কস্তুরী বাঈ
কান্দাই পর্বতমালার দক্ষিণ পাদমূলে এসে দাঁড়ালো মোদন তার দলবল সহ। একটা পাল্কীর মধ্যে মহারাজ দেবকী নারায়ণকে রাখা হয়েছে। পাল্কীর বেয়ারাগণও মোদনের লোক।
রাত্রি গম্ভীর হয়ে এসেছে।
চারিদিকে একটা থমথমে ভাব বিরাজ করছে।
গাঢ় অন্ধকারে চারিদিকে, আচ্ছন্ন।
মহারাজ দেবকী নারায়ণ মোসনের ইংগিতে উচ্চকণ্ঠে ডাক দেয়–কে এসেছে আমাকে নিতে, সামনে এসো! আমি মহারাজ দেবকী নারায়ণ বলছি…..
মহারাজের কণ্ঠস্বর নিস্তব্ধ রাত্রির জমাট অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে কান্দাই পর্বতমালার পাদমূলে। কেঁপে কেঁপে ফিরে আসে প্রতিধ্বনি আবার মহারাজের কানে। মোদন আর ভোলানাথ মহারাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মোদনের হাতে পিস্তল আর ভোলার হাতে ছোরা।
মোদনের অন্যান্য অনুচরগণ সহ মানসিং মহারাজের পাল্কীর অনতিদূরে আত্মগোপন করে আছে। মহারাজের লোক তাদের দেখতে না পায় সেইভাবে তারা লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ অন্ধকারে এগিয়ে আসে মহারাজের লোক, একটা থলের মধ্যে আছে এক লাখ টাকা।
লোকটার অদূরে অন্ধকারে উদ্যত রাইফেল হাতে সারিবদ্ধভাবে পুলিশ ফোর্স অপেক্ষা করছে।
টাকার থলে হাতে মহারাজের লোক এগিয়ে এলো।
একজন উচ্চকণ্ঠে বললো–মহারাজ আপনি কোথায়? আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না আমি……….।
মোদন মহারাজের পিঠে আঘাত করে বললো–বলুন আমি এখানে!
মহারাজ বলে উঠলেন–এই যে আমি এখানে! কে এসেছো এগিয়ে এসো।
মোদন আর ভোলানাথ সরে দাঁড়ায়।
একটা লোক থলে হাতে পাল্কীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো –মহারাজ—-
এই যে আমি……….বললেন মহারাজ।
মোদন আর ভোলানাথ পাল্কীর আড়াল থেকে সরে এলো দ্রুতভাবে, লোকটার দু’পাশে দু’জন দাঁড়ালো। মোদন ইংগিৎ পূর্ণ শব্দ করলো, সঙ্গে সঙ্গে মোদনের দলের লোক অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে পাল্কীসহ মহারাজ এবং মহারাজের লোকটিকে ঘিরে ধরলো।
মোদন লোকটার হাত থেকে টাকার থলে একটানে কেড়ে নিয়ে তার তল পেটে পিস্তলটা চেপে ধরলো।
কিন্তু ভোলানাথের হাতের সূতীক্ষ্ণধার ছোরা ততক্ষণে বিদ্ধ হয়ে গেছে মোদনের পিঠে। মোদন পিস্তল থেকে গুলি ছোরার সুযোগ আর পেলো না, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো ভূতলে। একটা তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়লো কান্দাই পর্বতের কন্দরে কন্দরে।
ভোলানাথ হুইসেল ধ্বনি করলো।
বিদ্যুৎ গতিতে পুলিশ ফোর্স ঘিরে ফেললো জায়গাটা, সকলের হাতেই গুলিভরা রাইফেল।
সম্মুখে মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন উভয়ের হাতে রিভলভার। বজ্র কঠিন কণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ–হ্যান্ডস– আপৃ–খবরদার একচুল কেউ নড়োনা গুলি করে হত্যা করবো।
পুলিশ ফোর্স এমনভাবে ঘিরে ধরেছিলো একটি প্রাণীও পালানোর সুযোগ পেলো না।
মিঃ ইয়াসিন আলো জ্বালার জন্য নির্দেশ দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা মশালে আগুন জ্বেলে দেওয়া হলো।
আলোকিত হয়ে উঠলো কান্দাই পর্বতের পাদমূল।
মিঃ আরিফ শয়তানের দলবলকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দিলেন।
পুলিশ ফোর্স প্রত্যেকের হাতে হাত কড়া পরিয়ে মাজায় দড়ি বেঁধে ফেললো।
কিন্তু ভোলানাথ কোথায়। মানসিং তাকালো তার দল বলের দিকে, খুঁজতে লাগলো সে ভোলানাথকে।
মিঃ আরিফ মশালের আলোতে তাকালেন ভুলুণ্ঠিত মোদনের দিকে। পিঠে সূতীক্ষ্ণ ছোরাখানা বিদ্ধ হয়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে জায়গাটা। অবাক হয়ে গেলেন মিঃ আরিফ আর মিঃ ইয়াসিন ছোরায় গাঁথা একখানা ভাজ করা কাগজ।
মিঃ আরিফ নিজ হস্তে ছোরাখানা খুলে নিলেন, তারপর ভাঁজ করা কাগজখানা মেলে ধরলেন মশালের আলোর সামনে, পড়লেন তিনি
–চরম পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমি নিজ হাতে সমাধা করলাম। অন্যান্যদের বিচার ভার রইলো পুলিশের উপরে।
–দস্যু বনহুর।
মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন উভয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে নিলেন।
মিঃ আরিফ একজন পুলিশকে ইংগিৎ করলো নিহত লোকটাকে চীৎ করে ফেলার জন্য।
পুলিশ মোদনকে চীৎ করতেই বিস্ময়ে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন মিঃ ইয়াসিন–এ যে মদনমোহন বার-এর মালিক। সঙ্গে সঙ্গে মানসিং-এর মুখে তাকালেন–মানসিং আপনারাই এই শয়তান দলের নেতা?
মানসিং লজ্জায় ভয়ে মরিয়া হয়ে মাথা নীচু করলো। কালো হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল। মোদনের রক্তাক্ত মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে আছে সে বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে, ভাবছে ভোলানাথই তবে দস্যু বনহুর। এখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো দস্যু বনহুর তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করলো।
মহারাজ দেবকী নারায়ণ মুক্তির আনন্দে অধির হয়ে মিঃ আরিফকে জড়িয়ে ধরলেন আপনাদের জন্যই আজ আমি জীবন ফিরে পেলাম, আশীর্বাদ করি……….
মিঃ আরিফ গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে বললেন–মহারাজ আপনার মুক্তির জন্য আশীর্বাদ পাবার যোগ্য হচ্ছে দস্যু বনহুর।
মহারাজ বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন–দস্যু বনহুর! সেতো মোদনের হত্যাকারী?
মিঃ ইয়াসিন বললো–মোদনের হত্যাকারীই শুধু নয় সে মোদনের শয়তানীর চরম শাস্তি দানকারী। কথাটা বলে তিনি মিঃ আরিফকে লক্ষ্য করে বললেন–স্যার, বিলম্ব করা চলবে না, মোদনমোহন বারখানা তল্লাসী করে আমরা শয়তানদের ঘাঁটি ধ্বংস করবো।
হাঁ, ঠিক বলেছেন মিঃ ইয়াছিন? এই সব শয়তানদের হাজতে পাঠিয়ে আমরা রওনা দেবো এদের ঘাঁটি অভিমুখে।
মিঃ আরিফ আর মিঃ ইয়াসিনের নির্দেশ মত মদনমোহন বার-এর কুচক্রি শয়তান–দলকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো।
মহারাজ দেবকী নারায়ণকে সসম্মানে পাঠানো হলো রাজ প্রাসাদে। এক লক্ষ টাকাও পাঠানো হলো তাঁর সঙ্গে।
মোদনের মৃতদেহটাও উঠিয়ে নেওয়া হলো পুলিশ ভ্যানে।
মোদন বার-এ পুলিশ ফোর্স সহ মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন পৌঁছার পূর্বেই ভোলানাথ পৌঁছে গেলো।
ম্যানেজার নাথুরাম মহাতক শুয়ে নাক ডাকছিলো ভোলানাথ তার দেহে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভেঙে গেলো নাথুরামের, দড়-বড় উঠে বসে চোখ রগড়ে বললো–তুমি। ওস্তাদ কই? আর আর সব কোথায়? টাকা এক লাখ কোথায়…
পুলিশ কান্দাই পর্বত থেকে তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেছে।
কোথায়? ঢোক গিলে বললো নাথুরাম।
ভোলানাথ বললো–পুলিশ অফিসে।
তুমি যাওনি?
আমার ভাগ্য মন্দ তাই বাদ পড়েছি।
তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না ভোলা?
পারবে একটু পরে। নাও ওঠো দেখি। ভোলানাথ রিভলভার উদ্যত করে ধরলো।
নাথুরামের চোখ দুটো ছানাবড়ার মত হলো, ভোলার হাতের উদ্যত রিভলভারের দিকে তাকিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে বললো–আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছো ভোলা?
ঠাট্টা নয় আদর করছি। উঠো নাথুরাম, লক্ষী ছেলের মত উঠে পড়ো দেখি……….
নাথুরামের চোখে-মুখে এবার ভীতিভাব ফুটে উঠলো, ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো সে শয্যা : ত্যাগ করে। কম্পিত কণ্ঠে বললো–ভোলা তুমি…
হা দেখতেই পাচ্ছো আমি……….
কিন্তু…..
চলো কথা পরে হবে, বের করো চাবীর গোছা?
চাবী?
হা।
চাবীর গোছা কি করবে ভোলা?
সব পরে বুঝবে। বৈর করো বলছি।
নাথুরাম চাবীর গোছা বের করে।
ভোলানাথ বলে–চলো আমার সঙ্গে।
নাথুরাম যন্ত্রচালিতের মত এগুতে থাকে। বন্দীদের কক্ষের সম্মুখে এসে দাঁড়ায় ভোলা বলে–চাবী দিয়ে তালা খুলে ফেলো নাথুরাম।
নাথুরাম বিলম্ব করছিলো ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠে ভোলা-মরতে না চাও শীঘ্র তালা খোল।
অগত্য তালা খুলে দিলো নাথুরাম।
ভোলানাথ বললো–ভিতরে চলো, নিজের হাতে বন্দীদের মুক্তি করে দাও।
বন্দীদের মুক্তি—
হাঁ, খোল ওদের শিকলের তালা।
ভোলার হাতের উদ্যত রিভলভারের দিকে ভীত নজরে তাকিয়ে নাথুরাম বন্দীদের হাত-পা থেকে লৌহ-শিকলের তালা খুলে দিলো এক এক করে।
বন্দী অসহায় জীর্ণ-শীর্ণ লোকগুলো মুক্তি পেয়ে যেন নব জীবন লাভ করলো। সবাই হাত এবং পায়ের ক্ষতগুলিতে হাত বুলিয়ে নীরবে মুক্তির আনন্দ উপভোগ করতে লাগলো।
ভোলা এবার নাথুরাকে বললো—-তোমাদের বার-এর যত পাহারাদার আছে এবং অন্যান্য যারা আছে এখানে তাদের উপস্থিত করো। নইলে এক্ষুণি তোমাকে যমালয়ে পাঠাবো।
নাথুরাম একটা মেশিনে চাপ দিতেই সাইরেনের মত কোকোঁ —-আওয়াজ হতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে যেখানে যে যেমন অবস্থায় ছিলো সবাই এসে হাজির হলো।
ভোলানাথ দরজা বন্ধ করে রিভলভার উদ্যত করে ধরলো, বললো–খবরদার কেউ একচুল নড়বে না।
ভোলার হাতে উদ্যত রিভলভার দেখে বার-গৃহের কর্মচারী এবং অন্যান্য সবাই হতভম্ব হয়ে গেলো। সবাই বিবর্ণ মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলো একবার ভোলানাথ আর ম্যানেজারের মুখে।
ম্যানেজার নাথুরামও করুণ অসহায় চোখে তাকাচ্ছে তার সঙ্গী-সাথীদের দিকে, কিন্তু কিছু। বলতে সাহসী হচ্ছে না কারণ ভোলার হাতে মরণাস্ত্র রয়েছে।
ভোলা কঠিন কণ্ঠে বললো–যাও, সবাই নিজ নিজ হাতে এবং পায়ে শিকল পরে নাও! বিলম্ব করলে মরবে আর যদি ঠিক মত ঐ শিকলগুলো হাতে পায়ে পরে নিজেদের হেফাযতে রাখো তাহলে–ওস্তাদ এসে তোমাদের মুক্ত করে দেবে।
বাধ্য হলো সবাই বন্দীদের পরিত্যক্ত লৌহ-শিকল নিজ নিজ হাত-পা আবদ্ধ করতে।
ভোলা বললো-”নাথুরাম তোমার হাতে চাবী আছে। তুমি ওদের শিকলগুগো তালা। আটকিয়ে দাও।
নাথুরাম মনে মনে ফুলছিলো, দাঁতে দাঁত পিষে বললো– ভোলা এসব কি করছো তুমি?
গম্ভীর কণ্ঠে বললো ভোলানাথ–এখনও বুঝতে পারোনি নাথুরাম? যাও আদেশ পালন করো।
নাথুরাম এবার সুর নরম করে বললো ভোলা তোমার এই কি ন্যায় নীতি? এই কি তোমার কাজ?
হাঃ হাঃ হাঃ…..অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো ভোলানাথ। তারপর হাসি থামিয়ে বললো– নিকৃষ্ট বার-এ কর্মচারী আমি আমার আবার ন্যায় নীতি….হাঃ হাঃ হাঃ….হাঃ হাঃ হাঃ…নাথুরাম যদি মঙ্গল চাও এক মুহূর্ত বিলম্ব করো না, যা বললাম, শোন।
এবার নাথুরাম তার দলবলের হাতে পায়ে শিকলে তালা বন্ধ করে সরে দাঁড়ালো, ভোলার আদেশ অমান্য করার সাহস হলো না তার।
ভোলা এবার নাথুরামের হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে দিলো।
তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মুক্ত বন্দীদিগকে লক্ষ্য করে বললো –তোমরা সচ্ছন্দে বিদায় গ্রহণ করতে পারো। তোমাদের সম্মুখে মুক্ত দরজা রয়েছে যাও তোমরা।
কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে বন্দীদের মন, ভোলানাথকে আরও অনেকদিন তারা দেখেছিলো তখন। ওকে অভিশম্পদই করেছে কারণ সেও ওদের দলেরই লোক। আজ সকলে প্রাণ ভরে ভোলানাথকে আশীর্বাদ করে, ভাবে কে এই মহান মহৎ ব্যক্তি? যে এতোদিনের অভিশাপ থেকে তাদের মুক্ত। করলো। সবাই প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে গেলো উন্মুক্ত দরজা দিয়ে।
নাথুরাম এবং মোদনমোহন বার-এর কর্মচারীগণ শৃখলাবদ্ধ অবস্থায় কটমট করে তাকাতে লাগলো। নাথুরামের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। কিন্তু কারো মুখ দিয়ে কিছুই বের হলো না। সবাই জানে ভোলানাথ কত বড় সাংঘাতিক আর ভয়ঙ্কর।
ততক্ষণে বার-গৃহের নৰ্তকীগণ এসে পড়ে সেই কক্ষে, ভোলার হতে উদ্যত রিভলভার এবং বার-গৃহের ম্যানেজার ও অন্যান্য সকলের অবস্থা দেখে সবই কুঁকড়ে যায়। ভয়ে আতঙ্কে পালাতে যায় তারা, ভোলা কঠিন কণ্ঠে বলে–পালাচ্ছো কোথায়? শোন।
সবাই কম্পিত পদক্ষেপে এগিয়ে আসে, জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়।
ভোলানাথ গম্ভীরকণ্ঠে বলে–এতোদিন খদ্দের সংগ্রহে নেচেচো, আজ জীবন রক্ষার্থে নাচ দেখাও। নাচো, নাচো তোমরা…
বিবর্ণ ফ্যাকাশে মুখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায় পেয়ারী, লীলাবাঈ আর যমুনারাণী।
ভোলানাথ আবার ধমক দেয়–নাচো—
এবার নর্তকীদল ঘুম-জড়িত চোখে, এলোমেলো বসনে নাচতে শুরু করে।
ভোলানাথ বলে–এদের নাচ দেখাও, যতক্ষণ না তোমাদের ওস্তাদ ফিরে আসে–ভোলানাথ দ্রুত বেরিয়ে বাইর হতে দরজা বন্ধ করে দেয়।
এবার ভোলানাথ এসে দাঁড়ায় যে কক্ষে সাউন্ডবক্সের মাধ্যমে বার-গৃহের শয়তান-দল পাপকর্মের নির্দেশ দিতো। সাউন্ডবক্সের সম্মুখে এসে দাঁড়ায় ভোলানাথ, একটানে সাউন্ডবক্স সরিয়ে ফেলতেই দেখতে পায় পিছনে একটা ছোট্ট দরজা।
ভোলানাথ বিলম্ব না করে সেই ক্ষুদ্র দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। অতি সতর্কভাবে এগুতে লাগলো ভোলানাথ, হঠাৎ তার নজরে পড়লো কক্ষটার মাঝখানে বসে আছে একটা লোক, লোকটার চোখ দুটো যেন জ্বলছে। ভোলানাথের দিকে তাকিয়ে আছে কটমট করে।
ভোলানাথ রিভলভার উদ্যত করে ধরলোখবরদার নড়বে না গুলি ছুড়বো। রিভলভার ঠিক রেখে ভোলা লোকটির দিকে এগুতে লাগলো।
কিন্তু একি লোকটা স্থির বসেই আছে এক চুল নড়ছে না। ভোলানাথ অবাক হলো, আরও সরে এলো লোকটার পাশে। গায়ে হাত দিতেই বুঝতে পারলো ওটা কোন মানুষ নয় একটা পাথরে মূর্তি।
ভোলানাথ জোরে ধাক্কা দিলো, ভীষণ মজবুত আর শক্ত মূর্তিটা একটুও নড়লো না। ভোলানাথ মূর্তির পিছনে উঁকি দিতেই বিস্ময়ে হতবাক হলো, মূর্তির পিছনে সম্পূর্ণ ফাঁকা। একটা খোলস ছাড়া কিছু নয় সেটা। ভিতরে বসার একটা আসন রয়েছে।
ভোলানাথের দৃষ্টি হঠাৎ পাথরের মূর্তিটার ভিতরে এক স্থানে সীমাবদ্ধ হলো, দেখলো একটা লাউডস্পীকার মেশিন ঝুলছে। একটা তার বেরিয়ে এসেছে ভিতর থেকে বাইরে। মূর্তিটার পায়ের কাছ দিয়ে তারটা চলে গেছে পাশের কক্ষে এবং যোগ হয়েছে সাউন্ডবক্সের সঙ্গে। ভোলানাথ বুঝতে পারলো কেউ এই খোলসের মধ্যে বসে লাউডস্পীকার কথা বলে থাকে কিন্তু কে সে।
ভোলানাথ মনোযোগ সহকারে পাথরের মূর্তিটা পরীক্ষা করে দেখছিলো, এমন সময় তার পিছনে তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেয়ে চমকে ফিরে তাকায়।
পিছনে তাকিয়েই ভোলানাথ বিস্ময়ে আরষ্ট হয়ে যায়। সে দেখতে পায় মুখে মুখোস পরা একটা লোক সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা হাতে মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেছে। ওদিকে দাঁড়িয়ে আছে কস্তুরীবাঈ।
ভোলার দৃষ্টি ভুলুণ্ঠিত লোকটার পিঠে পড়তেই চমকে উঠলো আবার ভোলা, একখানা ছোরা অমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে লোকটার পিঠে। তাজা লাল রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে ওর পিঠখানা এবং মেঝের খানিকটা অংশ।
ভোলা কস্তুরীবাঈ-এর দিকে তাকালো বুঝতে পারলো লোকটা যেই হোক সে তাকে পিছন থেকে ছোরা বিদ্ধ করে হত্যা করতে যাচ্ছিলো। কস্তুরীবাঈ তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে।
এবার ভোলানাথ ভুলুণ্ঠিত লোকটির মুখের মুখোশ একটানে খুলে ফেললো। তৃতীয় বারের মত চমকে উঠলো ভোলানাথ, এযে মোদন ওস্তাদের সহকারী বোমসিং। তখনও বোমসিংহের প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায়নি। সে কোঁকিয়ে কোকিয়ে বললো–ভোলানাথ তুমি এতো বড় বিশ্বাসঘাতক ………. যা মরে যাচ্ছি তোমাকে অভিসম্পাত করবো না………. জেনে নাও আমিই মোদন বারের আসল মালিক—
ভোলানাথ বলে উঠলো তুমি মালিক……..
হাঁ আজ পর্যন্ত কেউ জানে না মোদন বারের আসল মালিক কে………. আমি মোদনের সহকারীরূপে কাজ করতাম………. কিন্তু আমার পরিচালনাতেই এই বার–গৃহের সব কাজ হতো……….কস্তুরীবাঈ আমাকে ছোরাবিদ্ধ না করলে……….এতক্ষণ তোমার লাশ ধুলোয় গড়াগড়ি যেতো……….।
ভোলানাথ তাকালো অদূরে দণ্ডায়মান কস্তুরীবাঈ-এর কালো আবরণে ঢাকা মুখমণ্ডলের দিকে। কস্তুরীবাঈ-এর চোখ দুটো তাকে অভিনন্দন জানালো। দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলো কস্তুরীবাঈ।
ভোলানাথ অবাক তাকিয়ে রইলো, কে এই নর্তকী যে তাকে আজ মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে নিলো। আরও কতদিন তাকে রক্ষা করেছে চরম অবস্থা থেকে।
বোমসিং আর্তকণ্ঠে বললো……….ভোলানাথ……….কে……….তুমি?
ভোলানাথ বললো–শোন বোমসিং মরণ-মুহূর্তে শুনে যাও আমিই তোমাদের যমদূত দস্যু বনহুর।
বোমসিং-এর মৃত্যুমলিন মুখেও বিস্ময় ফুটে উঠলো, চোখ দুটো জ্বলে উঠলো দস্যু বনহুরকে সে আজ স্বচক্ষে দেখলো। এবার বোমসিং এর মুখটা বিকৃত হয়ে উঠলো মৃত্যু যন্ত্রণায়, অদ্ভুত একটা শব্দ বেরিয়ে এলো তার গলা থেকে–আঃ— আঃ—-আঃ—–আঃ——অ–কিছু যেন বলতে চেষ্টা করছে বোমসিং।
বনহুর ও পাশে বসে পড়লো পিঠ থেকে ছোরাখানা টেনে তুলে নিলো সে তারপর বললো বোমসিং কিছু বলবে?
বোমসিং অতি কষ্টে উচ্চারণ করলো……অ–নি—-ন…..ঘাড়টা ভেঙে মাথাটা কাৎ হয়ে পড়লো এক পাশে। বনহুর কিছুই বুঝতে পারলো না কি বলতে চাচ্ছিলো সে।
উঠে দাঁড়ালো বনহুর, আপন মনেই বলে উঠলো-অ-অনিন্দন….কে কে এই অনিন্দন? মানুষ না জায়গার নাম? কিন্তু কে তার জবাব দেবে বোমসিং তখন সকলের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে।
বনহুর তার কাপড়ের ভিতর থেকে একখানা ছোরা বের করলো, একটা কাগজে কিছু লিখে ছোরায় গেঁথে ছোরাখানা মূর্তিটার হাতের মুঠায় গুঁজে রাখলো তারপর বেরিয়ে এলো মোদনমোহন বার থেকে বাইরে।
কস্তুরীবাঈ তখন তার পিতা মহেন্দ্র গরসের সঙ্গে বার থেকে পথে অদৃশ্য হয়েছে।
মিঃ আরিফ মিঃ ইয়াসিন ভোর হবার পূর্বেই মোদনমোহন বার-এ এসে হাজির হলো। সঙ্গে তাদের পুলিশ ভ্যান, এবং সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী।
বার-গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তারা অবাক হন, কারণ একটি জনপ্রাণীকেও নজরে পড়ে না তাদের।
পুলিশ ফোর্স মোদনমোহন বার-গৃহের চার পাশ ঘেরাও করে ফেলেছে। কেউ যেন পালাতে না পারে সেজন্য সতর্ক আছে সবাই।
কিন্তু আশ্চর্য সমস্ত মোদনমোহন বার-গৃহখানা তল্লাসী করেও কাউকে পাওয়া গেলো না।
ভোর হয়ে এলো এক সময়।
সমস্ত বার তল্লাসী করেও যখন পুলিশবাহিনী কোন ব্যক্তিকে আবিষ্কারে সক্ষম হলো না, তখন সবাই হতাশ হয়ে পড়েছেন এমন সময় হঠাৎ একটা আর্তকণ্ঠস্বর কানে আসে তাদের।
মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন দু’জন পুলিশ সহ অগ্রসর হলেন। একটা কক্ষের মেঝেতে এসে দাঁড়ালেন তারা। আর্ত কণ্ঠস্বরটা যেন এই কক্ষের মধ্য হতেই বেরিয়ে আসছিলো, আশ্চর্য হলো সবাই শব্দ শোনা যাচ্ছে কিন্তু কক্ষ মধ্যে জনপ্রাণী নেই।
হঠাৎ তাদের নজরে পড়লো দেয়ালের একস্থানে একটা সাউন্ডবক্স টাঙ্গানো রয়েছে! শব্দটা সেই সাউন্ডবক্সেই আসছে। কিন্তু কোথা হতে এই সাউন্ডবক্সে শব্দ আসছে সেটা বুঝা যাচ্ছে না।
অনেক চেষ্টা করে এক সময় পথ পাওয়া গেলো। সাউন্ডবক্স সরাতেই পিছনে পাওয়া গেলো ক্ষুদ্র একটা দরজা। সেই পথে মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন উদ্যত রিভলভার হাতে ভিতরে প্রবেশ করলো।
কিছুটা এগুতেই অবাক হয়ে দেখলো তারা মেঝেতে পড়ে আছে একটা রক্তাক্ত দেহ। ভালভাবে লক্ষ্য করতেই বিস্ময়ে চমকে উঠলেন মিঃ ইয়াসিন, অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন–এ যে বোমসিং বাবু দেখছি…..গায়ে হাত দিয়ে বুঝতে পারলেন বহুক্ষণ পূর্বে তাকে হত্যা করা হয়েছে। দেহটা শক্ত হয়ে গেছে কাঠ হয়ে।
মিঃ আরিফ মূর্তিটা পরীক্ষা করে দেখছিলেন, তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন–এযে দেখছি আজব কারখানা। মূর্তিটার মধ্যে ফাঁকা আসনও দেখছি একটা।
মিঃ ইয়াসিন বোমসিং-এর মৃত দেহের পাশ থেকে উঠে এগিয়ে এলেন, মূর্তিটার দিকে অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন। সত্যিই এ সব যেন কেমন আজগুবি কাণ্ড-কারখানা লাগছে। একটা আর্তকণ্ড এখনও শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বুঝা যাচ্ছে না সে শব্দ কোথা হতে আসছে।
হঠাৎ মিঃ ইয়াসিনের নজরে পড়ে মূর্তির হাতে পুঁজা ছোরাখানায়। ছোরাখানা হাতে তুলে নিতেই দেখতে পায় ছোরাখানায় গাঁথা আছে একখানা ভাঁজ করা কাগজ। মেলে ধরলেন তিনি বৈদ্যুতিক আলোর সামনে,–পড়লেন
মোদন বারে’র গোপন রহস্য উদঘাটন করেছি। বার-এর মালিক বোমসিংকে তার উপযুক্ত সাজা দেওয়া হলো। অন্যান্য অনুচর এবং নর্তকীদলকে দক্ষিণ পাশের গোপন কক্ষে বন্দী করে রেখেছি। বিচার ভার আপনারা গ্রহণ করুন।
– দস্যু বনহুর
মিঃ ইয়াসিন এবং মিঃ আরিফ উভয়ে তাকালেন উভয়ের দিকে। মিঃ আরিফ বললেন– আশ্চর্য এই দস্যু বনহুর।
হাঁ স্যার আজ আমরা দস্যু বনহুরের সহায়তাতেই এই শয়তান দলকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হলাম
চলুন, আরও বাকী আছে।
হাঁ স্যার এখনও আমরা সবাইকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হইনি আশা করছি অল্পক্ষণই কার্যদ্ধার করতে পারবো।
মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন কয়েকজন পুলিশ সহ দস্যু বনহুরের চিঠির নির্দেশ মত বন্দী শালায় এসে হাজির হলেন। বন্দী কক্ষে প্রবেশ করে সবাই হতবাক হয়ে পড়লেন ক্ষণিকের জন্য। দেখলেন গুণ্ডাসণ্ডার মত সব জোয়ান বলিষ্ঠ লোক হাতে পায়ে শিকল বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে। মোদনমোহন বার এর ম্যানেজার নাথুরামকে চিনতেন মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন তারা খুশি হলেন কারণ দস্যু বনহুর তাদের কাজ অতি সহজ করে দিয়েছে।
একজন বৃদ্ধ দারওয়ান হাউমাউ করে কাঁদছিলো আর আর্তকণ্ঠে বিলাপ করছিলো। এতোক্ষণ এই শব্দই শুনতে পাচ্ছিলো। এবং প্রথম সাউন্ডবক্সে শুনতে পেয়েছিলেন। কারণ, সাউন্ডবক্সের লাউডস্পীকার মেসিন যন্ত্র খোলা ছিলো এই কক্ষে। বনহুর যে বেরিয়ে যাবার সময় সুইচ অন করে দিয়ে গিয়েছিলো তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন ও অন্যান্য পুলিশ অফিসার এবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুলিশগণ মিঃ আরিফের আদেশে শয়তান বন্দীদের শৃঙ্খল মুক্ত করে হাতে হাত কড়া মাজায় রশি পরিয়ে দিতে লাগলেন।
নর্তকীত্রয় পালাতে যাচ্ছিলো, মিঃ ইয়াসিন দু’জন পুলিশকে আদেশ দিলেন–এদের তিনজনকে একই রশি দিয়ে সাড়িবদ্ধভাবে বেঁধে ফেলো।
পিয়ারী বয়স কম, ইন্সপেক্টারের কথায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো–আমার কোন দোষ নেই সাহেব। আমাকে ছেড়ে দিন।
লীলাবাঈও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো–হুজুর আমি কোন অপরাধ করিনি। আমাকে বাঁধবেন না হুজুর। আপনারা আমাদের মা বাপ…..
যমুনারাণী আঁচলে চোখ মুছে বললো–আমাদের কোন দোষ নেই সাহেব। আমরা এখানে মাহিনা পেতাম কাজ করতাম, সাহেব ছেড়ে দেন সাহেব। এই নাক কান মলছি আর এসব কুকাজ করবো না।
মিঃ আরিফ বললেন–এতোদিন কতগুলো মানুষের মাথা খেয়েছো হিসাব রেখেছো?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলো নর্তকী তিনজন।
মিঃ ইয়াসিন বললেন–তোমাদের বিচার হবে তারপর ছাড়া পাবে বুঝলে?
পুলিশ বাহিনী মোদন বার-এর ম্যানেজার এবং অন্যান্য শয়তানদের বেঁধে গাড়ি বোঝাই করে ফিরে এলো পুলিশ অফিসে।
বনহুর গভীরভাবে চিন্তা করে চলেছে, তার আঙ্গুলের ফাঁকে ধুমায়িত সিগারেট। বালিশে ঠেশ। দিয়ে বসেছিলো বনহুর। ভাবছে বোমসিং মৃত্যুকালে কিছু বলতে চেয়েছিলো যা সে বলার সুযোগ পেলো না। তবে কয়েকটা শব্দ বোমসিং উচ্চারণ করেছিলো, অনিন্দন। অ–নি—-ন—এটা কোন লোকের নাম না দেশের নাম? কিসের নাম এই অক্ষরগুলো।
বনহুর রহমানকে ডেকে পাঠালেন।
অল্পক্ষণের মধ্যেই রহমান এসে হাজির হলো বনহুরের কক্ষে। কুর্নিশ জানিয়ে বললো– সর্দার, আমাকে ডেকেছেন?
হাঁ, বসো।
রহমান পাশের একটা আসনে বসে পড়লো।
বনহুর বললো–রহমান, অনিন্দন বলে কোন দেশ, নদী যা পর্বত আছে কোথাও? বা কোন ব্যক্তির নাম? বোমসিং মৃত্যুকালে অনিন্দন শব্দটা উচ্চারণ করেছিলো। জানি না সে ঐ নামে কি বলতে চেয়েছিলো।
রহমান আপন মনেই অক্ষর কয়টি উচ্চারণ করলো–স–নি——-তারপর গভীরভাবে চিন্তা করলো সে কিছুক্ষণ তারপর হঠাৎ বলে উঠলো রহমান-কান্দাই-এর অদূরে একটা দেশ আছে অনিন্দপুর, সর্দার সেই অনিন্দপুরের রাজার নাম হলো অনিন্দন। তবে বোমসিং মৃত্যুকালে কোন অনিন্দন শব্দ উচ্চারণ করে গেছে সেটা সঠিক বলা কঠিন।
বনহুর সোজা হয়ে বসে উহ্লুকণ্ঠে বললো–অনিন্দপুরের রাজার নাম অনিন্দন?
হাঁ সর্দার আমি সেই রকম শুনেছিলাম।
আমার মনে হয় বোমসিং এই রাজা সম্বন্ধে আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিলো। থাক বোমসিং আর জীবিত হবে না কাজেই তার কথার কিছুই আর শোনা যাবে না। রহমান?
বলুন সর্দার?
অনিন্দপুরে যেতে চাই এবং অনিন্দপুরের রাজার সঙ্গে আমি আলাপ করতে চাই।
কিন্তু সর্দার কান্দাই ছেড়ে এখন যাওয়া সম্ভব হয় কি করে?
কেন?
কান্দাই রহস্য এখনও সম্পূর্ণ উঘাটন হয়নি সর্দার। শয়তান মোদনের দল বন্দী হয়েছে, মোদন মরেছে, মেদনমোহন বার-এ মালিক বোমসিং খতম হয়েছে কিন্তু এখনও কান্দাই এর অধিপতি দেবসিং শর্মা গোপনে তার কু-কর্ম ঠিক পূর্বের মতই চালিয়ে চলেছে।
দেবসিং শর্মা!
হা সর্দার।
আমি তাকে একবার সাজা দিয়েছিলাম না?
হাঁ তাকে চরম সাজা দিয়েছিলেন সর্দার, কিন্তু লোকটা সুবিধার নয়।
কেন আবার যে–কিছু বলতে গিয়ে থামলো বনহুর।
আবার সে কান্দাই অধিবাসীদের অর্থলোভে বশিভূত করে তাদের সুন্দর স্ত্রী কন্যা হস্তগত করে তাদের জীবন বিনষ্ট করে চলেছে।
একথা এতদিন আমাকে জানাওনি কেন রহমান?
সর্দার আপনি তো কান্দাই ছিলেন না তাই জানেন না এবং আমরাও তাই জানাইনি। রহমান নত মস্তকে নম্রকণ্ঠে কথাটা বললো।
বনহুরের চোখেমুখে ফুটে উঠলো এক ভীষণ ক্রুদ্ধভাব। দাঁতে দাঁত পিষে বললো–সর্বপ্রথম আমি রাজা দেবসিং শর্মাকে উপযুক্ত শাস্তি দান করবো। তুমি সংবাদ সংগ্রহ করে আমাকে। জানাবে।
রহমান উঠে দাঁড়িয়ে নত মস্তকে কুর্নিশ জানিয়ে বেরিয়ে যায়।
নূরী এতক্ষণ আড়ালে থেকে শুনছিলো, রহমান চলে যেতেই নূরী প্রবেশ করে সেই কক্ষে।
বনহুর তখন শয্যা ত্যাগ করে পায়চারী করে চলেছে।
সব বনহুর সহ্য করতে পারে শুধু পারে না দুটো জিনিসকে সহ্য করতে একটি হলো অসহায় দুঃস্থ ব্যক্তির উপর নির্মম অত্যাচার আর নারী নির্যাতন।
সিংহের ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছিলো বনহুর এমন সময় নূরী এসে দাঁড়ায় তার সম্মুখে। হেসে বলে নূরী–হঠাৎ এমন গম্ভীর হয়ে পড়লে কেন হুর?
বনহুর নূরীর কথায় কোন জবাব দেয় না।
নূরী বনহুরের পাশে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়, বলে সে আবার —র রোজ যেখানে যাও আজ সেখানে যাবে না?
চমকে ফিরে তাকায় বনহুর, বলে–কোথায় যাই আমি?
তুমি না বললেও আমি সব জানি। মোদনমোহন বার-এ।
নূরী!–কুঞ্চিত করে বলে বনহুরকে তোমাকে এ কথা বলেছে?
আমার কাছে গোপন করতে চাইলেই কি গোপন করা যায়। সত্যি করে বলতো তুমি রোজ মোদনমোহন বার-এ যাওনি? সেখান থেকে সরাব পান করে আসোনি? নৰ্তকী পিয়ারীর প্রেম বন্ধনে…..
নূরী এ সব কি বলছো?
সব জানি আমি। আরও জানি নর্তকী পিয়ারী, নর্তকী যুমনারাণী, নর্তকী লীলার প্রেম সম্ভাষণ তুমি উপেক্ষা করলেও কস্তুরীবাঈকে তুমি উপেক্ষা করতে পারোনি………..
নূরী তোমার দুঃসাহস কম নয় দেখছি। এ সব বলার সাহস তোমার হলো কেমন করে? সব বুঝি তোমাকে রহমান বলেছে।
খিল খিল করে হেসে উঠলো নূরী।
বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে রইলো বনহুর।
নূরী হাসি বন্ধ করে বললো রহমান আমাকে কোন কথা বলেনি। ওকে অযথা সন্দেহ করো হুর। আমি জানি কস্তুরীবাঈ নামে এক নর্তকী তোমাকে ভালবাসে, শুধু ভালবাসে না গভীরভাবে ভালবাসে। আর তুমিও তাকে…..।
হঠাৎ বনহুর হেসে উঠে, হাসি থামিয়ে বলে–তুমি দেখছি সব খবরই রেখেছো? কস্তুরীবাঈকে আমি ভালবেসে ফেলেছি হঠাৎ, তাও তুমি জানো। কিন্তু কেনো আমি তাকে ভালবেসেছি তা বোধ হয় জানো না নূরী?
উঁ হুঁ তা জানি না।
এতো খবর রেখেছো অথচ আসল খবর রাখোনি।
বনহুর তুমি তা হলে সত্য কস্তুরীবাঈকে—
হাঁ সত্যি!
হুর!
অবাক হবার কিছু নেই।
নূরীর মুখ গম্ভীর হয়ে পড়লো, অভিমান ভরাকণ্ঠে বললো– তোমার উপর যে বিশ্বাস ছিলো আমি তা হারিয়েছি।
সে জন্য আমি নাচার নূরী। কারণ, কস্তুরীবাঈকে আমার প্রয়োজন।
বনহুর তুমি, তুমি—এতো নিচে নেমে গেছো?
সে আমাকে শুধু ভালই বাসে না, আমাকে সে কুকর্ম থেকে বিরত রাখে তাকে আমি—
– ভালোবাসো এই তো?
হাঁ নূরী, তুমি তাকে ভালবাসা ও বলতে পারো, প্রেম বলতে পারো কিংবা কৃতজ্ঞতা ও বলতে পারো–
বনহুর বাঁকা চোখে নূরীর দিকে তাকিয়ে মৃদৃ হাসলো।
নূরীর মুখ গম্ভীর হয়ে পড়েছে।
বনহুর নূরীকে টেনে নিলো, চিবুক্টা তুলে ধরলো মুখের কাছে, চাপা স্বরে বললো–প্রিয়ে আমাকে তুমি অবিশ্বাস করো না। আমি তোমাকে…..
ঐ সময় বাইরে কারো পদ শব্দ শোনা যায়।
বনহুর নূরীকে বাহুমুক্ত করে দিয়ে বলে–নূরী যাও কায়েস এসেছে কথা আছে ওর সঙ্গে।
নূরী প্রস্থান করলো সেখান থেকে।
কায়েস প্রবেশ করে কুর্নিশ জানালো।
বনহুর বললো–তাজকে প্রস্তুত করো এবং তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও দেবসিং শর্মার প্রাসাদে হানা দেবো।
সর্দার কান্দাই অধিপতি দেবসিং শর্মা?
হাঁ কায়েস।
কায়েস বিলম্ব না করে বেরিয়ে যায়।
অল্পক্ষণের মধ্যে বনহুর এবং তার দলবল দস্যু ড্রেসে সজ্জিত হয়ে দরবার কক্ষে এসে দাঁড়ালো।
বনহুর এবং রহমান একই ড্রেসে সজ্জিত হয়েছে।
রহমান শুধু বনহুরের সহকারীই ছিলো না, সে বনহুরের দেহরক্ষী হিসাবেও নিজকে চালিয়ে নিতো। সর্দারের জীবন রক্ষার্থেই সে নিজকে ব্যবহার করতে সর্বক্ষণ। রহমান তার প্রাণের চেয়েও ভালবাসে সর্দারকে এটাই ছিলো তার জীবন্ত প্রমাণ।
শুধু রহমান সর্দারকে জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসতো তা নয়। বনহুরের প্রত্যেকটা অনুচর তাদের প্রাণ অপেক্ষা সর্দারকে ভালবাসতো। সর্দারের জন্য তারা জীবন বিলিয়ে দিতে এতোটুকু দ্বিধা করতো না।
বনহুরের প্রত্যেকটা অনুচর যেমন নির্ভীক দুঃসাহসী তেমনি প্রভুভক্ত। আজ সবাই এসে দাঁড়িয়েছে সর্দারের আদেশ পাওয়া মাত্র তারা সেইমত কাজ করবে।
বনহুর বললো–আজ আমি ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করতে চলি নাই। আমি চলেছি একজন দেশ। শাসককে শায়েস্তা করতে। তোমরা সবাই জানো কান্দাই-এর শাসক না হলেও অধিপতি দেবসিং শর্মা। তার আদেশে কান্দাই অধিবাসী উঠা বসা করে থাকে।
হা সর্দার আমরা সবাই জানি একথা। বললো অনুচরদের মধ্য হতে একজন।
বনহুর বললো আবার দেশের অধিনায়ক হয়ে যদি সে দেশবাসীর সর্বনাশ করে তাহলে সে কত বড় পাপিষ্ঠ আর শয়তান হতে পারে তা তোমরা জানো। কাজেই আমি সেই পাপিষ্ঠ অধিনায়ককে ক্ষমা করতে পারি না। তোমরা সবাই এবার রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও।
আমরা সবাই প্রস্তুত সর্দার।
বেশ তবে চলো।
বনহুর আর রহমান দরবার কক্ষ ত্যাগ করলো।
সমস্ত অনুচরগণ অনুসরণ করলো সর্দার আর রহমানকে।
হঠাৎ বনহুরের মনে পড়লো কোন একটা জিনিস সে ফেলে এসেছে আস্তানায় ভিতরে। মনে পড়তেই বনহুর নিজেই ফিরে এলো আস্তানায়! একটা লৌহ সিন্দুক খুলে তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিচ্ছিলো সে।
বনহুর উবু হয়ে সিন্দুকে ঝুঁকে জিনিসটা তুলে নিচ্ছিলো পকেটে।
এমন সময় নাসরিন দূর থেকে বনহুরকে পিছন হতে দেখতে পায়। নাসরিন তার স্বামী মনে করে–কারণ আজ রহমানের দেহেও ছিলো বনহুরের মত একই জমকালো ড্রেস।
নাসরিন পা টিপে টিপে বনহুরের পিছনে এসে দাঁড়ায়। আলগোছে টিপে ধরে ওর চোখ দুটো।
বনহুর নূরী মনে করে ওর হাত দু’খানা মুঠায় চেপে ধরে টেনে নেয় কাছে।
নাসিরনের মুখে দৃষ্টি পড়তেই বনহুর বিস্মিত হয়।
অবাক হয়ে তাকায় বনহুর নাসরিনের মুখের দিকে।
নাসরিন লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলো মুহূর্তে, তার চোখে মুখেও ফুটে উঠলো হতভম্ভ ভাব।
ঠিক্ সেই দণ্ডে নূরী এসে পড়ে সেখানে।
তখনও নাসরিন বনহুরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ।
বনহুর নাসরিনকে তাড়াতাড়ি বাহুমুক্ত করে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
নূরীর চোখ দিয়ে তখন অগ্নি বর্ষণ হচ্ছে।
নাসরিন আর একটুও দেরী করে না সেখানে, ছুটে চলে যায়। এতো বড় ভুল সে জীবনে করে নাই, বুকের মধ্যে যেন তার আলোড়ন শুরু হয়েছে। নিজকে কোথায় গোপন করে রাখবে। ভেবে পায় না যেন সে।
নাসরিন চলে যেতেই বনহুর নূরীর মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
নূরী অধর দংশন করে বললো–বনহুর এত জঘন্য তুমি জানতাম না।
বনহুরের মুখোভাবে এতোটুকু পরিবর্তন আসেনি, একটু হেসে বললো সে–নূরী তুমি যা দেখলে সম্পূর্ণ এক্সিডেন্ট। নাসরিন ভুল করেছিল আমাকে, আমিও ভুল করেছিলাম তাকে…..শোন। নূরী! বনহুর নূরীর একখানা হাত ধরে।
নূরী ক্রদ্ধ কণ্ঠে বললো–তোমার নেকামিভরা কথাগুলো আমি বেশ বুঝতে পেরেছি! ছাড়ো আমার হাত….এক ঝটকায় বনহুরের হাতের মুঠা থেকে নূরী নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে পালিয়ে গেলো।
বনহুর নূরীর দিকে পা বাড়াতেই মাহবুব এসে ডাকলো সর্দার, সবাই প্রস্তুত আপনি চলুন।
থমকে দাঁড়ালো বনহুর, মনে পড়লো তার জন্য আস্তানার বাইরে সবাই অপেক্ষা করছে। বনহুর তার প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বললো–চলো।
সর্দার এসে তাজের পিঠে চেপে বসতেই অন্যান্য সবাই অশ্ব-পৃষ্ঠে চেপে বসলো।
এক সঙ্গে অশ্ব চালনা করলো সকলে।
কান্দাই জঙ্গল প্রকম্পিত হয়ে উঠলো, অশ্ব-খুরের শব্দে দুলে উঠলো যেন সমস্ত বনভূমি।
বনহুর আর রহমান সর্বাগ্রে।
পিছনে অন্যান্য সকলে হুঙ্কার ছেড়ে অগ্রসর হলো।
ধীরে ধীরে মিশে এলো বনহুরের অশ্ব-পদ শব্দ।
নূরী নিজ কক্ষে প্রবেশ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো। নিজের জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেললো নূরী খণ্ড খণ্ড করে। ঘরের জিনিসপত্র সব ছুঁড়ে ফেলে দিতে লাগলো। নূরীর আচরণে অবাক হয়ে গেলে আস্তানার অন্যান্য নারী-পুরুষ সবাই।
সারাট দিন নূরী মুখে কিছু দিলো না।
নাসরিন সব বুঝতে পারলো, তারই ভুলের জন্য নূরী এমন হয়েছে, অবিশ্বাস করেছে তার সর্দারকে।
নাসরিন এসে কিছু বলবে তাও সাহসী হলো না। কারণ নূরীকে নাসরিন অত্যন্ত ভয় করতে। যদিও নূরী আর নাসরিন উভয়ে সহচরী ছিলো তবু নূরীকে সমীহ করে চলতো সে।
কান্দাই অধিপতি দেবসিং শর্মার প্রাসাদ।
আজ দেবসিং-এর জন্ম উৎসব পালন হচ্ছে।
রাজপ্রাসাদের সম্মুখস্থ বাগানবাড়িতে উৎসব চলেছে।
আলোয় আলোকিত সমস্ত বাগানবাড়ি।
বাগানের মাঝখানে চলেছে নাচগান। একপাশে টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। এখনও খাবার আসনে এসে কেউ বসেনি।
দেবসিং শর্মা মধ্যস্থ আসনে বসে আছেন।
তার চার পাশ ঘিরে বসেছেন মহারাজের পরিষদগণ।
সম্মুখে নত্তৰ্কী দল নাচ দেখাচ্ছে। একপাশে বাদ্যকরগণ নানারকম বাজনা পরিবেশন করে চলেছে। আনন্দ-মুখর হয়ে উঠেছে বাগানবাড়িখানা মাঝে মাঝে করতালি দিচ্ছিলেন দেবশর্মা।
খানাপিনার পর চলবে আরও নাচ-গান, তারপর নতুন নর্তকী নাচ পরিবেশন করবে।
একটি তরুণীকে পাকড়াও করে আনা হয়েছে কোন এক নাগরিকের বাড়ি থেকে। উৎসব শেষে মহারাজের আনন্দদান কারণেই এর্কে যোগাড় করেছে প্রধান সেনাপতি রাজেশ্বর রাম।
এই মুহূর্তে রাজেশ্বর রাম বসে আছে দেবসিং শর্মার পাশে–সে মাঝে মাঝে হর্ষধ্বনি করছে। মহারাজ দেবসিং শর্মাকে কিছু বলছিলো রাজশ্বের রাম।
এবার নাচ শেষ হলেই সবাই খাবার টেবিলে গিয়ে বসবে।
নানরকম সুস্বাদু খাদ্য দ্রব্যের সুগন্ধে বাগান-বাড়ির আকাশ-বাতাস ভরপুর হয়ে উঠেছে। নাচ-গান উপভোগ করার মাধ্যমেও সকলের রসনায় পানি এসে পড়ছিলো আর একটু পরই তারা তৃপ্তিসহকারে ভুরিভোজনে আত্মনিয়োগ করবে। আনন্দে ডগমগ সবাই।
ঠিক সেই মুহূর্তে দস্যু বনহুর দলবল নিয়ে আচমকা প্রবেশ করলো সেই স্থানে। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত রাইফেল, পিস্তল আর ছোরা।
জমকালো পোশাক পরা, মাথার পাগড়ি দিয়ে মুখের নীচের অংশ ঢাকা, এক একজন যেন এক একটি যমদূতের মত প্রত্যেকটা আনন্দমুখর ব্যাক্তির বুকের কাছে অস্ত্র বাগিয়ে ধরলো।
বনহুর নিজে ছোরাখানা চেপে ধরলো দেবসিং শর্মার বুকের কাছে, দাঁতে দাঁত পিষে বললোখবরদার নড়বে না।
সকলের চোখেই বিস্ময় ভয় আর উদ্বিগ্নতা।
প্রত্যেকেই নিজ নিজ আসনের পাশে উঠে দাঁড়িয়েছে। দু’চোখ কপালে তুলে তাকাচ্ছে ফ্যাল ফ্যাল করে।
মহারাজ দেবসিং শর্মা বনহুরের চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে–দস্যু বনহুর তুমি?
বনহুর সচ্ছ-গলায় জবাব দেয় হাঁ আমি!
বললেন দেবসিং শর্মা—-আবার কেননা এসেছো?
নিয়ন্ত্রণ না পেলেও তোমার জন্ম-উৎসবে যোগ দিতে এসেছি দেবসিং। বনহুর তার দলবল সবাইকে ইংগিৎ করলো ও পাশে খাবারের টেবিলে গিয়ে বসতে।
সর্দারের নির্দেশ পাওয়া মাত্র রহমান ছাড়া সবাই গিয়ে খাবার টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসলো। নানারকম খাবারে টেবিল সজ্জিত ছিলো, গো গ্রাসে খেতে শুরু করলো সকলে।
বনহুর আর রহমান মহারাজ দেবসিং শর্মার দু’পাশে দু’জন আসন দখল করে নিয়ে বসলো।
অবশ্য মহারাজ দেবসিং শর্মার আসনে উপবেশন করছে দস্যু বনহুর স্বয়ং।
বনহুর এবং তার দলবলের আগমনে নাচনেওয়ালীরা নাচ বন্ধ করে এক পাশে দাঁড়িয়ে থর। থর করে কাঁপছিলো।
বনহুর তাদের লক্ষ্য করে বললো–নাচো।
দেবসিং শর্মাও বনহুরের সঙ্গে যোগ দিয়ে ফ্যাকাশে মুখে বললেন–নাচো তোমরা…..
নাচনেওয়ালীগণ পুনরায় নাচতে শুরু করলো।
বনহুরের সম্মুখস্থ টেবিলে একরাশ ফল-মূল রেখে গেলো একজন লোক। অবশ্য রহমানের নির্দেশেই সে ফল-মূল আসতে বাধ্য হয়েছে।
বনহুর নাচ দেখলো আর ছোরার আগা দিয়ে আংগুরের ঝোপাগুলো ফলের রেকাবি থেকে তুলে নিয়ে মুখে ফেলছিল। ঠেশ দিয়ে সচ্ছল আরামে বসে নাচ দেখছে বনহুর, যেন সে নিজ আস্তানায় বসে নাচ দেখছে।
দেবসিং শর্মা এবং তার পারিষদগণ সবাই যে যেমন বসেছিল তেমনি বসে আছে জড় পুতুলের মত। সকলের মুখেই ভীত ভাব কিন্তু কেউ আসন ত্যাগ করার সাহসী হচ্ছে না।
রহমান দেবশর্মার বামপাশের আসনে উপবেশন করেছিলো। সে রিভলভারখানাকে সতর্কভাবে ধরেছিলো দেবশর্মার পাঁজর লক্ষ্য করে। কেউ যেন এতোটুকু সুযোগ না পায় তাদের উপর হামলা চালাতে বা কোনরকম শয়তানী করতে।
মহারাজের জীবননাশ সম্ভাবনায় কেউ একচুল নড়ার সাহসী হলো না। সবাই আড় নয়নে। তাকাচ্ছে দস্যু বনহুরের কালো আবরণ ঢাকা মুখের দিকে।
এক সময় আহার শেষ করে বনহুরের অনুচর দল।
এবার বনহুর আদেশ দেয়–মহারাজ এবং তার অনুচরদের দেহ হতে মূল্যবান পোশাক এবং মতির মালাগুলো খুলে নাও।
রহমান নিজে দেবশর্মার কণ্ঠ থেকে মতিমালা এবং মূল্যবান হীরক হারগুলো খুলে নিলো। দেহের রাজকীয় পোশাক-পরিচ্ছদও খুলে নিলো সে নির্বিঘ্নে।
অন্যান্য অনুচরগণ মহারাজের পরিষদগণের দেহের মূল্যবান পরিচ্ছদ এবং অলঙ্কার খুলে। নিয়ে সবাই আনন্দধ্বনি করে উঠলো।
বনহুরের দলবল মহারাজের বাগান-বাড়ীর চারপাশ এমনভাবে ঘিরে ফেলেছিলো যার জন্য একটি প্রাণীও বাগান-বাড়ির বাইরে যেতে পারেনি বা কেউ বাগানবাড়িতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়নি।
বনহুর এবার দেবসিং শর্মার বুকে সূতীক্ষ ধার ছোরাখানা চেপে ধরে কঠিন কণ্ঠে বললো– আজও তোমাকে ক্ষমা করলাম রাজা। কারণ তুমি কান্দাই অধিপতি, তোমাকে হত্যা করলে কন্দাইবাসীর চোখে অশ্রুর নদী না বইলেও তাদের মনে ব্যথা লাগবে। আমি চাই না কারো মনে ব্যথা লাগে। কিন্তু মনে রেখো রাজা এর পর যদি কোন দিন কোন নারীর প্রতি তুমি হস্তক্ষেপ করো কিংবা অহেতুক এই রকম খাদ্য সম্ভারের আয়োজন করো তাহলে তোমাকে শুধু হত্যাই করবো না, তোমার মৃতদেহ ঝুলিয়ে দেবো তোমার রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে বুঝলে? এবার বলো কোথায় সে অবলা রমণী যাকে আজ রাতের জন্য তুমি অঙ্গশায়িনী করতে চেয়েছিলে?
দেবসিং-এর মুখ কালো হয়ে উঠেছে, বললেন তিনি–দস্যু বনহুর তোমার আদেশ আমি মাথা পেতে গ্রহণ করলাম। তুমি আমাকে হত্যা করো না আর যে রমণীর কথা বলছো তাকে। বাগান-বাড়ির আমার বিশ্রাম কক্ষে আটক করে রাখা হয়েছে।
বনহুর রহমানকে ইংগিৎ করলো তাকে নিয়ে আসার জন্য।
রহমান চলে গেলো।
অল্পক্ষণ পর ফিরে এলো এক আলুথালু বেশ তরুণীকে নিয়ে।
বনহুর তরুণীর আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বললো–রহমান একে নিয়ে যাও, পৌঁছে দিয়ে এসো এর অভিভাবকের কাছে। অন্যান্য অনুচরদের লক্ষ্য করে বললো–তোমরা যাও।
সর্দারের আদেশ পেয়ে সবাই জিনিস-পত্র নিয়ে উধাও হলো।
রহমান তরুণীসহ বেরিয়ে গেলো বাগান-বাড়ি থেকে।
বনহুর তখনও দেবসিং শর্মার বুকের কাছে চেপে ধরে আছে তার সুতীক্ষ্ণ ধার ছোরাখানা। সবাই যখন বেরিয়ে গেলো তখন বনহুর দেবসিং-এর বুকের কাছ থেকে ছোরা সরিয়ে নিয়ে। নিমিশে প্রাচীর টপকে তাজের পিঠে লাফিয়ে পড়লো।
মহারাজ দেবসিং শর্মা এবং তার পারিষদগণ শুধু নিচের পোশাক পরিহিত অবস্থায় ছুটোছুটি করে চিৎকার শুরু করলেন–পাহারাদার…..পাহারাদার ………পুলিশ…….পুলিশ…..
চারিদিক থেকে ছুটে এলো পাহারাদারগণ, সবাই বন্দুক রাইফেল উদ্যত করে এসে দাঁড়ালো। মহারাজের এবং পারিষদগণের অবস্থা দেখে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো।
মহারাজ দেবসিং শর্মা চিৎকার করে বললেন–এতোক্ষণ কোথায় ছিলে তোমরা? দস্যু বনহুর আমার সর্বনাশ করে গেলো।
মহারাজের আদেশে তৎক্ষণাৎ পুলিশ অফিসে ফোন করা হলো।
কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ সুপার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিন এসে হাজির হলেন পুলিশ ফোর্স নিয়ে। তাঁরা রাজবাড়ীতে পৌঁছে বিস্মিত-হতবাক হলেন।
মহারাজ দেবসিং বললেন–দস্যু বনহুর আমার শুধু সর্বনাশ করে নাই আমাকে সর্বতঃভাবে অপমান লাঞ্ছিত করেছে। আমার আমন্ত্রিত অতিথিগণের মুখের আহার তার অনুচরদের দ্বারা ভক্ষণ করিয়েছে, তাদের দেহের পোশাক-পরিচ্ছদ খুলে নিয়ে তাদের চরমভাবে অপমান করেছে।
পুলিশ সুপার দেবসিং শর্মার কথা শুনে রাগে গ গ করে ফুলছিলেন।
ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন মুখে রাগত-ভাব ফুটিয়ে রাখলেও মনে মনে তিনি হাসছিলেন। দস্য বনহুর তাকেও কম নাকনি চুবানি খাওয়ানি তবু তিনি এই দস্যুর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতে পারেন না কোন সময়।
মহারাজের মুখে সব শুনে মিঃ আরিফ ক্ষেপে উঠলেন ভীষণভাবে, যদিও দস্যু বনহুরের সহায়তায় তারা কয়েকদিন পূর্বে কান্দাই রহস্য উঘাটনে সক্ষম হয়েছেন। বললেন মিঃ আরিফ দেবসিং শর্মা আমরা আপনার এই দুর্ঘটনার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত। দস্যু বনহুর আপনাকে অপমান করে কান্দাইবাসীকে অপমান করেছে। আপনাকে এবং আপনার পারিষদগণকেই শুধু সে অপমান করেনি আপনাদের মহা-মূল্যবান অলঙ্কার আর পোশাক পরিচ্ছদ হরণ করে নিয়ে গেছে। আইনের কাছে সে চরম অপরাধে অপরাধী, কাজেই আমরা দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে অত্যন্ত চেষ্টা করবো।
সেদিনের মত পুলিশ-ফোর্স সহ পুলিশ অফিসারদ্বয় বিদায় গ্রহণ করলেন।
মিঃ আরিফ ঘোষণা করে দিলেন দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হলে কান্দাই রাজ্যে এক মহাউৎসবের আয়োজন করা হবে। যে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে তাকে সরকার মোটা টাকা পুরস্কার দান করবেন এবং তাকে খেতাব দানে সম্মানিত করবেন।
রহমান পাগলিনী প্রায় সেই তরুণীকে তার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো আস্তানায়। ততক্ষণে বনহুর তার দলবল নিয়ে পৌঁছে গেছে।
বনহুর রহমানকে জিজ্ঞাসা করলো রহমান, যুবতীটিকে তার আত্মীয়-স্বজনের কাছে পৌঁছে দিয়ে এসেছো?
হাঁ সর্দার।
অনুচরগণ রহমান আর বনহুরের সম্মুখে স্তূপাকার করে রাখলো যা তারা দেবশর্মার বাগান বাড়ি থেকে হরণ করে এনেছিলো।
বহু মূল্যবান কণ্ঠহার, শিরস্ত্রাণ, বলয় আর মুকুট।
বনহুর এক একটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিলো। আর ফল ভক্ষণ করছিলো।
বনহুরের সম্মুখ টেবিলে স্তূপাকার আংগুরের ঝোপা থরে থরে সাজানো।
এমন সময় বনহুরের শহুরে অনুচর হারেশ এসে কুর্নিশ করে জানালো সর্দার, পুলিশ বাহিনী। সমস্ত শহরময় আপনাকে খোঁজ করে চলেছে। পুলিশ সুপার মোটা বখশীশ ঘোষণা করেছেন…..
সব শুনেছি হারেশ! পুলিশ সুপারের মোটা বখশীশ পাবার লোভে আমি স্বয়ং হয়তো গিয়ে হাজির হবো। শোন কায়েস!
কায়েস একপাশে দাঁড়িয়েছিলো সর্দারের সম্মুখে এক পা সরে দাঁড়ালো–বলুন সর্দার?
এই সব মাল নিয়ে গিয়ে মাল-গুদামে রেখে দাও। আর এই মতিমালা যেটা সবচেয়ে বেশি মূল্যবান সেটা পুলিশ অফিসে পাঠিয়ে দাও আর লিখে দাও, যে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে তাকে যেন এই মতিমালা বখশীশ দেওয়া হয়।
কায়েস বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সর্দারের মুখে।
অন্যান্য অনুচর সবাই অবাক হলো সর্দারের কথা শুনে।
বনহুর নিজে একটা মালা তুলে নিলো হাতে–এই মালা ছড়া মহারাজের কণ্ঠে ছিলো। এটাই পাঠিয়ে দাও।
কায়েস মালা ছড়া হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখ দুটো তার ছলছল করে উঠলো, বললো–সর্দার এ মালা ছড়ার মূল্য অত্যাধিক….
সেই কারণেই এই মালা ছড়া আমি পাঠাচ্ছি কায়েস। দস্যু বনহুরকে যে পাকড়াও করবে তাকে যা তা বখশীস দিলে তো চলবে না। যাও।
কায়েস মালা ছড়া নিয়ে চলে গেলো।
রহমান তার অন্যান্য অনুচরদের বললো–তোমরা এ সব জিনিস নিয়ে যাও, গুদামে রেখে দাওগে।
অনুচরগণ স্থূপাকার মালপত্র নিয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।
রহমান শুধু দাঁড়িয়ে রইলো।
বনহুর বললো–রহমান, এবার বোমসিং-এর সেই অনিন্দপুরের অনিন্দনকে দেখতে হবে। বোমসিং অনিন্দন সম্বন্ধে কি বলতে চেয়েছিলো এবার জানতে হবে।
রহমানের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা চললো এসব ব্যাপারে। তারপর উঠে পড়লো বনহুর।
বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করে চারিদিকে তাকালো, নূরীকেই সন্ধান করছিলো বনহুর। কক্ষমধ্যে লক্ষ্য করে অবাক হলো সে, দেখলো কক্ষের জিনিস-পত্র বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানো রয়েছে সমস্ত মেঝের মধ্যে। তার বিছানা, বালিশ সব এলোমেলো।
বনহুর নূরীর কক্ষে এসে দাঁড়ালো।
নূরী তখন ওদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলো।
বনহুর নূরীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলো–নূরী।
নূরী কোন জবাব দিলো না।
বনহুর নূরীর কাঁধে হাত রাখতেই নূরী রাগতকণ্ঠে বললো–এখানে এসেছো কি জন্য?
হেসে বললো বনহুর–তোমাকে খুঁজতে।
আমার সঙ্গে তোমার কোন প্রয়োজন নেই, যাও তুমি আমার কক্ষ থেকে।
নূরী বলো কেননা তুমি আমার উপর রাগ করছো?
তোমার উপর রাগ করার কোন অধিকার আমার নেই। তুমি আমার কেউ নও।
নূরী।
বনহুর এতোক্ষণ ধৈর্যসহকারে কথা বলছিলো এবার সে ধৈর্যচ্যুত হয়–নূরী কেননা তুমি আমার উপর মিথ্যা রাগ বা অভিমান করছো বলো?
মিথ্যা নয় সত্যি।
যা তুমি দেখেছো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
নাসরিনকে তুমি ভালবাসো না বলতে চাও?
বাসী, কিন্তু তুমি যা ভাবছো তা নয়।
সব জানি বনহুর। এমনি আরও একবার তুমি ভুল বুঝাতে চেষ্টা করেছিলে? আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম নাসরিন তোমার…..
নূরী এ সব কি যাতা বলছো? জানো সে আমার সহকারী রহমানের স্ত্রী
পর-স্ত্রী বলেই তো তার উপর তোমার এতো লোভ।
নূরী…..ছিঃ ছিঃ এতো নীচ তুমি হতে পারলে?
হাঁ আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। তুমি যাও বনহুর। কারণ আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারি না।
তুমি যা দেখেছে সম্পূর্ণ ভুল…..
আমি শুনতে চাই না তোমার কোন কথা! নূরী দ্রুত বেরিয়ে গেলো তার কক্ষ থেকে।
এতোক্ষণ আড়াল থেকে সব শুনছিলো নাসরিন। নূরী বেরিয়ে যেতেই নাসরিন তাকে অনুসরণ করলো, আজ সে নিশ্চুপ থাকতে পারলো না।
নূরী আস্তানার একটা নির্জন জায়গায় এসে বসে পড়লো ধপ করে। মুখমণ্ডল তার রাগে ক্ষোভে রাঙা হয়ে উঠেছে। চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত।
নাসরিন এসে বসলো তার পাশে, ডাকলোনূরী।
নূরী গম্ভীর মুখে বসে রইলো, কোন জবাব দিলো না সে।
নাসরিন নূরীর কাঁধে হাত রাখলো।
নূরী এক ঝটকায় নাসরিনের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো–স্বামীর ভালবাসা উপেক্ষা করে আর একজনকে ভালবাসতে লজ্জা করে না তোর?
নূরী সব শোন তারপর বলল।
আমি কোন কথাই শুনতে চাই না। আমি জানতাম না তোদের মধ্যে এমন একটা গোপন প্রেম…..
চুপ করো নূরী আমি তোমাকে স্পর্শ করে বলছি মিথ্যা বলবো না। নূরী তুমি বিশ্বাস করো তোমার বনহুরের কোন দোষ নেই। দোষ যদি থাকে সে আমার। নূরী সেদিন সর্দার আর ও একই ড্রেস পরিধান করেছিলো। আমি ওকে দেখেছিলাম সেই ড্রেসে। ওকে খুঁজতে এসে দেখি সে উবু হয়ে কি যেন করছে। আমি জানতাম না ও নয়, আমি পিছন থেকে চুপি চুপি এসে ওর চোখ দুটো ধরে ফেলতেই সর্দার তোমাকে মনে করে আমাকে ধরে ফেলেছিলো ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি এসে পড়েছিলে। বলল এতে কার দোষ? কে অপরাধী? বলো–বলো নূরী…..
নূরীর দু’চোখ সচ্ছ হয়ে আসে, মন থেকে দূর হয়ে যায় একটা সন্দেহের কালো মেঘ। নূরীর মনে ব্যথা জাগে বনহুরকে সে কত না কথা বলেছে এ ব্যাপার নিয়ে। বললো নূরী–নাসরিন এ কথা আগে বলিসনি কেন? সেদিন বললে…..
বলার সাহস পাইনি নূরী। তুমি যদি বিশ্বাস না করো তাই বলিনি। যাও, যাও নূরী সর্দারকে ব্যথা দিও না। যাও তুমিনাসরিন নিজের আঁচলে নূরীর চোখের পানি মুছে হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিলো।
নূরী আর থাকতে পারলো না, ছুটে চলে গেলো বনহুরের কক্ষে।
বনহুর তার বিশ্রাম কক্ষে নেই।
নূরী দরবার কক্ষে গেলো, দরবার কক্ষে শূন্য।
এবার নূরী ঝরনার পাশে এসে চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো। হঠাৎ নজরে পড়লো বনহুর একটা পাথরের উপরে বসে আছে ওদিকে মুখ করে।
নূরী এসে দাঁড়ালো তার পাশে। কোমল কণ্ঠে অপরাধীর মত জড়োসড়ো হয়ে বললো আমাকে মাফ করে দাও হুর!
বনহুরের মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে উঠেছে। সে যেমন বসেছিলো তেমনি বসে রইলো।
নূরী বনহুরের পায়ের কাছে বসে দু’হাতে পা চেপে ধরলো–আমাকে তুমি মাফ করো হুর? আমি ভুল স্বীকার করছি…..
বনহুর উঠে দাঁড়ালো, গম্ভীর গলায় বললো–আমাকে বিরক্ত করো না নূরী! যাও এখান। থেকে।
না না আমি যাবো না। আমাকে তুমি তাড়িয়ে দিও না হুর। আমি ভুল বুঝে তোমাকে…..
তোমার কোন কথাই আমি শুনতে চাই না। তুমি যাও নূরী। বনহুর ক্রুদ্ধভাবে সেখান থেকে চলে গেলো।
নূরী থ’ মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, তার মুখে ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা।
বনহুর একটা দোকানের সম্মুখে গাড়ি রেখে নামতেই কে যেন পিছন থেকে ডাকলো– ভোলানাথ।
বনহুর ফিরে তাকাতেই দেখলো একটা বৃদ্ধের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে কস্তুরীবাঈ। আজ কতদিন হলো বনহুর ওকে অন্বেষণ করে ফিরেছিলো, খুশিতে উজ্জ্বল হলো বনহুরের চোখ দুটো।
বনহুর তার আংগুলের ফাঁক থেকে অদ্ধদগ্ধ সিগারেটখানা নিক্ষেপ করে এগিয়ে আসে কস্তুরীবাঈ-এর পাশে–কস্তুরী তুমি!
হাঁ, তুমি কোথায় যাবে ভোলানাথ?
সামনের দোকানে।
এটাতো স্বর্ণকারের দোকান।
হঁ এসো আমার সঙ্গে।
কস্তুরীবাঈ বললো–এসো ভোলা আমার বাপুর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই।
বনহুর থমকে দাঁড়ালো, ফিরে তাকালো বৃদ্ধের দিকে।
কস্তুরীবাঈ বললো–এ আমার বাপুজী বুঝলে?
বনহুর তীক্ষ্ণ নজরে দেখে নিলো একবার বৃদ্ধের পা থেকে মাথা অবধি।
বৃদ্ধ কিন্তু মুখখানা ফিরিয়ে রেখেছিলো অন্যদিকে। সে চোখ তুলে তাকালো না ভোলানাথের মুখে।
বনহুর কস্তুরীকে লক্ষ্য করে বললো–এসো কস্তুরী।
কস্তুরীবাই বনহুরের সঙ্গে অগ্রসর হলো।
বৃদ্ধ কস্তুরীবাঈ-এর সঙ্গে অগ্রসর না হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।
বনহুর আড়চোখে কস্তুরীবাঈ–এর কালো আবরণে ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ নিচু করে একটু হাসলো।
উভয়ে প্রবেশ করলো স্বর্ণকারের দোকান মধ্যে।
স্বর্ণকার সসম্মানে বনহুরকে অভিবাদন করে জিজ্ঞাসা করলো।
–কি চাই স্যার?
বনহুর বললো–একটি মূল্যবান অংগুরী দিন।
স্বর্ণকার খুঁজে খুঁজে সবচেয়ে যে অংগুরী বেশি মূল্যবান সেটা বের করে বনহুরের সম্মুখে রাখলো –নিন এটা বহু মূল্য পাথরে তৈরি অংগুরী।
কস্তুরীবাঈ অবাক হয়ে দেখলো, দু’চোখে তার রাজ্যের বিস্ময়।
বনহুর অংগুরীটা পরীক্ষা করে বললো—-কত দিতে হবে?
স্বর্ণকার অংগুরীর মূল্য বললো।
বনহুর অংগুরীর মূল্য মিটিয়ে দিয়ে, অংগুরীটা হাতে তুলে নিলো।
কস্তুরীবাঈ বললো-ভোলা এ অংগুরী তুমি কাকে দেবে?
আমার প্রেয়সীকে।
প্রেয়সী! কে সে ভাগ্যবতী নারী ভোলানাথ বলবে আমাকে?
যদি বলি তুমি?
কথা বলতে বলতে দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ায়।
বৃদ্ধ অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়িখানার দিকে মুখ করে।
বনহুর দাঁড়িয়ে পড়লো।
কস্তুরীবাঈও দাঁড়ালো তার পাশে, জমকালো আবরণে ঢাকা বোরখার ফাঁকে চোখ দুটো তুলে ধরলো বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর বললো–কস্তুরী তুমি আমাকে অনেকবার কুৎসিত কর্ম থেকে বিরত রেখেছো তাই আমি তোমাকে…..বনহুর কস্তুরীবাঈ–এর হাতখানা ধরে আংগুলে পরিয়ে দেয় বহু মূল্যবান অংগুরীখানা।
কস্তুরীবাঈ অস্ফুটকণ্ঠে বলে–ভোলানাথ!
হাঁ কস্তুরী আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসী। কিন্তু আমার আফসোস তুমি আজও আমার সম্মুখে তোমার চেহারা উন্মুক্ত করলে না।
দুঃখ করো না ভোলা, একদিন আমাকে তুমি দেখতে পাবে। আচ্ছা আজ তাহলে চলি?
কোথায় যাবে কস্তুরী বলল, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
অনেক দূরে যাবো তাছাড়া বাপু আছে আমার সঙ্গে।
বেশ যাও। কস্তুরী?
বলো?
আবার কবে দেখা হবে তোমার সঙ্গে।
সঠিক বলতে পারবো না। আজ চলি ভোলানাথ? কস্তুরীবাঈ বনহুরের কাছে বিদায় নিয়ে এগিয়ে যায় তার পিতার দিকে।
বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটের ফাঁকে খুঁজে দেয় তারপর। অগ্নিসংযোগ করে গাড়িতে উঠে বসে।
পুলিশ সুপার মিঃ আরিফের অফিস রুমে টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে আছে কয়েকজন পুলিশ অফিসার। মিঃ আরিফ মিঃ ইয়াসিন, মিঃ হারুন এবং মিঃ সিদ্দিকী। সকলেরই চোখে-মুখে দারুণ উক্তৃষ্ঠার ছাপ।
মিঃ আরিফের হাতে একখানা মূল্যবান হার এবং একখানা চিঠি।
মিঃ আরিফ বললেন–দস্যু বনহুর পুলিশ মহলকে এই চিঠি আর হারছড়া পাঠিয়ে উপহাস করেছে। দেখছেন না চিঠিখানা। পরুন মিঃ ইয়াসিন?।
মিঃ ইয়াসিন মিঃ আরিফের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়লেন–
পুলিশ সুপার এই মূল্যবান হারছড়া পুরস্কার ঘোষণা করে জানিয়ে দিবেন। যে দস্যু বনহুরকে প্রেপ্তার করে আনতে সক্ষম হবে তাকে এই হারটি পুরস্কার দেওয়া হবে। মনে রাখবেন হারছড়া আত্মসাৎ করা চলবে না।
–দস্য বনহুর।
মিঃ ইয়াসিন চিঠিখানা একবার নয় বার দুই পড়লেন। তারপর টেবিলে ওয়েট চাপা দিয়ে রাখলেন।
ইলেকট্রিক আলোতে মিঃ আরিফের হাতে হারছড়া ঝম করছে। উল্টে পাল্টে দেখে বললেন মিঃ আরিফ-আপনাদের মতামত জানতে চাই?
এমন সময় একজন পাহারাদার এসে জানালোস্যার, একজন সাহেব দেখা করতে চান। এই যে কার্ড দিয়েছেন।
কাৰ্ডখানা হাতে নিলেন মিঃ আরিফ, কার্ডে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আনন্দ-ভরা কন্ঠে বললেন মিঃ ফরিদ সাহেব এসেছেন। আমার বাল্য বন্ধু? যাও ভিতরে নিয়ে এসো।
চোখে চশমা মুখে ফ্রেম কটা দাঁড়ি, হাতে ছড়ি কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করেন এক অৰ্দ্ধ বয়স্ক ভদ্রলোক। চোখে-মুখে আভিজাত্যের ছাপ বিদ্যমান।
কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করতেই সবাই সসম্মানে উঠে দাঁড়ালেন।
মিঃ আরিফ দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন–আরে ফরিদ যে? এসো–এসো, বসো—মিঃ। আরিফ নিজ আসনের পাশে বসিয়ে দিলেন বাল্য বন্ধু মিঃ ফরিদ সাহেবকে।
মিঃ ফরিদ হেসে বললেন–কেমন আছো আরিফ?
চাকরি করি, থাকবো কেমন আর। না মরে কোন রকমে বেঁচে আছি এই যা। হাঁ আগে তোমার সঙ্গে এদের পরিচয় করিয়ে দেই। মিঃ আরিফ উপস্থিত সকলের সঙ্গে মিঃ ফরিদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
মিঃ ফরিদ বললেন–হঠাৎ অসময়ে এসে তোমাদের কথা বার্তার কোন অসুবিধা করলাম না তো?
আরে না না তুমি আমার পরম আত্মীয়ের চেয়ে অনেক বেশি। তুমি উপস্থিত থাকলে আমাদের আলোচনায় কোন ব্যাঘাত ঘটবে না। বলোনা, ভাই আমরা একেই নানারকম চুরি ডাকাতি খুন-জখম নিয়ে সর্বদা ব্যস্ত আছি। তারপর দস্যু বনহুরকে নিয়ে আর এক ঝাঁমেলা।
দস্যু বনহুর–মিঃ ফরিদ সাহেব শিউরে উঠলেন যেন। ঢোক গিলে বললেন–দস্যু বনহুর আবার নতুন করে কোথাও হামলা-টামলা…..
ঠিক হামলা নয়, সে পুলিশকে বাদর নাচ নাচাতে চায়।
তার মানে? বললেন মিঃ ফরিদ সাহেব।
মিঃ আরিফ দস্যু বনহুর সম্বন্ধে সমস্ত কথা খুলে বললেন মিঃ ফরিদের কাছে।
মিঃ ফরিদের মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে-বর্ণ হয়ে উঠলো। তিনি বললেন–কি জানি দস্যু বনহুর নাম শুনলে আমার পিলে কাঁপে। বড় হতভাগা দস্যু এটা না হলে ওমন হারছড়া পাঠিয়ে কেউ নিজের নামে গ্রেপ্তারী ঘোষণা করতে পারে। মিঃ ফরিদ কথাটা বলতে বলতে হারছড়া টেবিল থেকে হাতে তুলে নিয়ে উল্টেপাল্টে অবাক হয়ে দেখতে থাকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার তারা পূর্ব আলোচনায় ফিরে আসেন।
মিঃ আরিফ বললেন–হারছড়া সম্বন্ধে বাইরে জানাজানি না করাই ভাল।
হাঁ সেই ভাল। বাইরে কোনরকম জানাজানি করে পুলিশ মহল ভালভাবে সতর্ক হওয়াই ভাল। তাছাড়া সি. আই, ডি, পুলিশকে এই পুরস্কারের কথা জানিয়ে তাদের সতর্ক করে দিন। কথাগুলো বললেন মিঃ ফরিদ সাহেব।
আলোচনা জমে উঠলো ভীষণভাবে। কিভাবে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করা যায় সেজন্য এক একজন এক একরকম মতামত পেশ করতে লাগলেন।
শুধু মিঃ ইয়াসিন নীরব রয়েছেন তিনি শুনে যাচ্ছেন মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলছেন মাত্র।
সি. আই. ডি. পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ গহর মুর্শেদকে ফোন করে ডেকে আনা হলো।
মিঃ আরিফ তাকে এ ব্যাপারে সমস্ত কথা বুঝিয়ে বললেন। দস্যু বনহুরের চিঠি আর মালা। ছড়াও দেখালেন।
মিঃ গহর মুর্শেদ বনহুরের চিঠি পড়ে বিস্মিত হলেন, মালাছড়া তাকে আরও অবাক করে ফেলেছে। তিনি মালাছড়া নেড়েচেড়ে দেখে বললেন–নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য নিয়ে দস্যু বনহুর। এই মালা ছড়া পাঠিয়েছে। না হলে এতো মূল্যবান মালা সে হাত ছাড়া করত না। হাঁ এ মালাই আমরা ঘোষণা করবো, কারণ দস্যু বনহুর জানুক তার কথা আমরা পালন করেছি। কিন্তু আসলে আমরা অন্য মালা…….
মিঃ ফরিদ বলে উঠলো–দস্যু বনহুর যদি জানতে পারে আপনারা সে মালা গোপন রেখে মিথ্যা অন্য একটি মালা দিয়ে লোকটিকে ধোকা দিতে চান?
এ কথা সে কেমন করে জানবে। আমাদের মধ্যে কেউ একথা প্রকাশ করবে না। কিন্তু আসল কথা হলো দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করার এ আর একটি ফন্দি। হারছড়া অতি মূল্যবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ হার দস্যু বনহুর পুনরায় হস্তগত করার চেষ্টা করবে। সে জানে কেউ এটা গোপনে লুকিয়ে রাখতে পারবে না।
মিঃ ফরিদ বললেন-কাজেই আপনারা এই হারছড়া দিয়েই বনহুরকে গ্রেপ্তার করতে চান?
হাঁ আমি দস্যু বনহুরের পাঠানো হারছড়া দিয়েই দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করবো।
মিঃ আরিফ খুশি হয়ে বললেন–সত্যি মিঃ মুর্শেদ আপনার বুদ্ধি কৌশলের কাছে বহু সুতীক্ষ্ণ মস্তিষ্ক পরাজয় লাভ করে।
মিঃ মুর্শেদ বললেন–স্যার, এই হারছড়া আমার কাছে রাখতে চাই।
নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই আপনি ওটা রাখতে পারেন।
কিন্তু আমার কাছে যতদিন এ হারছড়া থাকবে ততদিন আমাকে কিছু সংখ্যক পুলিশ-ফোর্স দিতে হবে। যদিও আমার নিজের অফিসে অনেক সি. আই. ডি. পুলিশ আছে।
হাঁ এ ব্যাপারে আপনাদের ভাবতে হবে না মিঃ মুর্শেদ আপনি ইচ্ছামত পুলিশ ফোর্স পাবেন।
মিঃ মুর্শেদ বললেন আবার স্যার হারছড়া আমার কাছে আছে এ কথা যেন…..
ঠিক আছে এ কথা প্রকাশ পাবে না। বললেন মিঃ আরিফ।
এবার সবাই বিদায় গ্রহণ করার জন্য উঠে পড়লেন।
মিঃ ফরিদ বললেন–মিঃ মুর্শেদ আপনার বাসার ওদিক হয়েই আমাকে যেতে হবে, আমার। গাড়ীটা নষ্ট ছিলো কিনা তাই আপনার গাড়িতে…..
বলে উঠলেন মিঃ মুর্শেদ অত্যন্ত ভাল কথা। চলুন আমার গাড়িতেই আপনাকে পৌঁছে দেবো।
সেদিনের মত সবাই বিদায় গ্রহণ করলেন।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছেন মিঃ মুর্শেদ এবং মিঃ ফরিদ সাহেব।
ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে চলছে।
কান্দাই রাজপথ বেয়ে ছুটে চলেছে গাড়িখানা।
মিঃ ফরিদ বললেন–দস্যু বনহুরের আশঙ্কায় সদা আতঙ্কগ্রস্থ থাকতে হয়। কি যে এক মহাসমস্যা শুরু হয়েছে।
হাঁ মিঃ ফরিদ আপনার কথা অত্যন্ত সত্য। শুধু আজই নয় কয়েক বছর হলো দুর্দান্ত দস্যু কান্দাই শহরকে প্রকম্পিত করে তুলেছে। পুলিশমহল তো নাজেহাল হয়ে পড়েছিলো। কোন পুলিশ অফিসার তাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়নি।
মিঃ ফরিদ বললেন–শুনেছি, একবার নাকি দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হয়েছিলো?
একবার নয় দু’বার তাকে কান্দাই পুলিশ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছিলো।
অবাক হয়ে বললেন মিঃ ফরিদ–দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার হয়েছিলো?
হাঁ মিঃ ফরিদ কিন্তু তাকে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। এমন কি হাঙ্গেরী কারাগার তাকে আটকে রাখতে পারেনি।
আশ্চর্য!
শুধু আশ্চর্যই নয় মিঃ ফরিদ এই দুর্দান্ত দস্যু পৃথিবীর এক চরম বিস্ময়। শোনা যায় দস্যু বনহুর সুপুরুষ। তার দেহে অসীম বল, একসঙ্গে বিশজন জোয়ানকে সে নাকি কাবু করে ফেলতে পারে রিক্ত হস্তে।
তাই নাকি? আমি কিন্তু দস্যু বনহুর সম্বন্ধে এতো কিছু অবগত নই মিঃ মুর্শেদ।
তা বাইরে যারা থাকেন তারা তো সব খবর রাখতে পারেন না, রাখা সম্ভবও নয়। তবে দস্যু বনহুরের বিস্ময়কর কৃত্তিকলাপ সম্বন্ধে কান্দাই অধিবাসী এবং আশে-পাশের দেশগুলোর প্রায় ব্যক্তিই অবগত আছেন।
হয়তো আমি তেমন করে খেয়াল করিনি, এটাই আমার দস্যু বনহুর সম্বন্ধে ব্যর্থতার পরিচয়। তবে আমি দস্যু বনহুর সম্বন্ধে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হয় পুলিশ মহলের বোকামির জন্যই ‘ এতোদিন দস্যু বনহুর সচ্ছন্ধে তার কাজ চালিয়ে চলেছে।
অবাক কণ্ঠে বললেন মিঃ মুর্শেদ–বলেন কি মিঃ ফরিদ পুলিশ-মহলের ব্যর্থতা
তা না হলে দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার পরও তাকে পুলিশ মহল আটক রাখতে পারেননি। হাঙ্গেরী কারাগারও ব্যর্থ হয়েছে—
আপনি জানেন না মিঃ ফরিদ তাই দস্যু বনহুর সম্বন্ধে এমন তাচ্ছিল্যভরে কথা বলছেন। যদি একবার…..
মিঃ মুর্শেদের কথার মাঝখানে মিঃ ফরিদ হঠাৎ হেসে উঠলো অদ্ভুত ভাবে, তারপর বললো–তার পাল্লায় পড়তাম তাহলে বুঝতে পারতাম দস্যু বনহুর কেমন, তাই না?
হাঁ, আপনার দিব্য দৃষ্টি খুলে যেতো।
এ কথা সে কথার মাধ্যমে সি, আই, ডি, পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ মুর্শেদ এবং মিঃ ফরিদ পৌঁছে গেলেন নিজ নিজ গন্তব্য স্থানে।
মিঃ মুশেদ পৌঁছার পূর্বেই মিঃ ফরিদের গন্তব্য স্থান এসে পড়ায় মিঃ ফরিদ নেমে গেলেন।
ড্রাইভার পুনঃ গাড়িতে স্টার্ট দিলো।
মিঃ মুর্শেদ তার বাসায় পৌঁছে নামতে যাবেন এমন সময় পাশের আসনে একখানা ভাঁজ করা কাগজের টুকরা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি হাতে উঠিয়ে নিলেন। কাগজের টুকরাখানা মেলে ধরতেই দু’চোখ তার গোলাকার হয়ে উঠলো, কাগজের টুকরায় লেখা আছে–
মিঃ মুর্শেদ আপনি দস্যু বনহু গ্রেপ্তারের ভার গ্রহণ করে পুলিশ সুপারকে আশ্বস্ত করছেন এজন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
হার-ছড়া সাবধানে রেখে কাজ করবেন। কারণ হার-ছড়া অত্যন্ত মূল্যবান। একমাত্র দস্যু বনহুরকে যে প্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে সেই ঐ হার পাবার যোগ্য।
– দস্যু বনহুর
কাগজের টুকরায় লাইনগুলোর উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে মিঃ মুর্শেদ চিৎকার করে উঠলেন– দস্যু বনহুর আমার গাড়িতে……
ড্রাইভার ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন– স্যার দস্যু বনহুর! কোথায় সে?
গাড়ীর মধ্যে এতক্ষণ যে আমার পাশে বসেছিলো সে মিঃ ফরিদ সাহেব নন স্বয়ং দস্যু বনহুর।
ড্রাইভারের গলা যেন শুকিয়ে গেছে, দু’চোখ কপালে উঠেছে নির্বাক বধিরের মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে মিঃ মুর্শেদের দিকে।
মিঃ মুর্শেদ কাগজখানা হাতে নিয়ে ছুটলেন নিজ হল ঘরের দিকে। দ্রুত রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিয়ে পুলিশ সুপার মিঃ আরিফের অফিস রুমে ফোন করলেন– হ্যালো, হ্যালো স্যার আমি মিঃ মুর্শেদ বলছি……
ওপাশ থেকে ভেসে আসে পুলিশ সুপার মিঃ আরিফের গলা– মিঃ মুর্শেদ ব্যাপার কি?
মিঃ মুর্শেদের ব্যস্ত কণ্ঠ স্বর– স্যার…..স্যার আমার গাড়ি……আমার গাড়িতেই…..দস্যু বনহুর…..
মিঃ আরিফের আশ্চর্যপূর্ণ উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শোনা যায় কি বললেন? আপনার গাড়িতে……দস্যু বনহুর…..
হাঁ…..হাঁ স্যার…..মিঃ ফরিদবেশে যিনি পুলিশ অফিস হতে…..আমার গাড়িতে…..এলেন…..তিনি……তিনিই….
…… তিনিই দস্যু বনহুর?……
…… হা হা স্যার…….
…… বলেন কি……।
স্যার এক্ষুণি পুলিশ-ফোর্স সহ চলে আসুন। …… স্যার এক মিনিট বিলম্ব….করবেন না…..দস্যু বনহুর সাইরেন রোডে ১১নং বাড়িতে……সে নেমে গেছে……এই পনেরো মিনিট পূর্বে সে আমার গাড়ি থেকে নেমে গেছে। ……যাবার সময় সে একখানা চিঠি রেখে। গেছে……তাতেই সে নিজের নাম লিখে রেখে গেছে……
পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন, তিনি নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার বন্ধু মিঃ ফরিদের বেশে দস্যু বনহুর একটু পূর্বে বসেছিলো তার পাশের চেয়ারে! এ যেন তার কল্পনার বাইরে।
মিঃ আরিফ মুহূর্ত বিলম্ব না করে পুলিশ অফিসে ফোন করলেন।
কেবল মাত্র মিঃ ইয়াসিন এবং অন্যান্য পুলিশ অফিসারদ্বয় পুলিশ অফিসে ফিরে এসেছেন।
মিঃ ইয়াসিন রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিতেই মিঃ আরিফের ব্যস্ত সমস্ত কণ্ঠ শুনতে পান। ব্যাপার শুনে মিঃ ইয়াসিন এবং পুলিশ অফিসারগণ বিস্ময়ে যেন আরষ্ট হয়ে পড়েন। দস্যু বনহুর প্রেপ্তার ব্যাপার নিয়েই তখন পুলিশ সুপারের অফিসে গোপন আলাপ-আলোচনা চলছিলো, সেই মুহূর্তে তাদের পাশে উপবিষ্ট ছিলো স্বয়ং দস্যু বনহুর এ যেন এক ভয়ঙ্কর বিস্ময়। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা বের হয় না।
মিঃ ইয়াসিনের চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে অল্পক্ষণ পূর্বে মিঃ ফরিদের দাড়ি-গোঁফে ঢাকা মুখখানার কথা। পুলিশ সুপারের বাল্য বন্ধু মিঃ ফরিদ, কাজেই তাদের সন্দেহের কোন কারণ। ছিলো না। তাছাড়া পুলিশ সুপার নিজে যাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের পাশের আসনে বসালেন তাকে নিয়ে অন্য অফিসার মাথা ঘামাতে পারেন না।
কিন্তু এখন ভাববার সময় নেই তাকে এই মুহূর্তে পুলিশ ফোর্স নিয়ে যেতে হচ্ছে সাইরোন রোডের ১১নং বাড়িতে। মিঃ ইয়াসিন তবু মন থেকে ভাবনা দূর করতে পারলেন না। দস্যু বনহুর একবার নয় কয়েকবার এসেছে তার সম্মুখে কিন্তু তার আসলরূপ এখনও দেখেন নি তিনি। একদিন গভীর রাতে প্রথম যে দিন দস্যু বনহুর তাঁর বিশ্রামকক্ষে আচমকা আর্বিভাব হয়েছিলো সেদিনও বনহুরের মুখমণ্ডলের নিচের সম্পূর্ণ অংশ ঢাকা ছিলো কালো আবরণে। দ্বিতীয়বার ও তার। মুখমণ্ডল আচ্ছাদিত ছিলো পূর্বের মতই। মিঃ ইয়াসিনের সম্মুখে দস্যু বনহুর কয়েকবার আবির্ভূত হয়েছে বটে কিন্তু তার আসল রূপ কেমন জানে না তিনি আজও।
মিঃ ইয়াসিন বিলম্ব করার সুযোগ পেলেন না, তিনি পুলিশ ফোর্স নিয়ে তখনই মিঃ মুর্শেদের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী রওনা দিলেন।
ততক্ষণে মিঃ মুর্শেদও তার সহকারী মিঃ জামানসহ এসে পড়েছেন– যে বাড়ির গেটে কিছু পূর্বে দস্যু বনহুরকে নামিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
পুলিশ-ফোর্স পৌঁছে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িখানাকে ঘিরে ফেলার নির্দেশ দিলেন মিঃ মুর্শেদ।
সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ-ফোর্স বাড়িখানাকে ঘেড়াও করে ফেললো মিঃ মুর্শেদ স্বয়ং পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ, মিঃ ইয়াসিন গুলিভরা পিস্তল হাতে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলেন।
হল ঘরে প্রবেশ করতেই বাড়ির মালিক প্রৌঢ় ভূপতিনাথ হা হা করে উঠলেন– আপনারা কি চান? আপনারা কি চান? ভূপতিনাথের চোখে মুখে রাজ্যের ভীতি আর বিস্ময়। হঠাৎ পুলিশ অফিসারগণ পিস্তল হাতে তার বাড়িতে কেনো।
মিঃ মুর্শেদ সর্বাগ্রে, তিনি বললেন–খবরদার একচুল নড়বেন না।
মিঃ আরিফ তার বুকের কাছে পিস্তল বাড়িয়ে ধরে বললেন– জানেন কেন এসেছি, তবু কেনো নেকামি করছেন? বলুন দস্যু বনহুর কোথায়?
দস্যু বনহুর! ভূপতিনাথ যেন ভূত দেখার মতই চমকে উঠলেন। আবার বললেন ভূপতিনাথ দস্যু বনহুর– কোথায় দস্যু বনহুর?
বললেন মুর্শেদ আহম্মদ আপনার বাড়ির মধ্যে সে আছে।
অবাক কণ্ঠে বললেন ভূপতিনাথ– আমার বাড়ির মধ্যে সে আছে বলেননি! দস্যু বনহুর আমার বাড়ীতে…..
পুলিশ সুপার কয়েকজন পুলিশকে বাড়ির ভিতরে অনুসন্ধান করে দেখার জন্য নির্দেশ দিলেন।
মিঃ মুর্শেদ এবং মিঃ ইয়াসিন ভূপতিনাথকে কড়া পাহারায় রেখে মিঃ আরিফ নিজে পুলিশসহ বাড়ীখানাকে তন্ন তন্ন করে অনুসন্ধান করলেন। কিন্তু কোথাও দস্যু বনহুরকে খুঁজে পাওয়া গেলো না।
মিঃ আরিফ অন্যান্য পুলিশ সহ ফিরে এলেন হল ঘরে, রাগে ক্ষোভে গস গস করছেন তিনি। হল ঘরে প্রবেশ করেই ভূপতিনাথকে লক্ষ্য করে বললেন– এই বুড়োই স্বয়ং দস্যু বনহুর। মিঃ মুর্শেদ ওর মুখের দাড়ি-গো খুলে নিন।
অবাক হয়ে তাকালেন মিঃ মুর্শেদ মিঃ আরিফের মুখের দিকে। এ সব নকল। খুলে নিন মিঃ মুর্শেদ……
পুলিশ সুপারের আদেশে মিঃ মুর্শেদ ভুপতিনাথের দাড়ি ধরে হেঁটকে টান দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আর্ত-চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ ভূপতিনাথ। উঃ মাগো, মেরে ফেলেছে…..মেরে ফেলেছে……।
মিঃ আরিফ বললেন– সব নেকামি খুব জোড়ে টেনে দেখুন……
মিঃ মুর্শেদ আবার জোরে টান দিতেই পুনরায় হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন– তোমরা আমার দাড়ি টানছো কোনো? আমি কি অপরাধ করছি তোমাদের কাছে?
ধমক দিলেন মিঃ আরিফ– তুমিই দস্যু বনহুর।
এ আপনারা কি বলছেন? আমি আমি দস্যু বনহুর?
হাঁ, তোমার ছদ্মবেশ আমার কাছে আর চলবে না। একটু পূর্বে আমারই বাল্য বন্ধু সেজে আমার অফিসে আমার পাশের আসনে বসে আমাকে খুব ধোকা দিয়েছিলে। এবার আমি তোমার দাড়ি খুলে নেব। কথা শেষ করে মিঃ আরিফ ভুপতি-নাথের দাড়ি আর গো ধরে খুব জোরে টান মারলেন।
এবার ভূপতিনাথ খামচে ধরলেন মিঃ আরিফের আস্তিন আমাকে তোমরা নেকা পেয়েছো……দাঁড়াও……বাবা মেরে ফেলেছে বাবাগো……
সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ইয়াসিন এবং মিঃ মুর্শেদ ও পুলিশগণ ভূপতিনাথের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলেন মিঃ আরিফকে।
মিঃ মুর্শেদ বললেন– স্যার, এর দাড়ি-গোঁফ নকল নয়–সম্পূর্ণ আসল।
মিঃ আরিফ নিজে পরীক্ষা করেছেন কাজেই তিনিও বুঝতে পারলেন এর দাড়ি-গোঁফ নকল নয় আসল। এবার তিনি গলার স্বর নরম করে নিয়ে বললেন- আপনার নাম কি?
থর থর করে কাঁপছিলো ভূপতিনাথ, বললো সে আমার নাম ভূপতিনাথ বাবু।
বললেন মিঃ ইয়াসিন– একটু পূর্বে আপনার বাসায় কেউ কি তবে এসেছিলো?
না, আপনারা ছাড়া আজ আমার বাসায় এ পর্যন্ত কেউ আসেনি, আমি একাই হল ঘরে বসে হিসাব-নিকাশ করছিলাম।
মিঃ মুর্শেদ বললেন– এতোবড় বাড়ি নিয়ে থাকেন অথচ বাড়ির মধ্যে কোন জন-প্রাণী নেই কেনো? আপনার পরিবার-পরিজন তারা কোথায় থাকেন?
মিঃ আরিফ বললেন- হাঁ, বলুন দেখি আপনার বাসার লোকজন সব কোথায়?
ভূপতিনাথ বললেন আমার বাসায় আমি একাই থাকি। এবং আমার এক ভৃত্য থাকে। স্ত্রী বিয়োগের পর আমি কোন দ্বার পরিগ্রহণ করি নাই। সংসারের প্রতি আমার কোন মোহ নেই। বুঝলেন? যা এবার বসুন আপনারা।
মিঃ আরিফ বললেন দেখুন আমরা পুলিশ অফিসার। আমরা এখানে বসতে আসিনি। একটু পূর্বে আপনার বাড়ির গেটে দস্যু বনহুর প্রবেশ করেছে জানতে পেরে আমরা এসেছি তাকে গ্রেপ্তার করতে।
কিন্তু দ– দস্যু-বন– হুর গেলো কোথায়? আমার বাড়ির মধ্যে আপনারা তো তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখলেন।
হাঁ, অনেক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। শুধু আপনার চাকর ছোকড়াটা……
মিঃ মুর্শেদের কথায় বললেন ভূপতিনাথ বাবু– চাকর ছোরাটা বোধ হয় বাজারে গেছে…..
হাত কচলে দরজায় এসে দাঁড়ায় চাকর ছোঁকড়া– হুজুর আমি এসে গেছি। চা আনব?
ভূপতিনাথ চোখে কম দেখেন কানেও কম শোনেন, তিনি বললেন– কে পরেশ এসেছিস্?
না, যাইনি এখনও বাজারে।
যাসনি?
্না হুজুর। চা আনবো?
হাঁ নিয়ে আয়।
চাকর পরেশ চলে গেলো।
মিঃ আরিফ, মিঃ ইয়াসিন, মিঃ মুর্শেদ আসন গ্রহণ করেছেন।
ভূপতিনাথও বসে পড়েছেন মাঝখানের আসনে, তার সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে চপসে গেছে। একেবারে। মিঃ ইয়াসিন উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পীড় বাড়ীয়ে দিয়ে ফিরে এলেন।
একটু পরে চাকর চা নিয়ে ফিরে এলো। মাঝের টেবিলে চা সাজিয়ে রেখে বললো চাকর চা খেয়ে নিন স্যার।
ভূপতিনাথ চাকরের দিকে তাকালেন, চোখে তো তিনি ভাল দেখেন না, তবু ওকে লক্ষ্য করে বললেন–অতিথি এসেছেন, শুধু চা এনেছিস?
হাত কচলে বলে চাকর–হুজুর তাড়াহুড়ো করে…..
মিঃ আরিফ বললেন–ঠিক্ আছে, চা-তেই চলবে।
দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারের আসা ত্যাগ করে আরিফ সাহেব এবং পুলিশ অফিসারদ্বয় চায়ের কাপ হাতে উঠিয়ে নিলেন।
চাকর তখনও পাশে দাঁড়িয়ে।
চোখে-মুখে কালির ছাপ, মাথায় গামছা জড়ানো। একটা ময়লা লুঙ্গী পরা। গায়ের গেঞ্জিটাও ময়লা তেলচিটে, এখানে সেখানে কালি মাখা।
মিঃ আরিফ, মিঃ ইয়াসিন মিঃ মুর্শেদ চায়ের কাপে চুমুক দিতেই এক সঙ্গে থু থু করে উঠলেন চা তো নয় যেন লবণের গরম সরবত।
ভূপতিনাথ বাবু নিজেও ফুঃ করে সম্মুখে ছুঁড়ে ফেললেন মুখের চাগুলো, ঢোক গিলে বললেন–শয়তান এ সব কি চা তৈরি করেছিসলবণ–মরিচের গুড়ো দিয়ে….
ঠিক সেই মুহূর্তে দু’জন পুলিশ একটা ছোঁকড়াকে পাকড়াও করে আনে। ছোঁড়ার হাতে বাজারের থলে। ছোঁকড়াটা হাউমাউ করে কাঁদছে।
ভূপতিনাথ এবং পুলিশ অফিসারগণ অবাক হয়ে তাকান পুলিশ এবং থলে হাতে ছোঁকড়াটার দিকে।
পুলিশ দু’জনার একজন বলে উঠলো–স্যার এই লোকটা বাসার ভিতরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো। আমরা বাধা দিলে বলে আমি এই বাসার চাকর বাজারে গিয়েছিলাম বাজার করতে। স্যার আমরা ওকে পাকরাও করে এনেছি।
ভূপতিনাথ চোখের চশমটা ভালভাবে নাকের উপর তুলে দিয়ে তাকালো চাকরটার দিকে আরে পরেশ যে, চা তৈরি করে বাইরে গিয়েছিলি কখন?
পরেশ কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো–হুজুর আমি তো বাজারে গিয়েছিলাম, এই মাত্র ফিরছি। চা-তো তৈরি করিনি।
মিঃ আরিফ, মিঃ ইয়াসিন, মিঃ মুর্শেদ এঁরা তো একেবারে হাবা বনে গেছেন, একটু পূর্বে যে লোকটা তাদের সম্মুখে চা রেখে গেলো সে তো এ নয়।
বললেন মিঃ আরিফ-ভূপতিনাথ বাবু এটাই কি আপনার বাসার একমাত্র চাকর পরেশ?
হাঁ এই আমার একমাত্র চাকর পরেশ, খুব ভাল বিশ্বাসী বলেই আমি……….
কিন্তু একটু পূর্বে যে লোকটাকে আপনি পরেশ বলে চা তৈরির আদেশ দিলেন সে কে?
আমিও তো তাই ভাবছি……….কে সে?
মিঃ আরিফ তখন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, চিৎকার করে বললেন–আপনি আমাদের খোকা দিয়েছেন? এরেস্ট করো তোমরা ভূপতি বাবুকে। সব চালাকী এর। মিঃ ইয়াসিন আপনি দেখুন ঐ লোকটা কোথায় গেলো? নিশ্চয়ই সে দস্যু বনহুর…
ঠিক সেই সময় বাইরের গেটে মোটর স্টার্টের শব্দ শোনা যায়।
পুলিশ সুপার হুঙ্কার ছাড়েন–দেখো গাড়ি নিয়ে ঠিক পালালো বুঝি……….
দু’জন পুলিশ হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে। ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠে একজন–স্যার চাকরটা গাড়ী নিয়ে পালিয়েছে।
এক সঙ্গে পুলিশ অফিসারয় ছুটলেন বাইরের গেটের দিকে।
মিঃ আরিফ চিৎকার করে বললেন মিঃ ইয়াসিন পুলিশ ফোর্স নিয়ে পিছা করুন। দস্যু বনহুর আমাদের জীপ্ নিয়ে ভেগেছে। পুলিশ ভ্যান নিয়ে পিছা করুন।
পুলিশ সুপার এবং মিঃ ইয়াসিন পুলিশ-ফোর্স সহ পুলিশ ভ্যানে চেপে বসলেন। গাড়ী সম্মুখের জীপটাকে লক্ষ্য করে উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।
মিঃ আরিফ হাতের পিস্তল সম্মুখে উদ্যত করে রাখলেন। তিনি ঠিক ড্রাইভারের পাশের আসনে বসেছেন।
পুলিশ-ফোর্স প্রত্যেকে সম্মুখস্থ জীপ লক্ষ্য করে রাইফেল উদ্যত করে ধরে আছে, নাগালের মধ্যে এলেই গুলি ছুড়বে তারা।
সম্মুখের গাড়িখানা তীর বেগে ছুটছে।
গাড়ীখানা যে দস্যু বনহুর স্বয়ং চালাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পুলিশ ভ্যানের দক্ষ পুলিশ ড্রাইভারও হার মেনে যাচ্ছে অগ্রগামী গাড়িখানার কাছে।
সম্মুখের জীপখানা অল্পক্ষণে বেরিয়ে এলো জনমুখর পথ ত্যাগ করে নির্জন পথে। এ পথ সে পথ করে গাড়ী দু’খানা তীরবেগে ছুটছে।
কান্দাই পর্বত অভিমুখে সম্মুখ গাড়িখানা অগ্রসর হচ্ছে।
পিছনে পুলিশ ভ্যান যমদূতের মত এগিয়ে চলেছে।
মাঝে মাঝে ভ্যান থেকে ফায়ার হচ্ছিলো আগের জীপখানা লক্ষ্য করে। কিন্তু নাগালের মধ্যে গাড়ীখানা না থাকায় রাইফেলের গুলি ব্যর্থ হচ্ছিলো।
ঘণ্টা কয়েক কেটে যায়।
দু’খানা গাড়ী যেন রকেটের মত পর পর ছুটে চলেছে।
কান্দাই পর্বতের পাদমূল ধরে অগ্রসর হচ্ছে সম্মুখ গাড়িটা। উঁচুনীচু মেঠো পথ, গাড়িটা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে এগুচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে সম্মুখ গাড়ীখানা কান্দাই পর্বতের গা বেয়ে সঙ্কীর্ণ পথ ধরে উপরে উঠতে লাগলো।
পিছনের গাড়িখানাও ফলো করলো সনুক গাড়ীখানাকে।
পর্বতের গা বেয়ে পথটা উঠে গেছে উপরের দিকে, কখনও বা পর্বতের গা বেয়ে নেমে এসেছে কিছুটা নিচের দিকে। আঁকাবাঁকা পাথুরে পথ, এক পাশে সুউচ্চ কান্দাই পর্বত আর এক পাশে গভীর খাদ। একটু যদি গাড়ি চালনায় ভুল হয় বা গাড়ির কোন মেসিন নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সর্বনাশ হবে। গাড়িখানা পর্বতের নিচে পড়ে গিয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে।
এখন গাড়ি দুটো পৃথিবীর মাটি ছেড়ে প্রায় হাজার ফিট উপরে উঠে গেছে। পুলিশ ভ্যানের আরোহীগণের প্রত্যেকের মুখমণ্ডল লালে লাল হয়ে উঠেছে। মাথার উপরে প্রখর সূর্যের তাপ অগ্নি বর্ষণ করছে। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী। মিঃ আরিফ এবং মিঃ ইয়াসিনের মুখমণ্ডল রক্তাভ লাগছে। রাগে ক্ষোভে অধর দংশন করছেন মিঃ আরিফ।
সম্মুখ গাড়িখানা পর্বতের গায়ে একটা বাঁকে অদৃশ্য হলো। পিছনের গাড়িখানা দ্রুত এসে পড়লো বাকের মুখে।
মিঃ আরিফ বললেন–ড্রাইভার সম্মুখের গাড়িখানাকে কিছুতেই দৃষ্টির আড়াল হতে দেবেন না।
ড্রাইভার বললো–স্যার আমি প্রাণপণে চেষ্টা করছি, কিন্তু আশ্চর্য সম্মুখ গাড়িখানাকে কিছুতেই সীমার মধ্যে আনতে সক্ষম হচ্ছিনা।
মিঃ ইয়াসিন বললেন–গাড়িখানা যেভাবে ছুটছে যে কোন মুহূর্তে এক্সিডেন্ট হওয়া স্বাভাবিক।
মিঃ আরিফ বললেন–আমাদের গাড়িখানাও যে কোন সময় পর্বতের নিচে পড়ে চূর্ণ হয়ে যেতে পারে। ড্রাইভার সাবধানে গাড়ি চালাবে।
ড্রাইভার বললো–সে জন্য আমি এতক্ষণ———
কথা শেষ হয় না ড্রাইভারের সম্মুখের গাড়িখানা পর্বতের গায়ে আচম্কা ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়ে যায় একেবারে হাজার ফিট নিচে। গভীর একটা খাদের মধ্যে গাড়িখানা পড়ে গিয়ে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেলো।
মিঃ আরিফ আনন্দধ্বনি করে উঠলেন–দস্যু বনহুর আজ নিঃশেষ হয়ে গেলো।
মিঃ ইয়াসিনের মুখখানা কেমন যেন ভাব-গম্ভীর হয়ে উঠেছে, তিনি বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–শেষ পরিণতি এই ছিলো।
পুলিশ-ফোর্স যার যার উদ্যত রাইফেল নত করে নিয়েছে।
পুলিশ ভ্যানখানা এসে থামলো একেবারে সেই জায়গায় যেখানে পর্বতের গায়ে টক্কর খেয়ে দস্যু বনহুরের জীপখানা হাজার ফিট নিচে পাথরের খাদে পড়ে গুড়ো হয়ে গেছে।
মিঃ আরিফ গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন।
মিঃ ইয়াসিনও নামলেন।
অন্যান্য পুলিশ-ফোর্স পর্বতের গায়ে সরু পথটার উপরে নেমে দাঁড়িয়েছে। সবাই ঝুঁকে দেখছে নীচে গড়িয়ে পড়া গাড়িখানার নির্মম অবস্থা।
গভীর খাদের মধ্য হতে একটা ধূম্ররাশি কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরের দিকে উঠে আসছিলো। সবাই বুঝতে পারলো গাড়ি খানাতে আগুন ধরে গেছে।
মিঃ আরিফ এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, বললেন বিশ্ব বিখ্যাত দস্যু বনহুর আজ চিরতরে নিঃশেষ হলো।
মনিরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে স্বয়ং দস্যু বনহুর। চোখে-মুখে তার উজ্জল হাসির উচ্ছ্বাস, স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে সে স্ত্রীর মুখের দিকে।
মনিরা স্বামীর চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, মুখোভাব ঠিক্ আনন্দ-দীপ্ত না হলেও মনের গহনে যে একটা অনাবিল শান্তির উৎস বয়ে চলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। স্বামীকে নিবিড় করে পাওয়া যে তার চরম ভাগ্য।
বনহুরের হাতে একটি পত্রিকা।
চোখের সম্মুখে বনহুর মেলে ধরলো পত্রিকাখানা। তারপর পড়তে লাগলো–কান্দাই পর্বত হতে এক হাজার ফিট নিচে পড়ে গিয়ে দস্যু বনহুরের মর্মান্তিক মৃত্যু।……………..
মনিরা স্বামীর মুখে হাত চাপা দেয়–চুপ করো, আর আমি শুনতে চাই না। চুপ করো—
বনহুর পত্রিকাখানা পাশে রেখে সোজা হয়ে উঠে বসলো, মনিরার চোখে চোখ রেখে বললো–মনিরা দস্যু বনহুর কাল কান্দাই পর্বতের গভীর খাদে পড়ে চিরদিনের জন্য নিঃশেষ হয়ে গেছে–
আবার তুমি ঐ কথা শুরু করলে?
শুনতে চাও না কি করে এই নির্মম মৃত্যু থেকে বেঁচে গেলাম? সে এক অদ্ভুত ব্যাপার।
তোমার সবই তো অদ্ভুত; কোনটা অদ্ভুত নয় বলো?
হাঁ, কি বলছিলাম?
বলছিলে, পুলিশ যখন ভূপতিনাথ বাবুর বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো তখন তুমি..
হাঁ এবার মনে পড়েছে তখন আমি রান্না ঘরে প্রবেশ করে চাকরের জামা-কাপড়গুলো পরে নিচ্ছিলাম, ভাগ্যিস তখন চাকরটা বাসায় ছিলো না। হল ঘর থেকে হুকুম এলো চা তৈরির, কি করবো চা তৈরি করে নিয়ে গেলাম হুজুরদের সামনে।
অবাক কণ্ঠে বললো মনিরা–চা তৈরি করতে পারলে তুমি?
কি যে বলো সামান্য কয়েক কাপ চা, তাই তৈরি করতে পারবো না? উনোনে আগুন ধরানোই ছিলো, দেখলাম ওপাশে একটা ডেকচি? চায়ের না তরকারীর?
তা কেমন করে বলবো। দেখলাম উনোনের ওপাশে একটা ডেকচি কাৎ হয়ে পড়ে আছে, বোধ হয় তরকারীর ডেকচিই হবে। আমি সেটাতে পানি বসিয়ে দিলাম…..
তারপর কি করলে শুনি?
পানি গরম হলে, পাশেই একটা কৌটা দেখলাম সেটা খুলে খানিকটা গুড়ো ঢেলে দিলাম ডেচিটার মধ্যে।
সেটা চায়ের গুড়ো ছিলো?
কি জানি কেমন করে বলবো, লালের মত দেখলাম গুড়োগুলো।
সর্বনাশ ঠিক্ মরিচের গুড়ো ছিলো ওটাতে।
তা হতে পারে। কাপগুলো ওপাশেই ছিলো কাপে সেই পানিগুলো ঢেলে পাশের বয়াম থেকে চিনি বের করে মিশিয়ে নিলাম……….
বয়াম! বয়ামে চিনি? ঠিক লবণ ছিলো বয়ামে।
হয়তো তাই হবে, দেখলাম দানাগুলো বেশ মোটা…..
ছিঃ ছিঃ ছিঃ শেষ পর্যন্ত চা তৈরি করতে গিয়ে ঝাল পানি তৈরি করেছিলে?
বুঝেছি সে জন্যই ধরা পড়ে গিয়েছিলে।
উঁহু মোটেই না। চা তৈরি ব্যাপারে কিছু ঘটেনি, যত সব বিভ্রাট ঘটেছে। বেটা চাকর ছোরাটা হঠাৎ বাজার থেকে ফিরে আসায়।
আর তুমি উধাও হলে?
ইচ্ছা করলে উধাও হতে পারতাম কিন্তু পুলিশকে একটু……..।
বুঝেছি নাজেহাল করাই ছিলো তোমার উদ্দেশ্য।
হাঁ মনিরা, কারণ অযথা পুলিশ আমাকে নিয়ে এমন মাথা ঘামায় কেন। যেদিকে তাদের খেয়াল রাখা দরকার সেদিকে খেয়াল না রেখে আলেয়ার পিছনে ছুটে মরে ওরা। তাই একটু
তামাসা করলে তাই না?
কতকটা তাই। পুলিশের ভ্যানের পাশেই ছিলো পুলিশ সুপারের জীপখানা। চাকরের ড্রেসে অতি সচ্ছন্দে বেরিয়ে এলাম বাড়িটার বাইরে তারপর চেপে বসলাম গাড়িতে। পুলিশ সুপারকে অবগতির জন্য হর্ন দিলাম।
আশ্চর্য মানুষ তুমি?
আশ্চর্য নয় মনিরা অদ্ভুত বল।
হাঁ তাই। বলো তারপর কি করলে?
এমন সময় নূর এসে পড়ে সেখানে–আব্বু তুমি আম্মিকে গল্প শোনাচ্ছো?
মনিরা বললো–তুমি যাওতো বাবা, বাইরে খেলোগে।
না আমিও গল্প শুনবো।
বনহুর পুত্রকে টেনে নিলো কোলের মধ্যে–আচ্ছা বলছি শোন।
মনিরা অবাক হয়ে তাকালো স্বামীর মুখের দিকে। নূরের কাছে সে কি সব কথা বলে ফেলবে তাহলে।
বনহুর তখন বলতে শুরু করে দিয়েছে–দস্যুটা গাড়িতে স্টার্ট দিতেই ছুটে বেরিয়ে এলো পুলিশ সুপার দলবল নিয়ে।
নূর বলে উঠলো–দস্যু, কোন দস্যু আব্বু?
বনহুর মাথা চুলকালো।
ততক্ষণে বলে উঠলো নূর-দস্যু বনহুর বুঝি?
মনিরা পুত্রের প্রতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।
বনহুর স্ত্রীর চোখে চোখ রেখে ইশারা করে তাকে চুপ থাকতে বললো।
নূর পুনরায় প্রশ্ন করলো-আব্বু বনহুরকে তুমি দেখেছো?
বনহুর মুখভাবে ভীতিময় চিহ্ন এঁকে বললো–ওরে বাবা দস্যু বনহুরকে দেখলে আমি মরেই যাবো ভয়ে। লোকের মুখে শুনেছি……….
দেখোনি তা হলে?
না আব্বু না আমি দস্যু বনহুরকে মোটেই দেখিনি। কথাটা বলে একবার মনিরার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে বনহুর।
মনিরা ক্রুদ্ধ হবার ভান করে বলে মিথ্যা বলতে একটুও বাধে না তোমার?
নূরকে অন্যমনস্ক করার জন্য বলে বনহুর-নূর তুমি শোন, হাঁ কি বলছিলাম?
নূর বলে উঠে–দস্যুটা গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলো অমনি বেরিয়ে এলো পুলিশ সুপার দলবল নিয়ে।
ওহ এবার মনে পড়েছে। দস্যুটা গাড়ী নিয়ে ছুটলো, পুলিশ সুপার পুলিশ-ফোর্স নিয়ে ছুটলো দস্যুর গাড়িখানার পিছনে। দস্যু বনহুর ইচ্ছা করলে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে শহরের জনমুখর রাজপথের অগণিত যানবাহনের মধ্যে অন্তর্ধান হতে পারতো। কিন্তু সে তা না করে পুলিশ-ফোর্স এবং অফিসারগণকে নাকানি-চুবানি খাওয়ানোর জন্য বড় সখ হলো তার।
মনিরা আর বনহুর আবার দৃষ্টি-বিনিময় হলো। মনিরার চোখে মুখে রাগ অভিমান ঝরে পড়ছে। পুত্রের সম্মুখে কিছু বলতেও পারছে না সে।
বনহুর নূরকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো আর কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো, মাঝে মাঝে সিগারেট থেকে ধুম্ররাশি উদগীরণ করছিলো সে।
নূর পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিস্পলক নয়নে। কথাগুলো সে অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছিলো। দস্যু বনহুরের কথা এটা কম ব্যাপার নয়। সাংঘাতিক সংবাদ যেন শুনছে নূর। বনহুর একটু থামতেই বলে উঠে নূর–বললো না আবু তারপর কি হলো?
বনহুর সমস্ত ঘটনা বললো।
দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে শুনছিলো নূর।
মনিরাও কম আশ্চর্য হয়নি, স্বামীর দুঃসাহসপূর্ণ কার্যকলাপ তাকে একেবারে বিস্ময়াহত করে তোলে।
বনহুর বলে চলেছে–পর্বতের গা বেয়ে যখন দস্যু বনহুরের গাড়িখানা এগুচ্ছিলো তখন মাত্র কয়েক গজ দূরে ছিলো পুলিশ ভ্যান। ভ্যানের উপরে গুলি ভরা রাইফেল উদ্যত করে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ-ফোর্স।
হঠাৎ বলে উঠলো নুর–আমি হলে এক গুলি মেরে দস্যু বনহুরকে খতম করে দিতাম।
পুত্রের কথায় হঠাৎ মনিরা রাগ চেপে রাখতে পারলো না। ঠাই করে একটা চড় বসিয়ে দিলো সে নূরের গালে।
বনহুর সঙ্গে সঙ্গে নূরকে টেনে নিলো বুকের মধ্যে, বললো–একি করলে মনিরা?
ঠিক করেছি–
নূর কাঁদতে গিয়ে পিতার বুকে মুখ গুঁজে নিজকে সংযত করে নিলো, সে ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ তার আম্মা তাকে এমন করে মারলো কেন। সেতো কোনো অপরাধ করেনি। দস্যু বনহুরকে গুলি করে খতম করে দিতো এইতো বলেছে মাত্র।
বনহুর বললো–নূর লক্ষী আব্বু আমার, তুমি কেঁদো না। দস্যু বনহুরকে খতম করবে না তো কি তাকে আদর করবে তুমি? ঠিক বলেছো নূর একেবারে খাঁটি কথা বলেছে। হাঁ তারপর কি বলছিলাম শোন?
নূর পিতার আদরভরা কণ্ঠে মায়ের চড়ের কথা ভুলে গেলো, তাকালো সে বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর স্নেহমাখা কন্ঠে বললো–বড় হও তারপর দস্যু বনহুরকে পাকরাও করো……….।
মনিরা স্বামীর মুখে হাত চাপা দিলো–থা আর বলতে হবে না।
বনহুর স্ত্রীর হাতখানা মুঠায় চেপে ধরলো–দস্যু বনহুরের প্রতি তোমার এতো দরদ কেন শুনি?
মনিরা বললো–যাও আর নেকামি করতে হবে না। বলল দস্যুটা কি করলো তারপর?
ও তাহলে শুনবে তুমি? আচ্ছা বলছি–সম্মুখে কয়েক গজ দূরে দস্যু বনহুরের জীপ আর পিছনে উদ্যত রাইফেল হস্তে পুলিশ-ফোর্স সহ পুলিশ ভ্যান। দু’খানা গাড়ি এমন জায়গায় এসে পড়েছে যেখানে প্রতি মুহূর্তে রয়েছে মৃত্যুর আশঙখা। এক পাশে সুউচ্চ পর্বতমালা অন্যপাশে বিরাট খাদ। একটু ভুল হলে হাজার ফিট নিচে পড়ে গাড়িখানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। এই মৃত্যু ভয়াল পথ বেয়ে গাড়ি দু’খানা তীর বেগে ছুটে চলেছে পর্বতের গা বেয়ে উঁচু-নীচু পথ, পাথরে হোঁচট খেয়ে খেয়ে ছুটছিলো গাড়ি দুখানা। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে সম্মুখের গাড়িখানা ছিটকে পড়ে গেলো একেবারে হাজার ফিট নিচে।
নূর চমকে উঠলো, দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে বললো–দস্যু বনহুরের গাড়িখানা পড়ে গেলো আব্বু?
হাঁ দস্যু বনহুরের গাড়িখানা পড়ে গেলো নিচে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িখানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো, আগুন ধরে গেলো গাড়িখানাতে।
সর্বনাশ দস্যু বনহুর তবে মরে গেলো?
হাঁ গাড়ীখানার সঙ্গে পুরে ছাই হয়ে গেলো দস্যু বনহুর……….।
নূর হাত তালি দিয়ে আনন্দধ্বনি করে উঠলো–খুব হয়েছে, বেশ হয়েছে দস্যু বনহুর মরেছে………।
মনিরা নূরকে আনন্দিত হতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো–প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতে গেলো সে নূরের গালে।
বনহুর খপ করে ধরে ফেললো মনিরার হাতখানা। গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মনিরা।
মনিরা তখন রাগে ফুলছে।
নূর হতভম্বের মত তাকিয়ে আছে পিতা এবং মাতার মুখের দিকে সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ তার উপর আম্মি রেগে গেলো কেনো।
বনহুর নূরকে আদর করে বললোর যাও তত বাপ তোমার দাদীমা কি করছেন দেখবে যাও।
নূর মনটা ভার করে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।
বনহুর এবার মনিরাকে লক্ষ্য করে বললো–মনিরা এ তোমার ভারী অন্যায়। নূরকে অমন করে মারলে কেন?
এক-শো বার মারবো। হাজার বার মারবো। তোমাকেও মারবো, আমার কাছে তোমাদের কারো রেহাই নেই……….।
বনহুর নিজের গালটা এগিয়ে দেয় মনিরার দিকে নাও নূরের বদলে আমাকে মারো।
মনিরা না হেসে পারলো না, তবু ছোট্ট একটা চড় বসিয়ে দিলো সে বনহুরের গালে।
বনহুর হেসে উঠলোমশা মারলে না আদর করলে? সন্তানের বেলায় প্রচণ্ড আঘাত আর স্বামীর বেলায় কোমল পরশ, চমৎকার।
যাও তোমার সঙ্গে কথা বলব না আর। চলে যাচ্ছিলো মনিরা।
বনহুর ওকে ধরে ফেললো খপ্ করে, টেনে নিলো নিবিড় করে। বাহু-বন্ধনে আবদ্ধ করে বললো–মনিরা কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হলাম। যখন খুশী এসে তোমাকে দেখে যেতে পারবো। মার কদমবুসী করতে পারবো। নূরকে আদর করতে পারবো। পুলিশ দস্যু বনহুরের জন্য আর। কোন পাহারার ব্যবস্থা রাখবে না। কান্দাই-পর্বতের পাদমূলে দস্যু বনহুরের মৃত্যু ঘটেছে।
আবার ঐ সব অলক্ষণে কথা? যাও তুমি বড় ইয়ে। ছেড়ে দাও আমাকে।
উ হু তা হবে না। আজ ছাড়বো না তোমাকে।
ছিঃ লক্ষীটি ছেড়ে দাও, কেউ এসে পড়বে।
যদি না ছাড়ি।
লজ্জা নেই তোমার!
লজ্জা, কিসের লজ্জা? আমি তো কোন অন্যায় করছি না। তুমি তো আমারই….
ঠিক সেই মুহূর্তে সরকার সাহেবের কণ্ঠস্বর শোনা যায়–মনিরা মা, মনিরা মা……….।
বনহুর মনিরাকে বাহুমুক্ত করে দেয়।
হাসে মনিরা–এবার হলো তো?
ততক্ষণে সরকার সাহেব কক্ষ-মধ্যে প্রবেশ করেন। বনহুরকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন। তিনি–ছোট সাহেব পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন এসেছেন।
মনিরার দু’চোখে ভীতিভাব ফুটে উঠে।
বনহুর স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে–কোথায় তিনি?
হল ঘরে বসেছেন।
চলুন আসছি। বনহুর সরকার সাহেবকে অনুসরণ করে।
মনিরা ভয়-বিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, স্বামীর অমঙ্গল আশঙ্কায় দুলে উঠে তার মন। সেও পিছু পিছু অনুসরণ করলো বনহুর আর সরকার সাহেবকে।
দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ালো।
বনহুর কক্ষে প্রবেশ করতেই মিঃ ইয়াসিন আসন ত্যাগ করে হ্যান্ডসেফ করলেন।
বনহুর এবং মিঃ ইয়াসিন এক সঙ্গে আসন গ্রহণ করলেন। সরকার সাহেব এক পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন তার মুখমণ্ডলে দুঃশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে। তিনি উৎকুণ্ঠিতভাবে প্রতিক্ষা করছেন না জানি কি বিভ্রাট ঘটবে এবার।
মিঃ ইয়াসিন বলে উঠলেন–একটা দুঃসংবাদ নিয়ে আমি এসেছি মিঃ চৌধুরী। দস্যু বনহুর কাল মৃত্যু বরণ করেছে।
এ সংবাদ আমরা পত্রিকার মাধ্যমে অবগত হয়েছি ইন্সপেক্টার। কথাগুলো বনহুর অত্যন্ত বেদনা-ভরা কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন।
মিঃ ইয়াসিনের মুখেও একটা ব্যথার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। তিনি বললেন–পুলিশের লোক হলেও আমি দস্যু বনহুরকে সমীহ করতাম। সে ছিলো দেশের একজন হিতৈষী বন্ধু। মিঃ চৌধুরী আপনার আত্মীয় ছিলো দস্যু বনহুর, এটা শুধু আপনার গর্ব নয় আপনাদের বংশের গর্ব।
পুলিশ ইন্সপেক্টারের মুখে এ ধরনের কথা শুনে সরকার সাহেব খুশি হলেন, তিনি নাস্তার জন্য ভিতরে চলে গেলেন।
মিঃ ইয়াসিন বলে চলেছেন–আমি পারলাম না থাকতে, তাই সকলের অজ্ঞাতে এসেছি। আমি আপনাদের দুঃখে দুঃখ জানাতে।
বনহুর বললো– বনহুরের প্রতি আপনার এতো হৃদয়তা ছিলো জেনে সত্যি আমি আনন্দিত। পুলিশ অফিসার হয়েও আপনি তাকে চিনতে পেরেছিলেন। তার অন্তরের কথা আপনি অনুভব করেছিলেন আপনার অন্তর দিয়ে।
*
হাঁ মিঃ চৌধুরী আমি তার আসল রূপ দেখেছিলাম। যত বড় দস্যুই সে হোক তার অন্তরের কাছে আমরা পরাজিত হয়েছি। এই পৃথিবীতে কত লোক আছে, কিন্তু ক’জন কাঁদে পরের ব্যথায়? ক’জন পরের জন্য নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিতে পারে? দস্যু বনহুরকে আমি শ্রদ্ধা করি ……তার আত্মার শান্তি কামনা করি ….. কণ্ঠ ধরে আসে মিঃ ইয়াসিনের।
বনহুরের চোখ দুটোও অশ্রু ছল ছল হয়ে উঠলো। মিঃ ইয়াসিনের আবেগ-ভরা কথাগুলো তার মনকে বিচলিত করে তুললো।
সরকার সাহেব বয়ের হাতে নাস্তার প্লেট আর চা নিয়ে হাজির হলেন।
বনহুর নিজ হাতে পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিনকে পরিবেশন করে খাওয়ালেন। তারপর, তাঁকে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো এক সময় মনিরার পাশে।
মনিরাকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর– মনিরা শুনলে তো সব?
হাঁ শুনেছি।
দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন দুঃখিত। আজ আমি আশ্বস্ত মনিরা, দস্যু বনহুরকেও মানুষ ভালবাসতে পেরেছে। সত্যি আজ আমার বড় আনন্দ হচ্ছে নিজের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে…….
মনিরা ক্রুব্ধ কণ্ঠে বললো তোমাকে আর বক্ বক্ করতে হবে না। চুপ করো, বলছি ……স্বামীর মুখে হাত চাপা দেয় মনিরা।
বনহুর মনিরাকে টেনে নেয় নিবিড়ভাবে।
মিঃ আরিফকে আজ অত্যন্ত প্রফুল্ল এবং হাস্যউজ্জ্বল লাগছে। তিনি সোফায় ঠেশ দিয়ে সিগারেট পান করেছেন।
তার পাশের সোফায় মিঃ মুর্শেদ, মিঃ হারুন, আরও কয়েকজন পুলিশ অফিসার বসে রয়েছেন। একটা সোফায় মিঃ ইয়াসিন রয়েছেন। তাকে খুব প্রফুল্ল বা আনন্দমুখর মনে হচ্ছে না। কেমন যেন একটা বেদনাভরা ভাব ফুটে উঠেছে তার চোখে মুখে।
মিঃ আরিফ সিগারেট থেকে এক মুখ ধোয়া সম্মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন- এতোদিনে কান্দাই অভিশাপ মুক্ত হলো………
মিঃ মুর্শেদ বললেন- হাঁ ঠিকই বলেছেন মিঃ আরিফ। দস্যু বনহুরের জন্য দেশবাসীর মনে শান্তি ছিলো না। সদা সর্বদা একটা উৎকণ্ঠা আর ভীতি নিয়ে কাটাতো সবাই।
মিঃ হারুন বললেন– শুধু কান্দাইবাসীগণই নয় পুলিশ মহল ও সদা উদ্বিগ্নতা নিয়ে থাকতো। কোন কাজে স্বস্তি বা শান্তি ছিলো না কারো।
অন্য একজন পুলিশ অফিসার বললেন– দস্যু বনহুর মরেছে দেশবাসী নিশ্চিন্ত হয়েছে ….
মিঃ ইয়াসিন এতোক্ষণ বসে চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন, এবার তিনি বলে উঠলেন– দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে দেশের এক শ্রেণীর ও মানুষ নিশ্চিন্ত হয়েছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। যারা দেশের রক্ত শুষে খান তারাই আশ্বস্ত এবং নিশ্চিন্ত।
মিঃ ইয়াসিনের কথায় মিঃ আরিফ খুশি হতে পারলেন না, তিনি বললেন- আপনি কি বলতে চান দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে সমস্ত কান্দাইবাসী খুশী নয়?
গম্ভীর কণ্ঠে বললেন মিঃ ইয়াসিন না! একটু থেমে পুনরায় বললেন– দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে এক শ্রেণীর লোক অত্যন্ত খুশি হয়েছে–তেমনি ব্যথিত।
একটা ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হেসে বললেন মিঃ আরিফ –এটা আপনার ভুল ধারণা মিঃ ইয়াসিন, দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে কেউ দুঃখ করতে পারে না। কারণ সে যত পরউপকারী হোক তবু সে দস্যু-শয়তান।
মিঃ ইয়াসিন বলে উঠলেন– স্যার, দস্যু সে হতে পারে কিন্তু শয়তান সে ছিলো না। কারণ অন্যায় সে করেনি কোনদিন।
আপনি এ সব কি বলেছেন মিঃ ইয়াসিন? অবাক কণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ।
মিঃ হারুন বললেন একজন দস্যুর প্রতি এতোখানি সহানুভূতিশীল হওয়া দোষণীয় স্যার।
আমার মন যা সায় দেয় আমি তাই বলি। পুলিশের চাকরি করি বলে আমি ন্যায় কথা বলবো না এ হতে পারে না। দস্যু বনহুরের মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে কথাগুলো বললেন মিঃ ইয়াসিন।
মিঃ ইয়াসিনের কথায় কক্ষ-মধ্যে সকলেই বেশ অবাক হয়ে পড়েছিলেন। একজন পুলিশ অফিসারের কণ্ঠে দস্যুর প্রতি এতো দরদ-ভরা কথা একেবারে অশোভনীয়।
মিঃ আরিফ মিঃ ইয়াসিনের প্রতি ভিতরে ভিতরে অসন্তুষ্ট হলেও মুখে কিছু বললেন না, কারণ মিঃ ইয়াসিন অত্যন্ত কাজের লোক। তিনি একজন দক্ষ পুলিশ ইন্সপেক্টার।
সেদিনের মত আলোচনা শেষ হলো।
সমস্ত কান্দাই শহরব্যাপি দস্যু বনহুরের মৃত্যু খবর ছড়িয়ে পড়লো। পত্রিকায় বের হলো দস্যু বনহুরের মৃত্যু সংবাদ নিয়ে নানা রকম বিস্ময়কর সংবাদ।
নূরী কান্দাই আস্তানায় বসে এই সংবাদ পেলো। কেঁদে কেটে আকুল হলো নূরী। রহমানও চিন্তিত হলো, সে যতদূর সম্ভব নূরীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলো।
নূরী কোন কথা শুনলো না সে নিজে রহমানসহ কান্দাই-পর্বত অভিমুখে রওনা দিলো।
সমস্ত দিন অশ্ব চালনা করে প্রায় সন্ধ্যায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলো নূরী আর রহমান কান্দাই পর্বতের পাদমূলে। অনেক সন্ধান করে খুঁজে বের করলো তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত সেই পুলিশ, জীপখানা।
রহমান আর নূরী চূর্ণ-বিচূর্ণ গাড়িখানা নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো।
একটা আশার আলো মেলে গেলো রহমান আর নূরীর মনে। রহমান বললো–নূরী আমার মন বলছে সর্দার বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই সর্দার গাড়ীখানাতে ছিলো না।
নূরী আর রহমান ফিরে এলো আস্তানায়।
এক সময় কায়েস এসে নুরীর কানে কানে কোন গোপন কথা জানালো।
নূরীর মুখ হাস্যউজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বললো সে সত্যি?
— হাঁ, সত্যি! বললো কায়েস।
কায়েস কি বললো নূরীর কানে কেউ জানলো না- কেউ বুঝলো না। নূরীই বা এতো খুশি হলো কেন তাও কেউ জানলো না।
নূরী বনহুরের বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করে বনহুরের তৈলচিত্র খানার নিচে এসে দাঁড়ালো। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো নূরীর চোখ দিয়ে।
বনহুর তখন চৌধুরী বাড়ির মনিরার কক্ষে।
মনিরার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে বনহুর।
মনিরা স্বামীর ললাট থেকে চুলগুলি সরিয়ে দিয়ে বললো– তুমি কি পারো না এমনি করে শান্ত থাকতে?
এই তো আছি।
তবু ভয় হয় কখন পালিয়ে যাবে।
গেলেও আবার ফিরে আসবো মনিরা।
তাহলে কি তুমি আবার চলে যাবে?
কি জানি কেন যেন আমার মন স্থির থাকতে চায় না মনিরা। পারি না শান্ত হয়ে থাকতে।
তুমি সব পারো। যে কোন অসাধ্য সাধন করতে পারো তুমি শুধু পারো না তুমি আমার কথা রাখতে।
সেজন্য আমার কি কম দুঃখ মনিরা।
কিন্তু আমি তোমাকে যেতে দেবো না। দুদিন পূর্বে তুমিই না বলেছো দস্যু বনহুর কান্দাই পর্বতে মৃত্যুবরণ করেছে? তাই সত্য দস্যু বনহুর মরেছে আমি ফিরে পেয়েছি আমার স্বামী মনির চৌধুরীকে।
মনিরা।
হাঁ তুমি আমার সেই মনির যাকে একদিন আমি ঝড়ের রাতে নৌকা ডুবিয়ে হারিয়েছিলাম। তোমাকে হারিয়ে সেদিন আমার কচি মনে কি যে ব্যথা লেগেছিলো আজও তা ভুলিনি। তোমাকে আমি আর দস্যুতা করতে দেবো না।
বনহুর মনিরার কোল থেকে মাথা সরিয়ে নিয়ে উঠে বসে, নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে আবার, দৃষ্টি মেলে। আজ আবার বনহুরের মনে সেইদিনের কথা স্মরণ হয়। সেই নৌকায় বসে দু’জনার ঝগড়া। নৌকা চলছে, ঝড় উঠে এক সময় তলিয়ে যায় নৌকাখানা। তারপর আর কিছু মনে থাকে না। জ্ঞান ফিরে দেখে সে বলিষ্ঠ চেহারা, ঝাকড়া চুল, কানে বালা এক জোয়ান। মানুষকে। স্মরণ হয় পূর্বকথা, কিন্তু কে জানে কোথায় তার বাবা মা আর মনিরা। প্রথম বড় খারাপ লাগতো, বাবা মা আর মনিরার জন্য সর্বদা মনটা ছটফট করতো। এক-এক সময় পালাতেই ইচ্ছে করতো তার কিন্তু কোথায় পালাবে চারিদিকে গহন জঙ্গল। নানারকম হিংস্র জন্তুর সমাগম, গা ছম ছম করতো ওর। কিন্তু যখন সেই জোয়ান লোকটা আসতো তার পাশে সব ভয় ভাবনা যেন মুছে যেতো মন থেকে। কেমন যেন গভীর একটা আকর্ষণে সে ঝাঁপিয়ে পড়তো ওর প্রশস্ত বুকে, ডাকতো বাপু বলে। তারপর সব সয়ে উঠলো, কালু খাঁ তাকে পুত্র-স্নেহে মানুষ করে তুললো, নানারকম অস্ত্র শিক্ষা দিল তাকে। মুষ্টিযুদ্ধ শেখালো, শিকার করা শেখালো তারপর। শিক্ষা পেলে দস্যুতা…………
মনিরা স্বামীকে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবতে দেখে বললো– কি ভাবছো অমন করে?
সম্বিৎ ফিরে পায় বনহুর, চমকে উঠলো সে– হ্যাঁ কি বললে?
ওমন গভীরভাবে কি চিন্তা করেছিলে?
মনিরা তোমার কথায় আমার মনে উদয় হয়েছিলো পূর্বকথা। পিছনে ফেলে আসা সেই দিনগুলো….
থাক্ এবার ঘুমাও দেখি। রাত অনেক হয়েছে।
বনহুর শয্যা গ্রহণ করলো।
মনিরাও শুয়ে পড়লো বনহুরের পাশে।
মনিরা এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো।
দস্যু বনহুর কিন্তু ঘুমালো না, সে বার বার তাকাচ্ছে দেয়াল ঘড়িটার দিকে।
মনিরার হাতখানা বনহুরের বুকের উপর রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। বনহুর ধীরে ধীরে মনিরার হাতখানা সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। আলগোছে আলোটা নিভিয়ে বেরিয়ে যায় বনহুর ঘর থেকে।
হঠাৎ সিঁড়ির মুখে পথ আগলে দাঁড়ায় একটা ছায়া-মূর্তি।
বনহুর চমকে উঠে, চাপা স্বরে বলে– কে তুমি?
আমি ফুলমিয়া।
তুমি!
হাঁ।
এখানে কেন?
আপনি যেন না যান সে জন্য বিবি সাহেবা আমাকে সজাগ থাকতে বলেছেন।
তার মানে?
মানে আপনি পালান কিনা তাই।
ফুলমিয়া আমার বিশেষ দরকার আছে, একবার যেতেই হবে আমাকে।
কিন্তু বিবি সাহেবা…
তোমাকে কিছু বললে বলবে, আমি দেখিনি………..
না, সাহেব আমি মিছে কথা বলতে পারবো না।
তবে এক কাজ করি দাঁড়াও। আচ্ছা ফুলমিয়া?
বলুন সাহেব?
একগাছা দড়ি আনতে পারো?
দড়ি, হাঁ খুব পারি! কি করবেন সাহেব দড়ি দিয়ে?
তোমাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে না, তারই ব্যবস্থা করবো।
আচ্ছা সাহেব আসছি।
একটু পরে দড়ি নিয়ে ফিরে এলো ফুলমিয়া– নিন সাহেব। কিন্তু দড়ি দিয়ে কি হবে?
দাও!
বনহুর দড়িখানা হাতে নিয়ে বললো– এই খামটার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়াও।
ফুলমিয়া বনহুরের আদেশ পালন করলো। থামের পাশে ঘনিষ্ট হয়ে দাঁড়ালো এসে সে।
বনহুর বললো- নড়বে না একটুও বুঝলে?
আমাকে বাঁধবেন?
না, তোমাকে মিথ্যা বলা থেকে রেহাই দেবো।
বনহুর ফুলমিয়াকে খুব করে বেঁধে ফেললো থামটার সঙ্গে। তারপর রুমাল বের করে মুখ বাঁধলো, এবার বললো বনহুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাও।
গোঙ্গানীর মত শব্দ করে বললো ফুলমিয়া সাহেব আপনি চলে যাচ্ছেন?
হাঁ আবার আসবো।
বনহুর যখন ফুলমিয়াকে খুব করে বাঁধছিলো তখন ফুলমিয়া সম্পূর্ণ নীরব ছিলো। সে একটু টু-শব্দও করলো না। বা নড়লো না।
বনহুর সন্তর্পণে বেরিয়ে এলো চৌধুরী বাড়ি থেকে।
একটা নাইট-ক্লাবের সম্মুখে এসে গাড়ি থামলো, বনহুর নেমে গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো।
রাত্রি অনেক হয়েছে বটে তবু নাইট-ক্লাব গমগম করছে।
নানারকম আলোর ঝকমকানি চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। বনহুর নাইট-ক্লাবে প্রবেশ করতেই একটি যুবতী তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভিতরে নিয়ে গেলো।
নাইট ক্লাবের অভ্যন্তরে তখন নাচ-গান চলেছে।
এক পাশে বাদ্যযন্ত্র হস্তে বাদকগণ বসে বাজনা পরিবেশন করে চলেছে।
বনহুরকে সঙ্গে নিয়ে যুবতী একটা কক্ষে প্রবেশ করলো।
জমকালো পোশাকে আচ্ছাদিত এক নারীমূতি আসনে উপবেশন করেছিলো, সে বনহুরকে দেখবামাত্র আসন ত্যাগ করে অভিনন্দন জানালো।
বনহুর বললো– কস্তুরীবাঈ তুমি এখানে?
হাঁ এখানে আমি থাকি।
এই নাইট ক্লাবে তুমি থাকো?
একজন বাঈজীর পক্ষে এটা আশ্চর্য কিছু নয়। আসন গ্রহণ করো। কস্তুরীবাঈ সন্মুখে আসন দেখিয়ে দিল আংগুল দিয়ে।
বনহুর আসন গ্রহণ করলো।
কস্তুরীবাঈ বললো–আমি জানতাম তুমি আসবে।
জানতে আমি এখানে আসবো?
কে তোমাকে বলেছিলো এ কথা?
আমার মন।
আশ্চর্য মেয়ে তুমি।
শুধু আশ্চর্য নই অদ্ভুত বটে। ভোলানাথ তোমার মত একজন পুরুষকে আমি বশিভূত করে নিয়েছি।
কস্তুরী তুমি……..
থাক এখন অন্য কথা নয়, কাজের কথা।
কাজের কথা?
হাঁ।
কস্তুরীবাঈ ইঙ্গিৎ করলো প্রথম যুবতীটিকে সেখান থেকে চলে যাবার জন্য।
যুবতী চলে গেলো।
কস্তুরীবাঈ বললো– ভোলানাথ তুমি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করলেও তোমার সন্ধানে একদল শত্রু অহরহ সন্ধান করে ফিরছে। এই নাইট-ক্লাব তোমার জন্য নিরাপদ নয়।
ভোলানাথ বেশী বনহুর বললো– তুমি আমাকে সাবধানবাণী শোনালে কস্তুরী সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কে? তোমার মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেলো।
কস্তুরীবাঈ হেসে উঠলো খিল খিল করে। তারপর বললো– ভোলানাথ আমাকে দেখতে চাও?
হ তোমার অপরূপ সৌন্দর্য আমি দেখতে চাই কস্তুরীবাঈ। আমাকে তুমি বিমুখ করো না।
আমাকে তুমি দেখতে চাও, কিন্তু জানো আমাকে দেখলে তুমি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। আমাকে তুমি দেখতে চেওনা ভোলানাথ।
হাসে বনহুর, বেশ তুমি যাতে খুশি হও তাই চাই কস্তুরীবাঈ। বনহুর আসনে ঠেশ দিয়ে বসলো। একটু নিশ্চুপ থেকে বললো–একটা নাচ দেখাবে কস্তুরী?
দেখাবো।
নাচো তাহলে।
কস্তুরীবাঈ নাচতে শুরু করলো।
দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো বনহুর ওর দিকে।
সত্যি অদ্ভুত নাচে এই মেয়েটি।
নাচ শেষ হয়, কস্তুরীবাঈ দাঁড়িয়ে পড়ে এক পাশে।
বনহুর আসন ত্যাগ করে এগিয়ে যায় কস্তুরীবাঈ-এর দিকে, খপ করে ধরে ফেলে ওর দক্ষিণ হাতখানা।
কস্তুরীবাঈ শিউরে উঠে ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সে বনহুরের চোখ দুটির দিকে।
বনহুর কস্তুরীবাঈকে আলিঙ্গন করে, ওর ললাট স্পর্শ করে বনহুরের ওষ্ঠদ্বয়।
কস্তুরীবাঈ বলে–নানা আমাকে ছেড়ে দাও ভোলানাথ। আমাকে মুক্ত করে দাও..
বনহুর ওকে নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করে।
কস্তুরীবাঈ অসহায়ের মত ছটফট করতে থাকে বনহুরের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে।
সেই মুহূর্তে প্রথমা যুবতী কোন কারণে সেই কক্ষে প্রবেশ করে।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর বাহুমুক্ত করে দেয় কস্তুরীবাঈকে।
কস্তুরীবাঈ তৎক্ষণাৎ ছুটে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।
বনহুর তাকায় যুবতীটির দিকে।
যুবতী তখন ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে বনহুরের মুখে। রাগে ফুলছে যেন সে। যুবতী বনহুরকে কিছু না বলে দ্রুত চলে গেলো সেই কক্ষ থেকে।
বনহুরের ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠলো একটা হাসির রেখা। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলো।
মাত্র কয়েক মিনিট কেটেছে।
হঠাৎ আট দশজন জোয়ান বলিষ্ঠ লোক সেই কক্ষ মধ্যে প্রবেশ করে আচমকা আক্রমণ করলো বনহুরকে।
বনহুর হাতের সিগারেট দূরে নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দিয়ে চললো। বলিষ্ঠ জোয়ান লোকগুলোর নাকে মুখে চোখে তীব্র ঘুষি চালালো সে অবিরাম।
অল্পক্ষণেই আট দশজন লোক নাজেহাল হয়ে পড়লো বনহুরের কাছে। কে কোন পথে পালাবে খুঁড়ে নিলো। কিন্তু সেই দণ্ডে একজন পিস্তলধারী লোক এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে, পিস্তলখানা বনহুরের বুকে চেপে ধরে বললো–হাত উঠাও।
বনহুরের মুখোভাবে কোন পরিবর্তন আসেনি। এতোক্ষণ লড়াই করে এতোটুকু বিচলিত হয়নি সে। বনহুর যেন এমনি একটা অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিলো ধীরে ধীরে হাত তুলে দাঁড়ালো বনহুর।
লোকটা পিস্তল ঠিক রেখে অনুচরদের আদেশ করলো–একে বেঁধে ফেলো।
এতোক্ষণে পরাজিত লোকগুলো আবার এসে ঘিরে ধরেছিলো, তারা মজবুত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললো বনহুরকে।
বনহুর বাধা দিলো না, সে নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো।
ওরা বনহুরকে বেঁধে নিয়ে চললো। বনহুরের পিছনে পিস্তল হাতে সেই লোকটা এগিয়ে আসছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। আঁকা-বাঁকা বেশ কতকগুলো ধাপ অতিক্রম করে একটা কক্ষে প্রবেশ করলো তারা দস্যু বনহুর সহ।
বনহুর তাকালো কক্ষ মধ্যে, অবাক হলো সে। দেখলো মেঝের মাঝখানে একটা চেয়ারে উপবেশন করে আছে সট প্যান্ট টাই পরিহিত ভদ্রবেশী এক জীবন্ত শয়তান।
লোকটার পাশেই দণ্ডায়মান সেই যুবতী যে একটু পূর্বে বনহুরের নিকট হতে চলে এসেছিলো। যুবতীর চোখে মুখে ক্রুদ্ধ ভাব ফুটে উঠেছে।
পাশে কস্তুরীবাঈ, এখনও তার মুখে সেই কালো আবরণ ঢাকা।
বনহুরকে দেখবামাত্র লোকটা তার পা থেকে মাথা অবধি দেখে নিলো, তারপর রুক্ষ কণ্ঠে। গর্জে উঠলো–কে তুমি?
বনহুর স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দিলো–আমি একজন মানুষ দেখতেই পাচ্ছো।
লোকটা বনহুরের কথায় ক্ষেপে গেলো ভীষণভাবে। রক্ত চক্ষু ঘুরিয়ে বললো–মানুষ তা তো দেখতেই পাচ্ছি! কিন্তু কি তোমার নাম?
একটু ভেবে বললো বনহুর–আমার নাম শ্যামনাথ।
সঙ্গে সঙ্গে যুবতী বলে উঠলো–মালিক ও মিথ্যা কথা বলছে। ওর নাম ভোলানাথ।
বনহুরের দৃষ্টি এসে পড়লো যুবতীর মুখে, বললো সেও তুমি দেখছি আমার আসল নামটা জেনে নিয়েছো?
যুবতী বললো–তোমার আসল জানা আছে।
এবার বললো শয়তান লোকটা–আমার সহোদর বোমসিং-এর সর্বনাশ করেছো। তোমার জন্যই আজ বোমসিং এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।
হঠাৎ বনহুর হেসে উঠলো অট্টহাসি তোমার ঐ কুৎসিৎ মুখে সুন্দর পৃথিবী শব্দটা মানায় না শেঠজী।
সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বেগে আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ায়, সরে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দেয় লোকটা বনহুরের গালে।
বনহুরের হাত দু’খানা পিছমোড়া করে বাঁধা থাকায় সে নীরব রইলো কিন্তু দক্ষিণ হাতখানা মুষ্ঠিবদ্ধ হলো তার, চোখ দুটো জ্বলে উঠলো আগুনের গোলার মত দাঁতে দাঁত পিষলো শুধু সে।
লোকটা বললো আবার–এতোবড় স্পর্ধা বোমসিং-এর সর্বনাশ করে তুমি আবার আমার পিছু নিয়েছো? বোমসিং? বোমসিং আমার সহোদর তার মাইনে করা বাঈজী কস্তুরী এখন আমাদের। তুমি আবার তার পিছু নিয়েছো………
বনহুর নীরবে শুনতে লাগলো, কোন জবাব দিলো না।
লোকটা কর্কশ কন্ঠে বলে চললো–এতোবড় সাহস তোমার কস্তুরীবাঈ-এর দেহ তুমি স্পর্শ করেছো!
বনহুর বুঝতে পারলো প্রথমা যুবতী এসে তার মালিককে সব কথা বলে দিয়েছে। তাকালো বনহুর কস্তুরীর দীপ্ত সুন্দর নীল চোখ দুটোর দিকে। সে চোখ যেন এক রাশ সহানুভূতি ঝরে পড়েছে।
লোকটা বললো–ওকে নিয়ে যাও বন্দী করে রাখোগে। দেখো কোনক্রমে যেন ছাড়া না। পায়।
এবার বললো যুবতী–কেমন উপযুক্ত সাজা বাছাধন।
বনহুর একবার তাকিয়ে দেখে নিলো যুবতীর মুখের দিকে। লোকগুলো তখন বনহুরকে টেনে নিয়ে চললো সিঁড়ি বেয়ে নিচে।
বনহুরকে একটা কক্ষে আবদ্ধ করে রাখলো ওরা। তারপর সবাই চলে গেলো সেখান থেকে।
কক্ষটা কঠিন পাথরে তৈরি হলেও দরজাখানা ছিল লৌহ শিকলে তৈরি। বনহুর লৌহ-শিক হাত রেখে অনুভব করে নিলে। এই শিক বাঁকিয়ে বেরুতে তার কিছুমাত্র কষ্ট হবে না।
বন্দী কক্ষের মেঝে বসে ভাবতে লাগলো,এই নাইট ক্লাবের নাম সে শুনেছিলো, এখানে ভদ্রবেশী শয়তানদের হয় আনাগোনা কিন্তু সে জানতো না এর ভিতরে আছে একটা গভীর সহস্য।
রাত গম্ভীর হয়ে আসছে। বনহুর ভাবছে এবার তার কাজ শুরু করবে শিক বাঁকিয়ে বেরিয়ে সায়েস্তা করবে সে নাইট-ক্লাবের মালিক সেই জীবন্ত শয়তানটাকে।
ঠিক সেই মুহূর্তে বন্দী কক্ষের দরজার বাইরে পদ শব্দ হলো, বনহুর মিছামিছি নিদ্রার ভান করে বন্দী কক্ষের মেঝেতে শুয়ে পড়লো। অল্পক্ষণেই বন্দী-কক্ষের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো কস্তুরীবাঈ।
বনহুরের শিয়রে এসে বসলো কস্তুরীবাঈ, অতি চাপা-কণ্ঠে ডাকলো–উঠে পড়ো ভোলানাথ, উঠে পড়ো…
বনহুর নিদ্রা ভাঙ্গার ভান করে উঠে বসে বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললো–তুমি!
হাঁ চুপ–ঠোঁটের উপর আংগুল চাপা দেয় কস্তুরীবাঈ। তারপর মৃদু স্বরে বলে–ভোলানাথ এই সুযোগ, চলো তোমার পথ মুক্ত।
বনহুর হাসে–সুন্দরী, পথ মুক্ত হলেও আমি পালাবো না। আমি নিঃশেষ করবো এই শয়তানপুরি।
কিন্তু শুধু এই শয়তানপুরি নিঃশেষ বা ধ্বংস করে কোন ফল হবে না ভোলানাথ, উপড়ে ফেলতে হবে এই শয়তান দলের মূল শিকড়।
কস্তুরীবাঈ তুমি যদি পাশে থাকো তাহলে আমার কোন অসুবিধা হবে না। তুমি পারবে আমাকে সহায়তা করতে।
কস্তুরীবাই বললো–পারবো।
বনহুর আর কস্তুরীবাঈ বেরিয়ে এলো বন্দীশালা থেকে।
এগুতে লাগলো ওরা দু’জন অন্ধকার পথ ধরে সম্মুখ দিকে। একটা সিঁড়ির মুখে এসে থামলো বনহুর আর কস্তুরী।
ঠিক সেই মুহূর্তে পিছনে কারো চাপা কণ্ঠস্বর শোনা গেলো। বনহুর কস্তুরীবাঈকে টেনে নিয়ে সিঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
চাপ-স্বরে দু’জন লোকে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে এদিকেই। বনহুর আর কস্তুরীবাঈ রুদ্ধ নিশ্বাসে কান পেতে শুনতে লাগলো।
লোক দু’জন নিকটবর্তী হতেই বনহুর এবং কস্তুরীবাঈ স্বল্প আলোতেও তাদের চিনতে পারলো। একজন নাইট-ক্লাবের মালিক, অপর জন সম্পূর্ণ অপরিচিত। দু’জন কোন ব্যাপারে আলাপ করতে করতে এগিয়ে আসছিলো। অপরিচিত লোকটির হাতে একখানা ছোরা অন্ধকারেও চক চক করে উঠলো।
শিউরে উঠলো কস্তুরীবাঈ।
বনহুর বললো–শয়তানটা ভোলানাথকে হত্যা করতে যাচ্ছে। এক্ষুণি সর্বনাশ হবে।
কস্তুরীবাঈ চাপা কণ্ঠে বললো–ভয় নেই ভোলানাথ আমি তোমাকে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখবো যেখানে কেউ তোমার সন্ধান পাবে না। শীঘ্র এসো আমার সঙ্গে।
কস্তুরীবাঈ ভোলানাথের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো। একটা অন্ধকার পথ ধরে কিছুক্ষণ চলার পর একটি সুরঙ্গ মুখ দেখা গেলো। কস্তুরীবাঈ বললো–ভোলানাথ তুমি এই সুড়ঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করো।
আর তুমি?
আমাকে ফিরে যেতে হবে আমার কক্ষে।
বনহুর সুবোধ বালকের মত বলে উঠলো–আমিও তা’হলে যাবো তোমার সঙ্গে।
কোথায়?
তোমার কক্ষে।
সর্বনাশ হবে তাহলে।
সে দেখা যাবে, চলো।
কিন্তু তুমি জানো না ভোলানাথ এই শয়তান দল কত বড় সাংঘাতিক আর ভয়ঙ্কর।
জানি। আর জানি বলেই এসেছি এই নাইট-ক্লাবে।
তাহলে চলো আমার সঙ্গে। কস্তুরীবাঈ ভোলানাথ সহ তার শয়ন কক্ষে এসে হাজির হলো।
বনহুর বললো–কস্তুরীবাঈ তুমি শীঘ্র খাটে শয়ন করো আমি তোমার শয্যায় তলায় লুকিয়ে পড়বো।
বেশ তাই করো। কস্তুরীবাঈ কথাটা বলে নিজ শয্যায় শয়ন করে চাদর মুড়ি দিলো।’
অল্পক্ষণেই কস্তুরীবাঈ-এর দরজায় আঘাত পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে প্রবেশ করলো। নাইট-ক্লাবের মালিক এবং তার পিছনে উদ্যত ছোরা হস্তে দ্বিতীয় ব্যক্তি।
নাইট-ক্লাবের মালিক রুক্ষ কণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লো-কস্তুরীবাঈ! কস্তুরীবাঈ।
সবে নিদ্রা ভাঙ্গার মত চমকে উঠে বসলো কস্তুরীবাঈ, মালিককে তার কক্ষে দেখে অবাক হবার ভান করে বলে মালিক আপনি!
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে গর্জে উঠলো মালিক এ কক্ষে ভোলানাথ এসেছিলো কি?
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠে কস্তুরীবাঈ–ভোলানাথ–সে তো বন্দীখানায় বন্দী আছে।
না সে পালিয়েছে।
মালিক ভোলা পালিয়েছে?
হাঁ। কিন্তু কে তার দরজা মুক্ত করে দিয়েছিলো?
আমি-আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, কি করে বলবো।
দ্বিতীয় ব্যক্তিটি বললো–মালিক এ বেচারী কি করে জানবে। ভোলানাথকে নিশ্চয়ই অন্য কেউ মুক্ত করে দিয়েছে।
মালিক কক্ষের চারিদিকে তাকিয়ে দেখে নেয় তারপর হিংস্র জন্তুর মত গ গ করতে করতে সঙ্গী সহ বেরিয়ে যায়।
খাটের নীচ থেকে বেরিয়ে আসে বনহুর।
সঙ্গে সঙ্গে কস্তুরীবাঈ তার মুখের আবরণ টেনে মুখের নিচের অংশ ঢেকে ফেলে।
বনহুর কস্তুরীবাঈ-এর সম্মুখে এসে দাঁড়ায়–এবার তাহলে চলে যাই?
কস্তুরীবাঈ বলে উঠলোনা না এখন কোথায় যাবে? তোমাকে ওরা হত্যা করে ফেলতে পারে ভোলানাথ।
তুমি তো জানো কস্তুরী ভোলানাথ মৃত্যু ভয়ে ভীত নয়। তবে এখন আত্মগোপন করেছিলাম তার কারণ আছে। আমি লুকিয়ে এই শয়তানের আসল ঘাটির সন্ধান আবিষ্কার করতে চাই।
তবে যেতে চাও কেন?
নাইট-ক্লাবের বাইরে আমি যাবো না, যতক্ষণ না এদের সায়েস্তা করছি?
ভোলানাথ।
হাঁ কস্তুরী; তোমার সহায়তা আমার একান্ত প্রয়োজন ছিলো। সেদিন তুমি আমাকে এই নাইট ক্লাবের সন্ধান না জানালে আমি এতো সহজে হয়তো………।
আগে তুমি কার্যোদ্ধার করে তারপর তুমি আমাকে ধন্যবাদ জানাবে।
কিন্তু তোমার মুখ আমাকে কোন দিন দেখাবে না কস্তুরী?
এখন নয়। সেদিন যখন আসবে তখন তুমি আমাকে দেখতে পাবে আর সেদিন আমার প্রতি আসবে তোমার ঘৃণা আর অবহেলা। হাঁ, সেদিন তুমি আমাকে অবহেলা করলেও আমি ব্যথা পাব না। তোমার দেওয়া এই স্মৃতি চিহ্ন চিরদিন আমাকে সান্ত্বনা যোগাবে। কস্তুরীবাঈ আংগুলের দিকে তাকিয়ে বনহুরের দেওয়া অংগুরীটা দেখিয়ে কথাগুলো বলে।
বনহুর কস্তুরীবাঈ-এর একখানা হাত মুঠায় চেপে ধরে গভীর আবেগে ওকে আকর্ষণ করে।
কস্তুরীবাঈ কুঞ্চিত হয়ে পড়ে বলে–নানা ভোলানাথ তুমি আমাকে স্পর্শ করো না। আমাকে স্পর্শ করো না।
বনহুর হেসে বলে–তুমি যা চাও তাই পাবে কস্তুরী। যা চাও তাই পাবে আমার কাছে।
কস্তুরী বলে উঠে–এখন আমি তোমার কোন কথাই শুনতে চাই না ভোলানাথ। কারণ, ঐ শয়তান দল এক্ষুণি এসে পড়তে পারে।
আর আসবেনা কস্তুরী, ওরা ভোলানাথের সন্ধানে ক্লাবের বাইরে অন্বেষণে গেছে। দেখছো না ক্লাব মধ্যে সম্পূর্ণ নীরব। কিছুক্ষণ আমরা নিশ্চিন্ত কথা বলতে পারি।
কস্তুরীবাঈ বললো–ভোলানাথ তুমি আমাকে ভালবাসো জানি কিন্ত………।
বলো?
তোমার ভালবাসা কি সত্যি না মিথ্যা?
এ তুমি কি বলছো কস্তুরীবাঈ?
তুমি কি আর কাউকে ভালবাসোনি কোনদিন?
বেসেছি। তোমাকেও বাসতে চাই,
কিন্তু আমি জীবনে কাউকে ভালবাসিনি ভোলানাথ। শুধু তোমার ভালবাসাই আমাকে অভিভূত করেছে।
তবে কেন আমাকে ধরা দাওনা কস্তুরী?
কোন পুরুষ আজও আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি ভোলানাথ। যদিও আমি বাইজী………কিন্তু আর নয় এখন চলো এখান থেকে পালাতে হবে।
কস্তুরীবাঈ তুমি আর কি জানো এদের সম্বন্ধে বলছো? পালাবার পূর্বে ধ্বংস করে দিয়ে যাবো এদের এই নরক-কুণ্ড।
কস্তুরীবাঈ বনহুরকে সঙ্গে করে বেরিয়ে আসে, আবার তারা শুনতে পায় কোন এক গোপন কক্ষে তখন আলোচনা চলেছে। বুঝতে পারে বনহুর ভোলানাথ বন্দীশালা হতে পালানো ব্যাপার নিয়েই এরা সবাই পরামর্শ করছে। কোথায় গেলো, কেমন করে পালালো। কেউ নিশ্চয়ই ভোলানাথকে মুক্ত করে দিয়েছে।
বনহুর বললো–একটু বিলম্ব করো কস্তুরীবাঈ আমি এদের সায়েস্তা করে ছাড়ছি।
কস্তুরীবাঈ বললো–তুমি একা এতোগুলো লোকের সঙ্গে পারবে ভোলানাথ? এসো তোমাকে আমি মরণ-অস্ত্রের সন্ধান জানিয়ে দিচ্ছি।
বনহুর বিস্ময় নিয়ে তাকালো কস্তুরীবাঈ-এর কালো আবরণে ঢাকা মুখ মণ্ডলের দিকে।
কস্তুরীবাঈ বললো–এসো ভোলানাথ আমার সঙ্গে।
ভোলানাথ কস্তুরীবাঈকে অনুসরণ করলো।
সরু একটা গলিপথ ধরে কয়েক মিনিট চলার পর একটা দেয়ালের পাশে এসে দাঁড়ালো কস্তুরীবাঈ।
বনহুরও দূরে দাঁড়িয়ে পড়লো।
কস্তুরীবাঈ দেয়ালে এক জায়গায় মৃদু চাপ দিলো। সঙ্গে সঙ্গে একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র পথ বেরিয়ে এলো। কস্তুরীবাঈ নিজে সেই ক্ষুদ্র ছিদ্র পথে দৃষ্টি রেখে কিছু দেখে নিয়ে বললো–দেখো ভোলানাথ।
বনহুর সেই অদ্ভুত ছিদ্র পথে দৃষ্টি রাখতেই বিস্মিত হলো। দেখলো ঐ কক্ষ মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ধরনের মেশিন বসানো রয়েছে। সহসা বনহুর বুঝতে পারলো না কিসের মেশিন ওটা।
কস্তুরীবাঈ বনহুরসহ কক্ষের দক্ষিণ দিকে এগুলো। অল্প কিছু চলার পর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো কস্তুরীবাঈ, বনহুরও থেমে পড়লো সঙ্গে সঙ্গে। দেখলো একজন রাইফেলধারী পাহারাদার স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, পাহারা দিচ্ছে।
কস্তুরীবাঈ বললো–ভোলানাথ পারবে ওকে খতম করতে? যদি পারো তাহলে তুমি জয়ী হবে।
বনহুর হাসলো তারপর সন্তর্পণে লোকটার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটা রাইফেল হাতে ঝিমুচ্ছিলো, বনহুর পিছন থেকে বাম হাতে চেপে ধরলো ওর গলা আর দক্ষিণ হাতে রাইফেলটা কেড়ে নিলো আলগোছে।
একটা টু’শব্দ বের হলো না পাহারাদারটার মুখ থেকে। নেতিয়ে পড়লো মেঝেতে লোকটা। বনহুর লোকটাকে চীৎ করে ওর মাজা থেকে চাবিটা নিয়ে কক্ষের দরজা খুলে ফেললো। তারপর কস্তুরীবাঈ আর বনহুর প্রবেশ করলো সেই কক্ষমধ্যে।
কক্ষটা একটা মেশিন কক্ষ। নানারকম মেসিন সাজানো রয়েছে সাড়িবদ্ধভাবে।
কস্তুরীবাঈ বললো-ভোলানাথ এই যে মেসিন পত্র দেখছো এগুলো দ্বারা এরা বারুদ তৈরি করে। শুধু বারুদ নয় বোম তৈরি করে গোপনে চালান দেয় দেশ-বিদেশে।
বনহুর বললো–আশ্চর্য বটে। বাইরে দেখলে মনে হয় একটি সুন্দর নাইট-ক্লাব অথচ ভিতরে এমন রহস্যপূর্ণ।
কস্তুরীবাঈ বললো–বিলম্ব করো না ভোলানাথ, পাশের কামড়ায় স্তূপাকার বারুদ রয়েছে। আগুন ধরিয়ে দিতে পারলে এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে এই রহস্য-পুরি।
কিন্তু তোমার আমার অবস্থা কি হবে জানো?
জানি কিন্তু………।
আর কিন্তু নয় কস্তুরীবাই আমি তোমাকে যা বলি শোন। তুমি মুহূর্ত বিলম্ব না করে নাইট ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাও। বাইরে বহুদূরে চলে যাবে–
আর তুমি?
আমি কার্যোদ্ধার করে আবার মিলিত হবো তোমার সঙ্গে।
কস্তুরীবাঈ শিউরে উঠে বললো–এই ভয়ঙ্কর স্থানে তোমাকে একা ফেলে আমি যেতে পারি না ভোলানাথ।
হাসলো বনহুর, বললো–বেশ তাহলে আমাকে সহায়তা করো। বনহুর একটা তার সংগ্রহ করে নিলো, তারপর তারখানা নিয়ে কৌশলে বারুদের কক্ষে প্রবেশ করলো! তারের মুখ বারুদের কক্ষে রেখে ব্যালকুনির রেলিং বেয়ে আবার ফিরে এলো বনহুর কস্তুরীবাঈ-এর কক্ষে।
কস্তুরীবাঈ তখন মেসিনগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো, সেও বনহুরকে তার বসানো ব্যাপার নিয়ে সাহায্য করে চললো।
বনহুর আর কস্তুরীবাঈ দ্রুত কাজ করে যাচ্ছিলো। তাদের কানে ভেসে আসছিলো নাইট ক্লাবের শয়তান মালিক এবং তার অনুচরদের ব্যস্ততা ভরা ক্রুদ্ধ আলাপ আলোচনা। এদিকে কেউ আসবে না এই ধারণা নিয়েই তারা ওদিকে খোঁজ করে চলেছে। কারণ এদিকটা মেসিন ঘর আর পাকার বারুদে পরিপূর্ণ, তাছাড়া এদিকটায় কড়া পাহাড়ার ব্যবস্থা আছে এ কারণেই ওরা এদিকে খোঁজ না করে নাইট-ক্লাবের বিভিন্ন অংশে সন্ধান করে চলেছে।
ততক্ষণে বনহুর আর কস্তুরীবাঈ তাদের কাজ শেষ করে নেয়।
বারুদের কক্ষে তার বসিয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসে বনহুর কস্তুরীবাঈ-সহ। বনহুরের হাতের মুঠায় তারের শেষ অংশ এবং সুইচ রয়েছে।
বাইরের মুক্ত আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালো ওরা দু’জনা। নাইট ক্লাবটা ছিলো শহরের এক প্রান্তে আশে-পাশে তেমন কোন বাড়ী-ঘর ছিলো না। বনহুর আর কস্তুরীবাঈ দ্রুত সরে যেতে লাগলো। বেশ কিছুদূর সরে যাবার পর ওরা দাঁড়িয়ে পড়লো।
বনহুর বললো–ভোর হবার পূর্বেই আমি ওদের নিঃশেষ করে ফেলতে চাই কস্তুরী।
হাঁ আমার ইচ্ছাও তাই। তাছাড়া এখন ওরা সবাই নাইট-ক্লাবের অভ্যন্তরেই আছে। এখনই হলো সুবর্ণ সুযোগ।
বনহুর আর কস্তুরীবাঈ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। বনহুর সুইচে চাপ দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে দূরে নাইট-ক্লাবটার মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হলো, সেকি ভয়ঙ্কর শব্দ। মুহূর্তে যেন প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেলো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো নাইট-ক্লাব গৃহটা। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় শহরের কতকগুলোবিশিষ্ট নারী-পুরুষের সমাবেশ ঘটতো হাসি গানে ভরে উঠতো স্থানটা। আর ভিতরে চলতো এক জঘন্য কুৎসিত কুকর্ম। সেই নরক-পুরি এই দণ্ডে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো।
যে মুহূর্তে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটলো সেই মুহূর্তে কস্তুরীবাঈ ভীতভাবে জড়িয়ে ধরেছিলো বনহুরকে।
বনহুরও কস্তুরীবাঈকে গভীরভাবে টেনে নিয়েছিলো।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে এলো কস্তুরীবাঈ-এর।
কস্তুরীবাঈ দ্রুত সরে দাঁড়াতে গেলো।
বনহুরের বাহু দুটি আরও নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করলো তাকে। কস্তুরীবাঈ মুক্তি পেলো না ওর বাহুবন্ধন থেকে।
কস্তুরীবাঈ বনহুরের গালে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিতেই বনহুর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে তারপর বললো–প্রিয়ে তুমি আমার জীবন মন সর্বস্ব। তোমাকে আমি চাই…
কস্তুরীবাঈ মুখের আবরণ আরও ভালভাবে টেনে দিয়ে বলে–ভোলানাথ তোমাকে আমি পবিত্র নিষ্পাপ বলেই জানতাম। তুমি যে এতোখানি হীন জঘন্য তা জানতাম না।
আবার অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো বনহুর, তার মুখে ফুটে উঠলো একটা বৈচিত্র্যময় ভাবের পরিবেশ।
কস্তুরীবাঈ নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো বনহুরের মুখের দিকে।
অদূরস্থ নাইট-ক্লাবের অগ্নি-কুণ্ডের আলোকরশ্মিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো সব। বনহুর বললো–কাজ শেষ হলো কস্তুরীবাঈ এবার চলো তোমাকে কোথায় পৌঁছে দিতে হবে?
কোথায় যাবো জানি না।
তবে চলো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
যেখানে আমি থাকি।
বেশ চলো।
বনহুরের হাত ধরে কস্তুরীবাঈ রওনা দিলো।
বনহুরের আস্তানা।
বিশ্রাম কক্ষে বনহুর তার শয্যায় অর্ধশায়িত অবস্থায় বসেছিলো। তার সম্মুখস্থ টেবিলে স্তূপাকার ফলমূল থরে থরে সাজানো। নূরী বসে, এক একটি অংগুরের ঝোপা তুলে ধরছিলো বনহুরের মুখে। নিজেও খাচ্ছিলো দু’একটা করে।
নূরীর মুখভাবে একটা সহস্যময় প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। এক সময় বলে উঠলো নূরী–একটা কথা জিজ্ঞেস করবো সঠিক জবাব দেবেতো হুর। আংগুর চিবুতে চিবুতে জবাব দিলো বনহুর–কবে তোমার প্রশ্নে বেঠিক জবাব দিয়েছি বলো?
তবে সত্যি করে বলোতো গতরাতে তুমি কোথায় ছিলে?
ও এই কথা? একটা নাইট-ক্লাবে ছিলাম।
মুহর্তে নূরীর মুখমণ্ডল গম্ভীর হয়ে পড়লো, রাগত কণ্ঠে বললো–আজকাল দস্যু বনহুর দেখছি দস্যুতা ত্যাগ করে নাইট-ক্লাবে রাত্রি যাপন শুরু করে দিয়েছে। ব্যাপার কি কোন সুন্দরী। প্রেয়সীর প্রেমে—
হাঁ নূরী সত্যি বলতে কি আমি একজনকে মন প্রাণে ভালবেসে ফেলেছি।
অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো নুরী–বনহুর।
শুধু তাকে ভালবাসি তা নয় তাকে আমি সমীহ করি কারণ সে আমার বহুকাজে সহায়তা করেছে এমন কি একদিন সে আমার জীবন রক্ষা করেছে নুরী।
এবার বুঝেছি। হু একটা নর্তকীর মোহ তোমাকে এতোখানি নীচে নামাতে পারে এ আমি কোনদিন ভাবতে পারিনি বনহুর।
বনহুর মৃদু হাসলো তারপর বললো–দস্যু বনহুর নীচে নামতে জানে না নূরী। সে শুধু উচ্চতর হতে উচ্চস্তরে আরোহণ করতে পারে।
তাহলে নাইট-ক্লাবের একটি নর্তকীর সঙ্গে এমন করে রাতের পর রাত কাটাতে পারতে না। বনহুর। জানি তোমার দুর্বলতা কোথায়?
আমার নয় তোমার। কারণ তুমি আজও আমাকে বিশ্বাস করতে পারো না। তাই আমাকে………থাক আজ আর নয়।
নূরী মাথা নিচু করে কিছু ভাবলো।
বনহুর বললো–সে নর্তকীর নাম কি শুনবে নূরী?
আমি শুনতে চাই না।
কেন বলোতো? হিংসে হয় বুঝি?
আমি তার নাম জানি।
তাই নাকি?
হাঁ।
বলো দেখি কি নাম তার?
বলবো না।
অট্ট হাসিতে ভেঙে পড়ে বনহুর।
নূরী বলে-হাসছো কেন বলো?
বলবে না?
না।
আজ রাতে আমি আমার প্রিয়া কস্তুরীবাঈ এর সঙ্গে মিলিত হবো।
দাঁতে দাঁত পিষে বললো নূরী–এতো বড় সাহস তোমার? আমার সম্মুখে ঐ নিকৃষ্ট অস্পৃশ্য নর্তকীর নাম ধরতে লজ্জা হলো না তোমার?
জানো তো মানুষ–মানুষই দস্যু বনহুরের কাছে নিকৃষ্ট বা অস্পৃশ্য কেউ নয়। মেথর-মুচি ডোম তার চেয়েও যদি নিকৃষ্ট কেউ থাকে সেও আমার কাছে আমারি মত পবিত্র।
পবিত্র, তুমি আবার পবিত্র নাকি? নূরী মুখভাব গম্ভীর করে নিয়ে কথাটা বললো।
ঠিক সেই সময় পিছনে এসে দাঁড়ালো রহমান–হাঁ নূরী সর্দার পবিত্র। তাঁর চরিত্রের কাছে যে কোন মানুষ পরাজিত হতে বাধ্য।
ক্রুদ্ধ নাগিনীর মত ফোঁস করে উঠলো নূরীরহমান জানো না আজকাল তোমাদের সর্দার দস্যুতা ত্যাগ করে প্রেমাভিনয় ধরেছেন………
নূরী তুমি অযথা সর্দারকে………
বনহুর রহমানকে ইংগিৎ করলো চুপ হতে।
রহমান কথা শেষ না করে থেমে গেলো, হাসলো সে মনে মনে।
নূরী বুঝতে পারলো রহমান কোন জরুরী কথা নিয়ে এসেছে। তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে গেলো কক্ষ থেকে।
রহমান সর্দারকে কুর্নিশ জানিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো তারপর বললো–সর্দার বহু বিলম্ব হয়ে গেলো।
কি ব্যাপারে?
সর্দার, অনিন্দপুরে অনিন্দন মহারাজের বেশে চরম এক শয়তান সেজে বসেছে। রাজ্য পরিচালনার নাম করে সে প্রজাদের উপর চালাচ্ছে নির্মম অন্যায় অত্যাচার। আর গোপনে চালিয়ে চলেছে চোরাচালানি কারবার।
এ সংবাদ কে বহন করে এনেছে?
আবদুল মালেক।
কোথায় সে?
বাইরে অপেক্ষা করছে।
ডাকো তাকে।
রহমান বেরিয়ে যায়, একটু পর আবদুল মালেক সহ ফিরে আসে।
কুর্ণিশ জানায় মালেক।
বনহুর সোজা হয়ে বসলো, গম্ভীর কণ্ঠে বললো–কি খরব মালেক?
সর্দার, খবর অত্যন্ত জটিল। দু’সপ্তাহ পূর্বে আমি অনিন্দপুরে যাই এবং গোপনে সেখানকার সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করি।
কতটুকু জেনেছো?
সর্দার, যতটুকু প্রয়োজন বলবো সর্দার?
না থাক্ এখন।
অনিন্দপুর।
গভীর রাত।
সমুদ্র তীরে একখানা জাহাজ অপেক্ষা করছিলো। জাহাজে কোন আলো ছিলো না। কতকগুলো লোক জাহাজের রেলিং এ দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেকের দেহেই ডোরাকাটা ফুলপ্যান্ট আর হাফ হাতা সার্ট। অন্ধকারে এক একটা জমদূতের মত দাঁড়িয়ে কিসের যেন প্রতিক্ষা করছে।
চারিদিক নিস্তব্ধ নিঝুম।
সমুদ্রের জলরাশির কল কল ছল ছল শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যাচ্ছিলো না।
এমন সময় একটা মাল বোঝাই ট্রাক্ এসে থামলো সমুদ্র তীরের অনতিদূরে। ট্রাকটি থেমে পড়তেই ট্রাকের ড্রাইভিং আসনের পাশে দাঁড়িয়ে একটি লোক আলো নাড়তে লাগলো।
সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের ডেকেও জলে উঠলো তীরস্থ আলোটির অনুকরণে অপর একটি আলো। পরক্ষণেই জাহাজ থেকে একটা সিঁড়ি নেমে এলো নিচে।
আলোর তেমন কোন কারবার নেই শুধুমাত্র ঐ দুটি আলোর বিন্দুর সাহায্যে চললো আলাপ।
সিঁড়ি নেমে আসাতেই ট্রাক থেকে কতকগুলো কাঠের বাক্স নামানো হলো।
সিঁড়ি বেয়ে ততক্ষণে নেমে এসেছে জাহাজের ডেকের লোকগুলো ট্রাক থেকে নামানো। কাঠের বাক্সগুলে তুলে নিলো তারা মাথায় তারপর অন্ধকারে জাহাজের দিকে এগুলো।
একজন দাঁড়িয়ে বাক্সগুলোর গায়ে চাটি দিয়ে ক্র চিহ্ন এঁকে দিচ্ছিলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রাকটির পাশে আর একটি ট্রাক এসে থামলো। প্রথম ট্রাক অন্ধকারে চলে গেলো। প্রথম ট্রাকের স্থানে দ্বিতীয় ট্রাক স্থান দখল করে দাঁড়ালো।
আবার মাল নামালো, বোঝাই হলো জাহাজের অভ্যন্তরে একটি নয় পর পর কয়েকটা ট্রাক এলো এমনি মাল বোঝাই হয়ে, একইভাবে কাঠের বাক্সগুলো স্থান পেলো জাহাজটায়।
সিঁড়িতুলে নেবার পূর্বে জাহাজ থেকে নেমে এলো একজন সাহেব।
তীরে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি। তার দেহে অভার কোট, মুখে দাঁড়ি। পায়ে ভারী বুট, চোখে কালো চশমা। রাতের অন্ধকারে তাকে ভয়ঙ্কর লাগছিলো।
জাহাজের সাহেবটি নেমে এসে দাঁড়ালো কালো চশমা পরিহিত লোকটার পাশে। বললো– সাহেব–মিঃ সেন মাল পৌঁছে গেলে আপনি সংবাদ পাবেন। আর এই নিন টাকা।
কালো চশমা পরা লোকটা বললো–কত আছে এতে?
আজকের মালের মূল্য দু’লাখ টাকা আছে এতে।
বেশ দাও। হাঁ মনে রেখো একটা পয়সা হিসাবে গরমিল হলে তুমি মরবে ফিলিংম্যান।
স্যার, অবিশ্বাসের কিছু নেই।
তাহলে যেতে পারো। বললো চশমা পরিহিত ব্যক্তি। ফিলিং সাহেব বললো–স্যার, যাবেন না আপনি?
না, আজ যাওয়া সম্ভব নয় কারণ মহারাজ স্বয়ং যাবেন বলে জানিয়েছেন আমাকে।
মহারাজ স্বয়ং যাবেন?
হাঁ-তোমাদের মালিককে বলো আগামী অমাবস্যায় যে মাল চালান যাবে তার সঙ্গে যাবেন মহারাজ স্বয়ং। কারণ বোমসিং আর মোদন মোহনের মৃত্যুর পর কান্দাই-এ নতুন কোন পার্টি তেমন করে তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছেন না। আজকাল কান্দাই পার্টি ঝিমিয়ে পড়েছে যেন একেবারে।
দ্বিতীয় পার্টির সঙ্গে কেমন কারবার চলছে স্যার?
খুব ভাল না এবং সে কারণেই মহারাজ অনিন্দন স্বয়ং যাবেন কান্দাই। হাঁ আর একটা কথা, তোমাকে যে ভাবে পূর্বে বলেছিলাম সেইভাবে কাজ করবে, বাইরের লোক কেউ যেন টের না পায়।
সব কথা মনে আছে স্যার। কথাটা বলে ফিলিং সাহেব জাহাজের দিকে পা বাড়ালো।
ওভার কোটের পকেটে টাকার ফাইলগুলো রেখে মিঃ সেন তার গাড়ির দিকে এগিয়ে। চললো।
ততক্ষণে ট্রাকগুলো সব চলে গেছে।
গাড়ীতে উঠে বসে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো মিঃ সেন চলো এবার।
ড্রাইভার মাথার ক্যাপটা ঠিক করে দিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিলো। গাড়ি ছুটতে শুরু করলো বেগে।
কিছুদূর এসে হঠাৎ গাড়িখানা বিগড়ে গেলো। থেমে পড়লো গাড়িখানা আচমকা।
ড্রাইভারকে বললো মিঃ সেন–কি হলো?
স্যার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে।
মিঃ সেন কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো–গাড়ি খারাপ হলো কেন?
কি জানি স্যার। নেমে দেখবো?
দেখো। বললো মিঃ সেন।
ড্রাইভার নেমে পড়লো। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও গাড়ি ঠিক করতে পারলো না।
ক্রুদ্ধ হয়ে মিঃ সেন নেমে এগিয়ে গেলো এবার গাড়ির সম্মুখ ভাগে–দেখি কি হয়েছে? গাড়ির সম্মুখ ভাগের ঢাকনার মধ্যে ঝুঁকে পড়লো। টর্চ লাইট জেলে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো মিঃ সেন গাড়ির কল-কজাগুলো।
ঠিক সেইক্ষণে ড্রাইভার তার হাতের রড দিয়ে প্রচণ্ড একটা আঘাত করলো তার মাথায়।
সঙ্গে সঙ্গে উবু হয়ে পড়ে গেলো মিঃ সেন গাড়ির পাশে।
ড্রাইভার দ্রুত হস্তে লোকটার দেহের পোশাক খুলে দিলো। মুখ থেকে নকল দাড়ি গোঁফ, চোখের কালো চশমাটাও খুলে পরে নিলো সে চটপটু,ওভার কোটের পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলো টাকাগুলো ঠিক ভাবেই আছে কিনা।
মিঃ সেনকে পথের পাশে ঠেলে ফেলে দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো ড্রাইভার। সম্মুখ পথ পরিষ্কার কাজেই গাড়ি বেক্ করে গাড়ির মুখ পুনরায় ফিরিয়ে নিলো যে পথে এসেছিলো সেই পথে।
অল্পক্ষণে গাড়িখানা পূর্বের সেই স্থানে পৌঁছে গেলো, যেখানে কিছু পূর্বে টাকার আদান প্রদানে চলেছিলো। গাড়ি থেকে নেমে একটা আলো দোলাতে লাগলো সে।
জাহাজের সিঁড়ি সবে মাত্র তুলে নেওয়া হয়েছে। ক্যাপ্টেন আলোটা লক্ষ্য করে আবার সিঁড়ি নামিয়ে দেবার আদেশ করলো।
সিঁড়ি নেমে এলো আবার জাহাজ থেকে।
গাড়ী থেকে নেমে এগিয়ে এলো ড্রাইভার, এবার সে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো জাহাজের ডেকে।
ক্যাপ্টেন এবং সাহেবী পোশাক পরা লোকটা এগিয়ে এলো। ক্যাপ্টেন জিজ্ঞাসা করলো– স্যার আপনি?
হাঁ, আমি ফিরে এলাম। কারণ তোমাদের মালিকের সঙ্গে দেখা করাটা আমার একান্ত দরকার।
ক্যাপ্টেন বললো–নিশ্চয়ই আপনি এসে খুব ভালই করেছেন মিঃ সেন। মালিক শ্যামসিং আপনাকে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
কিন্তু আমি শুধু তার সঙ্গে দেখা করতেই এলাম না। মহারাজের একটা নতুন সংবাদ বহন করে এনেছি। জাহাজ ছাড়ার আদেশ দিন পরে সব আলোচনা করবো।
ক্যাপ্টেনের আদেশে জাহাজ তীর ছেড়ে গভীর সমুদ্রের দিকে এগিয়ে চললো।
প্রায় ঘণ্টা কয়েক চলার পর মিঃ সেন বললো–চলুন এবার আলোচনা শুরু করা যাক।
সবাই এসে ডেকের এক পাশে চেয়ারগুলো দখল করে নিয়ে বসলো। ক্যাপ্টেন সাহেবী পোশাক পরা লোকটার নাম ধরে ডাকলো ফিলিংম্যান–টাকাগুলো মিঃ সেনকে বুঝিয়ে দিয়েছিলে তো?
ফিলিংম্যান গম্ভীর গলায় বললো–হাঁ ক্যাপ্টেন, টাকাগুলো আমি একটিও আত্মসাৎ করিনি।
এবার বললো ক্যাপ্টেন –বলুন মিঃ সেন আপনার কথা বলুন?
হাঁ বলছি। মহারাজ এবার একটা নতুন প্ল্যান নিয়েছেন। তিনি জীবনে বহু অর্থ এইভাবে সংগ্রহ করেছেন এবার তিনি কিছুটা পুণ্যি করতে চান।
অবাক কণ্ঠে বলে ক্যাপ্টেনবেশী শয়তান হার্লিং–তার মানে।
মিঃ সেন পকেট থেকে টাকার ফাইলগুলো বের করে টেবিলে রাখলো তারপর বললো– এবারের মালগুলো মহারাজ পুস্তদ্বীপের বন্যাপীড়ীত অসহায়দের মধ্যে বিতরণ করে দেবার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। টাকাগুলো ফেরৎ দিতে বললেন।
অবাক কণ্ঠে বললো ক্যাপ্টেন হার্লিং –আপনি এসব কি বলছেন?
মহারাজের নিমক খাই তাঁর আদেশ পালন করতেই হবে আমাকে। তিনি চান পুস্তদ্বীপের দুঃস্থরা বাঁচুক।
ক্যাপ্টেন মাথায় হাত দিয়ে বললো–এক বাক্স নয় দু’শো বাক্স কফি সব বিতরণ করে দেবেন তিনি………
হাঁ ক্যাপ্টেন। বললো মিঃ সেন।
মিঃ সেনের নির্দেশে জাহাজ মাইথি একদিন পুস্তদ্বীপে এসে পৌঁছলো।
জাহাজ নঙ্গর করলো।
দ্বীপে ঘোষণা করে দেওয়া হলো দ্বীপবাসীদের মধ্যে কফি এবং সুস্বাদু ফলের রসভরা কৌটা বিতরণ করা হবে।
অল্পক্ষণেই অগণিত দ্বীপবাসী এসে বন্দরে উপস্থিত হলো।
মিঃ সেনের আদেশে জাহাজের সমস্ত মাল পুস্তদ্বীপের দুঃস্থ অসহায় জনগণের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হলো।
দ্বীপবাসীগণ বহুদিন হতে পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে জীর্ণ-শীর্ণ মৃত্যু প্রায় হয়ে পড়েছিলো। মিঃ সেন সবাইকে প্রচুর পরিমাণ কফি এবং ফলের রসভরা কৌটা দিলো।
শূন্য জাহাজ নিয়ে ফিরে চললো ক্যাপ্টেন হার্লিং।
মিঃ সেন আনন্দে অধির হয়ে পড়েছে, নিজ হাতে সে তুলে দিয়েছে এই সব খাদ্যসম্ভারগুলো অসহায় দ্বীপবাসীদের মধ্যে। আজ তার পরম আনন্দ।
ক্যাপ্টেন হার্লিং-এর মনের সংগে অবস্থা ভাল নয়, সে তার ক্যাবিনে বসেছিলো আরও কয়েকজন তার সঙ্গীর সংগে গোপনে কোন পরামর্শ করছিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যাবিনে প্রবেশ করে মিঃ সেন, দুহাতে তার দু’খানা রিভলভার।
চমকে উঠে ক্যাপ্টেন ও তার দলবল।
মিঃ সেন বলে–হ্যান্ডসআপ।
হাত তুলে দাঁড়াতে বাধ্য হলো সবাই।
মিঃ সেন বললো–ক্যাপ্টন টাকার ফাইলগুলো বের করো।
ক্যাপ্টেন ঢোক গিলে বললো–আপনি………
হাঁ আমার দু’লাখ টাকা বের করো। না হলে এক্ষুণি লাশে পরিণত হবে।
ক্যাবিনের মধ্যে প্রত্যেকে কেমন হতভম্ব হয়ে পড়েছিলো, এমন একটা অবস্থার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না।
ক্যাপ্টেন হার্লিং এবং তার অনুচরদলও কম শক্তিশালী নয় কিন্তু এমন অবস্থায় তারাও ভিজে বিড়ালের মত চুপষে গেছে যেন। ক্যাপ্টেন ভেবে পাচ্ছে না হঠাৎ মিঃ সেনের মধ্যে এমন পরিবর্তন হলো কি করে। বাধ্য হয়ে হার্লিং লৌহ আলমারী খুলে দু’লাখ টাকার ফাইলগুলো বের করলো।
মিঃ সেন বললো–আমার ওভারকোটের পকেটে ফাইলগুলো রাখো।
মিঃ সেন মুহূর্তের জন্য হাতের রিভলভার বেঠিক্ করলো না।
তার রিভলভার সর্বক্ষণ হার্লিং এর বুক লক্ষ্য করে আছে। হার্লিং বাধ্য ছাত্রের মত টাকার ফাইলগুলো মিঃ সেনের পকেটে রাখলো।
মিঃ সেন একখানা ভাঁজকরা কাগজ ক্যাপ্টেন হালিং–এর হাতে গুঁজে দিয়ে বললো– তোমার কোন দোষ নেই হালিং। টাকার রসিদ দিলাম।
মিঃ সেন রিভলভার ঠিক রেখে পিছু হটে বেরিয়ে গেলো ক্যাবিনের বাইরে। তারপর ক্যাবিনের দরজা বন্ধ করে দিলো মজবুত করে।
মিঃ সেন বেরিয়ে যেতেই হার্লিং কাগজখানা মেলে ধরলো চোখের সম্মুখে, বিস্ময়ে আরষ্ট হলো অস্ফুটকণ্ঠে পড়লো–
–মহারাজ ক্যাপ্টেন হালিং সম্পূর্ণ নিরপরাধ। জাহাজের সমস্ত মাল আমিই পুস্তদ্বীপবাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দিয়েছি। ক্যাপ্টেনের নিকট হতে আমি দু’লাখ টাকা নিয়ে গেলাম। সময়মত দেখা করবো।
–দস্যু বনহুর।
ক্যাপ্টেন হার্লিং-এর হাত থেকে কাগজখানা খসে পড়লো ভীতকণ্ঠে বললো সেদস্য বনহুর।
ক্যাবিনের মধ্যস্থ সবাই একসঙ্গে ভয়ার্তভাবে উচ্চারণ করলো-দস্যু বনহুর।
ততক্ষণে দস্যু বনহুর জাহাজের শেষ অংশের একটা নির্জন ক্যাবিনে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলো, মেঝের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো বনহুর। মেঝের একস্থানে পা দিয়ে চাপ দিতেই মেঝের কিছুটা অংশ লিফটের মত স স করে নীচের দিকে নেমে চললো।
মাত্র কয়েক মিনিট।
বনহুর জাহাজের তলদেশে এসে পৌঁছে গেলো। লিফটের মুখেই ছোট্ট একটা ডুবো ক্ষুদ্র জাহাজ, কতকটা সাবমেরিনের মত। বনহুর সেই ক্ষুদ্র জাহাজটির মধ্যে চেপে বসলো। সাবমেরিনটার মধ্যে প্রবেশ করতেই লিফটের মত জিনিসটা সাঁ করে উপরে উঠে গেলো।
বনহুর সাবমেরিন চালনা জানতো সে অভিজ্ঞ চালকের মত মেসিনে স্টার্ট দিলো।
মুহূর্ত ছুটতে শুরু করলো সাবমেরিনখানা।
ওদিকে তখন ক্যাবিনে আটকা পড়ে ক্রুদ্ধ জন্তুর মত ছটফট করছে ক্যাপ্টেন হার্লিং ও তার দলবল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ক্যাবিনের দরজায় ধাক্কা মেরে চললো।
অল্পক্ষণেই জাহাজের অন্যান্য লোকজন এসে পড়লো। দরজা খুলে দিতেই ক্যাপ্টেন হার্লিং ঝড়ের বেগের ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে চিৎকার শুরু করলো–দস্যু বনহুর দস্যু বনহুর গ্রেপ্তার করো। মিঃ সেনকে। গ্রেপ্তার করো কোথায় সেই সেনরূপী দস্যু..
দস্যু বনহুর নাম শুনেই প্রথমে সবাই চমকে উঠলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ়র মত এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ী করতে লাগলো।
ক্যাপ্টেন হালিং পুনরায় চিৎকার করে উঠলো–তোমরা হা করে আছো কেনো? যাও দেখো কোথায় সেই দস্যু বনহুর………
সবাই ছুটলো যে যেদিকে পারলো।
হার্লিং নিজেও ছুটাছুটি করে খুঁজতে লাগলো। অনেক খুঁজতেও যখন তারা মিঃ সেনকে জাহাজে পেলো না তখন হতাশ হয়ে পড়লো।
ক্যাপ্টেন হার্লিং-এর চোখ দুটো হঠাৎ জ্বলে উঠলো। সে তৎক্ষণাৎ ছুটলো জাহাজের পিছন অংশের দিকে।
তার নির্দিষ্ট ক্যাবিনের সম্মুখে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো ক্যাপ্টেন হালিং। দরজা ভিতর থেখে বন্ধ দেখে চোখ তার নিষ্প্রভ হয়ে এলো, বললো–সর্বনাশ হয়েছে। দস্যু বনহুর আমাদের সব নিয়ে ভেগেছে………
ততক্ষণের অন্যান্য সবাই এসে ভীড় জমে গেছে সেখানে।
মিঃ হালিং-এর আদেশে ক্যাবিনের দরজা ভেঙে ফেলা হলো। সঙ্গে সঙ্গে হার্লিং মেঝের মাঝখানে দাঁড়িয়ে একটা সুইচে পা দিয়ে চাপ দিলো। অমনি লিষ্টা সা সা করে নেমে গেলো নীচে। কিন্তু লিফটের মুখে পৌঁছে আর্তনাদ করে উঠলো সেখানে সাবমেরিনটা নেই। পাগলের মত ফিরে এলো ক্যাপ্টেন হার্লিং জাহাজের কামড়ায় যেখানে তার অন্যান্য অনুচরগণ অপেক্ষা করছিলো। মাথায় করাঘাত করে বসে পড়লো ক্যাপ্টেন হালিং–দস্যু বনহুর সর্বশান্ত করে গেছে, সে শুধু দু’লাখ টাকা নিয়েই উধাও হয়নি আমাদের যথাসর্বস্ব সাবমেরিন নিয়ে ভেগেছে।
ফিলিংম্যান বলে উঠলো–দস্য জানলো কি করে আমাদের এই গোপন পথের কথা?
ক্যাপ্টেন হাউ মাউ করে কেঁদে বললো–আমি কি জানতাম সে আসল মিঃ সেন নয়। তাকে নিয়ে আমি একদিন সমুদ্রগর্ভে অবতরণ করেছিলাম..
হায় হায় করে উঠলো সবাই।
ক্যাপ্টেন হার্লিং ধপ করে বসে পড়লো জাহাজের ডেকের উপর।
কস্তুরীবাঈ নাচ শেষ করে বনহুরের পাশে এসে দাঁড়ালো। যদিও তার সম্পূর্ণ মুখমমণ্ডল দেখা যাচ্ছিলো না তবু বনহুর বুঝতে পারলো কস্তুরীবাঈ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পা দু’খানা কাঁপছে ওর।
বনহুর ধরে ফেললো ওকে তারপর মুখে কাছে মুখ নিয়ে বললো–তোমার ডিউটি শেষ হয়েছে কস্তুরীবাঈ এবার মুখের আবরণ উন্মোচন করে ফেলো। সঙ্গে সঙ্গে কস্তুরীবাই এর মুখ থেকে কালো ওড়নার আঁচলখানা খুলে ফেলে বনহুর এবং আবেগ ভরা কণ্ঠে ডাকে নূরী………
নূরী স্বামীর বুকে মাথা রাখে–তুমি আমাকে…….
দস্যু বনহুরের চোখে ধুলো দেয় এমনজন আছে কেউ? যে দিন কস্তুরীবাঈকে প্রথম দেখেছি সেদিন চিনেছিলাম নূরী তোমাকে। শুধু তোমাকে নাম ধরে ডাকিনি কারণ তোমার সহায়তা আমার নিতান্ত প্রয়োজন ছিলো। বলো কি পুরস্কার তুমি চাও?
যে পুরস্কার তুমি আমাকে দিয়েছে তা আমার জীবনে চরম পুরস্কার।
বনহুর হেসে বলে–তাই নাকি? মা-ডাক শুনার জন্য………
নূরী বনহুরের মুখে হাত চাপা দেয় লজ্জায় রাঙা হয়ে তার মুখমণ্ডল।
হঠাৎ পিছনে তাকিয়ে চমকে উঠে বনহুর আর নূরী। যমদূতের মত বীভৎস চেহারা একটি লোক দাঁড়িয়ে আছে। তার দেহটা পুড়ে এবড়ো থেবড়ো হয়ে গেছে একেবারে। চিনতে বাকী রইলো না যমদূতটা অন্য কেহ নয় নাইট-ক্লাবের সেই নর-শয়তান শ্যামসিং। হাতে তার সূতীক্ষ্ণ ধার একখানা ছোরা চক্ চক্ করছে।
বনহুর নূরীকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চোখ দুটো তার তীব্রভাবে জ্বলে উঠে।