Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ইয়েতির আত্মীয় (১৯৯৯) || Samaresh Majumdar

ইয়েতির আত্মীয় (১৯৯৯) || Samaresh Majumdar

ভানুদা বলেছিলেন, আজকের রাতটা থেকে যাও অর্জুন। রাস্তাটা ভাল নয়, দু ঘণ্টার রাস্তা তিন ঘণ্টাতে যেতে হয়। তা ছাড়া মেঘ জমেছে খুব।

তখন সবে সন্ধে নেমেছে। কথা হচ্ছিল সুভাষিণী চা-বাগানের ম্যানেজারের বাংলোর সামনে দাঁড়িয়ে। রাতে চাবাগানের কারখানা, অফিস, রাস্তা বিদ্যুতের কল্যাণে দিনের আলোর মতো আলোকিত। কিন্তু পেছনের চাবাগান অন্ধকারে ঝিম মেরে পড়ে আছে। অর্জুন আমাদের দিকে তাকাতেই চটপটি আলো ছড়িয়ে ছুটে গেল এপাশ থেকে ওপাশে।

অর্জুন বলল, আপনি যখন জিপ দিচ্ছেন তখন যেতে তো সমস্যা হবে। ওরা যদি পরশু সকালে যাত্রা শুরু করে তা হলে আজই আমার ওখানে পৌঁছনো দরকার। তা হলে কাল গোটা দিনটায় ওদের সঙ্গে থেকে তৈরি হওয়া যাবে।

ভানুদা আর আপত্তি করেননি। ড্রাইভারকে ডেকে উপদেশ দিয়েছিলেন, যেন ঠিকভাবে জিপ চালায়। সাহেবের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।

ছুটন্ত জিপে বসে কথাটা ভাবতেই ইসি পেল অর্জুনের, ভানুদা তাকেও সাহেব বানিয়ে ছাড়লেন। অবশ্য চা-বাগানের ম্যানেজারদের অধস্তন সাহেব বলে থাকেন। অতএব সাহেবের বন্ধু বা ঘনিষ্ঠরা সাহেব হয়ে যাচ্ছেন। তা ছাড়া ভানুদা মনেপ্রাণে বাঙালি হলেও আদব-কায়দায় পুরোদস্তুর সাহেব। কখনও বিদেশে যাননি, কিন্তু একজন ব্রিটিশের জীবন যাপন করেন। আজ সকালে ফোন করে ঘুম থেকে তুলেছিলেন ভানুদা। সুভাষিণী চা বাগান থেকে জলপাইগুড়ির দূরত্ব আড়াই ঘণ্টার পথ। ঘুমজড়ানো চোখে রিসিভার তুলতেই ভানুদার গলা শুনতে পেয়েছিল, গুড মর্নিং, অর্জুনভাই। ঘুম ভাঙালাম মনে হচ্ছে।

না, না। কেমন আছেন ভানুদা? অর্জুন চেঁচিয়েছিল।

তুমি কি এখন খুব ব্যস্ত? হাতে কোনও কেস আছে?

না। একদম বেকার। কেন?

তা হলে চটপট সুভাষিণীতে চলে এসো। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, তোমার খুব ভাল লাগবে। লাঞ্চের মধ্যেই আসতে পারবে?

চেষ্টা করছি।

কিন্তু কিছু কাজ সেরে সুভাষিণীতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে গেল। এতটা পথ সে তার লাল বাইক চালিয়ে এসেছে। তনুদা তখন অফিসে বসে কাজ করছেন। তিনি যতক্ষণে কাজ সেরে এলেন ততক্ষণে সুভাষিণী চা বাগানটা একপাক ঘুরে দেখে নিয়েছে অর্জুন। চা-বাগানের মধ্যে একটা ফাঁদ পেতে রাখা হয় যাতে হিংস্র জানোয়াররা সেখানে ধরা পড়ে। অর্জুন দেখে এল ফাঁদটা রয়েছে কিন্তু কেউ সেখানে পা রাখেনি।

চায়ের সঙ্গে উপাদেয় জলখাবার খেতে-খেতে কথা হচ্ছিল। ভানুদা বললেন, তুমি তো জানো, আমি এডমন্ড হিলারির টিমে জায়গা পেয়েছিলাম যখন তিনি হিমালয়ে ইয়েতি খুঁজতে গিয়েছিলেন।

জানি। ওই অভিযানের স্লাইডগুলোর কথা এখনও মনে আছে।

এডমন্ড হিলারিসাহেব মারা গিয়েছেন। কিন্তু নিউজিল্যান্ড থেকে একটা টিম এখন কলকাতায় এসেছে। হিলারিসাহেবের টিমের একজন ইয়ং মেম্বার জন বেইলি এই দলের নেতা। জনের বয়স আমার মতনই। কাল রাত্রে কলকাতা থেকে জন আমাকে টেলিফোন করেছিল। ও আমার সাহায্য চাইছিল। কিন্তু ভাই, আমার বয়স হয়েছে। তা ছাড়া চা বাগানের এত সমস্যা যে, ম্যানেজার হয়ে এসব ছেড়ে আমি কোনও অভিযানে যেতে পারি না। আমার কোম্পানি খুশি হবে না; আমারও খারাপ লাগবে। তোমাকে ফোন করার পর আমি জনকে তোমার কথা ফোনে বললাম। আমি বলছি বলে ওর কোনও আপত্তি নেই তোমাকে দলে নিতে। ভানুদা বললেন।

এটা কীসের অভিযান হচ্ছে?

হিলারিসাহেব প্রমাণ করেছিলেন ইয়েতি বলে কিছু নেই। একধরনের তুষার-ভালুক মাঝে-মাঝে মানুষের মতো দুপায়ে হাঁটাচলা করে। পাহাড়ের লোকজন তাদেরই ইয়েতি বলে থাকে। আমরা একটা গুফায় ইয়েতির মাথা আছে শুনে দেখতে যাই। সেই মাথাটা আর ইয়েতির গায়ের চামড়া বলে ওরা যা দেখিয়েছিল তা লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে ওগুলো ভালুকের মাথা এবং চামড়া। কিন্তু এই ভালুকগুলোর চরিত্র অদ্ভুত। মানুষ যা করে তাই ওরা অনুকরণ করার চেষ্টা করে। মানুষের মতো হাঁটতে, ওপরের দুটো পা-কে মাঝে-মাঝে হাতের মতো ব্যবহার করতে ওরা খুব ওস্তাদ। জন এই ভালুকগুলোর ওপর ডকুফিল্ম তৈরি করতে এসেছে। ভানুদা ঠাট্টা করে বলেছিলেন, কে বলতে পারে, তুষার-ভালুক খুঁজতে গিয়ে তোমরা হয়তো তুষারমানবকে খুঁজে বের করতে পারো।

অর্জুনের মনে হয়েছিল ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। কিন্তু একটা কথা ভেবে সে হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু ভানুদা, আমি তো কোনওদিন পাহাড়ে চড়ার ট্রেনিং নিইনি। ছবিতে যা দেখেছি সেটা খুব কঠিন কাজ। দীর্ঘদিন ট্রেনিং না নিলে একদমই সম্ভব নয়। জনসাহেব আমাকে নেবেন কেন?

ভানুদা বলেছিলেন, ঠিকই। যদি অভিযানটা আমাদের মতো পায়ে হেঁটে পাহাড় ভেঙে করা হত তা হলে আমি তোমার কথা জনকে বলতাম না। ওরা ঠিক করেছে কাঠমণ্ড থেকে হেলিকপটারে চড়ে চোদ্দো হাজার থেকে যোলো হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ে গিয়ে বেসক্যাম্প করবে। সময় বাঁচানোর জন্যেই এটা

করবে ওরা। তোমাকে কাঠম যেতে হবে কালকেই।

কলকাতা হয়ে গেলে কাল কী করে কাঠমণ্ডুতে পৌঁছব?

তুমি কলকাতায় যাচ্ছ না। আগামীকাল সকাল এগারোটায় ভদ্রপুর থেকে প্লেনে উঠবে। শিলিগুড়ি থেকে জিপে ভদ্রপুর পৌঁছতে ঘণ্টাদুয়েক লাগবে। ভদ্রপুরে পৌঁছে মানিকলাল আগরওয়ালার ডিপার্টমেন্টাল শপে গিয়ে আমার নাম বলবে। আমি ফোন করে দিচ্ছি, টিকিট কাটা থাকবে।

ঠিক আছে। কিন্তু অত উচুতে যে ঠাণ্ডা হবে তার মোকাবিলা করার মতো পোশাক তো আমার নেই। যা আছে তাতে দার্জিলিং-এর শীতকে ম্যানেজ করা যায়। ওখানে কী করব?

এ নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। জন সব ব্যবস্থা করবে।

জিপ অন্ধকার চিরে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যতটা জোরে যাওয়ার কথা ততটা গতি উঠছিল না। রাস্তা এবুড়ো-খেবড়ো। বড় বড় গর্ত বাঁচিয়ে যেতে হচ্ছিল ড্রাইভারকে। এখন ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। অথচ মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে না তেমন। আর একটু পরেই জলদাপাড়ার জঙ্গল। অর্জুন ভাবছিল কোথা থেকে কী হয়ে গেল। আগামীকাল সে প্লেনে চেপে কাঠমণ্ড যাবে তা আজ বিকেলেও ভাবেনি। কিন্তু কাঠমণ্ডুতে গিয়ে জনসাহেবকে কোথায় খুঁজে পাবে সেটা তো ভানুদাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। কাঠমণ্ডুতে সে আগে কখনও যায়নি। তারপরেই সে নিজেকে বোঝাল, একটী অভিযান যখন হবে তখন নিশ্চয়ই নেপাল গভর্নমেন্ট সেটা জানবে? খোঁজ পেতে অসুবিধে হবে না।

এখন সত্যি বেকার বসে ছিল সে। সত্যসন্ধানকে জীবিকা হিসেবে নেওয়ার পর তার খাওয়া-পরার অভাব হয়নি। যদিও কলকাতা-দিল্লির অনেক গোয়েন্দা সংস্থা তাকে ভাল টাকা মাইনে দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে যায়নি। মূলত মা এবং জলপাইগুড়ির ওপর টান এর কারণ। এই যে সে কাঠমণ্ড যাচ্ছে, এর জন্যে কোনও অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা নেই। কোনও কেস নিয়ে সে যাচ্ছে না। কিন্তু জীবনে অর্থ রোজগার করাই তো সব নয়! এমন সুযোগ তো সহজে পাওয়া যাবে না।

জলদাপাড়ার জঙ্গলে না ঢুকে ডানদিকের রাস্তা ধরে মাদারিহাটের মধ্যে জিপ ঢুকে পড়ল। এবং তখনই বৃষ্টি নামল। এত বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি অনেকদিন দ্যাখেনি অর্জুন। রাস্তা ফাঁকা। দুপাশের বাড়িঘর, দোকানপাট সন্ধে পার না হতেই ঘুমন্ত। কোনওমতে জিপ যখন হাইওয়েতে গিয়ে উঠল, তখন ড্রাইভার বলল, সাব, কুছ দেখাই না যাতা হ্যায়।

হেডলাইট ফগলাইট জ্বালিয়েও কিছু দেখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গাড়ি চালালে দুর্ঘটনা ঘটবেই। অর্জুন বলল, রাস্তা ছেড়ে একপাশে সাইড করে রাখো।

বৃষ্টি পড়ছে, সঙ্গে শিল। জিপের টিনের ছাদে যেন দুরমুশ চলছে। ড়ুয়ার্সে বৃষ্টি একবার শুরু হলে সহজে থামতে চায় না। অথচ কাল ভোরে বেরোতে গেলে আজ রাত্রেই তাকে জলপাইগুড়িতে পৌঁছতে হবে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জামাপ্যান্ট, শীতবস্ত্র নেওয়া ছাড়া মাকে রাজি করাতে হবে। সে অবশ্য টেলিফোনে মাকে বলেছে ওগুলো একটা সুটকেসে গুছিয়ে রাখতে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে তা বলেনি। পাহাড়ে ওঠার কায়দা না জানা ছেলেকে মা সহজে যেতে দেবেন বলে মনে হয় না।

ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেল কিন্তু বৃষ্টি একই তেজে পড়ে চলেছে। শিলা বৃষ্টি আর হচ্ছে না, এই রক্ষে। প্লাবন না হলে এইসব রাস্তায় জল জমে না। হাওয়া শুরু হতে অর্জুন স্বস্তি পেল। ওই ঝোড়ো হাওয়া নিশ্চয়ই মেঘ উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সঙ্গে শব্দ হল প্রচণ্ড জোরে। ড্রাইভার হেডলাইট জ্বালাতেই দেখা গেল একটু দূরে একটা বড় গাছ রাস্তার ওপর পড়ে আছে। তার ডালপালায় রাস্তা ঢাকা। এই গাছের নীচে যদি এই জিপটাকে পার্ক করা হত তা হলে…। কল্পনা করতেই শিউরে উঠল অর্জন। ড্রাইভার বলল, সাব, এই রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। গাড়ি ব্যাক করে গয়েরকাটা দিয়ে চলে যাই।

লোকটা হিন্দিতে কথা বলছিল। যদিও ওটা ঘুরপথ হবে তবু তা ছাড়া তো কোনও উপায় নেই। বৃষ্টির জোর কমে এসেছিল। ড্রাইভার জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে দ্বিতীয় রাস্তা ধরল।

বৃষ্টি পড়েই চলেছে, তবে তার জোর কমে এসেছে। চারধার নিঝুম। অন্ধকার। কিন্তু অর্জুন জানে দুপাশে চা বাগান ছাড়া কোনও মানুষজন নেই। ঘুরপথে যেতে হচ্ছে বলে সময় বেশি লাগবেই। তার ওপর জিপের গতি বাড়ানো যাচ্ছে না, এত গর্ত। মিনিট চল্লিশ যাওয়ার পর হঠাৎ নজরে পড়ল, হেডলাইটের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল মোটর সাইকেলটাকে। রাস্তার পাশে গাছের গায়ে ধাক্কা খেয়ে মুচড়ে পড়ে আছে। আর তার ঠিক তিন হাত দূরে একটি মানুষ উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, মোটরবাইকটা জব্বর অ্যাকসিডেন্ট করেছে। বৃষ্টির জল লোকটির শরীর ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। অর্জুন অবাক হয়ে দেখল ড্রাইভার স্পিড বাড়িয়ে দিল। শরীরটাকে কাটিয়ে গর্ত উপেক্ষা করে এমনভাবে বেরিয়ে এল যেন ভূতে তাড়া করেছে। অর্জুন চিৎকার করল, আরে! গাড়ি থামাও। লোকটা তো বেঁচে থাকতে পারে। ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। গাড়ি থামাও।

অনেকটা দূরে চলে এসে ড্রাইভার বলল, নেহি সাব। ওরা ডাকাত হতে পারে। আমাদের ম্যানেজারসাহেব হুকুম দিয়েছেন, রাত্রে কেউ হাত দেখালে অথবা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলে পড়ে থাকলে কখনও যেন গাড়ি না থামাই।

কিন্তু এমন ঝড়বৃষ্টির রাত্রে অ্যাকসিডেন্ট হওয়াই তো সম্ভব। অর্জুন রেগে গেল।

ড্রাইভার জিপ থামাল না। মাথা নেড়ে বলল, সাব, লোকটা যদি সত্যি মরে গিয়ে থাকে তা হলে আমরা কিছুই করতে পারতাম না। চোট পেলে নিশ্চয়ই রক্ত বের হত। আমি কোনও রক্তের চিহ্ন দেখতে পাইনি। আর যদি অ্যাক্টিং হয় তা হলে আমরা এতক্ষণে শেষ হয়ে যেতাম। এসব রাস্তায় এইরকম ডাকাতি প্রায়ই হয়।

অর্জুন কিছু বলল না আর। ভানুদা তাকে তার লাল বাইকটা ওঁর ওখানে রেখে জিপে করে পাঠিয়েছেন। অর্জুন চেয়েছিল নিজের বাইকে জলপাইগুড়িতে ফিরে যেতে। ভাগ্যিস যায়নি, নইলে এই ঝড়বৃষ্টির অন্ধকার রাস্তায় তার অবস্থা যে ওরকম হত না তা কে বলতে পারে? কিন্তু লোকটার যদি সত্যি দুর্ঘটনা ঘটে থাকে, যদি এখনও ওর শরীরে প্রাণ থেকে থাকে, তা হলে প্রচণ্ড স্বার্থপরের মতো সে চলে এসেছে পাশ কাটিয়ে। বিবেকের দংশন ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠল অর্জুনের কাছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

ভারতবর্ষ থেকে নেপালে যেতে পাশপোর্ট এবং ভিসার প্রয়োজন হয় না। সীমান্ত আছে, সন্দেহজনক ব্যাপার ঘটলে দুদেশের পুলিশ এবং কাস্টমস সক্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু অর্জুনের ক্ষেত্রে কিছুই ঘটল না। শিলিগুড়ি থেকে জিপ তাকে ঠিক নটায় পৌঁছে দিল ভদ্রপুরে। ভদ্রপুর একটি সাধারণ শহর। মানিকলাল আগরওয়ালার দোকান খুঁজে পেতে অসুবিধে হল না। বেশ বড় দোকান। প্রচুর বিদেশি জিনিস সাজানো। অর্জুন শুনেছিল নেপালে বিদেশি জিনিস প্রচুর পরিমাণ পাওয়া যায়, এখন চোখে দেখল ক্যামে সাবান, জামান। নিভিয়া, ফরাসি পারফিউম, কী নেই! কিন্তু এখানে এসব জিনিস কেনে কারা?

মানিলাল আগরওয়ালা দোকানেই ছিলেন। মধ্যবয়সী স্মার্ট মানুষ। পরনে সাফারি সুট। ভানুদার নাম বলার আগেই বললেন, গুডমর্নিং অর্জুনবাবু। মিস্টার ভানু ব্যানার্জির ফোন পেয়ে আপনার জন্যে টিকিট বুক করে রেখেছি। আজ কোনও সিট ছিল না। একজনকে ক্যানসেল করাতে হল।

সে কী!

আরে, এ-নিয়ে ভাববেন না। এখানে এরকম হয়। আসুন, ভেতরে

আসুন। আপনার নিশ্চয়ই সকালে নাস্তা করা হয়নি। মানিকলাল সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন।

অস্বস্তি হচ্ছিল কিন্তু খিদেও পেয়েছিল। ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে সংকোচ কমে গেল। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মানিকলাল ওকে একটা খাম দিলেন, আপনার টিকিট। ফেরারটা ওপেন আছে। এখানে এসে আমি থাকি বা না থাকি, দোকানে বললেই আপনাকে শিলিগুড়িতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। আচ্ছা, আপনি কাঠমপুতে কদিন থাকবেন?

আমি জানি না। ওখানে যাওয়ার পর জানতে পারব।

আপনি ডোমেস্টিক ফ্লাইটে যাচ্ছেন। কোনও অসুবিধে হবে না। একটা ছোট প্যাকেট দিলে নিয়ে যেতে পারবেন?

কাউকে দিতে হবে?

হ্যাঁ। আসলে যাকে প্যাকেটটা পৌঁছে দিতে পাঠাচ্ছিলাম তার টিকিট ক্যানসেল করতে হল তো! কোন হোটেলে উঠছেন?

সেটাও ওখানে গেলে জানতে পারব।

জানা থাকলে আমার লোকই আপনার হোটেল থেকে নিয়ে যেতে পারত। ঠিকানা লিখে দিলে পৌঁছে দেওয়ার সময় হবে আপনার? দেখুন।

লোকটা এত উপকার করছে দেখে না বলতে পারল না অর্জুন। ভানুদার জিপ ছেড়ে দেওয়া হল। মানিকলাল, তাঁর গাড়িতে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। বেরোবার আগে একটা চৌকো সাদা পিসবোর্ডের বাক্স এগিয়ে দিয়েছিলেন, না, আপনাকে কষ্ট করে পৌঁছে দিতে হবে না। এয়ারপোর্টে আমার লোক এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবে। আমি ফোন করে দিচ্ছি।

কিন্তু তিনি আমাকে চিনবেন কী করে?

এই ফ্লাইটে আপনিই একমাত্র বাঙালি প্যাসেঞ্জার। তবু আপনার নাম-লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে ও বাইরে বেরোনোর গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে।

লোকটার নাম কী?

এস. কে. গুপ্তা। সাদা প্যাকেটটা সুটকেসে ঢুকিয়ে নিয়েছিল অর্জুন।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে প্লেন দেখে সে অবাক। কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণের কারণে প্লেন সম্পর্কে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে কোনও মিলই নেই। এমনকী, বাগডোগরা থেকে দমদমে যেসব প্লেন উড়ে যায় তার আভিজাত্য অনেক বেশি। ছোট্ট প্লেন। সাকুল্যে জনাআটেক প্যাসেঞ্জার বসতে পারে। প্রায় খেলনা-খেলনা মনে হয়। একজন বিমানসেবিকা আছেন। তাঁর স্থান পেছন দিকে। প্লেনটা যখন আকাশে উড়ল তখন বুক কাঁপছিল অর্জুনের।

কিন্তু ঠিকমতো পৌঁছে গেল ওরা। কাঠমণ্ডু শহরটা ভ্যালির মধ্যে বলে পাহাড়ি শহর থেকে একটু আলাদা। অথচ পাহাড় চারপাশে। এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার আগে মানিকলের কথা মনে পড়ল। কিন্তু তার নাম প্ল্যাকার্ডে লিখে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। মিনিটদশেক দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন। কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে না। এস, কে, গুপ্তার তো এখানেই আসার কথা। হতাশ হয়ে বাইরে বের হতেই ট্যাক্সিওয়ালারা ঘিরে ধরল অর্জুনকে। সবাই তাকে পৌঁছে দিতে চায়। ওদের মধ্যে একজন বাংলায় কথা বলল, সার, কোথায় যাবেন বলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি।

অর্জুন বলল, আমাকে ভাই আর-একটু অপেক্ষা করতে হবে। একজন এয়ারপোর্টে আসবে।

আপনার কোনও বন্ধু?

না। লোকটার কৌতূহল অর্জুনের পছন্দ হল না! কিন্তু ভিড়টা সরে গেল। তাকে ছেড়ে ট্যাক্সিওয়ালারা অন্য যাত্রী নিয়ে পড়েছে। এখানে কি ট্যাক্সিওয়ালারা বেশি প্যাসেঞ্জার পায় না? অর্জুন দেখল বাঙালি ড্রাইভারটি খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে। অর্জুন ঠিক করল আর অপেক্ষা করবে না। ফেরার সময় ভদ্রপুরে পৌঁছে মানিকলালকে তার প্যাকেট ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু এখন জন বেইলিকে খুঁজে বের করা তার প্রথম কাজ। নিউজিল্যান্ডের লোকজন নিয়ে এসেছেন অভিযান করতে, খবরটা এখানকার পর্বত অভিযান বিষয়ক দফতর নিশ্চয়ই জানবে। অর্জুন লোকটিকে ডাকল। বাঙালি হওয়ায় ওর কাছে সমস্যাটা বলা সহজ হবে।

লোকটি হাসল, যাবেন সার? দাঁড়ান। গাড়ি নিয়ে আসছি।

পার্কিং লট থেকে গাড়ি চালিয়ে এনে দরজা খুলে দিল ড্রাইভার, কোথায় যাব বলুন?

এখানকার মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট কোথায়?

কেন সার?

নিউজিল্যান্ড থেকে কয়েকজন অভিযাত্রীর আসার কথা। তাঁরা কোথায় উঠেছেন সেটা আগে জানতে হবে।

ও, তাই বলুন। লোকটা একগাল হাসল, এই গোপালকে জিজ্ঞেস করলেই সেটা জেনে যাবেন সার, কোথাও যেতে হবে না। কাল সন্ধের প্লেনে ওরা এসেছে সার। উঠেছে ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসে। আমি তখন এয়ারপোর্টে ছিলাম সার। ওই সাহেবদের সঙ্গে যদি দরকার থাকে তা হলে আপনাকে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি সার।

বাঃ। আপনি দেখছি বেশ চৌকস লোক। ওখানেই চলুন।

তা সার, কাঠমণ্ডর কোথায় কী হচ্ছে তার সব খবর আপনি এই গোপালের কাছে পাবেন। এই তো, কলকাতার একটা ছেলে পালিয়ে এসেছিল এখানে। তার বাবা আমার ট্যাক্সিতে ওঠায় আমি তাঁকে খবরটা দিয়ে দিলাম। এখানে তো আমার কম দিন হল না। ওই যে গাড়িটা দেখছেন, উলটে আছে, এক ঘণ্টা আগে অ্যাকসিডেন্টে ওর ড্রাইভার মারা যায়। যে জিপটা ওকে ধাক্কা দিয়েছিল তার পাত্তা পুলিশ কখনও পাবে কিনা জানি না। কিন্তু আমি জানি

ওটা একটা ভাড়া করা জিপ।

এত কথা জানলেন কী করে?

আরে আমি তো তখন প্যাসেঞ্জার নিয়ে এয়ারপোর্টে আসছি। পুলিশ ভাববে অ্যাকসিডেন্টে গুপ্তসাহেব মারা গেছেন। কিন্তু অদ্ভুত দিব্যি করে বলতে পারি সার, জিপটা গুপ্তসাহেবের গাড়িটাকে পাশ থেকে এমনভাবে ধাক্কা মেরেছে যে, উনি কন্ট্রোল রাখতে পারেননি।

অর্জুন সোজা হয়ে বসল, এই গুপ্তসাহেবের নাম কী?

সেটা এখনই বলতে পারব না সার। খোঁজ নিলেই, তা কেন, কালকের পেপারে পেয়ে যাবেন। ড্রাইভার মাথা নাড়ল।

লোকটার টাইটেল যে গুপ্তা তা আপনি জানলেন কী করে?

আরে বাপ। অতবড় ব্যবসায়ী। নেপাল, বুঝলেন, দুনম্বরি ব্যবসায়ীর কাছে স্বর্গের মতো। কিন্তু এই গোপালের ট্যাক্সিতে দুনম্বরি জিনিস সাপ্লাই করতে পারে না কেউ। গুপ্তসাহেবের লোককেও আমি ফিরিয়ে দিয়েছি।

এ হতে পারে না। অর্জুন আবার সিটে হেলান দিল। এস. কে. গুপ্তা একঘন্টা আগে এয়ারপোর্টে আসতে যাবেন কেন? আর এই গোপালের কথা যদি ঠিক হয় তা হলে অন্য লোক তাঁকে দুর্ঘটনায় জড়িয়ে মেরে ফেলবে কেন? তার তো জানার কথা নয় উনি এখনই এয়ারপোর্টে আসছেন। কারণ সে ভদ্রপুর থেকে রওনা হওয়ার পর গুপ্তসাহেব ফোনে জানতে পেরেছেন তাকে এয়ারপোর্টে যেতে হবে। এ নিশ্চয়ই অন্য লোক।

ইন্টারন্যাশনাল গেস্ট হাউসের সামনে গাড়ি থামিয়ে গোপাল জিজ্ঞেস করল, কদিন থাকবেন সার? দরকার হলেই বলবেন!

আমি তো বললাম এখনও কিছুই জানি না। কত দিতে হবে?

দুশো দিয়ে দিন সার।

দুশো? রাস্তা তো বেশি নয়।

অন্য কেউ হলে আরও বেশি চাইত। তা ছাড়া আপনার ঘোরাঘুরির ঝামেলা বাঁচিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় যে পৌঁছে দিল সেই গোপালকে একটু দেখবেন না সার। হাসল গোপাল।

রিসেপশনে পৌঁছে অর্জুন জন বেইলির খোঁজ করল। আপনি কি ইন্ডিয়া থেকে আসছেন?

হ্যাঁ।

অর্জুন?

হ্যাঁ।

এনি আইডেন্টিটি কার্ড, প্লিজ?

অর্জুন পাশপোর্ট সঙ্গে নিয়ে এসেছিল কিছু না ভেবেই। সেটা বের করে দেখাল। রিসেপশনিস্ট সেটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, রুম নাম্বার টু হান্ড্রেড সেভেন। মিস্টার বেইলি কাজে বেরিয়েছেন।

আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?

মিস্টার বেইলি আপনার নামে ঘর বুক করেছেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress