আফগানিস্থানের কবিতা
১). প্রথম পর্ব
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে নতুন প্রজন্মের কবিদের একটা বড় অংশ দেশের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, মৌর্য সাম্রাজ্য, মুসলিম আরব, মোগল, ইংরেজ, সোভিয়েত রাশিয়া এবং সবশেষে আমেরিকা এবং ‘ন্যাটো’র দেশগুলো এরা প্রত্যেকেই একে একে আফগানিস্তানে এসেছে। যুদ্ধ করেছে। হত্যা করেছে। একটি সমৃদ্ধ দেশকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ছিবড়ে করে দিয়েছে। আর এই হিংস্র বাতাবরণে জন্ম নিয়েছে প্রথমে ‘মুজাহিদিন’ এবং পরে ’তালিবান’-এর মত গোঁড়া ইসলামিক সংগঠনগুলি। যাদের একমাত্র ভাষা ছিল সন্ত্রাসবাদ। অদ্ভুত ব্যাপার আমেরিকা ‘সোভিয়েত’ বিরোধিতার অজুহাতে এই সন্ত্রাসবাদী দলগুলিকে অর্থ এবং মারণাস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করেছে পাকিস্তান ও সৌদি আরবের সঙ্গে হাত মিলিয়ে।
‘ওসামা-বিন-লাদেন’ এই প্রক্রিয়ারই বাই-প্রোডাক্ট। এ’ভাবেই বারেবারে ক্ষত বিক্ষত হয়েও আফগানিস্তান কিন্তু বেঁচে থেকেছে। কবিরাও, মরতে মরতে লড়তে লড়তে বেঁচে থেকেছে। আর তাই তাদের লেখা কবিতাও মরেনি।
আফগান কবিরা সাধারণত ‘পুস্তু’ এবং ‘দারি’(ফার্সি) ভাষায় কবিতা লেখেন।
কবিতার মৌখিক এবং লৈখিক রূপান্তর শিখরে পৌঁছায় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ‘জালালুদ্দীন রুমি বাল্খি’র কবিতায়। ‘বাল্খ’ আফগানিস্তানের একটি অঞ্চল, এখানেই ‘রুমি’র জন্ম হয় ১২০৭ সালের, ৩০ সেপ্টেম্বর।
পাঠকমাত্রই জানেন যে, ধার্মিকতা (ইসলামিক সুফিয়ানা) আর দর্শন এক অপূর্ব ‘মিস্টিক’ আবহ সৃষ্টি করে চলে ‘রুমি’র কবিতায়। যা এখনও মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। রুমি’র জন্ম আফগানিস্তানে হলেও, ভ্রাম্যমান এই দরবেশ নানা জায়গায় ঘুরে শেষ বয়সে ‘আনাতোলিয়া’তে স্থায়ী হন। ফার্সি ভাষায় রচিত তাঁর গজল এবং অন্যান্য সৃষ্টি এখন বিশ্ব সাহিত্যের সম্পদ। রুমি’র অফুরন্ত সৃষ্টির সমুদ্র থেকে একটি বিন্দু সুধারস –
জালালুদ্দীন রুমি’র একটি কবিতা
আমি মাঝে মাঝে ভুলে যাই, বন্ধুত্ব কাকে বলে?
অজ্ঞান এবং পাগল আমি
সব জায়গায় দুঃখ ছড়াতে থাকি,
আমার গল্পটাকে নানাভাবে বলা যায়,
প্রেমে ঢেলে, নোংরা রসিকতা দিয়ে বানিয়ে
একটা যুদ্ধ লাগিয়ে, এমনকি ফাঁকাতেও
আমার ক্ষমাকে ভাগ করে নাও
যে কোন সংখ্যা দিয়ে
ক্ষমা ঘুরে বেড়াবে
এই অন্ধকার উপদেশগুলো,
যা আমি অনুসরণ করি
তারা কি কোনও পরিকল্পনার অংশ
বন্ধুরা, সাবধান
চরম ঔৎসুক্য বা সমবেদনা নিয়ে
আমার কাছে এসো না।
রুমি’র পরে আফগানিস্তানের আর এক কিংবদন্তি কবি হলেন, ‘কুশাল খান খট্টক’।
খট্টক, সপ্তদশ শতাব্দীর কবি এবং আফগানিস্তানের জাতীয় কবিও বটে। খট্টকের কবিতায় দেশপ্রেম, বীরগাথা, প্রেম ইত্যাদির প্রাধান্য ছিল। রুমির রহস্যময়তার আবরণ ছিঁড়ে খট্টক কিছুটা কথ্য ভাষার আঙ্গিকে লিখে আফগান কবিতাকে সমৃদ্ধ করে তোলেন।
পড়ে দেখা যাক তাঁর একটি কবিতাঃ
‘ আমার বাষট্টি বছর বয়ে গেছে
আনন্দ ছিল, দুঃখও, মসৃণও ছিল
আর এখন আমার চুল আর কালো নয় ধবধবে শাদা,
তবে মনে মনে আমি এখনো তরুণ
পেরিয়ে এসেছি শোক, সংগ্রাম, বরফ, তুষার
আর এখনো দাঁড়িয়ে আছি,
দেখছি চারদিকে সোনালি গ্রীষ্ম হেসেখেলে বেড়াচ্ছে।’
আফগানিস্তানের মহিলা কবিদের (ফার্সি ভাষায়) মধ্যে প্রাচীনতমা হলেন রাবিয়া বাল্খি।
সম্ভবত ৯১৪-৯৪৩ খৃষ্টাব্দে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তখন সামানিন্দ এমির নাসের-২ এর রাজত্বকালে। রুদাকি ছিলেন ওই সময়কার রাজ-কবি। রাবিয়াও ওই সময়েই ফার্সি ভাষায় কবিতা লিখেছেন। অসামান্যা রূপসী ছিলেন রাবিয়া। সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা। তাঁর বাবা ‘কা-আল-কুজদারি’ ছিলেন সামানিন্দ রাজসভার সম্মানিত গোষ্ঠিপতি। যাইহোক, রাবিয়া কবিতা লেখার সূত্রেই, বাখতাস নামের এক তুর্কি দাসের সঙ্গে রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাখতাসও কবিতা লিখতেন। হ্যারিস, রাবিয়ার ভাই। বাবা ‘কা-আল-কুজদারি’র মৃত্যুর পরে হ্যারিস গোষ্ঠিপতি হয়। গোপনসূত্রে সে জানতে পারে বোনের প্রণয় সম্পর্কের কথা। ক্ষিপ্ত হ্যারিস বোন রাবিয়ার হাতের শিরা ছিন্ন করে তাকে স্নানাগারে আটকে রেখে দেয়। পরে রক্তক্ষরণ হতে হতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাবিয়া, ফার্সি কবিতার প্রথম মহিলা কবি! হ্যারিস একইসঙ্গে বাখতাসকে বন্দী করে একটি কুয়োয় ফেলে দেয়। বাখতাস কোনওমতে নিজের শক্তি আর বুদ্ধির প্রয়োগ করে কুয়ো থেকে উঠে আসে এবং হ্যারিসকে হত্যা করে। এরপর রাবেয়া’র খোঁজে বেরিয়ে পড়ে বাখতাস এবং জানতে পারে রাবেয়ার মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা। তীব্র শোক আর হতাশায় আত্মহত্যা করে বাখতাস।
চূড়ান্ত এই ‘রোমান্টিক ট্র্যাজেডি’ ফার্সি ভাষার প্রভাবাধীন অঞ্চলে বহু শতাব্দী ধরে ‘মিথ’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। আজ এতদিন পরেও চোখ জল এনে দেয় এমন মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেম। কবিতা বেঁচে থাকে শুধু, আর বেঁচে ওঠে এমনভাবেই।
কবিতা তাই প্রবাহমান ।
রাবিয়ার কবিতা এমনিতে দুষ্প্রাপ্য। একটি কবিতার ভাবানুবাদ পাঠকদের জন্য –
প্রেম
…….
ভালবাসার এক মিথ্যে জালে জড়িয়ে আছি
ব্যর্থ আমি, সবকিছুতেই ব্যর্থ ভীষণ
প্রেম-জরজর রক্তচাপে বিদ্ধ আমি
দেখতে পাচ্ছি যা কিছু আমার খুব প্রিয় ছিল, হারিয়ে গেছে কোথায় কখন
ভালবাসা এক সমুদ্র
তার বিশাল ঢেউয়ে কেইবা পারবে সাঁতার দিতে, পারবে কি ঠিকানাবিদ্ধ হতে প্রেমিক?
সে তো চির বিশ্বস্ত ,
তার অনিত্য হাতের বেড়ে ধরে রাখবে উথালপাথাল,
ধরে রাখবে শপথ করেই
যা কিছু ভুল ছলনা বিভোর,
মুছে দেবে সব নিভৃত কালো
প্রেমিক যদি, বিষ খেতে খেতে বলে উঠবে,
কী যে মিষ্টি, কী-ই যে ভাল।
আফগান কবিতা’র সমসাময়িকতা ওই দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে গড়ে উঠেছে। দেশের টালমাটাল অবস্থা এবং ‘বারবাক কারমাল’কে হত্যা করার পরে ধীরে ধীরে জেঁকে বসা ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সন্ত্রাস প্রায় অধিকাংশ সৃষ্টিশীল কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকর, চলচ্চিত্র পরিচালককে দেশান্তরী হতে বাধ্য করেছে।
যে কোনও স্বৈরাচারী শাসনেই এটা ঘটে থাকে। ‘পারতো নাদেরি’ আফগানিস্তানের অত্যন্ত সম্মানিত কবি। সোভিয়েত হস্তক্ষেপের সময় এঁকে তিন বছর ‘জেল-এ থাকতে হয়।
১৯৫৩ সালে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের ‘বড়কশান’-এ ‘নাদেরি’র জন্ম। কাবুল ইউনিভার্সিটির স্নাতক হন ১৯৭৬ সালে।
জেল ইত্যাদি খাটার পরেও তাঁকে দেশান্তরী হতে হয়ে ছিল। ‘নাদেরি’ জেল থেকে বেরিয়ে কবিতা লিখতে শুরু করেন। মূলতঃ রোমান্টিক এবং ফ্রি-ভার্সে দক্ষ ‘নাদেরি’ এখন আফগানিস্তানের ‘পেন’ শাখার সভাপতি। ‘পারতো নাদেরি’র একটি কবিতা’র অনুবাদ –
নির্জনতা
…………
তোমার হাতের রেখায়
তারা লিখে রেখেছে সূর্যের ভাগ্য
ওঠো, হাত তোলো
এই দীর্ঘ রাত আমার শ্বাসরোধ করে রেখেছে।
শাকিলা আজিজ্জাদা’র জন্ম কাবুলে, ১৯৬৪ সালে। ফার্সিতে লেখেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখি শুরু। শাকিলাও আফগানিস্তানের যুদ্ধাক্রান্ত সময়ের কবি। তবে অপ্রত্যক্ষভাবে। কারণ কাবুল থেকেই আইনে স্নাতক হয়ে শাকিলা ‘নেদারল্যান্ডস’-এ চলে যান ‘ওরিয়েন্টাল ল্যাংগুয়েজ অ্যাণ্ড কালচার’ নিয়ে পড়াশোনার জন্য। এখন তিনি ওখানেই থাকেন। ‘নেদারল্যান্ডস’-এ থাকার ফলে শাকিলা উন্মুক্ত মনে তাঁর অনুভূতি কবিতায় প্রকাশ করতে পেরেছেন। শাকিলার কবিতায়, নারীর শারীরিক এবং মানসিক অবস্থাকে উদারমনস্ক খোলামেলা দৃষ্টি-ভঙ্গিতে লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি।
প্রায় দু-দশক ধরে চলতে থাকা চরম রক্ষণশীল এবং মারমুখি ধর্মীয় গোঁড়াদের শাসনে যা সম্ভবপর ছিল না।
শাকিলা ‘প্রলিফিক রাইটার’। দুটি কবিতার বই আছে তাঁর।
প্রথম বইটি দ্বিভাষিক, ডাচ এবং ফার্সি ভাষায় লেখা। নাম, স্মৃতিকথা, শূন্যতার।
২০১২ সালে প্রকাশিত আরেকটি সংকলন শাকিলার- ‘আজিজ্জাদার কবিতা’ প্রকাশিত হয়, ফার্সিতে লিখিত এবং সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ। শাকিলার একটি কবিতার ভাবানুবাদ –
একটি পালক
…………………..
আমার স্বপ্ন ঠিক যেভাবে
তোমার পায়ের শব্দ শোনে,
সেই যে তুমি যখন পা টিপে টিপে ভেতরে আসো
তুমি বেড়ালছানার মত ঢুকে যাও চাদরের নীচে
তোমার চোখ আমায় গ্রহণ করতে থাকে
জেগে অথবা ঘুমিয়ে
তুমি আমার ঘুমের রেশমগুলো কোলে তুলে নাও
আর সেই মুহূর্তে যখন তোমার হাতদুটো
আমার কাঁধে জড়িয়ে যাওয়ার কথা
তুমি ঘুমিয়ে পড়ো বিছানায়
আর আধোঘুমে আধো জাগরণে
যখন আমার স্বপ্নরা প্রায় শেষ
আমি তখন তুমিময় হতে থাকি
পূর্ণ হতে থাকি আবার।
‘মোহম্মদ বাঘহের কোলাহি আহারি’ জন্ম ১৯৫০ সালে খোরাশানের মাশশানে। তাঁর প্রথম ’অ্যাবভ দ্য ফোর এলিমেন্টস’ কবিতার বই ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয়। ওই সময়ে আফগানিস্তানের পট পরিবর্তনের ভূমিকা লেখা হচ্ছে। পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি ১৯৭৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের সাহায্যে দাউদ খানকে ক্ষমতাচ্যুত করে। দাউদ খান ১৯৭৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েই আফগানিস্তানের শেষ সম্রাট জাহির শাহ’র অবর্তমানে ক্ষমতাসীন হন। দাউদ খানের জনবিরোধী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ভূমি সংস্কার এবং ‘সিভিল ম্যারেজ অ্যাক্ট’-এ সংস্কার করতে গেলে গিয়ে গোঁড়া মুসলিম মোল্লাতন্ত্র ক্ষেপে যায়।
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এরপরে। ‘আহারি’ এই গৃহযুদ্ধ প্রজন্মের কবি। ‘আহারি’র কবিতায় আফগানি লোকগাথার আভাস থাকে, অসীম দক্ষতায় তিনি গল্পগুলোকে কবিতাময় করে তুলতে থাকেন। এখনো অবধি ‘আহারি’র ছ’টি কবিতা’র বই প্রকাশিত হয়েছে। আহারি, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগান সমাজকে কবিতার শুশ্রূষা দিতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় পরাবাস্তবতার সঙ্গে মিশে গেছে সাধারণের কথ্য ভাষার চাল। তার একটি কবিতা পড়া যাক –
আবার ভ্রমণকারী হব
……………
আমি আবার ভ্রমণকারী হব
বুটের লেস যথাযথ ঝুলবে
নখগুলো কাটব না
গালে দাড়ির বহর বাড়বে
এই গভীর ভোরের মত
যা আমার এবং একটি সুন্দর মৃত্যুর মাঝে
দাঁড়িয়ে রয়েছে
আর এই সুন্দর মৃত্যুর কাছে যেতে যেতে
আমি ঘুরে বেড়াব সেই মুখগুলোর মাঝে
ঘরকুনো তীর্থযাত্রী’র মত
আমি তখন সেই পাখিটা
যে পৃথিবীর গাছ থেকে পড়ে যাচ্ছে
ভোরের শেষ তারা অস্ত যাচ্ছে যখন
পাখিটা পড়ে যাচ্ছে আপেলের বাক্সে,
একদিন একটি ভোরবেলায়।
বয়সে অনেকটাই তরুণ ‘রেজা মোহাম্মেদি’র জন্ম ১৯৭৯ সালে, কান্দাহারে। ইরান এবং লণ্ডনে পড়াশোনা করা রেজা’র কবিতা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে ফার্সি কবিতার অন্দরমহলে এটা বলা যায়। পুরস্কারও পেয়েছেন। তাঁর কবিতার বই তিনটি। তিনি ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। রেজা’র কবিতায় সাধারণতঃ প্রায় অবধারিত ভাবেই নিস্তরঙ্গ জীবনযাপনের নৈর্বক্তিক ছবি পাওয়া যায়। তিনি জোর করে কিছু শোনাতে চান না। নীরবতার অসীম খেলায় রেজা মোহাম্মেদি একজন পটু খেলোয়াড়ের মতো খেলে যান। ভাবানুবাদে রেজা’র একটি কবিতা –
ভালবাসাকে
……………
ঘুম ভাঙেনি একসঙ্গে
তাই আগেই এসেছি এই খালি ঘরটায় একলাই
সমুদ্র এই ঘরের সামনে
অনেক পরে তুমি উঠেছিলে, স্নান করেছিলে, খুলে দিয়েছিলে জানলা
প্রসাধন সেরে তুমি, ঘর ছেড়ে দিয়ে বাইরে এলে রাস্তায়
এইতো তোমার দিন শুরু হলো রাস্তা দিয়েই ঠিকানা খোঁজার
যা একখানি ঘর ছুঁয়ে আসে
একফালি স্ট্রিটে ঘুরন্ত হয়, বারবার,
এই দিনগুলো নিয়ে যায় তোমাকে
শহরের লোভী সীমানায়
আমার কিন্ত দিনগুলো যেন করিডোর,
তারা শিরায় শিরায় বাহিত এবং বন্ধ
তাতে বোতাম লাগানো পেতলের,
আমি আর তুমি আলাদাই
ফিরে আসি ফের, পথ খুঁজে নিয়ে নিজেদের
তুমি গাঢ় বেগুনী পোষাক পরেছ,
ঘড়ি’র রঙে মিলিয়ে,
আর আমি পরে আছি সান্ধ্য পোষাক
আর শুয়ে আছি বেশ হালকা মেজাজে,
এই তো সময়,
এবারে চা হয়ে যাক, একটু?
এবার আমাদের এক হতে হয়, চায়ের স্বার্থে, টিভির বাটনে কিংবা
রাত্রির খাওয়া দাওয়ার কারণে এক হতে থাকি আমরা
আমি খুবই ভালবাসি, আগুন হয়ে হে চুল্লি তোমাকে
আর তুমি ভালবাসো আগুনকে
যেভাবে ভালবাসা দেয় চুল্লি
এরপরে আর কী হতে পারে পরস্পরকে জড়িয়ে আমরা স্বপ্নই দেখি,
আমাদের আলাদা আলাদা স্বপ্ন …….।
‘পীর মোহম্মদ কারবাঁ’, মধ্য চল্লিশের কবি ‘খোস্ত’-এ জন্মগ্রহণ করেন। তালিবান শাসনের সময় ১৯৯০ সালে তিনি পাকিস্তানের পেশোয়ারে আশ্রয় নেন। এক দশক সেখানে কাটিয়ে তালিবানি শাসন শেষ হলে তিনি কাবুলে ফিরে আসেন।
‘কারবাঁ’র প্রকাশিত বই তিনটি।
‘কারবাঁ’ ইঙ্গিতময় কবিতায় পারদর্শী। মুখের ভাষাকে মোচড় দিয়ে কবিতায় নিয়ে যান ‘কারবাঁ’।
‘পীর মোহম্মদ কারবাঁ’র একটি কবিতার ভাবানুবাদ –
ফুল এবং মানুষ
……………….
ফুল, মাটি আর ছাই নেয়
কিছু পরিষ্কার বাকিটা ময়লা জলও নেয়
আর পবিত্র থাকে
সুন্দর আর সুরভিত থাকে
ফুলের রং আমাদের চোখে আরাম দেয়
হৃদয়ে দেয় শুশ্রূষা
মানুষ যার কাছে একদিন দেবদূতও মাথা নত করেছিল
সেই সব মানুষেরা ফুল দেখে
চোখের জলের চেয়েও পরিষ্কার জল পান করে
গভীর লাল আপেলে দাঁত বসায় তারা
কুৎসিত হতে থাকে,
কেন হতে থাকে, কেন?
এখানে এবার দিলাম সেই পঁচিশ বছরের মেয়েটির কবিতাটা, (যেটা না দিলেই নয়) , যাকে কবিতা লেখা এবং কবিতার বই প্রকাশ করার অপরাধে তার স্বামী মেরে মেরে রক্ত বমি করিয়ে নৃশংস ভাবে মেরে ফেলেছিলেন।
নাম তার নাদিয়া আঞ্জুমান(১৯৮০-২০০৫). আফগানিস্তানের হেরাটের মেয়ে নাদিয়া ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল। সাহিত্যের প্রতি ছিল তীব্র আকর্ষণ। বিশেষত কবিতার প্রতি। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালিবানরা। মেয়েদের সমস্ত স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু তাই নয় তাদের ঘরের বাইরে পা রাখাও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়। ব্যতিক্রমের আওতায় ছিল সেলাই শেখার স্কুল।
নাদিয়া ভর্তি হয়ে যায় এমন একটি সেলাই-স্কুলে। যার নাম ছিল, ‘Golden Needle Sewing School’.
এই স্কুলটিতে সেলাই-এর ক্লাস নেয়া হলেও গোপনে সাহিত্যের আলোচনা হতো।
হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ‘মহঃ আলি রেহাব’ এই আলোচনা করতেন। নাদিয়া তাঁর মাধ্যমেই ‘হাফিজ সিরাজ’, ‘বিদেল দেলহেভি’, ‘ফারা ফারোকজদের’ কবিতার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং নিজেও লিখতে থাকে, গোপনে।
এই স্কুলের বাইরে খেলায় ব্যস্ত ছেলেপুলেদের কাজ ছিল ধর্মীয় পুলিশদের দেখা পেলেই সাংকেতিক ভাষায় সজাগ করে দেওয়া।
দীর্ঘ পাঁচ বছর এই ভাবে সাহিত্যপাঠ নেওয়ার পরে ২০০১ সালে তালিবানদের পতন হয়।
একুশ বছর বয়সে নাদিয়া ‘হেরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তি হয়। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সেখান থেকে। ইতিমধ্যে অধ্যাপক রেহাবের উৎসাহ এবং সাহায্যে নাদিয়ার কবিতার বই ‘গুল-এ-দোদি’ ( ধোঁয়াচ্ছন্ন ফুল) প্রকাশিত হয়। বইটি শুধু আফগানিস্তানে নয়, ইরান এবং পাকিস্তানেও পাঠকদের কাছ জনপ্রিয়তা পায়। নাদিয়ার নাম দেশের সীমার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়েই নাদিয়ার সঙ্গে ফরিদ আহমেদ মজিদ নেইয়া’র বিয়ে হয়ে যায়। সাহিত্যে স্নাতক, লাইব্রেরিয়ান মজিদ নেইয়া কিন্তু নাদিয়ার কবিতা-প্রেম নিতে পারেনি। সে এবং তার পরিবার ধর্মের নামে তার কবিতা লেখার বিরোধিতা করতে থাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, তাই না? সব জায়গাতেই মহিলারা ধর্মের নামে নিপীড়ত হতে হয়। মহিলাদের জন্য অনেকগুলো ‘না’ পুরুষশাসিত সমাজে ধর্ম এবং রাজনীতি নামে নির্দিষ্ট করে দেয়, কোনও ধর্মই তার ব্যতিক্রম নয়।
তুমুল লড়াই, আত্মবলিদানের মাধ্যমে মহিলারা শিক্ষা থেকে ভোট, চাকরি থেকে খেলাধুলো করার অধিকার পেয়েছেন আজ।
‘সতীদাহ প্রথা’ সময়ের নিরিখে খুব একটা পুরনো ঘটনা নয় কিন্তু ।
যাই হোক, নাদিয়া ঠিক করে যে সে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘এক শবদ দিলহোরে’ ( অফুরন্ত ভয়) প্রকাশ করবে। বইটিতে তার বিবাহিত জীবনের ব্যর্থতাজনিত বিষাদের ছায়া ছিল। স্বামী মাজিদ নেইয়া ও তার পরিবারের সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও নাদিয়া বই প্রকাশের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। অশান্তি বেড়ে চলে দিনের পর দিন।
নাদিয়া তাতেও তার বই প্রকাশ করা থেকে পিছু হটেননি।
২০০৫ সালের ‘ইদ-উল-ফিতর’-এর দিন আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করা নিয়ে মাজিদের সঙ্গে নাদিয়ার বাদানুবাদ হয়। কবিতা লেখার জন্য আগে থেকেই ক্ষিপ্ত মাজিদ নাদিয়াকে মারতে শুরু করে। মারতে মারতে মেরে ফেলে নাদিয়াকে। মারের চোটে নাদিয়া শেষ নিশ্বাস ফেলার আগে রক্ত বমি করে। মাজিদ পরে এই ঘটনাকে বিষক্রিয়া হিসেবে চালায় এবং বলে যে নাদিয়া আত্মহত্যা করেছে। মাত্র এক মাস জেল খেটে সে বেরিয়ে আসে। নাদিয়া মাত্র ২৫ বছর বেঁচেছিল। এই স্বল্প জীবনেই সে স্মরণযোগ্য বেশ কিছু কবিতা তার পাঠকদের জন্য লিখে রেখে গেছে। নাদিয়ার একটি কবিতা পড়া যাক, ভাবানুবাদে –
গজল
—————–
সুরা চাই তার সুন্দর থেকে, তৃপ্ততা চাই
আমি তার অগ্নিপ্রবণ প্রেমের শিখায় পুড়তে পুড়তে
রানি হতে চাই হৃদয়ের
আমি হতে চাই শুধু একফোঁটা জল সুন্দর দুটি চোখের
সে তো ফুলই,
সেই ফুললিত মুখে হতে চাই আমি কোঁকড়া চুলের সৌরভ
অথবা তার চলার পথেই ধুলো যদি হতে পারতাম
তীব্র গরমে গলতে গলতে আমি যদি হয়ে উঠতাম
গোপন পংক্তি,
বিরল শব্দ ওর দু’ঠোঁটের সান্নিধ্যে তার শ্বাসের ছায়া
তারই পায়ে পায়ে হায় যদি হতে পারতাম
আর থাকতাম যদি তার সঙ্গে এভাবে, এমনিই সারাদিন
আমি বোঝাতে পারতাম এই বিচ্ছেদে তবে নিজেকেই
যে, আমি আমার মনের দরজা বন্ধ করেই দিচ্ছি
আমি হয়ে যাচ্ছি মাথা থেকে পা চাঁদের আলো ক্রমশ।
নিষিদ্ধ কবিতার আসরে (১৮ই ফেব্রুয়ারী,২০১৬ সালে) প্রেমের কবিতা পড়েছিলেন নাদিয়া
‘প্রিয়তম বিহনে সারা রাত পুড়ি আর জ্বলি
আমি এক মোমের বাতি, নীরবেই পুড়ি আর গলি’
আফগানিস্তানের কান্দাহার শহরের একটি গোপন কবিতা পাঠের আসরে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে পশতু ভাষায় নিজের লেখা এই ‘লান্দে’ পড়ছিলেন কুড়ি বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী নাদিয়া।
‘লান্দে’ হচ্ছে প্রেম-বিষয়ক দুই লাইনে লেখা বিশেষ ঘরানার অণুকাব্য—অনেকটা তিন লাইনের জাপানি হাইকুর মতো।
ওই কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত ছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন নারী কবি। তাঁরা এমন এক ‘নিষিদ্ধ’ বিষয় নিয়ে লেখা স্বরচিত কবিতা পাঠ করছিলেন, যার খবর তালেবানের কানে গেলে তাঁরা খুনও হয়ে যেতে পারতেন।
এই ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়টির নাম ‘প্রেম’!
ঐতিহ্যবাহী পশতুন লোককাব্যের অনন্য এক ঘরানার নাম ‘লান্দে’।
সাধারণত এই কাব্যের বিষয়বস্তু নারী ও পুরুষের শাশ্বত প্রেম।
রাজধানী কাবুলে বেশ আয়োজন করে প্রকাশ্যে এই কবিতা পাঠের আসর বসানো হয়। তবে তালেবান-অধ্যুষিত কান্দাহার বা হেলমান্দ প্রদেশে এ ধরণের কাব্যের আসর এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে নারীদের জন্য এটা ভয়াবহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তালেবান মনে করে, এ ধরণের কাব্যচর্চা নারী-পুরুষের অবাধ মেলা-মেশাকে উৎসাহিত করে।
তবে সব ঝুঁকি ও ভয় উপেক্ষা করে আফগানিস্তানের নারী কবিরা ‘মিরমান বাহির’ নামের একটি সাহিত্য সংগঠন করেছেন।
এই সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় নারী কবিরা প্রতি সপ্তাহে গোপন সাহিত্য বাসরে মিলিত হন। যাঁরা ভয়ে আসতে পারেন না, তাঁদের জন্য টেলিফোনের হটলাইন আছে। তাঁরা ফোন করে কবিতা পড়ে শোনান।
শুধু তালেবান নয়, কান্দাহার বা হেলমান্দের সমাজও সাধারণভাবে নারীদের এ প্রেমের কবিতাচর্চাকে বাঁকা চোখে দেখে।
নাদিয়া জানান, মা তাঁকে এই সাহিত্য সংগঠনে যোগ দিতে নিষেধ করেছেন। নাদিয়া বলেন,
‘মা বলেছেন, “প্রেমের কবিতা লেখে যে মেয়ে তাকে বিয়ে করবেটা কে?”’
তবে এই মিরমান বাহির-এর মাধ্যমে পশতুন নারীদের মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছেন নাদিয়া।
‘আই অ্যাম এ বেগার অব দ্য ওয়ার্ল্ড : লান্দেজ ফ্রম কনটেমপোরারি আফগানিস্তান’- বইয়ের লেখিকা এলিজা গ্রিসওল্ড এএফপিকে বলেন, ‘নীল বোরকার আড়ালে চুপ মেরে থাকা মৃতবৎ পশতুন নারীদের সম্পর্কে যে ধারণা প্রচলিত আছে, লান্দে তার গ্লানি, প্রেম ও ক্ষোভের শক্তি দিয়ে সেই ধারণার বিরুদ্ধে এক সুপ্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।’
মার্কিন জোটের অভিযানে কুড়ি বছর আগে কট্টরপন্থী তালেবানের পতন হওয়ার পরও আফগানিস্তানের অধিকাংশ জায়গায়ই নারীদের অবরুদ্ধ করে রাখা হচ্ছে।
মিরান বাহির-এর সমন্বয়ক পাকিজা আরজু বলেন, ২০১০ সালে হেলমান্দে জারমিনা নামের এক কবি গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি টেলিফোনে সাপ্তাহিক আসরে লান্দে পড়ে শোনাতেন। জারমিনার ভাই মনে করেছিলেন, তিনি কোনো পুরুষের সঙ্গে প্রেমালাপ করছেন। এই নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। পরে তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
টেলিফোনে নিয়মিত নিজের লেখা পড়ে শোনান এমন একজন কবির একটি লান্দে শোনান পাকিজা আরজু:
‘কার পাপে আমি আজ প্রথার বলি?
আমি শুধু নারী, এ আমার সবচেয়ে বড় অপরাধ?
দারী কবিতায় আধুনিকতার সূত্রপাত হয় মূলত ষাটের দশকের প্রথম দিকে পাশের দেশ ইরানে ফার্সি কবিতার বিবর্তনের প্রভাবে। ইরানে ‘ফ্রি স্টাইল পোয়েট্রি’ বা মুক্তক ঘরানার কবিতার প্রচলনের সাথে মহিলা কবিদের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
এক্ষেত্রে মুক্তক ঘরানাকে ধ্রুপদী কাব্য প্রকরণের দৃঢ় রীতিকলা ভেঙ্গে ভিন্ন একটি ভাবনা-প্রধান কাব্যশৈলী নির্মানের উদ্যোগ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ইরানের যশস্বী মহিলা কবি নিমা ইউশিজ-কে (১৮৯৭-১৯৫৬) মুক্তক কাব্যশৈলীর পায়োনিয়ার বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
তাঁর নাম থেকে মুক্তক কাব্যশৈলী ‘নিমায়ী’ কবিতা হিসাবে ইরান ও আফগানিস্তানে পরিচিত হয়ে ওঠে।
আফগানিস্তানেও ‘নিমায়ী’ কাব্যশৈলী বলতে ধ্রুপদী কাব্যকলার বন্ধনমুক্ত হাল জামানার আধুনিক ভাবনা বিষয়ক কবিতাকে বোঝানো হয়ে থাকে।
যশস্বী ইরানি কবি নিমা ইউশিজ (১৮৯৭-১৯৬০) এই ধারার পথিকৃৎ।
ফলে তাঁর নাম থেকেই মুক্তক কাব্যশৈলী ‘নিমায়ি’ কবিতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে ইরান ও আফগানিস্তানে। আফগানিস্তানেও নিমায়ি কাব্যশৈলী বলতে ধ্রুপদি কাব্যকলার বন্ধনমুক্ত সাম্প্রতিক কালের আধুনিক ভাবনা বিষয়ক কবিতাকে বোঝানো হয়। এখানে এই নিমায়ি রীতি বিকশিত হয় গত শতকের ষাটের দশকে। যুদ্ধজনিত কারণে সত্তর দশক থেকে প্রবাসের শরণার্থী শিবিরে বাস করে পরবর্তী জীবনে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে অভিবাসী হওয়া আফগান কবিরা নিমায়ি শৈলীতে রচিত আধুনিক কাব্যধারাকে সমৃদ্ধ করতে শুরু করেন। তাঁদের রচনায় বিষয়রূপে আসে দিনযাপনের অনিশ্চয়তা, প্রণয়ের অন্তরঙ্গ অনুভূতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রতীকীভাবে রাজনৈতিক জীবনের হিউমার। নমুনা হিসেবে কয়েকটি দারি কবিতার অনুবাদ।
পারতাও নাদেরি
————————-
জন্ম ১৯৫৩ সালে আফগানিস্তানের বাদাখশান প্রদেশে। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। গত শতাব্দীর সাতের দশকের শুরুতে কবিতায় সোভিয়েতবিরোধী মতাদর্শের জন্য তিন বছর কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। আফগানিস্তানের আধুনিক কবিসম্প্রদায়ের পুরোধা এই কবি বর্তমানে আফগান লেখকদের সংগঠন পেন চ্যাপ্টারের দায়িত্ব পালন করছেন।
পারতাও নাদেরি-র কবিতা
এখনো সময় আছে বাকি
———————————
এখন মাঝরাত
আমার উচিত মোনাজাতে রুজু হওয়া
কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রপাত
তাকাই আমার সততার আরশির দিকে
ধুলোর ধূসর প্রলেপে তা ছাওয়া।
জেগে ওঠা উচিত আমার
এখনো সময় আছে বাকি
বুঝতে পারি জলের সোরাহির সাথে পানপাত্রের ব্যবধান
নিবিড় কাকলিতে মাতে কটি রাজজাগা পাখি
কোলাহল থেকে বিযুক্ত হয় সংগীতের তান।
সময়ের রথচক্র ঘড়ঘড়িয়ে নেমে যাচ্ছে বয়সের ঢালে
জানি না কখন এসে লাগবে ওপারের বাতাস আমার পালে।
আগামীকাল বিষাক্ত তীরে হয়তো বিদ্ধ হবে আমার দু-চোখ
দেখো চিত্রিত পাখি দুটি ডানা ঝাপটে উড়ানে হয়েছে উন্মুখ।
হয়তো আগামীকাল আমার সন্তান হবে বৃদ্ধ—প্রতীক্ষায়
আমার ঘরে ফেরার পথ চেয়ে সে বসে থাকবে—হায়।
রেজা মোহাম্মাদি
————————
জন্ম ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানের কান্দাহারে। লন্ডনের মেট্রোপলিটান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর অর্জন করেছেন বিশ্বায়নের ওপর। ১৯৯৬-এ রেজা মোহাম্মাদি ইরানের ‘শ্রেষ্ঠ তরুণ কবি’ পদকে ভূষিত হন তিনি। পেশায় সাংবাদিক এই কবি সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার হিসেবেও পরিচিত।
রেজা মোহাম্মাদি-র কবিতা
হাওয়া
——————
যদি বা বাতাস পরে নেয় সুচারু পরিচ্ছদ
দু-পায়ে চামড়ার ফিতে আঁটা জুতা
রজনীর মধ্যযামে
আমার বাড়ির ভেতর দিয়ে বয়ে যেতে যেতে
একবাটি পেঁয়াজের সুরুয়া নিয়ে থামে।
সে চুমো খায় আমার মুখে
যখন আমি ইয়ার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল
রাজন্যকে বিদ্রূপ করে আবৃত্তি করি পদাবলি
রাজনীতির মাইফেলে আমি কবি এক উন্মূল।
সে আদতে অদৃশ্য
তাই কেউ দেখতে পায় না তাকে
আমি তাকে অনুসরণ করি
হেঁটে যাই সরণির বাঁকে।
আমার দিনযাপনের পল্লবে হাওয়া বয় ঢের
অনেক বছর ধরে আমি প্রণয়-কাতর বাতাসের।
শাকিলা আজিজজাদা
——————————–
জন্ম ১৯৬৪ সালে আফগানিস্তানের কাবুলে। বর্তমানে প্রবাসী এই কবি নেদারল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ব্যক্তিগত বাসনার অন্তরঙ্গ স্বর প্রতিভাত হয় তাঁর কবিতায়। কবিতা ছাড়াও তিনি রচনা করেছেন নাটক। মঞ্চে কবিতার উপস্থাপনায় তাঁর দক্ষতাও প্রশংসিত হয়েছে।
শাকিলা আজিজজাদা-র কবিতা
অভিসার
—————–
হয়ে তো গেল অনেক বছর
তারপর ঝরেছে চেনারের পত্রালি ঢের
বলতে পারি না ‘শুভকামনা’ দেখা হবে ফের
যেহেতু আমরা ক্রমাগত হচ্ছি প্রবীণ
আমাদের দেখা হবে নিশ্চিত
কেবলমাত্র রোজ কেয়ামতের দিন।
আমি জানি তোমার উপস্থিতিতে
প্রফুল্ল হবে আমার শরীর মন
তুমি বলতে রেশমের কালো মোজাদু’টি
আমার দু-পায়ে দেখাত সুদর্শন।
যদি একবার আমি দেখতে পেতাম
তোমার চাহনি শরমে শিহরিত
কাঁপা কাঁপা চোখজোড়া আমার
ফিতার ফুল ছুঁয়ে হচ্ছে উদ্দীপিত।
ধরবে বাজি—আমি যদি বলি নদী
তুমি হতে চাও নাকি মাছ
বয়ে যায় আমাদের প্রেরণার জলধি।
তোমার সাথে দেখা হবে ফের প্রস্রবণের পাশে
তোমার হাতে থাকবে একটি গোলাপ সংগোপনে
স্বপ্ন আমার ভাঙচুর হবে মৌমাছির গুঞ্জরণে
আর প্রত্যাশায় আমি হবো কেঁপে থর থর আনত
পুষ্পের ভারে ডালিমের ডালটির মতো।
আফগানিস্তানে ‘নিমায়ী’-রীতি বিকশিত হতে থাকে ষাটের দশক থেকে। এবং সে আমলের কবিদের ‘নিমায়ী’ ধরার ‘ফার্স্ট ওয়েভ’ বা ‘প্রথম তরঙ্গ’ বলা হয়।
সত্তর দশকের দারী ভাষার কবিরা ‘নিমায়ী’ ধারার ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা ‘দ্বিতীয় তরঙ্গে’র কবি হিসাবে পরিচিত।
নব্বই দশক থেকে আজ আব্দি কবিদের অনেকেই ‘নিমায়ী’ ধারার ‘থার্ড ওয়েভ’ বা ‘তৃতীয় তরঙ্গে’র ধারক হিসাবে নিজেদের পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। এখানে অনূদিত কবি তিনজনকে যথাক্রমে ষাট, সত্তর ও আশির দশক থেকে নির্বাচন করা হয়েছে।
ওয়াসেফ বাখতারী
—————————
যশস্বী কবি বাখতারী’র জন্ম ১৯৪২ সালে, শৈশবে বেড়ে ওঠেন প্রান্তিক শহর মাঝার শরীফে। উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে পড়াশোনা মূলত কাবুলে। যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ছিলেন কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের অধ্যাপক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুবাদকেরও কাজ করেন কয়েক বছর। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী। পঞ্চাশের দশকে লেখালেখির সূত্রপাত হলেও পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন ছ’য়ের দশকে। তিনি ‘নিমায়ী’ কাব্যধারার প্রথম তরঙ্গের পথিকৃত কবিদের অন্যতম।
অগ্নিরোগ | ওয়াসেফ বাখতারী
আনারের রক্তাক্ত দানার মতো
লোহিত হরফ দিয়ে লেখা
আমার ভাগ্যের হালখাতা
তার ছিদ্রময় প্রতিটি পাতা,
জলন্ত অঙ্গার হয়ে যেন
পুড়ছে আমার হৃদয়
যারা স্পর্শ করে এ বিধিলিপি অগ্নিময়—
এবং দিতে চায় সজল ত্রাণ
পুড়ে ভষ্ম হয় তাদের প্রাণ;
এ দুর্যোগ—
লোহিত এ অগ্নিরোগ
কুরে কুরে খায় আমাদের
সমুদয় আনন্দ উপভোগ।
আব্দুল সামী হামিদ
—————————
চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও কবি সামী হামিদ পেশায় মূলত সাংবাদিক। তবে রাজনৈতিক কার্টুন আঁকিয়ে হিসাবেও তিনি যশস্বী। ‘এসোসিয়েশন ফর দি ডিফেন্স অব আফগান রাইটারস রাইটস’-এর তিনি যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতা। এক সময় সম্পাদনা করতেন আন্ডারগ্রাউন্ড সংবাদপত্র ‘সালাম’।
২০০৩ সালে ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট’ বা ‘সিপিজে’ তাঁকে ‘ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম’ নামক পুরস্কারে সম্মানিত করে।
ওই একই সালে তিনি আততায়ীর ছুরিকাঘাতে মারাত্মকভাবে জখম হলে জনসমক্ষে আসা বন্ধ করে দেন। লেখালেখির সূত্রপাত ষাটের দশকের শেষ দিকে হলেও জনপ্রিয় হন সত্তর দশকে। তাঁর বইপত্র প্রকাশিত হতে থাকে আশির দশক থেকে। তিনি ‘নিমায়ী’ কাব্যধারার দ্বিতীয় তরঙ্গের কবি হিসাবে বিবেচিত।
এক হাজার এবং দ্বিতীয় রাত | আব্দুল সামী হামিদ
ঠিক জানি না সহ্য-ক্ষমতা কতটুকু আমার উদ্ভ্রান্ত হৃদয়ের
ধংসস্তূপের লোহিত পুষ্পটি বাঁচবে কি না সন্দেহ আছে ঢের,
বসন্তের স্বর্গীয় দূত যে কৃষ্ণ খেচর—বাঁধবে কি সে নীড়
নেই তো কবোষ্ণ দেয়ালগিরি কোনো— বইবে না সিগ্ধ সমীর।
আছে হয়তো দেয়ালে গর্তের নোনাধরা সংকীর্ণ বিস্তার
তাতে জায়গা হবে কি নীড়ের শুকনো পাতা খড়-কুটার?
ফোঁটায় ফোঁটায় তপ্ত মোমের মতো গলে নিয়তি আমার
শিখা-প্রিয় সুদর্শন মথ কি জেনে যাবে বিষয়টা এবার?
হাজার রজনী অতিক্রম করে আসবে যখন দোসরা রাত
মহিমান্বিত হবে কি কিংবদন্তীর শাহেরজাদের বরাত?
মোহাম্মদ করিম নাজিহি জিলওয়া
———————————————–
সাম্প্রতিক কালের জনপ্রিয় কবি জিলওয়া’র জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে পাকিস্তান ও ইরানের শরণার্থী শিবিরে। আশির দশকে তাঁর লেখালেখির সূত্রপাত হয় পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে হাতে লেখা পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে। নব্বই দশক থেকে তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে থাকে কাবুলের পত্র-পত্রিকায়। বর্তমানে কবি কাবুল শহরে বাস করেন। তাঁকে ‘নিমায়ী’ কাব্যধারার তৃতীয় তরঙ্গের কবি বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
হৃদয়ের বেদনার বিষয় | মোহাম্মদ করিম নাজিহি জিলওয়া
সে ছাড়া কেউ তো জানে না আমার হৃদয়ের দগদগে জখম
বাড়িওয়ালা ছাড়া আর কেই-বা খবর রাখে
ঘরের নকশা খুঁটিনাটি—গালিচা..আসবাবপত্র কত রকম
দেখেছে কা’রা তার নির্মমতার নজির
যা ডেকে আনে ধ্বংস বিষাদ অবশেষে সমূহ বিনাশ
জলন্ত চুলা ছাড়া অন্য কেউ কি বুঝতে পারে
আগুন ছড়াতে পারে কতোটা সন্ত্রাস?
যখন লিপ্ত হতে চাই তার সাথে ঝগড়া বিবাদ দ্বন্দ্বে
ভালোবাসার চোরাস্রোতে নিমজ্জিত হই—
মুগ্ধ হই আমি কোঁকড়ানো চুলের মৃদু ছন্দে
সরল পাখি জানবে কি ভাবে
কতোটা তফাত বার্ডফিডার আর ফাঁদে
জড়াই কিভাবে দেহজ প্রলোভনে—
কিসের টানে
উঠে যাই যশের অভ্রভেদী ছাদে
বিজ্ঞজনের প্রাজ্ঞমনে আমার কামনা কুহেলী
আদতে বাকচাতুরী শিশুতোষ ছল
প্রতিফলিত হয় তার নেশাতুর চোখে
দুই ভুবনের কোলাহল।
যদিবা কখনো বন্ধ হয় স্বর্গের দুয়ার
কী হবে জুলুমের যজ্ঞে পুড়িয়ে তাজা দেহ-মন
স্বর্গ মোসাফির এক জেনো
তোমার ভেতরেও আছে নিজস্ব ভুবন।
২). দ্বিতীয় পর্ব
এই কবিতাগুলো সাম্প্রতিককালে রচিত। আফগান কবিদের মৌখিক পরিভাষার সূত্র ধরে এসব কবিতাকে ‘আধুনিক’ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে। বাংলা কবিতার সমজদাররা যে-অর্থে আধুনিকতাকে অনুধাবন করে থাকেন, খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা হচ্ছে : বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক