Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আকাশঘুম || Anish Deb

আকাশঘুম || Anish Deb

খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ আরও জঘন্য।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই দামি মন্তব্যটা করেছেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করার সময় এই সংক্ষিপ্ত নামটাই বেশি চালু ছিল। কিন্তু রিটায়ার করার পর কেউ এ-নামে ডাকলে এবং তার সঙ্গে ‘স্যার’ যোগ করলে কানে যেন কেমন লাগে—বিশেষ করে সে যদি পুরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ না হয়।

রঙ্গলাল গোস্বামী সেই দলেরই একজন। তিনি হঠাৎ এসিজিকে প্রশ্ন করে বসেছেন, ‘এসিজি স্যার, খুন অতি জঘন্য, খুনি ধরা আরও/ সেই কাজে আপনার কেন পোয়াবারো?’

স্বভাবকবি রঙ্গলাল ছন্দ তৈরি করেন কথায়-কথায়। এ-বিষয়ে প্রশ্ন করলে সঙ্কুচিতভাবে মাথা নিচু করে জবাব দেন, ‘আমি একজন স্বভাবকবি/ কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’

এসিজির গুণমুগ্ধ এই ব্যাচিলার কবিমানুষটি সবসময় এসিজির সঙ্গী হতে ভালোবাসেন। আর সুযোগ পেলেই ছাত্রের মতো প্রশ্ন করেন এসিজিকে।

মাথার সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘পোয়াবারো কথাটার আসল মানে জানেন?’

রঙ্গলাল অবাক হয়ে তাকালেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন ‘না, জানি না।’

‘পোয়াবারো মানে হল পাশাখেলার একটা দান। তো ধরে নিন, খুনির সঙ্গে বুদ্ধির পাশা খেলতে আমার ভালো লাগে। তাই খুনি ধরার কাজটা খুনের চেয়েও জঘন্য জেনেও আমার খুনি ধরতে ভালো লাগে। আপনার স্বভাব-কবিতার নেশার মতো এটাও একটা নেশা।’

‘স্বভাব-কবিতা’ শব্দটা মোটেই এসিজির আবিষ্কার নয়, ওটা রঙ্গলাল গোস্বামীর সম্পত্তি। ওঁর প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘স্বভাব-কবিতা সমগ্র’।

ব্যাঙ্গালোর এয়ার টার্মিনালে বসে অশোকচন্দ্র আর রঙ্গলাল কথা বলছিলেন। ইন্দিরানগর ছাড়িয়ে এইচ.এ.এল. এরিয়ার এই এয়ার টার্মিনালে ওঁরা এসেছেন পাক্কা দু-ঘণ্টা। কিন্তু কলকাতার উড়ান ফ্লাইট নম্বর-এইট ডব্লিট ফাইভ ওয়ান এইট ছাড়তে এখনও অনেক দেরি। আবহাওয়ার কী একটা যেন গোলমাল হয়েছে—বোধহয় কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশা।

রঙ্গলাল বারবার বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘এসিজি স্যার, আজ বোধহয় কপালে কলকাতা পৌঁছোনো নেই।’

স্পিকারের নানারকম ঘোষণা চলছিল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রঙিন মনিটরগুলো রাজ্যের উড়ান-সংবাদ অক্লান্তভাবে পেশ করছিল। মোল্ডেড প্লাস্টিকের আর্গোনমিক চেয়ারে বসে বহু যাত্রী অপেক্ষা করছিলেন। টার্মিনাল বিল্ডিং-এর আধুনিক আলোকসজ্জা সবজায়গায় হিসেবমতো আলো পৌঁছে দিয়েছে। মার্বেল পাথরের গ্রানাইট পালিশ করা মেঝেতে আয়নার মতো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। অনেক যাত্রীই ব্যস্তভাবে এদিক-ওদিক যাতায়াত করছিলেন। কেউ-বা ট্রলিবোঝাই মালপত্র ঠেলে নিয়ে চলেছেন টার্মিনাল বিল্ডিং-এর বাইরে।

এসিজি ও রঙ্গলালের বোর্ডিং পাস নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন ওঁরা সিকিওরিটি চেক শুরু হওয়ার ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

কলকাতার একটা স্মাগলিং-এর কেসের ব্যাপারে অশোকচন্দ্র গুপ্ত ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন। কতকগুলো জেমস্টোনের স্পেক্ট্রাল ক্যারেকটারিস্টিকস খতিয়ে দেখার জন্য রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউট আর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স-এ ওঁর জরুরি কাজ ছিল। তিনদিনেই সবকাজ ঠিকমতো মিটে যাওয়ায় আজ হালকা মনে বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়েছেন।

রঙ্গলাল গোস্বামী বাগবাজারের ‘লালমহল’-এর বাসিন্দা। বছরতিনেক আগে ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ওঁর দাদার একটা হারানো চুনি খুঁজে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে এসিজির আলাপ।

এসিজি লক্ষ করেছেন, লাউঞ্জে অনেকেই রঙ্গলাল গোস্বামীকে লক্ষ করছেন। আর খানিকটা নজর কাড়ছেন এসিজিও। কারণ, বোধহয় ওঁদের দু’জনের পোশাক।

এসিজির পরনে পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি, তার ওপরে জড়ানো সাদা শাল। ভেতরে অবশ্য লুকোনো একটা উলের স্যান্ডো গেঞ্জিও রয়েছে। আর রঙ্গলালবাবুর পরনে সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, তার ওপরে মেরুন রঙের এক বিচিত্র জহরকোট। আর গলায় সবুজ রঙের একটা মাফলার।

এসিজির সঙ্গে রঙ্গলালের এই একটি জায়গাতেই বেশ মিল : দু’জনেই শীতকাতুরে। নইলে ব্যাঙ্গালোরে সেরকম শীত কোথায়!

রঙ্গলাল গোস্বামীর রং শ্যামলা। ডানহাতের তিন আঙুলে রুপোয় বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। মাথার তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুলের ঠিক মাঝখান দিয়ে সিঁথি। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট্ট আঁচিল। নাকটা বেশ জম্পেশ। দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে কামানো। গা থেকে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। বোঝাই যায়, বেশ শৌখিন মানুষ।

রঙ্গলালকে অনেকেই দক্ষিণ ভারতীয় ভেবে ভুল করছিল। তাদের দক্ষিণী কথার জবাবে রঙ্গলাল আকর্ণ হাসছিলেন এবং ‘থ্যাঙ্ক য়ু’ বলছিলেন।

এসিজি একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। এরপর প্রায় আড়াই ঘণ্টা সিগারেট ছেড়ে থাকবে হবে। প্লেন ওড়ার সময় ‘স্মোকিং প্রহিবিটেড’-এর আইন জারি হয়ে গেছে।

‘পোয়াবারো’ মানে যে পাশা খেলার একটা দান এ-কথা শোনার পর রঙ্গলাল সমঝদারের মতো মাথা নাড়ছিলেন। তখন সময় কাটানোর জন্য গোয়েন্দাপ্রবর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে নিয়েছেন একটা রুবিক কিউব—এবং শুরু করে দিয়েছেন রং-মেলান্তির খেলা।

এই বিচিত্র রঙিন কিউবটা রঙ্গলাল আগেও এসিজির কাছে দেখেছেন। দু-একবার ওঁর কাছ থেকে কিউবটা চেয়ে নিয়ে রং মেলানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা দেখে সহজ মনে হলেও আসলে যাচ্ছেতাইরকম কঠিন।

এই সদা-চুল মানুষটি রঙ্গলালকে সবসময় অবাক করে দেন। কোনওরকম সমস্যা পেলেই হল—এসিজি তার সমাধান করতে মনে-মনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজেকে যখন তিনি ‘থিঙ্কিং মেশিন’ বলেন, তখন মোটেই নিজেকে জাহির করেন না—যা সত্যি তাই বলেন। তাঁর কথায় সি. অগাস্ত দুপাঁ, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো থেকে শুরু করে পরাশর বর্মা, ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির সকলেই থিঙ্কিং মেশিন। আসল কথা হল, গোয়েন্দাদের থিঙ্কিং মেশিন না হলে চলে না।

এখন বসে-বসে তিনি কী ভাবছিলেন কে জানে। হঠাৎই একজন ফরসা, বেঁটে এবং মোটাসোটা ভদ্রলোক অনেকটা হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে এসিজির বাঁ-পাশের খালি চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নিভাঁজ বাংলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কলকাতার ফ্লাইট ক’টায় ছাড়বে কিছু বলল?’

এসিজি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘এটুকু বলেছে, যে-কোনও সময় সিকিওরিটি চেক-এর জন্যে ডাক পড়তে পারে।’

এরপর ভদ্রলোক অশোকচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। বললেন, তিনি পেশায় ডাক্তার। নাম ভবানীপ্রসাদ দে। লেক প্লেসে থাকেন। ওঁর একমাত্র মেয়ে ব্যাঙ্গালোরের একটা মেডিকেল কলেজে এ-বছরের মাঝামাঝি অ্যাডমিশন নিয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।

পরিচয় বিনিময় করার সময় এসিজি নিজের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু রঙ্গলাল গোস্বামী—যিনি এসিজির এমন গুণমুগ্ধ যে, ওঁকে নিয়ে স্বভাব-কবিতা লিখেছেন : ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/ আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’—তিনি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। এসিজির পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষতা, পাখির নেশা, অপরাধবিজ্ঞান চর্চা, খুনি ধরার নেশা, রুবিক কিউব সমাধানের ‘অলৌকিক ক্ষমতা’—সবই সবিস্তারে পেশ করলেন ডক্টর দে-র কাছে।

এই বিস্তারিত পরিচয়ে এসিজি লজ্জা এবং সঙ্কোচ ছাড়াও ভয় পাচ্ছিলেন। ভবানীপ্রসাদবাবু ভেবে না বসেন যে, রঙ্গলাল গোস্বামী এসিজির প্রচারসচিব। আজকাল নানা মহলে এই পদটির বেশ চল হয়েছে।

অশোকচন্দ্রের ‘জীবনী’ জানার পর ভবনীপ্রসাদ একেবারে বিগলিত হয়ে পড়লেন। জানা গেল, ভদ্রলোক গোয়েন্দাকাহিনির অন্ধ ভক্ত। এসিজির দু-একটি কীর্তিকলাপ যে পড়েছেন সেটা ওঁর বেশ মনে পড়ছে।

‘সত্যি, আমি খুব লাকি। আপনার মতো জিনিয়াসের সঙ্গে এরকম আচমকা পরিচয় হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।’

আজকাল ‘জিনিয়াস’ আর ‘জিনিস’—দুটো শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। বেপরোয়া অতিব্যবহারে বিশেষণের ক্ষয় হয়। যেরকম হয়েছে ‘শহিদ’ শব্দটার। মনে মনে ভাবছিলেন এসিজি।

ভবানীপ্রসাদ এসিজির হাত চেপে ধরলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘এয়ারবাসে তো অনেক সিট খালি থাকবে…এয়ারহোস্টেসকে ম্যানেজ করে আপনার পাশে বসব। তারপর দু-আড়াই ঘণ্টা ধরে আপনার সব থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স শুনতে-শুনতে যাব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’

এসিজি হেসে বললেন, ‘আপত্তি কেন, বরং ভালোই লাগবে। কী বলেন, রঙ্গলালবাবু?’

রঙ্গলাল গোস্বামী মাথা হেলিয়ে বললেন, ‘ডাক্তার, ডক্টর, কী বা মিশ্রণ/ অনাবিল স্বাদে মোর ভরিবে ভ্রমণ।’

স্বভাবকবির উত্তর শুনে ভবানীপ্রসাদ হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসির দমক থামলে চোখ বড়-বড় করে বললেন, ‘মশাই আপনিও তো দেখছি আর-এক ধরনের জিনিয়াস!’

রঙ্গলাল গোস্বামী সলজ্জভাবে নিজের পরিচয় দিলেন।

আর ঠিক তখনই অডিয়ো সিস্টেমে ঘোষণা করা হল, কলকাতাগামী উড়ান এইট ডব্লিউ ফাইভ ওয়ান এইট-এর যাত্রীদের সিকিওরিটি চেক-এর জন্য এগোতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

এসিজি চটপট উঠে দাঁড়ালেন। হাতের সিগারেটটা একটু দূরে রাখা লিটারবিন-এ ফেলে দিলেন। তারপর রুবিক কিউবটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে দিয়ে রঙ্গলালকে তাগাদা দিলেন : ‘চলুন, রঙ্গলালবাবু, শেষ পর্যন্ত তা হলে আমরা কলকাতা পৌঁছোতে পারব।’

রঙ্গলাল নির্মল হাসি হেসে ওঁর ট্র্যাভেল ব্যাগটা তুলে নিলেন। এসিজিও ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ালেন ওঁর ব্রিফকেসের হাতলের দিকে।

দীর্ঘকায় এসিজির হাতে ব্রিফকেসটা অনেকটা খেলনাগোছের দেখাচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ নজর বুলিয়ে তিনি ডক্টর দে-কে বললেন, ডাক্তারবাবু চলুন—।’

তখই তিনি খেয়াল করলেন, ডক্টর দে বেশ মনোযোগ দিয়ে একজন লম্বা ভারী চেহারার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন।

ভদ্রলোকের বয়েস ষাট কি বাষট্টি হবে। পরনে গাঢ় নীল রঙের সাফারি সুট। ডানহাতের মধ্যমায় একটা বড় হিরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। মাথা ভারতি কাঁচাপাকা চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের আধুনিক ডিজাইনের চশমা। পুরুষ্ট গোঁফ। দু-গালে এবং চিবুকের নিচে চর্বির থাক।

ডক্টর দে চাপা গলায় বললেন, ‘ওই ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন?’

এসিজি আর রঙ্গলাল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।

মুখটা যেন চেনা-চেনা মনে হল এসিজির। এই মুখের ছবি কোথায় যেন দেখেছেন?

রঙ্গলাল ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন! ‘দেখে মনে হয় নাকো চিনি উহারে…।’

‘মদনমোহন চ্যাটার্জি—’ ছোট্ট করে বললেন ভবানীপ্রসাদ।

ব্যস! তক্ষুনি সব মনে পড়ে গেছে এসিজির।

মদনমোহন চ্যাটার্জি। বিখ্যাত বিজনেস টাইকুন। খবরের কাগজের পাতায় প্রায়ই নানান কারণে ওঁর ছবি ছাপা হয়ে থাকে। এই তো মাসখানেক আগে কাগজে খবর ছিল, হলদিয়াতে মদনমোহন চ্যাটার্জি দু-হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা স্টিল প্ল্যান্ট শুরু করতে চলেছেন। আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক আর লস এঞ্জেলসে ওঁর শিপিং কোম্পানি রয়েছে। আমেরিকাতে একবছর—বোধহয় ১৯৯৮ কি ১৯৯৯ সালে—’ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন।

এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি একা নন। ওঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা।

‘আপনি মিস্টার চ্যাটার্জিকে চেনেন নাকি?’ এসিজি ভবানীপ্রসাদকে জিগ্যেস করলেন।

ভবানীপ্রসাদ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, একসময়ে…মানে, বছরদশেক আগে…আমি ওঁর ট্রিটমেন্ট করেছিলাম।’

‘কীসের ট্রিটমেন্ট?’

‘অ্যাজমার। মিস্টার চ্যাটার্জির হাঁপানির প্রবলেম আছে।’

‘এখন আপনার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই?’

হাসলেন ডক্টর দে। মুখে কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘নাঃ। কী করে আর থাকবে! আমি মশাই সস্তার ডাক্তার। আমি যখন ওঁর ট্রিটমেন্ট করতাম তখন উনি এত বড়লোক ছিলেন না। এখন আমাকে দেখে হয়তো চিনতেই পারবেন না।’

এসিজি সায়ে দিয়ে মাথা নাড়লেন : ‘হ্যাঁ—পয়সা অনেকসময় মানুষকে বদলে দেয়…।’

রঙ্গলাল এসিজির সঙ্গে তাল দিয়ে বললেন, ‘ধন বড় বিচিত্র/ বদলে দেয় চরিত্র।’

‘ইকনমিক টাইমস’, ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ‘মানি ম্যটারস’, ‘ইয়োর শেয়ার’ ইত্যাদি পত্রিকায় মদনমোহন চ্যাটার্জিকে নিয়ে প্রায় লেখালিখি হয়। ব্যবসায়ীদের দুনিয়ায় ওঁর ডাকনাম হজমমোহন চ্যাটার্জি। কারণ, উনি নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের জ্যান্ত গিলে খেয়ে হজম করেন। লোকে বলে, বহু ইন্ডাস্ট্রিকে উনি প্যাঁচ কষে সিক হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তারপর সেই সিক ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিয়েছেন। অন্তত চারজন ইন্ডাস্ট্রির মালিক ভাগ্যের ফেরে এখন মদনমোহন চ্যাটার্জির নানান কোম্পানিতে ম্যানেজার কি ডেপুটি ম্যানেজারের চাকরি করছেন।

মদনমোহনের চলাফেরার ভঙ্গি আর হাবভাবে পয়সা ফুটে বেরোচ্ছিল। তিনি আঙুল তুলে ইশারা করেছিলেন আর ওঁর সঙ্গী চারজন পড়ি-কি-মরি করে সেই হুকুম তামিল করছিলেন।

সিকিওরিটি চেকের পর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। স্পিকার ঘোষণা শুনে যাত্রীরা রওনা হলেন প্লেনের দিকে।

প্লেনটা এয়ারবাস-এ থ্রিটোয়েন্টি। এতে প্রায় শ’আড়াই কি তার বেশি সিট থাকলেও এসিজি লক্ষ করলেন, প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বেশ কম। এই শীতের সময়, বিশেষ করে শনিবারে, হয়তো রাশ কম থাকে—কে জানে! আর সেইজন্যই ডক্টর দে এসিজি আর রঙ্গলালের সঙ্গে বসার সুযোগ পেলেন।

রঙ্গলাল উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন। এটা ওঁর জীবনের দ্বিতীয় প্লেন জার্নি। প্রথমটা কয়েকদিন আগে এখানে আসার সময়। তখনও বাচ্চাছেলের মতো উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন।

প্লেনের সিটের ব্যবস্থা দুই-চার-দুই ঢঙে সাজানো। দুই আর চারের মাঝে দুটো অলিপথ সমান্তরালভাবে প্লেনের লেজের দিক থেকে নাক পর্যন্ত চলে গেছে। সামনের দিকে এক্সিকিউটিভ ক্লাস—পরদার আড়াল দিয়ে সেটাকে ইকনমি ক্লাস থেকে আলাদা করা হয়েছে।

ইকনমি ক্লাসের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁ-দিকের দুটো সিটে পরপর বসলেন রঙ্গলাল ও এসিজি। তারপরই অলিপথ। অলিপথের পরের সিটটাতে ভবানীপ্রসাদ বসলেন। ফলে এসিজির সঙ্গে কথা বলতে ওঁর তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না।

এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি ওঁর সঙ্গী একজন সুন্দরী মাঝবয়েসি মহিলা ও একজন পুরুষকে নিয়ে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ঢুকে গেলেন। অন্য দু’জন ইকনমি ক্লাসে, এসিজিদের কাছ থেকে একটু দূরে, ডানদিকের সিটে বসে পড়লেন।

মদনমোহনের এক্সিকিউটিভ ক্লাসের সঙ্গী দু’জন কি তা হলে ওঁর আত্মীয়? ভাবলেন এসিজি…আর ইকনমি ক্লাসের এই দু’জন কি কর্মচারী?

ডক্টর দে একমনে মদনমোহন ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের লক্ষ করছিলেন। এসিজিও একপলকে ওঁদের দেখে নিয়েছিলেন। তাতে এসিজির ধারণা হয়েছে, ওঁরা কেউই অন্তর থেকে মদনমোহন চ্যাটার্জির হুকুম তামিল করছেন না। কে জানে, এসিজির ধারণা হয়তো ভুলও হতে পারে।

রঙ্গলাল হঠাৎই বললেন, ‘এসিজি স্যার, ফিরে গিয়ে ভাবছি আমার সেই লেখাটায় হাত দেব…।’

‘কোন লেখাটায়?’ ভুরু কোঁচকালেন এসিজি।

‘ওই যে, বলেছিলাম না, আমি স্বভাব-কবিতায় আপনার জীবনী লিখব…।’

হাসি পেয়ে গেল এসিজির। সত্যি, রঙ্গলালের খেয়ালের কোনও জুড়ি নেই! এসিজির জীবনী—তাও আবার কাব্যে!

এমনসময় ঘোষণা শুরু হল।

বিপদ দেখা দিলে কীভাবে অক্সিজেন-মাস্ক ব্যবহার করতে হবে সেটা ঘোষণার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মূকাভিনয় করে দু’জন হোস্টেস হাতে-কলমে দেখিয়ে দিল। ধূমপান না করার জন্য যাত্রীদের অনুরোধ করা হল। অনুরোধ করা হল মোবাইল ফোন অফ করে রাখার জন্য। এবং যাঁর-যাঁর সিটবেল্ট বেঁধে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল।

সবশেষে জানানো হল, এই উড়ানে যাত্রাপথ দু-ঘণ্টা কুড়ি মিনিটে সম্পন্ন করা হবে।

শেষ কথাটি শুনে নিয়তি বোধহয় মুচকি হেসেছিল।

সিনিয়ার এয়ারহোস্টেস ইরিনা বিশ্বাস যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে এসে ঢুকল তখন ওর ফরসা কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ। মনে হল যেন বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে।

চিফ স্টুয়ার্ড কুমারমঙ্গলম সেটা লক্ষ করল। ইরিনা সবসময় হাসিমুখে কাজ করে—সহজে ঘাবড়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। তাই কুমারমঙ্গলম মুড ফেরানোর চেষ্টায় ওকে বলল : ‘হোয়াটস আপ, ইরিনা? এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন তোমাকে? ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে কোনও খিদে পাওয়া নেকড়ে ঢুকে পড়েছে নাকি—যে তোমাকে দেখে থাবা চাটছে?’

শেষ কথাটা বলে চোখ ঠেরে হাসল কুমারমঙ্গলম। কিন্তু ইরিনার কপালে ভাঁজ সমান হল না। অন্যসময় ঠাট্টা-ইয়ারকিতে ইরিনা যেমন খিলখিল করে হেসে ওঠে, তেমনটাও হল না। বরং গম্ভীর গলায় ও বলল, ‘শোনো, টয়লেটের মধ্যে একজন প্যাসেঞ্জার বোধহয় আটকে পড়েছে…।’

‘বলছ কী? একজন, নাকি দু’জন? আই মিন…।’

কুমারমঙ্গলম একগাল হেসে আরও কীসব ফাজিল মন্তব্য করতে যাচ্ছিল, ইরিনা ওকে বাধা দিল : ‘ধুত, এসব নয়, আমি সিরিয়াসলি বলছি। কে জানে খারাপ কিছু হল কিনা! ভদ্রলোক টয়লেটে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ…অ্যাবাউট হাফ অ্যান আওয়ার। ওঁর সঙ্গে যাঁরা আছেন ওঁরাই আমাকে বললেন চেক করতে। আমি টয়লেটের দরজায় বারকয়েক টোকাও দিয়েছি, কিন্তু নো রেসপেন্স—কেউ সাড়া দেয়নি।’

কুমারমঙ্গলম বিরক্তির শব্দ করল একটা। প্যাসেঞ্জারের টয়লেটে আটকে পড়ার কেস সাধারণত দেখা যায় না—তবে একেবারে যে হয় না তা নয়। বছর পাঁচেক আগে একশো পাঁচ কি দশ কেজি ওজনের এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোককে একরকম টেনে-হিঁচড়ে টয়লেট থেকে বের করতে হয়েছিল। সে-কাজ করতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল সে আর বলার নয়—বরং ভুলে যাওয়াই ভালো।

‘এই হতভাগা প্যাসেঞ্জারটার নাম কী?’

‘প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দেখেছি—মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি! তা হলে তো বুঝতেই পারছেন!’

কুমারমঙ্গলম সোজা কপালে হাত চাপড়ে বলে উঠল, ‘মাই গুডনেস! ওঁর নাম তো নিশ্চয়ই শুনেছি! লোকটা রাইভাল বিজনেসম্যানদের জ্যান্ত চিবিয়ে খায়—তা হলে তোমার-আমার মতো চুনোপুঁটির কী হাল করবেন কে জানে! শিগগির চলো, গিয়ে দেখা যাক কেসটা কী! দেরি হলে তো উনি আমাদের এয়ারলাইনের চোদ্দোটা বাজিয়ে ছাড়বেন। চলো, চলো…।’

কুমারমঙ্গলম চটপট পা চালাল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের দিকে। ইরিনাও দেরি না করে ওর পিছন-পিছন রওনা হল।

টয়লেটের আশেপাশে আর কেউ ছিল না। টয়লেটের দরজায় ‘এনগেজড’ ফ্ল্যাগটা কুমারমঙ্গলমের চোখে পড়ল। দরজার কাছে গিয়ে ও চাপা গলায় ডেকে উঠল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি! ইজ এভরিথিং ওকে, স্যার?’

কোনও সাড়া নেই।

আরও একবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল কুমারমঙ্গলম, কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না।

তখন ও তাকাল ইরিনার দিকে। তারপর নক করল টয়লেটের ধাতব জায়গায়।

না, কোনও উত্তর এল না ভেতর থেকে।

কুমারমঙ্গলম ইরিনার দিকে ফিরল : ‘তুমি শিয়োর, ইরিনা, মিস্টার চ্যাটার্জি আধঘণ্টার ওপর টয়লেটে ঢুকেছেন?’

‘ওঁর সঙ্গের লোকরা তো তাই বলেছে।’

‘আর কোনও উপায় নেই। মে বি সামথিং ইজ রং উইথ দ্য লক।’ ইরিনার দিকে একবার তাকিয়ে দরজার খুব কাছে মুখ নিয়ে গেল কুমারমঙ্গলম। গলা সামান্য তুলে বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি, স্যার, আপনি বোধহয় কোনও প্রবলেমে পড়েছেন। ডোন্ট য়ু উয়ারি, স্যার। আমি দরজা ভাঙছি। আপনি যতটা পারেন দরজার কাছ থেকে সরে দাঁড়ান, স্যার।’

তারপরই কুমারমঙ্গলম খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়াল। বুট-পরা ডান পা-টা উঁচিয়ে প্রচণ্ড জোরে এক লাথি বসিয়ে দিল দরজার লকের কাছটায়। প্লেনের টয়লেটের দরজাগুলো তেমন মজবুত কিচ্ছু নয়। তাই এক লাথিতেই লকের কয়েকটা স্ক্রু বেরিয়ে পড়ল, দরজাটা কয়েক ইঞ্চি ঢুকে গেল ভেতরে।

কুমারমঙ্গলম আর-একবার লাথি কষাল।

লকটা ভেঙে গিয়ে দরজাটা প্রায় ইঞ্চিখানেক ফাঁক হয়ে গেল।

‘স্যার…?’ দরজায় ফাঁক-হয়ে যাওয়া জোড়ের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল কুমারমঙ্গলম। ও দরজাটা ঠেলে খুলতে চাইলেও দরজাটা আর খুলছিল না—কোথাও একটা আটকে যাচ্ছিল।

ধাক্কাধাক্কির শব্দ পেয়ে আর-একজন হোস্টেস সাবরিনা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে চলে এল।

ইরিনা, কুমারমঙ্গলম এবং টয়লেটের ফাঁক-হয়ে-থাকা দরজার দিকে তাকিয়ে সাবরিনা কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গেল। ইরিনাকে জিগ্যেস করল, ‘হোয়াটস, আপ, ইরিনা? এনি প্রবলেম?’

ইরিনা সংক্ষেপে ওকে জানাল, প্রবলেম’টা কী।

ততক্ষণে কুমারমঙ্গলম দরজাটা ঠেলেঠুলে আরও খানিকটা ফাঁক করে ফেলেছে। এবং সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিয়েছে ভেতরে।

পরক্ষণেই কুমারমঙ্গলমের মাথা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। এবং ওর মুখের চেহারা এখন দেখবার মতো।

শ্যামলা মুখ থেকে রক্ত সরে যাওয়ায় ছাইরঙা ফ্যাকাসে লাগছে। ছোট-ছোট বুদ্ধিদীপ্ত চোখে বুদ্ধির দীপ্তির বদলে ভয় আর অবিশ্বাসের কুয়াশা। ওর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনও শব্দ বেরোচ্ছে না।

ইরিনা আর সাবরিনা একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কুমারমঙ্গলমের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। ওরা বেশ বুঝতে পারছিল, কুমারমঙ্গলম ওদের খারাপ কিছু শোনাতে চলেছে।

বেশ কয়েকমিনিট জিভ আর ঠোঁট নিয়ে ধস্তাধস্তির পর কুমারমঙ্গলমের মুখ দিয়ে কয়েকটা মারাত্মক শব্দ বেরিয়ে এল। চাপা অস্পষ্ট গলায় ও বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জি ইজ ডেড। আই থিং হি হ্যাজ বিন শট।’

তার মানে!—অবাক হয়ে ভাবল ইরিনা আর সাবরিনা : বন্ধ টয়লেটের ভেতরে মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ গুলি করেছে। ইমপসিবল! এ হতেই পারে না!

টয়লেটের দরজাটা আবার টেনে ভেজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কুমারমঙ্গলম ইরিনাকে দিয়ে ক্যাপ্টেনকে খবর পাঠিয়েছিল যে, একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন অ্যারাইজ করেছে। ক্যাপ্টেন যদি একবার আসেন তা হলে খুব ভালো হয়।

খবরটা পাওয়ামাত্রই ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি চলে এসেছেন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটের কাছে।

অর্জন সিনিয়ার পাইলট। ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এ আছেন প্রায় পাঁচবছর। শক্তসমর্থ পেটানো শরীর। ঠান্ডা চোখ আর চৌকো চোয়াল যেন বলে দিচ্ছে অর্জন সুখানিকে টলানো বড় সহজ ব্যাপার নয়।

ফ্লাইট ডেক থেকে অর্জন যখন এক্সিকিউটিভ ক্লাসের অলিপথ দিয়ে হেঁটে আসছিলেন, তখন ওঁর ঠোঁটে ছিল পেশাদারি স্মিত হাসি, আর একই সঙ্গে প্যাসেঞ্জারদের লক্ষ করে ছোট-ছোট ‘নড’ করছিলেন।

বাইরের ভাবটা এরকম বজায় রাখলেও অর্জনের মনে ছিল বিরক্তি। কারণ, উড়ান সময়ের একঘণ্টা পার হয়ে গেছে…এখন এই ঝামেলার জন্য যদি কোনও এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করতে হয় তা হলে প্রচুর সময় নষ্ট হবে। কলকাতায় পৌঁছতে কত দেরি হবে কেউ বলতে পারে না। আর কাছাকাছি এয়ারপোর্ট বলতে বিশাখাপত্তনম। সুতরাং, সেখানকার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা বলতে হবে ‘আকাশ এয়ারলাইনস’-এর চিফ ফ্লাইট ম্যানেজারের সঙ্গেও। আবার, যদি তিনি বলেন তা হলে হয়তো চেয়ারম্যান কি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সঙ্গে অর্জনকে কথা বলতে হবে।

ইতিমধ্যে কুমারমঙ্গলম এক্সিকিউটিভ ক্লাসের প্যাসেঞ্জারদের কাছে ঘোষণা করে দিয়েছে যে, যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করা যাবে না। প্যাসেঞ্জাররা যেন ইকনমি ক্লাসের টয়লেট ব্যবহার করেন। এই অপ্রত্যাশিত অসুবিধে তৈরি হওয়ার জন্য ‘আকাশ এয়ারলাইনস’ দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

এক্সিকিউটিভ ক্লাসের গ্যালিতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন সুখানি বুঝলেন, পরিস্থিতি ভালো নয়। কারণ, কুমারমঙ্গলম, ইরিনা এবং সাবরিনার মুখের চেহারা সেরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। কুমারমঙ্গলমকে অর্জন বেশ ভালো করেই জানেন। ছেলেটা বছরদুয়েক ধরে অর্জনের সঙ্গে ফ্লাই করছে। চটপটে, ঠাট্টা-রসিকতার সমঝদার, বুদ্ধিমান। কিন্তু এখন ওকে দেখে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। আর ইরিনা, সাবরিনা যেন দুই যমজ বোন—কারণ, দু-জনেরই মুখ ফ্যাকাসে, বিহ্বল, ভয়ে দিশেহারা।

অর্জন ওদের মুখ থেকে চোখ সরিয়ে টয়লেটের লক-ভাঙা দরজার দিকে তাকালেন : ‘এই টয়লেটটায়?’

‘হ্যাঁ—।’ কুমারমঙ্গলম জবাব দিল।

নিজের শরীরের ভার দরজাটার ওপরে ছেড়ে দিয়ে চাপ দিলেন ক্যাপ্টেন। দরজাটা ফাঁক হল আবার। সেই ফাঁক দিয়ে মাথা গলিয়ে দিলেন।

মদনমোহন চ্যাটার্জির দেহটা টয়লেট-সিটের ওপরে এলিয়ে রয়েছে। পোশাক-আশাক ফিটফাট। দুটো হাত অসাড় হয়ে দু-পাশে ঝুলছে। পাদুটো ছড়িয়ে রয়েছে সামনের দিকে। পায়ে আটকে যাওয়ার জন্যই দরজাটা পুরোপুরি খোলা যাচ্ছে না।

নিস্পন্দ দেহটার বাকি অংশের চেহারা যাচ্ছেতাইরকমের বীভৎস।

মুখ থেকে বুক পর্যন্ত রক্ত-মাংস-হাড় তালগোল পাকিয়ে ছড়িয়ে আছে। দু-গাল থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মাংসের টুকরো ঝুলছে। রক্ত ছিটকে লেগেছে দু-পাশে দেওয়ালে। ঠিক মনে হচ্ছে, একটা স্কন্ধকাটা মূর্তি টয়লেট-সিটের ওপরে শিথিল ভঙ্গিতে বসে আছে।

অর্জন সুখানির শরীরের ভেতরটা কেমন পাক দিয়ে উঠল। বমির দমক উথলে উঠতে চাইল গলা দিয়ে। কিন্তু প্রবল চেষ্টায় তিনি সেটা রুখে দিলেন।

কুমারমঙ্গলম আগেই ওঁকে বলেছিল যে, মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ মুখে গুলি করেছে। সেইজন্যই অর্জন টয়লেটের মেঝেতে জরিপ নজর বুলিয়ে নিলেন। না, কোনও পিস্তল কিংবা রিভলভার চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা একটু অবাক করার মতো। তাই আরও একবার অনুসন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন সুখানি। এমনকী, বডির দু-পাশে শিথিলভাবে ঝুলে-থাকা দুটো হাতের মুঠোও ভালোভাবে নজর করে দেখলেন।

না, মুঠোয় কোনও অস্ত্র ধরা নেই।

মিস্টার চ্যাটার্জি যখন সুইসাইড করেছেন তখন অস্ত্রটা নিশ্চয়ই টয়লেটের কোথাও-না-কোথাও পড়ে থাকবে। সেটা দেখতে না পেয়ে অর্জন সুখানির ভুরু কুঁচকে গেল। এছাড়াও কোথায় যেন একটা গরমিল রয়েছে। কিন্তু গরমিলটা সুখানিকে বারবার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল।

জরিপের কাজ সেরে অর্জন সুখানি কুমারমঙ্গলমের মুখোমুখি হতেই ও রুমাল দিয়ে মুখ মুছল, টেনশন কমানোর চেষ্টায় আলতো করে বলল, এইরকম সিচুয়েশানের কথা আমাদের কোম্পানির ইমার্জেন্সি ম্যানুয়ালে লেখা নেই। লোকটা সুইসাইড করার আর জায়গা পেল না—একেবারে আকাশে, টয়লেটের মধ্যে!’

অর্জন মাথা নেড়ে বললেন, ‘সুইসাইড বলছেন? কিন্তু টয়লেটের মধ্যে তো কোনও ফায়ার-আর্মস চোখে পড়ল না!’

কুমারমঙ্গলম, ইরিনা আর সাবরিনা বড়-বড় চোখে তাকিয়ে রইল ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে।

‘প্যাসেঞ্জারদের এদিকটায় আসতে বারণ করেছেন ভালোই করেছেন। কিন্তু এখন কী করবেন কিছু ভেবেছেন?’ ক্যাপ্টেন সুখানি কুমারমঙ্গলমকে জিগ্যেস করলেন।

‘দুদিকে পরদা লাগিয়ে এই সেকশানটা আইসোলেট করে দেব। তারপর বোধহয় বডিটাকে বাইরে বের করতে হবে।’

‘ভদ্রলোক শুনলাম খুব বিগ শট?’

ইরিনা এবার জবাব দিল, ‘তার চেয়েও বেশি। মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি। ওঁর কথায় শেয়ার মার্কেট ওঠানামা করে।’

‘তার ওপর পলিটিক্যাল কানেকশানের ব্যাপারটা তো আছেই!’ কুমারমঙ্গলম যোগ করল, ‘এই কেসটা ঠিকমতো হ্যান্ডল করতে না পারলে পার্লামেন্টে আমাদের এয়ারলাইনস কোম্পানির পিণ্ডি চটকানো হবে।’

‘ওঁর সঙ্গে আর যাঁরা আছেন তাঁদের খবর দেওয়া হয়েছে? ওঁর সঙ্গে কে যেন আছেন বললেন না?’ শেষ প্রশ্নটা ইরিনাকে লক্ষ করে ছুড়ে দিলেন ক্যাপ্টেন সুখানি।

ইরিনা মাথা নেড়ে সায় দিল : ‘হ্যাঁ—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ওঁর সঙ্গেই দু’জন ট্রাভেল করছেন। সিটে বসানোর সময়ে খেয়াল করেছিলাম, উনি তাঁদের সঙ্গে বেশ কথাবার্তা বলছিলেন, ঠাট্টা করছিলেন…।’

‘তাঁদের ইনফর্ম করেছেন?’

‘করেছি। তবে শুধু বলেছি, একটা প্রবলেম হয়েছে—ব্যস, এইটুকুই।’

ক্যাপ্টেন সুখানি কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন : ‘প্যাসেঞ্জার লিস্ট চেক করে দেখুন কোনও ডক্টর আছে কি না। বডি রিমুভ করার আগে একটা ফরম্যাল মেডিক্যাল ওপিনিয়ান খুব জরুরি। আমাদের কোম্পানির মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি রুটিনের যা গাইডলাইন আছে আমরা সেটাই ফলো করব। আর আমি হেড অফিসে ব্যাপারটা ইনফর্ম করছি।

কুমারমঙ্গলম সায় দিয়ে ঘন-ঘন মাথা নাড়ল।

ক্যাপ্টেনের কথা শোনামাত্রই সাবরিনা ব্যস্তসমস্ত হয়ে একটা ক্যাবিনেটের কাছে গেল। ওটার ছোট্ট পাল্লা খুলে প্যাসেঞ্জার লিস্টটা বের করে নিল। তারপর লিস্টের নামগুলোর ওপরে তাড়াহুড়ো করে চোখ বোলাতে লাগল।

একটু পরেই ও চোখ তুলে তাকাল ক্যাপ্টেনের দিকে।

‘ক্যাপ্টেন, ইকনমি ক্লাসে দু’জন ডক্টর আছেন। এক্সিকিউটিভ ক্লাসে কেউ নেই।…’

‘সিট নাম্বার কত?’ কুমারমঙ্গলম জিগ্যেস করল।

‘এম-টু আর কিউ ফোর…।’

‘ওঁদের একজনকে চট করে ডেকে নিয়ে আসুন।’ হাত নেড়ে বললেন অর্জন সুখানি। তারপর তাকালেন ইরিনার দিকে : ‘মেডিক্যাল চেকআপের পর মিস্টার চ্যাটার্জির কম্প্যানিয়নদের যে-কোনও একজনকে এখানে ডাকব। কারণ, ডেডবডির ফরমাল আইডেন্টিফিকেশানটাও খুব ইমপর্ট্যান্ট। উই উইল হ্যাভ টু প্লে দিস স্ট্রিক্টলি বাই দ্য কোম্পানি রুলস। নিয়মের মধ্যে কোনও ফাঁক আমি রাখতে চাই না।’

স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, ক্যাপ্টেন সুখানি খুব টেনশনে রয়েছেন। ওঁর ভুরু এখনও কোঁচকানো, কপালে ভাঁজ। আর আনমনাভাবে নিজের কাঁচাপাকা গোঁফে আলতো করে আঙুল বোলাচ্ছিলেন।

সাবরিনা অলিপথ ধরে পেশাদারি ছন্দে হেঁটে এগিয়ে এল এম-টু সিটটার কাছে।

ভদ্রলোকের পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির ওপরে কাশ্মীরি কাজ করা সাদা শাল। মাথায় ধবধবে সাদা চুল, চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা। বয়েস ষাট-পঁয়ষট্টি কি তার একটু বেশি। ভদ্রলোক একটা অদ্ভুতরকমের রঙিন কিউব নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন।

এই ভদ্রলোক ডাক্তার! কে জানে!

ঝুঁকে পড়ে সাবরিনা নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত?’

ভদ্রলোক হাসিমুখে চোখ তুলে তাকালেন সাবরিনার দিকে।

বয়কাট চুল। শ্যামলা রং। টানা-টানা চোখ। পরনে আকাশ-নীল সিল্কের শাড়ি। মেয়েটি বেশ লম্বা হওয়ায় শাড়িটা দারুণ লাগছে। হাওয়াসখি হিসেবে শতকরা একশো ভাগ মানানসই।

‘ইয়েস মিস,’ বললেন এসিজি, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প য়ু?’

‘ডক্টর, আই অ্যাম অ্যাফ্রেইড দ্যাট উই হ্যাভ আ মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। আমাদের এক্সিকিউটিভ ক্লাসের একজন প্যাসেঞ্জারের একটু মেডিক্যাল প্রবলেম হয়েছে। যদি আপনি এসে একটু দেখেন তা হলে ক্যাপ্টেন খুব খুশি হবেন। প্লিজ, স্যার।’

কোম্পানির ম্যানুয়ালের মুখস্থ করা ফরমুলার মতো সাবরিনা কথাগুলো বলল। ট্রেনিং-এর সময়ে যেরকম যান্ত্রিক ঢং ওদের শেখানো হয়েছে তার বাইরে ও যেতে পারেনি। এবং কথার শেষে ট্রেনিং-এ শেখানো নিয়ম মেনে ও একচিলতে হাসি জুড়ে দিল।

সাবরিনার কথায় এসিজির হাসি একটু চওড়া হল : ‘সরি মিস, আমি ফিজিক্সের ডাক্তার—আই মিন ডক্টরেট। নট মাচ হেল্প টু য়ু। মনে হয় আপনি আমার এই বন্ধুকে চাইছেন। ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে। হি ইজ আ মেডিক্যাল ডক্টর…অ্যাকচুয়ালি হোয়াট য়ু নিড।’ কথা বলতে-বলতে ভবানীপ্রসাদের দিকে ইশারা করে দেখালেন অশোকচন্দ্র।

সাবরিনা ওর ঠোঁট আঠা দিয়ে সাঁটা যান্ত্রিক হাসি নিয়ে ঘুরে তাকাল ডক্টর দে-র দিকে। তাকিয়েই ও ভদ্রলোককে খেয়াল করতে পারল। কিউ-ফোর থেকে সিট চেঞ্জ করে এখানে এসে বসেছেন।

ভবানীপ্রসাদ সাবরিনার কথাগুলো শুনতে পেয়েছিলেন। তাই ওকে আর ফরমুলা মুখস্থ বলতে হল না। তার আগেই ভবানীপ্রসাদ উঠে দাঁড়িয়েছেন।

‘চলুন, মিস, তবে আমার সঙ্গে কোনও মেডিক্যাল ব্যাগ নেই। আমি একটু পার্সোনাল কাজে ব্যাঙ্গালোর এসেছিলাম। যদি সেরকম…।’

‘আমাদের প্লেনে ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিট আছে, ডক্টর। কিন্তু আমার মনে হয় না ওসবের আর দরকার হবে।’

ভবানীপ্রসাদ একটু অবাক হলেন, ভুরু কুঁচকে তাকলেন সাবরিনার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে সাবরিনা এক্সিকিউটিভ ক্লাসের দিকে হাঁটা দিয়েছে।

রঙ্গলাল এসিজির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’

উত্তরে এসিজি ঠোঁট ওলটালেন। তারপর মন দিলেন রুবিক কিউবের দিকে।

ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে টয়লেট কিউবিকল থেকে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ক্যাপ্টেন সুখানি এবং কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন। তারপর চোখ ফেরালেন হাতঘড়ির দিকে।

‘রক্ত যেভাবে জমাট বেঁধেছে তাতে মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা হয়েছে আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে…এই ধরুন সাড়ে আটটা কি পৌনে নটা নাগাদ।’

ক্যাপ্টেন সুখানি ছোট্ট করে ‘হুম’ শব্দ করলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘কীভাবে মারা গেছেন?’

ডক্টর দে মাথা চুলকোলেন, ঠোঁট কামড়ালেন বারকয়েক। খানিক সময় নিয়ে ইতস্তত করে বললেন, ‘বডিটা বাইরে বের করার ব্যবস্থা করুন। ডেফিনিট কিছু বলতে হলে আগে ফুল ইন্সপেকশান হওয়ার দরকার। তবে তার আগে একটা সাজেশান আছে…।’

‘কী সাজেশান?’

‘আমার সঙ্গেই একজন বিখ্যাত ক্রিমিনোলজিস্ট ট্র্যাভেল করছেন। ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশানের ব্যাপারে রিমার্কেবল জিনিয়াস…ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত…। ওঁর সঙ্গে আচমকা এই ফ্লাইটে দেখা। উনি একবার বডিটা দেখে যদি একটা ওপিনিয়ান দিতেনে তা হলে ভালো হত।’

অর্জন সুখানি কিংবা কুমারমঙ্গলম কেউই অশোকচন্দ্র গুপ্তের নাম শোনেনি। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

ডক্টর দে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, এটা আমার সিরিয়াস রিকোয়েস্ট। য়ু হ্যাভ গট নাথিং টু লুজ…।’

সত্যিই তো! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। ডক্টর গুপ্তকে একবার ডেডবডি ইন্সপেক্ট করতে দিলে কী আর ক্ষতি হবে! কিন্তু…।

ক্যাপ্টেন সুখানি ভবানীপ্রসাদ দে-র মুখের দিকে তাকালেন। খুঁটিয়ে দেখতে চাইলেন ওর কথার আড়ালে কোনও উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে কি না। তা ছাড়া…।

অর্জন বললেন, ‘ডক্টর, কেসটা যদি প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল সুইসাইড হয় তা হলে একজন ক্রিমিনোলজিস্ট সেখানে…।’

‘ক্যাপ্টেন, আপনি অযথা হয়রান হচ্ছেন!’ একটু বিরক্ত হয়েই ভবানীপ্রসাদ বললেন, ‘অ্যাজ আই সেইড, য়ু হ্যাভ গট নাথিং টু লুজ।’

অগত্যা কী আর করা যায়!

একটু পরেই ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত টয়লেটের কাছে এলেন। তাঁর খানিকটা পিছনেই দাঁড়িয়ে রঙ্গলাল। ভদ্রলোক হতভম্ব চোখে একবার তার মুখের ওপরে চোখ বোলালেন।

ক্যাপ্টেন ভুরু কুঁচকে রঙ্গলালকে দেখে ডক্টর দে-র দিকে তাকিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন, ‘ইনি কে?’

ভবানীপ্রসাদ দেখলেন বিশদ ব্যাখ্যায় গেলে ব্যাপারটা জটিল হয়ে যেতে পারে। তাই হেসে বললেন, ‘ওঁর খুব ক্লোজ। সাম সর্ট অফ অ্যাসিস্ট্যান্ট।’

রঙ্গলাল ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে তাকিয়ে আকর্ণ হাসলেন।

অশোকচন্দ্র টয়লেটের ভেতরটায় উঁকি মারলেন। মাত্র কয়েকমিনিট। তারপরই বেরিয়ে এলেন বাইরে।

মাথায় ধবধবে সাদা চুলের গোছায় বারতিনেক টান মেরে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘ভারি অদ্ভুত!’

‘কী অদ্ভুত?’ জানতে চাইলেন অর্জন সুখানি।

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। এসিজি। চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে হেসে বললেন, ‘খবর বোধহয় ভালো নয়, ক্যাপ্টেন।’ রসিকতার সামান্য ছোঁওয়া টের পাওয়া গেল এসিজির কথায়, ‘বডিটা আগে সাবধানে বাইরে বের করে নিয়ে আসুন। ডক্টর দে খুব খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বলুন, মিস্টার চ্যাটার্জির মৃত্যুর কারণটা কী? তারপর আমরা বুঝতে চেষ্টা করব, ঠিক কীভাবে ভদ্রলোক দুর্ঘটনাটা ঘটালেন…।’

‘দুর্ঘটনা! অ্যাক্সিডেন্ট! সুইসাইড নয় বলছেন…।’ এসিজির মুখের দিকে বিভ্রান্তভাবে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি।

‘আমি এখনও কিছু বলিনি…’ হাসলেন এসিজি : ‘যা বলার ডক্টর দে আগে বলবেন…তারপর আমি।’

নার্ভাসভাবে ঘাড়ে হাত বোলালেন ক্যাপ্টেন, বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আমাদের চেয়ারম্যানকে এক্ষুনি রেডিয়ো মেসেজ পাঠাতে হবে। এরকম ভাসা-ভাসা বললে উনি খুব বিরক্ত হবেন। হি ইজ লাইক টু হ্যাভ সামথিং মোর স্পেসিফিক! যদ্দূর মনে হয়, মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে ওঁর হয়তো আলাপ থাকলেও থাকতে পারে। ওঁদের অনেক কমন সার্কল আছে। আমাদেরই হয়েছে যত জ্বালা!’

‘কমন সার্কল আছে নয়, ছিল। আপনি আপনাদের চেয়ারম্যানসাহেবকে অনায়াসে বলতে পারেন যে, মিস্টার মদনমোদন চ্যাটার্জি এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেটে…যতদূর মনে হচ্ছে…মার্ডার্ড হয়েছেন।’

অর্জন সুখানি একটা জোরালো ধাক্কা খেলেন।

মার্ডার! বন্ধ টয়লেটের মধ্যে সেটা কেমন করে সম্ভব! কিন্তু এটাও তো তিনি লক্ষ করেছেন যে, টয়লেটের মধ্যেও কোনও রিভলভার কি পিস্তল নেই।

ক্যাপ্টেন সুখানির সবকিছু কেমন গুলিয়ে যেতে লাগল।

সুইসাইড হলেও ব্যাপারটার ঠিক হদিস পাওয়া যাচ্ছে না, আবার মার্ডার হলেও তাই।

এমন সময় ইরিনা হন্তদন্তভাবে এসে হাজির হল। প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ক্যাপ্টেন, মিস চ্যাটার্জি…মানে, মিস্টার চ্যাটার্জির বোন…ওঁর সঙ্গে ট্র্যাভেল করছেন…উনি খুব উতলা হয়ে পড়েছেন। এখানে আসতে চাইছেন…।’

‘ওঃ হো,’ বেশ বিরক্ত হলেন অর্জন সুখানি। হাত নেড়ে ইরিনাকে বললেন, ‘ওঁকে দুশ্চিন্তা করতে বারণ করুন। বলুন, ব্যাপারটা আমরা হ্যান্ডল করছি। আর এদিকটায় যেন কেউ না আসে। দিস ইজ অ্যান অর্ডার। অ্যাড্রেস সিস্টেমে এটা অ্যানাউন্স করে দিন—এক্ষুনি।’

ইরিনা চটপটে পায়ে চলে গেল এক্সিকিউটিভ ক্লাসের দিকে।

ভবানীপ্রসাদ দে এসিজির কথাগুলো ভাবছিলেন। বৃদ্ধ গোয়েন্দার কথাগুলো একটু অতিনাটকীয় শোনাচ্ছে না কি? সুতরাং তিনি ছোট্ট করে কেশে গলা পরিষ্কার করে একটু চাপা গলায় এসিজিকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, এত তাড়াহুড়ো করে ডিসিশান নেওয়ার দরকার কী? আসলে আমার মনে হচ্ছিল…।’

বৃদ্ধ হুনুর আপত্তি করে মাথা নাড়লেন, শান্ত গলায় বললেন, ‘ডক্টর দে, লক্ষ করেছেন, কী বীভৎসভাবে ভদ্রলোকের মুখের নীচের দিকের অংশটা ছত্রখান হয়ে উড়ে বেরিয়ে গেছে। চোখের নীচটায়…বিশেষ করে নাক আর মুখের জায়গাটা কিছু আর নেই। মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে গুলি করলে এরকম হওয়া সম্ভব। নাঃ, মিস্টার চ্যাটার্জি ডায়েড ইনস্ট্যান্টলি…নো ডাউট অ্যাবাউট ইট…।’

অর্জন সুখানি ইতিমধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। যে-গরমিলটা অনেকক্ষণ ধরে ওঁকে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল সেটা এখন হঠাৎই মনে পড়ে গেল। টয়লেটের ভেতরে পিস্তল কিংবা রিভলভার ফায়ার করলে…।

ক্যাপ্টেন সুখানি অশোকচন্দ্রের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ালেন। ঠোঁটের কোণে তেরছা একটা হাসির ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আপনার থিয়োরিতে এমনিতে কোনও ফাঁক নেই—শুধু একটা পয়েন্ট ছাড়া। টয়লেটের ভেতরে কোনও লো ক্যালিবারের ফায়ার আর্মসও যদি ফায়ার করা হয়ে থাকে…মানে, মুখে রিভলভারের নল ঢুকিয়ে…তা হলে মাথা ফুটো করে গুলিটা সোজাসুজি গিয়ে লাগবে টয়লেটের দেওয়ালে। ওটা যে-ফোর্সে গিয়ে লাগবে তাতে দেওয়াল অনায়াসে ফুটো হয়ে যাবে। দ্যাট উইল কজ ডিকম্প্রেশান। বুঝতেই পারছেন, এই তেত্তিরিশ হাজার ফুট উঁচুতে একটা বুলেট যদি এয়ারক্র্যাফটের দেওয়াল ফুটো করে দেয়, তা হলে কী প্রবলেম হতে পারে?’

রঙ্গলাল সুখানির কাছে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াট ইজ ডিকম্প্রেশান, ক্যাপ্টেন?’

ক্যাপ্টেন সুখানি বিরক্ত হয়ে কুমারমঙ্গলমের দিকে কড়া চোখে তাকালেন। মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারায় ওঁকে সরিয়ে নিতে বললেন।

কুমারমঙ্গলম রঙ্গলাল গোস্বামীকে একপাশে টেনে নিয়ে বলল, ‘আসুন, আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি…।’

ক্যাপ্টেনের কথার সুরে একটা বাঁকা ভাব এসিজি লক্ষ করেছিলেন। কিন্তু তাতে বৃদ্ধ হুনুর কিছু মনে করেননি। পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই অ্যানালিটিক্যাল মাইন্ড থাকতে হবে এই চাহিদা বড্ড বাড়াবাড়ি। আর আই. কিউ. লেভেলও সকলের উঁচু তারে বাঁধা থাকতে হবে এমন কোনও মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। শরীরের ব্যায়াম না করলে কখনও শরীর চোস্ত হয় না। মগজের বেলাতেও ঠিক তাই। থিঙ্কিং মেশিনটার কলকবজায় নিয়মিত তেল দিলে তবে না মেশিন কাজ করবে! ক্যাপ্টেন সুখানিকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি কোম্পানির হোমরাচোমরাদের তেল দিতেই বেশি ব্যস্ত। ফলে ওঁর জং-ধরা মগজটা যেমন থাকার কথা তাই-ই আছে।

সুতরাং নরম হেসে মোলায়েম গলায় এসিজি বললেন, ‘একটা বোধহয় ভুল হচ্ছে, ক্যাপ্টেন। আমি কখনও বলিনি যে, মিস্টার চ্যাটার্জি বুলেট ফায়ারিং-এই খুন হয়েছেন। আমি বলেছি, মুখের ভেতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে গুলি করলে এরকম হওয়া সম্ভব…।

কুমারমঙ্গলম তখন হাত-পা নেড়ে রঙ্গলালকে ডিকম্প্রেশান বোঝাচ্ছিল।

‘…গ্রাউন্ড লেভেল থেকে অ্যাবাউট থার্টি থ্রি থাউজ্যান্ড ফুট হাইটে অ্যাটমসফিয়ার খুব থিন হয়ে যায়। মানে, বাতাস এত পাতলা যে, তার প্রেসার নেগলিজিবলি স্মল হয়ে যায়। এই পাতলা বাতাসে মানুষ বাঁচতে পারে না…।’

ঘাড় নেড়ে রঙ্গলাল বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—সেইজন্যেই সবাই অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে পাহাড়ে ওঠে।’

‘অ্যাবসলিউটলি রাইট।’ কুমারমঙ্গলম বলল, ‘সেইজন্য প্লেনের ভেতরে গ্রাউন্ড লেভেলের অ্যাটমসফেরিক প্রেসারে বাতাস ভরা থাকে। যদি কোনও কারণে প্লেন ফুটো হয়ে যায়…খুব ছোট ফুটো হলেও চলবে…তা হলে আলপিন ফোটানো বেলুন যেমন হাওয়া বেরিয়ে চুপসে যায় সেরকম আমাদের প্লেনের ভেতরকার বাতাসও ফুস করে বাইরে বেরিয়ে যাবে। তখন শ্বাসকষ্টে প্যাসেঞ্জার, ক্রু—সবাই কাহিল হয়ে পড়বে। সেইজন্যেই ডিকম্প্রেশানকে আমরা ভয় পাই।’

‘বুঝেছি, বুঝেছি—’ মাথা নেড়ে বললেন রঙ্গলাল, ‘যদি না থাকে বায়ুচাপ/ বলবে সবাই বাপরে বাপ।’

কুমারমঙ্গলম রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতার কী বুঝল কে জানে! তবে একগাল হেসে ঘন-ঘন মাথা নেড়ে সায় দিল।

ওরা এসিজিদের কাছে এসে দাঁড়াল আবার।

এসিজি মাথার চুলে হাত বোলালেন। তারপর সামান্য কেশে ক্যাপ্টেনকে লক্ষ করে বললেন, ‘আসলে আমি বলতে চাইছি, ক্যাপ্টেন, ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস। উন্ডটা গানশটের মতো, অথচ টয়লেটের দেওয়াল ফুটো হয়নি…।’

এসিজিকে বাধা দিয়ে কুমারমঙ্গলম বলল, ‘ব্যাপারটা সুইসাইড হতে বাধা কোথায়, মিস্টার গুপ্ত? ভদ্রলোক টয়লেটের ভেতরে দরজা লক করে বসেছিলেন। সেখানে বাইরে থেকে…ওঃ, ইমপসিবল।’

এসিজি চোখ ফেরালেন চিফ স্টুয়ার্ডের দিকে : ‘আপনার পয়েন্টটা আমি বুঝতে পারছি। তবে নেচার অফ উন্ড দেখে মনে হচ্ছে মিস্টার চ্যাটার্জি ইনস্ট্যানটেনিয়াসলি মারা গেছেন। তা হলে সুইসাইড করার পর তাঁর পক্ষে অস্ত্রটা কি লুকিয়ে ফেলা সম্ভব? সুতরাং, সুইসাইড যদি হয়, তা হলে অস্ত্রটা কোথায় গেল? আর মার্ডার যদি হয়, তা হলে মার্ডারার টয়লেটের দরজাটা ভেতর থেকে লক করল কীভাবে? এখন এই দুটোই হচ্ছে আমাদের কাছে মোস্ট ফান্ডামেন্টাল প্রশ্ন। সেইজন্যেই বলেছি, ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস। কী বলেন, ডক্টর দে?’

ভবানীপ্রসাদ দে কেমন যেন ধন্দে পড়ে গিয়েছিলেন। সেটা সামলে নিয়ে ক্যাপ্টেন এবং কুমারমঙ্গলমের দিকে একবার দেখলেন। তারপর এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘ওই ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তর তো আপনাকেই দিতে হবে, ডক্টর গুপ্ত।’

‘হুঁ…হুঁ…’ বলে সহাস্যে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ হুনুর।

ক্যাপ্টেন সুখানি অবিশ্বাসের চোখে দীর্ঘকায় বৃদ্ধ মানুষটির দিকে তাকালেন। এঁকে ডেকে এনে আরও ঝামেলা হল দেখছি। আমতা-আমতা করে তিনি বললেন, ‘মার্ডার ওয়েপনটা একবার ভালো করে খুঁজে দেখলে হয় না? হয়তো দরজার আড়ালে বা টয়লেট সিটের পেছনে আনাচে-কানাচে কোথাও একটা পড়ে আছে…।’

অশোকচন্দ্র এ-কথার কোনও উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না।

অর্জন সুখানি মরিয়া হয়ে অন্তত একটা খড়খুটো আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলেন। কারণ, লকড রুম প্রবলেম বড় বিচ্ছিরি জিনিস।

এসিজির দিকে আকুল চোখে তাকিয়ে তিনি একটা নতুন থিয়োরির প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনার কী মনে হয়, ডক্টর গুপ্ত? মিস্টার চ্যাটার্জিকে কোথাও খুন করে তারপর টয়লেটে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে?’

এসিজি বোধহয় ক্যাপ্টেনের মনের কথা আঁচ করতে পারলেন। তিনি বললেন, ‘সেটা হলেও তো লকড রুম প্রবলেমটাকে এড়ানো যাচ্ছে না, ক্যাপ্টেন। কারণ, ডেডবডিটা টয়লেটে সিটের ওপরে বসিয়ে দিয়ে মার্ডারার হয়তো সটকে পড়ল…ভালো কথা। কিন্তু টয়লেটের দরজাটা সে ভেতর থেকে লক করবে কী করে? তা ছাড়া, টয়লেটের ওয়ালে যেভাবে রক্ত ছিটকে লেগেছে তাতে এটা খুবই স্পষ্ট যে, মিস্টার চ্যাটার্জি যখন মারা যান তখন তিনি টয়লেট সিটেই বসেছিলেন এবং টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল।’

কুমারমঙ্গলমের দিকে ঘুরে তাকালেন এসিজি : ‘কী, মিস্টার কুমারমঙ্গলম, ঠিক বলছি তো?’

ঠোঁট চেপে অস্বস্তির চোখে ক্যাপ্টেনের দিকে একবার তাকাল কুমারমঙ্গলম, তারপর এসিজির দিকে ফিরে বলল, ‘ঠিকই বলেছেন—টয়লেটের দরজা ভেতর থেকে লক করা ছিল।’

‘তা হলে কী করে…।’

উত্তেজিত ক্যাপ্টেনকে বাধা দিলেন এসিজি : ‘সেটাই আমাকে বের করতে হবে…যদি আপনি আমাকে দয়া করে অনুমতি দেন…।’

‘কীসের অনুমতি?’

‘ওই যে বললাম…মোস্ট ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অনুমতি।’

ক্যাপ্টেন সুখানি দোনামনা হয়ে কী যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘আমি তা হলে আমাদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলছি। আমার চেয়েও ওঁর পারমিশান নেওয়াটা জরুরি। ওঁকে বলি, প্লেনে একটা মিসহ্যাপ হয়ে গেছে। এক্সিকিউটিভ ক্লাসের একজন প্যাসেঞ্জার…ওয়েলনোন বিজনেস টাইকুন মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জি হ্যাজ…।’

‘বিন মার্ডার্ড।’ ক্যাপ্টেনের কথা স্পষ্ট গলায় শেষ করলেন এসিজি : ‘আপনি আপনাদের চেয়ারম্যানকে আমার কথাও বলতে পারেন। এম.পি. মিস্টার পরেশ সান্যাল আমাকে পার্সোনালি জানেন। দরকার হলে সেকথাও আপনি জানাতে পারেন। এ ছাড়া আমার মনে হয়, ইনভেস্টিগেশানের ব্যাপারটা আমাদের প্লেনের মধ্যেই যতটা সম্ভব সেরে ফেলা উচিত। তাতে আমাদের সাইকোলজিক্যাল অ্যাডভানটেজ আছে। কারণ, মার্ডারার প্লেনে বন্দি থেকে আনসেফ ফিল করবে। হি অর শি উইল বি আন্ডার এক্সট্রিম টেনশান। ফলে আমরা সহজে তাকে চিনে নিতে পারব। দেন পুলিশ ক্যান টেকওভার।’

ক্যাপ্টেন হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কলকাতা পৌঁছোতে তো আর একঘণ্টাও বাকি নেই! সেখানে এয়ারক্র্যাফট ল্যান্ড করলে প্যাসেঞ্জারদের কিছুতেই আর প্লেনে আটকে রাখা যাবে না। প্যাসেঞ্জারদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা বিগ শট। ওঁরা আমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন…।’

হাত তুলে ক্যাপ্টেনকে অভয় দিলেন এসিজি। হেসে বললেন, ‘এলিমেন্টারি, মাই ডিয়ার ক্যাপ্টেন। প্যাসেঞ্জারদের বলুন যে, প্লেনে একটু টেকনিক্যাল প্রবলেম দেখা দিয়েছে। সেটা ঠিক করার জন্যে বিশাখাপত্তনম এয়ার টার্মিনালে আমাদের ইমার্জেন্সি ল্যান্ডিং করতে হবে। আশা করি দু-একঘণ্টার মধ্যে রিপেয়ারের কাজটা মিটে যাবে। অ্যান্ড দ্য ইনকনভেনিয়েন্স কজড ইজ রিগ্রেটেড।’ শেষ কথাটা এসিজি বেশ নাটকীয়ভাবে ঘোষণার ঢঙে বললেন।

ক্যাপ্টেন সুখানির মুখে পলকে হাসি ফুটে উঠল। তিনি হাত বাড়িয়ে এসিজির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন : ‘দ্যাট ওয়াজ আ রিয়েল বিউটি, ডক্টর গুপ্ত। নাউ আই বিলিভ য়ু ক্যান ন্যাব দ্য কিলার। থ্যাঙ্ক য়ু ভেরি মাচ।’

ক্যাপ্টেনের নির্মেঘ মুখের দিকে তাকিয়ে ভরসা পেল কুমারমঙ্গলম। কারণ, ক্যাপ্টেন সুখানি লোক চিনতে ভুল করেন না। তা ছাড়া, কুমারমঙ্গলমের কেন জানি না মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ এই লোকটা পারলেও পারতে পারে।

ফ্লাইট ডেকের দিকে রওনা হওয়ার আগে ক্যাপ্টেন ডক্টর গুপ্তকে জিগ্যেস করলেন, ‘আমাদের এম.পি-র নামটা কী বললেন যেন?’

‘মিস্টার পরেশ সান্যাল। কিন্তু চেয়ারম্যানসাহেবকে এতসব কি বলার দরকার আছে?’

‘আছে। এম.পি-টেম.পি. শুনলে ওঁরা একটু বেশি ভরসা পান। আর আমি এখুনি অ্যানাউন্সমেন্টেরও ব্যবস্থা করছি। ধরে নিন, আমরা ভাইজাগের দিকে রওনা হয়ে গেছি। কুমারমঙ্গলমের দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি : ‘কুমারমঙ্গলম, য়ু প্লিজ লুক আফটার দিস অড কাপল অফ ডক্টরস। ওঁরা যা-যা বলেন কো-অপারেট করুন। নাউ দে আর দ্য বস। আমি এক্ষুনি আমাদের চেয়ারম্যান মিস্টার সুরেশ ওয়ালিয়ার সঙ্গে কথা বলে সব ক্লিয়ারেন্স নিয়ে নিচ্ছি।’

তড়িঘড়ি পা ফেলে ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি পরদা সরিয়ে চলে গেলেন।

এসিজি ডক্টর দে-র দিকে ফিরে বললেন, ‘ডক্টর’ দে, আসুন, এবারে বডিটা সাবধানে বের করে ফেলা যাক।’

কুমারমঙ্গলম একেবারে হাঁ-হাঁ করে এসিজিকে বাধা দিল, বলল, ‘আপনি কেন হাত লাগাবেন, ডক্টর গুপ্ত! আপনি এপাশটায় দাঁড়ান…আমি আর ডক্টর দে ম্যানেজ করে নিচ্ছি।’

সরে এলেন এসিজি। হাসলেন মনে-মনে। এম.পি.-র নাম নেওয়ার অ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! এইসব নাম-টাম নেওয়া ওঁর অভ্যেস নয়। এখানে এরকম একটা ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন হয়েছে বলে বাধ্য হয়ে পরেশ সান্যালের নামটা বলতে হয়েছে। বছরতিনেক আগে মিস্টার সান্যালের একটা চুরি-যাওয়া সোনার হাতঘড়ি এসিজি উদ্ধার করে দিয়েছিলেন। সেই থেকেই পরিচয়টা গাঢ় হয়েছে।

এসিজি খেয়াল করেননি, কখন যেন রঙ্গলাল ওঁর খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন। ওঁর কানের কাছে মুখ এনে রঙ্গলাল যখন চাপা গলায় বললেন, ‘আকাশে মার্ডার/ প্রবলেম হার্ডার’, তখনই এসিজি ওঁকে খেয়াল করলেন। এবং হেসে ফেললেন।

মিনিট-পনেরোর মধ্যেই অর্জন সুখানি ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে এলেন। ততক্ষণে মদনমোহন চ্যাটার্জির দেহটা টয়লেট স্পেস থেকে বের করে বাইরে মেঝেতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। এবং ভবানীপ্রসাদ দে ওঁর প্রাথমিক পরীক্ষা সেরে ফেলেছেন।

পরীক্ষা করে এসিজির সঙ্গে একমত হয়েছেন ভবানীপ্রসাদ। পিস্তল কিংবা রিভলবার, যা-ই ব্যবহার করা হয়ে থাকুক না কেন, সেটা ফায়ার করা হয়েছে মুখের মধ্যে নল ঢুকিয়ে। এবং মৃত্যু হয়েছে তৎক্ষণাৎ।

অর্জন সুখানি ডেডবডির দিকে একবার তাকালেন। তারপর এসিজির মনোযোগ পাওয়ার আশায় ছোট্ট করে বারদুয়েক কাশলেন।

এসিজি কপালে ভাঁজ ফেলে মুখ তুলে তাকালেন ক্যাপ্টেনের দিকে।

‘ডক্টর গুপ্ত, আমাদের চেয়ারম্যানকে গোটা ব্যাপারটা জানিয়েছি। উনি আপনাকে এই কেসটা ইনভেস্টিগেট করার পুরো অথরিটি দিয়েছেন। মনে হয়, মিস্টার পরেশ সান্যালের সঙ্গে ওঁর পরিচয় আছে—কারণ, উনি মিস্টার সান্যালের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেছেন। আমরা আশা করছি, ভাইজাগেই ব্যাপারটা মিটে যাবে। তখন লোকাল অথরিটির কাছে কেসটা হ্যান্ডওভার করে দিতে হবে। মিস্টার ওয়ালিয়ার কথা মনে হল, হি ইজ কনভিন্সড অ্যান্ড ইমপ্রেসড অ্যাবাউট ইয়োর এবিলিটি। হয়তো মিস্টার সান্যাল কিছু বলে থাকবেন। ওয়েল…’ দু-পাশে হাত ছড়িয়ে বললেন ক্যাপ্টেন, ‘নাউ ইটস ইয়োর গেম।’

‘আমাদের প্লেন এখন তা হলে বিশাখাপত্তনমের দিকে যাচ্ছে?’ ভবানীপ্রসাদ জিগ্যেস করলেন।

‘হ্যাঁ। চেয়ারম্যানসাহেব বললেন, মিস্টার চ্যাটার্জি যখন মারাই গেছেন তখন অযথা তাড়াহুড়ো করে প্লেন ডাইভার্ট করে ডাক্তার-নার্সিং হোম খোঁজার কোনও মানে হয় না। আপনি কাজ শুরু করুন, ডক্টর গুপ্ত।’

‘গুড। তাহলে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে যেখানে বেশ কিছু সিট ফাঁকা আছে সেরকম একটা জায়গা আমাদের দিন, ক্যাপ্টেন। মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে যাঁরা ট্র্যাভেল করছেন তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। তবে অন্য প্যাসেঞ্জাররা যেন অযথা ভয়-টয় না পেয়ে যায় সেটাও খেয়াল রাখবেন। তা হলে আমাদের কাজের অসুবিধে হবে।’

‘কুমারমঙ্গলম, আপনি এক্সিকিউটিভ ক্লাসে একটু স্পেসের ব্যবস্থা করুন।’ চিফ স্টুয়ার্ডকে নির্দেশ দিলেন অর্জন, ‘দেখবেন, ডক্টর গুপ্তদের ওয়ার্কিং স্পেসের কাছাকাছি যেন কোনও প্যাসেঞ্জার না থাকে। অনেক সিট তো খালি আছে—সেরকম হলে তাদের একটু শিফট করিয়ে দেবেন।’

কুমারমঙ্গলম ‘ইয়েস, স্যার’ বলে বেরিয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন এবার হালকা গলায় এসিজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাকে আপনার সন্দেহ হয়, মিস্টার গুপ্ত? নরমালি দ্য কিলার ইজ সামওয়ান রিলেটেড টু দ্য ভিকটিম…।’

সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মারলেন এসিজি। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন, মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে চারজন ট্রাভেল করছিলেন। দু’জন ওঁর সঙ্গেই বসেছেন—এক্সিকিউটিভ ক্লাসে। আর বাকি দুজনে আছেন ইকনমি ক্লাসে।’

সুখানি বললেন, ‘হ্যাঁ মদনমোহন চ্যাটার্জির বোন তো খেপে লাল! ইরিনাকে যা-তা ভাষায় অ্যাটাক করেছেন। তারপর আমি গিয়ে ওঁকে অনেক কষ্টে ঠান্ডা করেছি। কিন্তু ইকনমি ক্লাসে কোন দু’জন ওঁর গ্রুপের?’

‘ডক্টর দে বোধহয় এ-ব্যাপারে আপনার হেলপ করতে পারবেন…।’ কথা বলতে-বলতে ভবানীপ্রসাদের দিকে ফিরলেন এসিজি।

কিন্তু রঙ্গলাল গোস্বামী তৎপরভাবে বলে উঠলেন, ‘আমার সঙ্গে কেউ চলুন…আমি ওঁদের চিনিয়ে দিচ্ছি।’

ক্যাপ্টেন চট করে এগিয়ে গেলেন পরদার কাছে। পরদা সরিয়ে উঁকি মারতেই সাবরিনাকে দেখতে পেলেন। ওকে ইশারায় ডাকলেন।

সাবরিনা আসতেই রঙ্গলালকে বললেন, ‘আপনি কাইন্ডলি হোস্টেসের সঙ্গে যান। যতটা ইনকন্সপিকুয়াসলি পারেন ওই দু’জন প্যাসেঞ্জারকে চিনিয়ে দিন…।’

‘ইনকন…কী বললেন?’ রঙ্গলাল প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ক্যাপ্টেনের চোখে।

এসিজি হেসে রঙ্গলালকে বললেন, ‘এমনভাবে চেনাবেন যেন কেউ বুঝতে না পারে।’

ওঁরা দু’জন চলে যেতেই এসিজি ক্যাপ্টেনকে বললেন, ‘মিস্টার চ্যাটার্জির বোনের সঙ্গে প্রথম কথা বলা যাক। উনি তো শুনলাম বেশ অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। তা ছাড়া, ডেডবডির ফরমাল আইডেন্টিফিকেশানটা এখন করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।’

এমনসময় কুমারমঙ্গলম ফিরে এল। বলল যে, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এক্সিকিউটিভ ক্লাসে একটা কর্নার স্পেসে বসে ডক্টর গুপ্ত সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে প্যাসেঞ্জাররা বেশ রেস্টলেস হয়ে পড়েছে একজন রেগুলার প্যাসেঞ্জার তো বলেই বসেছে, প্লেন হঠাৎ কোর্স চেঞ্জ করে ভাইজাগের দিকে যে যাচ্ছে তার আসল কারণটা কী? সত্যিই কোনও টেকনিক্যাল প্রবলেম, নাকি অন্য কিছু? কুমারমঙ্গলম তাকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে-টুঝিয়ে শান্ত করেছে।

ক্যাপ্টেন কুমারমঙ্গলমকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্তদের কাজের সময় প্যাসেঞ্জাররা এদিক-ওদিক চলে-ফিরে বেড়ালে প্রবলেম হবে। আপনি ইরিনাকে বলুন পি. এস. সিস্টেমে অ্যানাউন্স করে দিক, সব প্যাসেঞ্জার যেন নিজের-নিজের সিটে বসে সিট বেল্ট বেঁধে নেয়। কারণ, আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই টারবুলেন্স আশা করছি। একে তো কুয়াশার জন্যে ফ্লাইট লেট হয়েছে, ফলে প্যাসেঞ্জাররা ধরে নেবে আজ প্রকৃতি আমাদের সঙ্গে নেই।’ ডক্টর গুপ্তর দিকে তাকালেন ক্যাপ্টেন সুখানি : ‘এবার তা হলে মিস চ্যাটার্জিকে খবর দেওয়া যাক?’

সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লেন এসিজি। ওঁর চোখের দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেনের মনে হল বৃদ্ধ হুনুরের মন পড়ে আছে অন্য কোথাও—গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছেন তিনি।

কুমারমঙ্গলমকে ইশারায় নির্দেশ দিলেন ক্যাপ্টেন। অর্থাৎ মিস চ্যাটার্জিকে পাঠিয়ে দিন।

কুমারমঙ্গলম ব্যস্তভাবে চলে গেল।

ক্যাপ্টেন ভুরু উঁচিয়ে তাকালেন এসিজির দিকে। পুরোনো প্রশ্নটাই করলেন আবার : ‘কী বুঝছেন, ডক্টর গুপ্ত? হু কুড বি দ্য পসিবল কিলার? মিস্টার চ্যাটার্জির চেনা-জানা কেউ? না কি…।’

উত্তরে হাসলেন অশোকচন্দ্র : ‘এখনই কিছু বলা অসম্ভব। তবে, ক্যাপ্টেন, আপনার প্লেন চালানোর যেমন কিছু রুলস আছে, থিয়োরি আছে, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশানেও ঠিক তাই। যারা সাসপেক্ট তাদের মধ্যে একজনকে খুঁজে বের করুন যার খুন করার উদ্দেশ্য আছে, সুযোগ আছে, আর সাহস আছে…।’

‘ইজ ইট সো?’ মজা করে জিগ্যেস করলেন অর্জন সুখানি।

‘ইয়েজ, ক্যাপ্টেন—মোটিভ, অপারচুনিটি অ্যান্ড গাটস—দ্য রুল অফ থ্রি ফর আ কিলিং।’

‘উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট, ডক্টর। আমি ফ্লাইট ডেক-এ যাচ্ছি। কিপ মি ইনফরমড অফ এনি ডেভেলাপমেন্টস।’

ইরিনার সঙ্গে যে-ভদ্রমহিলা এসিজিদের কাছে এলেন ওঁকে দেখে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল উনি যথেষ্ট বড়লোক এবং বিরক্ত।

বয়েস পঁয়তাল্লিশ পেরোলেও মেকাপ সেটাকে প্রাণপণে পিছনদিকে টানছে। ছিপছিপে ফরসা চেহারা, পানপাতার মতো মুখ। বয়েসে সুন্দরী ছিলেন অবশ্যই—ফলে এখনও যে কেন মিস থেকে গেছেন সেটাই আশ্চর্যের।

ভদ্রমহিলার কপালে টিপ, চোখের পাতায় মাসকারা, চোখের ঢাকনায় আইলাইনার, আরও কত কী! ওঁকে ঘিরে থাকা পারফিউমের হালকা গন্ধ মনটা ভালো করে দিচ্ছিল। পরনে সোনালি পাড়ের এক অদ্ভুত রঙের শাড়ি—যেন কেউ স্প্রে করে কয়েকটা আবছা রং মোলায়েমভাবে শাড়িতে বুলিয়ে দিয়েছে। আর কাঁধ থেকে ঝুলছে একটা কালো চকচকে শৌখিন লেডিজ ব্যাগ। ভদ্রমহিলার পোশাক দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এখন শীতকাল।

ওঁর শরীরে গয়না বলতে মাত্র তিনটি। হাতে আংটি এবং ব্রেসলেট। আর গলায় সরু সোনার চেনে বসানো লকেট। তবে তিনটে গয়নাতেই যথেচ্ছভাবে হিরে বসানো।

এসিজি জোরে নাক টানলেন। হয়তো পারফিউমের গন্ধ ছাপিয়ে টাকার গন্ধ পাওয়া যায় কি না দেখতে চাইছিলেন।

‘এসব কী শুনছি! দাদার নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে! কোথায়, দাদা কোথায়? সেই কখন টয়লেটে গেছে! তখন থেকে এই অকর্মা মেয়েগুলোকে বলছি খোঁজ নিতে। কী করে যে এরা হোস্টেসের চাকরি পায় কে জানে! হোপলেস! এদিকে সিটে বসে আমি আর রমেশ দুশ্চিন্তায় মরছি—সেদিকে কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি রমেশকে বললাম…।’

‘ম্যাডাম—’ ভদ্রমহিলার কথাপ্রপাতে বাধা দিলেন অশোকচন্দ্র : ‘আপনার নামটা প্লিজ আমাদের বলবেন—।’

এতক্ষণ ভদ্রমহিলা ভবানীপ্রসাদ দে-কে লক্ষ করে কথা বলছিলেন—হয়তো ওঁর কম বয়েসটাই তার কারণ। এখন চমকে ঘুরে তাকালেন পঁয়ষট্টি পেরোনো বৃদ্ধের দিকে। কয়েকপলক তাচ্ছিল্যের চোখে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যেন ওঁর নাম না জানাটা এসিজির পক্ষে অপরাধ। তারপর বোধহয় এসিজির সাদা চুলের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধকে ক্ষমা করতে পারলেন।

দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বললেন, ‘শ্রাবণী—শ্রাবণী চ্যাটার্জি। আমি মদনমোহন চ্যাটার্জির বোন। তার আবার সার্টিফিকেট দেখাতে হবে না কি!’

এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে হাসলেন। শ্রাবণীর চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, একসময় এই চোখে তির ছিল। কত যুবক সেই তিরে বিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু আজ তুণ খালি—তবুও সোনার দিনটা আন্দাজ করা যায়। ‘না, মিস চ্যাটার্জি, কোনও সার্টিফিকেট আপনাকে দেখাতে হবে না। বরং আমরাই আপনার কাছে সার্টিফিকেট চাইছি।’ এসিজি নরম গলায় বললেন।

‘তার মানে!’

‘আপনি ডক্টর দে-র সঙ্গে ওই পরদার আড়ালে একবার যান। ওখানে একটা ডেডবডি আছে। প্লিজ, এর পরের কথাটা শুনে হঠাৎ করে যেন চেঁচিয়ে উঠবেন না—কারণ, অন্য প্যাসেঞ্জাররা এখনও জানে না, এই প্লেনে একটা মার্ডার হয়েছে। আপনি কাইন্ডলি গিয়ে আপনার দাদার ডেডবডিটা আইডেন্টিফাই করুন। হি প্রব্যাবলি হ্যাজ বিন শট ইন দ্য মাউথ।’

সঙ্গে-সঙ্গে শ্রাবণী একটা অদ্ভুত শব্দ করে টলে পড়ে গেলেন। ইরিনা সময়মতো ওঁকে ধরে না ফেললে হয়তো মাথায় কিংবা ঘাড়ে চোট লাগতে পারত।

ইরিনা শ্রাবণীকে একটা সিটে বসিয়ে দিল। তারপর ছুটে গিয়ে একগ্লাস জল নিয়ে এল।

ওর হাত থেকে জলের গ্লাসটা শ্রাবণীর চোখে-মুখে সামান্য ছিটিয়ে দিলেন এসিজি। ভবানীপ্রসাদ চটপট শ্রাবণীর বাঁ-হাতের কবজি চেপে ধরে পালস রেট মাপতে চাইলেন।

কয়েক মিনিটের মধ্যেই শ্রাবণীর চেতনা ফিরে এল। ধীরে-ধীরে চোখ খুললেন। অশোকচন্দ্র ওঁর দিকে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘প্লিজ, একটু শক্ত হোন, ম্যাডাম। আপনার সামনে এখন অনেক কাজ। এসময়ে ভেঙে পড়বেন না।’

কয়েকবার চোখ পিটপিট করে শ্রাবণী বললেন, ‘সরি। ইট ওয়াজ আ গ্রেট শক। দাদাকে খুব ভালোবাসতাম আমি…’ সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে নিলেন : ‘ওয়েল, হু ডিড ইট?’

অশোকচন্দ্র ঘাড়ের কাছে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মেরে বললেন, ‘সেটাই তো জানার চেষ্টা করছি, মিস চ্যাটার্জি।’

‘আপনি কি পুলিশের লোক নাকি? সন্দেহে ভুরু কুঁচকে গেল ম্যাডামের।

এসিজি কিছু বলে ওঠার আগে ভবানীপ্রসাদ গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর শ্রাবণীর কাছে এসে হেসে বললেন, ‘ইনি ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—দ্য গ্রেট ইনভেস্টিগেটর। থিঙ্কিং মেশিন। দ্য বেস্ট ইন দ্য গেম।’

এসিজি এত প্রশংসার ওজন সামলাতে মাথা নিচু করলেন।

শ্রাবণী চ্যাটার্জির ভুরু কুঁচকেই ছিল। এবার ঠোঁটের কোণাটা সামান্য বেঁকে গেল : ‘য়ু মিন ডিটেকটিভ?’

‘হ্যাঁ, ম্যাডাম, আমি একজন হুনুর—হুনুরি করে আনন্দ পাই।’ এসিজি অপ্রস্তুভাবে হেসে বললেন, ‘যাঁকে সহজ কথায় বলে গোয়েন্দা…।’

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসিজিকে খুঁটিয়ে দেখলেন শ্রাবণী। তারপর বেশ অবাক হয়ে বললেন, ‘ডিটেকটিভ? আপনি? দেখে তো মনেই হয় না!’

‘ওটা আমার ছদ্মবেশ, ম্যাডাম।’ হাত নেড়ে একটা ভঙ্গি করে এসিজি বললেন, ‘আসলে কী জানেন? চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়—সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারের মতো মোমের পালিশ দেওয়া ছুঁচলো গোঁফ আমার নেই। দেবেন্দ্রবিজয়, হুকা-কাশি, রবার্ট ব্লেক কিংবা ব্যোমকেশের মতো প্রতিভা আমার নেই। কোনও ক্যারিশমা নেই—আমার মাথার পেছন থেকে জ্যোতি বেরোয় না।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি : ‘তবে আমার মতো গোয়েন্দা—রিয়েল লাইফ ডিটেকটিভরা—জোড়াতালি দিয়ে যা-হোক করে কাজ চালিয়ে নেয়। মানে, শেষ পর্যন্ত খুনিকে ধরে ফ্যালে। ইন সিম্পল টার্মস, উই আর এফেক্টিভ।

‘অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, ম্যাডাম, আর নয়। প্লিজ, দাদার বডিটা আইডেন্টিফাই করে আপনি জলদি এখানে চলে আসুন। আই নিড ইয়োর হেলপ। ডক্টর দে, আপনি মিস চ্যাটার্জির সঙ্গে যান।’ কথা শেষ করে ইরিনাকেও সঙ্গে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন এসিজি। যদি ডেডবডি দেখে শ্রাবণী আবার অজ্ঞান-টগগান হয়ে যান!

ওঁরা তিনজন চলে গেলেন।

রঙ্গলাল অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এসিজি স্যার, আমার কিন্তু শ্রাবণী চ্যাটার্জিকে সন্দেহ হয়।’

চোয়ালে আলতো টোকা মারতে-মারতে এসিজি বললেন, ‘সন্দেহ হয় খুব ভালো কথা। এবারে বলুন তো, মিস চ্যাটার্জি ওঁর দাদাকে কীভাবে খুন করলেন?’

কাঁচুমাচু মুখ করে রঙ্গলাল বললেন, ‘সে কি ছাই জানি? ওটা বের করবেন আপনি।’

অশোকচন্দ্র এই ছড়া-কাটা উত্তর শুনে মোটেই হাসলেন না। শুধু আপনমনে বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রথমে বুঝতে হবে হাউ, তারপর হোয়াই, আর সবশেষে হু।’

‘তার মানে?’

‘মানে তো সিম্পল! প্রথমে বুঝতে হবে ঠিক কীভাবে মদনমোহন চ্যাটার্জি খুন হলেন—হাউ। তারপর বের করতে হবে, কেন উনি খুন হলেন—হোয়াই। এ-দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে পারলেই শেষ প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া যাবে : কে ওঁকে খুন করেছে—হু।’

ফ্যাকাসে মুখে শ্রাবণী চ্যাটার্জি ফিরে এলেন। ওঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, বয়েস অনেকটা বেড়ে গেছে। ইরিনা ওঁকে ধরে-ধরে নিয়ে আসছিল।

অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ভবানীপ্রসাদ ইশারা করে বোঝালেন, ঠিকঠাকভাবে আইডেন্টিফিকেশানের ব্যাপারটা মিলে গেছে।

শ্রাবণীকে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে ইরিনা চলে গেল। প্লেনের ক্রুদের সেরকমই নির্দেশ দিয়েছেন ক্যাপ্টেন সুখানি : জিজ্ঞাসাবাদের সময় কেউই এসিজির কাছে থাকবে না—অবশ্য যদি এসিজি কাউকে ডেকে পাঠান তা হলে আলাদা কথা।

সুতরাং এসিজি, ভবানীপ্রসাদ, আর রঙ্গলাল ছাড়া শ্রাবণীর সামনে আর কেউ নেই।

‘মিস্টার চ্যাটার্জির ওয়ার্থ কত ছিল?’ শ্রাবণীর পাশের সিটটায় বসে অশোকচন্দ্র প্রথম প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন।

‘ওয়ার্থ মানে?’ ক্লান্ত গলায় জানতে চাইলেন শ্রাবণী।

‘মানে, স্থাবর-অস্থাবর মিলিয়ে ওঁর সম্পত্তি কীরকম দাঁড়াবে?’

বিষণ্ণভাবে হাসলেন শ্রাবণী, অনেকটা আপনমনেই বললেন, ‘ঠিক জানি না, তবে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা তো হবেই। টাকার নেশা দাদাকে পাগল করে দিয়েছিল। টাকার পেছনে ছুটতে কী ভালোবাসত! আমি বাড়াবাড়িরকম ঝামেলা করলে দাদা বলত, ”শানু, কী করে তোকে বোঝাব এটা একটা দারুণ নেশা—অনেকটা মোটর রেসের মতো—থামলে কোনও মজা নেই, ছুটলেই বরং মজা।” কিন্তু শেষ পর্যন্ত থামতে তো হলই! কী প্যাথেটিক…।’ গলা ভেঙে গেল শ্রাবণীর, চোখের কোণে জল এসে গেল। ব্যাগ থেকে ছোট্ট লেডিজ রুমাল বের করে চোখের কোণ মুছে নিলেন।

‘এখন…মানে, উনি চলে যাওয়ার পর…এই বিশাল সম্পত্তির মালিক কে হবেন?’

‘অনেকটাই আমার কপালে এসে জুটবে।’ তেতো গলায় শ্রাবণী বললেন, ‘কী করব আর বলুন…একেই বলে নিয়তি।’

‘কেন, আপনি সম্পত্তি ভালোবাসেন না?’

ধারালো চোখে তাকালেন এসিজির দিকে : ‘ভালোবাসি অবশ্যই—তবে দাদার জীবনের বদলে নয়।’

এসিজি বেশ বুঝতে পারছিলেন, শ্রাবণী চ্যাটার্জির ইমোশানের পোটেনশিয়াল ক্রমেই চড়ছে। সত্যি, মানুষের ভেতরকার আবেগগুলো অনেকটা ইলেকট্রিক পোটেনশিয়ালের মতো। বাড়তে-বাড়তে হঠাৎই বাজ পড়ার ঢঙে ডিসচার্জ করে যায়। তখন বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো মনের খুব গভীরের ভাবনাগুলো চট করে বেরিয়ে আসে। মানুষটাকে ঠিকঠাক চেনা যায়।

দাদাকে সত্যিই কি এতটাই ভালোবাসতেন ভদ্রমহিলা!

‘আপনি ছাড়া মিস্টার চ্যাটার্জির ফ্যামিলি বলতে আর কারা আছেন?’

‘আমি ছাড়া দাদার আর কেউ ছিল না…কেউ না। তেমনি আমারও যা কিছু ছিল দাদা। এখন…এখন আমি একা হয়ে গেলাম। একেবারে একা…।’

কথা বলতে-বলতে শ্রাবণীর চোখের পাতা ভারী হয়ে গিয়েছিল, সেইসঙ্গে গলাও। রুমালটা আর-একবার ব্যবহার করলেন তিনি।

এসিজি ওঁকে বেশ খুঁটিয়ে জরিপ করছিলেন। ওঁর মনে হল, দুঃখটা মিথ্যে নয়।

শ্রাবণীকে একটু সময় দিয়ে তারপর কিছু একটা জিগ্যেস করতে যাবেন, অলিপথের ওপারের একটা সিটে বসেছিলেন ডক্টর দে—তিনি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন, ম্যাডাম, মিস্টার চ্যাটার্জি তো ম্যারেড ছিলেন—ওঁর ওয়াইফকে আমি দেখেছি…।’

ডক্টর দে-র দিকে তাকালেন শ্রাবণী : ‘দেখতেই পারেন—দাদার সঙ্গে বহু প্রোগ্রামেই বউদি যেত—কাগজেও একবার ছবি বেরিয়েছিল। তবে সবই ছ-বছর আগের কথা। নাইনটি সেভেনে বউদি সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা গেছে। তারপর দাদা আর বিয়ে করেনি—যদিও আমি বহুবার দাদাকে রিকোয়েস্ট করেছি। আর…’ এসিজির দিকে চোখ ফেরালেন শ্রাবণী : ‘দাদা-বউদির কোনও ইস্যু ছিল না।’

তারপর ভবানীপ্রসাদের দিকে তাকালেন : ‘বউদিকে আপনি কোথায় দেখেছিলেন? কোনও অনুষ্ঠানে?’

‘না, আপনাদের বালিগঞ্জের বাড়িতে…প্রায় বছরদশেক আগে। মিস্টার চ্যাটার্জির অ্যাজমার প্রবলেম ছিল। আমি ওঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন অবশ্য আপনাকে দেখিনি।’

‘না, আমি তখন ও-বাড়িতে থাকতাম না।’ ঠোঁট টিপে বললেন শ্রাবণী। তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে দিলেন : ‘ঠিকই বলেছেন, দাদার হাঁপানির প্রবলেমটা ভীষণ ভোগাত। বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে ওটা খুব বেড়ে গিয়েছিল।’

এরপর কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।

অশোকচন্দ্র গুপ্ত অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিলেন। এবার মুখ খুললেন।

‘যদি কিছু মাইন্ড না করেন তাহলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করব, ম্যাডাম?’

ভুরু কুঁচকে এসিজির দিকে তাকালেন শ্রাবণী। এসিজি দেখলেন, সত্যি, ওঁর চোখদুটোর একফোঁটা বয়েস বাড়েনি।

শ্রাবণী বললেন, ‘দাদার এই ব্রুটাল মার্ডার কেসটা সলভ করার জন্যে যদি পার্সোনাল প্রশ্ন করাটা জরুরি হয় তা হলে অবশ্যই করবেন। আই ওন্ট মাইন্ড।’

‘আপনি বিয়ে করেননি কেন?’ প্রশ্নটা করেই হাত তুলে ইশারা করলেন এসিজি : ‘ম্যাডাম, ইচ্ছে করলে আপনি জবাব না-ও দিতে পারেন।’

‘না, সেরকম কিছু নয়।’ মাথা সামান্য নিচু করলেন শ্রাবণী : ‘বিয়ে করেছিলাম। ওই যে, ডক্টর দে যখন দাদাকে চেক-আপ করতে গিয়েছিলেন, তখন আমি হাজব্যান্ডের সঙ্গে সল্টলেকে থাকতাম। পরে…পরে বিয়েটা নষ্ট হয়ে যায়…।’

‘সরি ম্যাডাম।’ ছোট্ট করে বললেন অশোকচন্দ্র।

‘না, ঠিক আছে।’ মুখ তুলে তাকালেন শ্রাবণী চ্যাটার্জি।

মাথা হেলিয়ে ঘাড়ে হাত বোলালেন এসিজি : ‘এবারে একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে আপনারা মোট চারজন ট্র্যাভেল করছিলেন…আপনি ছাড়া বাকি তিনজন কে-কে একটু বলবেন…?’

শ্রাবণী রুমালটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে বললেন, ‘আমি ছাড়া রমেশ—রমেশ শর্মা, ব্রজেন দাস, আর শাওনি রাঘবন। রমেশ আমার সঙ্গে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে আছে। আর বাকি দু’জন ইকনমি ক্লাসে।’

‘এদের একটু-আধটু ইনট্রো দিলে সুবিধে হয়…।’

‘রমেশ শর্মা লাস্ট পাঁচবছর ধরে দাদার পারসোনাল সেক্রেটারি। এমনিতে প্রায় দশবছর কাজ করছে দাদার কাছে। প্রথমে ”চ্যাটার্জি মাইনিং করপোরেশন”-এ—এম.পি-র কোরবাতে দাদার দুটো কপার মাইন আছে। শুনেছি ভালো প্রফিট হয়। সেখানে রমেশ জুনিয়ার ম্যানেজার ছিল। পরে দাদার ওকে ভালো লেগে যায়। তাই ওকে পার্সোনাল সেক্রেটারি করে নেয়। হি ইজ আ জেম অফ আ ওয়ার্কার। দিন-রাত কাজ করতে ভালোবাসে। এই তো, প্লেনে বসেই ব্রিফকেস খুলে দাদা কীসব কাগজপত্র বের করে রমেশের সঙ্গে ডিসকাস করছিল।’

এমনসময় কুমারমঙ্গলম এসিজিদের কাছে এল। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ থাকায় বেচারি দূর থেকেই ইশারায় কাছে আসার অনুমতি চেয়েছে। এসিজি ঘাড় নেড়ে সায় দিতেই ও চটপট করে চলে এসেছে ভবানীপ্রসাদের কাছে। ঝুঁকে পড়ে ডক্টর দে-র কানে-কানে কী যেন বলে কুমারমঙ্গলম চলে গেল।

অশোকচন্দ্র প্রশ্ন নিয়ে তাকালেন ভবানীপ্রসাদের দিকে।

ভবানীপ্রসাদ একবার শ্রাবণীর দিকে দেখে নিয়ে এসিজিকে বললেন, ‘ক্যাপ্টেন জিগ্যেস করছেন, আইডেন্টিফিকেশান যখন হয়ে গেছে তখন ওঁদের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিট নিয়ে আমি বডিটা যতটা সম্ভব থরো চেকআপ করে একটা রিপোর্ট লিখে দেব কি না—তাতে ”আকাশ এয়ারলাইনস”-এর সুবিধে হবে। ওঁদের চেয়ারম্যান তাই চাইছেন—বলছেন, ইটস পার্ট অফ রুটিন প্রসিডিয়োর।’

‘আমিই সে-কথা আপনাকে বলব ভাবছিলাম। বুলেট যদি না হয় তা হলে মিস্টার চ্যাটার্জির মুখে কী হিট করল? আর অত মারাত্মক ইমপ্যাক্টের ফোর্স জিনিসটা পেল কোথা থেকে? তবে ডক্টর দে, কুড য়ু ওয়েট ফর আ ফিউ মিনিটস? মিস চ্যাটার্জিকে আমি এখুনি ছেড়ে দিচ্ছি…তারপর…।’

‘ও. কে.—আই ক্যান ওয়েট।’

‘তারপর, মিস চ্যাটার্জি?’ এসিজি শ্রাবণীর দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন।

‘এরপর ব্রজেন দাস। ওকে কম্বাইড হ্যান্ড বলতে পারেন। অড জব ম্যান। সবরকমের কাজই একটু-একটু পারে। এই তো, লাস্ট উইকে আমাদের কর্ডলেস ফোনটা খারাপ হয়েছিল, ব্রজেন কীসব খুটখাট করে সেটা সারাই করে দিল। আমাদের বাড়ির টিউব লাইট কেটে গেলে সেটা পালটাতেও ব্রজেন, আবার ডাইনিং টেবিলের গ্রানাইট পাথরটা ঝকঝকে তকতকে করে রাখার ব্যাপারেও ব্রজেন। ওর ওপরে আমরা খুব ডিপেন্ডেন্ট। কিন্তু দাদা ওকে বাড়াবাড়িরকম আশকারা দিত, বিশ্বাসও করত। আমি মাঝে-মাঝেই দাদাকে অ্যালার্ট করতাম। বলতাম, ”বিশ্বাস করার একটা লিমিট আছে। তুমি কিন্তু সেটা প্রায়ই ভুলে যাও।” কিন্তু কে শোনে কার কথা!’

‘আর শাওনি রাঘবন?’

‘ও স্টেনো কাম টাইপিস্ট। বছরখানেক হল জয়েন করেছে। ওকে ঠিক বোঝা যায় না। তবে দাদা ওকে লাইক করত। ওকে তো এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ফ্লাই করাতে চেয়েছিল, আমি বারণ করেছি! সামান্য একটা দু-পয়সার স্টেনো-টাইপিস্ট—সে চড়বে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে! প্লেনে চড়ছে তাই না কত! দাদার সেই এক প্রবলেম! ওকে ভীষণ স্নেহ করত। শাওনিও সেটা বুঝত—তাই ঢং করত। নাঃ, ডক্টর গুপ্ত, দাদার মিসহ্যাপের ব্যাপারে আমাকে যদি কাউকে সন্দেহ করতে বলেন সে ওই শাওনি রাঘবন। এবার আপনি ইনভেস্টিগেট করে দেখুন…। ক্যাপ্টেন আমাকে বলেছেন যে, উনি আপনার ওপরে খুব ডিপেন্ড করছেন…আপনাকে পুরো অথরিটি দিয়েছেন…।’

‘মিস চ্যাটার্জি, থ্যাঙ্ক য়ু সো মাচ।’

এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। সেই সঙ্গে শ্রাবণীও।

রঙ্গলাল গোস্বামী কিছু একটা বলবেন-বলবেন করছিলেন। ওঁর উসখুসুনি দেখে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘কিছু বলবেন, রঙ্গলালবাবু?’

বিনয়-গদগদ ঢঙে ঘাড় কাত করে রঙ্গলাল বললেন, ‘ম্যাডাম, একটা স্বভাব-কবিতা রচনা করেছি…অধমের অপরাধ নেবেন না…।’

এসিজি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘বলুন, বলুন, রঙ্গলালবাবু—মিস চ্যাটার্জি কিছুই মনে করবেন না।’

‘বলি তা হলে?’ ঘাড় কাত করে জানতে চাইলেন রঙ্গলাল।

শ্রাবণী হেসে ঘাড় নাড়লেন : ‘স্বভাব-কবিতা! সেটা আবার কী! যা হোক, বলুন—।’

‘শ্রাবণী ও শাওনিতে দ্বন্দ্ব যথেষ্ট/ একই নাম দুই রূপ কৃষ্ট ও খ্রিস্ট।’

শ্রাবণীর মুখটা পলকে অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু তারপরই চট করে মেঘ সরিয়ে হেসে উঠে বললেন, ‘য়ু আর অ্যাজ অ্যামেজিং : অ্যাজ রিডিকিউলাস। লাইক য়ু।’ তারপর এসিজির দিকে তাকিয়ে : ‘দারুণ মজার মানুষ, তাই না?’

শ্রাবণী চ্যাটার্জি অহঙ্কারী পা ফেলে নিজের সিটের দিকে চলে গেলেন।

ডক্টর দে পরদা সরিয়ে টয়লেট কিউবিকলের সামনে এলেন। ভাবছিলেন ইরিনা কিংবা সাবরিনাকে বলবেন প্লেনের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিটটা নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু ঠিক তখনই একটু চেঁচামেচি শোনা গেল যেন।

এসিজি, রঙ্গলাল এবং ভবানীপ্রসাদ—তিনজনেই শব্দ লক্ষ করে চোখ ফেরালেন। দেখলেন, ইরিনা এবং একজন যুবক কথা-কাটাকাটি করতে-করতে এক্সিকিউটিভ ক্লাসের টয়লেট স্পেসের সামনে চলে এসেছে।

ইরিনা ছেলেটিকে আটকানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে নাছোড়বান্দা।

‘বলছি তো, আমি স্যারের বাড়ির কাজের লোক। স্যারের বিপদ শুনলে আমাকে তো ছুটে আসতেই হবে। আমাকে এভাবে…।’ বেশ গলা চড়িয়েই কথা বলছিল ছেলেটি।

‘আপনি ব্যাপারটা বুঝতে চাইছেন না, স্যার। এটা এক্সিকিউটিভ ক্লাস। আপনি ইকনমি ক্লাসের টিকিট নিয়ে এখানে আসতে পারেন না।’

‘বিপদের সময় আবার ক্লাস কী!’ একরকম তেড়ে উঠে বলল ছেলেটি, ‘আমার স্যারের—মানে, মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জির যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে আমাকে অ্যালাউ করতেই হবে, দিদি।’

এয়ারহোস্টেসকে দিদি!

এই ডাক শুনে ইরিনা আর থাকতে পারল না—ঠোঁট টিপে হেসে ফেলল। আড়চোখে তাকাল এসিজির দিকে : কী করা যায় এখন?’

এসিজি চট করে ব্রজেন দাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

মদনমোহন চ্যাটার্জির বাড়ির কাজের লোক হলেও ব্রজেনকে কাজের লোক বলে ঠাহর করা মুশকিল।

লম্বা ফরসা চেহারা। কাটা-কাটা মুখ-চোখ। তেল মাখানো চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। নাকের নীচে পুরু গোঁফ। চোখের তারা বেশ চঞ্চল। গায়ে সাদা ফুলহাতা শার্ট, তার ওপরে ছাই আর কালো রঙের ডোরাকাটা হাফ সোয়েটার। প্যান্টের রং হালকা নীল—তবে সামান্য ময়লা।

‘আপনার নাম কি ব্রজেন দাস?’

এসিজির প্রশ্নে পলকে সব ছটফটানি থেমে গেল। বৃদ্ধের দিকে সন্দেহের ঠান্ডা চোখে তাকাল ব্রজেন : ‘আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’

ডক্টর দে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, এসিজি হাত তুলে ওঁকে ক্ষান্ত করলেন। তারপর মোলায়েমভাবে হেসে ব্রজেনকে বললেন, ‘উত্তেজিত হবেন না, ব্রজেনবাবু। এখানে এসে ঠান্ডা হয়ে বসুন, সব বলছি…।’

ব্রজেন দাস এসিজির অনুরোধ মেনে নিল। এসিজিদের কাজের জায়গায় একটা সিট বেছে নিয়ে বসে পড়ল। ওর নজর কিন্তু বারবার ছিটকে যাচ্ছিল টয়লেটের কাছে পলিথিন শিট ঢাকা দেওয়া ডেডবডিটার দিকে। বোধহয় ভাবছিল, মেঝেতে ওটা কী ঢাকা দেওয়া রয়েছে!

হঠাৎ অশোকচন্দ্রের দিকে ঘুরে তাকিয়ে ব্রজেন বলে উঠল, ‘স্যার কোথায়? স্যারের কী হয়েছে?’

ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বেশ ধীরে-ধীরে সময় নিয়ে এসিজি টয়লেট স্পেসের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই পলিথিন শিটের নীচে আপনার স্যারের ডেডবডি আছে। ওঁকে কেউ খুন করেছে।’

‘খুন!’ তড়াক করে দাঁড়িয়ে উঠল ব্রজেন। ওর হাত সামান্য কাঁপছিল, ‘কী করে হল এসব? কে খুন করল স্যারকে? আমি স্যারকে একবার দেখব…প্লিজ…।’

এসিজি ভবানীপ্রসাদকে ইশারা করলেন। তারপর ব্রজেনকে বললেন, ‘আপনি যান, স্যারকে শেষ দেখা দেখে আসুন। ডক্টর দে আপনাকে বডি দেখাবেন।’

ব্রজেন ডক্টর দে-র সঙ্গে পা বাড়াল।

ইরিনা চুপ করে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ওকে এসিজি নিচু গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘ব্রজেন দাস মিস্টার চ্যাটার্জির ব্যাপারটা জানল কী করে?’

হাতের নখ খুঁটতে-খুঁটতে ইরিনা বলল, ‘হয়তো আমার দোষে জেনেছেন। আমি আর সাবরিনা ব্যাপারটা ডিসকাস করছিলাম, তখন এই ভদ্রলোক আমাদের পাশ দিয়ে ইকনমি ক্লাসের টয়লেটে যাচ্ছিলেন। তখনই ওভারহিয়ার করেছেন।’

‘ঠিক আছে,’ বলে ঘাড় নেমে ইরিনাকে বিদায় দিলেন বৃদ্ধ।

আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ব্রজেন দাস চোখ মুছতে-মুছতে ফিরে এল এসিজির কাছে। কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘স্যারই যখন আর নেই তখন আমার আর বেঁচে থেকে কী হবে! কোন হতভাগ্য আমার দেবতার মতো স্যারকে এইভাবে খতম করল! এবার আমার কী হবে? কোথায় যাব আমি?’

এসিজির ইশারায় রঙ্গলাল গোস্বামী ব্রজেন দাসের কাছে এলেন। ওকে ধরে যত্ন করে একটা সিটে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খুনি ধরতে ভাই/ আপনার হেলপ চাই। খুনির পেলে পাত্তা/ জুড়োবে স্যারের আত্মা।’

ব্রজেন দাস পলকে শোক ভুলে কবিমানুষটির দিকে এমনভাবে তাকাল যে, মনে হল স্যারের মৃত্যুর শকের চেয়ে রঙ্গলালের কবিতা ওকে আরও বেশি শক দিয়েছে। কিন্তু রঙ্গলাল অবিচলিতভাবে আকর্ণ হেসে একটা সিটে গিয়ে বসে পড়লেন।

‘মিস্টার দাস, আপনি জানলেন কী করে যে, মিস্টার চ্যাটার্জির বিপদ হয়েছে?’ একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি জিগ্যেস করলেন।

ব্রজেন দাস চোখ মুছে ইরিনার কথাটাই বলল। তারপর জিগ্যেস করল, ‘স্যারের সারা মুখে-বুকে এত রক্ত কেন? কীভাবে খুন হয়েছেন স্যার?’

‘আমরা তো সেটাই জানার চেষ্টা করছি।’ এসিজি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তব্য করলেন, ‘আপনি ওঁর কাছে কাজ করছেন কতদিন?’

‘তা চারবছরের বেশি হবে।’

‘ঠিক কী ধরনের কাজ করতেন একটু বলবেন?’

‘সবরকম। টাই বেঁধে দেওয়া, জুতোর ফিতে বাঁধা, গাড়ি চালানো, টুকটাক এটা-সেটা সারিয়ে দেওয়া, এমনকী দরকার পড়লে স্যারকে রান্না করেও খাওয়াতাম। স্যার একবার ”ব্রজ” বলে হাঁক দিলেই হল—আমি সটান গিয়ে হাজির হতাম। আমি বলতে গেলে স্যারের ছায়া ছিলাম—এখন আমার কপালে কী আছে কে জানে!’

‘শুনলাম, গত সপ্তাহে আপনি মিস্টার চ্যাটার্জির কর্ডলেস ফোন সারিয়ে দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। তবে শুধু কর্ডলেস কেন, আমি স্যারের টেপ-ডেক সারিয়েছি, স্যারকে একটা এফ. এম. ট্রানজিস্টার রেডিয়ো বানিয়ে দিয়েছি…।’

‘একজন সাধারণ কাজের লোকের পক্ষে এসব সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির কাজ জানাটা একটু আনকমন—মানে সাধারণত দেখা যায় না, তাই না?’

হাসল ব্রজেন। মাথার তেল-চকচকে চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ‘আমি সাধারণ কাজের লোক এটা আপনাকে কে বলল? দিদি?’

‘দিদি মানে?’

‘শ্রাবণীদি—স্যারের বোন।’

‘না-না, উনি কিছু বলেননি। উনি আপনার খুবই প্রশংসা করেছেন।’ ব্রজেনের ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালটা পরখ করবেন বলে এসিজি একটু মিথ্যে বললেন।

‘হুঁঃ—’ তেতো হাসল ব্রজেন : ‘স্যার আমাকে যেরকম বিশ্বাস করতেন, দিদি সেরকম করেন না। কী আর করা যাবে! সবার তো মন রাখা সম্ভব নয়!’

‘আপনি মাইনে কীরকম পান?’

‘সেটা কি বলতেই হবে?’ এসিজির দিকে বিদ্রোহী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ব্রজেন।

‘ঠিক আছে, বলতে হবে না। আপনার স্যারের কোনও শত্রু ছিল?’

‘বড়লোকদের শত্রু থাকবে না এ কখনও হয়! বরং বলতে পারেন স্যারের চারপাশে প্রচুর শত্রু কিলবিল করত। তবে হ্যাঁ, তারা কেউ থাকত বন্ধুর ছদ্মবেশে, আর কেউ-বা ছিল কর্মচারীর ছদ্মবেশে।’

কথাটায় একটা ইঙ্গিত ছিল। এসিজি সিগারেটে শেষ টান দিয়ে সেই ইঙ্গিতটাই ধরার চেষ্টা করলেন।

‘আপনি কতদূর পড়াশোনা করেছেন, ব্রজেনবাবু?’

মাথা নিচু করল ব্রজেন, আলতো করে বলল, ‘আমি বি. এসসি. পাশ।’ তারপর একটু সময় নিয়ে বলল, ‘কী করব বলুন! বহু চেষ্টা করেও তেমন কোনও চাকরি-বাকরি জোটেনি। তাই লজ্জা-টজ্জা ঝেড়ে ফেলে বড়লোকের চাকরের কাজ করছি—ভাগ্য ফেরানোর চেষ্টা করছি। তো এখানে স্যারের কাছে বেশ ভালোই ছিলাম…।’

ব্রজেনের কাছে ঝুঁকে এলেন এসিজি। গলা নিচু করে বললেন, ‘কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?’

‘কীসের সন্দেহ?’ অনেকটা যেন চমকে উঠল ব্রজেন। তারপর সামলে নিয়ে বলল, ‘আমি ছোটমানুষ—সন্দেহ কাকে করব! তবে স্যার যে-ই খুন করে থাকুক টাকার লোভে করেছে। স্যারের টাকাপয়সা সম্পত্তির তো কোনও হিসেব ছিল না…আশপাশের অনেকেই তক্কেতক্কে ছিল।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন এসিজি। তারপর হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘ঠিক আছে…অনেক ধন্যবাদ, ব্রজেনবাবু। আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন…সেরকম কোনও খবর হলে আপনাকে জানাব।’

ব্রজেন উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলে গেল, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল…আমার লাইফটা শেষ হয়ে গেল…।’

এসিজি ব্রজেনের আগের কথাটা ভাবছিলেন : ‘আশপাশের অনেকেই তক্কেতক্কে ছিল…।’

তার মানে?

ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে এসিজিকে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, একজন হোস্টেস ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল কিটটা গ্যালিতে দিয়ে গেছে। বলছে, তাড়াতাড়ি চেক আপের কাজটা সেরে ফেললে ভালো হয়…।’

অশোকচন্দ্র গুপ্ত আনমনাভাবে কী যেন চিন্তা করছিলেন। ঘোর ভেঙে চমকে উঠে ভবানীপ্রসাদের দিকে তাকালেন, বললেন, ‘আপনি বরং চেক আপটা সেরেই নিন। আমি ততক্ষণে এদিককার কাজ এগিয়ে নিই। আপনি যখন টয়লেটের ওখানে যাচ্ছেন তখন একজন হোস্টেসকে ডেকে একটু বলে দিন মিস্টার চ্যাটার্জির পারসোনাল সেক্রেটারিকে এখানে পাঠিয়ে দিতে…প্লিজ।’

‘উইথ প্লেজার—’ বলে ডক্টর দে উঠে গেলেন।

রঙ্গলাল অলিপথের ওপারে একটা সিটে চোখ বুঝে বসেছিলেন। ভবানীপ্রসাদ চলে যেতেই চোখ খুলে তাকালেন এসিজির দিকে : ‘স্যার, কাকে আপনার সন্দেহ হয়?’

এসিজি মুচকি হেসে জবাব দিলেন, ‘এখনও বলা সম্ভব নয়।’

বৃদ্ধের ছড়া-কাটার দুষ্টুমিটা ধরতে পেরে হেসে ফেললেন রঙ্গলাল।

রমেশ শর্মাকে অশোকচন্দ্রের কাছে নিয়ে এল ইরিনা।

পারসোনাল সেক্রেটারির পারসোনালিটি কম নয়। অন্তত রমেশকে দেখে এসিজির তাই মনে হল।

ফিটফাট স্যুটেড-বুটেড স্মার্ট চেহারা। চোখে মেটাল ফ্রেমের ছোট্ট চশমা। মাথার চুল পাতলা হয়ে কপালটা বড় হয়ে গেছে, কিন্তু তাতে ব্যক্তিত্ব বেড়েছে বই কমেনি।

রমেশ শর্মার বয়েস খুব বেশি হলে চল্লিশের ওপাশে। তবে মুখে কেমন একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব আছে। বেবিফেস বোধহয় একেই বলে!

‘মিস্টার রমেশ শর্মা, ডক্টর গুপ্ত’, বলল ইরিনা, ‘উনি মিস্টার চ্যাটার্জির সঙ্গে ট্র্যাভেল করছিলেন।’

রমেশকে এসিজির কাছে বসিয়ে ইরিনা চলে গেল।

এসিজি লক্ষ করলেন, রমেশ মাঝে-মাঝেই নার্ভাসভাবে গালে হাত বোলাচ্ছে।

এসিজি চুপ করে বসে রইলেন। রমেশের টেনশনকে বেড়ে ওঠার সময় দিলেন। দেখা যাক ও কী বলে!

অনেকগুলো সেকেন্ড-মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পর রমেশ আর থাকতে পারল না। ইতস্তত করে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত মিস্টার চ্যাটার্জি মার্ডার্ড হলেন…।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’ সঙ্গে-সঙ্গে তির ছুড়লেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।

‘আমি জানলাম মানে…শ্রাবণী…মানে, মিস চ্যাটার্জি আমাকে বললেন। ভেরি স্যাড।’

‘স্যাড তো বটেই—ব্যাডও।’ বললেন এসিজি, ‘কে ওঁকে খুন করতে পারে? কাউকে সন্দেহ হয় আপনার? এনি আইডিয়া?’

হাত আর ঠোঁট একসঙ্গে ওলটাল রমেশ : ‘কী করে বলব! তবে যার মনে রাগ আছে, লোভ আছে, সে-ই এমন কাজ করতে পারে। কীভাবে মার্ডার্ড হয়েছেন স্যার? মিস চ্যাটার্জি বলছিল—মানে, বলছিলেন, বুলেট-ফুলেট কিচ্ছু। কিন্তু আমি ভাবছিলাম, মার্ডারার এয়ারপোর্ট সিকিওরিটির এক্স-রে আইকে ফাঁকি দিয়ে একটা রিভলভার কী করে স্মাগল করে নিয়ে আসবে। দ্যাটস আ ভেরি টাফ ডিল, ইজনট ইট?’

মাথা নেড়ে সায় দিলেন এসিজি : ‘ঠিকই বলেছেন। এই পয়েন্টটা আমাকে গোড়া থেকেই ডিসটার্ব করছে।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল রমেশ, বলল, ‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে মার্ডার করার কোনও দরকার ছিল না। এমনিতে বয়েস হয়েছিল…তার ওপর অসুস্থ ছিলেন…।’

‘ষাট-বাষট্টি আর এমনকী বয়েস! তবে অসুখ-বিসুখ থাকলে…কী অসুখের কথা বলছেন আপনি?’

‘অ্যাজমা। টান ধরলে স্যারের ভীষণ ব্রিদিং প্রবলেম হত। আর যখন খুব টেনশান বাড়ত…বুঝতেই পারছেন, কোটি-কোটি টাকার বিজনেস, টেনশান তো থাকবেই…ফলে তখনই টানটা বেড়ে যেত। ওঁর সঙ্গে তো খুব ক্লোজলি কাজ করছি, তাই ব্যাপারটা জানি।’

‘উনি আপনার কোলিগের মতো ছিলেন, কী বলেন?’

‘কোলিগ!’ সরাসরি এসিজির চোখে তাকাল রমেশ, বিষণ্ণ হেসে বলল, ‘উনি আমার বস ছিলেন। সেটা উনি সবাইকে সবসময় মনে করিয়ে দিতেন—কিছুতেই আমরা ভুলতে পারতাম না যে, মিস্টার চ্যাটার্জি আমাদের ভাগ্যবিধাতা, অন্নদাতা…অবশ্য ওঁর মন বেশ উদার ছিল…কারণে-অকারণে আমাদের বাড়তি টাকাপয়সা দিতেন। কিন্তু ওই যে বললাম, ওঁর কথাই ছিল শেষ কথা—এটা কোম্পানির দারোয়ান থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সবাইকে উনি সমানভাবে বুঝিয়ে দিতেন। আপনার ওপরে কোনও কারণে বিরক্ত হলেই চাকরি থেকে ছুটি—আপনি ওঁর কোম্পানিতে কতবছর কাজ করেছেন, কত কী স্যাক্রিফাইস করেছেন সেসব তখন আর মাথায় থাকত না।’

এসিজি বেশ অবাক হচ্ছিলেন। মেঘ না চাইতেই জল! এক্সাইট করার আগেই ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের প্রদর্শনী! রমেশ শর্মার কথায় বেশ তেতো ভাব টের পাওয়া যাচ্ছিল।

‘আপনাকে কখনও জবাব দিতে চেয়েছিলেন না কি?’

ঠোঁটে হাসল রমেশ। সিটের হাতলে নখের আঁচড়ে কাটতে-কাটতে বলল, ‘বারদুয়েক সেরকম অবস্থা হয়েছিল। তবে কোনওরকমে বেঁচে গেছি। আমি বোধহয় খুব লাকি।’

‘মিস্টার চ্যাটার্জির তা হলে তো অনেক শত্রু থাকার কথা…।’

‘ওঁর বন্ধু বলেই কেউ ছিল না—শুধু দু-চারজন ছাড়া…।’

ব্রজেনের কথাটা মনে পড়ল এসিজির। তাই জিগ্যেস করলেন, ‘সেই দু-চারজনের মধ্যে কি আপনি পড়েন?’

‘অবশ্যই—’ জোর গলায় বলল রমেশ, ‘অন্তত আমি তাই মনে করি। এছাড়া ব্রজেন দাসের ওপরেও স্যার বেশ ভরসা করতেন। আর শ্রাবণী চ্যাটার্জি তো স্যারের ফ্যামিলি মেম্বার।’

‘শাওনি রাঘবন?’

‘ও তো বেশিদিন আসেনি। তবে ও স্যারের বেশ পছন্দের ছিল।’

আপনি তো বছরদশেক মিস্টার চ্যাটার্জির কাছে কাজ করছেন। যাকে পছন্দ করেন না তাঁর সঙ্গে এতবছর কাজ করাটা নেহাত মামুলি ব্যাপার নয়।’

‘এর সঙ্গে স্যারের মার্ডারের কী কানেকশান আছে জানতে পারি?’ একটু রুক্ষভাবে জানতে চাইল রমেশ।

‘সেরকম ডায়রেক্ট কানেকশান কিছু নেই। শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড একটু বুঝতে চাইছি।’ হাতের একটা ভঙ্গি করে বললেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তারপর ‘মিস্টার চ্যাটার্জি হার্টের কোনও প্রবলেম ছিল?’

‘যদ্দূর জানি, ছিল না। শ্রাবণী—মানে, মিস চ্যাটার্জি হয়তো আরও ভালো বলতে পারবেন।’

‘আপনি নাকি জেম অফ আ ওয়ার্কার? এসিজি আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের খোঁজে।

রমেশ অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধের দিকে। চশমাটা ঠিক করে নাকের ওপরে বসিয়ে বলল, ‘আর য়ু মেকিং ফান অফ মি?’

‘না-না মোটেই না।’ হাত নেড়ে রমেশকে ম্যানেজ করলেন এসিজি ‘মিস চ্যাটার্জি আপনার প্রশংসা করে এ-কথা বলেছেন।’

রমেশ চট করে নরম হয়ে গেল। বিনয়ে মাথা নামাল।

‘আপনি তো পারসোনাল সেক্রেটারি, মিস্টার শর্মা—আপনার জানা উচিত। এই ট্রিপে মিস্টার চ্যাটার্জির টেনশান কেমন ছিল?’

‘হাই টেনশান। তবে এটা নতুন কিছু নয়। কোটি-কোটি টাকার কারবার। সবসময়ে ওঁকে হাই টেনশনেই চলতে হত। যেমন, এই যে আমরা কলকাতা যাচ্ছিলাম…কাল সকালেই আমাদের হলদিয়া রওনা হওয়ার কথা ছিল। সেখানে একটা হাই টেনশান মিটিং ছিল—আমাদের নতুন স্টিল প্ল্যান্টের প্রজেক্ট নিয়ে। এসব ওঁর গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল…।’

‘প্লেন ফ্লাই করার পর আপনি ওঁর বিহেভিয়ারে অ্যাবনরম্যাল কিছু নোটিস করেননি?’

‘না। সেই একইরকম জেদি, একরোখা, অহঙ্কারী একজন মালটিমিলিয়নেয়ার। কলকাতায় গিয়ে মিস্টার চ্যাটার্জি ছ’জনকে ছাঁটাই করবেন ঠিক করেছিলেন। কাউকে ছাঁটাই করার ব্যাপার হলে উনি করতেন কি একেবারে পাবলিক নোটিস দিয়ে আর সব স্টাফকে জানিয়ে রীতিমতো ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তারপর ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরাতেন। ইউনিয়ন কিছু করতে পারত না। কারণ, টাকা দিয়ে ইউনিয়নের মুখ বন্ধ করার সহজ পথ উনি জেনে গিয়েছিলেন। বোঝেনই তো, সব ইউনিয়নই তো আর সমান নয়!’

মুখে একবার হাত বুলিয়ে নিল রমেশ। তারপর বলল, ‘এসব করে মিস্টার চ্যাটার্জি কেমন একটা স্যাডিস্টিক আনন্দ পেতেন। তো ব্রিফকেস খুলে-নানান কাগজপত্র দেখছিলেন আর আমার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই এটা-সেটা ডিসকাস করছিলেন…হঠাৎ…।’

একটু থামল রমেশ, ওর চোখে কেমন একটা দ্বিধা খেলে গেল। তারপর বেশ ধীরে-ধীরে বলল, ‘…হঠাৎই ওঁর টান শুরু হল—ওই টেনশান থেকে ওঁর যেমন হত আর কী!’

‘টান শুরু হলে মিস্টার চ্যাটার্জি কী করতেন, ওষুধ খেতেন?’

‘না, ইনহেলার ব্যবহার করতেন। উনি ভাবতেন আমরা কেউ ব্যাপারটা জানি না। আসলে মিস্টার চ্যাটার্জি খুব দাম্ভিক ছিলেন—এই টাইপের লোকেরা যেমন হয় আর কী! এরকম একজন বিখ্যাত মানুষ…সে হাঁপানির টানের কাছে কাবু হয়ে পড়েছে…এটা পাবলিক জানুক তিনি চাননি। তাই টান ধরলেই উনি ইনহেলার পকেটে নিয়ে উধাও হয়ে যেতেন—দু-চারবার পাম্প নিয়ে আবার ফিরে আসতেন আমাদের কাছে। আমি সবই জানতাম, কিন্তু না জানার ভান করতাম।’

‘আপনি ইনহেলারের ব্যাপারটা জানলেন কী করে?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর রমেশ বলল, ‘ব্রজেন আমাকে একদিন কথায়-কথায় বলেছিল।’

‘ব্রজেন দাস জানল কী করে?’

‘ও স্যারের সবই জানত। ওকে দিয়েই তো স্যার ইনহেলার কেনাতেন। ব্রজেন আমাকে একবার নামটা বলেছিল…”বেকলেট-ফিফটি” না কী যেন।’

‘মিস্টার চ্যাটার্জি তা হলে টয়লেটে গিয়েছিলেন ইনহেলারের পাম্প নিতে?’

‘আমার তো তাই মনে হয়। তারপর অনেকক্ষণ ধরে উনি ফিরছেন না দেখে মিস চ্যাটার্জি এয়ারহোস্টেসকে ডেকে বলেন…।’

‘উনি ফিরছেন না দেখে আপনার চিন্তা হয়নি?’

‘হয়েছিল—মালিকের জন্যে একজন এমপ্লয়ির যতটুকু চিন্তা হয় ঠিক ততটুকু—তার বেশি নয়। কারণ, মদনমোহন চ্যাটার্জি যে আমার মালিক সেটা আমি কখনও ভুলতে পারতাম না। তা ছাড়া, আপনাকে তো বললাম, উনি সেটা ভুলতে দিতেন না…।’

‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে আপনি একদমই পছন্দ করতেন না…।’

মাথা নাড়ল রমেশ। এসিজির দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ব্যাপারটা পছন্দ-অপছন্দের নয়। একটা কাজ করার জন্যে উনি মাসে-মাসে আমাকে মাইনে দিতেন—আমি সেই কাজটা দিতাম, মাইনে নিতাম। এসব ব্যাপারে আমি খুব প্রফেশন্যাল।’

রমেশ শর্মাকে হঠাৎই থামিয়ে দিয়ে এসিজি রঙ্গলালকে বললেন, ‘রঙ্গলালবাবু, আপনি আমাকে একটু হেলপ করুন। মিস শ্রাবণী চ্যাটার্জির কাছে একটু যান—মিস্টার চ্যাটার্জির ব্রিফকেসটা নিয়ে আসুন—বলবেন আমি চেয়েছি।’

রঙ্গলাল গোস্বামী রওনা হয়ে যেতেই রমেশ উত্তেজিতভাবে বলে উঠল, ‘এটা কি ঠিক হচ্ছে, মিস্টার গুপ্ত?’

এসিজি হেসে বললেন, ‘প্লিজ, উত্তেজিত হবেন না, মিস্টার শর্মা। প্লেনের ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি আমাকে এই অথরিটি দিয়েছেন। কিলিং ইজ নট আ ম্যাটার অফ জোক। খুনিকে খুঁজে বের করতে গেলে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় জানেন!’

রমেশ চুপ করে গেল বটে, কিন্তু উসখুস করতে লাগল।

একটু পরেই রঙ্গলাল ফিরে এলেন—হাতে বাদামি রঙের একটা ছোট ব্রিফকেস।

ওটা নিয়ে কোলের ওপরে বসালেন এসিজি। আঙুলের চাপ দিয়ে খুলতে যাবেন, রমেশ আলতো করে অনেকটা অনুরোধের ঢঙে বলল, ‘মিস্টার গুপ্ত, এটা কি না খুললেই নয়?’

থেমে গেলেন এসিজি : ‘কেন বলুন তো? কী আছে এতে?’

‘কোম্পানির সব কনফিডেনশিয়াল কাগজপত্র…।’

হাসলেন এসিজি…’য়ু আর রিয়েলি আ জেম অফ আ ওয়ার্কার। ড্যাম ডেডিকেটেড। বাট ম্যান, উই আর ডিলিং উইথ আ কিলিং। এর গুরুত্ব আপনি কেন বুঝতে পারছেন না কে জানে!’

কথা বলতে-বলতেই ব্রিফকেস খুলে ফেললেন এসিজি, এবং ভেতরের কাগজপত্র ঘাঁটতে শুরু করলেন।

হঠাৎই একটা কাগজ দেখে তিনি চমকে উঠলেন। কাগজটা বের করে নিলেন। কয়েকবার চোখ বুলিয়ে রমেশ শর্মাকে দেখালেন।

‘অ্যাজমার টান শুরু হওয়ার আগে মিস্টার চ্যাটার্জি কি এই কাগজটা দেখছিলেন?’

‘ঠিক বলতে পারছি না। হতে পারে। এরকমই কী একটা কাগজ দেখছিলেন—এর চেয়ে ডেফিনিট কিছু আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

এসিজি যে-কাগজটা দেখছিলেন সেটা একটা কবিতার বইয়ের একটি পৃষ্ঠার জেরক্স কপি। সেই পৃষ্ঠায় মাইকেলের বিখ্যাত কবিতা ‘আত্মবিলাপ’-এর পুরোটা এবং ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার প্রায় অর্ধেকটা রয়েছে। আর পৃষ্ঠার মাথায় হেডিং দেওয়া আছে ‘গীতিকবিতা’।

কিন্তু অশোকচন্দ্রের চমকে ওঠার কারণ অন্য। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতার দুটি লাইন লাল কালি দিয়ে কেউ আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। এবং সেই লাইন দুটি হল ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে।’

‘এর অর্থ কী বলতে পারেন?’ এসিজি কপালে ভাঁজ ফেলে রমেশ শর্মাকে জিগ্যেস করলেন।

এমনভাবে হাসল রমেশ যেন এসিজির বোকামিতে বেশ মজা পেয়েছে। তারপর বলল, ‘মিস্টার গুপ্ত, বেঙ্গলি আমার মাদার টাং নয়—আমি কী করে এই কবিতার মানে বুঝব!’

এসিজি মিথ্যের বাণ ছুড়লেন। বেশ সিরিয়াস মুখ করে বললেন, ‘মিস চ্যাটার্জি বলছিলেন যে, আপনি একটু-আধটু বাংলা পড়তে পারেন…।’

চোখ পিটপিট করল রমেশ। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতা ইংরেজিতে ট্রানস্লেট করার চেষ্টা অবশ্যই অডাসিটি। তবে তদন্তের স্বার্থে একটা খোঁড়া তর্জমা আপনাকে করে শোনাচ্ছি : ”ইফ য়ু আর বর্ন, য়ু আর টু ডাই/ ইমমরটালিটি ইজ অ্যান ইটারনাল লাই। তো এই লাইনদুটোর তলায় লাল কালি দিয়ে কেন দাগ দেওয়া হয়েছে বলতে পারেন? এই দাগের মানেটাই আমি জানতে চাইছিলাম।”

‘হতে পারে, এটা হয়তো খুনের হুমকি। মিস্টার চ্যাটার্জিকে কেউ ভয় দেখাচ্ছিল।’

‘একজ্যাক্টলি! কিন্তু কে ওঁকে ভয় দেখাতে চেয়েছিল?’

‘আপনি কি ভাবছেন আমি?’ রুক্ষভাবে পালটা প্রশ্ন করল রমেশ।

‘হতে পারে।’ নির্বিকারভাবে বললেন বৃদ্ধ হুনুর, ‘আবার অন্য কেউও হতে পারে। ওঁর তো শত্রুর অভাব ছিল না!’

রমেশ বাঁকাচোখে এসিজির দিকে একবার তাকাল শুধু—কোনও মন্তব্য করল না।

‘কী করে এটা মদনমোহন চ্যাটার্জির ব্রিফকেসে গিয়ে পৌঁছল বলুন তো?’

‘কী করে আবার, কেউ রেখেছে।’ তাচ্ছিল্যের ঢঙে বলল রমেশ।

‘হ্যাঁ, ঠিকই—কিন্তু রাখার চান্সটা তো পেতে হবে!’

‘আপনি কি ইনডিরেক্টলি আমাকে অ্যাকিউজ করতে চাইছেন? ওহ ইয়েস, আই হেটেড হিম। কিন্তু সেজন্যে গলায় ফাঁসির দড়ি পরতে আমি রাজি নয়। মিস্টার চ্যাটার্জি শকুনের মতো ঠোকরাতেন বটে, কিন্তু সোনার ডিমও পাড়তেন। এরকম একজনকে সরানোর চেষ্টা করে আমার কী লাভ!’

‘হুঁ…ঠিকই বলেছেন।’ বিড়বিড় করে বললেন বৃদ্ধ। তিনি মনে-মনে ভাবছিলেন, লাল দাগ দেওয়া এই কবিতার পাতাটা চারজনের যে-কেউ মদনমোহন চ্যাটার্জির ব্রিফকেসে রাখতে পারে।

কাগজপত্র ঘাঁটতে-ঘাঁটতে আরও একটা জিনিস পাওয়া গেল।

একটা সুন্দর রাইটিং প্যাড। তার একটা পৃষ্ঠায় বড়-বড় হরফে লেখা, ইমডিয়েট ডিসমিসাল। তার নীচে ছ’জনের নাম—নাম ঠিক নয়, নামের আদ্যক্ষর। আর পৃষ্ঠার নীচের দিকে আগামীকালের তারিখ দেওয়া।

রমেশ বেশ অস্বস্তি নিয়ে এসিজির কাজকর্ম লক্ষ করছিল। এসিজি হঠাৎই ওর দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘এই হাতের লেখাটা কার? মিস্টার চ্যাটার্জির?’

‘হ্যাঁ, আপনাকে বলছিলাম না, উনি ছ-জনকে ছাঁটাই করার ডিসিশান নিয়েছিলেন। এই লিস্টটায় যেসব নাম আছে সেগুলো কিছুদিন আগেই মিস্টার চ্যাটার্জি আমাকে বলেছিলেন।’

নামের আদ্যাক্ষরগুলোর ওপরে বারবার চোখ বোলাচ্ছিলেন এসিজি। একটি নাম ছাড়া আর কোনওটাই চেনা হল না। নামটার নীচে তিনবার দাগ দেওয়া এবং পাশে লেখা : ‘কালসাপ। নো পে অফ।’

সেই নামটায় আঙুল দিয়ে এসিজি রমেশকে জিগ্যেস করলেন, ‘এই বি. ডি. মানে কি ব্রজেন দাস। নাকি একই ইনিশিয়ালের অন্য কোনও স্টাফ আছে?’

রমেশ শর্মার মাথা ঝুঁকে পড়ল, হতাশায় মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিকই ধরেছেন…ব্রজেন দাস। এই ইনিশিয়ালের আর কোনও স্টাফ নেই। খুব স্যাড ডিসিশান।’

‘ব্রজেন এই ডিসিশানের কথা জানত?’

‘না বোধহয়। ভুলে যাবেন না, মিস্টার গুপ্ত, আমি ছিলাম স্যারের পারসোনাল সেক্রেটারি—তাই অনেক কিছু আমি একাই জানতাম…এমনকী শ্রাবণী, মানে, মিস চ্যাটার্জিও সেগুলো জানতেন না।’

‘ব্রজেন দাস জানলে পরে ওর হুমকি দেওয়ার এবং খুন করার একটা পজিটিভ মোটিভ তৈরি হতে পারে…।’

‘হাউ ডু আই নো?’ কাঁধ ঝাঁকাল রমেশ : ‘য়ু আর দ্য স্লুথ।’

‘আচ্ছা, ওর নামের পাশে কালসাপ কথাটা লেখা কেন?’

রমেশ শর্মা নখ খুটতে শুরু করল। বলবে-কি-বলবে না ভেবে কয়েকবার মাথা ওঠাল-নামাল। তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘চেপে রেখে লাভ নেই…আপনি পরে তো জানতেই পারবেন। ব্রজেন দাস স্যারের বিশ্বাসী লোক হয়ে ওঠার পর থেকে রেগুলার টাকা চুরি করত। এইভাবে ও কয়েকলক্ষ টাকা সরানোর পর স্যার ব্যাপারটা ধরতে পারেন। সপ্তাহদুয়েক আগে আমাকে বলেছিলেন। এটা আর কেউ জানে না। মিস চ্যাটার্জিও না।

অশোকচন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়ল, চোখ ছোট হয়ে গেল চিন্তায়। ওঁর চশমার কাচে আলো চকচক করছিল। রহস্যের জায়গাগুলো কি ধীরে-ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে?

একসময় ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে পরদার আড়াল সরিয়ে টয়লেট স্পেসের দিক থেকে বেরিয়ে এলেন। কিছু একটা দেখাবেন বলে ইশারায় এসিজিকে ডাকলেন।

এসিজি ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন করতেই ডক্টর দে তৃপ্তির সুরে বললেন, ‘বোধহয় খুনের কায়দাটা আমি বুঝতে পেরেছি, ডক্টর গুপ্ত। বলব, কী করে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে টয়লেটের ভেতরে মার্ডার করা হয়েছে?’

হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। উঠে দাঁড়িয়ে দু-পা সামনে এগিয়ে গেলেন। তারপর একটা হাত শূন্যে তুলে ডক্টর দে-কে বাধা দিলেন, ‘না, আমি বলছি। ভুল হলে শুধরে দেবেন, ও. কে.? অ্যাজামার অ্যাটাক হতেই মিস্টার চ্যাটার্জি ইনহেলার নিয়ে ওই টয়লেটে গিয়ে ঢুকেছিলেন। ইনহেলারের মাউথপিস কভার খুলে ক্যানিস্টারের স্প্রে বেরোনোর দিকটা মুখে ঢুকিয়ে অভ্যাসমতো পেছনদিকটায় চাপ দিয়েছিলেন…এবং সঙ্গে-সঙ্গে গুড়ুম…!’ মুখে পিস্তল ছোড়ার শব্দ করতে চাইলেন এসিজি : ‘ব্যস, সব শেষ।’

হেসে কাঁধ ঝাঁকালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।

আবিষ্কারের কৃতিত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ভবানীপ্রসাদকে বেশ হতাশ দেখাল। অবাক হয়ে তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘কী করে বুঝলেন বলুন তো?’ তারপর এসিজির পাশ দিয়ে রমেশ শর্মার দিকে সন্দেহের চোখে একবার তাকালেন।

রমেশ মাথা নিচু করে আঙুল খুঁটছিল, উসখুস করছিল, আর মাঝে-মাঝেই ডক্টর দে-র দিকে তাকাচ্ছিল।

ভবানীপ্রসাদ এসিজির চোখে চোখ রেখে রমেশের দিকে ইশারা করে বললেন, ‘মার্ডারার কি কনফেস করেছে? সব বলে দিয়েছে আপনাকে?’

হেসে ফেললেন এসিজি, মাথা নেড়ে বলনে, ‘ধুস, কী যেন বলেন!’ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর : ‘যাগগে, এবার বলুন দেখি, আমি ঠিক বলেছি কি না…।’

তারিফ করে মাথা নাড়লেন ভবানীপ্রসাদ : ‘ঠিক বলেছেন, তবে কনফার্ম করতে গেলে ল্যাবরেটরির হেলপ দরকার। এতক্ষণ ধরে তন্নতন্ন করে খুঁজে আমি ডেডবডির মুখের গর্তে বেশ কয়েক জায়গায় অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকের পার্টিকল পেয়েছি। মনে হচ্ছে, ইনহেলারের পুশটায়…মানে, ক্যানিস্টারের পেছনটায়…চাপ দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে একটা এক্সপ্লোশান হয় এবং একটা ছোট্ট স্টিলের বুলেট এত জোরে টাকরার দিকে ছুটে যায় যে, ওটা টাকরা ফুটো করে সোজা ব্রেনে গিয়ে লাগে। আপনি গোড়াতেই যা আন্দাজ করেছিলেন—মিস্টার চ্যাটার্জি ওয়াজ কিলড ইনস্ট্যান্টলি। আর বুলেটটাকে কী কায়দায় ট্রিগার করা হয়েছে সেটা বলা একটু মুশকিল—কারণ, সেই মেকানিজমটা ওই হাই ইমপ্যাক্টে বলতে গেলে ধুলো হয়ে গেছে। সেইজন্যেই ডেডবডির শুধু মুখে আর গালে কয়েকটা ছোট-ছোট টুকরো গেঁথে ছিল…আর সেরকম কোনও এভিডেন্স পাওয়া যায়নি। তবে টয়লেট কিউবিকলে অ্যালুমিনিয়াম আর প্লাস্টিকের কিছু টুকরো পাওয়া গেছে। ওঃ, এককথায় ডায়াবলিক্যাল! নৃশংস!’

রমেশ শর্মা হাঁ করে ভবানীপ্রসাদ দে-র কথা শুনছিল। ওর চোখজোড়া যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

রঙ্গলাল গোস্বামীও নিপাট কৌতূহলে দুই ডক্টরের কথাবার্তা প্রায় গিলে খাচ্ছিলেন।

এসিজি মাথার পিছনে হাত নিয়ে চুলের গোছায় বারকয়েক টান মারলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মদনমোহন চ্যাটার্জির ইনহেলার ব্যবহারের অভ্যেসের কথা খুনি অবশ্যই জানত। এও জানত, তিনি সকলের চোখের আড়ালে গিয়ে ইনহেলার ইউজ করেন। প্লেনে আড়াল বলতে এই টয়লেট। সুতরাং, খুনিকে যা করতে হয়েছিল সেটা হল মিস্টার চ্যাটার্জির ইনহেলারটাকে কোনও একফাঁকে বদলে দেওয়া—আসল ইনহেলারের বদলে ইনহেলার-বন্দুক। ব্যস, তারপর শুধু অপেক্ষা…।’

‘ঘটনাটা ঘটে যেতেই আমরা ভাবলাম, বন্ধ টয়লেটের ভেতরে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে কেউ গুলি করেছে। লকড রুম প্রবলেম—যার সমাধান মোটেই সহজ নয়। কিন্তু এখন ”হাউ” বোঝার পর ”হোয়াই” আর ”হু” টাও বোঝা যাচ্ছে।’

রঙ্গলাল উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘শাবাস, এসিজি স্যার, শাবাশ! স্বভাব-কবিতায় বলতে ইচ্ছে করছে : হাউ হোয়াই হু/ হু ক্যান ডু/ এরকম খুন/ মুখ সবার চুন/ জানে শুধু এসিজি/ খুনির সব ঠিকুজি! মিস্টার চ্যাটার্জিকে কে খুন করেছে, এসিজি স্যার?’

রমেশ শর্মা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর মুখ-চোখ লাল, হাত অল্প-অল্প কাঁপছে।

এসিজিকে লক্ষ করে রমেশ বলল, ‘ডক্টর গুপ্ত, আমি বোধহয় মার্ডারারকে চিনতে পেরেছি…।’

‘প্লিজ, মিস্টার শর্মা—এ-বিষয়ে একটি কথাও নয়।’ প্রায় আদেশের সুরে বললেন অশোকচন্দ্র, ‘আপনি সিটে ফিরে যান। আমি এখন শাওনি রাঘবনের সঙ্গে কথা বলব। দরকার হলে আপনাকে আবার ডাকব।’

রমেশ শর্মা যেন গালে একটা থাপ্পড় খেল। ওর মুখে লালচে ছোপ দেখা দিল। দু-একবার ইতস্তত করে ও হাঁটা দিল।

এসিজি রঙ্গলালবাবুকে বললেন, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর একটু পরে দিচ্ছি। সবদিক বিচার না করে হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়। আপনি, প্লিজ, একটু শাওনি রাঘবনকে খবর দিন…।’

শাওনি রাঘবনের বয়েস বাইশ কি তেইশ। মাজা রং। মেয়েদের তুলনায় বেশ লম্বা। চোখে রিমলেস চশমা। চিবুকে বিউটি স্পট। সরু-সরু আঙুলে দীর্ঘ নখ—তাতে চকোলেট রঙের নেলপলিশ। ঠোঁটে একই রঙের লিপস্টিক। গায়ে কালো চুড়িদারের ওপরে গোলাপি কার্ডিগান। কানে চকচকে দুল। কপালে টিপ। চোখের দৃষ্টি গভীর—মনে হয় যেন অতলান্তিক।

এসিজির মনে হল, অসংখ্য চৌম্বক বলরেখা শাওনিকে ঘিরে রেখেছে। তার আওতায় এসে পড়লে একটা চোরাটান টের পাওয়া যাবে।

মিস্টার চ্যাটার্জির খবরটা শোনার পর শাওনি তেমন একটা মুষড়ে পড়ল না। শুধু বলল, ‘হোয়াট আ ফেটফুল এন্ড। হি সার্টেইনলি ডিডন্ট ডিজার্ভ ইট।’

‘মিস্টার চ্যাটার্জি’ আপনাকে পছন্দ করতেন শুনলাম—।’ এসিজি বললেন।

‘ঠিকই শুনেছেন,’ বেপরোয়া ভঙ্গিতে জবাব দিল শাওনি, ‘কিন্তু সেটা মিস চ্যাটার্জি পছন্দ করতেন না।’

‘কেন বলুন তো?’

‘উনি খুব স্ট্যাটাস কনশাস। ওঁর কথাবার্তায় চালচলনে বড়লোকের দুর্গন্ধ বেরোয়। সেইজন্যেই গরিবদের অপছন্দ করাটা ওঁর অভ্যোসে দাঁড়িয়ে গেছে।’

‘রমেশ শর্মা বা ব্রজেন দাসের বেলাতেও তাই?’

‘ব্রজেন দাসের বেলা ওঁর অ্যাটিটিউডটা সেরকম বোঝা যেত না। তবে রমেশ শর্মার বেলায় বোঝা যেত। আর জানবেন, মেয়েরা সহজে মেয়েদের চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। আমরা চোখের নজর রিড করতে পারি। বাট রমেশ ইজ আ ভেরি নাইস চ্যাপ।’

এসিজি ইমোশন্যাল পোটেনশিয়ালের সমীকরণগুলো বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। কী বলতে চাইছে শাওনি?

‘মিস্টার চ্যাটার্জি আপনাকে ঠিক কী চোখে দেখতেন? ফাদারলি অ্যাফেকশান? না কি…।’

ঠোঁট বেঁকিয়ে খিলখিল করে হাসল শাওনি। জলতরঙ্গের বাজনা বেজে উঠল যেন।

‘আমার কাছে কি অ্যাফেকশানের কোয়ালিটি বা কোয়ান্টিটি মাপার যন্ত্র আছে নাকি যে, মেপে দেখব ওটা ফাদারলি, ব্রাদারলি…নাকি লাভারলি!’ আবার খিলখিল করে হাসি। তারপর : ‘সোজা কথা হল, মিস্টার চ্যাটার্জি ওয়াজ আ নাইস গাই। আই লাইকড হিম আ লট। আই উইল মিস হিম।’

‘ওঁর হাঁপানি রোগ—মানে, অ্যাজমা ছিল জানতেন?’

‘না—।’

‘মিস্টার চ্যাটার্জিকে কে মার্ডার করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?’

‘দ্যাট ভেনমাস লেডি, আর কে! উনি এখন কত কোটি টাকার মালিক হলেন আপনার কোনও ধারণা আছে!’

‘মালিক হিসেবে মিস্টার চ্যাটার্জি কেমন ছিলেন?’

‘গুড—কোয়াইট গুড। খুব সফট হার্টেড ছিলেন। ছোটবোনকে খুব ভালোবাসতেন—মানে, ব্রাদারলি…।’ আবার হাসিতে ভেঙে পড়ল শাওনি, ‘লাস্ট উইকে আমাকে বলেছিলেন যে, একটা দারুণ নিউজ দেবেন। দারুণ আনন্দের খবর।’

কৌতূহলী হয়ে উঠলেন এসিজি : ‘খবরটা কি পেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী খবর?’

‘শ্রাবণী চ্যাটার্জির বিয়ে—রমেশ শর্মার সঙ্গে। রমেশ খুব লাকি। ইট ওয়াজ গুড নিউজ ফর মিস চ্যাটার্জি, বাট আই থিংক ব্যাড নিউজ ফর রমেশ।’

এসিজির মুখে সামান্য অবাকভাব দেখে শাওনি বলল, ‘কেন, ওরা আপনাকে বলেনি? শুনলাম তো আপনি ওদের সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলেছেন…।’

‘আচ্ছা, মিস রাঘবন, আপনি ব্যাড নিউজ ফর রমেশ বললেন কেন?’

হাসল শাওনি : ‘বিয়েটা টিকবে বলে মনে হয় না—সেইজন্যে।’

এসিজি আনমনা হয়ে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলেন। শাওনি ‘ডক্টর গুপ্ত’ বলে তিনবার ডাকার পর ওঁর হুঁশ ফিরল।

‘থ্যাংক য়ু সো মাচ, মিস রাঘবন। আই অ্যাম গ্রেটফুল টু য়ু।’

‘কেন জানতে পারি?’ চোখের কোণ দিয়ে তাকাল শাওনি।

‘এখুনি জানতে পারবেন—একটু অপেক্ষা করুন।’

এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। গল্পটা কি ঠিক-ঠিক খাড়া করা যাচ্ছে? ক্যাপ্টেনকে কি খবর দেওয়া যায় এখন?

ভবানীপ্রসাদ একটা সিটে চোখ বুজে শরীর এলিয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁকে ডেকে বললেন, ‘ডক্টর দে, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?’

ভবানীপ্রসাদ চোখ মেলে তাকালেন।

‘উঠে পড়ুন—আমরা লাস্ট চ্যাপ্টারে পৌঁছে গেছি। আমি ক্যাপ্টেনকে ডেকে পাঠাচ্ছি আর মিস্টার চ্যাটার্জির বাকি সঙ্গী-সাথীদেরও ডাকছি। আর-একটু পরেই আমরা ভাইজাগে নেমে পড়ব।’

এসিজির কথা শুনে ভবানীপ্রসাদের ঘুম চটকে গেল। সাততাড়াতাড়ি মুখ-টুখ মুছে সোজা হয়ে বসলেন। লজ্জা পেয়ে বললেন, ‘সরি, ভীষণ টায়ার্ড লাগছিল…।’

রঙ্গলাল গোস্বামীকে দিয়ে খবর পাঠাতেই ক্যাপ্টেন সুখানি মিনিট-পাঁচেকের মধ্যে চলে এলেন।

এসিজির কাছে গিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, ডক্টর গুপ্ত, আর য়ু থ্রু?’

‘ইয়েস, ক্যাপ্টেন। আই থিংক দ্য গেম ইজ ওভার। আপনি কাউন্ডলি মিস্টার চ্যাটার্জির বাকি তিনজন কম্প্যানিয়ানকে ডেকে পাঠান। সকলের সামনেই তাস খুলে দেখাতে চাই আমি।’

বৃদ্ধ মুচকি-মুচকি হাসছিলেন—অনেকটা দুষ্টুমির হাসি। ক্যাপ্টেন চলে গেলেন টয়লেট স্পেসের দিকে। পরদা সরিয়ে ঢুকে গেলেন ভেতরে। আর-একটা পরদা সরালেই ওপাশে ইকনমি ক্লাস—সেখানে সাবরিনাকে দেখতে পেলেন। ওকে ডেকে নিচু গলায় এসিজির নির্দেশটা জানিয়ে দিলেন।

ক্যাপ্টেন এসিজির কাছে ফিরে আসার মিনিটখানেকের মধ্যেই মদনমোহন চ্যাটার্জির বাকি তিনসঙ্গী এসে হাজির হল : ব্রজেন দাস, রমেশ শর্মা এবং শ্রাবণী চ্যাটার্জি।

এসিজি লক্ষ করলেন, শ্রাবণী ধারালো দৃষ্টিতে শাওনিকে একঝলক দেখলেন। রমেশও একবার তাকাল শাওনির দিকে। আর ব্রজেন দাস নির্বিকার।

এসিজির অনুরোধে সবাই বসে পড়ল। ক্যাপ্টেন সুখানি বসলেন এসিজির পাশের সিটটায়।

মাথার পিছনের সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে উঠে দাঁড়ালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, বললেন, ‘এটা গোয়েন্দাকাহিনির খুব বিখ্যাত শেষ দৃশ্য। আমার রিকোয়েস্ট, আপনারা প্রত্যেকে মনোযোগ দিয়ে গল্পটা শুনবেন। যদি কোথাও আমার ভুল হয়, তা হলে দয়া করে ভুল ধরিয়ে দেবেন।’

উঠে দাঁড়ানোর ফলে এসিজি সবাইকে কম-বেশি দেখতে পাচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল, ওরা এক-একটি রংবেরঙের পাখি। তার মধ্যে আসল পাখিটাকে খুঁজে বের করতে হবে। দুষ্টু পাখি।

এসিজি বলতে শুরু করলেন, ‘মিস্টার মদনমোহন চ্যাটার্জিকে আপনারা সকলেই মোটামুটি জানতেন। দাম্ভিক একরোখা ক্ষুরধার বুদ্ধির বিজনেসম্যান। কাউকে কোম্পানি থেকে ছাঁটাই করতে হলে তিনি হাটে হাঁড়ি ভেঙে তারপর তাকে বরখাস্ত করতেন। আগামীকাল তিনি ছ-জনকে ছাঁটাইয়ের চিঠি ধরাবেন ঠিক করেছিলেন। এই কাগজটায় সেই ছ-জনের নাম লেখা আছে…।’

ঝুঁকে পড়ে মিস্টার চ্যাটার্জির ব্রিফকেস থেকে নামের লিস্টটা তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। সেইসঙ্গে মাইকেলের কবিতার জেরক্স করা পৃষ্ঠাটাও। তারপর : ‘…ছ-জনেরই নামের তলায় তিনবার দাগ দেওয়া এবং পাশে লেখা : ”কালসাপ। নো পে অফ।” আমার মনে হয়…।’

ব্রজেন দাস কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়াল, বলল, ‘বিনা কারণে স্যার আমাকে বরখাস্ত করছিলেন। স্যারকে আমি হাতে-পায়ে ধরে অনেক রিকোয়েস্ট করেছি, কিন্তু উনি শুনতে চাননি। বলেছি, ঘরে আমার সাতবছর আর দু-বছরের দুটো বাচ্চা রয়েছে—কিন্তু স্যারকে কিছুতেই টলাতে পারিনি—।’

‘সেইজন্যেই তুমি দাদাকে মার্ডার করলে!’ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন শ্রাবণী চ্যাটার্জি, ‘ছোটলোকের এতবড় সাহস!’

‘প্লিজ ম্যাডাম—’ শ্রাবণীকে হাত তুলে ইশারা করলেন এসিজি : ‘দয়া করে একটু শান্ত হোন—আমার গল্প এখনও শেষ হয়নি।’ এসিজি ব্রজেনের দিকে ফিরলেন : ‘ব্রজেনবাবু, এই কাগজটা একবার দেখুন তো! চিনতে পারেন?’

মাইকেলের কবিতার পাতাটা ব্রজেন দাসের মুখের সামনে ধরলেন অশোকচন্দ্র। ব্রজেন দাসের মুখের রং ফ্যাকাসে হয়ে গেল পলকে।

‘ ”বঙ্গভূমির প্রতি” কবিতাটার দুটো লাইনের তলায় লাল কালিতে দাগ দিয়েছেন আপনি : ”জন্মিলে মরিতে হবে,/ অমর কে কোথায় কাবে”। এইভাবে মদনমোহন চ্যাটার্জিকে খুনের হুমকি দিয়েছেন আপনি। ক্ষুরধার বুদ্ধির মালিক মদনমোহনবাবু কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, এটা আপনারই কীর্তি—তাই আপনার বরখাস্তের সিদ্ধান্তটা আরও পাকা করেছিলেন। সেটাই আপনি মেনে নিতে পারেননি। আক্ষেপের ব্যাপারটা কী জানেন? আপনি ”জন্মভূমির প্রতি” কবিতা পড়েছেন বটে, কিন্তু ওই একই পৃষ্ঠায় ছিল আর-একটি কবিতা—”আত্ম-বিলাপ”—সেটা আপনি পড়েননি।’ এসিজি আবৃত্তির ঢঙে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়…।’

ভবানীপ্রসাদ জিগ্যেস করলেন, ‘কিন্তু মিস্টার দাসকে স্যাক করার ডিসিশান নেওয়া হয়েছিল কেন?’

একবার রমেশ শর্মার দিকে তাকালেন এসিজি, তারপর বললেন, ‘মিস্টার চ্যাটার্জির বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ব্রজেনবাবু নিয়মিতভাবে টাকা সরাতেন। এভাবে কয়েকলক্ষ টাকা তিনি চুরি করেছিলেন…।’

‘মি-মিথ্যে কথা!’ চেঁচিয়ে উঠল ব্রজেন দাস।

দূরে বসা প্যাসেঞ্জাররা বিরক্ত এবং কৌতূহলী চোখে এসিজিদের দিকে তাকালেন।

ক্যাপ্টেন সুখানি ব্রজেন দাসকে বসতে বললেন। তারপর চাপা গলায় যোগ করলেন, ‘প্লিজ কন্ট্রোল ইয়োর টেম্পার। কথাবার্তা আস্তে আস্তে বলুন, নইলে অন্য প্যাসেঞ্জাররা ইরিটেটেড হবে।’

এসিজি হেসে বললেন, ‘চিন্তা করার কোনও কারণ নেই, দাসবাবু, আমার কথা সত্যি কি মিথ্যে সেটা পুলিশ তদন্ত করলেই প্রমাণ হয়ে যাবে। যখন আপনি দেখলেন, বাঁচার আর কোনও পথ নেই তখন মিস্টার চ্যাটার্জির মরার পথ বেছে নিলেন। আপনাকে উনি ভীষণ বিশ্বাস করতেন। আপনার কথায়, একবার ”ব্রজ” বলে হাঁক দিলেই হল—আপনি সটান গিয়ে হুকুম তামিল করতে হাজির হতেন। আপনি জানতেন, মিস্টার চ্যাটার্জির অ্যাজমার প্রবলেম—উনি ইনহেলার ব্যবহার করেন। এও জানতেন, উনি সবার সামনে ইনহেলার ব্যবহার করেন না—করেন আড়ালে। প্লেনে সেই আড়াল বলতে একমাত্র টয়লেট। সুতরাং, আপনার প্ল্যান তৈরি হল। এবার দরকার মারণাস্ত্র—মার্ডার ওয়েপন।’ একটু থামলেন এসিজি। তারপর বললেন, ‘ব্রজেনবাবু, কর্ডলেস ফোন যে সারাতে পারে, টেপ-ডেক সারাতে পারে, এফ. এম. ট্রানজিস্টার তৈরি করতে পারে, সে একটা ইনহেলারকে অবশ্যই মারণাস্ত্রে বদলে দিতে পারবে। আপনি সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট, টেকনিক্যাল কাজ জানেন, আপনি কেন লোকের বাড়ি চাকরের কাজ করবেন! করবেন এই কারণে যেহেতু আপনি—আপনারই কথায়—ভাগ্য ফেরাতে চান। সত্যিই তো! নিয়মিতভাবে হাজার-হাজার টাকা চুরি করে আপনি তো ভাগ্যই ফেরাচ্ছিলেন!’

ব্রজেন দাস বসে পড়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। এবার ওর মাথা ঝুঁকে পড়ল। ফোঁপানির আওয়াজ শোনা গেল মুখ থেকে। তারই মাঝে ও কীসব কথা বলছিল, কিন্তু কান্নাজড়ানো কথার একটি বর্ণও বোঝা গেল না।

শ্রাবণী চ্যাটার্জি জিগ্যেস করলেন, ‘ইনহেলারটাকে ওই শয়তানটা মার্ডার ওয়েপনে কনভার্ট করলে কী করে?’

‘কাজটা কঠিন—তবে ব্রজেন দাসের মতো টেকনিশিয়ানের কাছে অবশ্যই ততটা কঠিন নয়। ইনহেলারের যে-জায়গা দিয়ে ওষুধের স্প্রেটা বেরোয় ঠিক সেই জায়গা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে একটা স্টিলের বুলেট। মিস্টার চ্যটার্জির বডি পোস্টমর্টেম করার সময় নিশ্চয়ই ওটা খুঁজে পাওয়া যাবে। তো ওই বুলেটটাকে নিশ্চয়ই ছিটকে দিয়েছে কোনও জোরালো স্প্রিং অথবা বারুদ। আমার খুব বিশ্বাস, ব্রজেন দাসের আস্তানা সার্চ করলে বেশ কয়েকটা খালি ইনহেলার পাওয়া যাবে—চাই কি মার্ডার ওয়েপনের একটা ডুপ্লিকেট মডেলও পাওয়া যেতে পারে। কারণ, বারকয়েক টেস্ট না করে ব্রজেন দাস এ-ঝুঁকি কিছুতেই নেবেন না—কী, ঠিক বলেছি তো, দাসবাবু?’ ঠাট্টার সুরে এসিজি বললেন, ‘এই হল আমার মোটামুটি গল্প।’

এসিজি থামার পর অনেকেই অনেক প্রশ্ন করতে লাগল। জানতে চাইল, ঠিক কীভাবে খুনটা হয়েছে, এসিজি প্রথম কখন ব্রজেন দাসকে সন্দেহ করলেন—ইত্যাদি ইত্যাদি।

এসিজি এতটুকু বিরক্ত না হয়ে ধৈর্য ধরে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে চললেন।

ক্যাপ্টেন সুখানি উঠে দাঁড়িয়ে অশোকচন্দ্রের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন, বললেন, ‘থ্যাংকু য়ু, ডক্টর, ফর সলভিং অ্যান অ্যাপারেন্টলি ইমপসিবল ক্রাইম।’

আর সবাই ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু শ্রাবণী চ্যাটার্জি মাথা নিচু করে চোখ মুছছেন।

সকলের মুখের ওপরে চোখ বুলিয়ে এসিজি হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘একমিনিট। আপনারা কেউ যাবেন না। আমার গল্প এখনও একটু বাকি আছে।’

সবাই অবাক হয়ে তাকাল বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে।

শাওনি বলল, ‘তার মানে!’

হাসলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত : ‘তার মানে আসল খুনির নাম আমি এখনও বলিনি।’

পলকে সবাই চুপ করে গেল। কয়েক সেকেন্ড। তারপরই শুরু হল গুঞ্জন।

‘আসল খুনি?’ শ্রাবণী কান্না ভুলে মুখ তুলে তাকালেন।

‘বলেন কী, এসিজি স্যার!’ রঙ্গলাল গোস্বামী।

‘ইজ দিস আ জোক?’ ক্যাপ্টেন অর্জন সুখানি।

‘আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, ডক্টর গুপ্ত।’ ডক্টর ভবানীপ্রসাদ দে।

এসিজি বললেন, ‘একটা কথা আপনারা কেউই আমার কাছে জানতে চাননি।’ একটু থামলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর ‘ব্রজেন দাস কী করে জানলেন যে, ওঁকে ছাঁটাই করা হবে? মিস্টার চ্যাটার্জি যে-ধরনের মানুষ ছিলেন তাতে এ-কথা ব্রজেনবাবুকে তিনি কিছুতেই আগে জানাতেন না। আমার ধারণা…।’

ব্রজেন দাস চোখ তুলে তাকিয়ে ছিল এসিজির দিকে।

এসিজি ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনাকে ছাঁটাইয়ের খবরটা কে দিয়েছিল? রমেশ শর্মা?’

ব্রজেন দাস সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।

হাসলেন এসিজি, বললেন, ‘অবস্থাটা আপনারা সবাই বুঝে দেখুন। ব্রজেনবাবুর চাকরি গেলে উনি যে খেপে যাবেন এটা স্বাভাবিক। তারপর মিস্টার চ্যাটার্জি ও ব্রজেন দাসের মাঝখানে থেকে ঠিকমতো একটু খেলতে পারলে ব্রজেন দাসকে দিয়ে খুনটা করানো সম্ভব। ব্রজেন দাসের খুনের অস্ত্র ছিল স্পেশাল ইনহেলার, আর রমেশ শর্মার নিখুঁত খুনের অস্ত্র ছিল ব্রজেন দাস। কিন্তু তারপর?

‘তারপর তো পথ পরিষ্কার! মিস্টার চ্যাটার্জি মারা গেলে শ্রাবণী চ্যাটার্জি সবকিছুর মালিক হচ্ছেন। সুতরাং, শ্রাবণীদেবীর সঙ্গে যদি রমেশ শর্মার বিয়ে হয়—এই খবরটা শাওনি আমাকে দিয়েছেন, আর শাওনিকে খবরটা দিয়েছিলেন মদনমোহন চ্যাটার্জি নিজে—হ্যাঁ, যা বলছিলাম…বিয়েটা হয়ে গেলে রমেশ শর্মা সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক। যদি কোনও কারণে বিয়ে পরে ভেঙেও যায়, তা হলেও সম্পত্তির অনেকটা বাগিয়ে নেওয়া যাবে। তা ছাড়া…।’

‘য়ু ওল্ড ফুল! আপনমনে কীসব বকে চলেছেন? ক্যাপ্টেন সুখানির নির্দেশ ভুলে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রমেশ শর্মা, ‘কোনও প্রমাণ আছে আপনার কাছে?’ শ্রাবণীর দিকে ফিরে ‘তুমি একটা কথাও বিশ্বাস কোরো না, শ্রাবণী। দিস ওল্ড বাগার ইজ লায়িং লাইক আ সিঙিং ক্যানারি। আই উইল—।’

এসিজি রমেশকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘এখানে আমার ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব হাজির থাকলে আপনার কপালে অনেক দুঃখ ছিল। এনি ওয়ে, প্রমাণের কোনও দরকার নেই। দোষ স্বীকার করার পর ব্রজেন দাস যদি পুলিশকে শুধু বলে যে, এর মধ্যে আপনিও ছিলেন, তা হলেই আপনি ফেঁসে যাবেন—জাল কেটে আর বেরোতে পারবেন না। আপনার কথাবার্তা খুবই ইনটেলিজেন্ট। কায়দা করে ব্রজেন দাসের ব্যাপারে আমাকে সূক্ষ্ম-সূক্ষ্ম সব সূত্র দিয়ে গেছেন। যাতে কখনওই মনে না হয় যে, আপনি ইচ্ছে করে ব্রজেন দাসকে ফাঁসাচ্ছেন, সেজন্যে দরকারমতো অভিনয়ও করে গেছেন। হ্যাটস অফ টু য়ু, মিস্টার শর্মা!’

শ্রাবণী উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, রমেশের দিকে আঙুল তুলে বললেন, ‘রমেশ, এসব কী শুনছি! তুমি…তুমি সত্যি এরকম! আমি…আমি…।’

ব্রজেন দাস হঠাৎ চেঁচিয়ে এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘স্যার! ডক্টর গুপ্ত! শর্মাজি আমাকে চাকরি খোয়ানোর খবর তো দিয়েছেন—এ ছাড়াও আমাকে সবসময় মিস্টার চ্যাটার্জির এগেইনস্টে ওসকাতেন। বলতেন, ”এই গোঁয়ার লোকটা আমাদের সবার সর্বনাশ করবে।” আমি, স্যার, ওঁকে ছাড়ব না!’

এসিজি শ্রাবণীকে বললেন, ‘ম্যাডাম, যদি মনে করেন, তা হলে এই বুড়ো লোকটার একটা পরামর্শ নিতে পারেন।’ নিজের মাথার চুলে হাত দিলেন এসিজি : ‘রমেশ শর্মাকে আপনি বিয়ে করবেন না। মিস্টার শর্মা খুব লোভী, অ্যামবিশাস এবং ধূর্ত বটে। উনি ঠিক মানুষ নন, মানুষের চেয়ে একটু কম…।’

এমনসময় কুমারমঙ্গলম এসে দাঁড়াল ক্যাপ্টেন সুখানির কাছে। নিচু গলায় বলল, স্যার, ভাইজাগ এসে গেছে—প্লেন এখন ল্যান্ড করবে।’

ক্যাপ্টেন সুখানি সকলের মুখের ওপরে একবার নজর বুলিয়ে বললেন, ‘আমরা আর কয়েকমিনিটের মধ্যেই ভাইজাগে ল্যান্ড করছি। পুলিশের কাছে এখনই রেডিয়ো মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। আপনারা যার-যার সিটে বসে সিট-বেল্ট বেঁধে নিন। প্লিজ, মেক ইট কুইক।’

সবাই যখন চলে যাচ্ছে তখন অর্জন সুখানি এসিজিকে আর-একবার ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, ‘ডক্টর গুপ্ত, আই থ্যাংক য়ু এগেইন অন বিহাফ অফ ”আকাশ এয়ারলাইনস”। আমি চেয়ারম্যান সাহেবকে রেডিয়ো মেসেজে সব জানাচ্ছি।’

ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর রঙ্গলাল গোস্বামী গুটিগুটি পায়ে এসিজির কাছে এসে দাঁড়ালেন, চাপা গলায় বললেন, ‘এসিজি স্যার, দেখা গেল আপনার প্রতিভার লাইটনিং/ আকাশপথে খুনির সঙ্গে আপনার ফাইটনিং।’

এসিজি ভুরু কুঁচকে তাকালেন কবিবরের দিকে : ‘লাইটনিং না হয় বুঝলাম, রঙ্গলালবাবু, কিন্তু ফাইটনিংটা কী কেস?’

হাত কচলে বিনয়ে মাথা নোয়ালেন রঙ্গলাল, বললেন, ‘ওটা কবিতার আবেগ—মানে, ভেলোসিটি, এসিজি স্যার। ফাইট শব্দটাকে নিপাতনে সিদ্ধ করে ফাইটনিং করে দিয়েছি। স্বভাব-কবিতার এটাই তো বিউটি, স্যার…।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *