সকাল বিকশির, আমার জ্বরতপ্ত কপালে নরম রোদ হাত রাখে,
যেমন রাখতেন মা। স্মৃতিপাখি মাধুর্যে স্নান সেরে মাথার
ভেতর গান গায়। কিছুকাল থেকে জ্বরের পালা নিয়মিত চলছে।
জ্বালাময় চোখ, বিস্বাদ মুখ, খাদ্যে অরুচি, তেতে-ওঠা শরীর
প্রায়শ ভোগাচ্ছে। এরই মধ্যে রকমারি শব্দ ভিন্ন ভিন্ন চেহারা নিয়ে
ব্যালে-নাচ শুরু করে আমাকে ঘিরে। কাকে ছেড়ে কার রূপ দেখি
ভেবে পাই না। চোখের লেন্সের গভীরে ওদের ধ’রে রাখি। কখনও
ওদের দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না। ক’দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছে, আর
আজকাল বৃষ্টিধারা দেখলেই আমার মায়ের কবরের কথা মনে পড়ে।
তাঁর কবরের ওপর বৃষ্টির বর্শাগুলো বিদ্ধ হচ্ছে ভাবলে কেমন কষ্ট পাই।
জানি, তাঁর অস্তিত্ব এখন আমার চেতনাপ্রবাহ ছাড়া অন্য কোথাও নেই
একরত্তি, তবু মন বর্ষাকাতর সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার মা একটা খুদে
ঘড়ি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন ঠিক সময়ে জেগে ওঠার জন্যে, যাতে
তাহাজ্জতের নামাজের ওক্ত পালিয়ে না যায়। আজ আম্মার মৃত্যুর
প্রায় ছয় মাস পর ছাড়া অন্য কোথাও নেই
একরত্তি, তবু মন বর্ষাকাতর সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমার মা একটা খুদে
ঘড়ি বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন ঠিক সময়ে জেগে ওঠার জন্যে, যাতে
তাহাজ্জতের নামাজের ওক্ত পালিয়ে না যায়। আজ আম্মার মৃত্যুর
প্রায় ছয় মাস পর পুঁটুলির ভেতর থেকে সেই বন্ধ ঘড়িটি বের করার সঙ্গে
সঙ্গে সে সপ্রাণ হ’য়ে ওঠে। আমি ওর গায়ে হাত বুলিয়ে মায়ের হাতের
স্পর্শ পাওয়ার জন্যে তৃষিত হই। হায়, জড়বস্তু স্পর্শের উষ্ণতা ধারণ
করতে অক্ষম। সে স্মৃতিহীনতায় চিরনিদ্রায় নিমজ্জিত। চোখ ফেরাতেই
মা-কে দেখতে পাই খাটে, অন্তহীন নিঃসঙ্গতায় নিঃস্পন্দ, নিস্তব্ধ। নানা
শব্দের ভ্রমর চারদিকে উড়ছে, ওদের গুঞ্জরনে বর্ষারাতে অভিসারিকার
হৃদয়ের ধ্বনি। ভ্রমরগুলোকে ছোঁয়ার জন্যে হাত বাড়াই। ওরা আমার বশ
মানবে তো প্রভাত-পদ্মের উন্মীলনে? আমি পায়ে হেঁটে মেঘনা নদী
পার হচ্ছি, দু’পায়ে ঢেউগুলো মাছের গান হ’য়ে বাজে কানে, কয়েকটি পাখি
আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় পূর্বপুরুষদের
ছায়াচ্ছন্ন ঘাটে। চেনা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে, খানিক জিরিয়ে
উড়ে চলি ভৈরবের সেতুর ওপর দিয়ে। আমার মুখের
তপ্ত জমি মদির ফসলে তরঙ্গিত দয়িতার ঠোঁটের স্পর্শে। আমি কি
ঘরময় নূপুরের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি? এই আওয়াজ হৃদয়ে মুদ্রিত
করার বাসনায় আমি উন্মুখ এখন। আমি লড়ছি, যেমন যেমন পাহাড়ি হরিণ লড়ে
পর্বতশৃঙ্গে গাছপালার হঠাৎ-আগুন এবং তুষার-ঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা
করার জন্যে। শব্দভ্রমরসমুদয় পারে আমার অস্তিত্বের ভিত অক্ষুণ্ন রাখতে। যদি
এখন ওরা আমার বশ্যতার গন্ডিতে ধরা দেয়, তবেই আমার রোগমুক্তি,
আমার ভাল-লাগার সীমানা-না-মানা উড়াল মনগড়া অমরাবতীতে।