৃদ্ধা মাকে দেখতে পেয়ে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন:
“মা, তুমি একা একা কোথায় যাচ্ছ?”
চশমা চোখে মা মুখ তুলে উপরে তাকালেন। বললেন, “আরে খোকা যে। তুমি এসে গেছো বাবা ?”
—হ্যাঁ মা, আমি এসে গেছি।
ঘরে একা বসে মন অস্থির হয়ে গেছে। সেই সকালে বেড়িয়েছ, এখনও বাড়ীতে না পেয়ে তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছি খোকা।
খোকাবাবু সামনে এসে মায়ের হাত দুটো ধরে জিজ্ঞেস করলেন — “মা, তোমার পায়ের চটি জোড়া পরোনি কেন? খালি পায়ে তোমার পায়ে যে পাথর ফুটবে।”
মা ধীরে ধীরে মুখ তুলে খোকার পানে চেয়ে রইলেন। তার চোখের কোণে জল চলে এল। বললেন: “সারাটা বছর ধরে তুমি বিনা চটি জোড়াতে পসরা কর, সেটা তো তুমি কখনও খেয়াল কর না! তাই তোমার কষ্টের একাংশ আজ আমি একটু অনুভব করলাম।”