Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay » Page 25

জঙ্গলগড়ের চাবি (১৯৮৭) || Sunil Gangopadhyay

কাকাবাবু একা একাই দুপুরের খাওয়া শেষ করলেন। নরেন্দ্র ভার্মা কিংবা শিশির দত্তগুপ্তর দেখা নেই। ওঁরা কোনও খবরও পাঠাননি। তবে একটু আগে শিশির দত্তগুপ্তর একজন আদালি এসে এক জোড়া ক্রাচ দিয়ে গেছে।

খেয়ে উঠে কাকাবাবু নিজের আঁকা ম্যাপগুলো দেখলেন কিছুক্ষণ ধরে। মোট পাঁচটা ম্যাপ। তারমধ্যে চারখানা ছিড়ে ফেলে একখানা রাখলেন তিনি। সেটাকে আবার নতুন করে আঁকলেন। তারপর সেটাকে পকেটে ভরে রেখে তিনি ক্রাচ বগলে দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন জানলার কাছে। অনেকদিন বাদে তিনি নিজে নিজে হাঁটছেন, কেমন যেন নতুন নতুন লাগছে।

আকাশটা মেঘলা মেঘলা। চারদিকে কেমন যেন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। বেশ একটা বেড়াবার মতন দিন! কাকাবাবু ভাবলেন, এখন সন্তু কোথায়? কী করছে? ছেলেটাকে ওরা ঠিকমতন খেতে-টেতে দিয়েছে তো?

এবারে তিনি বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বারান্দা পার হয়ে নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। ক্রা নিয়ে হাঁটার অসুবিধে এই যে, খট খট শব্দ হয়। কাকাবাবুর নিজস্ব ক্রাচের তলায় রবার লাগানো আছে। কিন্তু সে দুটো তো সঙ্গে আনেননি।

নীচতলায় যে দুজন পুলিশের পাহারা দেবার কথা, তারা এখন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। কাকাবাবু যে বাগানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তা তারা লক্ষও করল না। কাকাবাবু একটু মুচকি হাসলেন।

সামনের লোহার গেটটা অবশ্য বন্ধ। তালা দেওয়া। অগত্যা কাকাবাবু নিজেই গেটের গায়ে দুবার থাবড়া মারলেন। সেই আওয়াজ শুনে একজন পুলিশ বেরিয়ে এল আর কাকাবাবুকে দেখে প্রায় ভূত দেখার মতন মুখের ভাব হয়ে গেল তার!

একটু তোতলাতে তোতলাতে সে বলল, এ-এ-এ কী স্যার! আ-আ-আ-পনি!

কাকাবাবু বললেন, আমি একটু বাইরে বেড়াতে যাব, গেটটা খুলে দাও!

পুলিশটি বলল, আ-আ-পনি বেড়াতে যা-যা-যাবেন? আপনার তো অসুখ! আপনি নিজে নিজে হাঁটছেন?

কাকাবাবু বললেন, অসুখ ঠিক হয়ে গেছে। খেয়ে ওঠার পর আমার একটু হাঁটাহাঁটি করা অভ্যস।

তবে একটু অপেক্ষা করুন স্যার। আমরাও যাব আপনার সঙ্গে। আমরা ততক্ষণে একটু খেয়ে নিই। উনুনে তরকারি ফুটছে।

আমার সঙ্গে যাবার দরকার নেই। আমি এক্ষুনি ফিরে আসব।

না, স্যার, তা হয় না! আমাদের বড় সাহেব বলেছেন…

তোমাদের বড় সাহেব কি আমায় আটকে রাখতে বলেছেন? যাও, শিগগির চাবি নিয়ে এসো।

কাকাবাবুর ধমক খেয়ে লোকটি আর তর্ক করতে সাহস করল না। চাবি এনে গেট খুলে দিল।

কাকাবাবু বললেন, তোমাদের সাহেব এলে বসতে বোলো। আমি ফিরে আসব। আর দিল্লি থেকে যে সাহেব এসেছিলেন, তিনি ফিরলে বোলো, আমার যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানে গেছি।

কোথায় যাচ্ছেন স্যার, বলে যাবেন না?

বললুম তো, একটু বেড়াতে যাচ্ছি। অনেকদিন হাঁটা হয়নি ভাল করে!

গেট থেকে বেরিয়ে কাকাবাবু কিন্তু বেশিক্ষণ হাঁটলেন না। একটা সাইকেল রিকশা পেয়ে তাতে চেপে বসলেন।

রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যাব বাবু?

কাকাবাবু বললেন, চলো, যেদিকে খুশি! বেশ মেঘলা মেঘলা দিন, আমায় কোনও ভাল জায়গায় একটু হাওয়া খাইয়ে নিয়ে এসো। তুমি দশটা টাকা পাবে।

রিকশা চলতে শুরু করতেই কাকাবাবু চোখ বুজলেন। যেন তাঁর কোনও দুশ্চিন্তাই নেই। সত্যিই তিনি হাওয়া খেতে বেরিয়েছেন।

দুজন সাইকেল-আরোহী একটু বাদেই কাকাবাবুর দুপাশ দিয়ে চলে গেল তাঁর দিকে ভাল করে তাকাতে তাকাতে। খানিকদূর গিয়ে লোক দুটি আবার ফিরে এল। কাকাবাবুকে আবার ভাল করে লক্ষ করে তারা চলে গেল খুব জোরে সাইকেল চালিয়ে। কাকাবাবু এসব কিছুই দেখলেন না। যেন তিনি ঘুমোচ্ছেন।

সাইকেল রিকশাটা শহরের ভিড় ছাড়িয়ে চলে এল একটা ফাঁকা জায়গায়। সামনেই একটা ছোট পাহাড়। আকাশে মেঘ আরও গাঢ় হয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে।

রিকশাওয়ালা থেমে গিয়ে বলল, ও বাবু! বৃষ্টি আসতেছে। এবার কোথায় যাবেন।

কাকাবাবু চোখ মেলে উঠে বসে বললেন, এ কোথায় এসেছ? বাঃ, বেশ জায়গাটা তো?

রিকশাওয়ালা বলল, এ দিকটা তো বাবু কুঞ্জবন। কাছেই পুরনো রাজবাড়ি আছে।

কাকাবাবু বললেন, রাজবাড়ি আছে থাক, সেদিকে যাবার দরকার নেই, আরও ফাঁকার দিকে চলল।

জোরে বৃষ্টি এসে যাবে যে বাবু!

ও, বৃষ্টি আসবে বলছ! তা হলে তো আর তোমার সাইকেল রিকশায় চলবে না।

কাকাবাবু রিকশা থেকে নেমে চারদিকে চেয়ে দেখলেন। যেন তিনি কোনও চেনা লোককে খুঁজছেন। কিন্তু কাছাকাছি মানুষজন কেউ নেই। তবে দুর থেকে একটা মোষের গাড়ি আসতে দেখা যাচ্ছে।

রিকশাচালককে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে কাকাবাবু বললেন, তুমি এবারে যেতে পারো।

রিকশাচালক তবু চিন্তিতভাবে বলল, জোর বর্ষা আসছে, আপনি এখান থেকে ফিরবেন কী করে?

কাকাবাবু বললেন, সেজন্য তোমার চিন্তা নেই। আমি এখন ফিরব না।

মোষের গাড়িটা কাছে আসতেই কাকাবাবু হাত তুলে সেটাকে থামালেন। গাড়োয়ান ছাড়া সে গাড়িতে আর কেউ নেই। মাঝখানের ছাউনিতে রয়েছে। কয়েকটা বস্তা।

কাকাবাবু সেই গাড়ির গাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ দিকে যাচ্ছ। গো কর্তা?

গাড়োয়ান বলল,যাচ্ছি তো বাবু, অনেক দুর। সেই কমলপুর।

কাকাবাবু সন্তুষ্টভাবে বললেন, বাঃ, কে! আমিও ওই দিকেই যাব। আমায় নিয়ে যাবে? চিন্তা কোরো না, যা ভাড়া লাগে তা আমি দেব। তুমি গাড়িটা একটু নিচু করো, নইলে তো আমি উঠতে পারব না।

কাকাবাবু উঠে বসার পর মোষের গাড়িটা চলতে লাগল ঢিমেতালে। কাকাবাবু ছাউনির মধ্যে বসে গাড়োয়ানের সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। বৃষ্টি পড়তে লাগল জোরে।

সেই বৃষ্টি ভিজেই দুজন সাইকেল-আরোহী আবার আস্তে আস্তে যেতে লাগল মোষের গাড়িটার পাশে পাশে। কাকাবাবুর দিকে তারা গভীর মনোযোগের সঙ্গে তাকিয়ে রইল। কাকাবাবুর সঙ্গে একবার চোখাচোখি হতেই তারা পালিয়ে গেল শাঁ শাঁ করে।

কাকাবাবু বললেন, আরেঃ!

লোকদুটি কিন্তু বেশি দূর গেল না। খানিকটা এগিয়েই আবার সাইকেল ঘুরিয়ে এদিকে আসতে লাগল। তারা কাছাকাছি এসে পড়তেই কাকাবাবু হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, এই যে, শোনো, শোনো!

এবার তারা উল্টোদিক থেকে আসছে বলে গাড়ির পাশে পাশে চলতে পারে না। একজন থেমে পড়ল। কাকাবাবু মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে, শোনো, রাজকুমারকে কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারো?

লোকটি যেন কিছুই জানে না এইরকমভাবে শুকনো মুখে বলল, রাজকুমার? কোন্ রাজকুমার?

কাকাবাবু কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, আমি যে রাজকুমারের কথা জিজ্ঞেস করছি, তাকে তুমি চেনো না?

লোকটি বলল, কই, না তো?

কাকাবাবু বললেন, তবে এখানে ঘুরঘুর করছ কেন? যাও, ভাগো!

ঠিক তক্ষুনি একটা জিপগাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। সাইকেল-আরোহী আর কাকাবাবু দুজনেই তাকালেন সেদিকে।

জিপটিও এসে থামল মোষের গাড়ির পাশে। কালো প্যান্ট আর কালো শার্ট পরা লম্বামতন একজন লোক মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার?

কাকাবাবু লোকটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন, এই যে, তুমি জানো নাকি, রাজকুমারকে কোথায় পাওয়া যাবে?

লোকটি বলল, হাঁ, জানি। আমি রাজকুমারের কাছেই যাচ্ছি। আপনি যাবেন আমার সঙ্গে?

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই! বাঃ, বেশ ভাল ব্যবস্থা হয়ে গেল।

মোষের গাড়ির গাড়োয়ানের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ওহে, জিপগাড়ি পেলে কে আর মোষের গাড়িতে যেতে চায় বলো! তোমার গাড়িটা নিচু করো, আমি নেমে পড়ি! এই নাও, তুমি দশটা টাকা নাও।

কাকাবাবু জিপগাড়িতে বসলেন সামনের সীটে। পেছন দিকে তিনজন গুণ্ডামতন চেহারার লোক বসে আছে গম্ভীরভাবে।

কাকাবাবু বললেন, হুঁ, ব্যবস্থা বেশ ভালই। আমি নিজে থেকে যেতে না চাইলে তোমরা কি আমায় জোর করে নিয়ে যেতে?

কালো শার্ট পরা লোকটি বলল, আপনি কী করে জানলেন যে আমরা এই রাস্তায় আসব।

কাকাবাবু আবার কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, বাঘ জঙ্গলে বেরুলেই তার পেছনে ফেউ লাগে। আমি জানতুম, আমি যে-দিকেই যাই না কেন, তোমরা ঠিক আমার পেছন পেছন আসবে?

কালো শার্ট পরা লোকটাও অকারণে হেসে উঠল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, যেখানে যাচ্ছি, সেখানে পৌঁছতে আমাদের কতক্ষণ লাগবে?

লোকটি বলল, অন্তত তিন ঘণ্টা তো বটেই। সন্ধে হয়ে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমি এই সময়টা ঘুমিয়ে নিচ্ছি। কাল রাত্তিরে ভাল ঘুম হয়নি। পৌছে গেলে আমায় ডেকে দিও।

তারপর কাকাবাবু সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লেন মনে হল। গাড়ির লোকগুলো এই এতটা সময় কোনও কথা বলল না। তবে তারা কেউ ঘুমোল না।

জিপটা শেষ পর্যন্ত থামতে কাকাবাবু জেগে উঠলেন নিজে থেকেই।

সন্তুকে যে বাড়িতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল, সেই বাড়ির গেটের সামনে। কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। দু জনের হাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে। মশাল। সেই আলোতে কাকাবাবু চিনতে পারলেন রাজকুমারকে। গাড়ি থেকে নেমে এসে কাকাবাবু রাজকুমারের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তা হলে আবার দেখা হল! এত শিগগিরই যে দেখা হবে তা ভাবিনি। আশা করি এবারে আর মারামারি করার দরকার হবে না। সন্তুর চিঠি আমি পেয়েছি। আমি জঙ্গলগড়ের ম্যাপ দিয়ে দিলে তোমরা সন্তুকে ছেড়ে দেবে। আশা করি ভদ্রলোকের মতন তোমরা কথা রাখবে। এই নাও জঙ্গলগড়ের ম্যাপ।

জামার পকেট থেকে কাকাবাবু ম্যাপটা বার করে এগিয়ে দিলেন রাজকুমারের দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *