Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জানলার কাছে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি || Sunil Gangopadhyay

জানলার কাছে দাঁড়িয়ে স্বীকারোক্তি || Sunil Gangopadhyay

এখন অনেকের সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে,
কী, শরীর ভালো আছে তো?
কেন এত শরীরের কথা?
যতই শুভার্থী হোক তবু তাদের ব্যগ্রতায় ফুটে ওঠে
একটি সরল সত্যের আভাস
আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, এবার কবে কখন
টুক করে কেটে পড়তে হবে ঠিক নেই!
প্রকাশ্যে নানা রকম পোশাকেই তো ঢাকা থাকে শরীর
তবু তার সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন কারণে
মানুষের কত কৌতুহল
কিন্তু শরীরের কথা তো অন্যদের বলতে নেই
সেটা ঠিক রুচিকর নয়
কেমন আছো? এর উত্তর শুধু, ভালো
সেটা কি শরীরের না। অস্তিত্বের সংবাদ, বলা শক্ত?

যতই আয়ু বাড়ে, ততই মানুষ অনেক কিছু হারায়
মাঝে মাঝে একলা জানলার ধারে দাড়িয়ে ভাবি সেই কথা
জীবনের যাত্রা শুরু যাদের সঙ্গে, তাদের অনেকেই আজ কোথায়?
বাবা, মা, ছোট মাসি, কৈশোরের নর্মসঙ্গিনীরা
উত্তর জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব, যাদের সঙ্গে দেখা না হলে
দিনটাই মনে হত ব্যর্থ
তারা দূরে সরে যেতে যেতে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তের ওপারে
কেউ ফেলে গেছে এক জোড়া চটি, মানুষটি অদৃশ্য
গৌহাটি থেকে যার চিঠি এসে পৌঁছোল সোমবার
সে আগের শুকুরবারেই নিশ্বাস সব খরচ করে ফেলেছে
অথচ চিঠিতে আগামী দিনকালের কত স্বপ্ন ছিল!

শুধু বান্ধবকুল নয়, একদিন এই দেশটাও তো ছেড়ে যেতে হবে
দেশ? দেশ বলে কি সত্যিই কিছু আছে?
সবটাই তো অলীক
কাঁটাতারের বেড়া আর বন্দুক ওঁচানো পাহারা দেওয়া
ভূমির নাম দেশ!
আমি যদি দৈবাৎ জন্ম নিতাম বেলুচিস্তানে
তবে আমি খেলা করতাম পাহাড়ের গুহায়?
তা হলে জন্মটাই কি আসল
মানুষের জন্মও তো ক্রোমোজোমের খামখেয়াল
মাতৃগর্ভে আমার কোনও দেশ ছিল না
আমার জনক-জননীও দেশের কথা চিন্তা করেননি
শিশুরা নাকি সব স্বৰ্গ থেকে আসে
কিন্তু স্বৰ্গ কারুর স্বদেশ হয় না
কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই স্বৰ্গ টর্গ মুছে যায়
সহজ পথগুলো জটিল হয় ক্রমশ
ঈশ্বরও টালমাটাল হয়ে পড়ে চাৰ্বাক দর্শনে
অথবা মার্কসবাদে
নারীরা টান মারে, যখন তখন বুকে বেঁধে তির
এর মধ্যে দেশ কোথায়?
জন্তুজানোয়ারের অনুভূতি দিয়ে যেমন বোঝে টেরিটরি
তারই নাম কি মানুষের দেশ?

ইহজীবনে চোখ দুটো থাকে সদাব্যস্ত
আঁচলের বাতাস ও অন্যান্য খেলাধুলো ছাড়িয়ে
দৃষ্টি চলে যায় ক্ষণে ক্ষণে অনেক দূরে
গোঁফ দাড়ি না গজালে নিসর্গকে ঠিক ঠিক চেনা যায় না
স্বৰ্ণাভ গোধূলি ও নীল রঙের ভোর, গাছপালার
রহস্যময় নীরবতা
ভোমরা আর মৌমাছির মতন কালচে রঙের কুরূপ পতঙ্গেরা
অপরূপ সব বিউটি কনটেস্টের ফুলগুলিতে ছড়িয়ে যায় প্ৰেম
আর মাছরাঙার ডানায় কেন এত অপ্রয়োজনীয় রং
এই সব দেখি, আরও দেখি প্রকৃতির অন্য সন্তানদের
ফসল কাটা হয়ে গেছে, এখন খাঁ খ্যা করছে মাঠ
শীতকালে বাঁধের ওপর উবু হয়ে বসে থাকা সারি সারি মানুষ
দীর্ঘশ্বাস নয়, তারা মাঝে মাঝেই থুতু ফেলে
হৃদয় ট্রিাদয় নয়, চোখই চিনতে পারে ওদের পরিচয়
সকালে আমি যখন বেগুন ভাজা দিয়ে রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাই
চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাঁধের সেই মানুষদের মুখগুলি
ওদের রুটি নেই, বেগুন ভাজাও নেই
এতদিনে তো জেনে গেছি, যারা খিদে চেপে রাখে তারাই
বেশি থুতু ফেলে
যেমন রমজানের মাসে রোজার উপবাসীরা
কিন্তু তাতে আমার কী দায়িত্ব, আমার কী আসে যায়
মানুষ তো স্বার্থপর প্রাণী, সারাজীবন ধরেই চলে আত্মরক্ষা
তবু এই যে উতলা হওয়া, এরই নাম কি দেশের টান?
ঠিক বিশ্বাস হয় না, এ তো ক্ষণকালের ঝালকানি
একটুখানি অন্যমনস্কতা, তাও চোখেরই কারসাজি
কোনওদিন তো নিজের ভাগের রুটি বাঁধের মানুষদের
দিতে যাইনি
তত্ত্ব তৈরি করেছি, চ্যারিটিতে সমস্যার সমাধান হয় না
বরং বেড়ে যায়
তার চেয়ে মাঝে মাঝে মিছিলে পা-মেলানো অনেক সহজ
তাতে একই সঙ্গে দেশপ্রেমিক আর বিশ্বপ্ৰেমিক হওয়া যায়
আমি সব মিছিলেরই মাঝপথের পলাতক
তবু অন্যান্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞদের দেখে কিছুটা কৌতূহলী আর
অনেকটাই মুগ্ধ হয়েছি
কোনও মিছিল এক সময় ঢুকে পড়েছে জঙ্গলে, কোনও মিছিল
সংসদের শীত-তাপ নিয়ন্ত্রণে
ওরা দেশকে চিনতে পেরেছে, আমি পারিনি।

হ্যাঁ, যেতে তো হবেই, বেশ কাটল এতগুলো বছর।
পরলোককে চুরমার করেছি অনেক আগেই
আত্মার অবিনশ্বরতা এক ছেলেভুলোনো রূপকথা
আত্মা ফাত্মা কিচ্ছু নেই, যেমন মানুষের বুকে থাকে না হৃদয়
একটা টুলু পাম্‌পকে হৃদয় বলে কত না আদিখ্যেতাই করা হয়েছে
বহুকাল ধরে
মাথা সর্বস্ব এই প্ৰাণী
সেই মাথার একদিকে কঠোর যুক্তিবোধ
অন্যদিকে কী চমৎকার উপভোগ্য অন্ধ বিশ্বাস
একদিকে মহাবিশ্ব, অন্য দিকে মন্দির-মসজিদ-গির্জা
আমি বেদ-উপনিষদের বদলে মেনেছি জৈমিনির মীমাংসা
এপিকিউরিয়ান দর্শনের সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়েছি জীবনযাত্রার
দৃশ্যমান জগৎকে দেখেছি স্পিনোৎজার চোখ দিয়ে
ভালোবাসাকে বসিয়েছি সবচেয়ে উঁচু, অদৃশ্য সিংহাসনে
সেই ভালোবাসা শরীর সর্বস্ব আবার শরীর বিরহিত
তবে, ভালোবাসার মধ্যেও কি ছোটখাটো মিথ্যে থাকেনি
সেই সব মিথ্যে বাদ দিলে সব কাব্য সাহিত্যও তো তুচ্ছ
মিথ্যে আর সত্য কতবার জায়গা বদলা বদলি করেছে
যেমন অনেক উপভোগের মধ্যে থাকে দুঃখ, কত কান্নার মধ্যে আনন্দ

কোনও পরিতাপ নেই
ভুল তো করেছি। অনেক, সেসব মানুষেরই ভুল
একটু আধটু অহংকার, আবার উপলব্ধির থাপ্পড়
সিঁড়িতে ওঠার একাগ্রতায় ভুলে গেছি। পাশ ফিরে তাকাতে
রূপ দেখেছি, বুঝিনি রূপের আড়াল
তবে একটা পাশবিক অন্যায় করিনি কখনও, নিজে ক্ষতবিক্ষত
হয়েছি অনেকবার
কিন্তু অন্যের রক্তদর্শন করার ইচ্ছে হয়নি…
পাশবিক? ছিঃ, এটা বলা ঠিক হল না।

কেউ যখন জিজ্ঞেস করে, শরীর কেমন আছে?
তক্ষুনি উত্তর না দিয়ে মনে মনে বলি:
যাচ্ছি, যাচ্ছি, এত ব্যস্ততার কী আছে?
পৃথিবীতে মানুষের পা ফেলার জায়গা কমে যাচ্ছে
জায়গা তো ছেড়ে দিতেই হবে
যাচ্ছি, যাচ্ছি, তবে ফুরফুরে মেজাজে, প্রিয় মানুষদের
কিছু না জানিয়েই যেতে চেয়েছিলাম
তবে বুকের ওপর কেন চেপে আছে একটা বিষণ্ণ পাথর
মায়া? পিছুটান?
জানলার কাছে দাঁড়ালেই চোখের সামনে ঝলসে ওঠে
একটা ছবি, আমি কেঁপে উঠি
দেশ টেশ মানিনি, পৃথিবীকে নিয়েও নিছক ভাবালুতা ছাড়া
আর বেশি সময় ব্যয় করিনি
তবু এতকাল পরে কী করে ফিরে এল দেশ-দেশান্তর
চতুর্দিকে এত রক্ত, পশুরা হাসছে মানুষের হিংস্রতা দেখে
আকাশ থেকে, সমুদ্র থেকে, জঙ্গল থেকে চলেছে মানুষেরই হাতে
মানুষের হত্যালীলা
বলতে তো পারতাম, তাতে আমার কী আসে যায়, আমি তো চলেই যাব
কেন মন তা মানছে না
রক্তের ফোয়ারা, রক্তের নদী, তাতে ডুবে যাচ্ছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস
এই দৃশ্য চোখে নিয়ে চলে যেতে হবে
এত কষ্ট, আঃ, এত কষ্ট, সত্যিই বুকে কষ্ট হচ্ছে খুব!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress