Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আলেকজান্ডার || Sankar Brahma

আলেকজান্ডার || Sankar Brahma

ইতিহাস পড়তে টুকাইয়ের বেশ ভালই লাগে। মজা পায় পড়ে। কতকাল আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা সব, যেন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ঘটতে থাকে। কখনও কখনও টুকাই যেন তা চোখের সামনে সুস্পষ্ট দেখে। একেবারে নিখুঁতভাবে যেন ঘটে চলেছে সেসব ঘটনা।

আগামীকাল ইতিহাস পরীক্ষা থাকায়, ইতিহাস বইটা খুলে, টুকাই পড়তে বসেছিল। পড়ছিল আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণের কাহিনি।

” খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ অব্দে সম্ভবত নৌকার সাহায্যে আলেকজান্ডার সিন্ধু নদ পার হয়ে ভারতে আসেন। এই সময় তিনি আকামেনিদীয় সাম্রাজ্যের গান্ধার প্রদেশের অধীন ও তৎসংলগ্ন সমস্ত রাজা ও গোষ্ঠীপ্রধানদের তাঁর কাছে বশ্যতা স্বীকার করার জন্য আহ্বান জানান। তক্ষশীলার রাজা অম্ভি (গ্রিক উচ্চারণে অমফিস) তাঁর নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন। সবাই কিন্তু তাঁর এই আহ্বান বিনা প্রতিরোধে মেনে নেয়নি। ফলে তিনি এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান শুরু করেন তিনি। পুষ্কলাবতীর রাজা অষ্টককে আলেকজান্ডার পরাজিত করেন, অশ্বক জাতিও তাঁর নিকট পরাজিত হয়। ঝিলাম রাজ পুরু বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেন এবং সর্বপ্রথম আলেকজান্ডারকে পরাজয় মানতে বাধ্য করেন । তারপর আরেকজাণ্ডার ভারতে প্রায় ১৯ মাস ছিলেন। পরাজিত , বিধ্বস্ত ও রণক্লান্ত সৈনরা দেশে ফেরার জন্য উণ্মুখ হয়ে উঠলে আলেকজাণ্ডার ভারত অভিযান বন্ধ করে গ্রিসে ফেরা শুরু করেন। ফেরার পথে তিনি বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাব দখল করেন। ঝিলাম নদী ও সিন্ধু নদের অন্তবর্তী সকল রাজ্য দখল করেন। তিনি ভারত ছাড়ার পর প্রায় দু’বছর, তার বিজিত অঞ্চলসমূহে গ্রিক শাসন বজায় ছিল। ভারত থেকে ফিরে কিছুদিন পর খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ অব্দে ব্যবিলনে তার অকাল মৃত্যু হয়। অন্যদিকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের নেতৃত্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা পাঞ্জাবে গ্রিক শাসনের অবসান ঘটায়।”

এইসব ঘটনা ছেড়ে, টুকাই ভাবতে থাকে, ভারতে প্রায় ১৯ মাস থেকে, ওই সময়টা আলেকজাণ্ডার কি করে কাটিয়েছিলেন? একমাত্র আলেকজাণ্ডারই তা বলতে পারবেন। ইতিহাসবিদরা এ ব্যাপারে তেমন কোন আলোকপাত করতে পারেননি।

এই ভাবনা নিয়ে সে এতটাই মগ্ন ও অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে, সে খেয়ালই করেনি, কখন বইয়ের পাতা থেকে বের হয়ে এসে আলেকজাণ্ডার তার সামনে দাঁড়িয়েছেন।
তিনি টুকায়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, শোন তবে, তোমার যখন এত কৌতূহল ওই ১৯ মাস আমি কি নিয়ে কাটিয়ে ছিলাম।
টুকাই অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকায়।
তিনি বলতে শুরু করলেন, ভারতে এসে আমি শুনেছিলাম, এখানে এমন অনেক মুনিঋষি আছেন যারা যোগবলে মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র আয়ত্ব করতে পেরেছেন। তাঁরা নাকি নির্জনে পাহাড়ের গুহায় বসে তপস্যা করেন। তাদের দেখা পাওয়া মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। আমি আমার সৈন্যদের বিভিন্ন সম্ভাব্য জায়গায়, তাদের খোঁজে পাঠালাম। যদি তেমন কোনও মুনি-ঋষির খোঁজ তারা পায়, তবে আমাকে তারা খবর পাঠাবে।
দিন যায়, মাস যায়, বছরও গড়িয়ে যায়, কোনও খবর আসে না তাদের কারও কাছ থেকে। তখন আমি ভাবলাম, এসব গুজব রটনা। তেমন কোন মুনি-ঋষি থাকলে এতদিনে সৈন্যরা নিশ্চয়ই আমায় খবর পাঠাত। ভাবলাম, আর নয় এবার আমায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে যেতে হবে আমার মাতৃভূমি ম্যসিডনে, অনেকদিন দেশ ছাড়া। সৈন্যরাও দেশে ফেরার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
দেশে ফেরার তোড়জোড় শুরু করেছি, এমন সময় একদল সৈন্য খবর পাঠাল, তেমন একজন সাধকের দেখা পেয়েছে তারা, যিনি মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র আয়ত্ব করেছেন।
আমি দূত (চিঠি লিখে পায়রার পায়ে বেঁধে দিয়ে) মারফৎ খবর পাঠালাম সৈন্যদের কাছে, তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসতে।
সৈন্যাদক্ষ লিখে পাঠাল (ওই পায়রার পায়ে বেঁধে) সাধক জানিয়েছেন যে, তিনি কারও দাস নন যে রাজা ডাকলেই তাকে সেখানে যেতে হবে। রাজার কোন দরকার থাকলে, রাজাকেই তার কাছে আসতে হবে।
তখন সৈন্যাদক্ষ তাকে ভয় দেখিয়ে বলে, তিনি না গেলে তার মুন্ডু কেটে, তারা রাজার কাছে নিয়ে যাবে। তা শুনে, তিনি মৃদু হেসে বলেন, তবে তাই করো। তোমরা আমার মুন্ডটাই কেটে নিয়ে যাও তোমাদের রাজার কাছে। তিনি যা জানতে চাইছেন, আমার কাটা মুন্ডটাই তার জবাব দেবে।
সৈন্যাদক্ষ বুঝলেন, তাই করলে তবে কোনদিনই রাজার আর তা জানার উপায় থাকবে না। সে কথা সে আমায় জানল।
– আপনি তখন কি করলেন?
টুকাই প্রশ্ন করে আরেকজাণ্ডারকে।
– কি আর করব? বাধ্য হয়ে আমিই গেলাম তার কাছে।
– গিয়ে কি দেখলেন?
– দেখলাম, এক সুদর্শন দৃঢ়চেতা শীর্ণকায় সাধক মেরুদন্ড সোজা করে ধ্যানরত অবস্থায় বসে আছেন গুহার ভিতরে।

কখন তার ধ্যান ভাঙবে, এই ভেবে আমি তার অপেক্ষায় গুহার বাইরে এসে বসে রইলাম। একদিন যায়। দু’দিন যায়। এইভাবে তিনদিন কেটে গেল, তাঁর ধ্যান আর ভাঙছে না দেখে আমি মনে মনে অস্থির হয়ে পড়েছি। এমন সময় তিনদিন পর, তিনি সহাস্য মুখে গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে মধুর স্বরে সম্বোধন করে আমায় বললেন, আসুন রাজন। বলে তিনি আমাকে আপ্যায়ন করে গুহার ভিতরে নিয়ে গেলেন। আমি তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। গুহার ভিতরে ঢুকে আমি তাকে করজোড়ে ভারতীয় হিন্দুদের রীতি অনুযায়ী সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাম। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে, আমার বাসনা তার কাছে নিবেদন করলাম। তিনি তা শুনে আমার চোখের দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে এত দীপ্তি ছিল যে আমার চোখের দৃষ্টি আপনা-আপনি নীচে নেমে এলো।
এরপর ধীরে ধীরে তিনি বললেন, সে বড় কঠিন কাজ।
– আমি পারব। আমি দৃঢ় কন্ঠে জানালাম তাকে।
– পথ খুব দুর্গম। ঘোড়া যাওয়ার উপযুক্ত নয়। ঘোড়া নিয়ে সেখানে যাওয়া যাবে না। পায়ে হেঁটেই যেতে হবে। দশ দিনের পথ। খাবার বলতে গাছের ফল আর ঝর্ণার জল। রাতে বিশ্রাম নিতে হবে গাছের তলায়।
– আমি তাই কবর। আপনি বলুন, দৃঢ় স্বরে বললাম আমি।
– প্রথম তিনদিন এই পথ ধরে পশ্চিমদিকে হাঁটবে,
তারপর তিনদিন উত্তর দিকে হাঁটবে, তারপর তিনদিন পূর্বদিকে হাঁটবে। শেষ দিনে দক্ষিণ দিকে হাঁটবে। পরদিন সকালে সামনে একটি সবুজ জলের কুন্ড দেখতে পাবে। সেখান থেকে দু’কোষ জল পান করলেই অমরত্ব লাভ করবে। পথে চিতা, ভালুক, ময়াল, বাইসন,তাকিন (বড় সিং-অলা জংলি ছাগল) প্রভৃতি হিংস্র জানোয়ার আছে, খুব সাবধানে যেতে হবে।
আমি তার কথা শুনে, তাকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম গুহা থেকে।
তারপর আমার বিশ্বস্থ বাছা বাছা পাঁচজন সৈন নিয়ে তীর ধনুক আর তরবারী সহ আমরা যাত্রা শুরু করলাম পরদিন ভোর থেকেই।
প্রথমদিন পশ্চিমদিকে দিকে যাবার পথটা হেঁটে যেতে খুব একটা কষ্ট হল না।
পথ মোটামুটি বন্ধুর। হাঁটতে হাঁটতে গাছের ফলমূল আর ঝর্ণার জল খেয়ে, রাতে একটা গাছের তলায় সকলে বিশ্রাম নিলাম। পরদিন সকালে আবার হাঁটা শুরু করলাম। পথ বেশ খাড়াই উতরাই ঢেউ খেলানো। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। এভাবে কষ্ট করে হাঁটতে হাঁটতে পথে ফলমূল যা পেলাম খেলাম। এরপর ঝর্ণার স্বচ্ছ-ফটিক জল পান করে তৃপ্ত হলাম। তারপর রাত নেমে এলে, একটা গাছের তলায় বিশ্রামের আয়োজন করলাম।
সারাদিনের পথের ক্লান্তিতে সকলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটা আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। একটা চিতাবাঘ গাছ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একজন সৈন্যকে ঘাড়ে কামড়ে ধরে বনের মধ্য বিলীন হয়ে গেল। এত আকস্মিকভাবে ঘটনাটা ঘটে গেল যে আমরা সকলে বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। বাকী রাতটা জেগে কাটল। সকালে আবার রওনা দিলাম বাকীরা সকলে। সারাদিন হেঁটে হেঁটে ফলমূল আর ঝর্ণার জল পান করে, দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে রাতে একটা বিশাল ঝাকড়া গাছের তলায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করলাম। ঠিক করা হল পালা করে একজন রাত জেগে পাহাড়া দেবে। তাই করলাম। গাছের গুঁড়ির মতো একটা জিনিষ দেখে, তাতে বসে একজন সৈন্য রাত পাহারা দিতে লাগল।
আমরা বাকীরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলে দেখলাম, সেই সৈনিক নেই, গাছের গুঁড়িটাও উধাও।
আমি তো অবাক। একজন সৈন্য সন্দেহ প্রকাশ করে বলল, ওটা বোধহয় গাছের গুঁড়ি ছিল না।
– তবে কি ছিল?
– ময়াল সাপ।
এভাবে দু’জনকে হারিয়ে, আমার মনটা ভেঙে গেলেও অন্য সৈনিকদের কাছে তা প্রকাশ করতে পারলাম না। কারণ তাতে তারা হতাশ হয়ে পড়বে।

সকালে উঠে দেখলাম, বন আর পাহাড়ের কোল ঘেষে একটা সরু সংকীর্ণ পথ উত্তর দিকে চলে গেছে। আজ থেকে সেদিকে আমাদের যেতে হবে। আমরা চারজন সকাল সকাল রওনা দিলাম সেদিকে।
তিনদিন এভাবে উত্তর দিকে হাঁটার পর আমরা পৌঁছালাম একটা গভীর বনের কাছে, এবার আমাদের যেতে হবে পূর্বদিকে। সেই পথটা চলে গেছে বনের ভিতর দিকে। আমরা সেখানে গাছের তলায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করছি। এমন সময় একদল বাইসন বনের দিক থেকে এদিকেই ছুটে আসছে দেখে, একজন সৈন্য তাদের দিকে তাক করে তীর ছুঁড়ল। তীরের ফলায় একটি বাইসন আহত হলে, তারা ক্ষেপে গিয়ে দলবেঁধে সেই সৈন্যটিকে তাড়া করে নিয়ে গিয়ে খাদে ফেলে দিল। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটল। তিনজন সৈন্যকে হারিয়ে বড় মর্মপীড়া হচ্ছিল আমার। কিন্তু কিছু করার নেই। আমাকে সবুজ জলের কুন্ড থেকে অমৃত পান করে অমর হতে হবে।
রাতটা আমরা তিনজনেই খুব সতর্ক হয়ে কাটালাম। ঘুম এলো না কারও চোখে। সকাল হতেই তিনজনে বেরিয়ে পড়লাম। গভীর বনে ফলের কোন অভাব হল না। ঝর্ণা না পেয়ে আমরা নদীর জল পান করলাম।
এভাবে দু’দিন কেটে গেল। তৃতীয় দিনে গভীর জঙ্গের মধ্যে আমরা পথ হারিয়ে ফেললাম। অসহায়ের মতো কোন দিকে যাব আমরা কেউই বুঝতে পারছি না। এদিকে দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে। এমন সময় ভালুকের তাড়া খেয়ে আমরা যে দিকে পারলাম, ছুটতে শুরু করলাম। ঘন জঙ্গলে ছোটা সহজসাধ্য নয়।
ইতিমধ্যে একজন সৈন্যকে টার্গেট করে ছুটতে ছুটতে ভালুকটা তাকে ধরে ফেলল। তার মৃত্যু অনিবার্য বুঝে আমরা দু’জনেই ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ এই মন্ত্রে ভর করে, তাকে ফেলে রেখে পালালাম। দেখতে দেখতে রাত নেমে এলো। এবার বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে। কাল একদিন পার হলেই সবুজ জলের কুন্ডের সন্ধান মিলবে। দু’জনেই গাছের উপর উঠে আশ্রয় নিলাম। নির্ঘুম রাত কাটল।
ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও পরদিন সকালে প্রবল উৎসাহ নিয়ে দু’জনে হাঁটা শুরু করলাম দক্ষিণ দিকের খাদের ধার ঘেষে সরু পথ দিয়ে উপরের দিকে। খুব সাবধানে পাথরের উপর পা ফেলে হাঁটতে আমাদের খুব বেগ পেতে হচ্ছিল। একটু অসতর্ক হলেই পাথর গড়িয়ে খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবল। পথে কিছু ফল আর ঝর্ণার জল পান করে পেট ভরালাম। আমাদের চলার পথ থেকে কিছুটা দূরে, বড় সিং-অলা জংলি ছাগল তাকিন চোখে পড়ল দু এক জায়গায়। তারা আমাদের দিকে ফিরেও তাকাল না। জন্তুগুলিকে দেখে আমার খুব একটা হিংস্র বলে মনে হল না। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকার নেমে এলে, আমরা একটা আশ্রয়ের খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। আমি ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত। রাত পোহালেই মিলবে অমৃত কুম্ভের সন্ধান।
সৈনিকটি গভীর খাদের ধারে পাহাড়ের গায়ে একটি কোটর দেখতে পেয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়ার কথা বলল, আমাকে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমি বললাম, আমি প্রথম রাতের প্রথম ভাগটা জেগে থাকছি, পরেরটা তুমি জেগে পাহারা দিয়ো। সে খুশি হয়ে সেখানে বিশ্রামের আয়োজন করে শুয়ে পড়ল। একটু পরেই নাক ডাকতে শুরু করল।
আমি বসে বসে ভাবতে লাগলাম। কাল সকালে যদি দু’জনেই অমৃত কুন্ডের জল পান করে অমর হয়ে যাই। তাহলে হয়তো তখন এই সৈন্যটিই আমার সিংহাসনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। কারণ তখন আর তাকে মারা যাবে না। সে যে অমর হয়ে যাবে। তাই এই তো সুবর্ণ সুযোগ। আমার পথের কাঁটা দূর করে ফেলার জন্য। এই সুযোগটাকে নষ্ট করলে, সে হয়তো জেগে উঠে, আমি শুতে গেলে, আমাকেই হত্যা করে, সে একা অমর হয়ে গিয়ে, আমার সিংহাসনের অধিকারী হয়ে বসবে। সে কথা মনে হতেই, আমি কোষ থেকে তরবারি বের করে এক কোপে, তার দেহ থেকে মুন্ডুটা দ্বিখন্ডিত করে ফেললাম। কিছুক্ষণ ছটফট করে দেহ আর মুন্ডটা স্থির শান্ত হয়ে গেল। তরবারীটা সৈনিকের পোষাক দিয়ে মুছে খাপে ভরে রাখলাম। তারপর আমি তার দেহ আর মুন্ডটা খাদে ফেলে দিলাম। এ কাজ করে আমার মোটেই অনুশোচনা হল না। কারণ, নিজের সিংহাসন বজায় রাখতে গিয়ে, এ কাজ আমাকে আগেও বহুবার করতে হয়েছে। তারপর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ঘুম ভেঙে সূর্যোদয় দেখে মনটা ভরে গেল আমার।
” ওঁং নমঃ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্ৰণতোঽস্মি দিবাকরং। ওঁং “
কোথা থেকে যেন এই ধ্বনি আমার কানে ভেসে এলো। আর মনেহল অমৃত সুধা পান করে আজই আমি অমরত্ব লাভ করব। এ কথা ভেবে হৃদয় নেচে উঠল। ছুটলাম সেই সবুজ কুন্ডের সন্ধানে।
একটু খোঁজাখুঁজি করতেই সে কুন্ডের দেখা পেলাম। সাধককে স্বকৃতজ্ঞ প্রণাম জানিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। বুকের ভিতরটা আনন্দে কেমন করতে লাগল। কুন্ডের কাছে গিয়ে, কোন দিকে না তাকিয়ে আমি কুন্ড থেকে দু’হাতে আঁজল তুলে জল পান করতে যাব। এমন সময় কে যেন বলে উঠল। দাঁড়াও।
আমি মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলাম, কুন্ডের ওপারে এক ভূশন্ডি কাক বসে। সে বলল, এই জল পান করে আমি আর মরতে পারছি না। আমার চোখের সামনে আমার সমস্ত পরিজনদের আমি মরতে দেখছি। কিন্তু নিজের মরণ নেই। আত্মহত্যা করেও মরতে পারছি না। তুমি কি চাও, তোমার চোখের সামনে এক এক করে সমস্ত পরিজনদের মরে যাবে, তা তুমি দেখবে। অথচ তুমি মরতে পারবে না। তার কথা শুনতে শুনতে আমার আমার আঁজলা থেকে ফোঁটা ফোঁটা করে সব জল কুন্ডে পড়ে গেল, হাত শূন্য হয়ে গেল। আমি কুন্ড ছেড়ে উঠে এলাম উপরে। এমন অমরতা আমার চাই না।
বলতে বলতে আলেকজাণ্ডার আবার ইতিহাসের বইয়ের পাতায় সেঁটে গেল।

টুকায়ের মা ঘরে ঢুকে দেখলেন, চেয়ার টেবিলে বসে পড়তে পড়তে, টুকাই কখন টেবিলে খোলা বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress